#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২৩
এশা শপিংমল ঘুরে ঘুরে নিজের জন্য দামি ব্র্যান্ডের পোশাক কিনলো। পলি বেগমের ছেলের বউ ও! কম টাকার পোশাক পরবে কেন!
ওর কেনাকাটা শেষ করে এরপর একটা শাড়ি পছন্দ করলো। মিনারা বেগমের জন্য নয়, ওর শাশুড়ি মায়ের জন্য। শাড়ি উপহার পেয়ে খুশি হওয়ার বদলে নিশ্চয়ই তার মেজাজে আগুন ধরে যাবে। অর্ন্তজ্বালা বাড়বে। এশা সেসবের পরোয়া করছে না এখন। ওই বাড়ির সমস্ত অসহ্য নিয়মকানুন ভেঙে ও স্বাভাবিক ভাবে চলবে। ছেলের বউ শাশুড়িকে শাড়ি উপহার দিতেই পারে! এশার উদ্দেশ্যে বোধ হয় পলি বেগমকে নিজের দুঃসাহস দেখানো।
কেনাকাটা শেষ করে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে নিজের পছন্দের খাবার খেল এশা। এরপর বিকাশের দোকানে গিয়ে মায়ের জন্য টাকা পাঠালো।
ও এভাবে না বলে চলে আসায় মা নিশ্চয়ই রাগ করেছে, কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এছাড়া আর কি করার ছিলো! মামারা এত সহজে জমির ভাগ দিবে না। নাদিমও দিবে না। এশা সেটা আগেই বুঝতে পেরেছে। এই দুঃসময়ে তারা এমন স্বার্থপরতা করবে মিনারা বেগম ভাবতে পারেনি। মানুষটা এত সহজ-সরল! তাই তো জীবনে ভালো থাকতে পারেনি। তাকে ওখানে রেখে এসে ওর মন পুড়ছে, বুকের ভিতর হাহাকার করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আর কোনো উপায় নেই।
এশা ফোন করলো মিনারা বেগমকে। জিজ্ঞেস করলো,
-মা তোমার ফোনে টাকা গেছে?
-এশা.. তুই আবার ওই বাড়িতে চলে গেছিস।
মিনারা বেগমের গলা ভীষণ ভার শোনা যাচ্ছে। বোধ হয় কান্নাকাটি করেছে।
-তোমার ফোনে টাকা পাঠিয়েছি মা। তোমার খাওয়া-দাওয়ায় অসুবিধা হলে বাইরে থেকে কিনে খেয়ো। আপাতত একটু কষ্ট করে ওখানে থাকো। আর আমার জন্য দুশ্চিন্তা করো না।
-আমাকে কিসের টাকা পাঠিয়েছিস? তুই টাকা কোথায় পেয়েছিস? কোথায় তুই বল তো?
মিনারা বেগমের গলায় ভীষণ উৎকণ্ঠা।
-আমি কাল থেকে ক্যাম্পাসে যাবো মা। কেনাকাটা করতে এসেছি তাই। বাসায় গিয়ে তোমাকে ফোন করবো।
মিনারা বেগম তালগোল পাকিয়ে ফেলল। কি বলছে এশা! ও কি শ্বশুর বাড়িতে যায়নি? সেখান থেকে ক্যাম্পাসে যাবে কীভাবে! কেনাকাটাও বা করবে কি করে! একদিনের ব্যবধানে ওর জীবনটা কি কোনো জাদুবলে পরিবর্তন হয়ে গেছে?
মানুষের শোরগোলে কথা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। এশা লাইন কেটে দিলো। বাসায় গিয়ে নিরিবিলি হয়ে ফোন করবে।
__
পলি বেগম বুঝতে পারলেন তার সংসারে আগের মত আর শান্তি ফিরে আসবে না। এই সংসারে তার কর্তৃত্ব যে কোনো দিন খর্ব হবে তা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। যা দুঃস্বপ্নে ভাবেননি তা আজ নিজের চোখে দেখছেন।
তার ছেলেই তো তার কথা শুনছে না! বউয়ের দোষ দিয়ে আর কী লাভ! কিরকম বেপরোয়া ভাবে এশাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসলো! ফুয়াদের মাথাটা বোধ হয় ওই মেয়েই খেয়েছে। নিজের রূপ সৌন্দর্যে ভুলিয়েছে।
অস্থির মেজাজে নিজের শোবার ঘর লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন পলি বেগম। গেটের ভিতরে গাড়ি ঢোকার শব্দ পেয়ে তিনি সেদিকে তাকালো। এই সময়ে গাড়িতে কে আসলো? ফুয়াদ তো ঘুমাচ্ছে। ফয়সাল, রাহাত এই অসময়ে অফিস থেকে এসেছে?
পলি বেগম দেখলেন এশা গাড়ি থেকে নামছে। তিনি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে তাদের গাড়ি ব্যবহার করা শুরু করেছে! কার কাছে জিজ্ঞেস করে! কোন সাহসে! রাগে পলি বেগমের দুই কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হতে লাগলো। মালা তাকে বলল,
-‘মা তুমি শান্ত হও। আমি ওকে দেখছি।’
এশা বাসায় ঢুকতেই মালা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-তুমি কাকে জিজ্ঞেস করে বাসা থেকে বের হয়েছো? আর কার অনুমতিতে গাড়ি বের করেছো?
-আপনার ভাইয়ের অনুমতিতে। সে অনুমতি না দিলে আমার কি এত দুঃসাহস আছে!
-এ বাড়িতে শুধু ফুয়াদের অনুমতিই কি যথেষ্ট?
এশা পাল্টা প্রশ্ন করলো,
-আপনার শ্বশুর বাড়িতে আপনি কার কার অনুমতি নিয়ে চলেন?
মালা বাক্যহারা হয়ে রইল। এই মেয়ে ওকে এই ধরণের প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা কোথায় পেল! ওর বুকের ভিতর কত হাত কলিজা। এশাকে দেওয়ার মত উপযুক্ত জবাব তৎক্ষণাৎ খুঁজে পেল না।
এশা সোফায় বসলো। সম্পা ওকে দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কোথায় বের হয়েছিলে তুমি সকাল সকাল?
-একটু কেনাকাটা করতে গিয়েছি ভাবী।
মেয়েটার মনে কি কোনো ডর ভয় নেই? সম্পার উচিত ওর পা ধোয়া পানি খাওয়া। মালা একটু তফাতেই দাঁড়িয়ে আছে ক্ষিপ্ত চেহারায়। ও আড় চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কি কি কিনলে?
এশা শপিং ব্যাগ থেকে সবকিছু বের করে দেখাতে লাগলো সম্পাকে।
-আপনার জন্যও একটা জামা কিনে এনেছি ভাবী।
সম্পা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল,
-তুমি একা একা কেনাকাটা করতে গিয়েছো! আবার আমার জন্যও কিনেছো!
ও আসলে সম্পার জন্য কিনেনি। কিন্তু ওর কেনাকাটা দেখে নিশ্চয়ই তার আফসোস হচ্ছে! সে তো এভাবে গিয়ে পছন্দমত কেনাকাটা করতে পারেনা। তাছাড়া এ বাড়িতে সম্পাই একমাত্র ওকে স্নেহ করে।
-হ্যাঁ ভাবী। এই জামাটা দেখেই আমার মনে হয়েছে এটা আপনার গায়ে দারুণ মানাবে।
এশা ওর কেনা সবচেয়ে সুন্দর জামাটা সম্পা ভাবীকে দিলো। তিনি এত খুশি হলেন!
-মালা আপা দেখুন এই শাড়িটা মায়ের জন্য কিনেছি।
মালা দেখলো না। সে হনহন করে ওখান থেকে চলে গেল। এই মেয়ে তামাশা শুরু করেছে নাকি!
মালা চলে যাওয়ার পর সম্পা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
-এশা তুমি কি এবার জানের মায়া ছেড়ে এই বাড়িতে এসেছো?
-একটু প্রাণ খুলে বাঁচতেই যদি না পারি সেই জান দিয়ে কি হবে ভাবী?
-জানি না এশা। কিন্তু আমার অত সাহস হয় না। আজ দশ-পনেরো পদের ভর্তা বানাতে হবে জানো! মালা আপা মাছ-মাংস কিছুই খেতে পারছেন না। খাওয়া তো দূর কোনো কিছুর গন্ধই সহ্য করতে পারছে না। এত পদের ভর্তা বানাতে কত সময় লাগবে বলো তো! তাছাড়া অন্য রান্না তো আছেই।
-তার জন্য তো তাহলে দুই-তিন জন কাজের মানুষ রাখা উচিত। ভাবী আপনি মাথা ব্যথার কথা বলে একেবারে সোজা হয়ে শুয়ে থাকুন। এত বড় সংসার! একজন কাজের মানুষ নেই!
-আমার শরীরটা আসলেই খারাপ এশা। সত্যি আমি আজ শুয়ে থাকবো।
সম্পা রান্নাবান্না না করে শুয়ে রইলো। ওর শরীরটা কয়দিন যাবৎ কেমন যেন লাগছে। মালা আসার পর থেকে চব্বিশ ঘন্টা খাটতে হচ্ছে। কাজের মানুষের মত হুকুমের উপরই থাকতে হয়! রাহাতকে বলেছে একটা প্রেগন্যান্সি কিট আনতে। তাও সে প্রতিদিন ভুলে যাচ্ছে। অপদার্থ একটা!
__
এশা রুমে এসে দেখলো ফুয়াদ এখনো শুয়ে আসে। তার ঘুম ভেঙেছে কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না।
ফুয়াদের মুখ বালিশে গোঁজা। জবুথবু চুল গুলো কপাল দখল করে আছে। তার চোখ দুইটাও দেখা যাচ্ছে না। জবুথবু হয়ে থাকা চুলের আড়াল দিয়ে ফুয়াদ যে এশার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা ও বুঝতে পারলো না।
এশাকে একেবারে অন্যরকম লাগছে। ওর চেহারা না, চলাফেরা-কথাবার্তার ঢং সবকিছু যেন রাতারাতি বদলে গেছে। যে মেয়ে বিয়ের পর ওর সাথে কথা বলতেও সংকোচ করত, বাসার সবার ভয়ে তটস্থ থাকতো। সে আজ সকালে ওর ঘুম ভাঙিয়ে শপিং করতে চলে গেল। তাও গাড়িতে করে। ভয়াবহ বিস্ময়কর কাণ্ড!
-অনেক ঘুমিয়েছেন। উঠুন। গোসল করে কিছু খেয়ে নিন।
আদেশের সুরে বলল এশা। এই বলে সে ফুয়াদের গায়ের কাঁথাটা সরিয়ে ফেলল। রুমে এসি চালু থাকায় শীত শীত লাগছে।
ফুয়াদ বলল,
-একটু পরে উঠবো।
-এখন সকালের নাস্তাও নেই। দুপুরের রান্নাও হয়নি। আমি আপনার জন্য কিছু বানিয়ে আনছি। এসে যেন দেখি আপনি উঠে গোসল সেরেছেন।
এই বলে এশা রান্নাঘরের দিকে গেল। ফুয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে তো একেবারে পাক্কা বউ বউ আচরণ করছে। পরে মনে হলো এশা তো ওর বউই।
এশা রান্না ঘরে গিয়ে দেখে মারুফা একা একা রান্না করছে। তার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। এশাকে ডাকেনি রান্নার কাজে। বাড়ির কেউই ওর সাথে তেমন কথা বলছে না। কথা না বললে তাতে ওর কি এসে যায়!
ফুয়াদের জন্য কি বানানো যায় ঝটপট? সে কয়েকবেলা ধরে না খাওয়া। এশা পরোটা বানাতে লাগলো। সাথে ডিম ভাজি করবে। মারুফা সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে। এশা নিজের ইচ্ছে মত আলাদা রান্না করে খাচ্ছে! ঈর্ষাকাতর মারুফার ইচ্ছে করছে ওর গায়ে গরম তেল ঢেলে দিতে।
পরোটা বানাতে বানাতে এশা মারুফাকে বলল,
-এ বাসায় এত কাজ অথচ একটা কাজের মানুষ নেই ভাবী! অনন্ত দুই-তিন জন কাজের মানুষ প্রয়োজন।
মারুফা কোনো কথা বলল না। কথা বলার মেজাজ নেই তার। স্বামীর সায় পেলে মারুফা ও এভাবে রং ঢং করতে পারতো।
ফুয়াদ এশার কথা অগ্রাহ্য করে শুয়ে থাকতে চাইলো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কেমন তাড়া অনুভব করছে। এমন ভাবে চোখ-মুখ শক্ত করে বলে গিয়েছে এশা! ও কি ভয় পাচ্ছে? কি উদ্ভট চিন্তা! ও এশাকে ভয় পেতে যাবে কেন!
ও শুয়ে থাকতে পারলো না। এশা এসে ওকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখলে যেন বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে, এরকম কিছু মনে হলো। ফুয়াদ উঠে গোসলে ঢুকলো।
এশার খাবার নিয়ে এসে দেখে ফুয়াদ সদ্য গোসল সেরে বের হয়েছে। এরপর সে কোমড়ে তোয়ালে পেঁচানো অবস্থায়ই সিগারেট ধরাতে লাগলো। অথচ তার মাথার চুল গুলোও ভেজা।
সে কাল বলেছিল, এশা তাকে বোঝার চেষ্টা করে না, চেনার চেষ্টা করে না, তার প্রতি খেয়াল করে না। তাই ও সব খেয়াল করছে। যদিও ভবিষ্যতে ফুয়াদের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এশা ফুয়াদের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঠোঁটের ভিতর থেকে সিগারেটটা নিয়ে অ্যাশট্রেতে ফেলে দিলো। এরপর তোয়ালে হাতে তার মাথাটা নিজের দিকে টেনে চুল মুছিয়ে দিতে লাগলো।
ফুয়াদ অদ্ভুত ভাবে লক্ষ্য করলো এই তীব্র অধিকারবোধের বিপরীতে ও সামান্য বিরক্ত হতে পারছে না।
(চলবে)
#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২৪
এশা পলি বেগমের জন্য কেনা শাড়িটা হাতে তার রুমের দিকে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুমতি চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
-মা, আসবো?
পলি বেগম দরজার দিকে তাকিয়ে এশাকে দেখতে পেল। বড্ড বেড়েছে সে!
-আসো।
পলি বেগম শান্ত গলায় বললেন। তিনি দেখবেন এই মেয়ে কতদূর বাড়তে পারে!
এশা রুমে ঢুকে হাসি মুখে বলল,
-মা আপনার জন্য এই শাড়িটা কিনেছি। এটা দেখেই আমার মনে হয়েছে আপনাকে অসম্ভব মানাবে।
পলি বেগম তাকিয়ে দেখলেন গাঢ় সবুজ রঙের জমিন আর চিকন করে টানা সোনালী পাড়ের সুন্দর একটি দামি শাড়ি। তিনি সেটি হাতে নিয়ে বললেন,
-অসম্ভব সুন্দর। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
এশার মনে হলো ও এই মুহূর্তে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বস্তু দেখছে। এটা কি পলি বেগম নাকি হুবহু তার মত দেখতে কেউ! চূড়ান্ত বিস্ময় বোধ হয় একেই বলে।
-আর কিছু বলবে তুমি?
পলি বেগম জিজ্ঞেস করল। এশা ঠোঁট নেড়ে বলল,
-না।
-তাহলে যাও এখন।
ও চলে আসলো। তবে বিস্ময়টুকু হজম করতে সময় লাগবে।
একটু পরই মালা প্রচণ্ড রাগ নিয়ে পলি বেগমের কাছে আসলো। বাড়ির পরিবেশ দেখে ওর মাথা ভনভন করছে।
-বাড়িতে এসব কি হচ্ছে? এই পরিবেশে আমার থাকা সম্ভব না।
এই বলে ধপ করে বিছানার উপর বসলো সে। পলি বেগম চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা দিয়ে কি যেন হিসেব-নিকেশ করছে। তিনি মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলেন,
-কি হয়েছে?
মালা চিৎকার করলো,
-কি হয়েছে তুমি চোখে দেখতে পাচ্ছো না মা? তোমার ছোট ছেলের বউ কোন দুঃসাহসে আমার মুখের উপর কথা বলে? সম্পাকে বলেছি ভর্তা বানাতে। ওর ভর্তা বানানো ভালো হয়। সে না বানিয়ে শুয়ে আছে। তোমার ছেলের বউয়েরা এত সাহস কোথায় পাচ্ছে?
পলি বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
-রান্না করছে কে?
-মারুফা ভাবী। তোমার ছোট ছেলের বউ তো একেবারে রাজরাণী সেজেছে। এ বাড়িতে এসব তো আমি আমার গোটা জীবনে দেখেনি।
-দেখো একটু কষ্ট করে।
মালা টেবিলের উপর এশার দেওয়া শাড়িটা দেখতে পেল। ওর মেজাজ আরো বিগড়ে গেল।
-এই শাড়ি তোমাকে ও দিয়ে গেছে? সেটা আবার তুমি রেখেছো?
হিসেব শেষ করে চোখের চশমাটা খুলে উঠে দাঁড়ালো পলি বেগম। মালাকে বলল,
-এশা তো বেশি দিন বাঁচতে পারবে না। সেজন্য ওর দেওয়া শাড়িটা রেখে দিলাম। স্মৃতি হিসেবে থাকবে!
-মানে?
-বাড়ির এই পরিবেশ, অস্থিরতা সবকিছুর জন্য ও দায়ী। ও দিনে দিনে সবকিছু আরো অস্থির করে তুলবে। সম্পা তো আস্তে আস্তে ওর লাইনেই যাচ্ছে। কয়দিন পর মারুফাও যাবে। এটা ছাড়া আর উপায় কি বলো?
পলি বেগম রুম ছেড়ে বাইরে বের হলেন। বাড়ির সামনের বাগানে গিয়ে বসলেন। নিজের মাথাটা আপাতত ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। মালাও ওর ছেলে রাঈদকে নিয়ে মায়ের পিছনে পিছনে গেল।
__
এশা এতদিন যাবৎ নিজের বইগুলো খাটের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। বাসায় কেউ দেখে ফেলবে সেই ভয়ে। আজ সেগুলো বের করলো। ময়লা জমেছে বইয়ের উপর। বইগুলো পরিষ্কার করে টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখলো।
এরপর ও ফুয়াদকে ফোন করলো। বলল,
-শুধু বই এনেছেন। খাতা কলম কোথায়?
-আমি তো চলে এসেছি। বাসার নিচে।
-তো কি হয়েছে? আবার যান।
-না, কিছু হয়নি। ঠিক আছে যাচ্ছি।
ফুয়াদ তো চেয়েছে এশা বাড়িতে নিজের যথাযথ অধিকার নিয়ে চলুক। কিন্তু এখন তো দেখছে ওর উপরও অধিকার খাটাচ্ছে। মহা মুশকিলের ব্যাপার তো।
ফুয়াদ খাতা কমল নিয়ে বাসায় ফিরলো। সঙ্গে কিছু তাজা ফুলও এনেছে। এগুলো অবশ্য এশার জন্য নয়। ফুয়াদ তাজা ফুলের ঘ্রাণ পছন্দ করে সেজন্য প্রায়ই আনে।
এশা ফুলদানি থেকে আগের রাখা শুকনো ফুল গুলো ফেলে তাজা ফুল গুলো রাখলো। ফুল রাখতে গিয়ে ও একটি বেলি ফুলের মালা পেল। কি চমৎকার ঘ্রাণ! এশা নাকের কাছে চেপে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ।
ফুয়াদ ফ্রেশ হয়ে বের হলেও জানতে চাইল,
-এই মালাটা কার জন্য?
-মালা আসলো কোথা থেকে? দোকানদার ভুলে দিয়েছে বোধ হয়।
এশার সামান্য মন খারাপ হলো। তবে খুব বেশি নয়। ফুয়াদ নিজের ইচ্ছায় এটা ওর জন্য আনলেও তো পারতো! যাক, পরিবারের চাপে প্রেমিকাকে হারিয়ে ওকে বিয়ে করা স্বামীর কাছ থেকে এত প্রত্যাশা করা অন্যায়।
ফুয়াদ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল,
-মালাটা তো খুব সুন্দর। তোমার ভালো লাগলে খোঁপায় দাও।
সিগারেটের গন্ধ পেয়েই এশা বিরক্ত মুখে বলল,
-রুমে বসে স্মোক করা যাবে না।
-ওহ স্যরি! ব্যালকনিতে যাচ্ছি।
-নো! রুমের বাইরে গিয়ে সিগারেট শেষ করে তারপর আসুন।
ফুয়াদ বিস্মিত হয়ে বলল,
-এশা এই রুমটা আমার। তুমি আমাকে এভাবে বের করে দিতে পারো না।
-তো আমি কি এখানে ভাড়া থাকছি? আমি আপনাকে বের করে দিচ্ছি না। সিগারেট শেষ করে আসতে বলছি।
ফুয়াদ বিড়বিড় করে বলল,
-না, আমি ভাড়াটিয়া।
এই বলে ও রুম থেকে বের হয়ে গেল। বাসায় বিড়ি সিগারেট নিষিদ্ধ। রুমের বাইরে আরো বিপদ। ছাদে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এশা ওকে ভালোই নাজেহাল বানানো শুরু করেছে তো। এসব একদম সহ্য করা উচিত নয়। ও হাবাগবার মত সহ্য করছে কেন? কি অদ্ভুত! নিজের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ধুর ছাই! ফুয়াদ ছাদে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো।
নিচে এসে দেখলো দরজা ভেতর থেকে আটকে রেখেছে এশা। ও কড়া নাড়লো কয়েকবার। এশা দরজা খুললো না।
-আমাকে কি পার্মানেন্টলি রুম থেকে বের করে দিলে নাকি?
ভিতর থেকে ব্যস্ত গলায় জবাব এলো,
-আরে না, না। একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ।
একটু না। ফুয়াদকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। এরপর দরজা খুলতেই ওর নাকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ভেসে আসে।
এশা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা-কালো ছাপার হাফ সিল্কের শাড়ি। সঙ্গে সাদা ব্লাউজ। ওর লম্বা চুলের বড় খোঁপাটায় বেলি ফুলের মালাটা পেঁচিয়েছে। শরৎ এর আকাশে ভেসে বেড়ানো শুভ্র মেঘের ভেলার মত স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে।
ফুয়াদ ওর দিকে তাকাতে তাকাতে রুমে ঢুকলো। এশা রুমের দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দুই হাতে ফুয়াদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-কাল থেকে সিগারেট কমিয়ে খাবেন।
ফুয়াদ কিছু বলল না।
-আমাকে কেমন লাগছে ফুয়াদ?
-সুন্দর। দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকার মত।
এশা শব্দ করে হাসলো। পাহাড়ি ঝর্ণা বয়ে চলার শব্দর মত শুনালো। ফুয়াদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
-তোমার উদ্দেশ্যে কি এশা? তুমি কি আমাকে প্রেমে ফেলতে চাচ্ছো?
-না।
এশা ফুয়াদের গলা জড়িয়ে ধরেই পিছন দিকে হেঁটে খাটের কাছে গেল। মেয়েটার মাথায় হঠাৎ কি ভুত চেপেছে? কি করতে চাচ্ছে? ফুয়াদ শুধু তাকিয়ে দেখছে। এই সাজগোজ, মিষ্টি ঘ্রাণ সবই ভালো লাগছে। যে কেউই এভাবে তাকিয়ে থাকবে।
এশা হঠাৎ গলা ছেড়ে ফুয়াদকে দূরে সরিয়ে বলল,
-অনেক রাত হয়েছে। যান শুয়ে পড়ুন।
-তোমার রোম্যান্স এত জলদি শেষ! আমি তো আরো কিছু ভেবেছিলাম।
-আমি অত কিছু ভাবিনি। বেলি ফুলের মালা দেখে শাড়ি পরতে ইচ্ছে করেছে।
-আর আমার গলা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করেছে কেন?
-সেই কৈফিয়ত ও দিতে হবে? স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরার জন্য কারণ থাকতে হবে?
-না তা অবশ্য নয়। তবে বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত তুমি নিজ আগ্রহ থেকে আমার কাছে আসোনি। আজ হঠাৎ..। ওহ! একবার অবশ্য জ্যোৎস্না রাতে জড়িয়ে ধরেছিলে। সেটাকে ওভাবে কাছে আসা বলা যায় না।
ফুয়াদ বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এশা শাড়ি পরিবর্তন করে সুতি জামা পড়ার জন্য হাতে নিলো। ফুয়াদ ওর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বলল,
-আরে ধুর এত ঝামেলা করে তোমার শাড়ি বদলাতে হবে না! ভেবেছিলাম আজ নিজের ইচ্ছায় কাছে আসবে। লজ্জা পাচ্ছো আসতে? কিন্তু আমার অত লজ্জা নেই।
ফুয়াদ এশাকে নিজের বুকের উপর টেনে নিলো। এরপর ওর গালে হাত ছুঁইয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-মাই লাভলি ওয়াইফ এশা। আমাকে কাঁবু করতে চাও?
এই বলে ওর ঠোঁটে প্রগাঢ় চুমু খায়। লম্বা ঘোর লাগা চুমুর শেষে এশা জিজ্ঞেস করল,
-আপনি তো এখনো চোখ বন্ধ করলে প্রেমিকার মুখ দেখতে পান। এই যে চোখ বন্ধ করে চুমু খেলেন। কাকে দেখতে পেলেন?
-বেহুদা কথা জিজ্ঞেস করার আর সময় পাও না। একে তো শাড়ি পরে পরিকল্পিত ভাবে আমাকে পাগল করেছো।
ফুয়াদের গলায় বিরক্তি। এশা আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। নিজের উপর ফুয়াদের দখলদারিত্ব উপভোগ করলো।
এই মানুষটার সঙ্গে ও সুন্দর একটি সংসার চায়। ভালোবাসা চায়। বাচ্চাকাচ্চা চায়!
__
সকালে উঠে এশা ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগলো। ওর আজ প্রথম ক্লাস পৌনে বারোটায়। ফুয়াদ এই মূহুর্তে অফিসে। এশা তাকে ফোন করে বলল,
-আমি রেডি হচ্ছি। আপনি বাসায় আসুন। আমাকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিবেন।
-আমি তো ব্যস্ত এশা।
-আমি ওসব শুনতে চাচ্ছি না। আপনাকে বিশ মিনিটের মধ্যে আসতে হবে।
এশা জোরালো গলায় বলল। ও আগের মত বোকা নেই যে ফুয়াদের ফাঁদে পা দিবে। বিয়ের আগেই পলি বেগমের প্রধান শর্ত ছিলো পড়াশোনা করতে পারবে না। আজ সেই শর্ত ভেঙে ক্যাম্পাসে যাবে! এটা সহজ ব্যাপার না।
ফুয়াদ যেহেতু ওর পড়াশোনার ব্যাপারে সায় দিচ্ছে। তাহলে সে ই ওকে বাসা থেকে ক্যাম্পাসে নিয়ে যাক! এতে সম্পূর্ণ দোষ ওর একার ঘাড়ে পড়বে না।
ও গাঢ় খয়েরি একটা থ্রি পিস পড়েছে। চুল গুলো একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে রুম থেকে বের হতেই নিচতলায় ফুয়াদের গলা শুনতে পেল। এসেছে তাহলে!
মানুষটাকে ভালোই বলা চলে। বিয়ের প্রথমে এশা জোর গলায় কিছু বলেনি, কোনো অধিকার খাটায়নি তাই হয়তো সম্পর্কটা ঝিমিয়ে ছিলো। ফুয়াদকে বললে বোধ হয় সবই পাবে। কিন্তু না বলতেই কবে পাবে?
ফুয়াদ রাঈদকে কোলে নিয়ে দোতলায় আসলো। মালা ছেলের খোঁজে এসে দেখলো ফুয়াদ এশাকে নিয়ে কোথায়ও বের হচ্ছে।
-কোথায় যাচ্ছো ফুয়াদ?
ফুয়াদ রাঈদকে মালার কোলে দিয়ে বলল,
-এশাকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিতে চাচ্ছি!
-মানে? বিয়ের আগেই তো কথা ছিলো..।’
-এসব নিয়ে পরে কথা বলছি। ওর ক্লাসে দেরি হবে।
ফুয়াদ এশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। দ্রুত বাইক চালিয়ে ওকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিলো। ও আজ আর অফিসে যাবে না। নিজের ফ্ল্যাটে যাবে। বাসায় ওর জাতীয় পরিচয় পত্র কার্ডটা খুঁজে পাচ্ছে না। ফ্ল্যাটে রেখে এসেছে কিনা দেখতে হবে। এই মুহূর্তে হারালে খুব ঝামেলায় পড়বে। ভিসার কাজে লাগবে।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা