#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (১৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
আচমকা কেউ বুকের চেপে ধরায় ভয় পেয়ে যায় পিয়া। ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করতেই পরিচিত কন্ঠস্বর পেয়ে স্বঃস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবে কান্নার বেগ বাড়ে তার। ফুঁপিয়ে উঠলো সে।
‘ক্ষত বিক্ষত শরীর এটা নয় তানভীর সাহেব।’
তানভীর জিজ্ঞাস্য চাহনি নিক্ষেপ করতেই পিয়া আঙ্গুল উঁচিয়ে জামাল এহতেশামের র*ক্তাক্ত শরীরের দিকে ইশারা করে।
নিস্তেজ, রক্তে মাখামাখি জামাল এহতেশামের শরীর। তবুও জন্মদাতা পিতাকে চিনতে বেগ পেতে হলো না তানভীরের। থমকে গেল তার দুনিয়া। দু’কদম পিছিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে সে। গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে, ‘বাবাআআআ।’
জনাকীর্ণ পরিবেশ এক চিৎকারেই যেন হয়ে গেল স্তব্ধ। পিয়া দৌড়ে গিয়ে তানভীরকে ধরল। তানভীর অসহায় নেত্রে চেয়ে নিষ্প্রতিভ গলায় প্রশ্ন করল,
‘বেঁচে আছে?’
ছোট্ট একটা জিজ্ঞাসা। কিন্তু মর্মদেশ এফোড় ওফোড় হয়ে যায় পিয়ার।
‘পাগলামি করে সময় নষ্ট করার সময় এখন না। বাবা শ্বাস নিচ্ছেন। দ্রুত ট্রিটমেন্ট শুরু হওয়া দরকার। র*ক্ত যোগার করা দরকার। তাড়াতাড়ি বাবাকে ভেতরে নিয়ে চলুন। আল্লাহর দোহাই দেরি করবেন না।’
লাল টকটকে চোখ তানভীরের। পিয়ার মুখের দিকে তাকাতেই পুনরায় বলল, ‘বাবাকে বাঁচান।’
তানভীর উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে জামাল এহতেশামের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরেন। জ্ঞানহীন, নিস্তেজ দেহ। বেঁচে আছেন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন এটাই যেন উপরওয়ালার দয়া।
_____________________
অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন তাহমিনা হক। আফরিনের কাঁধে ভদ্রমহিলার মাথা। মা আর নানির কান্না দেখে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছে মিষ্টি। শিরিন আহমেদ সযত্নে আগলে রেখেছেন মিষ্টিকে। অদূরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের অপেক্ষা করছে তানভীর। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে জামাল এহতেশামের। ব্লাডগ্রুপ মিলে যাওয়ায় কোনো দ্বিধা করেননি বেলাল শেখ। নার্সের সাথে গেলেন র*ক্ত দেওয়ার জন্য।
একা থম মেরে বসে আছে পিয়া। পিয়ার জামায় লেগে থাকা র*ক্ত শুকিয়ে ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। খিদায়, ক্লান্তিতে থাকা নিস্তেজ শরীরটা ঢুলছে। মুঁদে আসছে চোখ। চোখের পাতা এক করলেই আঁতকে উঠছে সে। বার বার চোখে শুধু এক্সিডেন্টের দৃশ্যই ভাসছে।
ঢুলতে দেখে পিয়ার কাছে এসে বসে তানভীর। হাতের আঁজলে আলতো করে পিয়ার হাতটা নিলো। পিয়া নিভু নিভু নয়নে চাইতেই তানভীর জানতে চাইল, ‘ খারাপ লাগছে?’
পিয়া এপাশ ওপাশ মাথা দোলায়। তানভীর ফিচেল হাসলো। বিবশ গলায় পুনরায় জানতে চাইল,
‘আজকে সারাদিন তোমার পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি তাই না?’
পল্লবিত নেত্রযুগল পিয়ার। নিষ্প্রাণ হেসে জবাব দেয়,
‘তেমন কিছু না।’
তানভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘ছুটোছুটি করতে গিয়ে তোমার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অথচ তোমার খেয়াল রাখাটাও আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’
‘এগুলো বলার সময় এখন না। আমার খেয়াল আপনি পরেও রাখতে পারবেন। আপাতত মেইন ফোকাস এখন বাবা।’
তানভীর কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘দুইদিন আগে তোমার কাছে ছিলাম অপরাধী। আজ হয়ে গেলাম ঋণী। তোমাদের এই কখনো শোধ করতে পারবো না।’
‘আপনজনের সাথে বুঝি ঋণ পরিশোধের সম্পর্ক? আপনার বাবা আমার কি হয়?’
শুকনো হাসে তানভীর। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কখনো ঋণ থাকে না। যা থাকে তা হলো ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান আর একে অপরের বিপদে পাশে থাকা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঋণ পরিশোধের সম্পর্কই হতো তবে অচেনা অজানা পরিবেশে এসে মানিয়ে নিয়ে সবার খেয়াল রাখা, রান্না করে খাওয়ানোর বিনিময়ে যে কটু কথা, অপমান হজম করে সবার আগে সেগুলোর ঋণ পরিশোধ করতে বলতো।
‘কিছু নিয়ে আসি? খেয়ে পানি খেয়ে নিবে একটু। নয়তো তুমি আবার অসুস্থ হয়ে যাবে।’
পিয়া আশস্ত করে,
‘আমায় নিয়ে চিন্তিত হবেন না। আমি ঠিক আছি। আগে ডাক্তার আসুক। বাবার সার্বিক অবস্থা জানি। তারপর খাবো। এখন আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না।’
তানভীর কথা বাড়ালো না। চেয়ারে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে রইলো। সহসাই পিয়া বলে উঠে,
‘আমার প্রচুর শীত করছে।’
ধ্যান ভাঙে তানভীরের। পিয়ার কপালে হাত ছোঁয়াল। মৃদু স্বরে।
‘গা গরম। জ্বর আসবে মনে হয়। চলো আমার সাথে। কিছু খেয়ে ঔষধ খাবে।’
পিয়া ‘পরে’ বলে নিশ্চুপ রইলো।
তানভীর ফের বলে,
‘তোমার জামাকাপড়ও বদলানো দরকার। প্রচুর র*ক্ত,,,,,,,,,,,,,,,
র*ক্ত কথাটা কর্ণগোচর হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠেন তাহমিনা হক। এহতেশাম, এহতেশাম বলে ছটফট করতে থাকেন তিনি। তানভীর আর পিয়া দৌড়ে আসতেই তাহমিনা হক শান্ত, স্থির নয়নে পিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয় তাহমিনা হকের চোখ। পিয়ার জামা ওড়না হাতরাতে থাকেন তিনি। ফ্যাচঁফ্যাঁচ করে কেঁদে উঠেন মুহূর্তেই। ভাঙা গলায় বলেন,
‘এগুলো আমার এহতেশামের র*ক্ত তাই না?’
কথাটা বলে সময় নিলেন তিনি। পিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন তানভীরের দিকে।
‘আমার এহতেশাম বাঁচবে তো রে বাবা?’
কথাটা বলেই আর সময় নিলেন না তাহমিনা হক। পুনরায় লুটিয়ে পড়লেন আফরিনের কাঁধে।আফরিনও ঠোঁট উলটে চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠে, ‘ভাইয়া।’
ধীরে ধীরে রক্তিম বর্ণ ধারণ করে তানভীরের চোখ। নিজের চেপে রাখা যন্ত্রণা লুকানোর জন্য চলে গেলো অন্যদিকে। পুরুষ কাঁদে না। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। যেখানে সবাই মাথা গুঁজে সেই মাথা গুঁজার জায়গাটাই যদি দূর্বল হয়ে পড়ে তাহলে বাকিদের মানসিক শক্তিও ক্ষয়ে যায়। তাই পরুষদের শক্ত থেকে বাকিদের আগলে রেখে বিপদ কাটিয়ে উঠতে হয়। পুরুষ দূর্বল হয়ে যাওয়া মানেই পুরো পরিবার দূর্বল হয়ে যাওয়া।
__________________
ডাক্তার বের হয়ে আসতেই হুড়মুড় করে ছুটে গেল সবাই।
‘আমার স্বামী বাঁচবে তো ডাক্তার সাহেব?’
প্রশ্ন করেই ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালান তাহমিনা হক। আফরিন তার মাকে এক হাতে জড়িয়ে নিলো।
‘দেখুন হায়াত_মউত সব আল্লাহর হাতে। কার মৃত্যু কখন হবে কেউ জানে না।’
তানভীর জিজ্ঞেস করলো,
‘ডক্টর বাবাকে কন্ডিশন কী?’
‘দেখুন উনার মাথার আঘাতটা গুরুতর। বা গালটা বলতে পারেন একদম থেতলে গেছে। চোখ ইনজুরড। তবে মারাত্মক কোনো ক্ষতি হয়নি।’
ডাক্তারের কথা শোনামাত্রই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাহমিনা হক। মেঝেতে বসে যেতে নিলেই দুইহাতে আগলে নিলো তানভীর।
‘আমরা আগে ডাক্তারের সম্পূর্ণ কথা শুনি মা। তুমি না আমাদের ছোটবেলায় শিখিয়েছো বিপদে ভেঙে পড়তে নেই। মনোবল শক্ত রেখে পরিস্থিতি সামলাতে। তুমি ভেঙে পড়লে তো আমরা গুড়িয়ে যাই মা। আমাদের মানসিক শক্তি যে তুমি।’
তানভীর বুকটা আঁকড়ে ধরেন তাহমিনা হক। মাথা গুঁজে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন তিনি।
তানভীর নিরেট গলায় পুনরায় বলল,
‘আপনি বলুন ডাক্তার।’
ডাক্তারও আবার বলতে লাগলেন,
‘তাছাড়া পায়ের ফ্র্যাকচারটা মারাত্মক। পায়ের পাতার হাড় ভেঙ্গে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আর কখনো হাঁটতে পারবেন না তিনি। পায়ের পাতার উপর কখনো প্রেশার দেওয়া যাবে না। ক্রাচে ভর দিয়ে চলতে হবে।’
‘বাবার সুস্থ হতে কতদিন লাগবে ডক্টর?’
‘পেশেন্টের সবগুলো ইনজুরিই ডিপ। তাই সেরে ওঠাও সময় সাপেক্ষ। এক থেকে দেড় মাস ফুল রেস্টে থাকতে হবে। আর প্রোপার যত্ন নিতে হবে।’
কথা গুলো বলে ডাক্তার চলে যাচ্ছিলেন। আবার ফিরে এসে বললেন,
‘আরেকটা কথা পেশেন্ট কে কখনো মানসিক চাপ দিবেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে।’
সাথে সাথে তানভীর পিয়ার দিকে তাকালো। তড়িঘড়ি করে মাথা নুইয়ে ফেলে পিয়া।
________________
জেদ ধরে বসে আছেন তাহমিনা হক। হাসপাতাল থেকে এক পা ও নড়বেন না তিনি। যাই হয়ে যাক।
তানভীর একহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে। মায়াভরা কন্ঠে বলে,
‘তুমিও যদি অসুস্থ হয়ে যাও আমরা কোথায় যাবো মা?’
তাহমিনা হক বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উলটালেন।
‘আমি এখানে তোর বাবাকে রেখে কোথাও যাবো না।’
‘আমি আছি তো মা। কেন পাগলামি করছো।’
‘আমি যাবো না কোথাও।’
‘কেন জেদ করছো?’
তাহমিনা হক উত্তর দিলেন না। নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন।
‘আমি কালই বাবাকে নিয়ে অন্য হাসপাতালে শিফট করবো। প্রয়োজন হলে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাবো। তারপরও বাবাকে সুস্থ করে তুলবো। সেই সাথে তোমাকেও তো সুস্থ থাকতে হবে।’
‘ভাইয়া আমি থাকি তোমার সাথে?’
তানভীর ধমকে উঠল,
‘পাগল তুই? মিষ্টির হাল দেখেছিস এই কয়েক ঘন্টায় কি হয়েছে? মাকে নিয়ে সোজা বাসায় যা। তারেক একটু পরেই আসবে তোদের নিতে।’
আফরিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে দমে গেল একদম। পিয়া আফরিনের কাঁধে হাত রাখে।
‘আপনি মাকে নিয়ে বাসায় যান। আমি আর আপনার ভাই আছি এখানে।’
তানভীর কেমন করে যেন তাকালো পিয়ার দিকে। শীতলতার চাদরে আচ্ছাদিত তানভীরের সেই চাহনি।
এর মাঝেই এসে উপস্থিত হয় তারেক। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে,
‘পৌঁছাতে দেরি করে ফেললাম তাই না? বাবার অবস্থা এখন কেমন?’
তানভীর সমস্তটা বলতেই তারেক বলল,
‘আল্লাহ ভরসা ভাই। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।’
এরপরই তারেকের নজরে আসে তানভীরের পিছনে আড়াল হয়ে থাকা পিয়াকে।
‘আসসালামু আলাইকুম ভাবি।’
পিয়া সালামের জবাব দিল,
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’
তারেক এরপরই কৌশল বিনিময় করে পিয়ার বাবার সাথে। পিয়ার বাবা প্রথমে চিনতে পারেননি। পরে মিষ্টি যখন আধো আধো গলায় বাবা বাবা করতে করতে তারেকের কোলে লাফ দিয়ে চলে গেলো তখন আর বুঝতে বাকি নেই তারেক কে।
____________________
রাত বাড়ল। সবাই চলে গেছে প্রায় অনেকক্ষণ। রয়ে গেছে কেবল পিয়া আর তানভীর। তবে যাওয়ার তাহমিনা হক বেলাল শেখকে বলেন, ‘সারাজীবনের মতো ঋণী করে রাখলেন ভাইজান।’
জবাবে বেলাল শেখ বলেন, ‘বিপদের সময় যদি সাহায্যই না করতে পারি তবে আত্মীয়তার সম্পর্ক কোন দিনের জন্য?’
চুপচাপ বসে আছে দুজন। থেকে থেকে ফিনাইলের গন্ধ নাকে এসে লাগছে।
‘আপনার মোবাইলটা দিবেন? আমার মোবাইলের চার্জ শেষ।’
‘সেজন্যই তোমাকে তখন ফোনে পাচ্ছিলাম না?’
পিয়া মাথা নাড়ায়। তানভীর পকেট থেকে মোবাইল বের করে পিয়ার হাতে দিল। মুখস্থ একটা নাম্বার তুলেই ডায়াল করল।
একবার রিং হতেই কে’টে গেলো। পিয়া আবারও কল করল সেই নাম্বারে। রিসিভ হয় এবার।
‘হ্যালো তানিয়া?’
পিয়ার গলার স্বর শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তানিয়া।
‘এই ফাজিল কই তুই? জানিস তোর জন্য আমার কি অবস্থা হয়েছে? তুই আসছিস না তোকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। রাস্তায় গিয়ে শুনি কে যেন এক্সিডেন্ট করেছে। এইদিকে তোর নাম্বারও বন্ধ। পরে শুনি এক ভদ্রলোক নাকি। তোর জন্য আমার নফল নামাজও পড়া শেষ।’ বলতে বলতে কেঁদে উঠে তানিয়া।
‘চিন্তা করিস না আমি ঠিক আছি। তবে হাসপাতালে আছি।’
‘হাসপাতাল?’ আঁতকে উঠল তানিয়া।
‘কারণ যে ভদ্রলোক এক্সিডেন্ট করেছে উনি আর কেউ না আমার শ্বশুর।’
‘ইন্না- লিল্লাহ। এখন কেমন আছেন তিনি?’
পিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘আছেন। তবে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া বেঁচে আছেন। আচ্ছা শোন আজকে আমি ফিরবো না। আমার জন্য চিন্তা করিস না।’
বলেই মোবাইল রাখল পিয়া। তা দিল তানভীরের হাতে। তারপর? তারপর শূন্যে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক। আবার স্তব্ধ পরিবেশে ফিনাইলের গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে। তানভীর চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে আছে। আচমকাই পিয়া বলে বসলো,
‘যদি বাবা আমাকে মন থেকে মানতে না পারে আপনারা বাবাকে চাপ দিবেন না প্লিজ। বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে টিনা না কি যেন নাম মেয়েটার? ওকে বিয়ে করে নিয়েন। বউ গেলে বউ পাবেন কিন্তু একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য বাবা চলে গেলে কিন্তু আর বাবা পাবেন না।’
তানভীর চোখ মেলে তাকায়? অদ্ভুত তার চাহনি। ক্ষনকাল চেয়ে থেকে নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘বলা শেষ?’
মাথা নুইয়ে ফেলে পিয়া। আসলেই তার আর বলার কিছুই নেই। কতটা কষ্ট বুকে চেপে কথাগুলো বলেছে সে ছাড়া কেউ জানে না।
তানভীর পিয়ার এক হাত নিজের হাতের আঁজলে নিলো। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ছুঁয়াল আলতো করে।
‘বাবাটাও আমার আর বউটাও আমার। আমার যে দুজনকেই চাই রাজমহিষী।’
#চলবে
#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (১৮)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
তিনদিন হয় ডাক্তারের সাথে অনেকটা জোরাজোরি করে জামাল এহতেশাম ঢাকা মেডিকেল থেকে বারডেমে নিয়ে এসেছে তানভীর। ডাক্তাররা নারাজ ছিল। তারা চাননি এমন অবস্থায় জামাল এহতেশাম কে অন্য হাসপাতালে শিফট করতে। তবে তানভীরও ছিল নাছোরবান্দা। জামাল এহতেশামের জ্ঞান ফিরলেও গালের আঘাতের জন্য কথা বলতে পারেন না। খাওয়ার সময়টুকু বাদে উনার মুখ বন্ধ। সবকিছু শুনেন আর ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন। তাছাড়াও চব্বিশ ঘণ্টা তিনি আছেন ডাক্তারদের পরিচর্যায়।
তাহমিনা হক বসে আছেন জামাল এহতেশামের পাশে। তখনই হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকেন গোলাম মোস্তফা। আর সাথে টিনা। কাঁদতে কাঁদতে নাজেহাল অবস্থা টিনার। কখনো নাক টানছে তো কখনো হেঁচকি দিচ্ছে।
‘আঙ্কেল আপনি ঠিক আছেন? আপনার বেশি কিছু হয়নি তো?’
‘আঙ্কেল কথা বলতে পারেন না।’ বলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন তাহমিনা হক।
‘এহতেশাম সাহেব?’
গোলাম মোস্তফা গলার আওয়াজে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তাহমিনা হক।
সেই জায়গায় বসলেন তিনি ।
‘আপনি অফিস নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না।’
তাহমিনা হক বিড়বিড় করে আওড়ালেন,
‘ওসব দিচ্ছিও না। যদি করে তো মাথার যেখানটায় আঘাত পেয়েছে সেখানটায় আরেকটা দিয়ে সারাজীবনের মতো অফিস নিয়ে চিন্তা করা ঘুচিয়ে দিবো।’
‘ভাবি কিছু বললেন?’
গোলাম মোস্তফার কথায় নড়েচড়ে দাঁড়ালেন তাহমিনা হক। নিরেট গলায় জবাব দেন, ‘নাহ্! কি বলবো?’
গোলাম মোস্তফা আঁইঢাঁই করেন তাহমিনা হকের দিকে তাকিয়ে। নত স্বরে বলেন,
‘সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত ভাবি। আসলে মেয়েটা আমার বড্ড আদরের তো। তাছাড়া মা নে,,,,,,,,’
গোলাম মোস্তফা কে কথা শেষ করতে না দিয়ে তাহমিনা হক কাঠ কাঠ গলায় বলে বসলেন,
‘কিন্তু আমার করা ব্যবহারের জন্য বিন্দু পরিমাণ দুঃখিত নই আমি।’
থতমত খেয়ে গেলেন গোলাম মোস্তফা। কথা বলতে না পারলেও রাগী রাগী চোখে তাকান জামাল এহতেশাম। জামাল এহতেশামের এই রাগী ভাবকে কোনো রকম পাত্তা দিলেন তাহমিনা হক।
প্রসঙ্গ বদলান গোলাম মোস্তফা।
‘এহতেশাম সাহেব মেয়েটা আমার আপনার এক্সিডেন্টের খবর শুনেই কেঁদে যাচ্ছে এক নাগালে। যখন শুনেছে আপনার রক্তের গ্রুপ আর ওর রক্তের গ্রুপ এক তখন তো রক্ত দেওয়ার জন্য একদম মরিয়া হয়ে গেলো।’
‘তিনদিন পর রক্ত দিতে এসেছে?’
‘আপনি ভুল বুঝছেন ভাবি। ও ঢাকায় ছিলো না।’
‘তাহলে আপনি কোথায় ছিলেন?’
তাহমিনা হকের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলেন গোলাম মোস্তফা। আমতা আমতা করতে লাগলেন তিনি।
‘ইয়ে মানে আমি অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম।’
তাহমিনা হক রগড় গলায় জবাব দেন,
‘আচ্ছাহ্! তা মা কাঁদতে কাঁদতে মেক-আপ করতে কোনো সমস্যা হয়নি তো তোমার?’
তাহমিনা হকের এক প্রশ্নে কান্না থেমে যায় টিনার। বন্ধ হয়ে যায় হেঁচকিও। টিনা কতক্ষণ তার বাবার দিকে তাকায় তো কতক্ষণ তাহমিনা হকের দিকে তাকায়। কিছু বলতে যাবে তখনই কেবিনে আসে নার্স।
‘একি একি আপনারা এতজন রোগীর কাছে কি করছেন? এখন পেশেন্টের ঘুমের সময়। আপনারা প্লিজ পরে পেশেন্টের সাথে দেখা করুন। সময়মতো না ঘুমালে উনার সমস্যা হবে।’
‘আসি তবে এহতেশাম সাহেব। আবার আসবো। আমি অফিস সামলাচ্ছি। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।’
আবারও কাঁদতে শুরু করে টিনা। নাক টেনে টেনে বলে,
‘আসি আঙ্কেল। একদম চিন্তা করবেন। দেখবেন আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন।’
চলে গেলেন তারা। কেবিনে আছে কেবল নার্স এবং তাহমিনা হক। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জামাল এহতেশাম।
‘ম্যাম স্যারকে কি খাওয়ানো শেষ? স্যারের কিন্তু এখন ঔষধ আছে।’
‘না।’
‘স্যারের ঔষধগুলো? ওগুলো টাইমলি না নিলে তো উনি সুস্থ হবেন না।’
‘আসলে স্যুপ টা তখন অনেক গরম ছিল। উনি মুখে নিতে পারছিলেন না। এরমধ্যেই আবার উনারা দুজন কেবিনে চলে আসে।’
‘তাহলে কি আমি স্যারকে স্যুপ টা খাইয়ে,,,,
নার্সের কথা শেষ হওয়ার আগেই তাহমিনা হক তড়িঘড়ি করে বলেন,
‘না, না আপনাকে খাওয়াতে হবে না। আমি এহতেশাম কে খাইয়ে দিচ্ছি। আপনি দশ মিনিট পরে আসুন।’
নার্স চলে যেতেই স্যুপের বাটি টা হাতে নেন তাহমিনা হক। ছোট করে হা করতেই চামচে অল্প পরিমাণ স্যুপ নিয়ে মুখে তুলে দেন জামাল এহতেশামের।
‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মুরুব্বিদের বলতে শুনতাম যে আদা পঁচে গেলেও নাকি আদার ঝাঁজ থেকে যায়। তুমিও ঠিক সেই আদার মতোই।’
জামাল এহতেশাম মুখে কিছু না বলতে পারলেও আবারও রাগী চোখে তাকালেন তিনি।
‘সে তো তোমার বিজনেস পার্টনার। তার উপর উনার মেয়েকে তুমি ছেলের বউ করতে চেয়েছিলে। তারা কিভাবে চার পাঁচদিন গত হওয়ার পর তোমাকে দেখতে আসে? তোমার ক্রিটিকাল কন্ডিশন জানার পরও?’
জামাল এহতেশাম কয়েক মিনিট ব্যাপারটা ভাবলেন। তারপরই তাচ্ছিল্য চোখে চাইলেন তাহমিনা হকের দিকে।
এই তাচ্ছিল্যতার কারণ ধরতে সময় নিলেন না তাহমিনা হক। তাচ্ছিল্য চাহনির উত্তর তিনি রহস্যময় একটা হাসি দিলেন।
আরো এক চামচ স্যুপ জামাল এহতেশামের মুখের সামনে তুলে ধরে বলেন,
‘আমাদের অদেখাও অনেক কিছু থাকে আর,,,,,
এটা বলেই থামলেন তিনি। তারপর সুর টেনে গাইলেন,
‘চোখের দেখাও হতে পারে ভুল।’
____________________
টিউশন শেষ করে বের হয়েছে পিয়া। ক্লান্ত শরীরটা আর চলছে না। কয়দিন ধরে দুশ্চিন্তায় খাওয়া দাওয়াও হচ্ছে না ঠিকমতো। ব্যাগের ভেতর থেকে পানির বোতল বের ঢক ঢক করে পানি খেলো সে। তন্মধ্যেই পিয়ার সামনে একটা বাইক এসে থামল। ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো সে। মাথা থেকে হেলমেট নামাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রাগত স্বরে বলল,
‘এভাবে কেউ বাইক থামায়?’
তানভীর আলতো হেসে একহাতে কান ধরে।
‘স্যরি ম্যাম।’
তানভীরের অভিনয় দেখে মুখের রাগী ভাবটা উধাও হয়ে যায় পিয়ার। ফিক করে হেসে ফেলল সে।
‘হয়েছে ঢং করতে হবে না। চলুন এখন।’
বলেই উঠে বসল বাইকে। তানভীর আমতা আমতা করে নত স্বরে বলল,
‘বলছিলাম কি তোমাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আজ আর হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।’
ধপ করে বাইক থেকে নেমে গেলো পিয়া। রগড় গলায় বলল,
‘আপনি বাইক নিয়ে কোন চুলোয় যাবেন যান। আমি রিকশা করে ঠিক চলে যেতে পারবো। অফিস থেকে হাফ ডে ছুটি নিয়ে দর্শন দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এবার আসতে পারেন।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানভীর। আরো একটা হেলমেট পিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘নাটক শেষ হলে এবার বাইকে উঠে বসুন ম্যাডাম।’
____________
কেবিন ঢুকার জন্য পা দিলেই তাহমিনা হকের মুখোমুখি হয় তানভীর। পিছনে পিয়া দাঁড়িয়ে।
‘ওহ্! এসেছিস। আমারও একা একা লাগছিল।’
‘আসসালামু আলাইকুম মা।’
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’ একগাল হেসেই সালামের উত্তর দিলেন তাহমিনা হক। দু’কদম এগিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরেন পিয়াকে। পুনরায় বলেন,
‘রোজ সময় কর এসে আমার সাথে গল্প করো বলেই হাসপাতালে থাকতে পারছি। নয়তো কিভাবে যে থাকতাম।’
বলেই তপ্ত শ্বাস ফেলেন তিনি।
‘আমি তো থাকতে পারতাম আপনার সাথে। কিন্তু,,,
পিয়ার গালে হাত রাখেন তিনি। আদুরে গলায় বললেন
‘সব ঠিক হবে মা। তুমি আমাদের জন্য যা করেছো সেই ঋণই তো আমরা কখনো শোধ করতে পারবো না।’
পিয়া ফিচেল হাসলো। ক্লান্ত স্বরে বলে,
‘মা বাবাকে কখনো সন্তানের কাছে ঋণী থাকতে শুনেছেন?’
ভিজে ওঠে তাহমিনা হকের দুচোখ। বুকের সাথে মিশিয়ে নেন পিয়াকে।
‘দুপুরে খেয়েছেন মা? আপু এসেছিল?’
নাক টেনে উল্টো হাতে চোখের পানি মুছে নিলেন তিনি।
‘আফরিন এসেছিল। দুপুর হতেই চলে গেল। মিষ্টি টা এতো জ্বালাচ্ছিল। তাই আমিই বলেছি বাসায় যেতে।’
‘খেয়েছেন কিনা সেটা তো বললেন না।’
বলেই চোখ পিটপিট করে তাকাল পিয়া।
‘খেতে ইচ্ছে করে না রে। মানুষটাকে ওই অবস্থায় দেখে গলা দিয়ে যে খাবার নামে না।’ মেঘমেদুর স্বর তাহমিনা হকের।
‘এখন চলুন তবে৷’
‘ মাগরিবের আজান দিলো বলে। খাবো আমি।’
‘আমি দুপুরে খাইনি মা।’
ভীষণ মায়া হয় তাহমিনা হকের। স্নেহের সুরে বলেন,
‘আমি খাইয়ে দিলে খাবে?’
মাথা ঝাকায় পিয়া। সম্মতি পেতেই তিনি পুনরায় বলেন,
‘আফরিন আসার সময় দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছিল। ওগুলো নিয়ে আসি। তারপর ক্যান্টিনে গিয়ে খাবো।’
বলে ঘাড় ঘুরাতেই দেখলেন তানভীর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
‘তুই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তানভীর। শুকনো গলায় বলল,
‘না দেখছি আমার আদর কিভাবে কনভার্ট হয়ে আরেকজনের হয়ে যাচ্ছে। আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি অথচ তোমার কোনো হুঁশই নেই।’
‘আদর করতে করতে তো বয়স এখন ত্রিশের কোঠায়। আর কত? এরপর দেখবি পিয়ার আদরও কমে গেছে।’
থেমে গেলেন তিনি। এরপর হুট করে বলে বসলেন,
‘একটা নাতি নাতনি হয়ে গেলে তোদেরকেও আর আমার লাগবে না।’
#চলবে