#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (০৯)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
সিগারেটে সুখটান দিয়ে সফেদ ধোঁয়ার কুন্ডলি খোলা আকাশে উড়িয়ে দেয় তুহিন। দু’আঙ্গুলের মাঝে রাখা সিগারেটটা পুড়া ঠোঁটে পুনরায় চেপে ধরতেই উপস্থিত হয় তানিয়া। চোখে তার প্রচন্ড ক্ষোভ। দাঁত কিড়মিড় করে খর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্যদিকে ভাবলেশহীন তুহিন। তানিয়ার রণমুর্তি দেখে যেন সিগারেটে আরো একটু সময় নিয়ে সুখটান দিল।
হনহনিয়ে এগিয়ে আসে তানিয়া। তুহিন আরো একবার সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরার আগেই টান দিয়ে ফেলে দিল। রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
‘সিগারেটের পিছনে সময় নষ্ট না করে চাকরির চেষ্টা চালালে আজকে এতোটা প্রেশার আমায় নিতে হতো না। চোখ বন্ধ করে আমি তোমার কথা বাবাকে বলতে পারতাম।’
‘তবে চোখ খুলেই আমার কথা বলো তোমার বাবাকে।’ নির্লিপ্ত, উদাসীন জবাব তুহিনের।
হাতজোর করে তানিয়া। অনুনয় করে বলল, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে একটু তো সিরিয়াস হও। আমার প্রতি তোমার উদাসীনতা আমি আর মেনে নিতে পারছি না। যখনই দেখা হয় আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানো। কেন? এমনই যদি করবে তাহলে কেন আমাকে তোমার সাথে জড়ালে? একদিকে পরিবারের দেওয়া প্রেশার। অন্যদিকে তোমার এমন উদাসীনতা আমি জাস্ট আর নিতে পারছি না।’
ঘাসের উপর নিভে যাওয়া সিগারেটটার দিকে একমনে চেয়ে আছে তুহিন। সেটা তুলে হাতে নিলো সে। সিগারেটটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে ফিচেল হাসল সে। নিরেট গলায় বলল,
‘একজন বেকার প্রেমিকের একাকিত্বের সঙ্গী কে জানো?’
প্রশ্নটা করে তানিয়ার দিকে তাকাল সে। পলকহীন চোখে তানিয়া তার দিকেই চেয়ে আছে। জবাব না পেয়ে তুহিন নিজে থেকেই উত্তর দেয়,
‘জানি আমি তুমি যে এটা জানো না। বেকার প্রেমিকের নিঃস্বঙ্গতার একমাত্র সঙ্গী হচ্ছে সিগারেট। কারন কি জানো? এই সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে ভেতরকার বিষাদ, চিন্তা, হতাশা এবং যন্ত্রণাগুলোকেও খোলা আকাশে উড়িয়ে দেওয়া যায় কিছু সময়ের জন্য।’
প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করে তানিয়া। ‘পরশু যে ইন্টারভিউ দিলে সেটার কি হলো?’
‘আমি যে তোমাকে ব্যবসা করবো বলে টাকা যোগাড় করতে বললাম তার কি হলো?’ ফিরতি প্রশ্ন তুহিনের।
দু-হাত দূরে দাঁড়িয়ে দুজনের কথা শুনছিল পিয়া। এতোক্ষণ খারাপ লাগলেও তুহিনের বলা শেষের কথাটা শুনে গা জ্বলে উঠে তার। ইচ্ছে করছে ছেলেটার গালে টপাটপ চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর জন্য এই মনোবাসনা তার কখনোই পূর্ণ হবে না। তাই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল তানিয়ার উত্তর শোনার।
‘তোমার পরিবার কে বলো।’ তানিয়ার নিরস জবাব।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন।
‘চাকরিও হচ্ছে না। ব্যবসা করতে নেমে যদি লস খাই সেই ভয়ে পরিবারও টাকা যোগাড় করে দিচ্ছে না।’
‘যেখানে তোমার পরিবার তোমাকে টাকা দিচ্ছে না। সেখানে আমি কে? কোনো ভাবে আমি তোমাকে টাকা যোগাড় করে দিলাম পরে যে তুমি আমাকে তোমার জীবন থেকে ছুড়ে ফেলে দিবে না তার গ্যারান্টি কি?’
‘এতই যেহেতু ভয় তবে ভালোবাসো কেন?’
‘এতকিছু ভেবে যদি ভালোবাসা হতো তাহলে কখনো বিচ্ছেদ রচনা হতো না।’
‘কবি হয়েছো দেখছি।’
‘এটা কোনো কবিতা নয় আর নয় কোনো উপন্যাস। যে লেখক সবশেষে কিছু একটা করে মিল দিয়ে দিবে। দিস ইজ রিয়েলিটি। এখানে কোনোকিছু পেতে হলে লড়াই করতে হয়। রিস্ক নিতে হয়। ভয় পেয়ে দু’কদম পিছিয়ে না গিয়ে দৃঢ়তার সাথে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।’
কথার পিঠে বলার মতো আর কথা খুঁজে পেল না তুহিন। শান্ত চোখে পলকহীন তাকিয়ে রয় তানিয়ার ওই ক্ষেপাটে মুখের দিকে।
‘আজকের পর থেকে আমি আর কখনো বিয়ে বিষয়ক বা চাকরি বিষয়ক কিছু তোমায় বলবো না। তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। শুধু বাবা বিয়ের কথা বললে আর অযুহাতে পালিয়ে বেড়াবো না। তুমি জানবে তোমার প্রেমিকা তোমায় ধোঁকা দিয়েছে। আর আমি জানবো আমি একজন ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম।’
মনের সমস্ত যন্ত্রণাগুলোকে ব্যক্ত করে উল্টো পথে হাঁটা ধরে তানিয়া। পিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে।
‘বাসায় ফিরবো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
আজকের এই স্পষ্টভাষী তানিয়া কে দেখে খুশি পিয়া। এই তানিয়াকেই সেই দেখতে চেয়েছিল। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই শুনতে পেল, ‘ভালোবাসি তো।’
থমকে দাঁড়ায় তানিয়া। কঠিন রূপটা মোমের ন্যায় গলতে শুরু করেছে। এই একটা শব্দের কাছে সে দূর্বল। ভীষণ রকমের দূর্বল। তবে আজ নিজের দূর্বলতাকে প্রকাশ করবে না। নমনীয়তা দেখাবে না।
‘আমিও বাসি।’
‘থাকতে পারবে আমায় ছাড়া?’
‘কেউ যদি কাছে টানার চেষ্টা না করে তবে তো তাকে ছাড়াই থাকতে হবে। ভালোবাসলে কাছে আসার চেষ্টাও দুজনের থাকতে হয়। এফোর্ট দুজনকেই দিতে হয়। এক তরফা চেষ্টার ফলাফল বরাবরই শূন্য থাকে।’
________________________
ছটফট করতে করতে শেষে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে তানিয়া। অন্যদিকে আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা মস্ত বড়ো চাঁদের দিকে চেয়ে নিজের ঘুম বিসর্জন দিচ্ছে পিয়া। তীব্র পীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঘুমের একটা ট্যাবলেট সেও গিলে নিয়েছে। কিন্তু আজ যেন ঘুম আর চোখ মিলে শত্রু শত্রু খেলায় মেতে উঠেছে। ভেঁজা আঁখি পল্লব জোড়া যখনই একে অন্যকে আলিঙ্গন করছে তখনই শ্রাবণধারা স্পর্শ করছে চিবুক। রাগ হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। আবার অভিমানের পিষ্টনে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হচ্ছে মন। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না এই যন্ত্রণাগুলো।
ফোন বেজে উঠলে কেটে দেয় সে। এই নিয়ে উনিশ বার কল কেটেছে। আজ ভুলেও ফোন উঠাবে না। চোখ বুঁজলেই দৃশ্যটা চোখে ভেসে ওঠছে। আর অন্তঃদেশের যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্র আকার ধারণ করছে। মনকে বার বার বুঝাতে চাইছে সে যা দেখেছে মনের ভুল৷ কিন্তু হায়! অবুঝ মন কি আর মানে? লুকিয়ে মোবাইলে ধারণ করা দৃশ্যটি যে তার মনের ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে।
গ্যালারির শুরুতেই থাকা ছবিটাতে ক্লিক করে পিয়া। ছোট হয়ে থাকা ছবিটা পুরো মোবাইল স্ক্রিন দখল করতেই বুক ধক করে উঠে তার। আবারও অভিমান শ্রাবণ হয়ে ঝরতে থাকে। কোন এক অজ্ঞাত মেয়ে তারই প্রিয় মানুষের হাত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রাস্তা পার হচ্ছে। মন বলছে লোকটা তাকে ঠকাচ্ছে। সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে নিঃস্ব করার ফন্দি আঁটছে। কিন্তু বাঁধ সাধে বিবেক। মেয়েটা বিপদে পড়েও তো তানভীরের কাছে আসতে পারে। হতে পারে সে রাস্তা পার হতে ভয় পা। কিংবা তার কোনো দূরসম্পর্কের বোন।
আবেগী মন যে মানতে নারাজ। বিপদ পড়ুক আর বোন হউক ওমন ভাবে হাত ধরবে কেন? লোকটাই বা পারমিশন দিবে কেন? ওমন আষ্টেপৃষ্ঠে হাত জড়িয়ে ধরার অধিকার তো কেবল তার। তার অধিকারে ভাগ বসানোর সাহস কোথায় পেল ওই মেয়ে? মানুষটার কি তার কথা একবারও মনে পড়ল না? তবে কি এজন্যই কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে? যেন বাইরেও একজন রাখতে পারে? না আর ভাবতে পারছে না সে। এড়িয়ে না গিয়ে প্রশ্ন করবে। জানতে চাইবে কেন এমনটা করছে। কেন দুই নৌকায় পা ফেলে চলছে সে। তাকে নিয়ে পুতুল খেলার অধিকার মানুষটার নাই। অদৃশ্য আ*ঘা*তে ক্ষত বিক্ষত করার অধিকারও নেই। গুমরে গুমরে কষ্ট না পেয়ে আজকেই জানতে চাইবে। সে যত দেরি করবে মানুষটা আরো সাহস পাবে। চোখের পানি মুছে মনকে শক্ত করল পিয়া। কন্ঠস্বর যথেষ্ট কঠিন আর রুক্ষ রাখার চেষ্টা করে। আজ কোনো লাজুকলতা না। আর নয় নমনীয়তা। আজ সময় কঠিন রূপ নেওয়ার।
কল লিস্টের শুরুতেই থাকা নামটা দেখে ঠোঁট কামড়ে ধরে সে। ‘প্রিয় পুরুষ’ নিজেই নিজের নাম্বার ‘প্রিয় পুরুষ’ লিখে সেভ করে দিয়েছিল তানভীর। প্রিয় পুরুষ কি তবে আজ থেকে অপ্রিয় হয়ে যাবে? সে তো এননটা চায় না। কান্না গিলে নিয়ে যেই না কল দিবে তার আগেই তানভীরের কল চলে এলো। রিসিভ করেই শুনতে পেল,
‘ফোন ধরছো না কেন? তুমি ঠিক আছো? কোনো বিপদ হয়েছে? গ্যারেজ থেকে বাইক বের করলাম। আমি এক্ষুনি আসছি।’
তানভীরের গলার স্বরে অস্থিরতা, উৎকন্ঠা।
এমন হম্বিতম্বি দেখে ফিচেল হাসল পিয়া। বিদ্রুপ করে বলল,
‘এই মিথ্যে নাটকগুলো না করলেও পারেন।’
অর্থহীন কথায় বোকা বনে যায় তানভীর।
‘কিসব বলছো? জ্বর এসেছে?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিয়া। নিস্তেজ গলায় বলল,
‘আপনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।’
ভ্রু কুঁচকে এলো তানভীরের। পিয়ার এমন ছোট ছোট কথাগুলো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার।
‘কিসের ধরা? আবোলতাবোল বকছো তুমি। আমার মনে হচ্ছে তুমি অসুস্থ। তোমার গলার স্বরও অদ্ভুত শোনাচ্ছে। আধঘন্টা সময় দাও আমি আসছি।’
আসবে শুনেই রেগে গেল পিয়া। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে বলল,
‘আপনি একদম আসবেন না। আপনি একজন প্রতারক। দিনের পর দিন আমাকে ঠকিয়েছেন।’
ঠকানোর কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল তানভীর। পিয়ার বলা কোনো কথারই কূল-কিনারা পাচ্ছে না সে। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করল সে। দুজনেই পাগলামি শুরু করলে ব্যাপারটা আরো ঘেটে যাবে।
‘রিল্যাক্স পিয়া। মাথা ঠান্ডা করে বলো কি হয়েছে। আর রইল তোমাকে ঠকাবো বা তোমার সাথে প্রতারণা করবো? তোমার সাথে প্রতারণা করা মানে তো নিজের সাথে প্রতারণা করা। এতো সাহস যে আমার নেই।’
পিয়া পুনরায় বিদ্রুপ করল।
‘ভাগ্যিস আপনার সাহসের প্রমাণটা রেখেছিলাম। আপনার সাহসের প্রমাণটা পাঠাচ্ছি। ভালো করে দেখুন। দেখে তারপর উত্তর দিন কেন আমার জীবনটাকে নিয়ে এমন খেললেন।’
কল কেটে ছবিখানা পাঠায় পিয়া। তারপর তাকায় আকাশের দিকে। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি সব হারিয়ে ফেলল সে।
তানভীর কান থেকে মোবাইল নামায়। টুং করে শব্দ হতেই সেখানে ক্লিক করে। ভালো করে ছবিটা দেখে আবারও কল করল পিয়াকে। রিসিভ হওয়ার সাথে সাথেই ভনিতা না করে বলল,
‘তাহলে সবকিছু জেনেই ফেলেছো?’
#চলবে