একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৮+৯

0
150

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৮.
শ্রুতি আসার পর থেকেই লক্ষ্য করেছে এই বাড়ির বড় মেয়ে জামাইয়ের থেকে ছোট মেয়ে জামাই এর কদর বেশি৷ ব্যাপারটা হজম করার মতো নয়৷ তাই সে তার দাদি আম্মুর ঘরে বসে আছে রহস্য উন্মোচনের আশায়৷ দাদি সেই কখন ছাদে গেছে হাঁটতে৷ এখনো এলো না! একটু পরেই তো সবাই খেয়ে রওনা হবে, তখন জিজ্ঞেস করব কীভাবে?

আমিনা রুমে ঢুকেই শ্রুতিকে দেখে হালকা চমকালেন৷ ছোট শ্রুতি কতো বড় হয়ে গেছে! এই তো তার সামনেই ফিরোজা রঙের জামদানি পরে বসে আছে মেয়েটা৷

‘আইজ এতো বিহানায় আমার ঘরে?’

‘দরকার ছিল দাদিআম্মু।’

‘কী কইবি?’ বলতে বলতে বিছানায় বসলেন৷ শ্রুতি নড়েচড়ে বসল খানিকটা৷

‘দাদিআম্মু যা জিজ্ঞেস করব সত্যি সত্যি বলবে। আচ্ছা আপার স্বামী মানে আসলে তার নাম জানি না তাই এভাবে বলছি। তাকে কী বাবা নিজে পছন্দ করে ঠিক করেনি?’

দাদি অবাক হলেন না৷ শ্রুতির কাছে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন তা তিনি জানতেন৷ শ্রুতি যে খুব বিচক্ষণ মস্তিষ্কের তা নয়৷ সে শুধুমাত্র তার বাবার ক্ষেত্রেই বিচক্ষণ৷ তার বাবার প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি সে খেয়াল করে৷ তাই এর ব্যাপারটাও যে খেয়াল করবে তা তিনি জানতেন৷

‘কি হলো দাদিআম্মু?’

‘নাহ রে বু। পছন্দ কইরা আনে নাই৷’

‘এর মানে? আমি যতোদূর জানি বাবা টাকা দেখেই বিয়ে দিয়েছে৷ নিজের লাভ যেখানে আছে সেখানেই তো বাবা থাকে৷’

‘এইডা তর ক্ষেত্রে হইছে৷ আর বউ আর হাসিনা ভালো বন্ধু আছাল৷ হাসিনা হইলো নাত জামাইর মা৷ ওইখান থিকাই বউ ঠিক কইরা রাখছিল হাসিনার পোলার সাথে বিভাডার বিয়া দিব৷’

‘আম্মু ঠিক করে রেখে গেল আপার বিয়ের কার সাথে হবে। আর তার সাথেই বাবা আপার বিয়ে দিল! এতোটা ভালো তো আমার বাবা নয়৷ তাহলে?’

‘যতোদূর বুজছি আমি, তোর লিগা নাত জামাইরে যখন পাইসে তখন তোগো বিয়া দিতে চাইসে৷ কিন্তু বড়ডারে বিয়া না দিয়া তো আর ছোডোডারে দেওন যায় না। বিভার বয়স ২৪ চলতাসে৷ তর ২১ ৷ মাইনষ্যে কী কইব? তার উপর তর বাপের পিয়ারী বউ আবার কানে বিষ ঢালসে। কইসে, বড়ডারে আগে ভাগাইতে৷ নয়তো পরে নিব কেরা? ঘরে বসাই বসাই খাওয়ান লাগব৷ তাই হের কথা হুইনা তর বাপে তর মায়ের পছন্দ অনুযায়ী-ই বিয়া দিসে৷ এর মাঝেই আবার হাসিনায় তার পোলার লিগা প্রেস্তাব নিয়া আইছে৷ তাই যারে পাইসে হের গলায়ই ঝুলাই দিসে৷’

আমিনা নিজ গরজে বললেন, ‘তয় আমি খুশি হইসি৷ বউয়ের ইচ্ছাডা পূরণ হইছে৷ নাত জামাইরে মনে হয় সাধারণ চাকরি৷ কিন্তু শুনসি পোলাডা ভালো৷ তাইলেই হইসে৷ তরা ভালো থাকলেই আমার সুখ।’

শ্রুতি হাসল। দাদি তাকিয়ে রইল৷ শ্রুতির হাসিতে কিছু একটা প্রকাশ পেল৷ কী সেটা? রাগ নাকি তাচ্ছিল্যতা? সাধারণ কোনো মানুষ দেখলে বলবে রাগ৷ কিন্তু দাদীর কেন যেন মনে হলো শ্রুতি কাঁদতে চাইছে তবে পারছে না৷

.
আমিন শিকদারের মাথা লজ্জায় কাটা যাচ্ছে৷ তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে দুই মেয়েসহ মেয়ে জামাই৷ দুই মেয়ে জামাইয়ের হাতেই ছেঁড়া পাঞ্জাবি৷

‘বাবা! এটা কী করেছ তুমি? শেষ পর্যন্ত মেয়ে জামাইদের জন্য ছেঁড়া পাঞ্জাবি এনেছ! ছিহহহহ! লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ওই বাড়ি গিয়ে কী বলব আমি? আমিন শিকদার তার মেয়েদের ছেঁড়া পাঞ্জাবি দিয়ে পাঠিয়েছে? এতে আমার সম্মান কোথায় যাবে ভাবতে পারছো তুমি?’
দুঃখের সাথে বাবার প্রতি রাগ মিশিয়ে কথাগুলো বলল শ্রুতি৷
আমিন সাহেব নিশ্চল, কান্ডজ্ঞানহীন! সে নিজে গিয়ে দুই জামাইয়ের জন্যে ভালো নামকরা পাঞ্জাবির দোকান থেকে দুটো পাঞ্জাবি কিনে এনেছেন৷ মাহাবের জন্যে অতো দামী জিনিস কিনতে না চাইলেও কিনেছেন৷ ভেবেছেন দামী পাঞ্জাবি দিয়ে কিছুটা অপমান করবেন৷ অথচ একি! সে নিজেই তো অপমানিত হচ্ছে৷ পাঞ্জাবি দু’টো তে মাঝ বরাবর দূ’টো বড় বড় ফোঁটা করে ছেঁড়া। বুঝাই যাচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে আঁকাবাঁকা বিশ্রীভাবে ছিঁড়েছে। আর সেটা যে তার গুণধর মেয়ে করেছে তাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার৷

শাহিনা এগিয়ে এল৷ রাগ তুঙ্গে তুলে বলল, ‘শ্রুতি! এইসব কোন ধরনের কথা? তোমার বাবা কেন ইচ্ছে করে ছেঁড়া পাঞ্জাবি আনবেন?’

‘হয়তো উনার টাকা নেই ভালো পাঞ্জাবি কেনার তাই৷’ সরল তবে ব্যঙ্গাত্মক ভাবে উত্তর দিল শ্রুতি।

‘উল্টোপাল্টা কথা বলবেনা শ্রুতি।’

‘যা সত্যি তা তো আমি বলবই মা…য়া।’

মাহাথির স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সব পর্যবেক্ষণ করছে৷ নাটকটা সুন্দরই হচ্ছে৷ নাটক দেখতে তার ভালো লাগে৷ আর সেটা যদি হয় বাস্তব, তাহলে তো কথাই নেই৷
আমিন সাহেব এগিয়ে এলেন৷ নতজানু হয়ে বললেন, ‘বিশ্বাস করো আমি তোমাদের জন্য ভালো মানের পাঞ্জাবি এনেছিলাম৷ কিন্তু কীভাবে কী যে হলো!’

পার্থিব স্বান্তনামূলক কথা বলল আমিন শিকদারকে৷ শ্রুতির পছন্দ হলো না৷ তবে দুই মেয়ে জামাইয়ের সামনে যে অপদস্ত হলো এতেই সে বেজায় খুশি!
বিভা সব বুঝতে পারছে৷ অথচ কিছু বলছে না৷ মাঝেমধ্যে মনে হয় শ্রুতি যা করে তা ভুল, আবার মাঝেমধ্যে মনে হয় ও যা করে তা ১০০% ঠিক; এমনটাই হওয়া উচিত৷ তবে এখন কী মনে হচ্ছে তা বিভা বুঝতে পারল না৷ আমিন সাহেব আবার কেনাকাটার জন্য বাহিরে বেরুতে নিলে পার্থিব আটকালো৷ শ্রুতি খুশিমনে চলে গেল হামিমের সাথে শেষবারের মতো দেখা করতে৷

.
‘আপনি পাঞ্জাবি দু’টো কেন ছিঁড়েছেন শ্রুতি?’

হটাৎ এমন কথায় ভারি চমকাল শ্রুতি! কিছু সময়ের জন্য বোধজ্ঞানহীন হলো সে৷ তারই প্রমাণ দিতে আমতা আমতা করে বলল, ‘কী যা তা বলছেন! আমি কেন ছিঁড়ব?’
পার্থিব হাসলো। শীতল, ভরাট কন্ঠে বলল, ‘শ্রুতি! আমি ঠান্ডা মস্তিষ্কের শান্তিপ্রিয় মানুষ৷ এরমানে কী এই দাঁড়ায় যে আমি বোকা?’
এরকম প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে কী উত্তর দেওয়া যায় শ্রুতি ভেবে পেল না৷ নিজেকে সামনের মানুষটার কাছে ভীষণ ছোট ও বোকা মনে হতে লাগলো। তবুও নিজের কন্ঠের ঠাঁট বজায় রেখে বলল,

‘ছিঁড়েছি বেশ করেছি।’

‘কেন ছিঁড়লেন?’

‘আপনি আমিন শিকদারের কোনো জিনিস নেবেন না৷’

‘আমি তো তার মেয়ে নিয়েছি৷’

শ্রুতি তাকালো পার্থিবের দিকে৷ বিড়বিড় করল, ‘যেভাবে এসেছি সেভাবেই ফেরতও চলে যাব৷’

‘কী বললেন? খেয়াল করিনি৷’

‘কিছুনা। আসলে আমি চাই না আপনি ওই বাড়ির কোনো জিনিস নিন৷’

‘তা না হয় মানা গেল৷ কিন্তু তাহলে মাহাব ভাইয়ার জিনিস কেন ছিঁড়লেন?’

শ্রুতির রাগ হলো৷ বড্ড কথা বলে লোকটা৷ বিরক্তমাখা কন্ঠে বলল, ‘বড্ড বেশি কথা বলেন৷ আমাকে কী মারার প্ল্যান করছেন? কালো বউ বলে পছন্দ হচ্ছে না? গাড়ির নিচে ফেলে বুঝি মারতে চান? সেকারণেই বুঝি বকরবকর করে গাড়ি চালাচ্ছেন?’

পার্থিবের খারাপ লাগলো। খারাপ লাগলো বলতে রাগ হলো৷ মেয়েটা সবসময় এমন কথা বলে৷ কিন্তু কেন বলে? সে কী বলেছে তার বউ কালো কিংবা শ্যামলা বলে তার সমস্যা? বলেনি তো৷ তাহলে? মেয়েটার এমন কথা শুনলে তার নিজেকে ছোট লাগে৷ মনে হয় সে তার স্ত্রীকে ভালোবাসতে পারছে না৷ তবুও বলে৷ কই তার কাছে তো শ্রুতিকে ভীষণ সুন্দর এবং মিষ্টি লাগে৷ পার্থিব ঠিক করলো যে আর একবার কোনোদিন যদি শ্রুতি এমন কথা বলে তাহলে দুই গালে কষে ৩ টা করে থাপ্পড় লাগাবে৷ তাহলে যদি তার বউকে ছাগল থেকে মানুষ বানানো যায়।

.
শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরেই অফিস যাওয়ার ভূত চেপেছে বিভার গুণধর স্বামীর৷ তাই তো বিভা তোড়জোড় করে রান্না করছে৷ তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি চলে গেছেন যেদিন সে নিজের বাড়িতে গেল৷ বাড়িতে নাকি কী কাজ আছে৷ তাই বলে এতো তাড়াহুড়ো! মানুষ দু’টোর সাথে পরিচিত হওয়াই হলো না৷ দু’টো পরোটা, ডিম বাজি আর আলু ভাজি নিয়ে বিভা চললো স্বামীর ঘরের দিকে৷

মাহাথির শার্টের হাতা ঠিক করছে৷ লোকটাকে দেখতে বিভার ভালো লাগে৷ ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে। নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে৷ বলতে, জানেন আমার প্রিয়জনের তালিকা সীমিত। আপনি হবেন আমার প্রিয়জন? এমন লাগামহীন চিন্তায় বিভা নিজেকেই অসভ্য বলে গালি দিল। বিভা ডাকল,
‘মাহাথির!’
প্রশ্নের কোনো প্রকার উত্তর না দিয়েই অন্য প্রসঙ্গে উল্টো আদেশ করে বসলো মাহাথির৷ খানিকটা চড়া গলায় বলল,
‘তুমি আর আমাকে মাহাথির বলে ডাকবে না৷’
বিভা কিছু বলল না৷ প্লেট টা টেবিলে রেখে বলল,
‘জলদি জলদি খেয়ে নিন মাহাথির৷ লেট হয়ে যাচ্ছে তো৷’

মাহাথিরের মনে হলো বিভা তার আদেশ অমান্য তো করলোই সাথে ঠ্যাটার মতো আবারো সেই কাজ করে মাহাথিরকে ছোট করল।
মাহাথিরের সহজেই যে কারোর উপর রেগে যেতে পারে। ঠিক যেমন এখন হলো৷ মেয়েটার উপর প্রচন্ড রাগ তার মাথায় এক্কেবারে লাফ মেরে উঠে গেল৷ বেয়াদব একটা মেয়ে! নেহাৎ-ই অফিসে লেট হচ্ছে বলে, নয়তো এই মেয়েকে সোজা করতে দুই সেকেন্ডও লাগত না৷ মাহাথির নিজের রাগকে প্রকাশ করতে এবং প্রাধান্য দিতে বিভার বানানো খাবার না খেয়েই চলে গেল৷ বিভা খাবারগুলোর দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো৷
_______
চলবে~
#শারমিন_ইরান
#একগুচ্ছ_শুকতারা
শব্দসংখ্যা – ১২০৯

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৯.
রাত আটটা। মাহাথির এখনো ফিরেনি৷ বিভা বসে আছে মাহাথির এর অপেক্ষায়৷ আজকে সে ঠিক করেছে মাহাথিরের সাথে কথা বলবে৷ তাকে অপছন্দ করার কারণ জিজ্ঞেস করবে। কালো হওয়ার জন্য অপছন্দ করে এটা বিভার মন মানে না৷ বিভার কেন যেন মনে হয় মাহাথির এর মনে অনেক দুঃখ। সেই দুঃখ জানার চেষ্টা করবে৷ মাহাথিরের প্রতি কীসের এতো টান তার?
মাহাথির কী আহামরি সুন্দর? না তো৷ তবে হ্যাঁ মুখের গড়ন টা বেশ। আসলে বেশ বলা যায় না৷ মাহাথির এর মুখের গড়ন সুন্দর নাকি শুধুমাত্র তার কাছেই সুন্দর লাগে তা বিভা জানে না৷ মাহাথিরকে যতোবারই বিভা দেখে মনে মনে বলে, ‘মাশ-আল্লাহ।’
বিভা কী মাহাথিরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ? না তো। বিভা তো মাহাথিরের মায়ায় পড়ে গেছে। মাহাথির অবশ্য মায়ায় পড়ার মতো কিছু করেনি৷ তবুও বিভার মায়া লাগে৷ ভীষণ মায়া লাগে৷ লোকটা তো রাগী৷ সেই রাগের মাঝেও বিভা মায়া খুঁজে পায়৷ তার বলতে ইচ্ছে করে, ‘আহারে! লোকটা কতো রাগী!’

কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খুলল বিভা৷ ঘরে ঢুকল মাহাথির৷ মুখে ক্লান্তির রেশ৷ সামনের কাঠের সোফায় বসে পড়ল৷ বিভা জলদি করে ফ্রিজ থেকে শরবত বের করে দিল৷ মাহাথির উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে গ্লাসে ঢেলে নিল৷ এরপর সোফায় বসে ধীরে ধীরে চুমুক দিল৷ বিভার অপমানিত বোধ হওয়ার কথা। হলো না৷ বরঞ্চ উলটে মায়া হলো৷ মনে হলো, লোকটা অযথাই রাগ করে৷ একটু রাগ না করলে কী হয়? শরবত টা খেলে তো তারই ভালো লাগতো৷ খেল না৷ খারাপ লোক…..
বিভা সামনের সোফায় বসে ঢকঢক করে পুরো শরবত টা খেয়ে নিল৷ এমন একটা কান্ড করে বিভা নিজেই কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়ল৷ মাহাথির ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল৷ এতোদিন জানতো মেয়েটা হাবাগোবা৷ আজ জানল মেয়েটা গরুগাধা৷ বাসায় ফিরেও শান্তি নেই৷

হাত মুখ ধুয়ে গামছায় মুখ মুচছে মাহাথির৷ সামনে তাকিয়ে দেখল একটা বাটিতে মোগলাই রাখা আছে৷ পাশেই পানির গ্লাস৷ কে বানিয়েছে? ওই মেয়েটা? ভাবলো খাবে না৷ কিন্তু এরপরই তার মনে পড়লো, তার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে৷ যদিও দুপুরে ক্যান্টিন থেকে পেটপুরে খেয়েছে৷
মাহাথির বসে বসে খেতে লাগলো।

‘মাহাথির, আপনি চা খাবেন নাকি কফি খাবেন?’
মাহাথির তাকালো। বিভা দাঁড়িয়ে৷ আজ পড়েছে খয়েরী রঙের একটা কামিজ৷ চুলগুলো বেসামাল ভাবে খোলা৷ সুন্দর লাগছে দেখতে৷ আচ্ছা, বিভা কী আজ চুলে শ্যাম্পু করেছে? এজন্যই কী এতো সুন্দর লাগছে তার চুল এবং তাকে?
এতোক্ষণের ভাবনাকে নিমিষেই পালটে ফেললো মাহাথির৷ ভরাট কন্ঠে বলল, ‘তোমার জন্য আমার নাম মাহাব।’

বিভার মুখটা ছোট হলো৷ বুঝা গেল মন খারাপ হয়েছে। মাহাথিরের মাঝে ভাবান্তর হলো না৷ নিজের মতো করে বলল,

‘মাহাথির শুধুমাত্র আমার কাছের মানুষদের জন্যে৷ আর কাছের মানুষের তালিকায় তুমি পড়ো না৷ সুতরাং, মাহাব বললে খুশি হতাম৷ কিছু না বললে আরোও বেশি খুশি হতাম৷’

বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে৷ কোথায় গেল? ছাদে?

.
শ্রুতি বসে আছে খাটের মাঝখানে৷ হাটুর ওপর মুখ রেখে ভাবছে সে৷ আজ দুপুরবেলা সে খেতে চাচ্ছিল না৷ ইচ্ছে করছিল না৷ রুমে এসে ঘুমিয়ে ছিল৷ প্রভা-প্রত্যাশা এসে অনেকবার ডেকে গেছে৷ সে উঠেনি৷ এরপর এলো তানহা৷ এসে আদুরে হাত মাথায় বুলিয়ে ডাকল শ্রুতিকে৷ মন খারাপের কথা জিজ্ঞেস করলো৷ শ্রুতি অবাক হলো৷ মহিলাটা এমন কেন? এতো মমতাময়ী কেন তিনি! শ্রুতি আশ্চর্য হয়ে নিজের প্রতি নিজের শ্বাশুড়ির ভালোবাসা দেখল৷ তানহা শ্রুতিকে খাইয়ে দিয়ে তবেই গেলেন রুম থেকে৷ শ্রুতি লক্ষ্য করল, মহিলাটি শুধুমাত্র মমতাময়ী নয়, তিনি ভীষণ সরল, দয়ালু, উদার মনের৷ শ্রুতি নিজের মায়ের সাথে মিল খুঁজল৷ পেল না৷ তার মা দুষ্টু প্রকৃতির ছিল৷ কথা তূলনামূলক বেশি বলতো৷ চিৎকার চেঁচামেচিও করতো৷ তবে হ্যাঁ একটা বিষয়ে মিল আছে, দু’জনই মমতাময়ী, স্নেহময়ী। শ্রুতির হটাৎ আজব একটা ইচ্ছে হলো৷ ইচ্ছে হলো রাস্তায় গিয়ে জনে জনে মানুষ ডেকে বলতে, ‘শুনুন! আমার দুইটা মা আছে। আমার দুইটা মা-ই মমতাময়ী। তাদের চোখ ভরা শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা।’

পার্থিব রুমে ঢুকেই দেখল তার রাগী রাণী এক দৃষ্টিতে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে৷ পার্থিব হাসলো৷ তার বউটা বড্ড বেসামাল৷ শ্রুতিকে আজব লাগছে৷ কারণটা বুঝা যাচ্ছে না৷ হটাৎ পার্থিব লক্ষ্য করলো, শ্রুতি চুলে তেল লাগিয়েছে৷ তেল লাগিয়ে দুই বেনী পাকিয়ে বসে আছে খাটে৷ মেয়েটাকে বাচ্চা লাগছে৷ তার চেয়েও বেশি লাগছে নিষ্পাপ। আচ্ছা কী নিয়ে চিন্তিত এতো সে? সেকেন্ডের ব্যবধানেই পার্থিব তার বউয়ের আরেকটা নাম রাখল, ‘চিন্তার রাণী।’

‘আমার সাম্রাজ্য নিয়ে বুঝি চিন্তা করছেন?’

‘মানে?’

‘সেকি! আপনি না আমার রাণী৷ তাই তো আপনার চিন্তার কারণ জিজ্ঞেস করছি৷ নিশ্চিত আমার সাম্রাজ্য নিয়েই চিন্তা করছেন৷ করুন করুন। চিন্তা করুন৷ রাণীদের চিন্তা করতে হয়৷ নয়তো সাম্রাজ্য লাটে উঠবে৷ তবে হ্যাঁ, বেশি চিন্তাও আবার করবেন না। কারণ আপনার রাজা আপনার পাশেই আছে৷’

বলেই মুচকি হাসল পার্থিব৷ শ্রুতি পার্থিবের দিকেই তাকিয়ে রইল৷ লোকটা এমন পাগল কেন? আবোল-তাবোল কী বললো কী ছাতার মাথা? শ্রুতির বিরক্তি আকাশসম৷ সামনের মানুষটিকে এই মূহুর্তে কোনো কড়া কথা শুনাবার ইচ্ছে নেই৷ তাই চুপ থাকাই শ্রেয়৷
পার্থিব তাকিয়ে আছে শ্রুতির দিকে৷ মেয়েটাকে তার ভীষণ ভালো লাগে৷ ভীষণ!

‘শ্রুতি শুনুন, আপনাকে না আমার বউ বউ লাগে৷ আপনাকে দেখলেই মনে হয় যেন আপনার মুখে লেখা ‘পার্থিবের বউ’। আপনার দিকে চেয়ে আলাদা শান্তি পাই আমি৷’

শ্রুতি বিরক্তিতে শব্দ করল৷ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আপনি একটা পাগল তা কী জানেন? আরে বাবা! আমাকে বউ বউ লাগবে কেন? আমি তো আপনার বউ’ই তাই না?’
কথাটায় কী ছিল জানা নেই৷ অথচ পার্থিবের সারা শরীরে যেন শিরশিরে অনুভূতি হলো৷ তার ভীষণ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগল৷ আচ্ছন্ন কন্ঠে সে বলল,’হ্যাঁ৷ আমার বউ৷ আপনি আমারই বউ।’
শ্রুতি তাকিয়ে রইল সামনের মানুষটির দিকে৷

.
‘সকাল বেলাতেও খেলেন না৷ এখনও কী খাবেন না?’

মাহাথির জানে পেছনে বিভা দাঁড়িয়ে৷ ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হলো না৷ তার দিকে পিঠ ঠেকিয়েই দাঁড়িয়ে রইল মাহাথির৷ সকাল বেলা সে খায়নি কথাটা ভুল৷ সে তো খেয়েছে৷ অফিস যাওয়ার পথেই খেয়ে নিয়েছে৷

‘কী হলো?’

‘তুমি আমাকে এতো বিরক্ত করো কেনো বলো তো? বাসায় থাকলেও মাহাথির মাহাথির বলে বলে কানের পোকা খাও৷ এখন একটু ছাদে এলাম৷ এখানেও দেখছি রেহাই নেই৷ কোথায় যাব আমি? বুঝতে পারো না যে তোমার উপস্থিতি আমি পছন্দ করিনা? আর কতো এভোয়েড করলে বুঝবে?’

‘আপনার কী গার্লফ্রেন্ড আছে?’
মাহাথির ঘুরে দাঁড়ালো। তার কথার পিঠে এমন প্রশ্ন আসা করেনি সে৷

‘তা দিয়ে তোমার কাজ?’

‘আমার কোনো কাজ নেই৷ শুধুমাত্র আপনার আমাকে অপছন্দ করার কারণ জানতে চাইছি৷’ বিভাকে যদিও বলা হয়েছে সে কালো তাই মাহাথির তাকে পছন্দ করে না৷ তবুও সে শুনতে চাইছে। যদি এই কয়েকদিনে মত পালটে, তাই৷

বিভার গলায় অধিকার প্রকাশ পেল যা মাহাথিরের পছন্দ হলো না৷ একদমই না৷ মাহাথিরের ইচ্ছে হলো কড়া কিছু কথা বিভাকে শুনিয়ে দিতে৷ মেয়েটা বারবার একই প্রশ্ন করে৷ এর আগেও করেছে৷ সে সত্য উত্তর দিয়েছে৷ আজ আবারো করছে৷ আজকেও সে সত্য উত্তরই দিবে৷ সে আবার বিভার দিকে পিঠ তাক করে সামনে ঘুরলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কালো মানুষদের ঘৃণা করি৷ কতোবার বলব? আজ প্রথম এবং শেষ বার বলছি, কালো মানুষ আমি সহ্য করতে পারি না৷ শেষবার বললাম, আর কখনো বলব না।’

বিভা স্তব্ধ হয়ে মাহাথিরের কথা শুনলো৷ মাহাথির বিভার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে আমি অনেক কারণেই অপছন্দ করি৷ এরমধ্যে অন্যতম কারণ হলো তুমি কালো। রাত হয়েছে অনেক। চলো খাবে চলো৷ সকালে খেয়েছিলে? নাকি নিজেকে সতী-সাবিত্রী প্রমাণ করতে কিংবা আমার প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ দিতে না খেয়ে ছিলে?’
মাহাথিরের চোখে নিবদ্ধ চোখজোড়া নিচে নেমে গেল৷ মাহাথির কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিভার নতমুখের দিকে। বিভাকে কথাগুলো বলে তার শান্তি লাগছে৷ মনের ভিতর কথা জমিয়ে রাখতে নেই৷ তা জমে জমে বিষের পাহাড়ে পরিণত হয়৷ এই যে সামনের মেয়েটার নতজানু মুখ তাকে বড্ড প্রশান্তি দিচ্ছে। পৈশাচিক প্রশান্তি। মেয়েটা তার পিছে পিছে ঘুরে অথচ সে পাত্তাই দেয়না, এর থেকে সুন্দর জিনিস আর কী হতে পারে?

বিভা জড় বস্তুর মতো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে৷ অবাক লাগছে নিজের কাজে৷ সে তো কারোর সাথে তেমন কথা বলে না৷ তাহলে মাহাথিরের প্রতি এতোটা ব্যাকুল কী করে হয়ে গেল? সে কী তবে ভালোবেসে ফেলল?
কল্পনায় কিছুক্ষণ আগে গিয়ে বারবার মাহাথিরের বলা কথাগুলো কল্পনা করল বিভা৷ অপমানিত বোধ হচ্ছে৷ নিজেকে ছোট লাগছে নিজের কাছে৷ সে কালো। এটা কী তার দোষ?
ছোটবেলায় শ্রুতি ভীষণ মন খারাপ করতো তার কালো হওয়া নিয়ে৷ এমনকি এখনো করে৷ নিজেকে ছোট করে সে কালো বলে৷ নিজেকে নিচু চোখে দেখে। অথচ বিভা! সে কখনো নিজের গায়ের রঙ নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল না৷ বরং সর্বদা সে শুকরিয়া আদায় করতো নিজের গড়ন নিয়ে৷ আজ প্রথমবার তার খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে, সে ফর্সা হলেও পারত!
বিভা হাসলো৷ কি বাচ্চাদের মতো চিন্তা করছে সে? উনি নাহয় উনার অপছন্দের একটি দিক বলেছে। তাই বলে মন খারাপ করতে হবে? যা সত্যি তা বলবে না? অবশ্যই বলবে৷ সে কালো তাই তাকে কালো বলেছে৷ এতে কষ্ট পাওয়ার কী আছে? লোকটা বড্ড খাপছাড়া। কখন রেগে থাকে, কখন খুশি থাকে বোঝাই যায় না৷ কিছুক্ষণ রেগে রেগে কথা বলল আবার কি সুন্দর যাওয়ার আগে তাকে খেতে যেতে বলল। বিভা তো ভেবেছিল সকালের মতো রাতেও রাগ করে খাবে না৷ একি! চোখ থেকে কী গড়িয়ে পড়ছে? অশ্রু?

________
চলবে~
#শারমিন_ইরান
#একগুচ্ছ_শুকতারা
শব্দসংখ্যা – ১২০২