একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-২৪+২৫

0
152

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২৪.
রাত ২ টা বাজে থম ধরে বসে আছে মাহাথির। আব্বার কথাগুলো কানে বাজছে। সে এই মূহুর্তে এমন কথা আশা করেনি। থম ধরে বসে রইল কিছু মূহুর্ত, কিছু সেকেন্ড, কিছু মিনিট।

নিজের ঘোর কাটতেই দেখতে পেল ২ টা ২০ বাজে। এখন তো মানিকগঞ্জের বাস নেই। সে যাবে কীভাবে? পিছনের বালিশ সরিয়ে নিজেই পিছাল। ঘার টা খাটের তক্তার সাথে মিশিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল কিছুক্ষণ। তার ভাইয়ের এইসব কাজের মানে কী? সে কী নতুন কোনো ঝামেলা চাইছে? মাহাথির তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। নিজের জীবনের কথা ভাবতে ভাবতেই কোথায় দিয়ে, কেমন করে ৪ টা বেজে গেল মাহাথির জানল না, বুঝল না। বিছানা থেকে নেমে যাওয়ার সময় মাথায় এলো বিভার কথা। পাশে তাকাল। মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটাকে একা রেখে যাবে সে? একা রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে? সে যদি আজ না ফিরে তবে? মাহাথির ঠিক করল, সে বিভাকে রেখে একাই চলে যাবে। এতো ঝামেলা ভালো লাগেনা।

মাহাথির বিভার কপালে হাত দিয়ে নাড়া দিতে লাগল। একা রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না, যদি কোনো সমস্যায় পড়ে? ডাক তিনবার দেওয়া হয়ে গেল, বিভার নড়চড় নেই। মাহাথিরের এইবার বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হয়ে এলো। রাগ হয়তো উঠল বিভার ওপর। সে আগের তুলনায় জোরে নাড়া দিল।

বিভা নিজের ঘুম ঘুম চোখ মেলে ধরল। ঘুম থেকে এইভাবে ডাক দেওয়া, সামনে মাহাথিরের ভ্রু কুঁচকানো দৃষ্টি — সব কেমন যেন এলোমেলো লাগল। বিভা কিছু ধরতে পারল না সাথেসাথেই।
মাহাথির এইবার হাত ধরে টেনে উঠাল বিভাকে। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘নেশা করে ঘুমাও? এতো ঘুম কেন চোখে?’

বিভার খুব খারাপ লাগল। বিরক্ত হলো। এইভাবে ডেকে উঠানোর জন্য মাথা ব্যথাও শুরু হলো। মাহাথিরের ব্যস্ত, দায়সারা কণ্ঠ, ‘দশ মিনিট দিলাম। তৈরি হয়ে নাও। গ্রামে যাব। আর তৈরি না হতে পারলে রেখেই চলে যাব।’

বিভা তাকিয়ে রইল মাহাথিরের দিকে। এইটা গ্রামে যাওয়ার সময়? মাঝরাতে উঠিয়ে বলছে, গ্রামে যাবে! বিভা তর্ক করল না। চুপচাপ নেমে গেল। নিজের ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করতে লাগল।
ঘুমটা কেটে গেছে। জামা নিতে নিতে বুঝল হয়তো কোনো সমস্যায় যাচ্ছে মাহাথির। একারণেই এতো তোড়জোড়। এখানে ভালো জামা পড়ার মানে হয়না। বিভা সাধারণ কামিজ পড়ে, মুখটা ধুয়ে কেবল হিজাব পেঁচিয়ে নিল। আর লক্ষ্য করল, এটা মোটেও মাঝরাত নয়, ভোর হয়ে গেছে।

বাসে বসে আছে তারা। মাহাথির সিটে হেলান দিয়ে আছে। চোখজোড়া হালকা লাল, চুল উষ্কখুষ্ক। চেহারা ক্লান্তিতে ডুবে আছে। বিভা পাশের দিকে মাথা উঁচু করে নিজের স্বামীকে দেখতে লাগল। বিভা কী বলবে তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে? ঘুমাবে মাহাথির? এতো ভালো সে?
ভালোই তো তার স্বামী। এই যে জরুরী তলবে যে যাচ্ছে, তাকেও সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়েছে, হাত ধরে বাসে উঠিয়েছে — এইসব কম কী? ভালো না বাসুক, বাসবে। তাই বলে খারাপ তো নয়। বিভা লক্ষ্য করল, মাহাথিরের থেকে সে খাটো। মাহাথির তার ঘাড়ে মাথা রাখতে গেলে উল্টো তার ঘাড় আরোও ব্যথা করবে — ভেবেই বিভা কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। তার চোখ ভর্তি ঘুম। সিটের সাথে মাথা হেলিয়ে দিল। কখন এসে চোখে ঘুম ধরা দিল বুঝল না।

ঝাঁকুনিতে বিভার ঘুম ভেঙে গেল। ঝাঁকুনি না হয়তো; কেউ তার মাথায় মনে হলো ধাক্কা দিল। ঘাড় টাও ব্যথা করছে। সামনে থেকে মাহাথিরের হাত সরে যেতেই বিভা তাকাল মাহাথিরের দিকে। যার অর্থ – আপনি আমার মাথায় ধাক্কা দিয়েছেন? মাহাথির কিছু না বলে নিজের মতো চুপচাপ রইল। বিভার ক্লান্ত লাগছে, সে ভাবল – মাহাথিরের কাঁধে মাথা রাখবে। নিজের ভাবনা সত্যিতে রূপ দিতেই মাথা ঠেকাল মাহাথিরের বাহুতে। সেকেন্ড পার হতেই মাথা টাকে দুই হাতে ধরে সোজা করানো হলো।
এইবার হয়তো বিভা বুঝতে পারল ঘটনা। এতোক্ষণ সে হয়তো ঘুমের ঘোরে মাহাথিরের কাঁধে মাথা রেখেছে, আর মাহাথির সরিয়ে দিয়েছে; ঠিক যেমনটা এখন দিল। এমন কেন করল? একটু কাঁধে মাথাটাই তো রাখতে চেয়েছে। স্বর্ণ, গয়না, জমির মালিকানা চেয়েছে নাকি? বিভা নিজের মন খারাপ নিয়ে এইবার নিজেই সরে বসল। তাকাল বাহিরের দিকে। বাহিরের দিকেই মাথা কাঁত করে রইল। গ্রামের গন্ধ আসছে, গতির সাথে গাছের চলাচল দেখতে দেখতে গ্রামের গন্ধ নিতে থাকল বিভা।

.
সিএনজি করে যাচ্ছে দু’জন। বিভা দেখেছে এইটা মানিকগঞ্জ। ‘মানিকগঞ্জ’ নামটার সাথে বিভার ছেলেবেলার কতো স্মৃতি যে আছে তা বিভা গুণে শেষ করতে পারবে না। এখানে তার নানিবাড়ি। ছোটবেলায় বন্ধ দিত, আর বিভা বায়না করতো নানি বাড়িতে আসার জন্য। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে তার নানিবাড়ি। নানা-নানি নেই, এক মামা আছে তাও খোঁজখবর নেয়না তাদের ভাই-বোনদের। মানুষের জীবন থেকে বাদ পড়ে যাওয়া বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ।

মাহাথিরের পিছু পিছু হেঁটে চলেছে বিভা। বেশিক্ষণ হাঁটতে হলোনা। কিছুদূর যেতেই পর পর কয়েকটা বাড়ি দেখল। সব বাড়িই সব বাড়ির থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে। তবে প্রথম দু’টো বাড়ি প্রায় পাশাপাশি। বিভার ভাবনার মাঝে মাহাথির দুটো বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভাও এলো।
নিচ থেকে সিমেন্ট দিয়ে বাড়ির মেঝের ভিত্তি গড়া, উপরে টিন — এখানের প্রায় সব বাড়িই এমন। কতো বদলে গেছে! আগে এই গ্রামের সব বাড়ি হতো মাটির কিংবা শুধু টিনের।
আচমকা চিৎকার, ভাঙচুর এর আওয়াজ আসতেই বিভা চমকে উঠল। তাকাল মাহাথিরের দিকে। মাহাথিরের মুখের গম্ভীরতা বিভার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিল।

মাহাথির গটগট করে নিচু নিচু চার/পাঁচটা সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠে সিমেন্টের ফ্লোর পর্যন্ত এলো, এরপর ঘরে চলে গেল। বিভাও মাহাথিরের পিছু পিছু ঘরে গেল। ঘরে ঢুকেই দেখল বাহিরটা সিমেন্টের বারান্দা হলেও, ঘরের ভেতর মাটি। ভেতরটা বেশ পুরোনো তবে পরিষ্কার।

বিভা লক্ষ্য করল খাট বলতে ঘরে একটা চৌকি। সেখানেই বসে আছে পাঞ্জাবি পরিহিত এক বৃদ্ধ লোক। বয়স খুব বেশি না হলে কমও নয়। মাহাথির শান্ত কণ্ঠে ডাকল, ‘আব্বা!’
বিভা বুঝল ইনি তার শ্বশুর। শ্বশুরকে সে আগে দেখেনি। তার শাশুড়ি যখন ঢাকায় গেল, কেবল বলেছিল তার শ্বশুর নাকি কৃষিকাজ করে, আগে ব্যবসা করত, এখন কাজ রেখে আসতে পারেনি।
কারোর শান্ত আব্বা ডাক শুনে পেছন ফিরলেন সিদ্দিক সাহেব। মাহাথিরকে দেখে কিছু বলতে গিয়েও কেঁদে দিলেন। মাহাথির বড় বড় পা ফেলে গেল বাবার কাছে। তখনি হাসিনা পানির গ্লাস নিয়ে ঢুকল ওপরদিকের দরজা দিয়ে। ঘরে ঢুকে মাহাথির, বিভাকে দেখে তেমন প্রতিক্রিয়া দিলেন না; যেন জানতেন যে ওরা আসবে।

‘ ওওও….বাপ-মায়ের আদরের পোলা আইসা পড়সে দেখি।’

মাহাথির তাকাল ঘাড় ফিরিয়ে। তার ভাই মাহিম, মাহিমের স্ত্রী দাঁড়ানো। হাসিনা গিয়ে নিজের স্বামীকে ধরে পানি খাওয়াল।
কারোর মুখে কোনো কথা নেই।

সিদ্দিক সাহেব কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের কী তোমার দালানের একটা ঘরে জায়গা হোবো বাপ?’
মাহাথির বাবার পাশে বসল। পিঠে হাত বুলিয়ে দিল, ‘কী হয়েছে আমাকে খুলে বলেন? আর একটা ঘরে জায়গার কথা আসবে কেন আব্বা? এই ঘর, ঢাকার ঘর যেখানে ইচ্ছে থাকবেন আপনি।’

‘সেই কপাল কইরা আসিনাই, বাবাগো। তোমার ভাই আমাদের রাকবে না। বলসে যদি তাদের ঘড়বাড়ি জমিজমা লিখে না দেই তাইলে ঘর থেকে তাড়াই দিবে।’ বলেই কেঁদে ফেললেন। ফ্যাঁসফ্যাঁস শব্দের কান্না ঘরজুড়ে বইতে লাগল। হাসিনা নিজের ঘোমটা ঠিক করে বসে রইলেন চুপচাপ।

‘জমি লিখে দিবেন না কেন শুনি? মাহিম আপনার ছেলে না? তাহলে জমি, দুইটা বাড়ি লিখে দিতে কোনো সমস্যা তো দেখিনা।’ ক্যাটক্যাট করে উঠল মাহিমের স্ত্রী।
মাহাথির চেষ্টা করছে নিজের রাগ সামলাতে। যতোই রাগী, জেদি হোক, মাহিমকে সে অনেক স্নেহ করে। চাইছেনা ভুলভাল কিছু বলতে। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘এইসব কথা ভালোভাবেও বলা যায়। তুমি, মাহিম তো পালিয়ে যাচ্ছো না। তাহলে এইসবের এতো তাড়া কেন? আর আম্মা আব্বাকেই বা বাড়ি ছাড়ার কথা কেন বলছো?’

‘আমরা পালায় যাচ্ছি না ঠিকই কিন্তু জমিজমা, বাড়ি তোমার নামে হস্তান্তর না হইতে কতোক্ষণ? বাপের আদরের পোলা বলে কথা।’ ব্যঙ্গাত্মক, বিদ্রুপ কণ্ঠ মাহিমের।
মাহাথির উঠে গিয়ে মাহিমের সামনে দাঁড়াল, ‘আব্বা-আম্মার কাছে আমরা দুইজনই সমান।’

‘কতো সমান জানা আছে! সমান দেইখাই তো তোমারে চারলাখ টাকা দিয়ে চাকরি দিয়া দিল। আর আমারে দুইলাখ দিতে পারতেসে না।’
কথাটা শেষ হওয়ার মূহুর্ত পার হলোনা। হাসিনা ধমকে উঠলেন, ‘আর একটাও মিছা কথা বললে আমি তোমারে জ্যা/ন্ত কব/র দিব।’
এতোক্ষণ ধরে নিরব দর্শক বিভা হাসিনার এমন হুংকারে চমকে গেল। দেখল হাসিনা উঠে এলো, ‘মাহাথির আব্বারে ৪ লাখ দিয়া চাকরি দিলে তোমার পিছেও ৬ লাখ দিসি। চাকরি জুটাইতো পারো নাই। ভুলভাল দালালরে দিয়া ধরা খাইসো। এরপর ব্যবসা করার জন্যে দিলাম দুই লাখ, তাও ব্যবসায় মন বসাইতে পারলা না। আট লাখ টাকা শেষ কইরাও নিজেরে মাহাথিরের লগে তুলনা দেও? বেকার হইয়া শ্বশুরের কথায় উঠো-বসো নিজের সম্মান বেঁইচা, লজ্জা করেনা?’

কথাটা মাহিমের অহমে বেশ আঘাত হানল। ক্ষেপে গেল, ‘একটা এতিম, রাস্তার ছেলের পিছনে চারলাখ খরচ করসো এইটাই অনেক বেশি না আম্মা? নিজের ছেলে আর এতিম ছেলে এক? নিজের ছেলের পিছনে আট ক্যানো পনেরো খরচ করলেও লাভ আছে। রাস্তার পোলার পিছনে নাই।’

হঠাৎ মাহিমের এমন কথায় বিভার বুকটা যেন কেঁপে উঠল। চোখের পলকও কাঁপল। সে কী ভুল শুনল? ভাবনার মাঝেই চড়ের শব্দে বিভা দেখল মাহিম নামক পুরুষটি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কানে এলো হাসিনার চিৎকার। বুক থাপড়িয়ে থাপড়িয়ে বলল, ‘মাহাথির আমার ছেলে, আমার ছেলে, আমার ছেলে।’ তিনবারের শেষের বাড়িটা যেন বেশ জোড়েই ছিল। শেষে তার নিষ্প্রভ কণ্ঠ, ‘মাহাথির আমার বড় ছেলে।’

এতোকিছুর মাঝে মাহাথিরের ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গেল না। তার শান্ত কণ্ঠ, ‘কী চাইছিস?’

‘জমিজমা, দুই বাড়ির মালিকানা।’

‘আমি এইসবের মধ্যে ভাগ বসাব না, মাহিম। তোরই সব। তুই রাখ, তবুও বাবা-মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার কর। তাদের থাকতে দে।’

‘কেন? বাপ-মায়ের প্রতি পিরীত শেষ? নিজের বাসায় রাখার জায়গা নাই?’ মাহিমের স্ত্রীর ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠ।

মাহাথির বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। নিজের আম্মা-আব্বার দিকে তাকিয়ে কেবল বলল, ‘ব্যাগ গুছান। নিয়ে যাব আমি আমার সাথে।’

হাসিনার বলার মতো কিছু নেই। সে ভালোই বুঝে গেছে বাড়ি তার ছাড়তে হবে। সে নিজের স্বামীর জন্য পাঞ্জাবি বের করল। ব্যাগে যতোটুকু কাপড় ঢুকানো যায়, ঢুকিয়ে নিল। দুইজনই মাহাথিরের সামনে দাঁড়াতে মাহাথির হাসল, ‘যাওয়া যাক?’

সামনে দুই কদম বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল। ফিরে এসে দাঁড়াল মাহিমের সামনে, ‘আব্বা-আম্মাকে তোর সাথে থাকার জন্যে বলেছিলাম কারণ তুই আমাদের অনেক আদরের মাহিম। আমি রাস্তার ছেলে হলেও তুই আব্বা-আম্মার একমাত্র ছেলে। তোকে ছেড়ে তারা ভালো থাকবে না, তাই। আর এই জমিজমা, বাড়ি কিছুই তোর নামে লিখে দেওয়া হবেনা, মাহিম। এইগুলা আমার আব্বার অনেক শখের। তার নামেই থাকবে; মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তাছাড়া এইসব তোর, আমি কখনো এইসবে ভাগ বসাতে আসব না।’

কিছুক্ষণ থামল মাহাথির, ‘এই পৃথিবীতে যে যেটার কদর করতে পারে, তার ভাগ্যেই তা জোটে না।’
বলেই স্থির হয়ে থাকা বিভার কবজি ধরে টেনে নিল নিজের কাছে। চারদিকে তাকিয়ে ঘরটা দেখে নিল। একদম আগের ঘরই আছে, মাটির ঘর। শুধুমাত্র বারান্দায় ঢালাই করে সিমেন্ট দেওয়া হয়েছে।

মাহাথির সামনে পা বাড়াল। যেই ঘরে একুশ বছর আগে আব্বা-আম্মার মাঝে থেকে প্রবেশ করেছিল, সেই ঘর থেকেই একুশ বছর পরে নিজে মাঝে থেকে একপাশে আব্বা-আম্মা, অন্যপাশে নিজের স্ত্রীর হাত ধরে বেরিয়ে গেল মাহাথির।

_____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৫৭০
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২৫.
দুপুর সাড়ে তিনটা।
সবে মাত্র বাসায় পৌঁছাল বিভা, মাহাথির ও তার আব্বা-আম্মা। ঘরে ঢুকেই সোফায় বসে শরীর ছেড়ে দিল মাহাথির। বিভা বসেও উঠে গেল। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে দিল তার শ্বশুর, শাশুড়ি কে।
বিভা তাকাল মাহাথিরের দিকে। ধুলোতে চেহারা কালচে হয়ে গেছে, সাথে ক্লান্তিতে ঢেকে গেছে চেহারা। বিভা হাপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। এই পৃথিবীর সবার জীবনই যেন এক একটা গল্প। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ এক একটি গল্প নিয়ে ঘুরে। কারোর গল্প পুরো পৃথিবী জানে, কারোর গল্প কেউ জানে না। কেউ না।

আজ ভার্সিটিতে এসেছিল বিভা। আজ যাওয়ার পথে হামিমের রিপোর্ট চেক করিয়ে নিয়ে যাবে। সেদিন শ্রুতি শুধু হামিমকে ডাক্তার দেখিয়েছিল, আজ রিপোর্ট দেবে সাথে বিভা ডাক্তারের সাথে কথাও বলে যাবে। মাঝে পেরিয়ে গেল একদিন। মাহাথির, আব্বা-আম্মা কারোর সাথেই তেমন কথা হয়নি। বিভা নিজেও তেমন কিছু জিগ্যেস করেনি বা বলেনি। নিজের কাছেই সব কেমন যেন ওলটপালট লাগছে। তার জীবনতো বিধ্বস্ত’ই; এখন কিনা জানছে তার স্বামীর জীবন তার চেয়েও বিধ্বস্ত।

.
‘ শ্রুতি, আমি অফিসে যাওয়ার পর আপনি প্রতিদিন কোথায় যান?’

পার্থিবের করা প্রশ্নে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শ্রুতি। দেখল পার্থিব ঘরে ঢুকে এক হাত দিয়ে দরজা আটকে দিল। শ্রুতি কিছু বলল না। পার্থিব এগিয়ে গেল, ‘ আমি কিছু জিগ্যেস করেছি।’

‘ কাজে যাই পার্থিব। আর কোথায় যাব? এমনভাবে প্রশ্ন করছেন শুনে মনে হচ্ছে ডাকাতি করতে যাই।’

‘ কী কাজ সেটাই জানতে চাই।’ পার্থিবের গলাটা গম্ভীর শোনাল।

‘ আছে কোনো কাজ। সরুন।’ বলেই পা বাড়ালেও যেতে দিল না পার্থিব। হাত ধরে আটকে ফেলল, ‘আমি আমার প্রশ্নের উত্তর না পেলে আপনাকে ছাড়ব না।’
শ্রুতি এবার বেশ রেগে গেল আর বিরক্ত হলো। পেয়েছে টা কী লোকটা? দাঁত চেপে বলল, ‘ চাকরি খুঁজতে যাই। হ্যাপি?’

‘চাকরি কেন খুঁজবেন আপনি?’ পার্থিব এমন কথা আশা করেনি।

‘ খুঁজব না কেন? অবশ্যই খুঁজব। নিজের ভরণপোষণ করতে হবে না? আমার ভাইয়ের অপারেশন করতে হবে না? দুই বছর ভার্সিটি ড্রপ দিলাম। ভর্তি হব না?’

‘ আমি আছি কী করতে? আর আমি নিজেই তো আপনাকে পড়াশুনা করতে বলেছি। বলিনি? আপনাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি আমার ওপর ভরসা রাখুন।’

‘ আপনি টাকা দেবেন?’ শ্রুতি কৌতূহলী গলার প্রশ্ন করল। পার্থিব উত্তর দিল না, কেবল শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। শ্রুতি নিজে নিজেই বলল, ‘ গুড! প্রথমে টাকা, দ্যান খোটা। নাইস কম্বিনেশন।’

পার্থিব এগিয়ে গেল এক পা। শ্রুতির মুখোমুখি দাঁড়াল। ভরাট কণ্ঠে বলল,
‘ এতো অবিশ্বাস ভালো নয় শ্রুতি। সবাই এক নয়। নিজের বাবার ভালোবাসা থেকে প্রতারণা পেয়ে স্বামীর ভালোবাসায় আঙুল তুলছেন।’

‘ কারোর ভালোবাসায় আঙুল তুলছিনা আমি। আমি চাকরি করব ব্যাস! শেষ কথা। আপা বিজনেস করছে। সে একা করবে কেন? আমিও করব। আমি আপনার টাকা নেব না পার্থিব। আপনার দয়া আমার চাই না।’

‘দয়া, দয়া, দয়া। কী পেয়েছেন টা কী শব্দটার মধ্যে? আপনার মনে হয় আমি দয়া দেখাই? নিজের স্ত্রীকে দয়া দেখাব কোন দুঃখে আমি? শ্রুতিইই….দয়া আর সম্মান শব্দ দুটো আলাদা। আকাশ পাতাল তফাৎ। দুটোকে এক করবেন না। ভুলেও না। আমি আপনাকে সম্মান করি। নিজে নিজের অসম্মান করবেন না।’ নিজের কণ্ঠে রাগ মিশিয়ে কথাগুলো বলল পার্থিব। পার্থিবের কথায় শ্রুতি একটু পিছিয়ে গেল। পার্থিব চিৎকার করেনি, শুধু রাগের সাথে কথাগুলো স্বাভাবিক স্বরে বলেছে, সাথে চোখে মুখে রাগের রেশ তো আছেই। এতেই ভয় পেয়ে গেল শ্রুতি। এর আগে পার্থিবের এমন কণ্ঠ শোনেনি সে। সবসময় মিষ্টি, সরল কণ্ঠে কথা বলেছে। তাই এখনের সামান্য উচ্চস্বরের কথাই শ্রুতির কাছে বিশাল কিছু মনে হলো। চোখ নামিয়ে নিল সে।

পার্থিব ঘুরে গেল অন্যদিকে। শ্রুতি স্পষ্ট দেখতে পেল পার্থিবের মুষ্টিবদ্ধ হাত। অন্যদিকে ঘুরে পার্থিব জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিল। নিজেকে শান্ত করে ফিরল শ্রুতির দিকে। আলতো হাতে দু গাল ধরল,
‘ আমাকে রাগাবেন না শ্রুতি। আপনার ওপর রাগতে চাইনা। আমার রাগ আপনি সহ্য করতে পারবেন না। সামান্য ধমকেই ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। আর যদি রাগ করি তাহলে আরোও কষ্ট পাবেন। আমি আমার বউকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। কারণ আমি জানি সে যতোই ওপরে ওপরে নিজেকে শক্ত দেখাক না কেন, সে একদমই শক্ত কোনো ব্যক্তিত্ব নয়।’

শ্রুতি তাকাল পার্থিবের দিকে। পার্থিব সরলভাবে হাসল। শ্রুতি মনে মনে বেজায় রেগে গেল। পার্থিবের কথাকে নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করল। এই গুণটা তার বাবা আমিন শিকদার প্রদত্ত। কারোর কথা সহজে সে মানে না, মানতে পারেনা। রাগ, হয়, জেদ হয়, নিজেকে ছোট মনে হয়।
ভিতরের জেদ ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল। দুই হাত দিয়ে ধাক্কা দিল পার্থিবের বুকে, ‘ আমার ব্যাপারে নাক গলানো বন্ধ করুন পার্থিব। আমি আপনাকে ভয় পাইনা। আর শুনেন….নাতো আমি আপনার সাহায্য চাই, নাতো আপনাকে চাই, আর না আপনার সংসার। আপনার সংসার আমি করব না। খুব তাড়াতাড়িই চলে যাব।’

জেদের বশে কথাগুলো বলে চলে গেল শ্রুতি। পার্থিব স্থির তাকিয়ে রইল মেঝের দিকে। তার গা/ধাবউ এর ব্যবস্থা এইবার করতেই হবে।

.
হাসিনা বিভার ঘরের দরজায় দাঁড়াল। অনেক স্নেহ মিশিয়ে ডাকলেন, ‘কাজ করো আম্মা?’
বিভা তাকাল। এমন ডাক আশা করেনি। সুন্দর হেসে বলল, ‘না, আম্মা। ভেতরে আসেন।’
হাসিনা ঢুকলেন। দেখলেন বিভার হাতে চিরুনি। হাসিমুখে হাত থেকে চিরুনি নিজের হাতে নিল, ‘চলো একটু গল্প করি। ওই ঘরে আসো?’
বিভা সায় দিল। গেল নিজের শাশুড়ির ঘরে। শ্বশুর ঘুমাচ্ছেন। জ্বর, ঠান্ডায় কাহিল হয়ে পড়েছেন লোকটা।
মাহাথির কোথায় যে গেছে কে জানে!

শাশুড়ি খাটে বসে বিভাকে চোখের ইশারা দিল। চোখের ইশারায় বিভা নিচে বসে গেল। বিভার চুলগুলো ধরে ধরে দেখতে লাগল হাসিনা। কিছুসময় পর চুলে চিরুনি দিল সাথে প্রশ্ন করল,
‘ আমারে মনে আছে তোমার? ছোটোবেলায় আমারে দেখসিলা।’
‘ না, নেই।’
‘ আমি তোমার মায়ের দূরসম্পর্কের চাচতো বোন লাগি। শরিক ছিলাম তোমার মায়ের। বিয়ের আগে কতো খেলসি দুইজন। বিয়ের পরেও বাপের বাড়ি আসলে দেখা হইতো। আর আমার তো গ্রামেই বিয়া হইল। তোমারে ছোটোবেলায় কোলেও নিসি। ছোটোবেলায় অনেক চঞ্চল ছিলা। এখন তো একদম নদীর মতো শান্ত হইসো।’

বলেই সামান্য শব্দ তুলে হাসল হাসিনা। এরপর কিছু সময় পার হলো নিঃশব্দে। হাসিনা শ্বাস ছাড়লেন। গল্প বলার মতো খুব আগ্রহ নিয়ে বলতে লাগলেন, ‘ তখন আমার সংসারের চার বছর চলে কেবল। ভালো সময়ই কাটতেসিল সবার। সমস্যার মধ্যে সমস্যা ছিল আমার কোলে বাচ্চা ছিল না তাই’ই। শাশুড়ি উঠতে, বসতে কথা শুনাইতো। পাড়া-প্রতিবেশি তো আছেই। সিদ্দিকীর বউ বন্ধ্যা আরোও কত কী যে বলতো! সব শুনতাম আর সন্তানের দোয়া করতাম। কোনো কবিরাজি ঝাড়-ফুঁক বাদ রাখিনাই। এমন করতে করতে যখন পাঁচ বছরে গিয়া পড়লাম, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম এতিমখানা থেকে বাচ্চা আনুমু। তোমার শ্বশুরও রাজি। আল্লাহ আমারে ভাগ্য কইরা স্বামী দিসিলো। কতোজন যে তারে বুঝাইছে দ্বিতীয় বিয়ার কথা; সে করে নাই।’

এই পর্যায়ে এসে শ্বাস নিলেন হাসিনা। হতাশা, দুঃখ, যন্ত্রণা গুলো যেন বেরিয়ে এলো। বিভার চুল ভাগ করল। হয়তো বেনি পাকাবে। সাথে শুরু করল নিজের জীবনের গল্পের পরবর্তী অংশ, ‘ দুইজন মিলা একদিন টাঙ্গাইল শহরে গেলাম। আশপাশ বলতে ওই জায়গাটা কাছে মনে হইল। এতিমখানার সামনে দাঁড়াইয়া আবারো থম ধইরা ভাবলাম যে আসলেই যা করতাসি তা ঠিক কিনা। তোমার শ্বশুর আমার হাত ধইরা সাহস দিল। আমিও ভরসা পাইয়া পা বাড়াইলাম তোমার শ্বশুরের সাথে। ওইখানেই আবার তোমার শ্বশুরের চেনা পরিচিত ভাই ছিল। তার সাথে কথা হইল। সে এক বাচ্চার দিকে দেখাইয়া বলল, ‘এই বাচ্চারে নেন, ভাবী। ছোট, কিছু বুঝব না। আপনাদের আদবে বড় হবে। কখনো জানবেও না আপনারা ওর আসল বাপ-মা না।’ আমি তার কথা শুনলাম কিন্তু তাকাইলাম না বাচ্চাটার দিকে। আমি তখন তাকাই আছি দূরে এতিমখানার পুকুর পাড়ে বসা একটা বাচ্চার দিকে। সাত/আট বছর বয়স। বাচ্চাটার মুখ কী শান্ত, মায়া মায়া ভাব। আমি জিগ্যেস করলাম ওই বাচ্চারে নিতে পারব কিনা। ভাই বলল পারব। আমি গেলাম বাচ্চাটার কাছে। বাচ্চাটা মুখ তুইলা তাকাইল। শান্ত বাচ্চার চোখে ভাসা ভাসা পানি দেইখা নিজেরে ঠিক রাখতে পারলাম না। ঠিক করলাম ওরেই দত্তক আনব। সিদ্দীকও রা করল না। দুইজনে মিলা যা কাগজপত্রের কাজ ছিল সব করলাম। এরপর বাচ্চাটারে আমাদের সাথে কইরা নিয়া আসলাম। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা বাচ্চাটা তখন পর্যন্ত একটা কথাও বলে নাই। হইয়া গেলাম আমি মাহাথিরের মা। বাচ্চাটার কাগজপত্রে নাম ছিল মাহাথির। আমি ভালো নাম দিলাম মাহাব। তাও মুখ দিয়া মাহাথিরই বাইর হয়।’

থামলেন শাহিনা। কিছু সময় পর আবার বলতে লাগলেন, ‘ বাচ্চাটারে নিয়া বাসায় আসার পর ঝামেলার ওপর ঝামেলা হইল। বাচ্চাটা কেবল দেখল সবার ঝগড়া। একদম কথা বলতো না জানো? কথা বলল তিন/চারদিন পর। তাও কী বলল- আপনারা আমার কী লাগেন? ওরে বললাম বাবা-মা লাগি। শুইনা কিছুই বললনা। থম ধরে জায়গায় জায়গায় বইসা রইল। হাজার বুঝাইলাম, কাজ হইল না। এমন কইরাই এক্কেবারে ছয় মাস কাটল। ছয়মাস চৌদ্দ দিন পর প্রথম ডাকল আব্বা, আম্মা বইলা। কী যে খুশি হইসি সেদিন! তোমার শ্বশুর তো মসজিদে যাইত মাহাথির রে নিয়া আর সবাইরে ডাইকা ডাইকা বলত – আমার ছেলে, আমার ছেলে। সে যে এতো খুশি হবে বুঝি নাই। তার দুইমাস পরেই আসল আরেক খুশির খবর। মাহিম আসল পেটে। আমি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই খবরে শাশুড়িও অনেক খুশি হইল। সে মাহাথিররে প্রথমে না মানলেও মাহিমের খবর শুইনা মানল। আমার খালি সংসার ভরা সংসার হইয়া ধরা দিল।’

বেনি পাকানো শেষ। তবুও মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন হাসিনা। বিভা ঘুরল। হাসিনা মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘ মাহাথির মুখে প্রকাশ করে কম। সে প্রকাশ করেনা তাও আমি বুঝি যে আমাদের কতো ভালোবাসে! কত কাহিনী যে আছে ওর। বড় হইয়াও ছোটবেলার অভ্যাস গেলনা। এখনো আগের মতো চুপচাপ।’

হাসিনা কথা চালাতে পারছে না, কষ্ট হচ্ছে। তবুও বলল, ‘ মাহাথির আমার পেটে না হইলেও ও আমার ছেলে বিভা। ওরে একুশ বছর পালছি আমি। তুমি আমাদের ভুল বুইঝ না, মা।’

বিভা চোখ তুলে তাকাল, ‘ভুল কেন বুঝব?’
‘তোমার স্বামী এতিম বইলা তোমার খারাপ লাগতে পারে। ও এতিম না, ও আমাদের ছেলে। ও খুব ভালো। শুধু বিয়ে করতে চাইতো না, মাহিম ভালোবাইসা ২১ বছরেই বিয়ে করল, ওর বিয়ার খবর নাই। সম্পর্কে বিশ্বাস করতে পারেনা। তাই বন্ধুবান্ধব ও নাই। একজন আছে কেবল। আনাস। ওর দুনিয়া খুব ছোট। ভালোবাসার মানুষ কম।
বিয়াতে জোড় করে রাজি করাইসি আমি। শেষে নিজেই সম্মতি দিসে। ও একটু রাগ দেখাইলেও ভালো বিশ্বাস করো। একটু মানাই চলো আর অনেক ভালোবাসো। দেখবা ও তোমারে হাজারগুণ বেশি ভালোবাসব। ভালোবাসবা না মা?’

বিভা মাথা নাড়ল। হাসিনা উত্তর পেয়ে হাসলেন। বিভার মাথায় হাত বুলালেন।

মাহাথির এতিম, অনাথ — এটা জানার পর বিভার মনে মাহাথির সম্পর্কে নতুন কোনো ধারণা তৈরি হয়নি, কিংবা সে নতুন কিছু ভাবেওনি। শুধু তার সবকিছু এলোমেলো লেগেছে। হয়তো এমন কিছু আশা করেনি সে।
বিভা কেবল ভাবল, তার শৈশব সুন্দর ছিল কিন্তু এর পরের জীবনটা না। অন্যদিকে, মাহাথিরের শৈশব সুন্দর ছিলনা। বাদ বাকি জীবন কেমন কাটিয়েছে তা বিভা জানেনা। কেবল জানে, সে মাহাথিরকে ভালোবাসবে। অনেক ভালোবাসবে। ভালোবেসে তার বর্তমান, ভবিষ্যত সুন্দর করে দেবে। একদম অন্ধকার রাতে তারার আলোর মতো সুন্দর।

.
ভাইয়ের রুমে বসে ছিল শ্রুতি। শাশুড়ির ডাকে নিচে নেমে এলো। নেমে আসতেই দেখতে পেল সবাই আছে। শ্রুতি তার শাশুড়ির কাছে যেতেই তিনি বললেন, ‘শ্রুতি, দেখো তোমার শ্বশুর কী এনেছে তোমার জন্য?’
শ্রুতি তাকাল। দেখল একটা বড় বোলের মধ্যে ৩/৪ টা কাঁঠাল। সামনেই তার শ্বশুর বসা। শ্রুতি অবাক হলো। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল তানহা বেগমের দিকে। তানহা বলল, ‘ তুমি কালকে বললে না যে তোমার ফলের মধ্যে কাঁঠাল প্রিয়। সেটা শুনেই তোমার শ্বশুর কাল সন্ধ্যায় গ্রামে গেল। গাছে যত কাঁঠাল ছিল, নিয়ে এলো। ঢাকার কাঁঠালে তো মজা নাই। তাই কাল রাতে গেল, এক রাত থেকে আজ নিয়ে এলো। আসতে আসতেই সন্ধ্যা। আরোও আনবে বুঝলে? এখন তো কাঁঠাল ছোট ছোট তাই। বড় হোক, আরোও আনবে।’

হিয়া এসে উৎসাহের সাথে শ্রুতির হাত ধরল। বলল, ‘ বড়বাবা এমনই শ্রুতি। একবার বললাম আমার ড্রাগন ফল পছন্দ। সকালে উঠে ফ্রিজ খুলে দেখি ফ্রিজ ভর্তি ড্রাগন ফল।’
শ্রুতি হাসল। মন থেকে হাসল আসাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে। আসাদ সাহেব গম্ভীর গলায় বলল, ‘ তোমরা কথাই বলবে, নাকি কাঁঠাল ভেঙে দিবে ওকে?’

তানহা, রুমা বেগম কাজে লেগে পড়লেন। শ্রুতি পার্থিবের দিকে তাকাল। পার্থিব শান্ত ভঙ্গিতে উপরে চলে গেল।

শ্রুতি তাকালে পার্থিব হাসে। এখন হাসল না। হাসতে কী ভুলে গেছে? শ্রুতি বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার কী পার্থিবকে গিয়ে জিগ্যেস করা উচিত যে, আপনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন না কেন? নাহ! জিগ্যেস করা উচিত নয়। তার আচরণের পরে এইসব জিগ্যেস করতে চাওয়ার ইচ্ছা আনাও অন্যায়।

.
বিভা রুমে ঢুকল। রাত ১১ টা ২০ বাজে। প্রতি রাতে মাহাথির চা খায়। চা ছাড়া তার চলেনা। বিয়ের প্রথম প্রথম নিজে বানিয়ে খেত। এরপর একদিন বিভা দেখতেই বিভা বানিয়ে দেয়।
বিভা নিজের হাতের কাপের দিকে তাকাল। চা টা সে খুব যত্ন নিয়ে বানিয়েছে। শুধু আজ নয়, প্রতিদিনই বানায়।

বিভা চা নিয়ে মাহাথিরের সামনে ধরল।
মাহাথির বাইরের দিকে তাকিয়েই কাপ ধরল। বিভাও বাইরের দিকে দেখতে লাগল। চায়ে চুমুক দিয়ে মাহাথিরের প্রশ্ন,
‘ কেমন লাগল এতিম স্বামীর জীবনকাহিনী শুনতে?’
প্রশ্ন করেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। বিভা বুঝল হাসিনা যে তাকে এইসব বলেছে তা মাহাথির শুনেছে। বিভা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘ ভালো লাগলো। তবে জেনেও তেমন কিছু হলোনা। আগে আপনি আমার যা ছিলেন, এখনো তাই আছেন।’

কিছু মনে পড়ল বিভার। মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে বলল, ‘ বিকালেও আপনার মাথাব্যথা ছিল। মাইগ্রেনের ঔষধ খেয়েছেন? নয়তো রাতেও ব্যথা করবে। ঔষধ নিয়ে আসি এখানে?’

বিভার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, ‘ আমার এতো যত্ন কেন করো?’
‘ ভালোবাসার যত্ন করতে হয় মাহাথির।’
‘ আমাকে ভালোবাসো?’

বিভা উত্তর দিল না। এই প্রশ্নের উত্তর সে সরাসরি দিতে পারে না। মাহাথির আকাশে তাকিয়ে বলল, ‘ তুমি আমাকে ভালোবাসো না বিভা। ইনফ্যাক্ট কেউ কাউকে এই পৃথিবীতে ভালোবাসে না। সবাই স্বার্থপর। তুমিও, আমিও, সবাই।’
কিছুক্ষণ থেমে ফের শুরু করল, ‘ সবার টা অবশ্য জানিনা। তবে তোমার আমার মাঝে যে ভালোবাসা নেই এইটা সত্যি। ভালোবাসতে সম্পর্কের প্রয়োজন হয়। যেমন ধরো বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের রক্তের সম্পর্ক। তাই বলা যায় একটা টান থেকে ভালোবাসা হয়েই যায়। কিন্তু তোমার সাথে আমার কীসের সম্পর্ক? তুমি বলছো তুমি আমাকে ভালোবাসো। কেন ভালোবাসো, কেন যত্ন করো বলো? আমাদের মাঝে কোনো রক্তের সম্পর্ক তো নেই। হ্যাঁ, আছে। শারীরিক সম্পর্ক। আমি কী ধরে নিব তুমি এই কারণে আমাকে ভালোবাসো? কে হই আমি তোমার?’

বিভা চোখ তুলে তাকাল মাহাথিরের দিকে। তার কণ্ঠে কী বিদ্রুপ ছিল? এই পর্যায়ে এসে বিভার মনে হলো মাহাথিরকে সে ভালো না বাসলেও পারতো। ভালোবাসা বলে কয়ে আসে না, হয়ে যায়। কীভাবে হয়, কী দেখে হয় বিভা তা জানেনা। যদি বিভা জানতো তবে মাহাথিরকে ভালোবাসা মতো কাজ সে করতো না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বুক ভার হয়ে আসছে। বিভাকে ভালো না বাসুক, বিভার ভালোবাসাকে কেমন করে অসম্মান করে সে?
আজ এখানে দাঁড়িয়ে মাহাথির নামক পুরুষ টাকে ভীষণ দূরের মনে হলো। অচেনা, অজানা, এক পাষাণ লোক যার কাছে বিভার কষ্ট, ভালোবাসা কিছুই পৌঁছায় না।
কিছুসময় পর মাহাথিরের চোখে চোখ রেখে নিজের চোখে ভাসা অশ্রু নিয়ে বিভা বলল, ‘ আপনি আমার অনেক কাছের পরমানুষ।’
মাহাথির গম্ভীর চোখে দেখল বিভার চোখ থেকে পড়ে যাওয়া এক বড় অশ্রুকণাকে।

বিভা কাপ হাতে নিয়ে মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। এরপর চলে গেল ঘরে। মাহাথির বিভার চোখের অশ্রু দেখল, তার চলে যাওয়া দেখল, কেবল অনুভব করতে পারল না বিভার কণ্ঠের যন্ত্রণা। যদি পারত তবে হয়তো তার বুক কেঁপে উঠত। মাহাথির আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ অনেক কাছের পরমানুষ?’

______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২২১০
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান