উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব-১০

0
184

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব১০
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

দুপুরের কাঠ ফাটা রোদ। রোদের তাপে উত্তপ্ত ধরণী। হাওয়া বাতাসের ছিটেফোঁটাও দেখা নেই। এই কাঠ ফাটা রোদে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ি ফাঁকা বললেই চলে। সবাই গিয়েছে অভ্র ভাইয়ার বৌভাতে। বৌভাতের আয়োজন করা হয়েছে কনভেনশন হলে। বাড়িতে রয়ে গিয়েছে আম্মু, আমি আর দাদুমনি।

সকালে উঠে হাতের দিকে তাকাতেই অবাক হয়েছিলাম। হাতে ক্রিম এলো কিভাবে? পরক্ষনেই মনে পড়লো রাতে আমার ঘরে কেউ এসেছিলো। কে হবে সে? খাবার খেতে নিচে ডাকা হলে যেতেই আদ্র ভাই হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,
“হাত ঠিক আছে? জ্বালা কমেছে?”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। আদ্র ভাই আমার হাতের বিষয়ে জানলো কিভাবে? আদ্র ভাইয়ের কথা শুনে সবাই প্রশ্ন করা শুরু করলো। আমি ভীতু চোখে ইভান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। কি বলবো বুঝতে পারছি না। মিনমিনে স্বরে বললাম,
“গরম কফি খেতে গিয়ে হাতে পড়ে গেছে”

আদ্র ভাই কেমন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি কি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। বড় আম্মু বলল,
“আমাদের বললি না কোনো? দেখ হাতটার কি অবস্থা হয়েছে”

“আসলে তোমরা সবাই তখন ব্যস্ত ছিলে তাই ডাকিনি”

“যা হয়েছে হয়েছে। এরপর কিছু হলে সাথে সাথে আমাদের ডাকবি। এখন খেতে বস”

বড় আম্মু সকল কাজ ফেলে নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন আমায়। খাওয়া শেষে রুমে এসে বসেছি এমন সময় শুভ ভাই হাজির। এক গাদা জ্ঞান দিয়ে অতঃপর প্রস্থান নিলেন। অভ্র ভাইয়ের রিসেপশনে যাওয়ার জন্য সবাই জোরাজুরি করলেও যায়নি। শরীরটা ভালো লাগছে না। আমার আর দাদুমনির দেখাশোনার জন্য আম্মু রয়ে গেলেন।

ছাদে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় কারো আগমন হলো ছাদে। এই সময় বাড়িতে তো কেউ নেই তাহলে কে এলো ছাদে? পিছু ফিরে দেখি ইভান ভাই এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তাকে দেখে মনে ভয় জেঁকে বসলো। সে এগিয়ে আসছে আমি পিছিয়ে যাচ্ছি। আমি ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। একসময় ইভান ভাই কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“হাতের অবস্থা কেমন? খুব বেশি জ্বালা করছে বুঝি? কাছে আয় আমি ক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছি”

এমন সময় ওনাকে এখানে দেখে অবাক হলাম। ইভান ভাই এখানে কোনো? তার তো এখানে থাকার কথা না। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনি এখানে কোনো? সবাই তো বৌভাতে গিয়েছে”

“তোকে রেখে কি যাওয়া যায় বল যতো হোক তুই আমার হবু বউ বলে কথা। তার চেয়ে বড় কথা ছোটো মানুষ ভয় পাবি তাই ভাবলাম রয়ে যাই”

ইভান ভাইয়ের কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারছি না। তিনি যে আমার সাথে এতো ভালো ভাবে কথা বলবে সেটা আমার ভাবনায় আসেনি। আমি ভাবনার শহরে বিচরণ করছি এমন সময় ইভান ভাই কাছে এসে বাম হাত মুচড়ে ধরে বলল,
“কালকের ঘটনা যদি কাউকে বলেছিস তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না”

বলে হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমি তাকিয়ে আছি তার যাওয়ার দিকে। মানুষটা এতটা পাষান কেন? কাল যেই হাতে গরম কফি ফেললেন আজ আবার সেই হাতের আঘাত দিলেন। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে অবিরাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করবো না ইভান ভাই, কখনো না”

আরো কিছুক্ষণ সময় ছাদে থেকে নিজেকে শান্ত ঠিকঠাক করে নিলাম। রুমে যাবো তার আগে ইভান ভাইয়ের রুম। সেখানে কারো কথোপকথন শুনে থমকে গেলাম। আদ্র ভাই ইভান ভাইয়ের কলার ধরে আছেন। তার চোখ মুখে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। হাস্যজ্জল মানুষটাকে এর আগে এতটা রাগতে দেখিনি। ক্রধিত কণ্ঠে বললেন,
“এরপর ওর গায়ে যদি একটা আঁচড় পড়ে আমি ভুলে যাবো তুই আমার ভাই কিংবা বন্ধু। তোকে আমি ছাড়বো না ইভান”

এমন ঘটনায় অবাক হলাম। আদ্র ভাই ইভান ভাইয়ের চার মাসের বড়। তবে তাদের মাঝে সব সময় বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। কখনো একে ওপরের সাথে গলা তুলে কথা বলেনি। হটাৎ এমন কি হলো যে দুজন এরকম করছে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ইভান নামক মানুষটাকে নিয়ে আর ভাবতে চাই না। তাই সেখানে থেকে চলে এলাম।
——–

বিকেলে সব কাজিনরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। আমাকে অনেক বার ডাকা হলো। আসবো না আসবো না অবশেষে ইভার জোড়াজুড়িতে আসতেই হলো। ড্রয়িং রুমে আসতেই সবার আগে চোখ পড়লো ইভান নামক মানুষটার ওপর। তাকে দেখলেই তিক্ত অনুভূতি জেগে ওঠে। তাই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। ইভা খোঁচা দিয়ে বলল,
“কিরে ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি? বিয়ে হতে পারলো না এখনই ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিস”

আমি চোখ গরম করে ওর দিকে তাকালাম
ইভা ভদ্র মেয়ের মতো চুপ মেরে গিয়েছে। প্রিয়ম ভাবি আমাকে ডেকে তার কাছে নিয়ে বসালেন। মিষ্টি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“কেমন আছো রোদ? হাতের কি অবস্থা? জানো আজকে তোমাকে আমরা সবাই মিস করেছি। বাবা তো ইভান ভাইকে পাঠিয়েছিল তোমকে নেওয়া জন্য। তুমি গেলে না। আমরা সবাই অনেক কষ্ট পেয়েছি”

তারমানে ইভান ভাই নিজ থেকে আসেননি। এসেছিলেন বড় আব্বুর কথায়। তিনি তো আমাকে একবারও যাওয়ার কথা বললেননি।
“সরি ভাবি। শরীর টা ভালো ছিলো না তাই আরকি”

“থাক বাদ দাও। এখন তুমি সুস্থ আছো এই অনেক”

সবাই মিলে অনেক আড্ডা দিলাম। নতুন ভাবি মুহূর্তেই আমাদের সবার সাথে মিশে গিয়েছেন। আজকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি যাননি। আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে রাত হয়ে গেল। সবাই রাতের খাওয়া শেষে নিজেদের রুমে চলে এলাম। রুমে পায়চারি করছি। কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে ছাদে যেতে। খোলা আকাশের নিচে মুক্ত পাখির ন্যায় শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে। যেই ভাবা সেই কাজ। ছাদে আসতেই পা জোড়া থমকে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ইভান ভাই ফোনে কাউকে বলেছেন,
“আই লাভ ইউ। আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসছি তোমার কাছে। চিন্তা করো না। ইভান তোমার ছাড়া আর কারো হবে না। ইভান শুধু এবং শুধুই তোমার”

ইভান ভাই ফোন কেটে পিছু ঘুরতেই চমকে উঠলেন আমায় দেখে। তিনি এই সময়ে আমাকে এখানে আশা করেননি। সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। তার মুখোমুখি হয়ে প্ৰশ্ন করলাম,
“আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন ইভান ভাই?”

তার কোনো উত্তর নেই। নিরুত্তর তিনি। আমার মাঝে ঝড় বইছে। আরেকটু কাছে এগিয়ে চি*ল্লিয়ে বললাম,
“কি হলো? আমার কথার জবাব দিচ্ছেন না কোনো? আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন?”

এবার ইভান ভাই মুখ খুললেন,
“হ্যাঁ! আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি”

পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। এতদিন ভেবেছিলাম হয়তো ইভান ভাই আমাকে পছন্দ করে না তাই আমার সাথে এমন আচরণ করেছে। কিন্তু তার কারণ তাহলে এই ছিলো। ইভান ভাইয়ের শার্ট এর কলার ধরে বললাম,
“কোনো ইভান ভাই, কোনো? আপনি কোনো আমায় ভালোবাসলেন না? আমি কি দেখতে খারাপ? নাকি আমায় আপনার পছন্দ না? আপনি কোনো এমন করলেন ইভান ভাই, কোনো?”

চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। অশ্রুরা আজ বাঁধা মানছে না। ইভান ভাই উত্তর করলেন,
“আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। এটাই একমাত্র রিজন তোকে ভালো না বাসার”

“ভালোই যদি না বাসেন তাহলে সেদিন হাত পুড়ে যাওয়ায় আপনি ব্যাকুল হয়েছিলেন কেন ? কেন আমায় নিজের বুকে জড়িয়ে সান্তনা দিচ্ছিলেন? কেন আমার অগোচরে আমার গলায় লকেট পড়িয়ে আমার ঘরে উপহার রেখে এসেছিলেন। কেন আদ্র ভাইয়ের দেওয়া নুপুর পায়ে পড়েছিলাম বলে রাগ করে ছাদ থেকে চলে গিয়েছিলেন। তারপর আদ্র ভাইয়ের দেওয়া নুপুর খুলে নিজের হাতে নুপুর পড়িয়ে দিয়েছেন? কেন ? যদি ভালোই না বেসেন তাহলে কেন আমার কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়েছিলেন? আমি আমার ছেলে ফ্রেন্ড এর গাঁ ঘেঁষে ছবি তুলেছিলাম বলে আপনি এতো রিয়েক্ট কেন করেছিলেন? এতো শাসনই বা কেন ? ইভান ভাই কেন?”

“আমি জবাব দিতে বাধ্য নই”

“আপনাকে জবাব দিতেই হবে। আমাকে কি আপনার পুতুল মনে হয়? খেলতে ইচ্ছে হলে খেলবেন না ইচ্ছে হলে ছুড়ে ফেলে দিবেন?”

“তোর প্রতি একটা মায়া কাজ করছিলো। পরবর্তী অনুভব করলাম এটা শুধুই মোহ। আমি ভালোবাসি ইরা কে”

আমি ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছি ইভান ভাইয়ের দিকে।
“শুধুই কি মায়া আর মোহ?”

ইভান ভাই সম্পূর্ণ নিরুত্তর। তার মুখে কোনো কথা নেই। নীরবে কেটে গেল কিছু প্রহর। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ইভান ভাই নিশ্চুপে ছাদ ত্যাগ করলেন। এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম। কিছুক্ষন পর পাশে এসে কেউ দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখি আদ্র ভাই।
“আদ্র ভাই আমরা কেন ভুল মানুষের প্রেমে পড়ি?”

আদ্র ভাই আমার মুখ পানে তাকিয়ে আছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমরা কষ্ট পাওয়ার জন্য ভুল মানুষের প্রেমে পড়ি”

“তবে কি সারাজীবন আমাদের এই কষ্ট বয়ে বেড়াতে হবে?”

“উহু না। এটা সাময়িক কষ্ট। এক সময় আমাদের জীবনে সঠিক মানুষের আগমন ঘটবে। যে কিনা অতীতের সকল দুঃখ মুছে দিয়ে নিয়ে আসবে সুখের জোয়ার”

“সত্যিই কি তাই?”

“হ্যাঁ”

অতঃপর দুজনেই চুপ। আদ্র ভাই আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে দুহাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,
“রৌদ্রময়ীর চোখে অশ্রু মানায় না, মানায় তেজ। যেই তেজে ভস্ম হয়ে যাবে ওপর পক্ষ”

#চলবে?