#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)
পর্ব→৪ [🚫কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ🚫]
—“কি খবর তোমার! কাল থেকে একবারও ফোন করোনি আমায়। ”
ফোন ধরে এমন কথা শুনতেই আনায়ার কপালে পড়া ভাজ গুলো নিমিষেই গায়েব হলো গেলো। কিছুটা নিরাশ কন্ঠেই আশপাশ তাকিয়ে ইমন সহ প্রত্যেকের কাজ কর্ম দেখতে লাগলো। এরপর ইনোসেন্ট মুখ করতেই গালের টোল গুলো ভেসে উঠলো৷এরপর আনায়া বলতে লাগলো,
—“কি আর বলবো রেহান! দু’দিন ধরে আমার সাথে সবকিছুই কেন যেন উল্টো পাল্টা হচ্ছে। ”
সূদুর আমেরিকা থেকে রেহান চিন্তিত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
—“কেনো কি হয়েছে! শ্বশুর মশাই আবারও অসুস্থ হয়নি তো! ”
—“না!না! তেমন কিছু না। আর আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি তাই আমার বাবাকে শ্বশুর মশাই, শ্বশুর মশাই বলে ডাকা বাদ দেও। ”
রেহান হেসে বললো,
—“আরে এইজন্যই তো প্র্যাকটিস করছি, যাতে বিয়ের পর আর কোনো ভুল না হয়। আচ্ছা এসব বাদ দেও, কি হয়েছে সেটা বলো। ইমনকে তোমার জবের ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম, ও তো বললো একটা জব নাকি আছে। তোমার পছন্দ……
রেহানের কথা শেষ হওয়ার আগেই আনায়া বললো,
—“ইমন ভাই যে ওনার জব ছেড়ে দিচ্ছেন, এটা তো জানো! ”
—“হুম! ”
—“আমাকে উনি এই জবই করতে বলেছেন। ”
রেহান প্রফুল্ল সুরে বললো,
—“কি বলো, আমি তো ব্যস্থতার জন্য ঠিক ভাবে কথাই বলতে পারিনি ওর সাথে। যাই হোক,এবার তুমি খুশি তো! ”
আনায়ার ছোট করে উত্তর দিলো,
—“হুম!”
—“কি হলো আনায়া! কোনো সমস্যা, তুমি কি এই জবটা করতে চাও না! ”
—“না! না! কিন্তু এই ভিকের পি.এ. এর জবটা আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। ”
—“কি বলো! ভিকের পি.এ. হচ্ছো আর তুমি খুশি নও। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে যতটুকু দেখি তিনি হয়তো খুব ছন্নছাড়া মানুষ। আর ইমনের কাছে শুনেছি তিনি নিজের কাজের প্রতি যেমন দায়িত্বশীল নয় তেমনি তার আশেপাশের মানুষগুলোর কাজের প্রতিও তিনি সিরিয়াস না। সে হিসেবে তো তোমার সুবিধাই রয়েছে, যাস্ট নিজের মতো কাজ করে যাবে। বসের ধমকা ধমকি না শুনলেই হলো। আর তবুও যদি এই জব করতে না চাও তাহলে আমি ইমনকে বলছি, ও অন্য কোনো ব্যবস্থা করে দেবে। তুমি তো আবার আমার শ্বশুরের অতি আত্ননির্ভরশীল মেয়ে, নিজের হবু জামাইয়ের কাছ থেকে তো আবার কোনো হেল্প নেবে না!”
—“তুমি সবসময় এমন কেনো বলো৷ আমি তো শুধু আত্মনির্ভরশীলই হতে চেয়েছি। আর তোমায় ইমন ভাইকে কিছু বলতেও হবে না। ”
—“ঠিক আছে কিছু বলবো না। আর এতো বেশি টেনশন করো না। কাল রাতের কনসার্টে একটা মেয়েকে দেখেছিলাম ভিকের গালে চ*র বসিয়েছে। আমি তো ভেবেছিলাম ভিকে হয়তো মেয়েটাকে মে*রেই ফেলবে। পরে দেখি কিছুই না! আর যাই হোক, ভিকে হয়তো মেয়েদের প্রতি নিজের বেপরোয়ার প্রভাব ফেলবে না। সে হিসেবে ভিকের পি.এ. হওয়াটা বলতে গেলে অনেক কিছুই, তোমাকে তাকে ভয় পেয়ে কোনো টেনশন নিতে হচ্ছে না !”
রেহানের কথা শুনে আনায়ার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আনায়া আ’তংকি’ত সুরে বললো,
—“তুমি কিভাবে জানলে কালকের কনসার্টে ভিকে কে একটা মেয়ে চ*র মেরেছে! তুমি তো দেশে নেই! ”
আনায়ার কথায় রেহান হেসে বললো,
—“এই জন্যই ফোনটা রাখতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি তো জেদ দেখিয়ে নিলে না।…. তুমি কি ভুলে গিয়েছো আজকালকার দুনিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে। সেখানে ভিকে কে কেউ চ*র মারার মতো সাহস দেখিয়েছে, এটা কি এখনো চাপা থাকবে। নিউজ, ইন্টারনেট সবজায়গা এই খবর ছড়িয়ে গিয়েছে। ভিকের ফ্যানগুলো তো ঐ মেয়েকে খুঁজে বের করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। পুরো দুনিয়া যেখানে জেনে গিয়েছে সেখানে আমি এটা জানবো না!
হুট করেই আনায়ার কথা বন্ধ বলা বন্ধ হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“আনায়া তুই আসলেই একটা গাধী!এই সামান্য বিষয়টিও ভুলে গিয়েছিলি! ”
তবুও সে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
—“আচ্ছা তোমার কি মনে হয়, মেয়েটা কি ভিকে কে চ*র মেরে সত্যিই কোনো ভুল কাজ করেছে। না মানে মেয়েটা তো আর এমনি এমনি মারে নি। মেয়েটা গিয়ে ভিকে কে না থামালে তো উনি লোকটাকে তো সত্যি সত্যি মে*রে ফেলতো!”
—“বাপ রে, ভিকের পি.এ. হতে যাচ্ছো আর তাকে সাপোর্ট না করে ওই মেয়েটার সাপোর্ট করছো! তোমার সাহস বরাবরই হাই লেভেলে থাকে। যাই হোক, শোনো আনায়া! ভিকে অনেক বড় একজন রকস্টার সাথে সে সবার চেয়েই আলাদা। একদম ছন্নছাড়া বেপরোয়া একজন মানুষ। তবু তার ফ্যান ফলোয়ারের হিসেব নেই। একসময় আমিও তার অনেক বড় ভক্ত ছিলাম কিন্তু এখন কাজের জন্য চাইলেও এসব পাগলামোতে মেতে উঠতে পারি না। এখন কথা হচ্ছে ভিকে মাঝে মধ্যেই কনসার্টে লোকজনকে বেঁধোরে পেটাতে থাকে। প্রথমে ভাবতাম এসব কি নৃ’শংস’তা! পরে জানতে পারলাম যাদেরকে সে মারে তারা কেউই ভালো মানুষ নয়। তাদের উদ্দেশ্যই থাকে ভিকের কনসার্টে এসে ওর এমন কোনো পারসোনাল বিষয় নিয়ে হার্ট করা যাতে ভিকে রেগে যায়। লোকজন এতো মার খায় তবুও এরা নিজেদের কাজ থেকে পিছু হাটে না।
আর তুমি এসব বিষয় সম্পর্কে অবগত নও এইজন্যই তোমার কাছে ওই মেয়েটার কাজই ঠিক মনে হচ্ছে। ”
রেহান হেসে হেসে কথাগুলো বললেও আনায়া ভাবুক সুরে বললো,
—“তারমানে এখানে ভিকের কোনো দোষ নেই,সব দোষ ওই মেয়েটারই!”
এবার রেহান আর কিছু বললো না। সে হয়তো কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই কিছুটা ভারিক্কি কন্ঠে বললো,
—“আচ্ছা আনায়া, কি হয়েছে তোমার, বলো তো!”
আনায়া সাথে সাথেই কোনো উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফিসফিস করে বললো,
—“রেহান! ভিকে কে চ*র মারা মেয়েটা আমিই ছিলাম! ”
—“আনায়া, আর ইউ কিডিং উইথ মি! ”
—“নো, রেহান!”
আনায়া এ কথা বলতেই তাদের কথোপকথনের মাঝে পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেলো। অনেক্ক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও রেহান কিছু বলছে না দেখে আনায়া মৃদু সুরে বললো,
—“রেহা…ন!
—“আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। এবার এই ভিকে তোমাকে একেবারেই উপরে পাঠিয়ে দিবে।আমার আর এই জীবনে মনে হয় শ্বশুর মশাইয়ের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে না। বিয়ে করলেও শ্বশুর মশাইয়ের এই আগুন মেয়ের এমন তেজ, জেদ আর সাহসের জন্য একসময় আমি নিজেই শেষ হয়ে যাবো। ”
আনায়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“এখানে আমি টেনশন করছি আর তুমি মজা করছো! ”
—“কি করবো বলো, তোমার কাজকর্ম গুলোই যে এরকম! আচ্ছা ভিকে তোমাকে কিছু বলেনি!”
আনায়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে। তাই সোজাসাপটা উত্তর দিলো,
–“নাহ! আমার তো মনে হয় সে আমাকে চিনতেই পারেনি। ”
—“তাহলে এত টেনশন করো না! আচ্ছা আগে এটা বলো, তোমার জবটা তো হয়ে গিয়েছে তাই না! ”
—“হুম! একটু আগে ইমন ভাই আমাকে দিয়ে কি কি যেন কাগজে সাইন করিয়ে নিয়ে গেলো। আর এখন পুরো অফিসে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। আচ্ছা যত যাই হোক, আমার চাকরি হওয়ার পাশাপাশি তো ওনার জবটা চলে গেলো। ইতিহাসে ইনিই মনে হয় প্রথম ব্যাক্তি যে কিনা নিজের জব ছেড়ে দেওয়ার দিনেও এভাবে নেচে গেয়ে সবাইকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। ”
আনায়ার কথা শুনে ইমন হাসলো। আর বললো,
—“ও তো একটা পাগল! বয়সে আমার কত বড় অথচ স্বভাব কাজে একদমই বাচ্চাদের মতো। আচ্ছা আনায়া আমি বরং এখন ফোন রাখছি। একটা ফ্রেন্ডের বাসায় এসেছি তো পরে সময় করে আমি তোমাকে ফোন করবো। ”
আনায়াও মুচকি হেসে বলল,
” আচ্ছা ঠিক আছে ভালো থাকো! নিজের খেয়াল রেখো! ”
অতঃপর দুজনের কথোপকথনের সমাপ্তি এখানেই ঘটলো। অথচ আনায়ার স্টুডিওতে বসে কথা বলতে বলতে কখন যে তার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তার সব কথোপকথন একজন শুনতে পেরেছে, সেটা একবারও আনায়ার ধ্যানেও আসেনি।
________
রেহান আহমেদ! আনায়া আর তার প্রণয়ের শুধু হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে থেকেই। রেহান ছিলো আনায়ার ভার্সিটির সিনিয়র। অল্প সময়ের মাঝেই দুজনের মাঝে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, ভালোলাগা এরপর তা প্রণয়ে রুপ নেয়।
রেহান অনার্স কমপ্লিট করেই স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে সুদূর আমেরিকা। বাকি মাস্টার্সটা ওখান থেকেই কমপ্লিট করেই দেশে ফেরার ইচ্ছে ছেলেটার। এরপর দেশে ফিরেই একদম প্রিয়তমাকে নিজের করে নেবে। আর মাত্র কয়েক মাস। অন্য সবার কাছে এই সময়গুলো চোখের পলকে চলে গেলেও রেহানের কাছে এক একটা দিন কয়েক বছরের সমান মনে হয়।
দুজনার মাঝে এত দূরত্ব থাকার পরেও রেহান প্রতিনিয়ত আনায়ার খোঁজ খবর নিতে থাকে। বিদেশে গিয়েছে প্রায় কয়েক মাস হলো অথচ এতোগুলা দিন বিদেশের মাটিতে থাকার পরও তার মাঝে আসেনি তেমন কোনো পশ্চিমা সংস্কৃতি কিংবা মন-মানসিকতা। তার জীবনের এখন লক্ষ্য একটাই, তাড়াতাড়ি মাস্টার্স কমপ্লিট করে দেশে ফিরে তার শ্বশুর মশাইয়ের মেয়েকে বিয়ে করা। আর কিছু চাই না তার।
রেহান কোন আলালের ঘরের দুলাল কিংবা বস্তা বস্তা সম্পত্তির মালিকের ছেলে নয়। সে উচ্চমধ্য পরিবারের একজন সাধারণ ছেলে। বাবা তার ভার্সিটির প্রফেসর, মা গৃহিণী। সাথে ছোট একটা ভাইও রয়েছে যে কিনা আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দিবে। খুব সাদামাটা তাদের জীবনযাপন। জীবনে নেই কোনো উচ্চ আকাঙ্ক্ষা।
বাবা-মা হিসেবে দুই ছেলেকে নিয়ে গর্বিতও রেহানের বাবা মা। দুটো ছেলেই পড়াশোনাতে তুখোড়। তবে ছোট ছেলের বসয়ের দোসে মাঝেমধ্যে বাঁদরামোর স্বভাব প্রকাশ পেলেও। বড় ছেলে রেহানের নাম নেওয়া মাত্রই আশেপাশে চেনাজানা সকল লোকজনই বলবে, এই ছেলে নিত্যান্তই অত্যন্ত সুদর্শন, নম্র, ভদ্র স্বভাবরে ও নানা গুনাবলি সম্পন্ন একজন ছেলে।
রেহান দেখতে আর পাঁচটা ফর্সা সাধারণ বাঙালির মতই। গাঢ় বাদামি চোখের মনি সাথে কালো কুঁচকুঁচে সিল্কি চুল। নায়ক, সেলিব্রিটিদের মতো কখনো জীমে গিয়ে বডি বানানোর প্রয়োজন কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই তার হয়নি। এমনিতেই সাধারণ বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী সে। সবকিছু মিলে তার জীবনে আক্ষেপের কোনো জায়গা নেই। এখন শুধু আনায়াকে নিয়ে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে পারলেই হলো। আর দেশে ফিরে নিশ্চিয় তার মতো ছেলেকে চাকরির পেছনে ছুটতে হবে না।
অন্যদিকে ইমন রেহানের কোনো সমবয়সী বন্ধু নয়। ইমন রেহানের দুঃসম্পর্কিত এক কাজিন সাথে রেহানের চেয়ে বয়সেও অনেকটা বড়। তবে কাজিনের চেয়ে তাদের ফ্রেন্ডশিপ বন্ডিংটা একটু বেশিই স্ট্রং। এমনিতে তাদের দু’জনের “তুই” করে বলা সম্মোধনে যে কেউ তাদের স্কুল, কলেজ, কিংবা ভার্সিটির বন্ধু ভেবে বসবে।
______________
রাত এগারোটা ! অন্যান্য সময় কেনীথের অফিস রুমের বিশাল কাঁচের বারান্দাটা বন্ধ করে পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকলেও মাঝেমধ্যে এই বারান্দাটাও নিজের রুপ ফিরে পায়।
তবে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে নির্জন কোনো বিশেষ রাতে। যে রাতে কেনীথে বাড়ি ফেরার কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, মাথার মধ্যে চলতে থাকে নতুন এক খেলার আসর ঠিক সেদিনই কেনীথ বারান্দার পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়ে বারান্দায় প্রাণের সৃষ্টি করে।
আজও হয়তো এসেছে সেই বিশেষ কোনো রাত! বারান্দার গ্লাস গুলো সব খোলা। বাহির থেকে সাঁই সাঁই করে বাতাস রুমের ভেতরে এসে ঢুকছে। তবে তার আগে সেগুলো কেনীথকে অনেকটা বাধ্য হয়েই অতিক্রম করছে। এটা নিত্যান্তই কেনীথের নিজস্ব ধারণা। কেনীথের মতে তার নিজস্ব রুপটাকে কেউ পছন্দ করে না। যদি তার ভেতরে থাকা পৈশা*চিক রুপটার সম্পর্কে কোনো অবগত নয় তবে প্রকৃতিরা তো তার পৈশা*চিক কর্মকাণ্ড সবকিছুতেই সাক্ষী। তারা নিশ্চয় তার মতো একজন পি*শাচকে পছন্দ করবে না।
বারান্দায় সটানভাবে দাঁড়িয়ে মুক্ত বাতাস গায়ে লাগাতে লাগাতে এসব ভাবতেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো কেনীথ। এরপর প্যান্ট থেকে ফোনটা বের করে একটা অতি প্রয়োজনীয় ব্যাক্তির নাম্বারে ফোন করলো। তখনই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কেউ বললো,
—“হ্যালো বস! কার ইনফরমেশন লাগবে, নামটা শুধু বলেন! ”
কেনীথ ভারিক্কি কন্ঠে বললো,
—“রেহান!”
লোকটি এবার ইতস্তত ভাবে বললো,
—“বস, রেহান নামে তো পৃথিবীতে বহুত মানুষ আছে। আজকাল তো আবার মানুষ কু*ত্তা বিড়ালের নাম……..
বাকি কথাটুকু আর লোকটি শেষ করতে পারলো না। তার আগেই বললো,
—“আমার নতুন P.A., আনায়া শিকদার! ”
লোকটি কি বুঝলো জানা নেই তবে হেঁসে বললো,
—“বুঝতে পারছি বস! ৫ মিনিট টাইম দেন, সব ইনফরমেশন বের করে ফোন দিচ্ছি। ”
কেনীথ নড়াচড়া না করে ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ মিনিটই এভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক পাঁচ মিনিট পর সেই নাম্বার থেকে ফোন এলো। কেনীথ ফোন ধরতেই তার কাঙ্খিত সকল ইনফরমেশন পেয়ে গেলো। সে যা ধারনা করেছিলো তেমনটাই শুনতে পেলো। মূহুর্তেই তার চোয়াল শক্ত করে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলো। অতঃপর নিজের প্লান অনুযায়ী পরবর্তী নিদর্শনাটাও লোকটি দিয়ে দিলো। এখন আপাতত তার চিন্তা নেই, বাকি কাজ এখন তার বাম হাত সমতূল্য লোকটাই করে দেবে।
কেনীথ এবার আট তলা ভবনের উপর থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো আকাশে কোনো তারার দেখা নেই। সম্পূর্ণ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে। রাস্তা থেকে বিলাসবহুল গাড়িরগুলোর চলাফেরার আওয়াজও কমতে শুধু করেছে। ধারনা করা যায় খুব শীঘ্রই আকাশে ওই মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টির আগমন ঘটবে। এই অসময়ে বৃষ্টি কারোরই পছন্দ হবার কথা না। কিন্তু এটাই যেন কেথীনের একটু বেশিই পছন্দ হলো। প্রকৃতি তাকে বাঁধা দেওয়ার যে ব্যার্থ চেষ্টা চালাতে যাচ্ছে তা ভেবেই সে আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“এতোবছর পর পাখি নিজে থেকে আগুনের খাঁচায় ধরা দিয়েছে। এতো সহজে যেতে দেই কি করে! ”
___________________
আনায়া ভাবতেই পারেনি নতুন জবের প্রথম দিনেই তাকে এতো খাটতে হবে। এই চাকরি কিভাবে কি করবে সে। না করেও তো উপায় নেই। কিন্তু ভার্সিটির পড়া। এতো রাত করে যাওয়ার পর নিজের পরা, বাবার প্রতি দায়িত্ব এসব কিভাবে সামলাবে সে। সাথে বাড়িতে ছোট বোনটাও আছে। একা একা বেচারী আর কি-ই বা করতে পারবে।
ইমনের অফিস থেকে প্রাক বিদায় আজই হয়ে গিয়েছে। দুদিন পর ইমনের জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু আয়োজন করা হবে। যদিও এটা অফিস কিংবা কেনীথের কোনো নিয়ম নয়। অফিসের আরো লোকেরা মিলেই এই নিয়মটা বানিয়েছে। এতে কেনীথ কখনো বাঁধা দেয়নি যেমন তেমন এসব আয়জনে সে কখনো এ্যাটেন্ডও করেনি। ইমনের বেলাতেও নিশ্চয় করবে না।
আনায়া এসব ভাবতে ভাবতেই ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সারে এগারোটা বাজে! এতদিন তো রাতের বেলায় ইমন ভাই-ই তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে কিন্তু আজ সে কি করবে। ইমন তো সেই দুপুর বেলায় তাকে সাথে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে লান্স করিয়ে সে বাড়ি ফিরে গিয়েছে। কিন্তু আনায়াকে এতো এতো কাজ অফিস থেকে প্রথম দিনেই দেওয়ায় তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। সে তো ভেবেছিলো এইসব রকস্টারদেরও কোনো কাজ-টাজ আছে নাকি!শুধু স্টেজে গিয়ে গান গেলেই তো হলো। কিন্তু এখানে এসে বুঝতে পারলো তার পুরো ধারণাই ভুল। এখন তার রকস্টারদের কোনো বিজনেস ম্যান থেকে কম কিছু মনে হচ্ছে না। আর তার কাছে তো এই পি.এ. জবটার চেয়ে অফিসের আর লোকজনের কাজগুলো বেশি কঠিন মনে হচ্ছে। কি সব মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে থাকে সবসময় । আনায়া মনে মনে একটু বিরক্ত তবে তার কাছে কোনো অপশন নেই।
তবে তাকে বলা হয়েছে আজকে আর কালকের দিনটাই একটু বেশি কষ্ট করতে হবে। পরবর্তীতে কাজের তেমন চাপ নেই। আবার মাঝেমধ্যে পড়েও যেতে পারে। এখন আপাতত এসব চিন্তা বাদ দিয়ে ভালোই ভালোই বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই হলো। এখান থেকে বাড়ি ফিরতেই প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে যাবে। আনায়া একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
“জীবনটা এতো প্যারাময় কেনো! ”
মোটামুটি অফিসের সবাই চলে গিয়েছে। অফিসের অনেকগুলো লাইটও অফ করে দেওয়া হয়েছে। তবে পুরো অফিটাতে সে শুধু একা নয় বরং আরো অনেকেরই আছে।
আনায়া আজকের কাজ শেষ করে দ্রুত গতিতে লিফটে করে নিচে নেমে পড়লো। কিন্তু নিচে নেমেই পুরো তব্দা খেয়ে গেলো। এটা কি! কোনো অটোরিকশা, বাস কিছুই নেই। হুট করেই মনে পড়লো সে ঢাকার সবচেয়ে ভিআইপি এরিয়ায় গুলোর মধ্যে এক জায়গায় আছে৷ এখানে দামী দা মী প্রাইভেট কার ছাড়া অটোরিকশা, বাস কোথা থেকে আসবে। আনায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আরেক দফায় চমকে উঠলো। তাকিয়ে দেখলো খুব জোরে বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অসময়ের দিনকালে এমন বৃষ্টির আগমন তার মোটেও পছন্দ হলো না। কিন্তু এই মূহুর্তে সে করবেটা কি! কারো কাছে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য সাহায্য চাইবে! কিন্তু এতো রাতে কে সাহায্য করবে কারো সাথে তো আজ তেমন পরিচয়ও হয়নি।
আনায়ার চিন্তাভাবনার মাঝেই হঠাৎ ধুম করে বৃষ্টি নামলো। আনাইয়া চোখমুখ কুঁচকে গিয়ে বিল্ডিংয়ের ছাঁদের নিচে গিয়ে দাড়ালো। পড়নের কালো কুর্তিটা বৃষ্টি পানিতে হালকা ভিজেও গিয়েছে। আনায়ার মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো।
আনায়া খেয়াল করলো বৃষ্টির বেগ আরও বাড়ছে। আনায়া কি করবে না করবে কিছু বুঝতে পারছে না। তার কাছে কোনো ছাতাও নেই। আর থাকলেও বা কি হবে, এই এতদূর পথ কি সে হেঁটে হেঁটে বাড়ি যেতে পারবে! কোন উপায় না পেয়ে ইমন কে ফোন দিতে চাইল। কোন উপায় না পেয়ে ইমন কেই ফোন দেওয়ার কথা ভাবলো। আনায়া একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ইমনের ইমনের নাম্বারে কল করবে তার আগেই হঠাৎ কালো কুচকুচে এবং কালচে লালের কম্বিনেশের একটা মার্সিডিজ কার এসে দাঁড়ালো তার সামনে।আনায়া ফোন করতে গিয়েও আর করলো না। হুট করে তার সামনো থামাতেই ভ্রু জোড়া সামন্য কুঁচকে গেলো৷
দুনিয়ায় এতো জায়গা থাকতেও গাড়িটাকে তার সামনে এসেই থামতে হলো! কিছুক্ষণ গাড়িতে যে বসে আছে তাকে হালকা গালা*গালিও করে নিলো। আনায়ার মেজাজ খারাপের মাঝেই হুট করেই গাড়ির জানালার কালো কাঁচটা নিচে নামতে লাগলো। গাড়ির ভেতরে স্টিয়ারিং এ এক হাত রেখে বসে থাকা লোকটাকে দেখতেই হঠাৎ আনায়ার কুঁচকে যাওয়া ভ্রু স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
আনায়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেনীথ দৃঢ় ভাবে সামনে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই বললো,
—“যাস্ট এক মিনিট টাইম দিচ্ছি,এরপর আমি চলে যাবো। কারো আসার হলে আসতে পারে। ”
আনায়া খেয়াল করলো কেনীথের চোখে কালো চশমা। মুখে মৃদু বাঁকা হাসি। আর কথাটা যে তাকে বলেছে এটা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এনার মাঝে হঠাৎ তার জন্য এতো দরদ কোথা থেকেই উদয় হলো। বিষয়টি কি সত্যিই স্বাভাবিক, নাকি অন্যকিছু। আনায়া নিজের সন্দিহান চিন্তাভাবনাকে মাটি চাপা দিয়ে আবারও মনে মনে ভাবতে লাগলো।
“আনায়া তুই সবসময় একটু বেশিই বুঝিস! লেকটা হয়তো এতোটাও খারাপ না। নাহলে তুই বাদে এখন পর্যন্ত কারো কাছেই এনার বদনাম শুনেছিস, নাহ তো!”
আনায়া এদিকে ভেবে যাচ্ছে অন্যদিকে শিরদাঁড়া সোজা করে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা কেনীথ একবারোও আনায়ার দিকে ফিরে তাকায়নি। তবে কালো চশমার নিচ থেকে আড়চোখে আনায়ার সবকিছুই খেয়াল করছিলো সাথে মনে মনে ষাট সেকেন্ড কাউন্টও করছিলো। যখন দেখলো আনায়া এখোনো কোনো রেসপন্স করছে না তখন কেনীথ আবারও গম্ভীর আওয়াজে বললো,
—“Only 15 seconds left! ”
হুট করেই কারো কন্ঠ স্বর শুনে আনায়া নিজের ধ্যান থেকে ফিরিয়ে এলো। কেনীথের কথার উদ্দেশ্য আনায়া বোঝার সাথে সাথেই অনেকটা লাফিয়েই গাড়ির দরজার সামনে চলে গেলো। অন্যদিকে কেনীথেরও দেরী হলো না অটোমেটিক দরজাটা খুলে দিলে৷ আনায়া আর কোনো কথা না বাড়িয়েই কেনীথের পাশের সিটটায় বসে পড়লো। আর কেনীথের উদ্দেশ্যে বললো,
—“থ্যাংকিউ স্যার! ”
তবে কেনীথ কোন প্রতিত্তোর না দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। কেনীথের একহাত দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরানো দেখতে দেখতে আনায়া অমায়িক হেসে মনে মনে ভাবলো,
—“লোকটা নিত্যান্তই অদ্ভুত তবে ভালো মনের মানুষও হয়তো। সবার সামনে যতই ম্যানার লেস হোক না কেনো, একটা মেয়েকে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে ঠিকই আর পাঁচটা ভালো মানুষের মতোই হেল্প করলো। ”
আনায়া নিজের চিন্তাভাবনার মাঝেই মুচকি হাসলেও তার পাশে বসা থাকা ব্যাক্তিটির মুখের বাঁকা হাসি আরো বিস্তৃত হলো।
___________________________
রাত বারোটার ছুঁই ছুঁই! আজ রাতে মেঘেরা হয়তো গোল মিটিং বসিয়ে হয়তো ডিসিশন নিয়েছে পুরো দেশকে বৃষ্টির পানিতে ঢুবিয়ে মা*রার। আনায়ার কাছে বিষয়টি এমনটাই মনে হলো। গাড়ির সবগুলো জানালা বন্ধ। বাহিরে অঝোরে ঝাড়তে থাকা বৃষ্টির পানি ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এদিকে একদম চুপচাপ আসে থাকতেও ভালো লাগছে না। কেনীথের দিকে কয়েকবার আড় চোখে তাকিয়েও বেশি একটা লাভ হয়নি। লোকটি সেই কখন থেকে রোবটের মতো করে স্টিয়ারিং ঘুড়িয়েই যাচ্ছে। আনায়া আবারও সামনে তাকিয়ে দেখলো, সেই কখন থেকে রাস্তার পর রাস্তারই দেখা মিলছে। বাড়ির কাছে আর এখনো পৌঁছেতে পারেনি।মনটাও ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে থাকা ছোট বোনটা আর বাবার জন্য টেনশন হচ্ছে।
তবে এই মূহুর্তেই তার মন ভালো করার মন্ত্র জানা মানুষের ফোন কল আসতেই খুশিতে মনে মনে লাফিয়ে উঠলো। আনায়া একবার ভাবলো কেনীথের সামনে ফোন ধরাটা কি ঠিক হবে। পরক্ষণেই ভাবলো, সে ফোনে কথা বললে কেনীথ আবার তাকে কি বলবে। আনায়া প্রফুল্ল মুখে ফোন কেটে যাওয়ার আগেই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একজন হাসি মুখে বলতে লাগলো,
—“কি খবর জান! বলেছিলে বাড়িতে গিয়ে ফোন করবে, শেষে এখন আমাকেই ফোন করতে হলো। তুমি নাকি আবার আমায় মিস করো।”
—“তুমি না শুনেই একটু বেশিই বুঝো! আমার কথা রাখতে হলে তো আগে আমায় বাড়ি পৌঁছাতে হবে, তাই না!”
—“মানে তুমি এখনো বাড়ি যাওনি! তাহলে তুমি কোথায়! ”
—“কোথায় আবার! কাজ শেষ করে এখন বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছি। আচ্ছা, তোমার ওখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে! ”
—“এই মূহুর্তে আমার এখানে বৃষ্টি কোথা থেকে আসবে। কেনো, তোমার ওখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে নাকি! ”
—“হুম, প্রচন্ড রকমের! তুমি এখন কি করছো, তোমার কথা শুনে কেনো যেন মনে হচ্ছে তুমি কার ড্রাইভিং করছো! ”
—“আরে বাহ!তুমি তো দেখছি দূর থেকেও আমাকে ফলো করতো শুরু করেছো। চিন্তা করো না তোমার জামাই বিদেশী মাইয়ার সাথে ভাগবে না! ”
আনায়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“আমি বলি কি আর তুমি কি বলো! আর ওমন চিন্তা ভাবনা মাথাতেও আনলে সোজা আগু*নে পুড়ি*য়ে মেরে ফেলবো। ”
—“আহ…! আমার আগুন পাখিরে, তোমার আগুনে তো সেই কবেই জ্বলে পু*ড়ে শেষ হয়ে গিয়েছি। আচ্ছা শোনো, ফোন লাউডস্পিকার রাখো তো! ”
—“কেনো! ”
—“কেনো আবার, ওর সাথে কথা বলবো এইজন্য! ইমনের সাথে দুদিন ধরে কথাই হয়নি আমার। ”
—“কিন্তু রেহান! ইমন ভাই তো আমার সাথে নেই, মনে আমি তো তার সাথে বাড়ি ফিরছি না। ”
রেহান বিস্মিত সুরে বললো,
—“মানে….! তাহলে এতো রাতে তুমি অটোরিকশায় অথবা বাসে করে বাড়ি যাচ্ছো! ”
—“আরে এতো রাতে আমি এগুলো পাবো কোথায়! আমি তো কেনী………
বাকিটা আর আনায়া বলতে পারলো না তার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে এক বিকট আওয়াজে থমকে গেলো আনায়া। আনায়ার হুট করেই অনাকাঙ্ক্ষিত চিন্তায় গলা শুকিয়ে এলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠ স্বরে বললো,
—-“রে..হা…না!”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। আনায়া আবারও ডাকলো,
“রেহান! ”
এবারও রেহানের কোনো সাড়াশব্দ নেই। বরং কিছু বিদেশি মানুষেদের কন্ঠস্বর আর চিল্লা*চিল্লির আওয়াজ এলো আনায়ার কাছে। বেচারীর চোখে পানি টলমল করছে। একবার কেনীথের দিকো তাকিয়ে দেখলো সে নির্বিকার ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। আনায়া আবারও কান্নারত আওয়াজে রেহানের উদ্দেশ্য বলতে লাগলো,
—- “রেহান প্লিজ আমার সাথে তুমি মজা……..
এবারও আনায়া তার নিজের কথাটুকু শেষ করতে পারলো না। এরআগেই হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লো।
এই ঘটনাটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটনো না বরং তারপাশে বসে থাকা কোনীথের ইচ্ছেকৃত প্লানেই এমনটা হলো। বৃষ্টিময় এই আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে কেনীথ আনায়াকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলো তা আনায়া বৃষ্টির কারণে একবারও খেয়াল করেনি। খেয়াল করেনি সে যে রাস্তায় গাড়ি করে যাচ্ছে সেটা আদোও তার বাড়ির রাস্তা কিনা!
আনায়ার কথা শেষ করার আগেই কেনীথ ইচ্ছে করেই খুব কৌশলে গাড়িটা জোরে একটা বড় গাছের সাথে লাগিয়ে দেয়। জোরে ঝাঁকি খাওয়ায় আনায়া নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পারায় সোজা সামনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে গাড়ির কাঁচের সাথে ধাক্কা লেগে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেলো আর সাথে সাথে সেন্সলেস হয়ে পড়লো। আনায়ার কপালের একপাশে অনেকটা কেটেও গিয়েছে। অথচ কেনীথের সামান্য কোনো আঘাতও লাগেনি। সে নির্বিকার ভাবে গাড়ি থামিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইছে। উইন্ডস্ক্রিন ওয়াইপারগুলো বারবার বৃষ্টির স্রোতের পানিগুলোকে দূরে ঝাপটে সরিয়ে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ ঠিক একই ভাবেই সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কেনীথ এই ভরা বৃষ্টির মাঝেও গাড়ি থেকে নেমে পড়লো । গাড়ি থেকে নামতে দেরী হলেও, বৃষ্টি পানিতে চুপসে যেতে বেশি দেরী হলো না। কেনীথ গাড়ি থেকে নামার পর আনায়ার পাশের দরজা খুলে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা মাথা নিচের ঝুকে অজ্ঞান হয়ে বসে রইছে।
কেথীন আর সময় নষ্ট না করে তাকে গাড়ি থেকে বের করে নিজের বাম কাঁধের সাথে ঝুলিয়ে নিলো।
নির্জন ফাঁকা আঁকাবাঁকা পাকা রাস্তা। আশেপাশে এই দুটো মানব ছাড়া কেউ নেই। শুধু রয়েছে পেছনে ফেলে আসা লাল কালো মার্সিডিজ গাড়িটা। গাছের সাথে জোরে ধাক্কা লাগায় সেই বেচারারও চেহারা বেঁকে এবড়োথেবড়ো হয়ে গিয়েছে। তাতে কি! কেনীথের নিত্যনতুন ব্রান্ডের নতুন গাড়ি কেনাটা এতোদিনে সবার কাছে স্বাভাবিক বিষয় হলেও কিছুদিন পর পর এই গাড়িগুলো নৃশংস অবস্থাগুলো যে কেনীথ কেনো করে সেটাই কারো মাথায় ঢুকে না। এই লোকটার সব রাগ যেন নিজের গাড়ির উপরই ঝাড়তে ভালোবাসে।
অঝোরে বৃষ্টি ঝড়ছে। বৃষ্টির পানিতে দুটো দেহ একদম ভিজে একাকার। কেনীথের চোখে কালো চশমা। একহাত দিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা আনায়াকে ধরে রেখেছে আর অন্য হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে সামনের দিকে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে।
আনায়ার দু’হাত নিস্তেজ হয়ে কেনীথের পিঠের দিকে ঝুলছে। মাথাটাও প্রায় অনেকটা কেনীথের পিঠের দিকে ঝুঁকে রইছে। খোঁপা করা চুল গুলোও পানিতে ভিজে চুপসে গিয়ে প্রায় অনেকটাই খুলে গিয়েছে। বৃষ্টির সাথে মৃদু বাতাসে ভেজা চুলগুলো বারবার কেনীথের মুখে এসে লাগছে। তবুও সে নির্বিকারে হেটে যাচ্ছে।
আনায়ার কপালের কেটে যাওয়া অংশ থেকে র*ক্ত ঝরছে। ফোঁটা ফোঁটা র*ক্ত পানির সাথে মিশে কেনীথের টিশার্টের পিঠ ভিজে যাচ্ছে। আবার কিছু ফোঁটা ফোঁটা রক্ত অনেকটা ব্যবধান নিয়ে পাকা রাস্তায় পড়লেও সেগুলো আবার বৃষ্টির পানির স্রোতে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
অনেকটা দূরত্বের ব্যবধানে রাস্তায় সোডিয়ামের আলো জ্বলছে। আকাশের মেঘ ভেঙ্গে এমন বৃষ্টির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। নির্জন রাস্তায় কোনো সুদর্শন পুরুষের পৈশাচিক মনের আ*তংকদায়ক পরিকল্পায় তার মুখে ঝুলছে এক বিস্তৃত বাঁকা হাসি। অন্যদিক ফুটফুটে ফর্সা চেহারার অচেতন মেয়েটা জানলোও না, তার সাথে এমনটা কেন করা হলো।
#চলবে