#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (০৮)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
মুখোমুখি বসে আছে তানভীর এবং গোলাম মোস্তফা। তানভীরের পাশে বসা তার বাবা।
বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন মানুষের মাঝে বসে বড্ড অস্বস্তি অনুভব করছে সে। কিসের জন্য ডেকেছে বা কি নিয়ে কথা বলবে সবটা জানা থাকলেও এই প্রসঙ্গে কথা বললে কি উত্তর দিবে সেটা নিয়ে ইতস্তত করছে। ভীষণ অপ্রস্তুতও। আর বাবার সাথে কখনো বেয়াদবি করেনি সে। বা কারো সঙ্গে উচ্চবাক্যে কথা বলাও তার স্বভাবে নেই।
‘যে মেয়েকে বিয়ে করেছো তাকে ছেড়ে দাও।’ ভণিতা বিহীন স্পষ্ট ভাষায় বলেন গোলাম মোস্তফা।
কথাটা যেন বিষের মতো লাগল তানভীরের। অবাক চোখে জামাল এহতেশাম এক নজর দেখল সে। তিনি ভাবলেশহীন। নিজের বাবাকে এমন নিশ্চুপ দেখে মনঃক্ষুণ্ন হয় তার।
‘আপনি এসব কি বলছেন আঙ্কেল?’
‘তোমার আঙ্কেল ঠিকই বলেছেন।’ মুখ খুলেন জামাল এহতেশাম।
‘তাকে আমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিয়ে করেনি বাবা। সারাজীবন সংসার করবো বলেই কবুল বলে গ্রহণ করেছি। পবিত্রতা দিয়ে খুব শক্ত করে ধরেছি হাত। ইহজনমে আর ছাড়ছি না।’
তারপর গোলাম মোস্তফাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘মাফ করবেন আঙ্কেল আপনার এই অন্যায় আবদার আমি রাখতে পারবো না।’
‘ভেবে বলছো তো সবকিছু?’
ফিচেল হাসে তানভীর। শান্ত গলায় জবাব দিল, ‘বিয়েটা তো আমি ভেবেই করেছি। তাহলে এখন আর নতুন করে কি ভাববো? আমার আর ভাবার কিছু নেই।’
রহস্যময় হাসেন গোলাম মোস্তফা।
‘তোমার বাবা এবং আমার কিন্তু কোটি টাকার পার্টনারশিপ।’
গোলাম মোস্তফার মুখের কথা কেড়ে নিলেন জামাল এহতেশাম।
‘আমাদের এই পার্টনারশিপকে তোমার আর টিনার বিয়ে দিয়ে সম্পর্কে বদলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো যা করার করে নিয়েছই। তারপরও মোস্তফা সাহেব তোমাকে একটা সুযোগ দিয়েছে শুধু টিনা তোমাকে ভালোবাসে বলে। নতুবা মোস্তফা সাহেব ব্যবসায়ের অংশীদারত্ব ছেড়ে দিবেন। এখন তুমি বলো এই মুহূর্তে তোমার বাবার পক্ষে সম্ভব ৫০% ব্যবসায়ের ঋণ পরিশোধ করা?’
স্তম্ভিত তানভীর। খানিকটা বাকরুদ্ধও। কি উত্তর দিবে ভাবতে ভাবতেই গোলাম মোস্তফা দিলেন আরো লোভনীয় প্রস্তাব।
‘তুমি যদি চাও তাহলে আমার শেয়ারের অংশটুকুও আমি তোমার নামে লিখে দিবো।’
থমথমে পরিবেশ। বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন মানুষ তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে তানভীরের উত্তর শোনার জন্য।
হতবিহ্বল তানভীর হাসতে হাসতে এপাশ ওপাশ মাথা দুলায়। খুব ঠান্ডা শীতল গলায় তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার ব্যবসার আসল পুঁজি যে তোমার সন্তানের সারাজীবনের সুখ সেটা তুমি আগে কেন বলোনি বাবা। তাহলে তো কাউকে পছন্দ করার আগে দশবার ভাবতাম আর বিয়ে করার আগে তো নিজেই নিজেকে জুতোপেটা করে বলতাম বাবার পুঁজিতে হাত দেওয়া যাবে না।’
______________________
বেলা নামলো। রৌদ্রের প্রখরতা কমেছে। ক্লান্ত বিকেলে ক্লান্ত সবাই। বাড়ি ফিরেন জামাল এহতেশাম। অন্যদিন এই সময়ে রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ এলেও আজকের চিত্র একদম ভিন্ন। একেবারে শান্ত পরিবেশ। দমকা হাওয়া বইবার আগে পরিবেশ যেমন গুমোট থাকে ঠিক তেমন।
জামাল এহতেশামের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে আজকে বড়সড় ঝড় বইবে। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে রইলেন। অপেক্ষা সেই ঝড়ের।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে যখন কারো উপস্থিতি টের পেলেন না তখন বেশ অবাকই হলেন তিনি। চোখ মেলে তাকানোর সাথে সাথে ভাঙার শব্দে উনার দেহ কেঁপে উঠে। মেঝের দিকে তাকাতেই দেখলেন শখের ফুলদানি টা টুকরো টুকরো হয়ে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একবার ফুলদানির তো আরেকবার স্ত্রীর দিকে চেয়ে আবারও গা এলিয়ে দিলেন তিনি।
‘কেমন হয় যদি এভাবেই একটা একটা করে তোমার প্রিয় জিনিস আর প্রিয় মানুষ তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যায় তো?’
উত্তর দিতে পারলেন না জামাল এহতেশাম। শব্দেরা আটকে এসেছে গলায়।
‘আমি বাবা দেখেছি কিন্তু তোমার মতো স্বার্থপর বাবা আর দু’টো দেখিনি।’
তাহমিনা হকের কথা শুনে নিস্তেজ চোখ জোড়া মেলে তাকালেন তিনি। চোখেমুখে কেবল বিষন্নতা।
‘টাকার পিছনে ছুটতে থাকা এক লোভী ব্যবসায়ীর আবরণ থেকে বেরিয়ে এসো দেখো সন্তানদের কাছ থেকে তুমি কতটা দূরে। এমন কিছু করো না যার জন্য তোমারই ঔরসজাত সন্তানেরা তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। টাকার লালসার জন্য যে বাবা সন্তানের পছন্দ অপছন্দ মেনে নিতে পারে না। টাকার লালসার জন্য যে বাবার সন্তানের ভালো থাকা চোখে পড়ে না সে বাবা নামের কলংক।’
বলে থামলেন তাহমিনা হক। জামাল এহতেশাম অনুভূতিশূন্য চোখে এখনো তাকিয়ে আছেন। উনাকে এমন চুপ দেখে গা পিত্তির জ্বলে যাচ্ছে তাহমিনা হকের।
‘কোন সাহসে তুমি আমার ছেলেকে অফিসে ডেকেছো? কোন সাহসে তুমি আমার ছেলেকে টাকার লোভ দেখিয়েছো? সবাইকে কি নিজের মতো ভাবো? অবশ্য কাকে কি বলছি। বলছি কত টাকা লাগবে তোমার? কত টাকা পেলে আমার ছেলেটাকে একটু রেহাই দিবে? আমার দু’টো কিডনি বিক্রি করলে হবে? আর সাথে যদি বাবার দেওয়া জমিটা বিক্রি করি তাহলে হবে না?’
তেড়ে গিয়ে জামাল এহতেশামের কলার চেপে ধরেন তিনি।
‘উত্তর দিচ্ছো না কেন? টাকার কথাই তো বললাম। টাকা পেলে তো আর তোমার কিছু লাগে না।’
কলার ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। চোখের কোটরে উপচে পড়া জল। বিষাদ ঘিরে ধরেছে। কণ্ঠনালী কাঁপছে তিরতির করে। রাগ, ক্রোধ রূপ নিলো হাহাকারে। চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠেন।
‘ নিজের সিদ্ধান্ত মেয়ের উপর চাপিয়ে দিতে পারোনি বলে মেয়ে আর জামাইয়ের সাথে ঠিক করে কথা বলো না। নাতনিকে পর্যন্ত ঠিকমতো আদর করো না। কোলে নাও না। বাচ্চা মেয়েটা তোমাকে দেখলে লাফালাফি করে তোমার কোলে ওঠার জন্য। তুমি উপেক্ষা করে চলে যাও। তোমার বিবেক তোমাকে তাঁড়া করে না? কিভাবে পারো? মায়া হয় না? অবশ্য মায়া হওয়ার জন্য মন লাগে। বিবেকের করা প্রশ্নের জবাব দিতে মনুষ্যত্ব লাগে যার কোনোটাই তোমার নেই। তুমি অমানুষ। অমানুষের চেয়েও অধম। যার বিবেক হ্রাস পায় আর যার অন্তরে পশুত্ব বিরাজ করে সেই অন্তর থেকে মায়া, মহব্বত আর ভালোবাসা নিজ দায়িত্বে সরে আসে।’
অনর্গল কথাগুলো বলেই থামলেন তাহমিনা হক। গলা শুকিয়ে এসেছে উনার। একই কথা বার বার বলতে বলতে ক্লান্ত তিনি। অবুঝ কে বুঝানো যায় কিন্তু বুঝদার অবুঝের মতো হলে তাকে বুঝানো যায় না।
ড্রয়িংরুমে আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না উনার। কয়েক সেকেন্ড এখানে দাঁড়ালে মেজাজ আরো বিগড়ে যাবে। পা বাড়ালেন নিজের রুমের দিকে। যাওয়ার আগে দিয়ে গেলেন সতর্কতার বাণী।
‘খবরদার আজকের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তো। এরপর আর কিছু বলবো না কাজে প্রমাণ দিবো। জীবনটা আমার ছেলের। আমার ছেলে সিদ্ধান্ত নিবে কার সাথে সারাজীবন থাকবে। অন্যকেউ তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে আমি মা হয়ে বরদাস্ত করবো না।’
জামাল এহতেশাম নিষ্পলক চোখে স্ত্রীর চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছেন। কি অদ্ভুত! শার্টের কলার ধরলেন এতোগুলো কথা শুনিয়ে গেলেন তারপরও একটু রাগ হচ্ছে না উনার। আর না নিজের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করার জেদ চাপছে। প্রশ্নের তীর বার বার উনার দিকেই ধেয়ে আসছে।
একটা বার মুখ ফোটে বলতে চাইলেন ‘ তুমি মা হলে আমিও তো বাবা। আমার চাওয়া পাওয়ার কি দাম নেই?’ কিন্তু বলতে পারলেন না। অদৃশ্য এক হাত গলা চে//পে ধরেছে উনার। কেউ যেন কানে কানে এসে বলছে, ‘ টাকা, নাম, যশ আর খ্যাতির পিছনে ছুটতে ছুটতে এতোটাই দূরে চলে এসেছিস যে সন্তান আর তোর মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। তাই তোর চাওয়া পাওয়ার কোনো অধিকার নেই।’
ক্লান্ত দেহটাকে আবারও সোফায় এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘আসলেই অধিকার নেই। বাবা হওয়ার যোগ্যতা টাই যে নেই আমার।’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্য করবেন প্লিজ!