এই জোছনা ধারায় পর্ব-১৩+১৪

0
276

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১৩

এশা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডা, শীতল বাতাসে ওর চুল গুলো উড়ছে। চাঁদের ঝকঝকে আলোতে এশার মুখাবয়ব চমৎকার সুন্দর দেখাচ্ছে। ফুয়াদ সেদিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। তার মনে প্রেমে পড়ার ভয়। বিয়ে করতে হয়েছে বলেই করেছে কেবল। স্ত্রীর প্রতি প্রেম, ভালোবাসার ব্যাপার গুলো সচেতন ভাবেই উপেক্ষা করে চলেছে। মেয়েটার প্রতি অন্যায় করছে জানে। কিন্তু কি করার! সব মানুষেরই আলাদা স্বপ্ন, পরিকল্পনা থাকে। ইশা ওর জীবনের পরিকল্পনার অংশ নয়।

–দাঁড়িয়ে থাকবে? বসতে পারো চাইলে।

ফুয়াদ বলল। এশা বোধ হয় শুনতে পেল না। সে উদাস, অন্যমনস্ক হয়ে আছে।

–আপনি জ্যোৎস্না দেখতে পছন্দ করেন? নাকি আমি বলেছি দেখে এসেছেন?

অনেকক্ষণ পর এশা জানতে চাইলো। ফুয়াদ উত্তর দিলো,

–কবি সাহিত্যকরা তাদের গল্প, উপন্যাস, কবিতায় জ্যোৎস্না, বৃষ্টি এসবের অতিরঞ্জিত সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা দিয়ে মেয়েদের প্রভাবিত করতে পেরেছে। ছেলেদের পারে নাই তেমন। ছেলেরা অত সহজে প্রভাবিত হয় না। জ্যোৎস্না দেখতে আবার পছন্দ করার কি আছে!

–আপনার ধারণা যেসব মেয়েরা গল্প, উপন্যাস পড়ে তারাই শুধু জ্যোৎস্না, বৃষ্টি পছন্দ করে?

–বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। তোমার রুমেও অনেক বই দেখেছি।

এশা আর কিছু না বলে ঘাসের উপর বসলো। ফুয়াদ বিরক্ত গলায় বলল,

–এই রাতের বেলায় ঘাসের ভিতর সাপ, বিচ্ছু কিছু না দেখেই বসে পড়লে। উঠো।

ও সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এই জ্যোৎস্নার আলোয় নদীর পাড়ে নিজের মনের তীব্র উদাসীনতা ওকে বেখেয়াল করে দিয়েছে যেন। ফুয়াদ মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে জায়গাটা ভালো করে দেখে এশাকে আবার বসতে বলল।

–এই বিয়েটা করে তুমি একটা বোকামি করলে এশা। এর চেয়ে যদি কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারে ছোটখাটো চাকরিজীবী কাউকে বিয়ে করতে শান্তিতে থাকতে।

এশার পাশে বসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে কথাটা বলল ফুয়াদ। ও এই কথার উত্তর না দিয়ে বলল,

–সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধে আমার শ্বাস আটকে যায়। আপনি শেষ করুন। আমি একটু হাঁটি।

–না, না বসো। দুঃখিত।

ফুয়াদ সিগারেটটা পানিতে ফেলে দিলো।

–ছোটবেলা থেকে কষ্ট করে বড় হয়েছি এজন্য মা সব সময় চাইতেন আমার ধনী পরিবারে বিয়ে হোক। যাতে আমার জীবনে কোনো অভাব না থাকে। ধনী পরিবার থেকে আমার জন্য আরো বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু বেশিরভাগই আমার সম্পর্কে জেনে পিছিয়ে গেছে। যারা আমার চেহারার কারণে একটু আগ্রহ করেছিল তাদের আবার চাহিদা ছিলো ধুমধাম করে বরযাত্রী খাওয়ানো, ঘর সাজিয়ে দেওয়া। কিন্তু এসব মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। মধ্যবিত্ত পরিবারের যে প্রস্তাব মা একটু পছন্দ করতেন তাদের আরো বেশি চাহিদা ছিলো।

এশা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,

–কিন্তু আপনারা বিয়েতে কিচ্ছু চাননি। অর্থবিত্তও অনেক। আপনিও দেখতে ভালো। এত ভালো প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বিয়ের পর লেখাপড়া করতে না পারার ব্যাপারটা তুচ্ছ মনে হলো মায়ের কাছে। এছাড়া সূবর্ণা ভাবীর আচরণও মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো। গৃহহীন হওয়ার অবস্থা প্রায়। মা দ্রুত আমার বিয়ে দিয়ে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে চেয়েছিলেন।

ফুয়াদ চুপ থেকে কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল,

–আমি দেখতে ভালো? তোমার ভালো লাগে আমাকে?

–হ্যাঁ।

–তুমিও তো দেখতে সুন্দর। একটা প্রেম ট্রেম করে বিয়ে করতে পারতে। অন্তত কারো ভালোবাসা পেতে। তোমার কোনো প্রেম ছিলো না?

–না। আপনার ছিলো?

–সাতাশ বছরের এই লম্বা জীবনে দুই-একটা প্রেম থাকবে না!

–প্রেম ছিলো তো বিয়ে করেননি কেন?

–মায়ের জন্য পারিনি।

–মায়ের সঙ্গে এটা নিয়েই আপনার ঝামেলা?

–মায়ের সঙ্গে আমার কোনো ঝামেলা নেই। এই প্রসঙ্গ বাদ দাও।

ঝামেলা অবশ্যই আছে। এতটা ভয়াবহ ঝামেলা যে সে পরিবারের কারো কাছে না বলে দেশ ছাড়তে চাচ্ছে। এশা এই ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ও আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

ফুয়াদ দুই হাতের তালুতে মাথা রেখে ঘাসের উপর শুয়ে পড়েছে। হঠাৎ এশাকে বলল,

–আমি বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করি না। বাবা হওয়া মানে কাঁধে বিশাল দায়িত্ব। এই ছোট জীবনে অত দায়িত্ব নেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আমার কাছে নেই। আমি যে মেয়েটাকে বিয়ে করবো বলে ঠিক করেছিলাম সে এই ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নিয়েছিলো।

ফুয়াদ একটু থেমে বলল,

–তোমার সঙ্গে এই সম্পর্কটা কতদূর যাবে জানি না। কিন্তু তুমি কি এই ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারবে? তুমি কখনো মা হবে না..।

এশা তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ওকে হতভম্ব দেখাচ্ছে। এটা সহজ ভাবে নেওয়ার মত ব্যাপার! অনেকক্ষণ ভেবেও এরকম অস্বাভাবিক চিন্তাভাবনা ও সহজ ভাবে নিতে পারলো না।

–কি হলো কথা বলছো না কেন?

এশা নিজেকে সামলে স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করলো,

–আমি বাচ্চাকাচ্চা অনেক পছন্দ করি।

–আমি অপছন্দ করি না। অর্পি, রাঈদ ওদের কোলে নিই, আদর করি। কিন্তু দুই-চারটা ছেলে-মেয়ে জন্ম দিয়ে তাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার মত বাড়তি ঝামেলা আমি আমার জীবনে নিবো না। আমার কাছে এসবের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।

এশা টের পেল ওর মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে। ফুয়াদের সঙ্গে সম্পর্কটা এখন পুরোপুরি ঠিক না থাকলেও ও মনে মনে আশা করেছিল, একদিন সব ঠিক হবে। ওর জীবনটা নিশ্চয়ই সুন্দর হবে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওর মনে সেই আশা ভঙ্গের আশঙ্কা। ফুয়াদ আর ও সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ। এমনকি সে অন্য পাঁচটা মানুষের চেয়েও আলাদা। এশা এখনো তাকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। যদিও এত সহজে বুঝে উঠার মত মানুষও সে না। তবে যেটুকু বুঝেছে তাতে স্পষ্ট যে ফুয়াদের জীবনের স্বপ্ন, পরিকল্পনায় কোথায়ও ওর জায়গা নেই। তাহলে ওর জীবনটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

এশা অনেকক্ষণ পর বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল,

–সবার জীবনেই কষ্টের পর সুখ আসে আপনি কি এ কথায় বিশ্বাস করেন?

–না। জীবন সবার সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করে না।

–আমারও তাই মনে হয়। এই যেমন ধরুন আমার মায়ের জন্ম খুব দরিদ্র পরিবারে। কষ্ট করে বড় হয়েছে। এরপর যখন বিয়ে হলো আমার বাপেরও তেমন আর্থিক অবস্থা ছিলো না। টানাপোড়েনের ভিতরই আমার জন্ম হলো। এরপর আমার বাবা মারা গেল। যখন দ্বিতীয় বিয়ে হলো সেই মানুষটাও মারা গেল। এরপর আরো কষ্ট করে জীবন কাটালো। এখন ভাইয়ের বাসায় উটকো ঝামেলার মত। সেখানেই হয়ত অবহেলায় মারা যাবে। মার জীবনে কখনো কষ্টের পরে সুখ আসেনি।

এশা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

–আমি সুখের অপেক্ষায় দিন গুনছি। কিন্তু মায়ের ব্যাপারটা উপলব্ধি করার পর আমার ভীষণ ভয় করছে। হয়ত জীবন তার মত আমার সঙ্গেও ন্যায্য আচরণ করবে না। একটা মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শুধু দুঃখই করবে। কি ভয়াবহ ব্যাপার তাই না?

এশা উঠে দাঁড়ালো। এই জ্যোৎস্না, তার আলোয় উজ্জ্বল নদীর জল–এসব কিছুই এশার এই মুহুর্তে ভালো লাগছে না।

–আচ্ছা বাসায় চলুন।

–জ্যোৎস্না দেখা শেষ?

–হ্যাঁ।

ফুয়াদও উঠে দাঁড়ালো। এশা আগে আগে হাঁটছে। ফুয়াদ দ্রুত কয়েক পা হেঁটে এসে ওর পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। সে বুঝতে পেরেছে বাচ্চা না নেওয়ার সিদ্ধান্তটা এশা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। ও খুব সাধারণ মেয়ে। বড় হওয়ার পর থেকেই হয়ত বাচ্চাকাচ্চা সহ একটি সংসারের স্বপ্ন দেখেছে। তাই এই ব্যাপারটা শুনে ধাক্কা খাওয়া স্বাভাবিক।

এশা ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে জিজ্ঞেস করল,

–আপনি সত্যিই কাউকে না জানিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন?

–হুম।

–আপনি বাবা হতে চান না এটাও সত্যি?

–তোমার সাথে এসব নিয়ে আমি ফাজলামি কেন করবো বলো?

–বিয়ের আগে কেন বলেননি তাহলে?

–তুমি তো আমার সম্পর্কে কিছুই জানতে চাওনি।

–বাচ্চা নেওয়ার মত স্বাভাবিক ব্যাপার আলাদা করে আবার কে জানতে চায়?

–জানি না।

–আমার যদি কোথায়ও যাওয়ার জায়গা থাকতো আমি আপনাদের বাসায় যেতাম না। যেদিন আপনি আমাকে চড় মেরেছেন সেদিনই চলে যেতাম। আমার সমস্ত আত্মসম্মান জীবনের কাছে অসহায়।

এই বলে এশা হঠাৎ ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরলো। ওর চোখে জল ছলছল করছে। ও ব্যাকুল স্বরে বলল,

–ফুয়াদ আমার ভালো থাকতে ইচ্ছে করে। আপনাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

ফুয়াদ কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। যেন এই ব্যাপারে সে বড়ই অপারগ।
(চলবে)

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১৪

সবে ভোর হয়েছে। এই ভোর সকালে পলি বেগম গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ডাক্তার তাকে রোজ হাঁটতে বলেছেন। এশা আর সম্পা এখনো ঘুমাচ্ছে। মারুফা উঠেছে শুধু। পলি বেগম মারুফাকে আদেশ করেছেন ওদের দুই জনকেও চটজলদি ডেকে তুলতে। তিন ছেলের বউকে সঙ্গে নিয়ে তিনি হাঁটবেন। একা একা হাঁটা খুবই বিরক্তিজনক ব্যাপার।

সম্পা আর রাহাত গতকাল রাতে দুইটা ভুতের মুভি দেখে তিনটার দিকে ঘুমিয়েছে। এত ভোরবেলা উঠতে সম্পার মেজাজ কি যে খারাপ লাগছে। ডাক্তার পলি বেগমকে হাঁটতে বলেছে। ওকে তো আর হাঁটতে বলেনি। মানুষকে যন্ত্রণা দেওয়াই এই মহিলার সবচেয়ে পছন্দের কাজ।

পলি বেগম দেখলেন মারুফা আর সম্পা গেটের দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি ওদের প্রথমেই গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,

–এশা আসেনি?

মারুফা বলল,

–না আসেনি। ওর নাকি শরীর ভালো লাগছে না। জ্বর এসেছে।

মারুফা কিছুটা তাচ্ছিল্য করে আবার বলল,

–জ্বর না ছাই! ঘুম ছেড়ে উঠতে চাচ্ছে না তাই বানিয়ে বলেছে। ওকে আসলে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ফুয়াদ প্রশ্রয় না দিলে এত সাহস কোথায় পায়?

এই সকাল সকালই পলি বেগমের মেজাজে আগুন ধরে গেল। মেজাজ সামলাতে না পেরে কোনদিন যেন তিনি এশার মাথায় বাড়ি মেরে বসেন ঠিক নেই। এতদিন তিনি কেবল এশাকে শাসিয়েছে। নতুন বলে একটু রয়ে সয়ে কয়েকবার সতর্ক করেছেন। তাতে তেমন কাজ হচ্ছে না বোধ হয়। এশার কোনো পরিবর্তন দেখছেন না। এবার ফুয়াদেরও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বউকে যদি সত্যি সে আসকারা দিয়ে থাকে তাহলে সে ও সোজা হবে সঙ্গে এশাও।

সম্পার চোখের ঘুম এখানো কাটেনি। ইশ্ ও যদি পারত এশার মত এমন সাহস করে না আসতে! একটু সাহসের অভাবে জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। এশাকে ও হিংসা করলেও এই মুহুর্তে সমর্থন না করে পারছে না। মনে হচ্ছে এই মারুফার সঙ্গে মিল দিয়ে না চলে এশার সঙ্গে মিল দিলে ভালো হবে।

পলি বেগম আর মারুফা আগে আগে হাঁটছে। সম্পা ওদের থেকে বেশ পিছনে পড়ে আছে। ওর ইচ্ছে করছে রাস্তার ভিতরই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।

হাঁটতে হাঁটতে মারুফা পলি বেগমকে বলল,

–আপনি এশাকে ভাত খেতে তরকারি দিলেন না। ফুয়াদ সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে দিয়েছে। এমনকি গতকাল মাঝ রাতে তারা বাসা থেকে বের হয়ে কোথায় যেন গিয়েছিল। শেষ রাতের দিকে ফিরেছে।

–তুমি নিজের চোখে দেখেছো?

–হ্যাঁ মা। আপনি আমাকে চিনেন না? নিজের চোখে না দেখে আমি কোনো কথা বলি না।

মারুফা আবার বলল,

–এশাকে দেখে দেখে সম্পাও এখন হিংসা করে এশার মত নিজের মর্জি মত চলতে চাচ্ছে। এ কথা ও নিজে আমাকে বলেছে।

পলি বেগমের চোখ-মুখ ক্ষিপ্ত দেখালো। তিনি বললেন,

–ঠিক আছে দেখি।

ফয়সাল খাঁটি মা ভক্ত ছেলে। রাহাত আর ফুয়াদের মত পিছনে পিছনে বউকে প্রশ্রয় সে দেয় না। তাই মারুফাও সর্বদা চেষ্টা করে শাশুড়ির মন রক্ষা করতে। এছাড়া ওর কোনো উপায় নেই। সব যন্ত্রণা সহ্য করে ওর এই সংসারেই পড়ে থাকতে হবে। মারুফার এখন উদ্দেশ্য হলো শাশুড়ির সবচেয়ে পছন্দের ছেলের বউ হয়ে এই সংসারের হর্তাকর্তা হওয়া।
__

সকালে হাঁটা শেষে বাসায় ফিরে পলি বেগম দেখলো এশা নাস্তা তৈরি করেছে। তাদের ফিরতে দেখে ও জলদি টেবিল সাজালো।

–তোমার গায়ে নাকি জ্বর?

পলি বেগম জিজ্ঞেস করলেন। এশা উত্তর দেওয়ার আগেই তিনি ওর কপালে হাত দিয়ে উত্তাপ পরীক্ষা করলেন।

–সামান্য শরীর গরম। এর জন্য হাঁটতে যেতে পারলে না!

এশা নমনীয় গলায় বলল,

–শরীর ভীষণ খারাপ লাগছিলো মা।

–তেমন কোনো খারাপ আমি দেখছি না। আমার কথার বাইরে যত বেশি বাড়বে তত বেশি ভেঙে যাবে।

খাবার মুখে তুলতে তুলতে স্বাভাবিক গলায়ই কথাটা বলল পলি বেগম। তার এই স্বাভাবিক গলায় বলা কথার ভিতরের তেজ এশা আন্দাজ করতে পারছে।

মারুফা সকালে যখন ডেকেছিল ওর শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছিলো। তার উপর চোখ ঘুমে ভেঙে আসছিলো। চোখ থেকে ঘুম সামান্য কাটতেই ওর হুঁশ হয়। পলি বেগম ডাকা সত্ত্বেও যায়নি! আবার ভয়াবহ অপরাধ করে ফেলেছে। একবার ভেবেছিল তখনই বের হবে। তাতে যদি এই অপরাধ মুছে। পরে মনে হয়েছে এখন গিয়ে ওদের কোথায় পাবে? তারচেয়ে ভালো নাস্তা তৈরি করা। তাতে যদি কিছুটা ক্ষমা পায়।
__

টেবিলে নাস্তা বেড়ে দিয়ে এশা দ্রুত রুমে আসে। ফুয়াদ বলেছিল তার শার্ট-প্যান্ট ইস্ত্রি করে রাখতে। সে সকালে অফিসে যাবে। ও ফুয়াদের চার পাল্লার আলমারিটা খুলল। এটাতে কেবল ফুয়াদেরই কাপড়-চোপড় রয়েছে। এশা এই আলমারি আগে কখনো খোলেনি। আজ খুলে বিস্মিত হয়েছে! একটা মানুষের এত কাপড়-চোপড়! ওর তো সারাজীবন সর্বোচ্চ দুই-চারটা তুলে রাখা জামা ছিলো।

পলি বেগমের সব নিয়ম-কানুন এই জন্যই বোধ হয় তার ছেলেরা মেনে চলে। নয়ত এত বিলাসিতা করবে কীভাবে! তার কথার অবাধ্য হয়ে এরকম বিলাসি জীবন ছেড়ে কে ই বা কষ্ট করতে চাইবে? এশাও বোধ হয় চাইতো না।

ফুয়াদের জন্য কী রঙের জামা-প্যান্ট নামাবে? এশা কিছুক্ষণ খুঁজে ধূসর রঙের একটা শার্ট বের করলো। সঙ্গে কালো প্যান্ট। শার্ট-প্যান্ট সুন্দর ভাবে ইস্ত্রি করে রেখে ও ছাদের দিকে গেল। আকাশে মেঘ করেছে। ওর কিছুক্ষণ ছাদে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।

ও এমন একজন পুরুষকে বিয়ে করেছে যে বাবা হতে চায় না। তার কাছে বিয়ের মত সম্পর্কেরও কোনো মূল্য নেই কাছে। ওর প্রতি তার বিন্দুমাত্র টান নেই, ভালোবাসা নেই। অনিশ্চিত এক সম্পর্কের গোলক ধাঁধাঁয় পড়েছে ও। এশা ভেজা চোখে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

কাল রাতে ওরকম বোকার মত কাণ্ড কেন করলো ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরে! ওর অমন ব্যাকুলতার বিপরীতে ফুয়াদ কিরকম শীতল, নির্লিপ্ত ছিলো। ভাবতেই এশার লজ্জা করছে, অপমান বোধ হচ্ছে। হঠাৎ কীভাবে যেন আবেগপ্রবণ হয়ে ওরকম হ্যাংলামি করে বসলো! ওই লজ্জাজনক দৃশ্যটা ওর স্মৃতি থেকে মুছে ফেলত পারতো যদি।

–এশা তুমি এখানে এভাবে বসে আছো কেন?

হঠাৎ কারো গলার স্বর পেয়ে এশা চমকে তাকায়। তাকিয়ে সম্পাকে দেখতে পেল।

–তোমার কি শরীর বেশি খারাপ লাগছে? আমার কাছে জ্বরের ওষুধ আছে। খাবে?

–এক্ষুনি ওষুধ খাবো না ভাবী। অনেক জ্বর আসবে মনে হচ্ছে।

সম্পা ওর পাশে বসে কপালে হাত দিয়ে দেখে বলল,

–শরীর তো খুব গরম লাগছে। আমার রুমে থার্মোমিটার আছে। মেপে দেখো।

সম্পা ভাবী হঠাৎ এত ভালো আচরণ কেন করছে? এর আগে তো কখনো এত আন্তরিকতা দেখায়নি। এশা মনে মনে বিস্মিত হয়।

–আমি বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করি। এ বাড়িতে আসার পর একদিনও ভিজতে পারিনি এখনো। মা অনুমতি দেয়নি। বাড়ির বউ লাফিয়ে লাফিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে! খুব বিচ্ছিরি লাগবে নাকি দেখতে। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো তাকে কে বলেছে? আমি দুই হাত মেলে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজি।

সম্পা থেমে বলল,

–আজকে ভিজবো বুঝলে? এজন্য ছাদে এসেছি।

–মা অনুমতি দিয়েছে?

–না আজ তার কাছে অনুমতি চাইনি। অনুমতি ছাড়া ভিজে দেখি কি করে! সে তো আর বাঘ-ভাল্লুক না যে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।

এশা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

–আজ বৃষ্টি হবে না ভাবী। এগুলো উড়ো মেঘ। বাতাসের সাথে উড়ে যাবে।

সত্যি সত্যি বৃষ্টি হলো না। সম্পা হতাশ গলায় বলল,

–সাহস করে নিজের পছন্দের একটা কাজ করতে আসলাম। তাও করতে পারলাম না। আচ্ছা এশা শুনো।

–জি ভাবী বলুন।

–তোমার সাথে যা বলেছি কাউকে বলো না আবার।

এশা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। সম্পা ছাদ থেকে চলে গেল। সম্পার আজ হঠাৎ কি হলো? এর আগে তো সে এশার সঙ্গে ভালো ভাবে কথা ই বলেনি। তার খাতির মারুফার সঙ্গে।

এশা ছাদ থেকে এসে দেখলো ফুয়াদ সদ্য গোসল সেরে বের হয়েছে। তার কোমড়ে শুধু একটা তোয়ালে জড়ানো। সে এশার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

–আমার চুল গুলো একটু মুছে দাও তো।

এশা চুল মুছে দিতে গিয়ে আবার ফুয়াদের প্রতি নিজের অনুভূতি টের পেল। যে মানুষটার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। এক ছাদের নিচে, এক বিছানায় থাকছে। তার প্রতি নিজের অনুভূতি দমিয়ে রাখা কীভাবে সম্ভব? আচ্ছা ওর ছোঁয়ায় ফুয়াদের কি কোনো অনুভূতি হয় না? তার মনে সামান্য প্রেম জাগে না? তার হৃদয়-মন কি কঠিন কোনো ধাতু দিয়ে তৈরি?

–হয়েছে আর মুছতে হবে না।

ফুয়াদ শার্ট-প্যান্ট পরে তৈরি হয়। এশাকে জিজ্ঞেস করল,

–টাই বাঁধতে পারো তুমি?

–পারি।

–বেঁধে দাও আমাকে তাহলে।

এশা বেঁধে দিলো না। ও মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকলো।

–কি হলো?

–সব সময় তো আপনিই বাঁধেন।

ফুয়াদ এশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

–ভয় পাও আমার কাছে আসতে? প্রেমে পড়ার ভয়? কাছে আসার দরকার নেই। ওভাবে দূর থেকে দেখলেও প্রেমে পড়ে যাবে। যাবে নাকি ইতিমধ্যে পড়ে গিয়েছো তুমি জানো। আমি কিন্তু তোমাকে আগেই সতর্ক করেছি। আমার প্রেমে পড়া বারণ।

এশা কোনো উত্তর দিলো না। ফুয়াদ চলে গেল।
__

দুপুরের দিকে এশা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসলো। উঠে দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু রান্না করতে হবে। সকালে পলি বেগমের সঙ্গে হাঁটতে না গিয়ে এক অপরাধ করেছে। এখন রান্নাবান্না রেখে শুয়ে থাকলে অপরাধ দ্বিগুণ হবে।

সম্পা মাছ কাটছে। মারুফা চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে রুমে চলে গেছে। সে এখন তেমন কাজকর্ম করে না। সব সম্পা আর এশার উপর চাপিয়ে দেয়। সম্পা আবার একটু করে পুরোটা এশার উপর চাপায়।

এশা কাজ করার শক্তি পাচ্ছে না। সম্পা মাছ কাটা শেষে বলল,

–আমি মাছ, মাংস ধুয়ে রেডি করে দেই। তুমি মসলা বেটে রান্নাটা করে ফেল।

পলি বেগম এখনো শিলে পাটায় বাটা মসলা দিয়ে তরকারি খেতে পছন্দ করেন। এই যুগে কেউ শিলে পাটায় মসলা বাটে? সম্পা যখনই মসলা বাটতে যায় মনে মনে পলি বেগমকে ভয়াবহ গালি দেয়।

সম্পা এশার দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর চেহারা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। জ্বরের তাপে কেমন লালচে হয়ে গেছে।

–তোমার গায়ে কি অনেক জ্বর আসছে?

–হ্যাঁ ভাবী। শরীর খুব খারাপ লাগছে।

ওর দিকে তাকিয়ে সম্পার মায়া হলো। বলল,

–আজকে রান্না তাহলে আমি করি। তুমি রুমে যাও।

–আপনার একা কষ্ট হয়ে যাবে।

–হবে একটু। তবে খুব বেশি না। তুমি যাও। আর শুনো আমি যে তোমার সাথে খাতির করেছি মারুফা ভাবী যেন না জানে।

সম্পার প্রতি এত কৃতজ্ঞতা হচ্ছে এশার। তার আর মারুফার মধ্যে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি? এশা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এই মুহূর্তে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে ও রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
__

এই ভর দুপুরে সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। অনেকক্ষণ যাবৎ কলিংবেলটা বেজে চলেছে। কেউ দরজা খুলছে না। সম্পা রান্না করছে, এশার গায়ে না হয় জ্বর। মারুফা কি শুনতে পাচ্ছে না? সে তো কোনো রকম একটু ভাত বসিয়ে দিয়ে চলে গেছে। দরজাটা পর্যন্ত খুলতে পারছে না! সে আজকাল নিজেকে এই সংসারে দ্বিতীয় মুঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ওরফে পলি বেগম ভাবতে শুরু করেছে বোধ হয়।

সম্পা রাগে গজগজ করতে করতে গিয়ে দরজা খুললো। দরজার সামনে আধুনিক সাজপোশাক গায়ে সুন্দর দেখতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্পা কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে চেনার চেষ্টা করলো। আরে এটা সেই মেয়ে না? ফুয়াদ যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কী আশ্চর্য ব্যাপার! মেয়েটা এই বাড়িতে এসেছে কেন!
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা