এই ভালো এই খারাপ পর্ব-০৩

0
84

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

বিকেলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলো তিথি। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর পার হওয়ার সময় সে দেখলো কপোত-কপোতী পাশাপাশি বসে বাদাম আর ডালমুট খাচ্ছে, হাসছে, কথা বলছে। আহা কি সুখ তাদের মনে! কি সুন্দর জুটি! তার জীবনে এরকম কোনো মানুষ এল না কেন?

অথচ কলেজে উঠার পর সে কত স্বপ্ন দেখতো! সমবয়সী অথবা কলেজের সিনিয়র কেউ তার প্রেমে পড়বে। তাকে খুব সুন্দর নামে ডাকবে। হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটবে। ভীষণ ভীষণ ভালোবাসবে। একটু চোখের আড়াল হলে পাগলামি করবে। তাকে সুন্দর সুন্দর উপমা দেবে। বলবে, তোমার গায়ে রঙ যাইহোক না কেন তুমি আমার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী।

অথচ তার কপালে কি জুটলো! একটা আঠাশ-উনত্রিশ বছর বয়সের বুড়ো খেঁচড়।
না জানে প্রশংসা করতে, না জানে একটু মিষ্টি করে কথা বলতে, না জানে একটু সুন্দর নামে ডাকতে।

সেসব তো দূর কোনোদিন তাকে নিয়ে শপিংমলে যায়নি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। এমনকি রেস্টুরেন্টে তার পাশাপাশি বসে খায়নি। কারণ সে পাশে দাঁড়ালে মানসম্মান কমে যাবে।

জীবনে যা যা চেয়েছিলো কিছুই পেল না সে। যা চায়নি তাই পেয়েছে। যেমন মানুষ দেখে তার ঘৃণা লাগতো তেমন মানুষ তার কপালে জুটেছে। একটু যত্ন-আত্তির ভালোবাসা যা সে চেয়েছে কিছুই পায়নি। চেয়েছে সিনেমার হিরোদের মতো কাউকে। কপালে একেবারে ফাটাকেষ্ঠ জুটে যাবে কে জানতো?

ডাক্তার দেখানোর জন্য ওয়েটিং রুমে বসেছিলো সে। কম্পাউন্ডার এসে বলল, ” ম্যাম এখন আপনি যেতে পারেন। ”
তিথি চেম্বারে ঢুকতেই দেখলো মহিলা ডাক্তারটি তাকে আগাগোড়া পরখ করছে। কেমন রাগী রাগী ভাব। সব কি ফাটাকেষ্ঠর বাপের বীজ নাকি? নইলে সবখানে এমন মানুষ জুটে কেন?

” এবোরশন কেস? ”

তিথি উপরনিচ মাথা নেড়ে বলল।

” জ্বি। ”

” নাম? ”

” মেহেবুবা মাহনূর তিথি। ”

” আপনার স্বামী কোথায়? ”

” মৃত। ”

” আপনাকে তো বিধবাদের মতো লাগছে না। ”

তিথির দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ডাক্তারনী। তিথি বলল,

” আমি বাচ্চাটা চাই না। আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে। ”

” সেটা বাচ্চা নেয়ার সময় খেয়াল ছিল না? ”

তিথি ভড়কে গেল। বলল,

” বাচ্চা যে দিয়েছে তার দোষ। ওসবে আমার হাত নেই।”

ডাক্তার মহিলাটি বলল, ” আপনার হাসবেন্ড আজলান শেখ না? ”

তিথি চমকে উঠলো। চোখদুটো ঈষৎ বড়বড় করে বলল, ” আপনি কিভাবে জানেন? ”

” উনাকে কে না চেনে। দেখুন আপনার হাসবেন্ড একজন আইনের মানুষ। বাচ্চাটা তারও। আমি তাকে ছাড়া আপনাকে কোনো সল্যুশন দিতে পারবো না। আমাদের উপর চাপ আসবে। ”

তিথি বলল, ” টাকা তো আমার আব্বা দিবে। টাকা পেয়ে গেলে কাজ করতে সমস্যা কোথায় ডাক্তার?”

” ডাক্তাররা সব কাজ টাকার জন্য করে একথা আপনাকে কে বললো? আপনি এখন যান। ”

তিথি সরু চোখে চেয়ে বলল, ” এখানে কি আগে থেকেই আজলান শেখ এসেছিলো? তো আসুক সমস্যা কি? আমি অন্য ডাক্তারের কাছে যাব। এই শহরে কি ডাক্তারের অভাব আছে? ”

ডাক্তার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তিথি বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলল, ” ফিসটা তাহলে আজলান শেখের কাছ থেকে নিয়েন। ”

” গন্ডারের বাচ্চা গন্ডার তোর বংশবৃদ্ধি হতে দেব না আমি” এ বলে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে এল তিথি।

_____

বাড়ি ফেরার পথে অন্য একজন গাইনী বিশেষজ্ঞের খোঁজ নিয়ে এল তিথি। আজলান শেখের এসব ষড়যন্ত্র তাকে ঠেকাতে পারবে না। দরকার পড়লে সে গলায় দঁড়ি দিয়ে আজলান শেখের নামে চিঠি লিখে যাবে। মরেও শান্তি দেবেনা সে লোকটাকে। তাকে অসহায়, অবলা পেয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন করেছে শারীরিক মানসিকভাবে। লোকটাকে সে কিছুতেই ক্ষমা করবে না।

বাড়ি ফিরতেই মা হাসিমুখে দৌড়ে এসে বললো,
“হ্যা রে তিথি, শোন না। জামাই ফোন দিছে আমার ফোনে। বলছে তোরে পাঠাই দিতে। ”
ফোন দিয়েছে শুনে তিথি একটু খুশি হলো। কারণ আজলান শেখ এখন ভয় পাচ্ছে বাচ্চাটা হারিয়ে ফেলবে বলে। এমন ভয়ই তো দেখতে চেয়েছিলো তিথি।
” আর কি বলেছে? ”
” বললো গাড়ি যাবে, আপনাদের মেয়েকে বলুন তৈরি হয়ে থাকতে। গাড়ি গেলে যেন উঠে পড়ে। মেয়েকে একটু ভালো বুদ্ধিসুদ্ধি দিন। বাবা মা মিলে মেয়েকে উস্কে দিলে ঘর তো ভাঙবেই। ”

তিথি হা হা করে হেসে উঠে বলল,

” ফাটাকেষ্ঠ ভয় পায়ছে আম্মা বুঝলে? অনেক তো বাহাদুরি করলো। তুমি ফোন করে বলো আমি যাব না। কিছুতেই না। ”

মালেকা বেগমের মুখখানা চুপসে গেল। বলল,

” জামাই যদি আসে তাও যাবি না? ”

তিথি গালে হাত দিয়ে বলল,

” তওবা তওবা কি বলো আম্মা? আজলান শেখ জীবনেও আসবে আমাকে নিতে? তুমি কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতেছো? মাঝেমধ্যে এমন আউলাঝাউলা কথা বলো যে কচু গাছে ফাঁস খাইতে ইচ্ছে করে। ”

” তুই সত্যি সত্যি বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলবি তিথি? তোর মনে একটুও মায়াদয়া হচ্ছে না বাচ্চাটার জন্য? মায়ের মন এত পাষাণ হতে পারে না তিথি।”

মাকে ঝাড়ি মেরে চলে এলেও কথাটা তিথিকে ভাবালো। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবলো ওয়েটিং রুমে বসা ওই রোগীটার কথা। ওই মহিলার কিছুতেই বাচ্চা হচ্ছে না তাই কত কষ্টে আছে। তিথির ভীষণ কান্না পেল কিন্তু সে কাঁদলো না বাচ্চার খচ্চর বাপের কথা মনে পড়ায়।

মালেকা ফোনটা কানে ধরে ঘরে ঢুকে এসে বললো,

” এই তিথি নে তোর শ্বাশুড়ি ফোন করেছে। ”

তিথি মাথা তুলে চাইলো। বলল,

” কথা বলার মুড নেই। ”

মালেকা বেগম বললেন,

” হ্যা বেয়াইন দিচ্ছি। এ নে কথা বল। সালাম দে। ”

তিথি ফোনটা কানে লাগিয়ে বললো,

” হ্যা বলো। ”

মালেকা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

” আদবকায়দা সব ভুলে গেছিস দেখছি। ”

” আহা কথা বলতে দাও তো আম্মা। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” দেখ বউ তুই ভুলভাল ঔষধ টষুধ খাবি না কিন্তু। আল্লাহর কসম লাগে ওই বাচ্চার যদি কিছু হয় আমি নিজে বিষ খাবো। ওই বাচ্চাটা হোক। তারপর তোরা যা ইচ্ছে তাই করিস। ”

তিথি বলল, ” এসব তোমার কথা? নাকি তোমার ছেলের? ”

” আমার ছেলের কথা হবে কেন? ”

তিথি বলল, ” তোমার গুণধর ছেলে কোথায়? ”

আম্বিয়া বেগম পাশে তাকালেন। উনি ছেলের ঘরে বসে আছেন। আজলান এক পায়ের উপর অন্য পা লম্বা করে রেখে পিঠের নীচের বালিশে ঠেস দিয়ে বসে টিভিতে নিউজ দেখছে। কোলের উপরও একটা বালিশ।
মনোযোগ কোনদিকে আম্বিয়া বেগম বুঝে উঠতে পারলেন না। বললেন,

” ওর ঘরে বসে টিভি দেখছে। ”

তিথি বললো,

” শুনে খুশিতে মরে গেলাম। রাখো ফোন। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” শোন না বউ। ও নিজেই বলছে তোকে চলে আসতে। বাচ্চাটা হোক। তারপর এই ডিভোর্স ডিভোর্স খেলিস মা আমার। বাচ্চাটারে নষ্ট করিস না। ”

তিথি বলল, ” ব্যাপারটা কি সাসুমা? ছেলের সামনে বসে এত ভালো কথা বলছেন। ছেলে সরলে তো খানকির বেটি ডাকতে দু’বার ভাববেন না। ”

আম্বিয়া বেগম থতমত খেয়ে বললেন, ” তুই একটা কথা বল । আসবি কি আসবি না? ”

তিথি বলল, ” যাব না মানে যাব না। ব্যস। আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে আবার বলছে ফিরে যেতে। কেন? আমাকে কি কিনে নিয়েছ মা ছেলে মিলে? ”

আম্বিয়া বেগম কিছু বলার আগেই আজলান বলল, ” মা ফোনটা দাও। ”

আম্বিয়া বেগম ফিসফিস করে বললেন, ” বকিস না বাবা। একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি আনতে পারিস কিনা দেখ। তারপর ওই বেটির কি হাল করি আমি দেখ। ”

আজলান ফোন কানে দিয়ে বলল,

” হ্যালো! শুনতে পাচ্ছ। ”

তিথি চুপ করে রইলো। মাকে খুঁজলো। মালেকা বেগম বাথরুমে গিয়েছেন। তিথি তেঁতোমুখে বলল, ” হাগার আর সময় পায়নি। ”

আজলান আরও কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলতেই তিথি নাকিসুরে রোবট গলায় বলল,

” দুঃখীত ফোনের মালিক এখন হাগতে গেছে। অপেক্ষা করুন নইলে ফোন রাখুন। ”

তিথি কথাটা বলামাত্রই আজলান ঘর ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,

” মেহবুব! ”

আম্বিয়া কেঁপে উঠলেন। বুক ধড়ফড় করে উঠলো উনার। বুকে হাত দিয়ে অগ্নিশর্মা ছেলের শক্ত মুখপানে চেয়ে বিড়বিড় করলেন,

” লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
খানকির বেটি আবার কি বলে বসলো কে জানে? কেন আমি ওই মেয়েরে বউ করে আনতে গেলাম খোদা?”

তিথি ফোনটা কেটে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। জোরে জোরে হাসলো। মন থেকে হাসলো।
মনের দুঃখে রসিয়ে রসিয়ে গাইলো,

” দেখতে বর বর, কিন্তু আস্ত বর্বর
একটা জুটে গেছে কপালে
দেখতে handsome, কিন্তু ফেলুরাম
ফেঁসে গেছি আমি অকালে ”

আম্বিয়া বেগম ধীরেসুস্থে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি হলো রে? কি বললো আবার? ”

আজলান ঘরের একোণা হতে ওকোণা অব্দি চোখ বুঁজে পায়চারি করতে লাগলো। তার মাথার রগ দপদপ করছে। আম্বিয়া বেগম বললেন,

” ও আজলান? কি হলো। বল না। ”

আজলান অনেকক্ষণ পর থামলো। রিমোট চেপে টিভি অফ করলো। ড্রয়ার থেকে চাবিটা হাতে নিল। বালিশের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিল। আলনার উপর থেকে গ্রে স্যুট ভেস্টটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

” আমি আসছি। ”

আম্বিয়া বেগম পিছু পিছু ছুটলেন।

“কোথায় যাচ্ছিস?ও আল্লাহ। কিছু তো বল বাবা।”

আজলান বলল, ” ওকে নিয়ে আসবো। ”

_____________

তিথির ভীষণ খিদে পেয়েছে। মাগরিবের পরপর ভীষণ খিদে পাচ্ছে ইদানীং। দুপুরের ভাত বেঁচে গেলে সে আছরের আজানের পর আবার খায়। আজকে খায়নি তাই খিদে আরও জোরসে বেড়েছে। তরকারির পাতিলের ঢাকনা উল্টে দেখলো চিংড়ি মাছের ঝোল আর তিনটে চিংড়ি রয়ে গেছে। সেই পাতিলে দুমুঠ ভাত মিশিয়ে মাখতে মাখতে দু-চার লোকমা পুরে দিয়েছে মুখে। তক্ষুণি কলিং বেল বেজে উঠলো। তুষার আর বাবা নেই বাড়িতে। মা নামাজ পড়ছে। তিথি ভাবলো, হয়ত তুষার আর বাবা কেউ এসেছে। তাই ভাত চিবোতে চিবোতে বাম হাতে টেনে দরজা খুললো।

দরজা খোলামাত্রই আজলানকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠতে দেরী। তার হাতটা শক্ত করে ধরে ” একদম চুপ ” বলে গাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেতে আজলানের দেরী হয়নি। কোরবানির গরুকে যেমন টানে ঠিক সেভাবেই টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিলো।

তিথি বসে গেল আর না পারতে। আজলান চোখ নীচু করে তাকে দেখলো। তিথির ঠোঁটের একপাশে ভাত আর ঝোল লেগে আছে। ডান হাতে ভাতমাখা তো আছেই। দেখতে দেখতে বমি পেয়ে গেল তার।

তিথি এতক্ষণ কথা বলতে পারছিল না ভাত মুখে থাকায়। ভাতগুলো খাওয়া শেষে হাতে লেগে থাকা ঝোলঝাল খেতে খেতে বলল,

” আচ্ছা ভাতগুলো খেয়ে আসি? আমার হাতে মাখা ভাতগুলো এখন কে খাবে? ওগুলো ফেলে দিলে অপচয় হবে না? তুমি তো অপচয় করা পছন্দ করো না।”

আজলান দাঁতে দাঁত চেপে তাকে হ্যাঁচকা মেরে টেনে তুলে গড়িতে বসিয়ে জোরে গাড়ির দরজা বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,

” কি দোষ করলাম জানিনা। এমন একটা বস্তি কি করে জুটলো কপালে! ”

সারারাস্তা ভর তিথি ঢেঁকুর তুলতে তুলতে এল। একটু পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি গন্ডারটা। এত অত্যাচার করে তাকে!

গন্ডারটা সন্ত্রাস দমনকারী চৌকস বাহিনীর সদস্য না হলে নারী নির্যাতন কেসে সে কবেই গরাদে ভরে দিত। তারপর বলতো,

” নে মদন, এবার টান জেলের ঘানি। তুই করবি সন্ত্রাস দমন? নিজেই তো আস্ত একটা সন্ত্রাস। ”

চলমান….