উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব-২৪

0
173

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২৪
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা চারপাশ। ক্রমাগত পায়চারি করে যাচ্ছি আদিক থেকে ওদিক। মন মেজাজ কিছুই ভালো নেই। আদ্র ভাইয়ের হটাৎ এমন ম্যাসেজের কারণ বুঝতে পারছি না। হাস্যজ্জল মানুষটার হটাৎ করে কি হলো? আর এই ম্যাসেজের মানেই বা কি? কি বোঝাতে চাইছেন উনি? মাথায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ঝটপট কল লাগলাম আদ্র ভাইয়ের নাম্বারে। রিসিভ হতেই তড়িৎ গতিতে বলে উঠলাম,
“এগুলোর মানে কি আদ্র ভাই?”

“কোনগুলো?”

“এইযে তোমার ম্যাসেজের”

“জানিস রৌদ্রময়ী আমি না বড্ড ভীতু। তোকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমায় বারে বার গ্রাস করে। আমি যে ভয় পাই তোকে হারিয়ে ফেলতে, প্লিজ কখনো হারিয়ে যাস না। আমি নিঃস্ব হয়ে যাব তোকে ছাড়া”

“কি হয়েছে তোমার? এভাবে বলছো কেন? মাথা ঠিক আছে তোমার?”

“হটাৎ কেন যেন একরাশ ভয় জেঁকে ধরছে মনে হচ্ছে এই বুঝি আমি আমার রৌদ্রময়ীকে হারিয়ে ফেললাম। হাত বাড়িয়েও তোকে খুঁজে পাইনা। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে”

“আমি কখনোই হারাবো না। আমি তোমার আছি, আর তোমারই থাকবো। এই রোদ তোমার ছাড়া অন্য কারো হবে না”

ওপর পাশে আদ্র ভাই নীরব। মানুষটাকে এতটা বোঝাচ্ছি যে আমি তার তবুও সে বুঝছে না। তার অসহায় কণ্ঠ আমায় পীড়া দেয়। বুকের মাঝে অসহানীয় যন্ত্রনা হয়। আদ্র ভাই কাতর কণ্ঠে বলল,
“সারাজীবন আমার হয়েই থাকিস রৌদ্রময়ী”

“প্রমিস করলাম, তোমার হয়েই থাকবো”

আদ্র ভাই নিশ্চুপ। আমার আদ্র ভাই তো নিশ্চুপ থাকার মানুষ না। হটাৎ করে মানুষটার কি হলো? এমন আবোল তাবোল বকছে কেন? আর এমন নিস্প্রাণই বা কেন? তার এই মন খারাপ যে একটুও ভালো লাগছে না। আদ্র ভাইয়ের মুড অফ দেখে আমিই কথা বাড়ালাম। তবে উনি চুপচাপ। কিছু জিজ্ঞেস করলে ‘হু’, ‘হা’ উত্তর দিচ্ছে আবার চুপ মেরে যাচ্ছেন। কোনো কিছুতেই উনাকে স্বাভাবিক করতে পারছি না। ঘড়িতে সময় রাত একটা বেজে পনেরো মিনিট। সকালে ক্লাস আছে। আদ্র ভাইকে বিদায় জানিয়ে ফোন রাখতে যাবো এমন সময় তার কম্পিত কণ্ঠস্বর,
“আমার হয়েই থাকিস রৌদ্রময়ী। তোকে ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন”

সেই কণ্ঠে কি যে ছিলো আমি নিজেও জানি না। ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে ছুটে আদ্র ভাইয়ের কাছে চলে যাই। তাকে শক্ত করে আলিঙ্গনে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করি,
“কি হয়েছে তোমার আদ্র ভাই?”

কিন্তু সেই সুযোগ যে নেই। বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছি কিন্ত ঘুম আসার নাম নেই। আদ্র ভাইয়ের মুখটা শুধু চোখের সমানে ভেসে উঠছে। তার সেই করুণ কণ্ঠস্বর। চেয়েও ঘুমাতে পারছি না। এভাবে এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তার ঠিক নেই।
——-

অনবরত বেজে চলেছে এর্লাম। ঘুমে বিভোর আমার কোনো হেলদোল নেই। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশে থাকা এর্লাম খুঁজে চলেছি। কিন্তু হাতের নাগালে পাচ্ছি না। খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়ে গেলাম। এর্লাম বন্ধ করে আবার ঘুম দিলাম। রাতে ঘুম না হওয়ায় চোখ খুলতে পারছি না। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কোনো রকম চোখ কচলে বিছানা থেকে নামলাম। দেরি হয়ে গেছে। তাড়াহুড়া করে রেডি হচ্ছি। রেডি হওয়া শেষে নিচে নেমে দেখলাম ইভা আর শুভ ভাই নাস্তা করছে। ওদের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। আমি টেবিলে না বসে দরজার দিকে যেতে নিলে শুভ ভাই ডেকে উঠলো।
“খাবার না খেয়ে ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?”

“এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে এখন খেতে বসলে আরো দেরি হয়ে যাবে। আমি গাড়িতে যেয়ে বসছি। তোমরা এসো”

“আমাকে সময়ের জ্ঞান দিস না। পাশে এসে বস”

অগত্যা শুভ ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলাম। শুভ ভাই নিজের প্লেট থেকে আমায় খাইয়ে দিচ্ছেন। সাথে নিজেও খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে তিনজন মিলে বেরিয়ে পড়লাম মেডিকেলের উদ্দেশ্যে।

ক্লাসে আনমনে বসে রয়েছি। সামনে প্রফেসর সমান তালে বকবক করেই চলেছে। তবে আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমার মাথায় একটাই কথা ঘুরছে, ‘আদ্র ভাইয়ের কি হয়েছে?’। মাথা থেকে কথাটা বের করতে পারছি না। মনটা কেমন ছটফট করছে।একের পর এক ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু আমার বিন্দু মাত্র মনোযোগ নেই। আমার সকল চিন্তা যে একটা মানুষ কে ঘিরে। ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছি। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি। সময় যেন যাচ্ছে না। ক্লাস শেষ হতেই বেরিয়ে পড়লাম। ইভাকে বললাম তুই বাড়ি চলে যা আমি একটু আদ্র ভাইয়ের অফিসে যাবো। ইভা আমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে নিলো।
“আদ্র ভাইয়ের অফিসে তোর কি কাজ?”

“আমার দরকার আছে। তুই বাড়ি যা”

“আমি এখন লাইব্রেরিতে যাবো। তুই বাড়ির গাড়ি নিয়ে চলে যা। আমি পড়ে এসে পড়বো”

ইভার সাথে কথা বলছি এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সামনে ধরতেই আদ্র ভাইয়ের নাম্বার থেকে কল। মনটা ভালো হয়ে গেল। তারমানে উনিও আমায় মিস করছিলেন? খুশি মনে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশে থেকে কিছু তিক্ত কথা ভেসে এলো। কথা গুলো শুনে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল। মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। আর কিছু মনে নেই।
——–

পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে শুভ ভাইয়ের কেবিনে আবিষ্কার করলাম। মস্তিষ্কে চাপ দিতেই মনে পড়ে গেল সেই সময়ের কথা। আদ্র ভাইয়ের কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এক অপরিচিত লোকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
“ফোনের মালিকের অবস্থা খুবই খারাপ। গাড়ি এক্সিডেন্ট করছে। আপনার নাম্বার সবার ওপরে ছিলো তাই আপনাকে কল করলাম। তাড়াতাড়ি আপনারা আসুন”

আদ্র ভাই এক্সিডেন্ট করেছে? এখন উনি কোথায়? কি অবস্থায় আসছেন? বেড থেকে নেমে যাওয়া ধরলাম এমন সময় হাতে টান লাগলো। তাকিয়ে দেখি হাতে স্যালাইন লাগানো। সাবধানে স্যালাইন খুলে হন্তদন্ত হয়ে কেবিন থেকে বের হতে নিবো এমন সময় কারো সাথে ধাক্কা লাগলো। তাকিয়ে দেখলাম শুভ ভাই। শুভ ভাইয়ের মুখে কেমন আঁধারে নেমে আছে।
“তুই নেমে কোথায় যাচ্ছিস? স্যালাইন খুলেছিস কেন? তোর শরীর ঠিক নেই, বেডে যেয়ে বস। আমি স্যালাইন লাগিয়ে দিচ্ছি”

“আমি বেডে যাব না। আদ্র ভাই এক্সিডেন্ট করেছে আমাকে ওনার কাছে যেতে হবে। তুমি সরো আমি আদ্র ভাইয়ের কাছে যাবো। আদ্র ভাইয়ের নিশ্চই কষ্ট হচ্ছে”

“পাখি যেটা বলছি সেটা শোন”

শুভ ভাইকে একপ্রকার ঝাড়ি দিয়ে বললাম,
“তোমায় বললাম তো আমি আদ্র ভাইয়ের কাছে যাবো। সরো”

শুভ ভাইকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই তিনি বলে উঠলো,
“আদ্র ওটিতে। অপারেশন চলছে। ওর অবস্থা বেশি ভালো না”

স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শুভ ভাই কি বলছে এসব? আমার আদ্র ভাইয়ের কিছুই হতে পারে না।
“কি বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার? আমি আদ্র ভাইয়ের কাছে যাবো”

“হ্যাঁ! আমার মাথা ঠিক আছে। তুই জ্ঞান হারানোর পর ইভা ফোন ধরে। সাথে সাথে কল লাগায় আমাকে। আমি দ্রুত সেখানে পৌঁছায়। আদ্র অবস্থা ভালো না। তাড়াতাড়ি করে ওকে নিজের গাড়িতে করে হসপিটালে নিয়ে আসি। ওর অপারেশন আমার করার কথা ছিলো কিন্তু আমি দেখলাম আমার হাত কাঁপছে। জীবনে এতো এতো অপারেশন করেছি কিন্তু এই প্রথম বার আমার হাত কাঁপছে। নিজের ভাইয়ের অপারেশন আমি করতে পারছি না। নিজেকে ব্যর্থ ডক্টর মনে হচ্ছে। তাই ডক্টরদের কাছে দায়িত্ব দিয়ে চলে এসেছি”

আমি নিশ্চল চোখে তাকিয়ে আছি শুভ ভাইয়ের দিকে। কিছুই যেন আমার মাথায় ঢুকছে না। আমাকে আদ্র ভাইয়ের কাছে যেতে হবে। এখনই যেতে হবে। শুভ ভাইকে বললাম,
“আমি আদ্র ভাইয়ের কাছে যাবো। আমাকে নিয়ে চলো”

শুভ ভাই আমাকে আটকাচ্ছে। কিন্তু আমি কথা শুনলে তো। আমার একটাই কথা আমি আদ্র ভাইয়ের কাছে যাবো।
“তোর শরীর দুর্বল। তুই স্যালাইন টা শেষ কর তারপর নিয়ে যাবো”

আমি কিছুতেই শুভ ভাইয়ের কথায় রাজি হচ্ছি না। আমার পাগলামি রীতিমতো বেড়েই চলেছে। তাই শুভ ভাই কোনো উপায় না পেয়ে আমায় ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিলো। আস্তে করে শুভ ভাইয়ের গাঁয়ে ঢোলে পড়লাম।
——-

আশেপাশে ফিনাইলের গন্ধ। শুভ্র চাদরে মোড়ানো বেডে নিস্প্রাণ হয়ে শুয়ে আছে আদ্র ভাই। তার চেহারায় মলিনতার ছাপ। মানুষটা কি সুন্দর চোখ বুঝে ঘুমিয়ে রয়েছে। তবে এদিকে ঘুম নেই কতো গুলো মানুষের চোখে। আদ্র ভাইয়ের এই অবস্থার কথা শুনে ফুপ্পি কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছে। একমাত্র আদরের ছেলে বলে কথা। বাড়ির সবাই এসে হসপিটালে ভীড় জমিয়েছে। রাত হওয়ায় শুভ ভাই জোর করে সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সকালে আসতে বলেছে। হসপিটালে রয়ে গেছি আমি আর শুভ ভাই। ফুপ্পি যেতে চায়নি তাকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছি। ফুপ্পির অবস্থাও কাহিল। আম্মুরা মিলে তার দেখাশোনা করলে ঠিক হয়ে যাবে। আমি বসে আছি আদ্র ভাইয়ের পাশে। শুভ ভাই রাউন্ডে গিয়েছি পেসেন্ট দেখতে। আমি এক মনে তাকিয়ে আছি আদ্র ভাইয়ের নিস্প্রাণ মুখের দিকে। ভাবছি সেই সময়ের কথা।

ঘুম ভেঙ্গলে মুহূর্তে ব্যায় না করে আদ্র ভাইয়ের কাছে চলে এলাম।শুভ ভাইও এবার আমায় আটকায়নি। আদ্র ভাইয়ের কেবিনের বাহিরে সবাই ভীড় করে বসে আছে। সবার চোখে অশ্রু। আদ্র ভাই মানুষটা সবার অনেক ভালোবাসার। তার এই অবস্থায় সবার চোখে অশ্রু থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ডক্টর বলেছে খুব শীঘ্রই আদ্র ভাইয়ের জ্ঞান ফিরবে। সবাই সেই আশায় বসে আছে। আদ্র ভাইয়ের জ্ঞান ফিরলে সবাই একে একে দেখা করতে গেলেও আমি আসিনি। কারণ আমি জানি আমি তার এই অবস্থা সহ্য করতে পারব না। ভালোবাসার মানুষকে করুণ অবস্থায় দেখার সাহস যে আমার নেই। সবাই চলে গেলে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।আদ্র ভাইকে হাই ডোজের ওষুধ দেওয়ায় সে ঘুমিয়ে আছে। আদ্র ভাইকে এই অবস্থায় দেখে চোখ থেকে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। নিঃশব্দে আদ্র ভাইয়ের পাশে যেয়ে বসলাম।

আদ্র ভাইর হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলে উঠলাম,
“আদ্র ভাই! এই আদ্র ভাই। ওঠো না। এই দেখো তোমার রৌদ্রময়ী তোমায় ডাকছে। তুমি তার ডাকে সারা দিবে না? আমার আদ্র ভাই তো এতো নিষ্ঠুর না। তবে আজকে কেন তুমি এতটা নিষ্ঠুর হলে। কথা বলো তোমার রৌদ্রময়ীর সাথে। আমায় এভাবে কাঁদতে দেখে তোমার কষ্ট হচ্ছে না? তুমি না বলো তোমার রৌদ্রময়ীর চোখে অশ্রু মানায় না। তাহলে এখন তুমি কেন তার অশ্রু নিজ হাতে মুছে দিচ্ছ না? ওঠো আদ্র ভাই ওঠো। এই আদ্র ভাই। দেখো আমি তোমায় ভাই বলে ডাকছি। তুমি রাগ করবে না? মুখ ফুলাবে না? ওঠো না আদ্র ভাই”

আমার এতো আহাজারিও যেন আদ্র ভাইয়ের কানে যাচ্ছে না। উনি ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। হটাৎ কেউ কাঁধে হাত রাখলো। পিছনে তাকিয়ে দেখি শুভ ভাই। শুভ ভাইয়ের চোখে প্ৰশ্ন। অতঃপর শুভ ভাই জিজ্ঞেস করেই বসলো,
“ভালোবাসিস আদ্রকে?”

#চলবে?