উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব-৩৭+৩৮

0
175

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৩৭
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

নিস্তব্ধতায় ঘেরা পুরো ড্রয়িং রুম। কোথাও নেই কোনো শব্দ। মনে হচ্ছে নীরবতা পালন করা হচ্ছে। মাথা নিচু করে ড্রয়িং রুমে সবার সামনে বসে আছি। মেজাজ পুরো খারাপ। ইচ্ছে করছে আদ্র কে হাতের কাছে পেলে ইচ্ছে মতো ধোলাই দিতাম। সেই সময়ের ঘটনা, রোশনি কথা গুলো বলে চলে গেল। আমি হতবাক, হতোভম্ব হয়ে বসে আছি। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আমাকে দেখে মনে হবে ঘোরের মাঝে ডুবে গিয়েছি। ইভা পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কিরে কিছু বলছিস না কেন? রোবট হয়ে গিয়েছিস? নাকি অনুভূতিহীন হয়ে গেছিস?”

আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কি বলবো বুঝতে পারছি না। ইভা আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“রোদ শুনতে পাচ্ছিস ওই হাদারাম গাধা তোকে দেখতে এসেছে। কিছু কর আদ্র ভাইকে কল দে। তাকে জানা বিষয়টা”

এবার আমার ধ্যান ভাঙলো। হন্তদন্ত হয়ে ফোন খুঁজছি। অতঃপর পেয়েও গেলাম। হাত পা কেমন কাঁপছে। হটাৎ করে বুকের মাঝে আদ্র কে হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে আদ্রর নাম্বার ডায়াল করলাম। প্রথমবার রিসিভ হলো না। ফের ফোন লাগলাম। রিসিভ করতেই উনাকে বলতে না দিয়ে তড়িৎ গতিতে বলে উঠলাম,
“আদ্র ভাই কোথায় তুমি? বাড়ি এসো জলদি”

ওপর পাশ থেকে শান্ত কণ্ঠে ভেসে এলো,
“আগে ভাই বলা বন্ধ কর। আমি তোর জামাই লাগি ভাই না”

“জামাইয়ের গুষ্টি কিলাই। তুমি ফাও পেচাল বাদ দেও। এখন আগে আমার কথা শোনো ঈশিতা আপুরা এসেছে বাসায়”

“ভালো তো, এখানে এতো হাইপার হওয়ার কি আছে। ওর বাবার বাড়ি ও বেড়াতে এসেছে”

এবার কিছুটা ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠলাম,
“তুমি চুপচাপ আমার কথা শুনবে? নাকি কল কেটে দিবো”

“ঠিক আছে বল শুনছি”

“ঈশিতা আপুর শশুর-শাশুড়ি, তার দেবর চাচা শশুর-শাশুড়ি এসেছে আমাকে তাঁদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে”

ওপর পাশের মানুষটা নিশ্চুপ। তার কোনো কথা নেই। ওনার কোনো আওয়াজ না পেয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“শুনছো?”

“হ্যাঁ শুনেছি। তুই এতো হাইপার না হয়ে আগে এক গ্লাস পানি না। এই বেহুদা টেনশন করে যদি অসুস্থ হয়েছিস তাহলে তোর খবর আছ বলে দিলাম”

তার এই শান্ত রূপ এই মুহূর্তে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো। মেজাজ এমনি খারাপ তার ওপর ওনার শান্ত রূপ মেজাজটাকে আরো খারাপ বানিয়ে দিচ্ছে।
“আমি তোমাকে কি বলছি আর তুমি কি বলছো?”

“তোকে আগে যেটা বলেছি সেটা কর। পানি খা”

আমি উঠে টেবিলে থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম।
“খেয়েছি, এখন বলো”

“এখন কল কেটে গোসল করে খেয়ে দেয়ে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে ওদের সামনে যা, বাকিটা আমি দেখছি”

“তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমি আবার ওতি শোকে পা*গল হওনি তো? আমি ওদের সামনে শাড়ি পড়ে যাই আর ওরা আমায় ওদের ছেলের বউ করে নিয়ে যাক আর তুমি বসে বসে দেখতে থাকো”

আদ্র ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
“তোকে যেটা বলেছি সেটা কর। আমি আছিতো নাকি? আমি থাকতে তোর কিসের এতো টেনশন? পিচ্চি মাথায় এতো টেনশন না নিয়ে রিলেক্স থাক আমি আছি তো”

কিছু বললাম না।ওনার মনে হয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওনাকে আমি বলছি এক উনি বুঝছেন আরেক। ফের বলল,
“মাথা থেকে এসব আউল ফাউল টেনশন ঝেরে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করে শাড়ি পড়ে বউ সেজে রেডি হ। আমি আসছি”

রাগ করে কল কেটে দিতে যাবো এমন সময় তার বিরবির কণ্ঠে শুনতে পেলাম,
“বেটা বেশি বেড়েছে তাই না? আদ্রর রৌদ্রময়ীর দিকে হাত বাড়ানো জাস্ট ওয়েট। আমার বউকে বিয়ে করতে চাওয়ার শখ মিটিয়ে দিবো জনমের মতো”

আরো কিছু শুনবো তার আগেই কলটা কেটে গেল। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। ইভা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলল আদ্র ভাই?”

“তোর আদ্র ভাই অতি শোকে পা*গল হয়েছে। আমাকে বলেছে সেজেগুঁজে ওদের সামনে যেতে”

ইভা ভাবুক হয়ে বলল,
“আদ্র ভাই যেহেতু বলেছে তারমানে সে নিশ্চই কোনো কিছু করবে। তুই চিন্তা করিস না”

ইভা নিজের রুমে চলে গেল। আমিও সকল চিন্তা বাদ দিয়ে গোসল করতে চলে গেলাম। বের হয়ে চুল মুছচ্ছি এমন সময় রুমে আম্মুর আগমন। হাতে কয়েকটা শাড়ি নিয়ে এসেছে। শাড়ি গুলো বিছানার ওপর রেখে বলল,
“এখান থেকে যে কোন একটা পড়ে রেডি হয়ে নে”

আম্মুর কথার বিপরীতে কিছু বললাম না। মাথা নাড়িয়ে সায় জানালাম। আম্মু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো বুঝতে পারছে না তার মেয়ে এতো ভালো হলো কবে থেকে। কারণ কোনো প্রশ্ন ছাড়া এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়ার মেয়ে আমি না। আম্মু কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চলে গেল।
বিছানায় বসে শাড়ি গুলো উল্টে পাল্টে দেখছি এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপর পাশ থেকে আদ্র মহাশয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“শাড়িগুলোর মধ্যে যে নীল শাড়ি আছে ওটা পড়ে আসবি”

বলেই ফট করে কল কেটে দিলো। আমি বেক্কেলের মতো ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলাম। এই লোক কি সত্যি সত্যি পা*গল হলো? নিজের বিয়ে করা বউকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে উনি তাঁদের বাধা না দিয়ে উল্টো তাঁদের সামনে পড়ে যাওয়ার জন্য আমায় শাড়ি সিলেক্ট করে দিচ্ছে? আমি শিওর এই লোক পা*গল হয়ে গেছে। রাগে বিরবির করতে করতে শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাজল পড়ছি এমন সময় ইভা আর রোশনি রুমে ঢুকলো। দুজনের মুখে লেগে আছে হাসি। ওদের হাসি দেখে কপাল কুঁচকে গেল। একটু আগেই না ইভা মেজাজ খারাপ নিয়ে গেল। এতটুকু সময়ের মাঝে কি এমন হলো যে এদের মুখে বিশ্ব জয় করা হাসি লেগেছে আছে? কারণ কি? ওদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কিরে হাসছিস যে? এতো হাসি আসছে কথা থেকে?”

“সেটা বলা যাবে না”

“কেন?”

রোশনি বলল,
“বড় আব্বু তোমায় নিয়ে যেতে বলেছে। সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে”

বুঝতে পারলাম এদের জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই। তাই নিজেকে শেষ বারের মতো আয়নার দেখে নিয়ে বললাম,
“চল”

বলে সামনে আগাতে নিলে ইভা আটকে দিলো। কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকালাম।
“মাথায় কাপড় না দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? আগে মাথায় কাপড় দে”

“এমনি মেজাজ খারাপ, তুই আর খারাপ করিস না”

ইভা কিছু না বলে নিজ দায়িত্বে মাথায় কাপড় দিয়ে দিলো। দুজন দুপাশ থেকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে আমি হাঁটতে পারিনা। তাও কিছু বললাম না। চুপচাপ ওদের সাথে যেতে লাগলাম। আমায় নিয়ে ইভা সিঙ্গেল সোফায় বসিয়ে দিলো। ইচ্ছে নেই মুখ তুlলে সামনের মানুষ গুলোকে দেখার। মাথ নিচু করে বসে আছি। তবে আশেপাশে সবাইক যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পারছি। নিজেকে কেমন ভিন্ন গ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। হটাৎ কেউ বলে উঠলো,
“মা মুখটা একটু তোলো তো, তোমার চাঁদ বরণ মুখটা একটু দেখি”

কণ্ঠস্বরটা আমার বড্ড চেনা। তড়িৎ গতিতে মুখ তুলে তাকালাম। সামনের মানুষ গুলো যে আমার বড্ড কাছের। আমার সামনে ফুপ্পি, ফুফা, আরু,আদ্র আর আদ্রর দাদুমনি বসে আছে। আমি অবাক চোখে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। ওরা কখন এলো? আর এখানেই বা কি করছে? এখানে তো এই হাদারাম গাধা আর তার ফ্যামিলির থাকার কথা ছিলো। আর আমার সাথে হচ্ছে টাই বা কি? আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব। আমার অবস্থা দেখে সবাই একসাথে উচ্চস্বরে হেসে দিলো। ওদের হাসতে দেখে কিছুই বুঝতে পারলাম না। নিজেকে কেমন ভিন্ন গ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে। এখানে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কেমন মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আড়চোখে তাকালাম আদ্রর দিকে। মহাশয় আয়েস করে সোফায় গাঁ এলিয়ে বসে আছে। আদ্রর পরনে কালো শার্ট কালো প্যান্ট, কোর্ট খুলে পাশে রাখা, একদম ফর্মাল লুক যাকে বলে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো, হাতে কালো ঘড়ি, চুলগুলো গুছিয়ে রাখা পুরো হিরোর মতো লাগছে। ওনার বসার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে শশুরবাড়ি এসেছে এমন ভাব তার। ভেবে দেখলাম এটা তো তার শশুর বাড়িই। আদ্র সবার চোখের আড়ালে চোখ টিপে দিলেন। আমি রক্তিম চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। ফুপ্পি গম্ভীর মুখ করে বলে উঠলো,
“বড়দের সামনে এসে সালাম দিতে হয় এটা জানো না? ভদ্রতা শেখোনি?”

ফুপ্পির কথা শুনে জিভে কামড় দিলাম। এদের একেক জনের একেক রূপ দেখে ক্ষনে ক্ষনে অবাক হচ্ছি। আজ মনে হয় আমার অবাক হওয়ার দিন। মিনমিনে স্বরে সালাম দিলাম। সালামের উত্তর দিয়ে দাদুমনি বলে উঠলো,
“তা মেয়ে ঘরের সব কাজ জানো তো? রান্না বান্না, ঘর সামলানো”

“জি পারি”

ফুপ্পি ফের জিজ্ঞেস করলো,
“মেয়ে একটু হেটে দেখাও তো? আর চুলগুলো দেখি তো কতোটুকু। এখনকার মেয়েদের মতো কেটে ছোটো করে ফেলোনি তো? আমার ছেলের আবার লম্বা চুলের মেয়ে পছন্দ”

ফুপ্পি কথাগুলো বলে মিটিমিটি হাসছে। ইভা মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে চুলের ক্লিপ খুলে দিলো। সাথে সাথে চুলগুলো ঝরঝর করে পিঠে ছড়িয়ে গেল। উঠে সুন্দর করে হেটে দেখালাম।
“হয়েছে বসো বসো। না চুল মাশাআল্লাহ লম্বাই আছে”

ভদ্র মেয়ের মতো যেয়ে বসে পড়লাম। এরা একেক জন একেক কথা জিজ্ঞেস করছে আর আমি বসে বসে সেগুলোর উত্তর দিচ্ছি। আদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমার অবস্থা দেখে হাসা হচ্ছে তাই না? সব হাসি আমি বের করবো, অ*সভ্য লোক কোথাকার! হুট্ করে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিলেন। চোখ গরম করে ওনার দিকে তাকালাম। উনি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন। আমি পারছি না ওনার চুল গুলো টেনে দিতে। বজ্জাত লোক একটা। এগুলো যে ওনার বুদ্ধি সেটা বুঝতে দেরি হলো না। সব আমায় হেনস্থা করার পয়তারা। ওয়েট সব সুধে আসলে তুলবো। বাকি সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওরাও মুচকি মুচকি হাসছে। আমি তাকাতেই সবাই চুপ করে গেল। সব প্রশ্ন শেষে ফুফা বলল,
“ভাই সাহেব আপনাদের মেয়ে আপনাদের পছন্দ হয়েছে। এখন দুজন কে আলাদা করে কথা বলতে দিলে ভালো হয়। ওদের টা ওরা বুঝে নেক”

বড় আব্বু ফুফার কথায় সম্মতি জানিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“রোদ মা আদ্র বাবা কে নিয়ে তোমার রুমে যাও তো”

উঠে গট গট পায়ে হাঁটা দিলাম। পিছু পিছু ইভা রোশনি আর আদ্র এলো। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। দরজার সামনে থেকে ফিসফিস কণ্ঠে শুনতে পেলাম ইভা বলছে,
“গুড লাক ভাইয়া। ভিতরে তোমার জন্য বারুদ অপেক্ষা করছে। বেঁচে ফিরলে দেখা হবে”

“এভাবে ভয় দেখাচ্ছিস কেন? দোয়া কর যেন বেঁচে ফিরতে পারি। আর না ফিরলে দুয়া মে ইয়াদ রাখনা”

আদ্র দুঃখি দুঃখি মুখ করে কথা গুলো বলল। অতঃপর ওদের বিদায় দিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে রুমে ঢুকলো।

#চলবে?

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৩৮
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

পুরো রুম এলোমেলো, রুমের অবস্থা নাজেহাল। এদিক ওদিক বালিশ, কুশন সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আদ্র এক কোণে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে উনার ভয়। ইভাদের থেকে বিদায় নিয়ে রুমে ঢুকেছে বেচারা। আমি রক্তিম চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। সেই চাহনি দেখে শুকনো ঢোক গিললো উনি। বেচারা যে ভয় পেয়েছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিন্তু আজকে কোনো ছাড় নয়। উনাকে বুঝতে হবে আমি তখন কতটা ভয় পেয়েছিলাম। উনাকে হারে হারে টের পেতে হবে। শাড়ির আঁচল তুলে কোমরে গুঁজে নিলাম। সেটা দেখে আদ্র ফাঁকা ঢোক গিলে বিরবির করে বলে উঠলো,
“আদ্র আজকে তোর কপালে শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, সব আছে। বউ আজকে সেই খেপেছে। এতটা ক্ষেপানো ঠিক হয়নি”

এদিক সেদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। শেষে কিছু না পেয়ে বিছানা থেকে বালিশ তুলে নিলাম। একপা একপা করে আদ্রর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আর উনি পিছিয়ে যাচ্ছে। একসময় বিছানার সাথে বেঝে বিছানায় পড়ে গেল। আমি কোলবালিশ দিয়ে উরাধুরা মারছি তাকে। আদ্র না পারছে আমাকে আটকাতে আর না পারছে উঠতে। নিজেকে বাঁচাতে বলে উঠলো,
“আরে বউ মারছিস কেন? আমিতো ভালোর জন্যই বলেছিলাম। যে সুন্দর করে বউ সেজে রেডি হো আমি আসছি”

“তুমি বলেছো তাঁদের সামনে যেতে”

“তাঁদের সামনে যেতে বললেই তোকে যেতে দিবো নাকি?”

“সেটা আগে বলোনি কেন?”

“বলিনি বলে এভাবেই মারবি? আর একটা মা*ইর পড়লো কিন্তু জামাই নির্যাতনের মামলা করে দিবো”

“তোমার মালার গুল্লি মারি বজ্জাত লোক। জানো কতো টেনশনে ছিলাম আমি? আমার মনের মাঝে কিছু ঝড় বইছিলো? মনের মাঝে তোমাকে হারানোর ভয় কাজ করছিলো। কিন্তু তুমি সেটা বুঝলে তো?”

আদ্র কে বালিশ দিয়ে মারতে গিয়ে শাড়িতে পা স্লিপ করে ওনার ওপর পড়ে গেলাম। আদ্র নিজের কোমরে হাত দিয়ে ব্যাথাতুর স্বরে বলে উঠলো,
“এতক্ষন মে*রেও শান্তি হয়নি? এখন কোমর ভাঙতে চাইছিস?”

“কোমর ভাঙা তো সামান্য বিষয় আমি তো তোমায় খু*ন করবো”

আদ্র হাত বাড়িয়ে আমার মুখের ওপর পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিলো। চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,
“পারবি আমায় খু*ন করতে? হাতে কাঁপবে না”

উনার এই কথা শুনে থমকে গেলাম। চোখ আটকে গেল ওনার ঝিল সম চোখে। এই মানুষটাকে খু*ন তো দূরে কথা তার সামান্য কিছু হলেই তো আমি পা*গল হয়ে যাবো। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আদ্র উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আর এদিকে আমার উত্তরের কোঠা শুন্য। কোনো জবাব না দিয়ে মাথায় এলিয়ে দিলাম তার বুকে। এই মানুষটা ছাড়া আমার চলবে না। আমার আশেপাশে সব সময় তাকে চাই। আমায় আস্কারা দেওয়া জন্য, শাসন করার জন্য, আবদার পূরণ করার জন্য, আমার সকল কিছুতে উনাকে আমার চাই। আদ্র বুঝতে পারলো আমার নীরবতা। আমার মাথাটা নিজের বুকে আরো একটু চেপে ধরে মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো রৌদ্রময়ী থেমে গেলি কেন? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস? আরে বোকা মেয়ে আমি তো মজা করে কথাটা বলেছি সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন?”

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। চুপচাপ মিশে রইলাম তার প্রশস্ত বুকে। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তো জানি আমার রৌদ্রময়ী আমায় কতটা ভালোবাসে। সে আমায় আঘাত করতেই পারে না। আমি তো এমনি কথার কথা জিজ্ঞেস করলাম। যা সরি, এই দেখ কান ধরছি”

আমি তাও কোনো রিয়েকশন দিলাম না। আদ্র বুঝতে পারলো আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। একটু সময় নিয়ে কি যেন ভাবলো। অতঃপর উনি আমায় ঘুরিয়ে নিচে ফেলে নিজের আমার ওপর ভর দিয়ে বলে উঠলো,
“এতোক্ষণ তো আমায় মা*রা হচ্ছিলো, এখন আমি মা*রি? দেখি কেমন লাগে?”

পাশ থেকে বালিশ দিয়ে মারতেই নিবে তার আগে আমি ওনাকে আমার ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলাম। দুজন মুখোমুখি এখন। আমিও পাশ থেকেই বালিশ নিয়ে নিলাম। উনার দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“আমায় অন্য ছেলের সামনে শাড়ি পড়ে বউ সেজে বসতে বলা হচ্ছিলো তাই না? সে বেলায়”

“তাই বলে তুই আমার মারবি?”

“একশোবার মারবো”

“ঠিক আছে দাড়া”

আদ্র বালিশ দিয়ে আমার বাহুতে মারলো। আমিও পাল্টা দিলাম। শুরু হয়ে গেল আমাদের মারামারি। বালিশ দিয়ে যে যাকে ইচ্ছে মারছি। মারামারি করতে করতে দুজন পুরো রুমে ছুটোছুটি করছি।পুরো রুম এলোমেলো করে ফেলেছি, রুমের অবস্থা নাজেহাল। এক সময় হাপিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আদ্রও ক্লান্ত হয়ে পাশে শুয়ে পড়লো। দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। হটাৎ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। এমন সময় বাহির থেকে ইভার কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আদ্র ভাই ঠিক আছো? নাকি দুয়া মে ইয়াদ কারু?”

“এবারের মতো বেঁচে গেছিরে বনু”

“বেঁচে গেলে নিচে এসো সবাই ডাকছে তোমাদের”

“ঠিক আছে তুই যা আমরা আসছি”

আদ্র বিছানা থেকে উঠে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
“আমি যাবো না তুমি যাও”

“কেন যাবি না?”

“সবার সামনে যেতে লজ্জা লাগবে”

“লজ্জা সাইডে ফেলে উঠ দেখি”

হাত ধরে এক টান দিয়ে উঠিয়ে দাঁড় করালো। আমায় দাঁড় করিয়ে নিজে নিচে বসে গেল। সুন্দর করে একটা একটা করে আমার এলোমেলো হয়ে যাওয়া কুচি গুলো ঠিক করে দিলো। আমি এই মানুষটাকে যতবার দেখি ততবার অবাক হই। তার সব দিকে নজর। শাড়ি ঠিক করে দিয়ে আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“এবার চল”

আদ্র আমার হাত ধরা অবস্থায় নিচে নামলো। সবার সামনে এভাবে হাত ধরায় কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। তাই হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম কিন্ত উনি ছাড়লে তো। চোখ রাঙিয়ে বলল,
“হাত ওরকম সাপের মতো মুচড়াচ্ছিস কেন?”

“হাত ছাড়ো। সবার সামনে হাত ধরে রাখা বিষয়টাতে লজ্জা লাগছে আমার”

আমরা ফিসফিস করে কথা বলছি এমন সময় ফুফা আমাদের দিকে তাকিয়ে বড় আব্বুকে বলল,
“আমার মনে হয় ওরা দুজনেই রাজি। তাহলে আজকে দুজনের এনগেজমেন্টটা হয়ে যাক। কি বলেন ভাইজান?”

বড় আব্বু একবার আব্বুর দিকে তাকালো। আব্বু সায় জানাতেই বড় আব্বুও রাজি হয়ে গেল। আমাদের দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করানো হলো। ফুপ্পি একটা রিংয়ের বক্স আদ্রর দিকে এগিয়ে দিলো। আদ্র রিংটা হাতে নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। আমি আব্বু আম্মুর মুখের দিকে তাকালাম। দুজনের থেকে সম্মতি নিয়ে হাত এগিয়ে দিলাম। আদ্র খুব যত্নে হাতের অনামিকায় আংটি পরিয়ে দিলো। বড় আব্বু আমার হাতে একটা রিং তুলে দিয়ে ইশারা করলো আদ্র কে পড়িয়ে দিতে। আমি হাত বাড়ানোর আগেই উনি নিজের হাত বাড়িয়ে দিলেন। সবার দিকে একবার তাকিয়ে ওনার হাতে রিং পড়িয়ে দিলাম। আজকের দিনটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। বাড়ির সবাই এতো সহজে মেনে নিলো ভাবতে পারছি না। এর পিছনে নিশ্চই আদ্রর কোনো হাত আছে। সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। আরু তো এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
“ফাইনালি তুমি আমার ভাবি হতে চলেছো আপি। তোমার ভাবি বানানোর আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো”

সবার সামনে এভাবে বলায় কিছুটা লজ্জা পেলাম। ফুপ্পি এক প্রকার ধমক দিয়ে বলল,
“এভাবে বলতে নেই আরু দেখছো না ভাবি কেমন লজ্জায় পাচ্ছে, বেচারি লজ্জা লাল নীল হয়ে যাচ্ছে”

আমার ফুপ্পিও যে আমায় লজ্জা দিচ্ছে সেটা বুঝতে দেরি হলো না। আজকে কি আমার লজ্জা আর সারপ্রাইজ পাওয়ার দিন নাকি? কে জানে। ফুপ্পি আমায় নিজের কাছে টেনে নিলো। কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“তুই আমার মেয়ে ছিলিস আর আজীবন মেয়েই থাকবি। শুধু আমার ছেলেটাকে একটু আগলে রাখিস। বেচারা তোকে অনেক ভালোবাসে”

শেষে কিনা শাশুড়ির মুখে আমায় তার ছেলের ভালোবাসার কথা শুনতে হচ্ছে? আদ্র ফুপ্পির সাথে ফ্রি প্রায় সব কথাই শেয়ার করে। আমি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালাম। ফুপ্পি আমায় জড়িয়ে নিলো তার সাথে। এর মাঝেই ডাক পড়লো খাবার খাওয়ার। সবাই একে একে যেয়ে বসে পড়লো। আমার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। হুট্ করে সব লজ্জা মনে হয় আমার ওপরই ভর করেছে। লজ্জা বাদ দিয়ে খেতে বসে পড়লাম।

ড্রয়িং রুমে আড্ডার আসর বসেছে। ফুপ্পিরা খেয়ে চলে যেতে চাইলেও যেতে দেওয়া হয়নি। বিকেলে আমার আর আদ্র বিয়ের ডেট ফিক্স করা হবে। তাই ওদের রেখে দেওয়া হয়েছে। সবাই এটা ওটা বলে আমায় খোঁচাচ্ছে। এদের খোঁচা শুনে আমার অবস্থা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ টাইপ। ঈশিতা আপু, ভাবি, ইভা, অভ্র ভাই সবাই মিলে আমার পিছু লেগেছে। লজ্জা দিচ্ছে আমায়। আদ্রকে বললেও সেগুলো ওনার গাঁয়ে লাগছে না। লাগবে কিভাবে লজ্জা সরম বলতে তো তার মাঝে কিছুই নেই। আর এইদিকে লজ্জায় মুড়িয়ে যাচ্ছি আমি। আমার লজ্জা আরো একধাপ বাড়িয়ে দিতে মুখ খুলল আরু। উৎসাহ নিয়ে বলা শুরু করলো,
“জানো আজকে ভাইয়া কি করেছে?”

সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করলো,
“কি?”

উৎসুক হয়ে সবাই বসে আছে আরুর কথা শোনার জন্য। আরু বলা শুরু করলো,
“আমি সোফায় বসে কার্টুন দেখছি হটাৎ ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকেই আম্মু কে ডাকা শুরু করেছে। আম্মু রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে চেঁচাচ্ছিস কেন?”

“তোমার ভাই আমার বউকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তুমি কিছু করো নাহয় আমি কিন্তু তোমার ভাইয়ের মেয়েকে তুলে নিয়ে আসবোবলে দিলাম”

“পাগলের মতো কি উল্টাপাল্টা বলছিস? আগে খুলে বলবি তো কি হয়েছে?”

ভাইয়া পুরো ঘটনা খুলে বলতেই আম্মু হাসা শুরু করলো। সাথে হাসছি আমিও। সেটা দেখে তার কি রাগ। রাগে গজগজ করতে করতে বলে উঠলো,
“আমার বউ অন্যের হয়ে যাচ্ছে আর তুমি হাসছো?”

“মাথা ঠান্ডা কর বাপ্ আমার । আর দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় নাকি? তোর রৌদ্রময়ী তোরই থাকবে”

এতে ভাইয়া কিছুটা শান্ত হলো। নাহয় যেই মুডে এসেছিলো মনে হচ্ছিলো রোদ আপুকে না পেলে সে সব ধ্বংস করে দিবে। অতঃপর আব্বুকে ফোন দিয়ে বাসায় আনা হলো। তারপর সবাই মিলে তোমাদের বাসায়। এই হলো ঘটনা। ভাবা যায় আমার ভাই রোদ আপুর জন্য লাজ লজ্জা ভুলে আম্মু আব্বুর সামনে এতো পা*গলামি করলো?”

আরু থামলো আমি অবাক হয়ে আদ্রর দিকে তাকিয়ে আছি। এই লোক এতো কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে আমার জন্য? এদিকে লজ্জায় আমার মাথা কাঁটা যাচ্ছে। আদ্র বলল,
“এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। যা করছি সব আমার ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য করছি এতে লজ্জার কি আছে?”

এই লোকের বেলাজ মার্কা কথা আর শোনা যাচ্ছে না। সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম এরা মুখিয়ে আছে আমায় আরেক দফা লজ্জা দেওয়ার জন্য । তাই ওখানে না থেকে উঠে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। পিছন থেকে আদ্রর কণ্ঠে শুনতে পেলাম,
“দেখলি তোদের দেওয়া লজ্জায় টিকতে না পেয়ে বউ আমার চলে গেল”

ভাবি বলল,
“আদ্র ভাইয়া বউ না হতেই এখনই বউয়ের আঁচল ধরে ঘোরা শুরু করলেন? বলতে হবে ননদিনী আমার খুবই ভাগ্যবতী আপনার মতো মানুষকে পেয়ে”

রুমে এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনটা এখন শান্ত। সকালে টেনশনের বুদ হয়ে থাকলেও এখন মন একেবারে ফুরফুরে।
——–

ছাদে রাখা দোলনায় বসে আছি। দোলনা জিনিসটা আমার অনেক প্রিয়। তাই ছাদে আর আমার ব্যালকনিতে দোলনা রাখা। দোল খাচ্ছি আর আকাশ দেখছি। আকাশ জুড়ে থালার ন্যায় চাঁদ জ্বল জ্বল করছে। তার আলো দিয়ে আশপাশ আলোকিত হয়ে আছে। সাথে মাঝে মাঝে মৃদু দমকা হাওয়া এসে শরীর ঠান্ডা করে দিয়ে যাচ্ছে। দমকা হওয়ায় মনটাও ফুরফুরা হয়ে গেছে। আদ্ররা রাতে যেতে চাইলেও যেতে দেয়া হয়নি। ফুপ্পিরা এলে আমাদের বাড়িতে অনন্দের সমাহার বসে। সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া, বিকেলের নাস্তা কাড়াকাড়ি করে খাওয়া। এর ওর পিছু লাগা, লেগপুল করা এগুলো লেগেই থাকে। তাই ফুপ্পিরা এলে তাঁদের সেদিন যাওয়া হয়ে ওঠে না। আমরা বায়না করে রেখে দেই তাঁদের। এক মনে আকাশ দেখছি আচমকা কেউ এসে পাশে বসলো। তাকিয়ে দেখি আদ্র মহাশয়। উনাকে দেখেও কথা বললাম না। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
“কিরে মুখ ফুলিয়ে রেখেছিস কেন?”

“তোমার সাথে কথা নেই?”

“কেন? আমি কি করেছি?”

“তোমার জন্য আমায় আজ সবার সামনে লজ্জা পেতে হয়েছে”

“তো এখানে আমার কি দোষ?”

“সব দোষ তোমার”

হটাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন আসতেই ফট করে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
“সত্যি করে বলো তো ওই হাঁদারাম গাধার জায়গায় তুমি এলে কি করে? ওখানে তো ওদের থাকার কথা ছিলো। আর ওগুলো কে ভাগালেই বা কিভাবে?”

আদ্র চুটকি বাজিয়ে বলল,
“ইটস ম্যাজিক”

#চলবে?