#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (০৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম নাম)
পড়ন্ত বিকেল! নিভু নিভু করছে দিনের আলো। মাগরিবের আজান এখনই দিলো বলে। পিয়া টিউশন শেষ করে দ্রুত পায়ে বের হয়। রাস্তার কাছে এসেই ফোন লাগায় চিরপরিচিত নম্বরটায়।
‘কোথায় আপনি? আমার টিউশন শেষ।’
তানভীর অপরাধের স্বরে বলল, ‘ স্যরি! আসতে পারবো না। হঠাৎই একটা মিটিং ফিক্সড হয়ে গিয়েছে আমার।’
পিয়ার মুখটা মলিন হয়ে গেল মুহূর্তেই। ম্লান কন্ঠে বলল, ‘ওহ।’
পিয়ার বলা ‘ওহ’ শব্দটা যেন বুকে এসে বিঁধল তানভীরের। তপ্ত শ্বাস ফেলল সে।
‘কোম্পানির এখন নাজেহাল অবস্থা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কোম্পানির জন্য ডিলটা ভীষণ প্রয়োজন। এতো জরুরি না হলে আমার দায়িত্বটা অন্য কাউকে দিয়ে তোমার সঙ্গে ঠিকই দেখা করতাম।’
পিয়া মনমরা স্বরে বলে,
‘রাখি তবে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।’
পিয়ার এঁধো স্বর শুনে অপরাধবোধ আরো একটু বেড়ে গেল তানভীরের।
‘রাগ করে প্লিজ।’
মিছে হাসার চেষ্টা করল পিয়া। ‘রাগ করিনি।’
‘তবে অভিমান?’
চুপ হয়ে যায় পিয়া। তার আসলেই অভিমান হয়েছে। ভীষণ অভিমান। আসতে না পারলে কথা দিল কেন? ফোনের ওপাশের মানুষটা কি জানে না আজকাল তার সঙ্গ কতটা ভালো লাগে পিয়ার।
পিয়ার নীরবতা বলে দিচ্ছে অভিমানের গভীরতা। শব্দহীন হাসে তানভীর।
‘পরে যদি সুদে আসলে ভালোবাসা দিয়ে অভিমান ভাঙাই চলবে না?’
অভিমানী মুখে সহসাই লজ্জা লাল আভা প্রতীয়মান হয়। লাজুকলতার ন্যায় মুড়িয়ে গেল সে। আড়ষ্ট স্বরে বলল,
‘রাখছি।’
ফোন কানে রেখেই রিক্সাওয়ালার উদ্দেশ্য বলল,
‘এই মামা যাবেন?’
‘সাবধানে যেও। পৌঁছে একটা টেক্সট দিও আমাকে। না হয় চিন্তায় থাকবো আমি।’
____________________
কপালে হাত রেখে আধশোয়া হয়ে বসে আছে তানিয়া। পিয়া কাঁধের ব্যাগটা রেখে প্রশ্ন করল,
‘কিরে শরীর খারাপ? টিউশন যাসনি আজ?’
উত্তর না দিয়ে তানিয়া উল্টো প্রশ্ন করল,
‘রাতে বারান্দায় গিয়ে কার সঙ্গে ফুসুরফুসুর করিস তুই?’
ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখে একটু লাজুক হাসে পিয়া।
ভ্রু কুঁচকে খুব তীক্ষ্ণ চোখে সেই হাসি অবলোকন করে তানিয়া। এককালে এমন লাজুক হয়ে সেও হাসতো। কল্পনায় নিজের একটা সংসার সাজাতো। আজ বুঝতে পারছে সেই সংসারটা হয়তো শুধু কল্পনায় থাকবে বাস্তবে রূপ নিবে না। কল্পনার সংসারকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সম্পর্কে থাকা দু’জনেরই একাগ্র প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সে সিরিয়াস হলেও হয়তো অপর পক্ষের মানুষটা তাকে নিয়ে উদাসীন। এগুলো ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসার তার। বুকে খুব তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হয়।
চোখের ইশারায় পিয়াকে নিজের কাছে ডাকে তানিয়া। পিয়ার হাত মুঠোয় নিয়ে অনুরোধের স্বরে বলে,
‘আমি যেই ভুল করেছি সেই একই ভুল তুই করিস না। বেঁচে থেকেও জিন্দা লা’শ হয়ে যাবি। না পারবি ছাড়তে না পারবি ভুলতে। কল্পনায় সাজানো সংসারটা তোকে তিলে তিলে মা*র*বে। ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাবে।’
‘কার সঙ্গে কথা বলি জানতে চাস তুই?’
‘আমি জানতে চাই না কার সঙ্গে কথা বলিস। শুধু এইটুকু বলবো আমার মতো ভুল করিস না।’
হঠাৎ দরজার ঠকঠক শব্দে নিজেদের মধ্যকার আলাপচারিতা বন্ধ রাখে দুজন।
‘ভেতরে আসবো মা?’
রেহানা বেগমের আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে বসে দু’জন। হালকা হেসে বলল,
‘ভেতরে আসুন আন্টি।’
মাঝবয়েসী মহিলা রুমে এলেন। ঠোঁটের কোণে হাসি বিদ্যমান উনার।
‘অনেকদিন হয় তোমাদের সাথে ঠিকমতো কথা হয় না। তোমরাও পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকো আমিও কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সময়ই হয়ে উঠে না।’
পিয়া সরে গিয়ে রেহানা বেগমকে জায়গা করে দিল বসার জন্য।
দুজনেই একে একে বলে উঠল,
‘বসুন আন্টি।’
‘আসুন একটু জমিয়ে আড্ডা দেই। পড়াশোনা আর পরীক্ষা দিতে দিতে আমাদের মাথাও হ্যাং হয়ে গিয়েছে।’
ভদ্র মহিলা উৎসাহিত হয়ে বসে পড়লেন নিজের মেয়ের বয়সী দুজনের সঙ্গে গল্প করার জন্য। কথার ফাঁকে কেউ একজনকে ডেকে বললেন মুড়ি মাখা দেওয়ার জন্য। যেন আড্ডা আরো একটু জমে উঠে।
পিয়া এবং তানিয়া গল্পে গল্পে এতোটাই মগ্ন হয়ে গেলো যে নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে কথা হচ্ছিল সেটাই ভুলে গেল দু’জন।
_______________________
‘বাপি আমার শুধু তানভীর কে চাই। এনে দাও। নয়তো আমিও মায়ের মতো সারাজীবনের জন্য হারিয়ে যাবো।’
মেয়ের মাথাটা শক্ত করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরেন গোলাম মোস্তফা। প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারানোর পর একমাত্র মেয়েকে অবলম্বন করে বেঁচে আছেন তিনি। বুঝ হওয়ার পর থেকে যা চেয়েছে মুহুর্তেই চোখের সামনে হাজির করেছেন তিনি। মেয়ের চোখের পানি সহ্য হয় না বলে ফুলের টোকা দূরে থাক ধমক পর্যন্ত দেন নি। আর আজ কি না মেয়ে একটা ছেলের জন্য কান্না করছে। সহ্য হচ্ছে না উনার।
‘কাঁদে না মা। বাপি কথা দিয়েছি না তানভীরকে আমি তোমার করে দিবো। বিশ্বাস হয় না আমার কথা? প্রমিস তো মা।’
মানতে নারাজ টিনা।
‘বাপি তানভীর কেন বিয়ে করে নিলো? আমার খুব কষ্ট হয় বাপি। ও কি বুঝে না আমি কতটা ভালোবাসি ওকে?’
‘বিয়ে করেছে তো কি হয়েছে। ছেলেরা এমন দুই একটা বিয়ে করলে কিছু হয় না। বিয়ে যেমন করেছে আবার ছেড়েও দিবে শুধু সময়ের অপেক্ষা। পথের কাঁটা কিভাবে উপরাতে হয় আমার জানা আছে। আমি জামালের সঙ্গে কথা বলবো কিভাবে কি করা যায়।’
‘ওরা একসাথে থাকার আগেই তানভীরকে আমার করে দাও বাপি। আমি তোমার কাছে আর কিছুই চাই না।’
গোলাম মোস্তফা আশস্ত করলেন মেয়েকে। মেয়ে আজ পর্যন্ত যা চেয়ে তাই দিয়েছেন। এখন ভালোবেসে একজনকে চাইছে এ আর এমন কি। এনে দিবেন। বাই হুক অর বাই ক্রুক। মেয়ের আবদার পূরণে যদি কাউকে পৃথিবী থেকে সরাতে হয় পিছ পা হবেন না। তাই করবেন তিনি।
_____________________
‘বেয়াই সাহেবের ফোন ধরছো না কেন?’
চোখ বুঁজে কিছু একটা ভাবছিলেন জামাল এহতেশাম। স্ত্রীর কথা শুনে চোখ মেলে তাকান তিনি। পরক্ষণে আবারও চোখ বুঁজে রইলেন। গা-ছাড়া ভাব উনার। শুনেও যেন শুনেন নি।
‘উত্তর দিচ্ছো না কেন?’
জামাল এহতেশাম ভাবলেশহীন জবাব দিলেন।
‘আমার মোবাইল। আমি কার ফোন ধরবো আর কার ফোন ধরবো না সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছে।’
‘আমায় রাগিও না এহতেশাম। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।’
‘রাগার আর বাকি আছো কোথায়? আমি তোমায় সময় দেইনি সেই রাগেই তো এমন কাজ করলে।’ জামাল এহতেশাম আবারও গা-ছাড়া জবাব দিলেন।
‘আমায় কি শেষ বয়সে এসেও একটু শান্তি দিবে না তুমি?’
নড়েচড়ে বসলেন জামাল এহতেশাম। ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘তুমি তোমার জীবনে অসুখী?’
‘সুখ আসলে কোনটা সেটা জানলে তো হতোই৷ আমি সেসব নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি না। তুমি এখন আমার সামনে বেয়াই সাহেবকে ফোন দিবে।’
‘আমি পারবো না। এখন আমাকে ফোন দিতে আসে কেন? বিয়ের আগে তো দেয়নি।’
‘দিয়েছে কি দেয়নি সেটা আমি জানি আর তুমিও জানো। অযথা দোষারোপ করবে না। তুমি এখনই ভদ্রলোককে ফোন করবে।’
দাঁত কিড়মিড় করে চাইলেন জামাল এহতেশাম। ক্রোধিত স্বরে বললেন,
‘আমি তোমার কথা শুনতে বাধ্য নই মিনা।’
হাতের কাছে পানি পূর্ণ একটা গ্লাস দেখতেই ফেলে দিলেন তাহমিনা হক। কঠিন স্বরে বললেন,
‘এই বয়সে এসে আমি অবাধ্য হলে মেনে নিতে পারবে তো?’
আরো তেতে উঠেন জামাল এহতেশাম।
‘তুমি কিন্তু ইচ্ছে করে অশান্তি করছো। শুধু শুধু ঝামেলা পাকিয়ে কি মজা পাচ্ছো তুমি?’
দাঁতে দাঁত পিষেন তাহমিনা হক। চাপা স্বরে বলেন,
‘তুমি সেই সুযোগটা আমায় করে দিচ্ছো কেন? এক্ষুণি ফোন লাগাও নয়তো আমি আরো অশান্তি করবো।’
জামাল এহতেশাম বাধ্য হলেন ফোন করতে। চাপে পড়ে দুই মিনিট কথা বললেন বেলাল শেখের সঙ্গে। তারপর ব্যস্ততা দেখিয়ে রেখে দিলেন ফোন।
কথা শেষ হতেই বিশ্ব জয়ের হাসি হাসলেন তাহমিনা হক। এ যেন অসাধ্যকে সাধন করেছেন তিনি।
‘আগে কথা বললেই হতো। শুধু শুধু আমার এতো দামের গ্লাসটা ভাঙতে হতো না।’
কটমট চোখে তাকালেন জামাল এহতেশাম। চোখের দৃষ্টিতেই যেন ভস্ম করে দিবেন স্ত্রীকে।
‘নারীদের এতোটা জেদ মানায় না। নারীর জেদ ধ্বংস ডেকে আনে।’
‘আমি জেদ করিনি এহতেশাম। এটা জেদের বয়স না। জেদ করার হলে অল্প বয়সে ছেলে মেয়ে দুটো পৃথিবীতে আসার আগেই করতাম। আমি জেদ করলে তোমার সাথে সংসারটা আমার এতোদূর আসতো না।’ শীতল কণ্ঠে কথাগুলো বলে থামলেন তাহমিনা হক।
‘আমিও দেখবো তোমার ছেলে ওই মেয়ের সঙ্গে ঠিক কতদিন সংসার করে। আদৌ এই বাড়িতে এসে সংসার করতে পারে কিনা সেটাও দেখার বিষয়।’
জামাল এহতেশামের হুমকিতে দমে গেলেন না তাহমিনা হক। হুমকির আভাস পাওয়া গেল তার কথাতেও।
‘তা বেশ তো। একজন পাত্রী তো রেডি আছেই। এখন নিজের জন্যও একটা পাত্রী দেখা শুরু করে দাও। কারন বিয়ে যদি ভাঙে তবে একটা না দুটো বিয়ে ভাঙবে।’
আর কথা বাড়ালেন না জামাল এহতেশাম। তাহমিনা হক রুম থেকে যেতে পা বাড়ালেন। যাওয়ার আগে অনুদ্বেল কন্ঠে বললেন,
‘তোমার কাছে যেটা জেদ আমার কাছে সেটা সন্তানের সারাজীবনের সুখ।’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে।