একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-০৫

0
167

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৫.
তানহার দৌড়োদৌড়ির শেষ নেই৷ সকাল থেকেই সকল কাজ ত্বরান্বিত ভঙ্গিমায় করছে সে৷ একেকবার করে একেকদল আসছে বউ দেখতে৷ সবার সাথেই আন্তরিকতার সাথে কথা বলতে হচ্ছে তাকে৷ এক দল যায় তো কিচ্ছক্ষণের মধ্যেই অন্য দল এসে হাজির৷ সবাইকে আবার সঠিকভাবে আপ্যায়নও করতে হচ্ছে৷ একা পেরে ওঠা যাচ্ছে না৷ অন্যরাও নিজেদের মতো নানা কাজে ব্যস্ত৷ কী আর করার! ছেলে যখন বিয়ে দিয়েছে, বউ দেখতে তো মানুষ আসবেই৷ পাতিল থেকে হরেকরকম পিঠ তুলে নিলেন প্লেটে৷ অতিথিদের সামনে প্রদানের জন্য উদ্যত হলেন তানহা৷

শ্রুতির মনটা ভালো না হলেও খারাপ না। সকালে বিভার সাথে কথা হয়েছে৷ তাছাড়াও সকালে পার্থিবকে বলেছিল যাতে হামিম এর সাথে কথা বলিয়ে দেয়৷ পার্থিব কেমন করে যেন সত্যি সত্যি হামিমের কাছে ফোন পৌঁছে দিয়েছিল৷ কিন্তু বিভার মতোই হামিম শ্রুতির সাথে কথা বলেনি৷ শুধু চুপ করে কানে নিয়ে বসে ছিল৷ হামিমের নিঃশ্বাস এর শব্দ শ্রুতি ঠিকই পেয়েছে৷ হামিম অন্যদের তুলনায় জোড়ে নিঃশ্বাস নেয়৷ হামিমের নিঃশ্বাস এর শব্দতেই খুশি হলো শ্রুতি। শ্রুতি গম্ভীর গলায় শুধু এটুকু বলেছিল, ‘ভাই? আমি জানি তুই শুনতে পাচ্ছিস। মন খারাপ করিস না৷ আমি আজ চলে আসব সন্ধ্যাবেলা৷ আপাও আসবে৷ আমরা আবার অনেক মজা করবো৷’
এতটুকু বলে থামে শ্রুতি৷ আবারও বলতে শুরু করে,
‘আমার ভাই যদি তার আপাদের ভালোবাসে তাহলে যেন সে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার সব ঠিকমতো খেয়ে নেয়৷ ঠিকাছে?’
হামিম কিছু বলেনি৷ ফোন কেটে দিয়েছে৷ এতে অবশ্য শ্রুতি কিছু মনে করেনি৷ কারণ সে জানে হামিম অভিমানী। তার ধারণা তাকে কেউ ভালোবাসে না৷ অথচ সে জানেই না তার দুই বোন তাকে কতোটা ভালোবাসে! নিজের পৃথিবী মানে৷

দেড় ঘন্টা ধরে একইভাবে বসে আছে শ্রুতি৷ প্রতিবেশীরা আসছে আর তাকে দেখে নানানরকম প্রশংসাসূচক বাক্য বলে বিদায় নিচ্ছে৷ সম্ভবত এরা এই ব্লিডিং এরই মানুষজন৷
তার শ্বশুড়বাড়ি ১১ তলার এক ব্লিডিং৷ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটগুলো মিলেই তার শ্বশুড়বাড়ি৷ সে এখন দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করছে৷ তাকে ঘিরে আছে নানান মানুষজন৷ এখন অবশ্য তেমন ভীড় নেই৷ তবে শ্রুতি আশঙ্কা করছে কিছুক্ষণ এর মধ্যেই আবার ভীড় জমবে৷ অর্থাৎ তাকে আরেকদফা দেখতে আসবে৷
দূরেই প্রভা-প্রত্যাশা দাঁড়িয়ে খোশমেজাজে ছবি তুলছে৷ শ্রুতি সেখানে বিভা আর নিজেকে কল্পনা করলো৷ মনের অজান্তের সুক্ষ্ম এক হিংসা কাজ করল প্রভা-প্রত্যাশার প্রতি৷ এতোক্ষণে এটুকু জেনেছে যে প্রভা-প্রত্যাশা জমজ দুই বোন৷ তার ছোট দুই ননদ৷ পার্থিব এর ছোট দুই বোন৷ অর্থাৎ পার্থিবই বড়৷
“পার্থিবই বড়” কথাটা ভুল৷ কারণ তার চাচারাও এখানে থাকে৷ সেই সূত্রে এই পরিবারের বড় ছেলে পার্থিবের চাচাত ভাই হিমেল৷

শ্রুতির আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে দিয়ে আবারো এক দল মানুষ প্রবেশ করল৷ তানহা এগিয়ে এলেন৷ বিয়ের দিনের সেই ভাবী মেয়েটিও এগিয়ে এল৷ শ্রুতি জেনেছে এই মেয়েটি হলো হিমেল এর স্ত্রী হিয়া৷ প্রভা-প্রত্যাশা এদিকে তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না৷ তারা নিজেদের কাজে ব্যস্ত৷ সুন্দরমতো ছিমছাম গড়নের দুইজন মহিলা আর একজন তুলনামূলক স্বাস্থ্যবান মহিলা এসেছেন৷ পাশে কিশোরী বয়সের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সম্ভবত তাদের কারো মেয়ে হবে৷
তারা নিজেদের মধ্যে সাংসারিক আলাপ করতে লাগলেন৷ আলাপের এক পর্যায়ে সুন্দরমতো মহিলাটি বলে ফেললেন,
‘মেয়ে তো মাশা-আল্লাহ ভালোই আনছেন। রঙ চাপা চলেও দেখতে ভালো। কিন্তু এতো রোগা কেন? শরিলে তো বলতে গেলে কিছুই নাই৷’
শ্রুতি বিরক্ত হলো না৷ এমন কথা সে প্রায়ই শুনে৷ সে এসবে অভ্যস্ত। তাই এখন আর বিরক্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই৷
শ্রুতির বদলে বিরক্ত হলেন তানহা৷ এসব কী ধরনের কথাবার্তা? শ্রুতি এতোটাও চিকন নয়৷ আবার সে মোটাও নয়৷ মাঝারি গড়নের চেয়ে একটু কম৷ তার পছন্দ নাই হতে পারে৷ তাই বলে এসব বলবে কেন?

‘কি ভাবী, মিথ্যা বললাম কী? দেখেন শরীরে কিছু নাই৷ জামাই কি দেইখা আদর করব?’
বলেই শরীর দুলিয়ে হাসতে আরম্ভ করলেন৷ মনে হলো বিশেষ কোনো কৌতুক বলে ফেলেছেন৷ শ্রুতি অবাক হয়ে চেয়ে রইল৷ সমাজে এমন কিছু মহিলা থাকে যারা এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে মজা পান৷ নিজেদের রসিক মানুষ হিসেবে গণ্য করেন৷ এরাও ঠিক তাই৷ শ্রুতি এদের নিয়ে তেমন ভাবল না৷ বলেছে তো বলেছে৷ তবে এটা সত্যি যে সে কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ করছে৷

‘আদর করার জন্য কিছু দেখার প্রয়োজন পরে না৷ আর আমি ইচ্ছে করেই হ্যাংলা-পাতলা মেয়ে বিয়ে করেছি আন্টি৷ আসলে কী বলুন তো,আমি দেখেছি কিছু কিছু মেয়েরা বিয়ের পর কান্নাকাটি করে৷ আমার বউ ও যদি সেরকম হয়! যদি আবার কান্নাকাটি করে তাহলে? কান্নাকাটি করলে যেন কোলে তুলে কান্না থামাতে পারি তাই রোগা মেয়ে বিয়ে করেছি৷’
আনন্দিত গলায় বললো পার্থিব৷

পার্থিবের রসিকতা শ্রুতির পছন্দ হলো না৷ কথায় ঠিক কী প্রকাশ পেল শ্রুতি বুঝল না৷ চেষ্টাও করল না৷
মহিলা পার্থিব এর কথায় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধুমাত্র।
__________

আমিন সিকদার বিমর্ষ চিত্তে বসে আছেন৷ চেহারায় অপ্রসন্নতা স্পষ্ট৷ তার মুখ অবয়বেই চিন্তার স্পষ্ট প্রকাশ৷ বিভা, শ্রুতির এর বিদায় এর সময় বিভাকে ভাড়া করে আনা ক্যাবে করে তার শ্বশুড়বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল৷ বিভার শ্বশুরবাড়ি তো এতোটা সচ্ছল নয় যে, নিজের গাড়ি করে বিভাকে নিয়ে যাবে৷ সব ছোটলোকের জাত। যত্তোসব!
চিন্তা সেটা নয়৷ চিন্তা অন্য জায়গায়। বিদায়ের সময় শ্রুতির মুখে হাসি ছিল৷ মিষ্টহাসি সমেত সে তাকিয়ে ছিল আমিন সাহেবের দিকে৷ হাসিটাতে যে লুকায়িত কোনো চিন্তা ছিল তা স্পষ্টই বুঝেছে আমিন সাহেব৷ তার থেকেও বড় বিষয় হলো – যাওয়ার আগে শ্রুতি আমিন সাহেব এর দিকে এগিয়ে এলো৷ মুখটা আমিন সাহেবের শ্রবণেন্দ্রিয়ের সামনে নিয়ে বলল, বাবা! বেশি কষ্ট একদম পাবেন না৷ আপনার ছোট মেয়ে ছয় মাসের মধ্যেই আপনার বাড়িতে আবার ফেরত আসবে,কথা দিলাম। আপনি একদম নিশ্চিত থাকতে পারেন৷
বলার সাথে সাথেই তার মুখের মুখের হাসি আরোও প্রশস্ত হলো সেই সাথে আমিন সাহেবের চুপসে যাওয়া মুখটা আরোও রক্তশুন্য হলো৷

ঘটনাটির স্মরণ করা মাত্রই বিন্দু বিন্দু ঘাম জায়গা করে নিল তার মুখমন্ডলে। ঘটনাটি প্রথমে আমল নেয়নি তিনি৷ কিন্তু এখন বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার৷ শ্রুতি যেন তেন মেয়ে নয়৷ শ্রুতিকে সে ভয় পায়। বিন্দুমাত্র হলেও পায় যদিও সেটা অপ্রকাশিত। শ্রুতির সামনে প্রকাশ করেন না তিনি৷ কিন্তু কী করবে শ্রুতি? সত্যিই কী কিছু করবে? যদি আসাদ সাহেব তার উপর রেগে যান? তার কম্পানির সাথের প্রজেক্টটা যদি রিজেক্ট করে দেন, তাহলে? তার চেয়েও বড় কথা এতো বড় বাড়িতে বিয়ে হয়েছে শ্রুতির৷ এতো বড়লোক বাড়ির সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক সামান্য ব্যাপার নয়৷ এর সাথে তার অনেক স্বার্থ জড়িয়ে আছে৷ সবটা ভেস্তে যাবে না তো কোনোভাবে?

‘কী নিয়ে এতো চিন্তা করছো বলোতো?’

আমিন উত্তর দিলেন না৷ সব প্রশ্ন উত্তর পাওয়ার আশায় করা হয় না৷ এটাকেও সেই কাতারে ফেলা যেতে পারে৷ শাহিনা বলল, ‘তোমার ওই ছোট মেয়েকে নিয়ে ভাবছো বুঝি? ভেব না৷ কিচ্ছু করতে পারবে না৷ বিয়ে হয়ে গেছে৷ শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে৷ তারাই ওর ডানা কেটে ঘরে বসাই রাখবে। মেয়েদের যত উড়াউড়ি সব বিয়ের আগেই যা, বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির কয়েক ঘা পিঠে পরলেই শায়েস্তা হবে ওই বেয়াদব মেয়ে৷’

আমিন সাহেব শাহিনার দিকে তাকালেন৷ শাহিনা প্রতিবার বিভা, শ্রুতিকে ‘তোমার ওই মেয়ে’ বলে সম্বোধন করেন৷ এর কারণ কী? সে কী বিভা, শ্রুতিকে নিজের মেয়ে ভাবে না? কিন্তু বিয়ের সময় তো সে বলেছিল ওদের নিজের সন্তান ভেবেই লালন-পালন করবে সে৷ অবশ্য কাকে কী বলবেন আমিন সাহেব? সে নিজেই তো ভাবে না৷ কালো মানুষের প্রতি তার তীব্র ঘৃণা, হোক সে নিজের মেয়ে কিংবা ছেলে৷ কালো মানুষের দিকে তাকালেই তার ঘৃণা লাগে, গা গুলোয়।

‘শাহিনা, তুমি হয়তো ভুলে গেছ শ্রুতি যা বলে তাই করে দেখায়৷ এর আগেরবার আমার অফিসের গুণী-জ্ঞানী মানুষদের সামনে যা ঘটেছিল তা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে।’

এক কিংবা দেড়বছর আগের কথা৷ সেদিন ছিল বিভার জন্মদিন৷ ভালো-মন্দ রান্না হয়েছে। যদিও বিভাই সব রান্না করেছে শ্রুতির জোড়াজুড়িতে৷ কারণ নিজেকে এতোটাও গুরুত্বপূর্ণ বিভা ভাবে না যার জন্মদিনে এতো ভালো ভালো রান্না হবে৷ শ্রুতি চায় যাতে আজ সে, বিভা, হামিম আর দাদিআম্মু মিলে দিনটা উপভোগ করতে পারে৷ কিন্তু ব্যাঘাত ঘটালো আমিন সাহেব। সে জানালো আজ তার অফিসের কিছু মানুষ আসবে তার বাড়িতে৷ দুপুর এর লাঞ্চ করে তবেই যাবেন৷ এটাও জানা গেল – তার অফিসের ক্লায়েন্টরা নিজ ইচ্ছেতে আমিন সাহেবের বাড়িতে আসছে৷ শ্রুতির রাগ হলো৷ ক্রোধে ফেটে পড়ল সে৷ তেজপূর্ণ গলায় বলল, ‘আজ এই বাড়িতে কেউ আসবে না৷ কেউ না।’

আমিন সাহেব রাগ সহিত চাইলেন শ্রুতির পানে৷ আজকাল এই মেয়েটাকে তার আর সহ্যই হচ্ছেনা৷ মাঝেমধ্যে বড্ড আফসোস হয় তার! সে কেন জন্মের পরই এই মেয়েটাকে গলা টিপে হত্যা করলো না! কেন?
আমিন সাহেব রাগ সংবরণের বৃথা চেষ্টা করে বললেন, ‘আমাকে রাগাস না৷ আমি কোনোরকম ঝামেলা চাইছি না৷ আমার ক্লায়েন্ট আসবে মানে আসবেই৷’
শ্রুতি তাচ্ছিল্যতার সহিত হাসল৷ বলল, ‘শুনবে না তো আমার কথা? ওকে শুনো না৷ কিন্তু এর পরে যা হবে তার জন্য একমাত্র তুমিই দায়ী বা…..বা।’
শেষের বাবা ডাকটা কিছুটা সুর তুলে বলল শ্রুতি। সাথে ছিল কটাক্ষ৷ বলেই হাসতে হাসতে চলে গেল সে৷

দুপুর ১ঃ৩০। দুপুরে আমিন সাহেবের ক্লায়েন্টরা সবাই এলো৷ সোফায় বসে তারা আলাপ-আলোচনা করছে। কিছুক্ষণ পর আমিন সাহেব সকলে দুপুরের খাবারের জন্য ডাইনিং টেবিলে আমন্ত্রণ জানালেন৷ সবাই গিয়ে একে একে বসল। আমিন সাহেব গলা উঁচিয়ে ডাকলেন খাবার পরিবেশনের জন্য৷ শ্রুতি হাসিমুখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো৷ আমিন সাহেবের ভ্রু আপন শক্তিতে এক হয়ে এলো৷ শ্রুতি হাসিমুখে সকলে সালাম দিল, ‘আসসালামু আলাইকুম’

‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’’
কিছু কিছু ব্যক্তিবর্গ সালামের উত্তর নিলেন৷

‘ভালো আছেন আংকেল? আমি শ্রুতি৷ আমিন শিকদারের আদরের ছোট মেয়ে। ভালো নাম ফাতিমা ইসলাম।’ বলেই হাসিসমতে আমিন শিকদারের দিকে তাকালেন৷ ইতিমধ্যে তার মুখমন্ডল রক্তশুন্য৷ শ্রুতি পরিকল্পনা আন্দাজের বৃথা চেষ্টায় নেমেছে সে৷

‘মা, কথা পরে হবে৷ যাও আগে খাবার নিয়ে এসো৷ তোমার আংকেলরা তো বসে আছে।’

‘খাবার তো নেই বাবা৷’ অসহায়, হতভম্ব কন্ঠে বলল শ্রুতি।

‘খাবার নেই মানে! কী বলছো এইসব? মাথা ঠিক আছে? আপ..নারা কিছু মনে করবেন না৷ আমার ছোট মেয়েটা মজা করতে একটু বেশি পছন্দ করে৷ এই আরকি..। হাহা…’

‘বাবা, আমি মজা করবো কেন? আমি মজা করছিনা৷ আমি সত্যি বলছি। খাবার নেই৷ আর তাছাড়া এতো নাটকের কী প্রয়োজন আছে বলোতো? সত্যিটা বলে দাও ওনাদের, তাহলেই হয়৷’

‘কোন সত্যি?’ সেখানকার মধ্যবয়স্ক মতো একজন লোক বলে উঠল৷

শ্রুতি অসহায় চাহনির সাথে বলল, ‘আর বলবেন না আংকেল৷ লজ্জার বিষয়৷ কাল থেকে বাবা চিন্তায় চিন্তায় শুকিয়ে যাচ্ছিল আপনারা আসবেন বলে৷ আসলে বাবা একটু কৃপণ ধাঁচের৷ এইরকম উল্টোপাল্টা খরচ একদম পছন্দ করেন না৷ অথচ আপনারা নাকি বলেছেন, আপনারা নিজ থেকে আমাদের বাসায় এসে লাঞ্চ করতে চান৷ সে নিয়ে বাবার সে কী চিন্তা! চিন্তা আর দেখে কে! পরে সে বসে বসে নাটক সাজাতে লাগলেন৷ যেন আপনারা এলে আমি খাবার না থাকার নাটক করি৷ আসলে খাবার আছে৷ কিন্তু শুধু আমাদের বাড়ির ছয়জন এর। আপনারা খেলে আমাদের আর খাওয়া হবে না৷’ বলেই করুণ মুখটা আরোও করুণ করার প্রচেষ্টায় নেমে পড়ল শ্রুতি৷

অন্যদিকে আমিন হতভম্ব, বিস্ময়, আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন শ্রুতির দিকে৷ গর্জে উঠে বললেন, ‘শ্রুতি! এইসব কোন ধরনের মজা৷ তোমার মজা বন্ধ করো। আর শাহিনা কই? তাকে ডাকো৷ তোমার আম্মুকে ডাকো৷ জলদি!’

শ্রুতি শিশুসুলভ দৃষ্টি মেলে বলল, ‘এতোজন মানুষ আসবে শুনে মা ভীষণ রেগে গেছেন৷ তাই ছাঁদে চিলেকোঠার ঘরে রাগ করে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন।’

টেবিল থেকে ইতিমধ্যে সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে৷ তাদের চেহারা অপমানে জর্জরিত। আমিন সাহেবের ভালো, অমায়িক ব্যবহারে সবাই নিজে থেকেই এই বাড়িতে আসতে চেয়েছে৷ কিন্তু এইভাবে অপমানিত হবে কিংবা তাদের পারিবারিক ঝামেলায় ঢুকে পরবে কেউ ভাবেনি৷ কেউ কেউ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ এখানে তাদের বলার কিছু নেই৷ মেয়েটা কী মিথ্যে বলবে?
তাদের মধ্যে থেকে একজন খাটো লোক বলে উঠল, ‘আজ তাহলে আসি৷ আমার হঠাৎ একটা কাজ পড়ে গেল। যেতে হবে।’

আমিন সাহেব কী বলবে ভেবে পেলেন না৷ এরা তো শুধু মেহমান নয়, এরা সবাই টাকার কুমির৷ এদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়া মানে নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারা৷ কী বলে আটকাবেন তিনি?

ইতিমধ্যে সকলে লজ্জায়,অপমানে,রাগে প্রস্থান করে ফেলেছে৷ ঠিক সেই মূহুর্তে দৌড়ে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো শাহিনা৷ উদগ্রীব কন্ঠে বলল, ‘কই? কই? ক্লায়েন্ট কই? তোমার না ক্লায়েন্ট আসার কথা ছিল? কই তারা? এরকম লাগছে কেন তোমাকে?’

শান্ত গলা প্রশ্ন ছুড়ল আমিন সাহেব- ‘এতোক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?’

ক্রোধে ফেটে পড়ল শাহিনা৷ ক্রুদ্ধ দৃষ্টি শ্রুতির পানে মেলে বলল, ‘শ্রুতি আমাকে ছাদে আটকে রেখেছিল৷ এইমাত্র তোমার বড় মেয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।’

কথাটা শোনা মাত্রই যেন আমিন সাহেবের চোখ মূখ ফেটে লাভা বের হতে লাগল৷ শ্রুতির দিকে তাকালে সে মুচকি হাসি সমেত চলে গেল৷
ক্লায়েন্টদের জন্য রান্না শাহিনার সকল খাবার রাস্তার পথশিশুদের মাঝে বিলিয়ে দিল বিভা, শ্রুতি৷ এরপর তারা দিনটিকে তাদের মতো উৎযাপন করল৷ যেখানে ছিল বাহার, বিভা, হামিম, দাদীআম্মু, আর তাহিরার মিষ্টি হাসিসমেত একটি মুখ।
___________
চলবে~