একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান
১৬.
আমরা আমাদের ‘বড়বেলা’ টাকে আলাদা গুরুত্বের নজরে দেখি। বড় হয়ে এটা করব, ওটা করব… কতো চিন্তা বড়বেলাকে কেন্দ্র করে! অথচ এরমধ্য দিয়ে ‘ছোটবেলা’ অবহেলায় রয়ে যায়; একজন মানুষের জীবনে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটা মূহুর্ত মূল্যবান। বলতে গেলে ছোটবেলাটাই বিশেষভাবে মূল্যবান। কেননা, এই বয়সেই একটা মানুষের চিন্তাধারা তৈরি হতে শুরু করে, এই বয়স মানুষকে ভাবতে শেখায়। এই বয়সের চিন্তাধারা, ভাবনা মানুষের মস্তিষ্কে একটা আলাদা প্রভাব তৈরি করে। তাই যাদের ছোটবেলা সুন্দর, যারা সুন্দর,স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে, বলা যায় তাদের মানসিকতাও সুন্দর, সমৃদ্ধ, সুস্থ।
শ্রুতির ছোটবেলা, কৈশোরকাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রতিটা কালই খারাপ। ১৩ বছরে মা মারা যাওয়া, বাবার বদলে যাওয়া, ফুটফুটে ছোট ভাইয়ের অসুস্থতা সব মিলিয়ে জীবনটা কেমন যেন দুর্বিষহ! এতো খারাপ জীবন কারো হয় বুঝি? শ্রুতি জানে এর চেয়েও কষ্টের জীবন হয়। তবুও সে মানেনা। হয়তো আমাদের মানুষদের কাছে ‘নিজেদের’ কষ্ট টাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্ট বলে বিবেচিত হয় তাই।
শ্রুতি ছোটবেলা থেকে নিজের আপনজন বাদে তেমন কারোর সাথে মিশতো না, কথা বলতো না। তাই হয়তো এতো এতো মানুষের মাঝে ওর অস্বস্তি টা একটু বেশিই। এই যে তার সামনে হিমেল,হিয়া,তার শ্বাশুড়ি, চাচিশ্বাশুড়ি সবাই বসে গল্প করছে। অথচ সে করতে পারছেনা জড়তার কারণে। এইভাবে কখনো এতো মানুষ মিলে হাসাহাসি করা হয়নি, তাই হয়তো সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেনা। মাথা নিচু করেই সব ভাবছে শ্রুতি। এরমধ্যেই রুমা বেগম ডেকে উঠলেন, ‘শ্রুতি, তুমি কিছু বলছো না যে? তুমিও কিছু বলো?’’
‘আমি কী বলব? আমার বলার মতো কিছু নেই।’ বলেই জোড় করে হাসার চেষ্টা করল। শ্রুতির মনে হয়— জোড় করে হাসার চেয়ে বিশ্রী কাজ আর হতে পারেনা।
‘আচ্ছা, ভালো কথা। তোমার ভাই…হামিম, ও কী জন্ম থেকেই অসুস্থ?’
‘জ্বী না। ধীরে ধীরে হয়ে গেছে।’
‘কী বলো! ধীরে ধীরে?’ হিয়ার গলায় বিস্ময়!
এইবার তানহা প্রশ্ন করল, ‘ধীরে ধীরে মানে? একটু বুঝিয়ে বল না মা?’
‘ওর জন্ম থেকেই হার্টে ছিদ্র। একটা রক্তনালি দিয়ে রক্ত চলাচল করতে পারেনা। বুকের একপাশের বাল্ব নষ্ট ছিল। তাই ধীরে ধীরে ওর মাথাটা বড় হয়ে গেছে। আর পায়ে সমস্যা অন্য কারণে। দুটো অপারেশন করলে ঠিক হয়ে যাবে।’
শ্রুতি নির্লিপ্ত ভাবে কথাগুলো বলল। অথচ ভেতরে বয়ে গেল এক অসহ্য ঝড়। ও বলতে পারল না যে, হামিমের অপারেশন যদি ছোটবেলায় হতো তবে তার ভাই এতোটা অসুস্থ হতো না। শ্রুতি বলতে পারল না, ওর বাবা যাও টাকা দিত কিন্তু সৎ মায়ের প্ররোচনায় দেয়নি।
তার ভাই জন্ম থেকেই ভীষণ অসুস্থ থাকতো। ঠান্ডা-জ্বর লেগেই থাকতো, শ্বাস নিতে কষ্ট হতো। তবুও তার ভাইকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। এইভাবেই চলে গেছে এক/দেড় বছর। এরপর আর সহ্য করতে না পেরে ষোল বছর বয়সী বিভা নিজেই নিজের ভাইকে নিয়ে ছুটেছিল হাসপাতালে দাদির সাহায্যে। এই কথাগুলো শ্রুতি কাউকে বলতে পারেনা। ছোটবেলায় এতো খারাপ লাগতো না, হয়তো বুঝতো না তাই। তবে এখন খুব খারাপ লাগে, অসহ্য যন্ত্রণা হয়। আচ্ছা, আম্মু যদি বেঁচে থাকতো তাহলেও কী এইসব হতো?
অন্যদিকে রুমা শ্রুতির কথা শুনে কেমন যেন থম মেরে গেল! হিয়াও মুখটা ছোট করে ফেলল। অসুস্থতা দেখতে তার একদম ভালো লাগেনা। সে এইসব দুঃখ কষ্ট মানতেই পারেনা। হয়তো বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে, বড় ভাইয়ের আদরের বোন তাই। হিমেল শুধু শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘আমার মনে হয় অপারেশন যতো তাড়াতাড়ি করানো যায়, ততোই ভালো।’’
‘জ্বি, ভাইয়া।’ শ্রুতির ঠান্ডা উত্তর।
তানতা শ্রুতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘বেশি চিন্তা করেনা, মা। রোগ আল্লাহ দেয়, আল্লাহই সারায়।’
পার্থিব, নিয়াজ, আসাদ বারান্দায় বসে কিছু কাগজ পত্রের হিসাব মিলাচ্ছিলেন। এর মাঝে শ্রুতির কথাও মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছে পার্থিব। আজকে খুব ভালোভাবেই শ্রুতিকে চেপে ধরবে বলে মনস্থির করল সে।
.
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কিছু ধারা থাকে, থাকে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বিভা-মাহাথিরের বেলায় তার কিছুই নেই। তাদের সম্পর্ককে ‘যান্ত্রিক’ সম্পর্ক নাম দিলে তেমন ভুল হবেনা। এই যে সকালে উঠে বিভা নাস্তা বানায়, মাহাথির খেয়ে চলে যায়, আবার কিছুদিন না খেয়েই চলে যায়, ফিরে রাত ৯টা/ সাড়ে ৯ টায়, কোনোদিন ১০ টাও বাজে। এরমধ্যে দুজনের কথা নেই বললেই হয়। যদিওবা বিভা ফোন করে তখন যেন মাহাথিরের কন্ঠে শুরু হয় বিরক্তিকর বর্ষণ। এতো বিরক্তি মধ্যে দিয়ে বিভা কথা আগাতে পারে না, রেখে দেয়। তাও যখন ভীষণ মনে পড়ে মানুষটাকে তখন আবার ফোন দেয়। এরপর তো রাতে বাড়ি ফিরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এইটাকে সম্পর্ক বলে?
বিভা নাস্তা টেবিলে সাজাচ্ছে আর ভাবছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, এখন গিয়ে ডাকা উচিত নয়তো দেড়ি হয়ে যাবে।
ডাকতে যাওয়ার আগেই মাহাথির এসে খাওয়া শুরু করল। বিভার মনে হলো কতোদিন সে এই চেহারাটা দেখে না। গতদিন সকালে বিভা উঠতে পারেনি। মাহাথির না খেয়েই চলে গিয়েছিল। এরপর ফিরল রাত করে। তেমনভাবে দেখার আগেই খেয়ে ঘুম। যদিও বিভা রাত্রি বেলা লাইট জ্বালিয়ে প্রায়ই তাকিয়ে থাকে। তবুও জাগ্রত মানুষের চেহারা দেখায় তৃপ্তিই আলাদা।
ভাবনার মাঝেই খাবার শেষ করে উঠে গেল মাহাথির। বিভা ভাবল, মানুষটার সব কাজেই কেমন ঝটপট ভাব। মাহাথির জুতো পরছে। দরজার ছিটকিনি খুলবে এমন সময় বিভা তড়িঘড়ি করে বলে উঠল, ‘মাহাথির, শুনুন!’
মাহাথির ফিরল। বিভা দ্রুত গিয়ে বিড়বিড়িয়ে কিছু পড়ে মাহাথিরের মাথায় ফুঁ দিয়ে দিল। বলল, ‘হয়ে গেছে। এইবার যেতে পারেন।’
মাহাথির হয়তো বুঝল ব্যাপারটা। ওর কাছে ব্যাপারটা নিছকই মনে হলো নাটক। রেগে চলে গেল।
বিভা শ্বাস ছাড়ল। তার সবকাজেই রাগ করে। কেন করে? সে আয়তুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিয়ে দিল। এতে রাগের কী হলো?
বিভার মনে আছে তার আম্মু সবসময় আমিন শিকদারকে বেরোনোর সময় এইভাবে ফুঁ দিয়ে দিত। সে যথেষ্ট বড় ছিল, তাই তার মানস্পটে কিছু সুন্দর স্মৃতি এখনো রয়ে গেছে। তখন থেকেই ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগতো তার। মনে হতো সেও একদিন দিবে। তবে ব্যাপারটা ভুলেই বসেছিল সে। মনে পড়ল সেদিন মাহাথিরের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে। বিভার মনে হলো সে আয়তুল কুরসি পড়ে দিলে হয়তো মাহাথির সুস্থ থাকবে সব ছোট-বড় বিপদ থেকে। সেই বিশ্বাসেই এই কাজ। এখানে রাগের কী আছে? ভেবেই বিভার ভ্রু কুঁচকে গেল।
.
মাহাথির অফিসে ঢুকল ভীষণ রাগ নিয়ে। ঢুকেই নিজের চেয়ারে শব্দ করে বসল। মাহাথিরকে দেখে এগিয়ে এলো আনাস,
‘কিরে! তোর মুড কী সবসময়ই অফ থাকে?’
‘অফ থাকার মতো কাজ করলে অফ থাকবে না?’ কন্ঠে বিরক্তি ভরপুর।
‘কী জন্যে অফ? ভাবি ঝগড়া করেছে?’
‘সেই অধিকার আমি ওকে দেইনি। ইন ফ্যাক্ট, ঝগড়াও ভালো ছিল। বাট ও রীতিমতো ন্যাকামো শুরু করে দিয়েছে।’’
‘বুঝিয়ে বল।’ আনাসের গম্ভীর কণ্ঠস্বর।
‘আরেহ! আজকে বের হতে গেছি ওমনি ডেকে বিরবির করে সূরা পড়ে ফুঁ দিয়ে দিল। মানে হয় এইসবের? এইসবকে নাটক ছাড়া কিছু ভাবতে পারছিনা আমি। তার উপর কেন দিয়েছে জানিস? ওইদিন এক্সিডেন্ট করেছি না? সেইজন্যই হবে। কারণ ওইদিন বাসায় যাওয়ার পর এমন ভাবে প্রশ্ন করতে লাগল যেন আমি মারা গেছি।’
‘তোর খুশি হওয়া উচিত। এখানে রাগের কিছু তো দেখছি না। তোকে ভালোবাসে, তাই চিন্তা করে।’
‘এইটাইইই। আমাকে ভালো কেন বাসবে? ভালোবাসা জন্মানোর জন্য কিছুই করিনি। ভালো করে কথা পর্যন্ত বলিনা। তাও কীভাবে ভালোবাসা জন্ম নিবে? এইটাকে নাটক ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনা আমি।’
‘ভালোবাসার জন্য কিছুই লাগেনা মাহাথির। হয়ে যায়। আর তার চেয়েও বড় কথা এইভাবে দেখেশুনে ছেলেরা ভালোবাসে, কিন্তু একটা মেয়ে একটা খারাপ ছেলেকেও ভালোবাসতে পারে। এই অসীম ভালোবাসার ক্ষমতা নিয়ে একমাত্র মেয়েরা জন্মায়।’
‘থামবি তুইইই?’’
‘না। এতোদিন তোর সমস্যা টা বুঝতে পারছিলাম না। তাই জানার জন্য তোর সাথে বেশি সময় কাটিয়েছি অফিস ছুটির পরেও। তুই বলেছিসও। তোর সমস্যা বিভা কালো। বাট ট্রাস্ট মি, আমার মনে হয়না এইটা তোর মেইন সমস্যা। তুই জোড় করে সমস্যা বানাচ্ছিস। জাস্ট বিভাকে না মানার অজুহাত খুঁজছিস। কিন্তু কেন? সমস্যা কী ওর মধ্যে?’
‘সামনে থেকে যা।’
আনাস-মাহাথিরের কথা তর্কের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তবে এইটা নতুন নয়, প্রায়ই হয়। মাসে ৭/৮ বার গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ডের মতো ঝগড়া করে দুজনে। এরপর যেকোনো একজন আগ বাড়িয়ে কথা শুরু করে। হয় আনাস, নাহয় মাহাথির।
আনাসেরও মেজাজ খারাপ হচ্ছে এখন। চলে যেতে নিল। থেমে গিয়ে শান্ত কণ্ঠে ডাকল,
‘বন্ধু, শোন?’
‘কী?’
‘তুই বলেছিলি বিভা স্ত্রী হিসেবে জ ঘন্য, আজ আমি বলছি, তুই স্বামী হিসেবে জ ঘন্য এবং বি ষাক্ত।’ বলেই বড় বড় পা ফেলে চলে গেল আনাস। আর আনাসের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল মাহাথির যেন ভ স্ম করে দিবে এখনই।
.
‘তারা দেখছেন?’
‘না।’
‘তাহলে কী দেখছেন?’
‘ঘুমিয়ে পড়ুন তো, যান।’
‘আপনার কথা আমি কেন শুনব?’
‘সেটাই। শুনতে হবেনা। দাঁড়িয়েই থাকুন।’
‘হামিমের অপারেশন কেন করানো হয়নি?’
‘আপনাকে বলতে ইচ্ছুক নই।’
‘আমি শুনতে ইচ্ছুক।’
‘তাহলে যান। গিয়ে প্রাণপ্রিয় শ্বশুরের কাছ থেকে শুনে আসুন।’ বিরক্ত হয়ে বলল শ্রুতি। বলেই আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘুরতে নিল। ওমনি পার্থিব তার দুইহাত শ্রুতির দুপাশে রেখে আটকে ফেলল। বলল, ‘শ্বশুর নয়। প্রাণপ্রিয় বউ এর থেকে শুনতে ইচ্ছুক।’
‘হাত সরান, যাব।’
‘আমাকে বলুন শ্রুতি হামিমের অপারেশন কেন হয়নি? ওর যা সমস্যা তাতে এইসব ক্ষেত্রে ছোটবেলাতে অপারেশন হওয়াই বেস্ট।’
শ্রুতি মুখ নিচু করে নিল। বলবে না মানে না। পার্থিব শ্রুতির বাহুতে হাত রেখে ফিরালো নিজের দিকে। দুই হাত ধরে আবদার করল,
‘আপনি কেন আমাকে মেনে নিচ্ছেন না, আমার সাথে স্বাভাবিক হচ্ছেনা না তা আমি জানিনা। তবে আপনার কাছে ১টা রিকুয়েষ্ট করব। আপনি একবার আমাকে মন থেকে মানার চেষ্টা করুন, দেখবেন পারবেন। প্লিজ।’
শ্রুতি হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল, পারল না, পার্থিব আরোও শক্ত করে ধরল, ‘শ্রুতি! একবার আমার সাথে সহজ হওয়ার চেষ্টা করুন। দেখবেন ঠিক পারবেন। একটু চেষ্টা করে দেখুন-ই-না। আপনার তো মনে হতেও পারে যে, নাহ….পার্থিব ছেলেটা এতোটাও খারাপ না। ওর সাথে থাকা’ই যায়। অনেকটুকু করতে হবেনা, একটু চেষ্টা করুন।’ পার্থিবের কণ্ঠ ব্যাকুলতায় ঘেরা।
শ্রুতি জড় বস্তুর মত চুপ করে রইল। চোখ পানিতে ভরপুর। যেকোনো সময় টুপ করে পড়ে যাবে। শ্রুতির নিজের এই স্বভাবটা ভীষণ অপছন্দ। অল্পতে চোখে পানি কেন আসে? আর এই লোকের সামনেই এই ঘটনা বেশি ঘটে। ফালতু লোক। এর সামনেই কেন নিজেকে এতো দুর্বল লাগে?
শ্রুতিকে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পার্থিব দুহাতে গাল ধরে উঁচু করল মুখ। ওমনি দুই চোখ থেকে বড় বড় দুই ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল। সযত্নে মুছে দিল সেই পানি নিজ হাতে। আদর মাখা কণ্ঠে বলল,
‘আমাদের সম্পর্কের শুরু বন্ধুত্ব দিয়ে হোক। প্রথমে বন্ধু হই, এরপর নাহয় আপনি মেহমান বউ থেকে আপন বউ-এ রূপান্তরিত হবেন?’
শ্রুতির বাসর রাতের কথা মনে পরল। এরপর সে হালকা ভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল।
পার্থিবের ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। তার হাসিতে প্রকাশ পেল সে এতোটা আশা করেনি। শ্রুতির সম্মতি যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। তবে সে সফল। বরফ গলাতে সে সফল। ভেবেই শ্রুতির দুইহাতের আঁজলাতে মুখ ডুবিয়ে দিল। শ্রুতি ভারি চমকে উঠল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সামনে থাকা পাগলটার দিকে।
_______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৫২৬
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান
একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান
১৭. (অর্ধাংশ)
পেরিয়ে গেছে আড়াই মাস।
দেখতে দেখতে কীভাবে যেন পার হয়ে গেল। অবশ্য মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন হয়তো বিশেষত্ব বহন করে না, তাই সময় কই দিয়ে চলে যায়, আমরা টের পাইনা।
পার্থিব বসে আছে অফিসে। চেহারায় নির্লিপ্তভাব। একটু আগেই অফিসের অফ টাইমে তার বাবা তাকে আদেশ করেছেন শ্রুতির কী সমস্যা তা খুঁজে বের করার জন্য। আসাদ সাহেবের মতে, শ্রুতির নিশ্চয়ই তার বাড়িতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে, আর অসুবিধা যদি নাই হয় তাহলে কী অন্য কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা তা জানার দায়ভার দিয়েছে পার্থিবের কাঁধে।
পার্থিব তার বাবাকে তেমন কিছুই বলেনি। অবশ্য, বলবেই বা কী? শ্রুতি তো আগের থেকে যথেষ্ট ফ্রী হয়েছে তার সাথে,তার পরিবারের সাথে। তারা এখন নিয়ম করে গল্প করছে। ওই দিনের পর থেকে শ্রুতি তেমন কোনো কঠিন ব্যবহার পার্থিবকে দেয়নি। বরং, তারা আসলেই একে অপরের খুব ভালো বন্ধু হচ্ছে। তাদের গল্পের নিয়ম — ১ দিন শ্রুতি গল্প করে, ১ দিন পার্থিব। গল্প থাকে সাধারণ বিষয় নিয়ে। পার্থিব এখনো শ্রুতিকে তার কিংবা তার পরিবারের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন জিগ্যেস করেনি। পার্থিবের বিশ্বাস শ্রুতি নিজে থেকেই তাকে জানাবে। আগের চেয়ে ভালো ব্যবহার করছে, তার সাথে থাকার চেষ্টা করছে এইটাই যথেষ্ট নয়কি?
বিকেল ৫ টা ২০ মিনিট।
পার্থিব একটা স্টেশনারির দোকানে ঢুকল। উদ্দেশ্য — এক্রেলিক রঙ কেনা। সময় যখন ভালো যায়, তখন হয়তো সবদিক দিয়েই ভালো যায়। হামিম এখন তার সাথে কথা বলে। যথেষ্ট সুন্দরভাবে কথা বলে। এইতো আজ সকালে পার্থিব যখন অফিসের জন্য বের হচ্ছিল, হামিম তখনই হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে পার্থিবের সামনে থামল। ঠান্ডা কন্ঠে শুধু বলল, ‘রঙ করতে ভালো লাগে। রঙ নেই। নিয়ে এসো।’
পার্থিব তখন হেসে দিয়ে সাড়ে আট বছরের বাচ্চাটার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল।
.
আজ বিভা রান্না করেছে মুরগি ভুনা আর পাতলা ডাল। এরচেয়ে বেশি তাকে দিয়ে সম্ভব হচ্ছেনা। মাত্র দুই পদের তরকারি রান্না করে তার অবস্থা খারাপ। এতো গরম লাগছে যা বলার বাহিরে। শ্যামলা মুখ আগুনের তাপে লালাভ আঁচে ছেয়ে আছে। কামিজের ভেতর দিয়ে, গলা বেয়ে, কপাল বেয়ে যে টপটপ পানি পড়ছে তা বিভা অনুভব করতে পারছে। আচ্ছা এতো গরম কেন লাগছে? এর আগে তো লাগেনি।
মানুষ তার অবচেতন মনে অনেক কিছুই ভেবে ফেলে। বিভা ভাবল এখনই ঘরে গিয়ে এসি ছেড়ে বসে যাবে। ঘরে ঢুকেই রিমোট খুঁজতে গিয়ে ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে সে বুঝতে পারল এইটা আগের বাড়ি নয়; তারই বাড়ি, তবে নতুন বাড়ি। বিভা নিজের কাজে মনে মনে কিছুটা লজ্জা পেল। সে কী উচ্চাকাঙ্খী হয়ে যাচ্ছে? গরম লেগেছে, ফ্যানের নিচে বসলে ঠান্ডাও লাগবে। এসির প্রয়োজন টা কী? ভেবেই বিভা চোখ ঘুরাতেই দেখল তার জামাকাপড় নিচে পড়া। আবারও? এই নিয়ে ৩/৪ দিন হবে। প্রথম তিনদিন মাহাথির বাসায় ছিল না। আজ আছে। তার সামনেই এক পায়ের উপর আরেক পা রেখে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছে। বিভা জানে কাপড় মাহাথিরই ফালায়। তবুও আজ প্রশ্ন করল, ‘মাহথির?’
উত্তর এলো না। বিভা ফের প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘মাহথির?’
‘মাহাথিরও আমার নাম। মাহাবও আমার নাম। তুমি মাহাথির বলেই কেন ডাকো? মাহাব ডাকতে সমস্যা কী? তোমাকে বলেছি না তোমার মুখে মাহাথির ডাকটা শুনতে আমার ভালো লাগেনা?’ একরাশ বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিল মাহাথির।
কথাগুলো হয়তো বিভার কানে ঢুকল না। কেবল শান্ত গলায় জিগ্যেস করল, ‘কাপড় গুলো নিচে পড়া কেন? এর আগেও দেখেছি।’
‘বাড়ি আমার, ওয়ারড্রব আমার। তাই জামাকাপড় কার থাকবে সেটা আমিই ডিসাইড করব।’
বিভা জামাকাপড় গুলোর দিকে তাকিয়ে মুখটা ছোট করে ফেলল। জামাকাপড় গুলোর মাঝে তার মায়ের শাড়ি স্পষ্ট দৃশ্যমান। শখ করে মায়ের একটা শাড়ি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে ভীষণ মন খারাপ হলো। ছোট একটা বিষয়, অথচ বিভার মনে হলো এরচেয়ে দুঃখের কিছু হতে পারেনা। সে টুকটুক করে জামাকাপড় গুলো তুলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মাহাথির একবার তাকাল। মেয়েটা কী বেশি দুঃখ পেয়েছে? মুখটা কেমন ছোট করে নিল। অবশ্য সেই বা কী করবে। প্রয়োজনীয় ১ টা জিনিস পাচ্ছিল না, তাই তার রাগ জামাকাপড়ের ওপর উঠিয়েছে। পরে দেখা গেল সে যেই জিনিসটা খুঁজছিল তা তার চোখের সামনেই ছিল। আগেরবার গুলোতেও অবশ্য অন্যের রাগ বিভার জামার উপর দেখিয়েছে। তবে এতোদিন বিভার প্রতিক্রিয়া দেখেনি, আজকে দেখল। ফোন স্ক্রোল করতেও ভালো লাগছেনা। ফোন টা অফ করে, চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।
বিভা সচরাচর কাঁদে না। কাঁদলেও আড়ালে কাঁদে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে সে কান্না কমিয়ে দিয়েছে। বড় বোন হয়ে যদি কথায় কথায় কাঁদে, তবে কেমন হবে?
আজ বিভা কাঁদল, খুব কাঁদল অনেকদিন পর। কান্নার সময় মনে হলো, তার কান্নার সঙ্গীও কেউ নেই। কারোর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে পারলে হয়তো শান্তি পেত। বিভা নিজের মায়ের ছবিতে মুখ লুকাল। টপটপ করে পড়া পানিতে ভিজে গেল বিভার কোল।
.
______
চলবে~
একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান
১৭.(বাকি অংশ)
বারান্দায় বসে ফোনে কিছু কাজ করছিল পার্থিব। সামনেই মগ দেখতে পেয়ে মাথা তুলল। শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মগ বারিয়ে দিয়ে।
পার্থিব সুন্দর করে হাসল, ‘থ্যাংকিউ।’
শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে রেখেই চুপচাপ বসে কফি খেতে লাগল। পার্থিব ফোনে কাজ করা অবস্থায় একবার শ্রুতির দিকে চাইল আড় নজরে। দুই হাতে মগ ধরে খুব মনোযোগের সাথে কফি খাচ্ছে শ্রুতি, সাথে হয়তো কিছু ভাবছেও।
শ্রুতি তার সাথে কথা তো বলে, তবে তা নিতান্তই যতোটুকু বলার দরকার; আগে তো তাও বলতো না। এছাড়া একদম যে পার্থিবের সাথে মিশে গেছে ব্যাপারটা তেমন ও নয়। তবে ওই যে, শ্রুতি চেষ্টা করছে — এতেই পার্থিব খুশি। ভীষণ খুশি।
‘শ্রুতি, আপনার ভ্রু জোড়া ব্যথা করেনা?’
শ্রুতি তাকাল। তার তাকানোর অর্থ ‘ভ্রু ব্যথা করবে কেন?’
‘আপনার দিকে তাকালে আমারই কষ্ট হয়। এতো গম্ভীর কেউ হয়?’
‘কি আর করব বলুন। অন্যদের স্বামীরা গম্ভীর, সেখানে আমার স্বামীর মুখ থেকে হাসি সরেই না, তাই সম্পর্কে ব্যালেন্স রাখার জন্য আমিই মুখটা গম্ভীর করে থাকি।’
শ্রুতির ত্যাছড়া উত্তরে মাথা নিচু করে হেসে দিল পার্থিব। হাসার আরেকটি কারণ পার্থিবকে কী সুন্দর করে ‘আমার স্বামী’ বলে সম্বোধন করল। মেয়েটা কিছুটা পাগল আছে। তার কথা তাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। একদিন সে বলেছিল, ড্রামা করে সম্পর্কের ব্যালেন্স রাখে আর আজ শ্রুতি বলছে গম্ভীরতা দিয়ে সম্পর্কের ব্যালেন্স রাখে।
‘শ্রুতি, আজ কিন্তু আপনার গল্প বলার পালা। শুরু করুন।’
শ্রুতি মনে করতে চেষ্টা করল যে কোন ঘটনা পার্থিবকে শোনানো যায়। মনে পড়ছেনা কিছুই, তবুও চেষ্টা করছে। শ্রুতি চাইছে সম্পর্কে সত্যিই একটা সুযোগ দিতে। তার এমন সিদ্ধান্তের পিছনে ৭০ ভাগ অবদান বিভার বলা কথার, ৩০ ভাগ অবদান পার্থিবের সেদিনের ব্যকুলতায় ভরা কণ্ঠের। বিভা প্রায়ই তাকে ফোনে বুঝায় নানান কথা। তাই নিজের আপাকে সম্মান করেই সে পার্থিবের সাথে সহজ হওয়ার চেষ্টায় নেমেছে। শ্রুতির হুট করে মনে পড়ল দুই বছর আগের বিভার জন্মদিনের কথা। যে বার তার বাবার আমন্ত্রণ করা অতিথিকে সে ভাগিয়ে দিয়েছিল। ভাবল এই ঘটনাই শুনানো যাক। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে শুরু করতে গেল। শুরু করা হলো না। আচম্বিত প্রশ্ন করল,
‘পার্থিব, আজ কতো তারিখ?’
‘২৪ জুন। কেন বলুন তো?’
‘কারণ ৩ জুলাই আপার জন্মদিন।’
‘গ্রেট! তাহলে চলুন সবাই মিলে সেলিব্রেট করি।’
‘সবাইই?’ শ্রুতির কন্ঠে শঙ্কা।
‘আমরা সবাই। আপার বাড়িতে গিয়ে উনাকে সারপ্রাইজ দিয়ে আসি।’
‘আচ্ছা, ভেবে দেখি।’
‘ভেবে দেখার কী আছে? এর আগের বছর গুলো একসাথে সেলিব্রিটি করেছেন অথচ এইবছর করবেন না কেন? কষ্ট পাবে না আপা?’
‘আপনার বয়স কত? আপনি আমার আপাকে আপা কেন বলেন?’
‘নাম ধরে ডাকব?’ অবাক হয়ে গেল পার্থিব।
শ্রুতি কী বলবে ভেবে পেল না। আমতা আমতা করল, ‘না মানে…..’
‘বয়সে বড় হই, সম্পর্কে ছোট। সম্মান আছে না? আর যেহেতু আমার স্ত্রী এতো
সুন্দর করে ডাকে, তাহলে আমারো ডাকা উচিত। তাইনা?’ বলেই সুন্দর করে হাসল পার্থিব।
‘আপনি শুধু হাসেন কেন? হাসা ছাড়া কাজ নেই?’
‘কেন? আমার হাসি সুন্দর না? নাকি আমি সুন্দর না, খারাপ দেখতে বেশি?’
শ্রুতি চোখ সরিয়ে নিচে নামাল। পার হলো কিছু সময়। এরপর চোখ তুলে ধীরকণ্ঠে বলল, ‘আপনি অনেক সুন্দর, পার্থিব। একজন সুদর্শন মানুষ।’
‘তাহলে ভালোবাসেন না কেন?’
‘একবার বলেছিনা যে ভালোবাসতে সৌন্দর্যের প্রয়োজন হয়না?’ মাথা নিচু রেখেই শুধু একপলক তাকিয়ে বলল শ্রুতি।
পার্থিবও ঘাড় নিচু করে শ্রুতির মুখ দেখার চেষ্টা করল, ‘তাহলে আমার বেলায় সেটা মানেন না কেন? আমি যে বলি, আমি আপনাকে পছন্দ করি, ভালোবাসি — সেটা মানেন না কেন? বার বার নিজের দোষ কেন খুঁজে বেরান?’
শ্রুতি উত্তর খুঁজছে। পাচ্ছেনা। কী বলবে এখন? কী বলা উচিত? শ্রুতির মনে হলো সে নিজে একটা মাছ, আর পার্থিবের কথা একটা জাল। জাল মাছকে আটকানোর চেষ্টা করছে। হয়তো আটকে গেছেও।
শ্রুতি ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, তাহলে আমরা আপার বাড়িতে যাচ্ছি সেই কথাই ফাইনাল।
বলেই চলে গেল। পার্থিব কিছুটা ভ্রু উচিয়ে দেখতে লাগল তার বোকা বউয়ের কৃত্রিম ব্যস্ততা।
.
পার হলো আরোও কিছুদিন।
আজ পহেলা জুলাই। সন্ধ্যা ৭ টা। পার্থিব আজ আগেই বাসায় ফিরেছে কাজ সেরে। ফিরেছে বিকেলের দিকে। সারা বিকেল সবার সাথে কথা বলে, এখন বসে আছে হামিমের ঘরে। উদ্দেশ্য ছিল বাচ্চাটার সাথে সময় কাটানো, তবে হামিম এখন গভীর ঘুমে মগ্ন।
আজ সকাল থেকেই শ্রুতিকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। অন্যদিনের তুলনায় খোজ মেজাজে ঘুরছে সে। এর কারণ অবশ্য পার্থিব ধারণা করতে পারছে। ৩ তারিখ তারা বিভার বাড়িতে যাবে। সেই কারণেই এতো খুশি।
ঘরে শ্রুতিকে ঢুকতে দেখা গেল। ঢুকেই বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল তবে শান্তভাবে, ‘পার্থিব, শুনুন, আমার মনে হয় যে মাহাথির ভাইয়ার সাথে আমার কথা বলা উচিত। হয়তো উনি জানেন না যে আপার জন্মদিন। পরে উনি লজ্জা পাবেনা বলুন? উনিও কিছু প্ল্যান করতে পারবে নাহয়?’
‘হুম বলা উচিত। এখন বলবেন?’
‘হ্যাঁ, এখনই বলি। নাম্বার দিন।’
শ্রুতি নাম্বার নিল না। পার্থিবের ফোনেই ফোন দিল। রিং হচ্ছে…..
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। মাহাথির ভাইয়া?’ শান্তকণ্ঠ শ্রুতির।
হঠাৎ করে ফোন দিয়ে এইভাবে বলায় মাহাথির বেশ অবাক হলো। এইভাবে ডাকার তার চেনাপরিচিত কেউ নেই। কেউ কী ফালতু মজা করছে? এমনিতেই তার মেজাজ আজ অতিরিক্ত খারাপ। অতিরিক্তর থেকে বেশি বুঝাতে কোনো শব্দ থাকলে সেই শব্দ সমান খারাপ। সে অল্পতেই রেগে যায়, এর উপর আজ কাজে ভুলের কারণে তার বস তাকে ঝেড়েছে। তার উপর এই ফোন যেন আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল। কান থেকে ফোন নামিয়ে আবার দেখল, নাহ! সেভ করা কোনো নাম্বার নয়।
‘হ্যালো?’
‘কে বলছেন?’
‘আমি শ্রুতি বলছি।’
“শ্রুতি” নামটাও মাহাথিরের মস্তিষ্ক তেমনভাবে চেনে না। শ্রুতি….আচমকা মনে পড়ে গেল পাঞ্জাবি ছেঁড়ার ঘটনা। বিভার বোন শ্রুতি। কিন্তু তাকে কেন ফোন দিয়েছে এই অসময়ে ভেবেই প্রশ্ন করল,
‘হ্যাঁ বলো। কোনো দরকার?’ কণ্ঠে দায়সারা ভাব।
‘আপনি কী ব্যস্ত?’
‘না। বলো কী বলবে।’
‘আসলে ৩ তারিখ আপার জন্মদিন।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আপনি কী জানতেন এই ব্যাপারে?’
‘না, জানতাম না।’
‘ও। এইটা জানাতেই ফোন করলাম। আসলে ওইদিন আমরা আসছি।’
‘আচ্ছা।’
এতোক্ষণ ধরে মনের মধ্যে উঁকি দেওয়া প্রশ্নটা করেই ফেলল শ্রুতি, ‘আপনি কী বিরক্ত হলেন?’
‘হ্যাঁ, হয়েছি। কাজের সময় ফোন দিলে বিরক্ত হওয়াই বোধহয় উচিত।’
শ্রুতির মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলেও নিভিয়ে শান্তকণ্ঠে বলল, ‘আসলে আপার জন্মদিন জানানোর জন্যই ফোন করা। নয়তো বিরক্ত করতাম না। ভাবলাম, জানলে হয়তো আপনি আপাকে কোনো গিফট দিতে পারবেন। আপাও খুশি হবে।’
বিভা কিংবা বিভা জড়িত কিছুই মাহাথিরকে কোনো প্রভাবিত করেনা। আর এই মেয়ে কিনা ফোন দিয়েছে বিভার জন্মদিন জানাতে। যেখানে বিভা কষ্ট পেলে মাহাথিরের মাঝেমধ্যে পৈশাচিক আনন্দ হয়, সেখানে সে করবে বিভাকে খুশি…হাস্যকর!
মাহাথির রাগের মাথায় কখনো চিন্তা করেনি ওপর ব্যক্তিটি কী ভাবল না ভাবল। সবসময় তার যা মনে হয়, তাই করে। এখন তার মনে হলো এই শ্রুতি মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়া দরকার। গম্ভীরকণ্ঠে শুধুমাত্র বলল,
‘শ্রুতি, তুমি হয়তো জানো না যে আমি বিভাকে তেমন পছন্দ করিনা। বিয়ে হয়েছে তাই বউ জাস্ট এতোটুকুই আমাদের সম্পর্ক। হয়তো বিভা তোমাকে এই ব্যাপারে কিছু জানায়নি। তাই আমি জানালাম। ও কিংবা ও জড়িত কিছুই আমার উপর ইফেক্ট করেনা। তাই ওর জন্মদিন জানলেও যা, না জানলেও তা। তবে এতো কষ্ট করে ফোন দিয়েছ জন্য থ্যাংকিউ। বাসায় এসো, দেখা হবে।’
শ্রুতির মনে হলো তার খুশির বাগানের গাছগুলো হঠাৎ করে মরে গেল। গাছের পাতাগুলো ঝড়ে গেল। তার খুশির বাগান হয়ে গেল একদম নিষ্প্রাণ। সে যে কিছু বলবে তার শক্তিটুকু খুঁজে পেল না। কান থেকে ফোন নামিয়ে লাল রঙের চিহ্নে স্পর্শ করে বিছিন্ন করে দিল তারবিহীন যোগাযোগ।
বিভা যেমন অল্পতে কাঁদেনা, শ্রুতির তেমন ছোট ছোট ব্যাপারে চোখ ভরে ওঠে। আর এখানে তো বড় একটা ব্যাপার। শ্রুতি মাথা নিচু করে ফোন এগিয়ে দিল পার্থিবের দিকে। ঘর থেকে বের হতে নিলে পার্থিবের গম্ভীর কণ্ঠের ডাক শুনল, ‘শ্রুতি!’
শ্রুতির পেছন ঘুরতে ইচ্ছে হলোনা। ভীষণ লজ্জা লাগছে। এতোক্ষণ যাবত সব কথা শুনেছে পার্থিব। ফোন ছিল লাউডস্পিকারে। শ্রুতির মনে হলো তার আপা পার্থিবের সামনে অনেক ছোট হয়ে গেল। চোখ ভরা পানি নিয়ে একবার তাকাল পার্থিবের দিকে। পার্থিবের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘পার্থিব, আজ গল্প করতে ইচ্ছে করছেনা। ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমাই?’
পার্থিব এগিয়ে গিয়ে শ্রুতির মাথায় হাত রাখল। বলার মত কিছু পেল না। সে নিজেই কিছু বুঝতে পারল না।
সবসময় বলার প্রয়োজন হয়না। পার্থিবের কিছু না বলা ছাড়াও, শুধু মাথায় হাত রাখাতে শ্রুতি মনে হলো এরচেয়ে ভরসার কিছু হতে পারেনা। তার যদি ভরসার জায়গা থাকে তার আপার কেন নেই?
পার্থিব শ্রুতির অশ্রুভেজা চেহারা নিজের চোখে বন্দি করতে করতে ভাবল – লাইফ এতো কমপ্লিকেটেড কেন?
______
চলবে~
পর্বসংখ্যা – ১৮৫৫
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান