একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৪৫+৪৬

0
304

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪৫.
মাহাথির হঠাৎ করে চোখ খুলে উঠে বসল। হাত বাড়িয়ে ফোনের আলো জ্বেলে দেখল ৩ টা ৫৬ মিনিট। এই সময়ে নিজের ঘুম ভাঙার কোনো অর্থ মাহাথির বের করতে পারল না। তবে লুকায়িত একটি অর্থ বের করা যায়। সে ঘুমের আগে অনেকবার চেষ্টা করেছিল না ঘুমোতে। চেয়েছিল, আজ সে জেগে থাকবে। বিভাকে খাবার তৈরি করে দিবে। মাহাথিরের ধারণা তার নিয়তের কারণেই সৃষ্টিকর্তা তার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। নিয়ত খুব মূল্যবান একটি বস্তু। নিয়তের ওপর কিছুই নেই। মাহাথির তাকিয়ে দেখল পাশে বিভা নেই। যার অর্থ আম্মার বলা কথা সত্য। বিভা আসলেই রাতে উঠে পড়ে। মাহাথির নেমে পড়ল খাট থেকে।

বিভার সামনে সাতটা তেলের পিঠা। আরোও তিনটা ছিল। সে তা সাবাড় করে দিয়েছে। আটমাসে পড়ার পর থেকেই ক্ষুধা বেড়ে গেছে তার। যখন তখন খেতে ইচ্ছে হয়। অসময়ে প্রচন্ড ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করে। রাতে ঘুম হয়না। মাঝরাতে ক্ষুধায় পেটে ইঁদুরেরা মারামারি করে। এই মারামারি বিভা সহ্য করতে পারেনা। তাই তো নিজেই উঠে পড়ে। মাহাথির, আম্মা কাউকে ডাকেনা। সে মানুক বা নাই মানুক মানুষগুলো কষ্ট করে। তার জন্যই মানুষগুলো সারাদিন কষ্ট করে। আর সে এতোটুকু করে নিতে পারবেনা বুঝি? তাই তো প্রতিদিন উঠে উঠে সে রান্না করে খাবার খায়। প্রতিদিন অবশ্য রান্না করতে হয়না। যেদিন ঘরে রান্না করা তরকারি থাকে সেদিন তাই দিয়ে সে পেট ভরে ভাত খায়। আবার না থাকলে নিজেই রান্না করে। আজ ভীষণ পিঠা খেতে ইচ্ছে করছিল। তাই তো বানিয়ে ফেলল। মানিকগঞ্জে এই পিঠাকে বলা হয় ‘তেলের পিঠা’। বিভা আরেকটা মুখে নিয়ে খেতে লাগল। মনে হলো এই খাবারটা ভীষণ ভদ্র একটা খাবার। কী সুন্দর মিষ্টি, মজা! অভদ্র খাবার অবশ্য হয়না, তবুও যে খাবার খেতে কষ্ট সেটাকে বিভা অভদ্র খাবার বলে গণ্য করে। অভদ্র খাবারের তালিকায় ‘টক’ জাতীয় খাবার রাখা যেতে পারে। মিষ্টি খাবার খাওয়ায় কোনো কষ্ট নেই। মুখে পুরো আর খাও। আগে বিভা এতো মিষ্টি পছন্দ করতো না, তবে ইদানীং বেশি খাওয়া হচ্ছে। আম্মা বলেছে, মেয়ে হলে নাকি টক খেতে ইচ্ছে করে। ছেলে হলে নাকি মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করে। কথাটা হয়তোবা সত্য। তার প্রমাণ জলজ্যান্ত বিভা।
বিভা একটা আস্ত পিঠা নিজের দু’গালে ঢুকিয়ে আরামে চিবুচ্ছে। কিন্তু আরাম টা আর রইল না। তার টেবিলের সামনেই মাহাথির দাঁড়ানো। দৃষ্টির ভাষা – বিভাকে এখানে এইভাবে মাহাথির তাকে আশা করেনি। কিছুটা অবাক হয়েছে সে।
বিভা মাহাথিরের থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তখন তার মনে হলো তার দু’গাল ভর্তি পিঠা। শুধু তাই নয়। তার হাতেও একটা আধখাওয়া পিঠা। বিভা একবার মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে হাতের পিঠা প্লেটে রেখে দিল। এরপর মাথা নিচু করে ভীষণ লজ্জার সাথে পিঠা চিবুতে লাগল। তার অঙ্গভঙ্গি তার সাথে বেঈমানী করে প্রকাশ করে দিল যে, সে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। অঙ্গভঙ্গির সাথে বন্ধুত্ব করে নিল মুখভঙ্গিও। মাহাথির ততোক্ষণে চেয়ার টেনে বিভার সামনে বসেছে। মাহাথির তার ভেতরের সবটুকু আদর ঢেলে বলল,
‘ আমাকে ডাকতে পারতে পাগলী। আমি বানিয়ে দিতাম।’

বিভার মুখের পিঠা তখনো শেষ হয়নি। দাঁতগুলোও তার সাথে দুষ্টুমি করে পিঠা চিবুচ্ছে না। বিভা কিছু বলল না। মাহাথির বলল,
‘ পায়ে পানি এসেছে তোমার। শরীর তেমন ভালো না। এই সময়ে রান্নার ধোঁয়া গায়ে লাগানো ঠিক? আমাকে বললেই হতো। হয়তো পারফেক্ট হতোনা। কিন্তু তুমি ইন্সট্রাকশন দিতে, সে অনুযায়ী নাহয় বানাতাম।’

বিভা এবারেও নিরুত্তর। বিভার পিঠাভর্তি ফুলো গাল টিপে দিল মাহাথির। মুচকি হেসে বলল,
‘ ক্ষুধা মিটেছে?’

বিভা দুপাশে মাথা নাড়ল। যার অর্থ মিটেনি। মাহাথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। প্লেটের দিকে তাকিয়ে বিভার দিকে তাকাল। বিভার মুখের পিঠা ততোক্ষণে শেষ। মাহাথির হাত বাড়িয়ে পানি ভরে গ্লাস এগিয়ে দিল বিভার দিকে। বিভা পানি খেয়ে সরলকণ্ঠে বলল,
‘ আরেকটা খাব আমি।’

বলেই হাতে তুলে নিল একটা পিঠা। কামড় বসিয়ে চোখ তুলে মাহাথিরকে দেখে বিভা একটা অভাবনীয় কাজ করে বসল। নিজের অর্ধ-খাওয়া পিঠা এগিয়ে দিল মাহাথিরের দিকে। বলল, ‘ খাবেন?’
উষ্কখুষ্ক চুলের অগোছালো মাহাথিরের লালাভ চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। তবে সম্মতির আগেই বিভা বলল, ‘ সরি।’
বলেই তার হাতের পিঠা রেখে নতুন আরেকটা পিঠা তুলে নিল। মাহাথিরের দিকে এগিয়ে দিলে মাহাথির শান্তভাবে বিভার হাতের পিঠা আগের জায়গায় রেখে অর্ধশেষ পিঠাটা বিভার হাতে তুলে দিল। এরপর মাথা নিচু করে কামড় বসালো। কামড় বসিয়েই চোখ তুলে তাকাল বিভার দিকে। কী গভীর চোখ! বিভা তাকাতে পারল না। নাম না জানা ভালোলাগায়, লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল।

.
শ্রুতির নিজের উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারছেনা। ফোন করে বিভাকে জানিয়েছে, পার্থিবকে জানিয়েছে, বাড়ির সবাইকে বলেছে। হামিম আজ নিজ পায়ে হেঁটে তার ঘরে এসেছে। হালকা কষ্ট হয়েছে, তবে পেরেছে। ব্যাপারটা সাধারণ হলেও শ্রুতি, বিভার কাছে ভীষণ খুশির একটা মূহুর্ত। বিভা শুনেও অনেক খুশি হয়েছে। শ্রুতি নিজেও বেশ খুশি। ঘটনাটা ঘটেছে সকালে, অথচ তার খুশি রাতেও কমেনি। উলটো দ্বিগুণ বেড়েছে। পার্থিবও শ্রুতির খুশিটা বেশ উপভোগ করছে। মেয়েটার হাসিমুখ দেখলে আলাদা প্রশান্তি কাজ করে বুকে।
শ্রুতি পার্থিবের দিকে তাকাল। পার্থিব তার পাশেই শুয়ে আছে। দৃষ্টি শ্রুতির মতোই উপরে। শ্রুতি এগিয়ে পার্থিবের হাত মেলে বাহুতে নিজের মাথা রাখল। ভালোলাগায় আপ্লূত হয়ে বলল, ‘ আমাদের জীবনে কী সুন্দর সব ভালো ঘটছে তাইনা, পার্থিব?’

‘ হুম, সব ভালো হচ্ছে আল্লাহর রহমতে।’

‘ আল্লাহ আমাদের সব কষ্ট দূর করে নিচ্ছে। আমি চারদিকে তাকালে শুধু খুশি আর খুশি দেখতে পাই।’

‘ আর আপনার খুশি দেখে আমি শান্তি পাই।’

শ্রুতি পার্থিবের কথার বিপরীতে কিছু বলল না। এই মানুষটা এতো সুন্দর করে কথা বলে! এতো ভালোবাসে তাকে! মাঝেমধ্যে ভীষণ লজ্জা লাগে, আফসোস হয়। মনে হয় মানুষটা আরোও বেশি ভালোবাসার যোগ্য যা শ্রুতি দিতে পারছেনা। শ্রুতি এগিয়ে গিয়ে পার্থিবের গালে সময় নিয়ে চুমু খেল। কৃতজ্ঞতার সাথে ভালোবাসার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বলল, ‘ থ্যাংকিউ পার্থিব। থ্যাংকিউ সো মাচ।’

পার্থিব এক হাতে শ্রুতির কোমড় জড়িয়ে বলল, ‘ কেন?’

‘ সবকিছুর জন্য। আমাকে ভালোবাসার জন্য, আমার পাশে থাকার জন্য। আপনি না থাকলে এতোকিছু হতোই না।’

শ্রুতির অজানা কারণেই ভীষণ খুশি লাগছে। চারদিক রঙিন মনে হচ্ছে। ক্যাঙ্গারুর মতো লাফাতে ইচ্ছে করছে। এতো খুশির কারণ শ্রুতি জানেনা। জানতেও চাইছেনা। মাঝেমধ্যে অজানা কারণে খুশি হওয়া ভালো। শ্রুতি তাকিয়ে দেখল পার্থিব ভীষণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শ্রুতি পার্থিবের কপালে চুমু খেল। বলল, ‘ আমার জীবনে এতো এতো খুশির উছিলা হয়ে আসার জন্য আপনাকে আপনার মহারানির হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা জানাই মহারাজ। আপনি কী সেই ভালোবাসা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক?’
পার্থিব শ্রুতির গলায় নিজের মুখ আড়াল করে বলল, ‘ উঁহু! একদম ইচ্ছুক নই।’

.
আমিন সাহেব নির্লিপ্ত মুখে টিভি দেখছেন। চেহারা দেখে তার মন বোঝার উপায় নেই। সাধারণভাবেই টিভি দেখছেন গত চল্লিশ মিনিট যাবত। তবুও, এখন যদি তাকে জিগ্যেস করা হয় যে, গত চল্লিশ মিনিটে যা দেখলেন তার সারমর্ম বলুন। আমিন সাহেব নিশ্চিত সে কিছুই বলতে পারবেনা। কারণ বলার জন্য শোনার প্রয়োজন। শুধু তাকিয়ে থাকলেই কথা নিজ পায়ে হেঁটে তার মস্তিষ্কে চলে যাবেনা। গত চল্লিশ মিনিটে সে কিছুই শোনেনি। শুধু তাকিয়ে ছিল। কেন ছিল, কেন শোনেনি তা সে নিজেও জানেনা। তবে শুধু শুধু তাকিয়ে থাকার মানে হয়না। আমিন সাহেব উঠে পড়লেন। টিভি বন্ধ করে কী করবেন ভেবে পেলেন না। তাই আবারো এসে সোফায়তেই বসলেন।

দেড়ঘন্টা আগে সে বাড়িতে প্রবেশ করেছে। হাত-মুখ ধুয়ে কিছু নাস্তা সেড়ে এরপর বসেছেন টেলিভিশনের সামনে। তাতেও মন বসছেনা। শাহিনা , তার ছেলেরা কেউ বাড়িতে নেই। আমিন সাহেবের হঠাৎ মনে হলো তার ছেলে? ভেতর থেকে উত্তর এলো, না! তার সৎ ছেলে। আমিন সাহেব সেই উত্তরই মেনে নিলেন। ওরা সবাই কোথায় গেছে তা আমিন সাহেব জানেনা। অবশ্য জিগ্যেসও করেনি। প্রায়ই যায় কোথাও। এ নিয়ে তার কোনোকালেই মাথাব্যথা কিংবা দুঃখ ছিল না। আজও নেই। তবে আজ কেমন যেন লাগছে। সারা বাড়িটা ফাঁকা। শুনশান নিরবতায় ঘেরা। আমিন সাহেব সোফায় বসে পানি খেতে লাগল। তখনি সে দেখতে পেল রান্নাঘরে দু’জন গৃহচারী কাজ করছে। হয়তো রাতের রান্না। আমিন সাহেবের কাছে ব্যাপারটা কিছুটা খারাপ লাগল। তার মস্তিষ্কে অবচেতনে ভেসে উঠল আজব একটি দৃশ্য- বিভা, মা রান্নাঘরে ঘোরাঘুরি করে কাজ করছে, শ্রুতি পিছনে হামিমকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটার পরপরই ভেসে উঠল আরোও আজব একটি দৃশ্য – তাহিরা শাড়ি পরে রান্না করছে। পেছনে বিভা দাঁড়ানো। শ্রুতি চারদিকে ছোটাছুটি করছে। আবার ভেসে উঠল – বিভা মায়ের পা জড়িয়ে ধরে আছে অজ্ঞাতকারণে, শ্রুতি হামাগুড়ি দিচ্ছে, মা আর তাহিরা হাসতে হাসতে কাজ করছে। আমিন সাহেবের মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠল। হঠাৎ করে সে এইসব কেন ভাবছে? অবশ্য মনে পড়তেই পারে। এ আর এমন কী!

নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে আমিন সাহেব আরেক অভাবনীয় ইচ্ছা পোষণ করল। তার মনে হলো আজ একবার তাহিরার ঘরে যাওয়া যেতে পারে। ভাবার পর একটু সময়ও নষ্ট না করে উঠে চলে গেল আমিন সাহেব। নির্মম হলেও সত্য যে এই ঘরে সে ঢুকল সাড়ে নয় বছর পর। তাহিরা সব সত্যি জানতে পেরেছিল হামিম পেটে থাকার তিনমাসে। এরপরই সেদিন আলাদা হয়ে যায় সে। তাহিরা ঝামেলা করে আলাদা হওয়ার পর সে আর আসেনি এই ঘরে। যা কথাহতো তাহিরা যখন বাইরে ড্রইংরুমে, ডাইনিংরুমে থাকতো তখনই হতো। এছাড়া তেমন প্রয়োজনও পড়েনি আসার। তাহিরা থাকতো বিভা, শ্রুতিকে নিয়ে। সে এখানে কী করবে! তবে তার ঘর ছাড়ার আগে সেই ঘরে থাকা তাহিরার সাজানো জিনিসপত্র নিয়েই ছেড়েছিল। সে অফিস থেকে এসেই দেখেছিল তার ঘরের আবহ সম্পূর্ণরূপে পালটে গেছে। সে নিয়ে যখন জিগ্যেস করা হলো, কেন এমন করেছো?

তাহিরা স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘ ঘরটাকে নিজের ঘর ভেবে ভীষণ যত্ন নিয়ে সাজিয়েছিলাম। এখন এই ঘরের মানুষটা যেহেতু আর আমার নেই তাই ঘরটাও আমার নেই। তবে এই ঘরের প্রতি আমার করা যত্নগুলো মূল্যবান ছিল। আর আমার অনুভূতিকে আমি সম্মান করি। একারণে ঘর ছাড়ার সাথে সাথে নিজের অনুভূতিও সরিয়ে নিচ্ছি।’

আমিন সাহেব ঘরে ঢুকে দেখলেন তার ঘর যেমনভাবে তাহিরা সাজিয়েছিল, এই ঘরটাও ঠিক তেমনিভাবে সাজানো হয়েছে। তার বাড়ির রুমগুলো একইরকম হওয়ায় তেমন কোনো পার্থক্য চোখে ফুটছেনা। তবে ঘরটা ধুলোয় ভরে আছে। সামনের টেবিলটা দেওয়ালের সাথে অগোছালো হয়ে আছে কিছুটা। আমিন সাহেব ধুলোভর্তি ঘরের আড়ালে সাড়ে নয় বছর আগের তাহিরা থাকা অবস্থায় পরিপাটি, পরিষ্কার, সুন্দর ঘরের কল্পনা করতে লাগলেন। নিজের ঘরের কল্পনার কথা মাথায় খেলতেই তার ঘরের বর্তমান অবস্থা কল্পনা করলেন। তার ঘর এবং ধুলোয় ভর্তি ঘরের পার্থক্য করতে গেলে আমিন সাহেবের অবচেতন মন বলল – এই ঘরটা বেশি সুন্দর। এই ঘরটায় তাহিরা ছিল। আর তাহিরার জন্যই ঘরজুড়ে একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে।

আমিন সাহেব নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। সে এসব ভাবছে কেন? এমন তো নয় সে তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতো। একসময় বাসতো, তবে এখন তো বাসেনা। তাহলে এমন আদিখ্যেতার মানে কী? আমিন সাহেব নিজের ঘরে চলে গেলেন। খাটে শুয়ে এসি ছেড়ে পাতলা কম্বল গায়ে জড়ালেন। তার হঠাৎ করে মনে হলো, এই আভিজাত্যময় ঘরটা সুন্দর নয়। তবে সুন্দর ছিল একসময়। সাড়ে নয় বছর আগের পার হওয়া প্রতিটা দিন এই ঘরটা সুন্দর ছিল।

.
রাত তিনটা চারমিনিট। বিভা ফোন দেখে হালকা চমকাল। আজ অন্যদিনের তুলনায় আগে ঘুম ভেঙেছে। অন্যান্যদিন প্রায় সাড়ে তিনটায় ঘুম ভাঙে। সে তুলনায় আজ আগেই উঠেছে সে। নিজের এইভাবে উঠে পড়ায় ভীষণ বিরক্ত হয় বিভা। মাঝরাতে উঠে পড়ে, এরপর সারাদিন ঘুমে ঢোলে পরে। আজব ব্যাপার!

বিভা বাইরে বের হতে হতে ভাবল আজ কী খাওয়া যায়। তার তেমন কিছু খেতে ইচ্ছে করল না, মনেও পড়ল না বিশেষ কোনো খাবারের নাম। বিভা বাইরে এসে ঘরজুড়ে আলোয় চমকে গেল। এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে ঘর্মাক্ত মাহাথিরকে দেখে তার চমকের পারদ বাড়ল আরেকটু। সাথে মনের ভেতর ভয় হলো মাহাথির এখানে, বিছানায় তাহলে কে ছিল! নিজের অজান্তে এমন প্রশ্নে কিছুটা ভয় পেল বিভা। পরমুহূর্তেই মনে হলো, সে তো পাশে তাকিয়ে দেখেনি যে মাহাথির আছে কিনা। হয়তো ছিলনা। খেয়াল করেনি।

বিভা সামনে এগোতেই মাহাথির চোখে হাসল। কড়াই থেকে কিছু উঠাতে উঠাতে বলল, ‘ রান্নাঘরে এসোনা। সোফায় বসো। আমি নিয়ে আসছি খাবার।’
মাহাথিরের ভাবভঙ্গিতে মনে হলো বিভার এখন উঠে খাওয়া ভীষণ স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। বিভা হঠাৎ খুশি হয়েও হলোনা। তার মনের অভিমানেরা ঝাপটে ধরল তাকে। বিভার ভাবনার মাঝেই মাহাথির এগিয়ে এসে এক হাতে প্লেট রেখে অন্য হাতে বিভাকে নিয়ে বসাল। মাহাথির নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলতে চাইলেও, কণ্ঠে তার উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেল। বলল,
‘ এই নাও। খেয়ে প্লিজ রিভিউ দাও তো কেমন হয়েছে?’

বিভা প্লেটে তাকিয়ে দেখল ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, চিকেন চাপ। আয়োজন অতিরিক্ত না হলেও সাধারণও নয়। প্লেটের কোণায় আবার টমেটো সস রাখা। মুরগির পদ দেখে খারাপ লাগছেনা। বরং খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এতোদিন যাবত মুরগি দেখেই তার মাথা ঘুরাতো, নাড়িভুড়ি উলটে আসতো।
মাহাথির অপেক্ষা করল বিভার পরবর্তী কাজের। বিভা গত দু’মাস ধরে মুরগি, মাছ খায়’ইনা বলতে গেলে। অন্যদিকে ডাক্তার বলেছে, শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি আছে। তাই সব ভেবে মাহাথির ভাবল মুরগির কিছু খাবার বানানো যেতে পারে। তাইতো আজ না ঘুমিয়ে বসে বসে ইউটুব দেখে এইগুলোই করল মাহাথির। তবে সবকিছু সে অল্প তেলে ভেজেছে। এখন আল্লাহ মা’বুদ জানেন কেমন হয়েছে।

বিভা শুকনোমুখে বলল, ‘ খাবনা।’
বিভার এমন কথায় মাহাথিরের মনটা কাচের মতো ভেঙে গেল। বলল, ‘ কেন বিভা? অন্যকিছু খাবে? বলো তাহলে। অন্যকিছুই বানিয়ে দেই?’
মাহাথিরের এমন কথায় বিভার কাছে সামনের মানুষটাকে ভীষণ অপরিচিত লাগল। মনে হলো, এই কী সত্যি মাহাথির? বিভার মন হয়তো মাহাথিরের আদর, ভালোবাসা, আশকারা পেতে চাইল। তাই অভিমানে বলল, ‘ আমি আপনার হাতের কিছু খাবনা, মাহাথির। ঘরে যাব। ঘুম পাচ্ছে।’
বিভা উঠতেই মাহাথির হাত টেনে ধরে বসাল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শান্তকণ্ঠে বলল,
‘ আমার রাগ খাবারের ওপর দেখাচ্ছো? খেয়ে নাও। ক্ষুধা লাগেনি?’

‘ লাগলেও খাবনা।’

‘ বিভায়া! আমি কিন্তু রাগ করব। খাও। খেয়ে নিয়ে বলো তোমার হাসবেন্ড এর রান্নার হাত কেমন?’ বলেই মাহাথির নিজের হাতে বিভাকে খাইয়ে দিতে গেল। বিভা জড়বস্তুর মতো বসে রইলে। মাহাথির খাবার আরেকটু এগিয়ে ধরল। বিভা একবার মাহাথির, একবার খাবারের দিকে তাকিয়ে মুখে নিল খাবার। মাহাথির নিজের ভালোলাগার সাথে বিভাকে খাওয়াতে লাগল। বিভা আড়চোখে দেখতে লাগল তার সামনের মানুষটাকে। মাহাথির কী এখন ইচ্ছে করেই এমন অগোছালো থাকে নাকি বিভাকে প্রেমে ফেলার জন্য? নির্লিপ্ত মুখভঙ্গিও কী সুন্দর! বিভা চোখ সরিয়ে মাহাথিরের হাতের দিকে নিতেই তার দৃষ্টি সেখানে স্থির হয়ে রইল। মাহাথির আবার খাওয়াতে গেলে বলল, ‘ এখানে কী হয়েছে?’
মাহাথির সেদিকে একবার তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘ গরম তেল ছিটকে এসেছিল।’

মাহাথিরের নির্বিকার কণ্ঠের কথা বিভার সহ্য হলোনা। আর তার হাতে থাকা ছোট্ট বলের মতো দুটো দাগও সহ্য হলোনা। চোখ ঝাপিয়ে শুরু হলো অশ্রুপাত।
মাহাথির বিভার চোখে পানি দেখে হঠাৎ করে থমকে গেলেও ভাঙা মনের কাঁচে যেন ভালোলাগারা এসে ফুল ফুটিয়ে দিল। মাহাথিরের মনটা ভালো হয়ে গেলো এক নিমেষেই। নিজের স্ত্রীর কান্না তাকে প্রমাণ দিল সে তার স্ত্রীর কাছে কতোটা মূল্যবান। তার মনে হলো, তার এতোক্ষণের কষ্ট স্বার্থক। মাহাথির প্লেট নামিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরল তার মাহতিমের আম্মুকে। মাহাথিরকে আরেকধাপ থমকে দিয়ে বিভা মাহাথিরের বুকে পরে, গেঞ্জি আঁকড়ে ফুঁপিয়ে উঠল। পরিস্থিতি কিছুটা বিষণ্ণ হলেও, মাহাথিরের মনে হলো এরচেয়ে সুখকর কিছু হতে পারেনা।
______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২১৪০
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪৬. (অর্ধাংশ)
সুখের সময় হয়তো দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়না। কিংবা আমরা সুখ উপভোগ করি বলে সুখের সময় কোথায় দিয়ে চলে যায় ধর‍তে পারিনা। বিভার কেবিনে দাঁড়িয়ে আছে মাহাথির, শ্রুতি, পার্থিব। শ্রুতি গাল থেকে চোখের পানির দাগ শুকোয়নি, অথচ সেই দাগের ওপর দিয়েই আবার নতুন করে অশ্রুপাত হতে লাগল। গতকাল শ্রুতি গেছিল বিভাদের বাসায়। বিভার নয় মাসের বেশিদিন বাকি নেই। তাই শ্রুতি ভেবেছিল এই সময়টাতে সে থাকবে বোনের পাশে। সারা সকাল ভালো কাটলেও রাত নয়টার দিকে বিভার পেটে যন্ত্রণা শুরু হয়। বিভার চিৎকারে, যন্ত্রণায় শ্রুতি ভয়ে পেয়ে হাসিনাকে ডেকে আনলে হাসিনা বলে প্রসবের ব্যথা কখনো কখনো নয়মাসের আগে, কিংবা পরেও হয়। বিভার ব্যথা উঠেছে শুনেই শ্রুতির হাত-পা অবশ লাগতে শুরু হলো। তবে ভাগ্য বোধয় সহায় ছিল। তাইতো মাহাথির তখনি অফিস থেকে ফিরেছে। সেদিনই আবার মাহাথিরকে বেশিক্ষণ থাকতে হয়েছিল অফিসে। সাথে শ্রুতি আছে বলে মাহাথির নিজেও কিছুটা চিন্তামুক্ত ছিল।
অফিস থেকে ফিরেই বিভার চিৎকার শুনে মাহাথির বিভাকে নিয়ে নিচে চলে যায়। নিচে শ্রুতির জন্য অপেক্ষাকৃত গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। শ্রুতি বিলম্ব না করে সেই গাড়িতেই উঠাতে বলে। মাহাথির, শ্রুতি বিভাকে নিয়ে চলে যায় হাসপাতালে। হাসিনা চেয়েও যেতে পারেন না নিজের স্বামীর কারণে। মানুষটার আবার শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। এছাড়া মাহাথির আশ্বাস দেয় যে, সে জানাবে বিভার খবরাখবর।
মাঝরাস্তায় শ্রুতি পার্থিবকে জানালে পার্থিব জানায় যতোদ্রুত সম্ভব সে পৌঁছে যাবে।

বিভাকে ডাক্তার দেখে বলে আগামীকালই বিভার সিজার করানো উচিত। বাচ্চার পজিশন, আকারের কথা চিন্তা করেই বিভাকে সিজারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মাহাথিরও বিভার সুস্থতার কথা চিন্তা করে টু শব্দ করেনি। তার শুধু বিভাকে সুস্থ চাই।

ভোরবেলায় পার্থিব-শ্রুতি বাড়ি গিয়ে গোসল সেড়ে এসেছে। পার্থিব শ্রুতিকে খাওয়াতে চাইলেও কিছু খাওয়াতে পারেনি। পার্থিব নিজেও চিন্তিত। তবুও শ্রুতিকে যথেষ্ট সামলে রেখেছে সে। হাসিনাও এসে পুত্রবধূকে দেখে গেছে সকালবেলা, সাথে তাকে সাহস দিয়ে গেছেন।

কিছুক্ষণ পর বিভাকে ওটিতে নেওয়া হবে। বিভা কেবিনের বেডে শুয়ে আছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। উপরে উপরে যতোটাই নির্লিপ্ত, ভেতরে ভেতরে ততোটাই ভঙ্গুর সে। বিভার নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। মনে হচ্ছে তার আপনজনদের মুখ সে আর কোনোদিন দেখবেনা। এই তো তার সামনে দাঁড়ানো অশ্রুসিক্ত চোখের শ্রুতি, চিন্তিত মুখের পার্থিব, সাধারণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মাহাথির। মাহাথির। বিভার মাহাথির। ভাবতেই চোখ গলিয়ে দু’পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল অশ্রুধারা। বিভার ভীষণ আফসোস হলো। এতো চেহারার মাঝে তার ছোট্ট ভাইটা নেই। সে যদি তার ভাইকে আর না দেখে? ভাবতেই বুকে কী যেন একটা কামড়ে ধরল। হামিমকে দেখতে পারলে হয়তো বুকটা শান্তি পেত। তার ভাই। তার মা মরা ভাইটা। বিভা শ্রুতিকে ডাকল। শ্রুতি শুয়ে বিভার পাশে বসল। বিভার চোখ স্পষ্ট ছলছলে, অথচ মুখে হাসি। হাসিমুখে বলল,
‘ শ্রুতি! আমি ভীষণ খুশি বোন। হামিম হাঁটতে পারছে। একদিন দেখবি ও একদম সুস্থ হয়ে যাবে। তাইনা বল? তোরা অনেক ভালো থাকবি। দেখিস…..’

বিভার এমন অসংলগ্ন কথায় শ্রুতি যেন অন্যকিছুর আভাস পেল। কেঁদে ফেলল। বলল, ‘ এমন করে বলছিস কেন, আপা? আমরা সবাই ভালো থাকবো। একসাথে ভালো থাকবো।’

বিভা সে কথা কানে নিল না। পার্থিবকে ডাকল। পার্থিব বিভার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে চেয়েও পারল না। শুধু বলল,
‘ আমাদের ছোট্ট বাবাকে নিয়ে ফিরে আসুন, আপা। আমরা সবাই অপেক্ষা করব আপনার জন্য।’

বিভা হাসতে চাইল। শ্রুতির দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
‘ এই পাগলকে দেখে রেখ তো পার্থিব।’
পার্থিব সম্মতি দিল। পার্থিব বুঝল বিভা এইবার হয়তো মাহাথিরকে কিছু বলবে। পরিস্থিতি বুঝে শ্রুতিকে নিয়ে বাইরে গেল সে।

বিভা চোখ বন্ধ করল। মাহাথিরকে সে কী বলবে? সে যে এই মানুষটাকে কতোটা ভালোবাসে তা কী বলবে? বিভা বলল,
‘ এদিকে আসুন।’

মাহাথির এগিয়ে এলো। সে যে কতোটা ভয়ে আছে বিভা কী বুঝতে পারছে? তার বুকের হৃৎযন্ত্র যে এতো জোড়ে বাজছে তা কী বিভা শুনতে পারছে? মাহাথির নিচু হলো। সে বিভার চোখের দিকে তাকাতে চাইছে না। মাহাথির তাকালেই যদি বিভা তার চোখের ভাসা পানি দেখে ফেলে? বিভা বলল,
‘ ভয় পাচ্ছেন, মাহথির?’

‘মাহথির’! এতোদিন ধরে বিভার মুখে ডাকটা শুনেও বুকটা কেমন যেন ধ্বক করে উঠল। এতোদিন যাবত মাহাথির চাইতো বিভা তার সাথে কথা বলুক। আজ যখন বিভা কথা বলছে, মাহাথিরের মনে হলো তার শব্দভান্ডারে কোনো শব্দ বহাল নেই। বিভা মাহাথিরের গালে হাত রাখল। ভীষণ যত্ন করে মাহাথিরকে ছুয়ে বিভা বলল,
‘ মুখটা শুকিয়ে গেছে আপনার। রাতে-সকালে আমার জ্বালায় কিছু খেতেও পারেননি। তাইনা? এতো চিন্তা করছেন কেন বলুন তো? আমি ওটিতে গেলেই খেয়ে আসবেন। কেমন? আমি জানি আপনার ক্ষুধা সহ্য হয়না।’

মাহাথিরের চোখের পাতা কেঁপে উঠল। বিভা এইভাবে কথা বলছে কেন? তার ভীষণ অসহায়বোধ হলো। মনে হলো এই দুনিয়াতে তার থেকে নিঃস্ব কেউ নেই। মাহাথির নিজের কাঁপা হাত বিভার মাথায় বুলিয়ে দিয়ে। বিভা চোখ বন্ধ করে নিল। চোখ বন্ধ করতেই খুব মায়ের কথা মনে পড়ল, দাদীর কথা মনে পড়ল। বিভার মনে পড়ল নিজের বাবার বিশ্বাসঘাতকতার কথা। আচ্ছা, সে যদি না ফিরে আসে তবে কী মাহাথির বিশ্বাসঘাতকতা করবে? একদম তার বাবার মতো? বিভার মনে হলো, কক্ষনো মাহাথির এমন করবেনা। সে এমন হতেই পারেনা। আবার মনে হলো, সে তো আমিন শিকদারকেও বিশ্বাস করতো। কিন্তু আমিন শিকদার তো বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি। মাহাথিরও যদি না রাখে?
রাখবে না কেন? অবশ্যই রাখবে। কারণ সে জানে, মাহাথির তাকে ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে।

নার্স এসে বিভাকে নিয়ে যেতে চাইল। সময় হয়ে গেছে। অগত্যা মাহাথিরও আর কিছু বলতে পারল না। বিভার হাত ধরে সেও বিভার সাথে সাথে হাঁটতে লাগল। সামনেই দু’জন নার্স বেডটাকে টেনে নিচ্ছে। মাহাথির নিচু হয়ে বলল, ‘ আমার তোমাকে ভালোবেসে মন ভরেনি বিভা। মাহতিমকে নিয়ে ফিরে আসো। দু’জনকে একসাথে ভালোবাসতে চাই আমি। অনেক ভালোবাসব তোমাদের। দেখো তুমি।’
মাহাথিরের কথায় বিভার চোখ থেকে উত্তপ্ত অশ্রু গড়ালো। নিজের সন্তানের কথা চিন্তা করে, মনের খারাপ ভাবনা থেকে শেষবারের মতো বলল, ‘ আমার ছেলের খেয়াল রাখবেন, মাহাথির। ওকে মোটেও কষ্ট দেবেন না।’

বলতে বলতেই চোখ গেল দূরে দাঁড়ানো শ্রুতি, পার্থিবের দিকে। তাদের দেখে মাহাথিরের মুখ দেখে হাসিমুখে চোখ বন্ধ করল বিভা। সে বুঝল তাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হলো। ইশ! বড্ড ভুল হলো! আফসোস হচ্ছে ভীষণ! মাহাথিরকে ভালোবাসি বলা হলোনা। একবার বললেও তো পার‍তো। আর যদি না বলা হয়? সে দু’দিন আগেই সংবাদে শুনেছিল একজন মা দু’জন সন্তান জন্ম দিয়ে মারা গেছে। সেও যদি মারা যায়! তার মায়ের মতো? তাহলে? ভালোবাসিটা বলে দিলে হয়তো এতো আফসোস হতোনা।

অপারেশন থিয়েটার এর দরজা বন্ধ হতেই শ্রুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হলো নয় বছর আগে যেভাবে দরজা বন্ধ হয়েছিল, ঠিক একইভাবে দরজা বন্ধ হলো। চোখের সামনে ভাসতে লাগল নিজের মায়ের মুখ। চোখ গলিয়ে পড়তে লাগল অশ্রুধারা। পার্থিবের দিকে ঘুরে জড়বস্তুর মতো বলতে লাগল, ‘ আমি বুঝে গেছি সব। আপা আসবেনা পার্থিব। আপা আর আসবেনা। আমার মা আসেনি। আপাও আসবেনা। আপাও চলে গেল আমাকে ছেড়ে।’
পার্থিব গম্ভীর চোখে দেখল শ্রুতির ঠোঁট ভেঙে, নাক ফুলিয়ে ভীষণ যন্ত্রণায় কান্না গেলা কথাগুলো। পার্থিব শ্রুতিকে বুকে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। শ্রুতির কানে ধীরকণ্ঠে বলল,
‘ চুপ। একদম চুপ। আপা আসবে। আপনি না আমাকে বিশ্বাস করেন। এইবার একটু করেন শ্রুতি। আপা সত্যিই আসবে।’

থাই গ্লাস দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে মাহাথির। চারপাশে কতো মানুষ! অথচ ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভাগ্য তেমনভাবে তাকে কখনো জিতিয়ে দেয়নি, আবার হারিয়েও দেয়নি। মাঝামাঝি পর্যায়ে রেখেছে। তার এই পরিস্থিতির মাঝামাঝি কী হতে পারে? মস্তিষ্ক বলল, মাঝামাঝি তখনই হবে যখন একজন বেঁচে যাবে, অন্যজন মারা যাবে। কথাটা ভাবতেই পা জোড়া কেমন কেঁপে উঠল। আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছেনা। দুর্বল লাগছে ভীষণ। থাই গ্লাসে নিজের হাত রেখে মাথা নিচু করে বদ্ধ চোখে মাহাথির নিজমনে বলল,
‘ আমি ভবিষ্যতের সকলের জিতের বিনিময়ে এইবার জিততে চাই। বিভাকে চাই, আমার সন্তানকে চাই। আমাকে জিতিয়ে দিন আল্লাহ। বাকিটা জীবন নাহয় হাসিমুখে হার মেনে নেব।’

এপ্রোন পড়তে পড়তে ওটিতে ঢুকছে ডাক্তার। চারদিকে তাকাতেই দেখল পেল মাহাথিরকে। প্রতিদিনই সে এমন অসহায়, নিঃস্ব স্বামীদের, কাছের মানুষদের দেখে। তবে এই পুরুষটিকে কী একটু বেশি নিঃস্ব লাগলো তার কাছে? ডাক্তার বুঝতে পারল না। শুধু কানে ভাসল কিছু কথা –
‘ আপনার কাছে অনুরোধ – আমার স্ত্রী যেন সুস্থ হয়ে ফিরে। আপনারা যতো টাকা চেয়েছেন, আমি দিয়েছি। আরোও বললে আরোও দিব। বিনিময়ে আমার স্ত্রী, সন্তানকে সুস্থ চাই।’
কথাটা গম্ভীরমুখে বলেছিল পুরুষটি। কেমন একরোখা কণ্ঠ! অথচ তার কাছে মনে হলো কণ্ঠে ছিল একরাশ লুকায়িত আকুলতা, অনুরোধ।

পার্থিব শ্রুতিকে জড়িয়ে বসে আছে। নিস্তব্ধত চারপাশ। এইতো সেদিন শ্রুতি বলছিল, চারপাশে এতো খুশি কেন পার্থিব? সত্যিই তো এতোদিন চারপাশে কতো খুশি ছিল। এতোদিন বেশি খুশি ছিল বলেই কী এখন বেশি দুঃখ, যন্ত্রণা পাচ্ছে? পার্থিব গম্ভীরমুখে চোখ তুলে চাইল। দূরে মাহাথির ভাই দাঁড়ানো। পার্থিব তার মনের অবস্থা সম্পূর্ণ বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। পার্থিব একবার শ্রুতি, একবার মাহাথিরকে দেখল। মনে পড়ল হামিমের নিষ্পাপ মুখমণ্ডল। চোখ বন্ধ করে দোয়া করল,
‘ সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে দাও আল্লাহ। কাউকে কখনো নিরাশ করোনি তুমি। আমাদেরও করোনা। এতোদিন যতোটুকু খুশি ছিলাম, তার থেকেও দ্বিগুণ খুশি ফিরিয়ে দাও। প্লিজ আল্লাহ।’

______
চলবে~

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪৬. ( বাকি অংশ)
মাহাথির এখনো আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাত বুকে গুঁজে দৃষ্টি তার বাইরের দিকে। তাকে দেখে নিঃসন্দেহে কেউ ভেবে বসবে, লোকটা হয়তো পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছে। কিংবা গাছপালা গুনছে। কিংবা বিল্ডিং ও গুনতে পারে এতো মনোযোগ দিয়ে। অথচ এসবের কিছুই মাহাথির করছেনা। তার দৃষ্টি বাইরে থাকলেও মাথা-মন সবজুড়ে কেবল একটাই নাম। বিভা, বিভা, বিভা। মাহাথির দৃষ্টি ফেরাল নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা পার্থিবের দিকে। শান্তকণ্ঠে বলল,
‘ কতোক্ষণ হয়েছে পার্থিব?’

পার্থিব ঘড়ি না দেখেই বলে দিল,
‘ কেবল মাত্র পয়ত্রিশ মিনিট হয়েছে, ভাই।’

শ্রুতি ঠায় পড়ে আছে পার্থিবের কাধে। সিজার তেমন ভয়ংকর কোনো ব্যাপার নয়। প্রতিদিনই কতো কতো মানুষ সিজার করাচ্ছে। তবুও, শ্রুতির কাছে ব্যাপারটা আতংকের। মায়ের মৃত্যুই হয়তো তার একটি কারণ। শ্রুতি পার্থিবের পাশে তাকাল। তার শাশুড়ী তানহা এসেছেন। শাশুড়ীকে দেখে একদফায় কান্না শেষ শ্রুতির। এই সময়ে তানহার আসার কোনো কারণ ছিলনা। তবুও নাকি চিন্তা হচ্ছিল বলে চলে এসেছে। এই খারাপ সময়ের মাঝেও ব্যাপারটা বেশ মুগ্ধ করল শ্রুতিকে। নিজের শাশুড়ীর প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়ে দিল।

পার্থিবের উত্তর শুনে মুখ ফেরাল মাহাথির। সময়ও যেন ফুরাচ্ছে না। মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট হয়েছে। ডাক্তার বলেছিল সর্বনিম্ন পঁয়তাল্লিশ মিনিট, সর্বোচ্চ দেড় ঘন্টা লাগতে পারে। মাহাথির নিজেকে আশ্বস্ত করতে চাইল। এইতো! আর কিছুক্ষণ! এর পরেই বিভা চলে আসবে।
বিভা যাওয়ার পর থেকেই খারাপ-ভালো নানান চিন্তা মাথায় খেলছে। সবকিছু ছাপিয়ে এবার বেশ অভিমান হলো। বিভা তাকে যাওয়ার সময় ওইভাবে কেন বলল? তবে কী বিভা তাকে বিশ্বাস করেনা? বিভা কেন বলল, আমার বাবার খেয়াল রাখবেন। মাহাথির কী খেয়াল রাখতো না? সে কী ভালোবাসেনা নিজের ছেলেকে? ও কী এতো খারাপ? খারাপ চিন্তা, রাগ, অভিমান মিলিয়ে মনটা কেমন বিষাক্ত হয়ে উঠল। মনটা ছিঁড়ে এনে ফেলে দিলে বোধয় শান্তি পাওয়া যেত।

পেরিয়ে গেছে আরোও কিছু সময়। মাহাথিরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ো হচ্ছে। পঞ্চাশ মিনিট হয়ে এলো। কোনো খবর নেই কেন? সে যে আর পারছেনা। ধৈর্যে কুলোচ্ছে না। মাহাথিরের ডাকে আল্লাহ বোধয় সহায় হলেন। সেই মূহুর্তেই নার্স কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ ওটিতে ঢুকতে ঢুকতে হাসিমুখে বললেন,
‘ বেবিকে ভালোভাবে বের করা হয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আপনাদের কাছে দিব।’
কথাটা যেন মাহাথিরের বুকে আছড়ে পড়ল। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল। পার্থিব উঠে মাহাথিরের কাছে গেল। কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ কংগ্রাচুলেশন ভাই। বাবা হয়ে গেলেন। আর আমি ছোটবাবা।’

মাহাথির পার্থিবের দিকে তাকিয়ে কী বলবে বুঝতে পারল না। চোখের পলক ফেলে কিছু বলতে চাইল। হাসার চেষ্টা করেও পারলনা। পার্থিব হয়তো বুঝল সামনের মানুষের মনের অবস্থা। বলল,
‘ রিল্যাক্স ভাই। আমাদের বাবা ঠিক আছে। আপাও ঠিক থাকবে। এরপর আমরা সবাই কিন্তু একসাথে ঘুরতে যাব।’
মাহাথির এইবার হেসে দিল সামান্য। তবে মলিনভাবে। পার্থিব আর ঘাঁটাল না। শ্রুতির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করল শ্রুতির মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এমনিতে মেয়েটাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে, আবার চোখজুড়ে নিজের আপার জন্য চিন্তা, হাহাকার। পার্থিব হাপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
‘ মা, অসুবিধা হচ্ছে? কিছু লাগলে বোলো।’
তানহা বেগম সরল হাসলেন। মাথা নেড়ে জানালেন অসুবিধা হচ্ছেনা।

মাহাথির তাকিয়ে আছে ওটির দিকে। বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখেছে – কথাটা তাকে জিতিয়ে দিয়েছে। তবে এখনো সে নিজের হার-জিতের মাঝামাঝিতে অবস্থিত। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। শরীর মন সব যেন ভেঙে আসছে।
হঠাৎ বাচ্চার চিৎকারে চারপাশ এলোমেলো হয়ে গেলো মাহাথিরের। মাহাথির ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল। সাথে উঠে এলো পার্থিব, শ্রুতি, তানহা সবাই। নার্স বেরোলো হাসিমুখে। কোলজুড়ে নবজাতক একটি শিশু। নার্স উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
‘ মাশ-আল্লাহ! আপনাদের সাড়ে তিন কেজি ওজনের সুস্থ ছেলে সন্তান হয়েছে। বাচ্চাটা তো কাঁদছিলোই না। এরপর ডাক্তার পিঠে চাপড় দিতেই তার কান্না শুরু। এখন থামানো যাচ্ছে না। নিন।’

মাহাথির আগাতে পারল না। নিজের উপর বিশ্বাস হলোনা বিন্দু পরিমাণে, সাথে বিভার বলে যাওয়া কথায় বিভার প্রতি অভিমানের সাথে সাথে নিজের প্রতি বিশ্বাসও হারালো মাহাথির। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে দূরে চলে গেল। পার্থিব অবাক হওয়ারও সময় পেল না। বাচ্চার কান্নায় এগিয়ে গিয়ে সেই কোলে তুলে নিল। ওমনি দু’পাশে এসে দাঁড়ালো তার মা এবং বউ। শ্রুতি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভুলে গেল। তাকিয়েই রইল।
পার্থিবের অবস্থাও কিছুটা নাজেহাল। ভীষণ ভয় লাগছে। কী সুন্দর ফুটফুটে মুখ! সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো। তানহা মাহাথিরের ব্যাপারে গেল না। পার্থিবকে বলল, ‘ পার্থিব! কানে আজান দেও বাবা।’
পার্থিব নিজের বোকামোতে অবাক হলো। আজান না দিয়ে কী করছিল সে! বাচ্চাটাকে বুকের সাথে মিশিয়ে উঁচু করে ধরে আজান দিল পার্থিব। আজান শেষ করেই বাচ্চাটার টলটলে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কী বাবা? চিনতে পারছো? আমি তোমার ছোট আব্বু।’

ঠিক সেই মুহূর্তে সবাই শুনতে পেল নার্সের ব্যগ্র কণ্ঠ, ‘ হ্যালো শুনছেন! আপনাদের পেশেন্টকে এক ঘন্টা পর কেবিনে দেওয়া হবে। আর এই ঔষধগুলো কেউ নিচ থেকে নিয়ে আসুন।’
এমন অপ্রত্যাশিত হঠাৎ কথায় সবাই চমকে উঠলেও, সবার বুক থেকে সরে গেল বিশাল বড় ভারী এক পাথর। মাহাথির দু’সেকেন্ড চুপ করে বুঝতে চেষ্টা করল নার্সের কথা। এরপর দ্রুত এগিয়ে নার্সের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বলল উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি নিয়ে আসছি। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’
যেতে যেতে মাহাথিরের মনে হলো সে জিতে গেছে। হ্যাঁ, মহান আল্লাহ তাকে জিতিয়ে দিয়েছে। ভাবতেই দু’হাতে নিজের মুখ মুছে নিজেকে শান্ত করতে চাইল মাহাথির। বুকে অজানা সুখময় ব্যথা অথচ মুখে হাসি ফুটতে চাইছে। মাহাথির উপরে তাকিয়ে স্বস্তির সাথে চোখ বন্ধ করল। তার ভঙ্গিতে প্রকাশ পেল সৃষ্টিকর্তার প্রতি নীরব কৃতজ্ঞতা।

শ্রুতি বিভার খবর শুনে পার্থিবের দিকে তাকাতেই পার্থিব হাসিমুখে বলল,
‘ কী বলেছিলাম শ্রুতি? বলেছিলাম না, আমাকে বিশ্বাস করুন। আপা ফিরে আসবে। কিন্তু আপনি তো আমাকে বিশ্বাসই করলেন না। বসে বসে চোখের ট্যাংকি খালি করলেন।’ পার্থিবের কণ্ঠে দুষ্টুমি।
শ্রুতি ফিক করে হেসে ফেলল। শ্রুতির হাসিতে তার সব দাঁত বেরিয়ে এলো। শ্রুতি নিজের আনন্দ, খুশি, উত্তেজনা কমাতে তানহা বেগমকে জড়িয়ে ধরল। আবার তাকে রেখে এসে পার্থিবের কোলে থাকা বাবুর কপালে চুমু খেল। এরপর বাবুসহ পুরো পার্থিবকেই পাশ থেকে জড়িয়ে ধরল। শ্রুতির কান্ডে পার্থিব হেসে ফেলল। মনে হলো চারদিকে শুধু খুশি আর খুশি। সে সৃষ্টিকর্তার কাছে দ্বিগুণ খুশি চেয়েছিল, পার্থিবের মনে হলো সৃষ্টিকর্তা শতগুণ খুশি ঢেলে দিয়েছে। চারপাশের আবহ টাতে শুধু শান্তি আর শান্তি।

.
বিভাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। জ্ঞান ফেরার পর সকলের সাথে দেখা করা শেষ। পার্থিব, শ্রুতি, তানহা, হাসিনা, সিদ্দীক সাহেব সকলের সাথেই বিভা টুকটাক কথা বলেছে। সকলের হাসি দেখে বুক জুড়ে বয়ে গেছে আত্মিক তৃপ্তি, প্রশান্তি।
বিভা এখন তাকিয়ে আছে সকলের দিকে। এতো এতো মানুষের ভালোবাসা দেখে বিভার মনে হলো সে ভীষণ মূল্যবান কেউ। আসলেই তো মূল্যবান। তবে সে যেমন মূল্যবান, সামনে মানুষগুলিও তার কাছে মূল্যবান। ভীষণ মূল্যবান। তাইতো মানুষগুলোর দিকে তাকিয়েই সে নিজের ব্যথা ভুলে অন্যরকম একটা শান্তি পাচ্ছে। তবে শান্তির মাত্রা আরেকটু গাঢ় হতো যদি মাহাথিরকে এবং তার সন্তানের দেখা পাওয়া যেত। শুনেছে, মাহাথির নাকি বাচ্চাকে কোলেই নেয়নি। শুনে বিভার ইচ্ছে করল মাহাথিরকে নাক বরাবর দুটো ঘুষি মারতে। বাচ্চাটাও নেই। ডাক্তার নিয়ে গেছে সাধারণ পরীক্ষা করার জন্য।
বিভা নড়তে গেলেই পেটে টান খেল। ব্যথা মুখ কুঁচকে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।

কিছু মূহুর্ত বাদেই বাচ্চার কান্নায় চোখ খুলে ফেলল বিভা। কেবিনে তখন শুধু শ্রুতি, পার্থিব। বিভা তাকিয়ে দেখল নার্স বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঢুকল। সাথে পিছন পিছন এলো এতোক্ষণ যার তৃষ্ণায় বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি। বিভা মাহাথিরকে এক পলক দেখে বাচ্চার কান্নায় বাচ্চার দিকে চাইল। নার্স বাচ্চাকে বিভার পাশে শুইয়ে দিতেই বিভা ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে লাগল নিজের সন্তানকে। ছোট কোনো বাচ্চা খেলনা পেলে যেমন আনন্দ প্রকাশ করে ঠিক সেভাবেই খিলখিল করে হেসে উঠল বিভা। হাসিমুখে একবার মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে, আবার শ্রুতি-পার্থিবের দিকে তাকিয়ে বাচ্চার কপালে চুমু খেল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘ বাবা। আমার বাবা। আমার ছেলে।’
মাহাথির চোখ জুড়িয়ে দেখল তার স্ত্রী-সন্তানের হাসিমুখ। আর সে পরিপূর্ণ। তার জীবন পরিপূর্ণ। বাচ্চাটা কী সুন্দর মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসছে! বিভার হাসির আওয়াজগুলো তার কানে এলো ভীষণ শ্রুতিমধুর হয়ে। তবে বাচ্চাকে এখনো কোলে নেয়নি সে। বাচ্চার দিকে তাকিয়েই মুখটা শুকিয়ে গেল। ভেতরটা ছেয়ে গেল নিদারুণ যন্ত্রণায়।

শ্রুতি, পার্থিব বেরিয়ে গেল। বিভা এখনো বাচ্চার গালের সাথে নিজের গাল মিশিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর পর চুমু খাচ্ছে। দৃষ্টি মাহাথিরের দিকে যেতেই থেমে গেল বিভা। কাতর চোখে চেয়ে রইল। ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বিভা বলল, ‘ এদিকে আসুন, মাহথির। বাবুকে কোলে নিন।’

বিভার এমন কথায় অভিমানে মাথা নিচু করে ফেলল মাহাথির। বিভা নিষ্পাপ, সরল গলায় বলল, ‘ কি হলো! আসুন। আমিতো উঠে বসতে পারছিনা। বসতে পারলে আমি নিজেই আপনার কোলে তুলে দিতাম।’

মাহাথির এগিয়ে এলো। বেডের পাশে নিচু হয়ে দেখতে লাগল নিজের সন্তানকে। বিভা হাসিমুখে বলল, ‘ কোলে নিন মাহথির। আপনার বাচ্চা ও।’
কথাটায় কী প্রকাশ পেল মাহাথির জানেনা। অধিকার, আত্মবিশ্বাস যেন উড়ে উড়ে ভড় করলো তার ওপর। নিজের সন্তানকে তুলে নিল দু’হাতে। বিভাই তুলে দিল। বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই যেন বুকের ভেতর উথাল-পাতাল শুরু হলো। নিজের সন্তানের এমন নির্মল ছোঁয়ার মাহাথিরের ইচ্ছে করল বাচ্চাটাকে জাপটে ধরতে। তবে তা করা যাবেনা। তাইতো আলতো করে বুকের সাথে চেপে ধরল। একবার বাচ্চাটার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মার্বেলের মতো চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তারদিকে। মাহাথির ভীষণ যত্ন নিয়ে নিজের সন্তানকে চুমু খেতেই তার চোখের কোণ বেয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রু। অশ্রুকণা হয়তো পড়ল কিছু ঘন্টা আগে জন্ম নেওয়া নবজাতকের মাথায়। তাইতো আবার গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার শুরু করল। বাচ্চার এমন চিৎকারে সকল ভালোলাগায় ভাঁটা পড়ল। নিজের সন্তানের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল মাহাথির। বিভা হেসে ফেলল মাহাথিরকে দেখে।

.
বাহিরে বসে আছে শ্রুতি। পার্থিব তাকে খাইয়ে বাসায় গেছে একটু। আসবে হামিমকে নিয়ে। এরপর তারা একসাথে চলে যাবে বাসায়। রাতে মাহাথির থাকবে। বিভাকে ছাড়া হবে পাঁচদিন পর।
শ্রুতি তাকিয়ে দেখল মাহাথির বেরিয়ে আসছে। এসে তার পাশেই বসল। শ্রুতি তাকিয়ে রইলে মাহাথির নিজথেকেই বলল,
‘ ডাক্তার বলল ওরা এখন একটু ঘুমাবে।’

শ্রুতি চুপ করে রইল। এরপর নিজেথেকেই সে বলল,
‘ আমি জিতে গেলাম ভাইয়া।’
শ্রুতির কণ্ঠে খুশি উপচে পড়ছে। মাহাথির শ্রুতির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মেয়েটা খুশি নিয়ে তাকিয়ে আছে। শ্রুতি আবারো বলল, ‘ আপাকে ভালোবাসার চ্যালেঞ্জে আমি জিতে গেলাম।’

মাহাথির সরুভাবে হাসল। হেসে মাথা নিচু করল। শ্রুতি ফের বলল, ‘ শুধু জিতিনি। একদম ভালোভাবে জিতে গেছি। আপনি মারাত্মকভাবে ভালোবেসে ফেললেন, আর আমি মারাত্মকভাবে জিতে গেলাম।’

মাহাথির তার পাশের পাজি মেয়েটাকে কী বলবে বুঝতে পারল না। অবশ্য তার মুখ থেকেও সরু হাসি সরছেনা। শ্রুতি বলল,
‘ মাঝে মাঝে হেরে যাওয়া ভালো। কিন্তু আমি সবসময় জিতে যাই। বাবার সাথে জিতেছি, আপনার সাথেও। হাহা…’
শ্রুতির উচ্ছ্বাস থামছেনা। মাহাথিরও এবার ভালোভাবেই হেসে ফেলল।
হাসিনা-সিদ্দীক চলে গেছেন বিভা আর নিজেদের নাতিকে দেখেই। তানহা বেগমকেও পার্থিব নিয়ে গেছে। মাহাথির শ্রুতিকে বলল, ‘ খেয়েছো কিছু? নিয়ে আসি?’
শ্রুতি হাপ ছেড়ে বলল, ‘ পার্থিব খাইয়ে দিয়ে গেছে। এবার অন্তত আপনি কিছু খেয়ে নিন। নয়তো আপার কাছে বলে দিব।’

.
হামিম বাসায় শ্রুতি, পার্থিব কাউকে না পেয়ে জোড়ে জোড়ে কান্না করেছে শুনেই শ্রুতির মনটা হালকা খারাপ হলো। তবে এতো খুশির মাঝে মনটা বেশি খারাপ করতে পারল না। হাসিমুখে হামিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। হামিম বিভার দিকে আসতে বিভা চোখভরে নিজের ভাইকে দেখল। তাই ভাই দাঁড়িয়ে আছে – এতো এতো খুশির মাঝে এই খুশি টাও বিভার মন আরোও ভালো করে দিল। কানে শোনার থেকে চোখে দেখায় এতো ভালোলাগছে কেন? বিভা কিছুক্ষণ নিজের ভাইকে আদর করে টুকটাক কথা বলল। এরপর পার্থিব-শ্রুতি, হামিম সবাই তার কেবিনেই রইল। যাদের অনুপস্থিতি ছিল, তাও পূর্ণ হলো। মাহাথির বাবুকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই শ্রুতি কোলে নিল। বাচ্চাটার সাথে খেলতে লাগল। বাচ্চাকে নিয়ে হামিমের কাছে গেলে হামিম ভীষণ অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ এটাতো মুরগি না। হাতিও না।’

মাহাথির হতাশ হলো। এই ছেলে আবার শুরু করেছে! মাহাথিরের মনে হলো হামিমকে তো স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি। ভর্তি করালে পড়ালেখায় সবসময় ভালো করবে ছেলেটা। সেই কবেকার কোনকথা এখনো ধরে বসে আছে। নিশ্চয়ই পড়ালেখাও ভুলবে না।
মাহাথির তাও খুশি হলো। ব্যাপারটা মুরগিতে আছে, মুরগিতে থাকাই ভালো। ভাগ্য ভালো তাকে এসে জাপটে ধরে বলেনি, হাতির বাচ্চা দাও।

শ্রুতি হামিমের কথা বুঝল না। ঘরে থাকা কেউই বুঝল না। শ্রুতি ভোঁতামুখে বলল,
‘ বাচ্চা মুরগি কেন হবে ভাই? ও তো আপার বাচ্চা। মানুষের বাচ্চা মুরগি হয়?’
হামিমের সাথে যেন শ্রুতিও অবুঝ হয়ে গেল। হামিম শ্রুতির উত্তর দিলনা। গম্ভীরমুখে হেঁটে গিয়ে বসল চেয়ারে। হামিমকেও আর কিছু বলা হলোনা। শ্রুতি বলল, ‘ আচ্ছা ওর নাম কী হবে?’

পার্থিব হতাশ গলায় বলল, ‘ আপনি এতো এতো নাম দেখলেন। অথচ কোনো নামই আপনার পছন্দ হলোনা?’

‘ না হয়নি তো। এখন?’

বিভা হাসিমুখে বলল, ‘ ওর নাম মাহতিম। ভালো না এইটা?’

পার্থিব হাসিমুখে উত্তর দিল, ‘ মাহথির ভাইয়ার ছেলে মাহতিম। ওয়াও! গ্রেট!’

শ্রুতিও খুশি হলো। নিজের কোলে থাকা বাচ্চাটার গাল আঙুল দিয়ে নাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ কী মাহতিম বাবা! পৃথিবীতে এসে কেমন লাগছে? আমার আব্বুটা।’ বলেই দু’গালে সময় নিয়ে চুমু খেল শ্রুতি। ঠিক তখনি কান্নার আওয়াজে মুখ তুলে ফেলল শ্রুতি। একি! বাচ্চাটা তো কাঁদছে না! তাহলে কাঁদছে কে? তখনি পেছনে ঘুরে দেখল হামিম নিজের পা দিয়ে মেঝেতে বাড়ি দিচ্ছে আর কাঁদছে। সবাই ভীষণ অবাক হলো। বিভা উতলা কণ্ঠে বলল,
‘ হামিম। এদিকে আসো। কী হয়েছে? কাঁদছো কেন ভাই?’

হামিম সত্যি সত্যি উঠে এলো। তবে বিভার কাছে না গিয়ে মাহাথিরের কোমড় জড়িয়ে বলল, ‘ একটা নড়চড় হাতি এনে দাও আমার পেটে। প্লিজ। দেও।’
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল। মাহাথির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল নিজের শালার দিকে। এইটাই হয়তো বাকি ছিল! বিভা হামিমকে ডাকল,
‘ হামিম। এদিকে আসো। আমাকে বলো। আমি এনে দেব। আর তোমার হাতি লাগবে কেন?’

হামিম বেডের পাশে এসে বেডের সাইডে থাকা শক্ত অংশ আঁকড়ে ধরল। গড়গড় করে বলল, ‘ একদিন বড় ভাইয়া এসে আমাকে বলল সে নাকি বাবা হবে আর আমি মামা। এরপর বলল আমি খুশি কিনা। তারপর….তারপর বলল বাবুটা সে তোমার পেটে দিয়েছে। তাই বাবুটা তার। আর বলল তোমার পেটে মুরগি হবে যে তোমার পিছে পিছে হাঁটবে। আর বলল.. আর আর এগুলা বলল।’
বিভা হতভম্ব হয়ে নিজের ভাইয়ের কথা শুনল। একবার মাহাথিরের দিকে তাকাতে গিয়েই চোখে পড়ল শ্রুতি তার বাচ্চাকে পার্থিবের কোলে দিয়ে নিজে চেয়ারে বসে হাসছে।
বিভাকে আরেকটু হতভম্ব করতে হামিম বলতে শুরু করল, ‘ ভাইয়া তোমার পেটে মানুষের বাচ্চা দিলে আমার পেটে হাতির বাচ্চা তো দিতে পারে। আমার একটা নড়চড় করা হাতি লাগবে। কেন দিচ্ছেনা?’ বলেই মুখ ভেঙে কেঁদে ফেলল হামিম। মাহাথির হতাশার শ্বাস ফেলল। এখন সে একদম নিশ্চিত, যে এই ছেলে ক্লাসে টপ করবে। অবশ্যই করবে। ক্লাসের বাকি ছেলেদের কথা ভেবে দুঃখী হলো মাহাথির।

বিভা চোখ বন্ধ করল। তার নিজেরও ভীষণ হাসি পাচ্ছে। শ্রুতি তো খুটখুট করে হেসেই যাচ্ছে। হাসি থামিয়ে কোনোমতে বলল,
‘ একারণে তুই এতো হাতির বাচ্চা হাতির বাচ্চা করিস?’ বলে আরেকদফা হাসা শুরু করল সে।
হামিম মুখ গোমড়া করে মাহাথিরের হাত টেনে বলল, ‘ দিবেনা হাতির বাচ্চা? তুমি তো আমাকে এতোকিছু দেও। একটা হাতিও দেও। আমার হাতির নাক অনেক ভালো লাগে। নাক ধরে হাতিকে ঘুরাব আমি। তাইতো চাইছি।’
শ্রুতি এবার শব্দ করে হেসে দিল। হামিমকে কাছে ডেকে বলল, ‘ শুধু বড় ভাইয়ার কাছে চাচ্ছো কেন? ছোট ভাইয়ার কাছেও চাও। বড় ভাইয়া নাহয় হাতি দিবে, সে নাহয়…’
‘ কাঠবিড়ালি দিবে?’ উৎসুক হয়ে বলল হামিম।
শ্রুতি হাসতে হাসতে বলল, ‘ দিতেও পারে।’

হামিম এবার পার্থিবের কোমড় জাপটে ধরল। পার্থিব হতবাক হয়ে চেয়ে রইল শ্রুতির দিকে। তাকে ফাঁসানোর কোন দরকারটা ছিল? হামিম বলল,
‘ একটা কাঠবিড়ালি দিবে ভাইয়া?’
‘ হাতিই তো বেস্ট ছিল হামিম। কাঠবিড়ালি কেন চাই?’
‘ চাই। আমি কাঠবিড়ালিকে জিগ্যেস করব যে – কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও? গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? – তাই লাগবে।’ মাঝে আবৃত্তির মতো করে বলল হামিম।
হতাশের ওপর আরেকধাপ হতাশ হলো পার্থিব। কাজী নজরুল ইসলামের কী খুব দরকার ছিল কবিতাটা তৈরি করার? নয়তো এ যাত্রায় বেঁচে যেত সে।
মাহাথির, পার্থিবের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেই লাগল দু’জন। অন্যদিকে বিভা, শ্রুতি হেসেই যাচ্ছে। শ্রুতি নিজের পেট চেপে আছে। আর হাসি সম্ভব নয়। তবুও থামছেনা। গাল-চাপা ব্যথা হয়ে এলো।
মাহাথির ভ্রু কুঁচকে হামিমের দিকে তাকিয়ে আছে, পার্থিব ভ্রু কুঁচকে অসহায়মুখে তাকিয়ে আছে। তাদের বিপরীতে হামিমের নিষ্পাপ সরল মুখ। মাহাথির মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, ইহজনমে সে আর কোনোদিন অতিরিক্ত কথা বলবেনা। এমনিতে তো তার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, ওইদিন কেন বেরিয়েছিল?
_______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২৩০৫
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান