একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-২৯

0
48

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#পর্বঃ২৯
#তুশকন্যা

“আজেবাজে না বলে এখন এটা বল একে কি করবো। ওকে আমার যাস্ট অসহ্য লাগছে। সারারাত ওর জন্য ঠিকঠাক ঘুমাতে পারিনি।”

—“কিহ!…সারারাত? বেচারীর কি হালটাই না করেছেন। নিজের বউ অথচ আপনার একটু দয়াও হলো না?”

—“দেবো একটা আ*ছাড়! কিসের বউ বউ লাগিয়ে রেখেছিস? যাকে আমার বউ বলছিস সে তো জানেও না যে আমি কে!”

পাভেল খানিকটা অবাক হয়ে বললো,

“কিহ!উনি জানেই যা যে…তবে না জানিয়েই এসব করে ফেলেছেন! ছিহ বস, এসব আপনার কাছ থেকে আশা করিনি।”

কেনীথের চোখমুখ শক্ত হলো। মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে রয়েছে সেখানে আবার এই পাভেলের উটকো কথাবার্তা।

“তোর সাথেও কিছু করার আগে মুখ একদম বন্ধ রাখ। যে কাজের জন্য ডেকেছি তা কর।”

পাভেল আরো কিছু হয়তো বলতে চেয়েছিলো তবে তা না বললো না। কেনীথকে রাগিয়ে তার লাভ নেই বরং কেনীথ রেগে সত্যি সত্যিই তার কি করে ফেলে কে জানে।

“কি কাজ… ”

কেনীথ কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে পাভেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। পরবর্তী খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“ওকে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা কর। ওর জন্য আমার… হোয়াট এভার, ওকে আর বেশিক্ষণ নিজের চোখের সামনে দেখতে চাই না। যেখানে ছিলো সেখানেই ফেলে আসবি নাকি মেরে ফে*লবি কিংবা তোর সাথে নিয়ে যাবি…যা ইচ্ছে কর তবে ওকে আমি আর আমার আশেপাশে রাখতে চাই না। যে কাজের জন্য নিয়ে এসেছিলাম তা এখন শেষ।”

পাভেল কেনীথের কথায় এবার চোখমুখ চুপসে নিয়ে দাঁড়ানো থেকে সোজা সোফায় ধপ করে বসে পরলো। অতঃপর কেনীথের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর সুরে বললো,

“আপনি কি তার বাবাকে মে”রে…”

“হুম”

কেনীথের অকপট স্বীকারোক্তিতে পাভেল দীর্ঘ শ্বাস ফেললো তবে নিমিষেই উত্তজিত হয়ে বলতে থাকলো,

“তবে ওনার দোষটা কোথায়? বাবুশকা বারবার মানা করেছিলো। এরপরও কেনো এমনটা করলেন? শুধু শুধু ওনাকে কেনো কষ্ট দিচ্ছেন।”

“জানি না, ভালো লাগে তাই!”

“এসব ফালতু কথা বাদ দিন। মেজাজ খারাপ করছেন আমার।”

“মেজাজ তুই খারাপ করছিস। যা বলেছি সেটা কর!”

পাভেল বসা থেকে একপ্রকার লাফিয়ে উঠে কেনীথের দিকে চরম হতাশাগ্রস্ত আর চিন্তিত সুরে বলতে থাকলো,

“বস আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন? বাবুশকা যদি একবার জানতে পারে আপনি ওনার এই হাল…আবার বলছেন ওনাকে এখন আপনার লাগবে না। মে*রে ফেলবো, নিয়ে যাবো! এসব করা তো দূরের বিষয়, এসব কথা মিসেস লুসিয়ার কানে গেলে আমাকে তো টুকরো টুকরো করে কাটবেই সঙ্গে আপনারও ভবলীলাসাঙ্গ করে দেবে। আপনি ওনাকে যে এখানে নিয়ে এসেছেন এটা শুনেই তো তিনি…”

পাভেলের একদমে বলতে থাকা কথায় কেনীথ ব্রেক লাগিয়ে কপাল কুঁচকে বললো,

“তুই না বললি কাউকে কিছু বলিসনি!”

কেনীথের এহেন কথায় পাভেল আমতা আমতা করে বলতে থাকলো,

“মানে ঐ আর কি…বেশি কিছু বলিনি। যাস্ট বলেছি উনি এখন আপনার কাছে।”

কেনীথ শুধু পাভেলের দিকে তাকিয়ে রইলো তবে কিছু বললো। এরই মাঝে হটাৎ তাদের নজর আনায়ার দিকে পড়লো। ওর ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে তবে তার মস্তিষ্ক যেন আজ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। সামান্য উঠে বসার শক্তি যোগাতে পারছে না আর তার চেয়ে বড় বিষয় সে এখনোও অদ্ভুত কিছু হয়তো ভাবছে আর শারিরীক ব্যাথার জন্য ধীরে ধীরে গোঙ্গানোর সুরে কাতরাচ্ছে। যা শোনা আর দেখা মাত্রই পাভেল বিচলিত হলেও কেনীথের মাঝে কোনো হেলদোল হলো না। যে কারণে পাভেল আনায়ার দিকে ছুটতে গিয়েও কেনীথের জন্য থেমে যায়। এবং অবাক সুরে বলে,

“আপনি এখনো বসে রইছেন…উঠে গিয়েছেন উনি।”

“তো আমি কি নাচবো।”

“আপনাকে নাচতে কে বলেছে। আমি তো আর কিছু করতে পারবো না। ওটা আপনার বউ, আপনি গিয়ে সাহায্য করুন।”

কেনীথ পাভেলের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,

“তোরই তো দরদ উথলে পড়ছে, তুই যা বরং।”

“হাহ…এটাকে দরদ উথলানো বলে কি না জানি না। তবে ওনার অবস্থা যা করেছেন তা দেখার মতো না । আর এমনিতেও আমার নিজের জীবনের মায়া আছে। আপনি ফ্রি-তে বউ পেয়ে কদর না করলেও আমি কিন্তু এখনো একটা মেয়ের আশেপাশেও ঘেঁষতে পারিনি। সারাজীবনটা মনে হয় আপনার সাথে কাজ করেই পার হয়ে যাবে, আমার বিয়ে-শাদি আর হয়তো হবে না।”

কেনীথ পাভেলের কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজেই উঠে গিয়ে আনায়া দিকে। অন্যদিকে পাভেল বকবক করতে গিয়ে তা খেয়ালও করেনি।আর পরবর্তীতে তা খেয়াল করতেই পাভেল ছুটে কেনীথ কাছে গেলো।

কেনীথ আনায়ার কাছে আসতেই দেখতে পেলো ও অদ্ভুত ভাবে মৃদু গোঙ্গানোর পাশাপাশি বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ করে যাচ্ছে। তার সামনে যে দুটো জলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে রইছে সেদিকে নজরও ফেলছে না। এসব কেনীথ আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পাভেল দেখে খানিকটা অবাক হলো। কেনীথ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই শুয়ে থাকা আনায়ার উদ্দেশ্যে বলতে থাকলো,

“কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেনো?”

আনায়া কেনীথের কথা শুনতে থমকে গিয়েছে। ও এবার সোজাসুজি কেনীথের দিকে বি*ধ্বস্ত চোখে তাকিয়ে রইছে। এদিকে আনায়া কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আচমকা দুজনকে অবাক করে দিয়ে খানিকটা ভীতু স্বরে বললো,

“আপ…নারা কারা?”

আনায়ার এহেন কথায় কেনীথের কুঁচকে থাকা কপালটা আরো খানিকটা কুঁচকে গেলো।

“ঢং করছিস? রাত না পেরোতেই এখন চিনতে পারছিস না? একরাতেই সব ভুলে গেলি?”

কেনীথের এমন তিক্ততা পূর্ন কথায় আনায়ার মাঝে কোনো হেলদোল না হলেও পাভেল পাশ থেকে কেনীথের উদ্দেশ্য ফিসফিসয়ে বলতে থাকলো,

“বস উনি দেখি এখন আপনাকেও চিনতে পারছে না। এক রাতে কি করলেন আপনি এসব। তারমানে সবকিছু জোরা…জুরি করেই…”

“চুপ করে থাক! ”

কেনীথ আনায়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ওর পাশে বসলো। এরপর ওর দিকে খানিকটা ঝুঁকতেই আনায়া কুঁকড়ে গিয়ে ভীত চোখে কেনীথকে দেখতে লাগলো। কেনীথ ওর হাবভাব দেখে আরো বেশি অবাক হলো। হঠাৎ আনায়ার এহেন আচরণের কারণ কি!

তবে কেনীথ অনেকটা বিরক্ত হয়ে আনায়ার বাহু শক্ত করে ধরতেই আনায়া আধোআধো সুরে বলতে লাগলো,

“আমাকে মা*রবেন না। আমি বাবার কাছে যাবো।”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ পাভেলের দিকে তাকিয়ে আনায়াকে ছেড়ে দিলো। অতঃপর কঢ়া কন্ঠে বলতে থাকলো,

“পাগল হয়েছিস? কালকেই না তোর চোখের সামনে ওকে শেষ করলাম এখন আবার কেনো বাপ বাপ করছিস? সত্যিই ম*রার শখ হয়েছে? কালকে কি করেছি মনে নেই।”

আনায়ার ছলছল চোখজোড়ায় আরো বেশি পানি এসে জমলো। আচমকা সে কেনীথের কাছে প্রচন্ড ভীতু হয়ে ধরা দিচ্ছে। যা কেনীথের মোটেও বোধগম্য নয়।

“মিথ্যা বলছেন আপনি। বাবা একটু আগেই এসেছিলো আমাকে নেওয়ার জন্য। বলেছে আমি যেন তৈরি হয়ে থাকি। আর বাবার না কোনো মাথা ছিলো না… না না ছিলো। তার হাতে ছিলো তার মাথা।”

কেনীথ অবাকের চোখে আনায়ার দিকে তাকিয়ে ওর কথাবার্তা শোনার পর পাশে পাভেলের দিকে তাকালো। পাভেলও যেন আনায়া এহেন অবস্থা দেখে ভারী অবাক। আনায়াকে মোটেও সুস্থ মস্তিষ্কের মনে হচ্ছে না তার। এদিকে কেনীথ যেন রাগারাগি করে আর কিছু না করে তার আগেই পাভেল কেনীথের উদ্দেশ্যে বলতে থাকলো,

“বস… প্লিজ এখন আর রা*গারা*গি করে কিছু করবেন না। ওনাকে দেখে ঠিকঠাক মনে হচ্ছে না। হয়তো বা হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।”

পাভেলের এহেন চিন্তিত চেহারার দিকে তাকিয়ে কেনীথও খানিকটা চিন্তিত হলো। তবে তা প্রকাশ না করে পাভেলের উদ্দেশ্যে বললো,

” একটা কাজ কর। নিচে ওর জন্য রান্না করে রেখে এসেছি। একটু গিয়ে নিয়ে আয়। আমি না হয় এদিক টা দেখছি।”

এইবার পাভেল খানিকটা মুচকি হাসলো তবে মনে মনে সে আনায়াকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। তবে কেনীথের এহেন হাবভাব দেখে আর কিছু বললো না। যথারীতি কেনীথের কথা মতো দ্রুত নিচে চলে গেলো।

পাভেল চলে যেতেই কেনীথ নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। প্রতিজ্ঞা করলো আপাতত আর মাথা গরম করবে না। আনায়ার সঠিক কিছু একটা করা না পর্যন্ত নিজেকে ঠিকঠাক রাখবে। যে কারণে কেনীথ শান্ত চেহারা নিয়ে আনায়াকে খানিকটা আলতোভাবে জোর করেই উঠিয়ে বসালো। এদিকে আনায়া কেনীথকে অপরিচিত ব্যক্তির মতো দেখছে। যে কারণে কেনীথের স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে চাইছে। ওর চোখে পানি ঝলঝল করছে। যেনো মূহুর্তে তা বর্ষণের ন্যায় ঝড়ে পড়বে।

এদিকে কেনীথ নিজের মুখটা আনায়ার দিকে এগিয়ে একহাতে আনায়ার ঘাড় ধরে ওর মাথাটাকে নিজের কাছে খানিকটা টেনে নিতেই আনায়া ঠোঁট উল্টে বললো,

“ব্যাথা পাচ্ছি”

কেনীথ ওর টলটলে চোখমুখ দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে বাঁকা হাসলো। আনায়ার কষ্টে আনন্দিত হলো কিনা তা অজানা। তবে সে আনায়াকে ছাড়লো না বরং ওর মুখের সামনে মুখ নিয়ে নানান ক্ষ*ততে পূর্ণ ঘাড়ে আরেকটু চেপে ধরে মুচকি হেসে বলতে লাগলো,

“কাল রাতে তোর শরীরে সকল ক্ষ*ত সৃষ্টি আমিই করেছি। তোর বাবাকেও আমিই মে*রে ফেলেছি। কিভাবে কষ্ট দিয়েছি মনে আছে?…এবার মনে পড়লো আমি কে?”

আনায়া ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলেও নিমিষেই কেনীথের কথায় সে স্তব্ধ হয়ে পড়লো। সত্যিই এমন কিছু হয়েছে কিনা মনে করার চেষ্টা করতেই মূহুর্তেই আনায়ার সব কিছু মনে পড়তে লাগলো। বিশেষ করে শুধু তারেকের মৃ*ত্যুর সেই লো*মহর্ষ*ক দৃশ্যগুলো। যেগুলোই মূলত আনায়ার মস্তিষ্ককে নিষ্ক্রিয় করার মূল সূচনা। যাকে আরো বেশি উত্তোলনের কাজটা কেনীথ পরবর্তীতে নিজেই করেছে এবং প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে।

কেনীথ আনায়াকে ছেড়ে দিতেই আনায়া কেনীথের দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে বললো,

“তার মানে বাবা সত্যিই আর নেই?”

কেনীথ মুচকি হেসে অকপটে বললো,

“নাহ!”

আনায়া কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো,

“তার মানে আপনি আমাকেও মে*রে ফেলবেন তাই তো?”

কেনীথ এবার খানিকটা হেসে বললো,
“তুই কি আমায় ভয় পাচ্ছিস?”
আনায়া উত্তরে কিছু বললো না শুধু কেনীথের দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে রইলো। অন্যদিকে কেনীথও আর কথা না বাড়িয়ে আনায়ার উদ্দেশ্যে আদেশ সরূপ বললো,

“ফ্রেস হয়ে নে…এরপর খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে হবে। আমি কোনো রোগীকে পালতে পারবো না।”

এই বলে কেনীথ বসা হতে দাঁড়িয়ে গেলো।অন্যদিকে আনায়াও বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তো পড়লো তবে শারিরীক অক্ষমতার জন্য মূহুর্তেই পড়ে যেতে নিলেই আনায়া কাভার্ডের সাহায্য নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। তবে পুনোরায় আরো কয়েক পা এগোতেই আচমকা সে নিজেকে শূন্যে অনুভব করতে লাগলো।

কেনীথ তাকে আচমকা পাজকোলে তুলে নিলেও আনায়ার কাছ থেকে কোনো রেসপন্স এলো না। আনায়া এখনোও চাইছে কেনীথের কাছ থেকে দূরে সরতে। তাই সেটা সম্ভব না হলেও এক আকস্মিক আ*তংক নিয়ে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। এদিকে কেনীথ আনায়াকে ওয়াশরুমে এনে নিচে নামিয়ে দিলো এবং আনায়া উদ্দেশ্যে বললো,

“বাকিটা প্লিজ নিজে কর। আমি কিছু করতে পারবো না। আর এমন ভাব করিস না যে আমি তোকে মে*রেই ফেলেছি। এখনো বেঁচে আছিস তুই। ”

কেনীথ নিজের মন মতো কয়েকটা কঢ়া কথা শুনিয়ে চলে যেতেই আনায়া থমথমে পরিবেশটাকে অদ্ভুত ভাবে ঘুরে ঘুরে দেখলো। অতঃপর আনায়া ধীরে ধীরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আজ তার চালচলন সব কিছু অদ্ভুত।

আনায়া আয়নাতে নিজেকে দেখতে লাগলো এবং একটা সময় পর নিজের মুখ গলার বিভিন্ন দাগ আর ক্ষ*ত গুলো ছুঁয়ে দেখতে দেখতেই নিঃশব্দে চোখের জল ফেললো। এরই মাঝে আচমকা আনয়ার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই অবাকের সুরে বললো,

“বাবা!”

আনায়া স্পষ্ট আয়নার মাঝে তার ঠিক পেছনে নিজের বাবাকে দেখতে পারছে। অত্যন্ত লো*মহ*র্ষক শরীরটা মাথা বিচ্ছিন্ন, আর মাথাটাকে তারেক নিজের হাতের তালুতে ধরে রেখেছে। আনায়া ত্বরিত পেছনে ঘুরে তারেককে দেখার জন্য উদ্বেগ হলো। তবে আনায়া পিছনে ঘুরে মোটেও কোথায়ও নিজের বাবাকে দেখতে পেলো না। আনায়া কপাল কুঁচকে কিছুটা ভীতু চোখে পুনোরায় আয়নার দিকে ফিরলো। ঠিক তখনই সে পুনোরায় তারেককে একই অবস্থায় দেখতে পেলো।

—“তোমাকে তো উনি মে*রে ফেলেছে তাহলে তুমি কিভাবে… ”

আনায়া ঘাবড়ে গিয়ে আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে তারেকের হাতে থাকা মাথাটা আনায়াকে কিছু বলতে লাগলো,

—“………………”

“যদি এমনটা করি তাহলে তো উনিও আমায় মে*রে ফেলবে।”

আনায়ার এহেন সহজ স্বীকারোক্তিতে তারেক আনায়াকে আরো অনেক কিছু বলে বিদায় নিলো। যদিও তারেক সম্পূর্ণ রুপে আনায়ার ভ্রম কিংবা হ্যালুসিনেশন ছিলো। যা শুধু মাত্র তার ধীরে ধীরে বিকৃত হতে থাকা মস্তিষ্কের প্রভাব। তবুও আনায়া তারেকের সকল উপদেশ মনোযোগ দিয়ে শোনার পর কোনো গোপন লক্ষ্য পূরণের আশায় মুচকি হাসলো।

_____________

আনায়া ফিরতেই কেনীথ ওকে বিছানাতেই বসিয়ে, খাবার দিয়ে নিজের হাতে খেতে বলেছে। আনায়াও সম্পূর্ণ পুতুলের ন্যায় কেনীথের কথা মান্য করে নিজের হাতেই খাবার খাওয়ার চেষ্টা করছে। খাবারের ঝাল না থাকায় আনায়ার তেমন সমস্যা না হলেও বরাবরের মতো খাবার মুখের ভেতরে যাওয়ার পর তার চিবোতে অনেকটাই কষ্ট হচ্ছে ওর। আনায়ার চোখে বিন্দু বিন্দু পানি এসে ভীর করলেও সে অদ্ভুত ভাবে কোনোপ্রকার শব্দ না করেই অল্প অল্প করে খাবার চামচে তুলে মুখে দিচ্ছে।

এদিকে সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক দেখে কেনীথ পাভেলকে নিয়ে বাহিরে গিয়েছে। তবে বেশি দূর না বরং আনায়ার রুমের পাশেই করিডরে দুজনে কিছু বিষয়ে কথা বলছে।

“বস, ওনাকে তো ঠিকঠাক মনে হচ্ছে না। একবার ডক্টর দেখালে ভালো হতো না?”

কেনীথ তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললো,

“একদিনেই ডোজ বেশি হয়ে গিয়েছিলো। ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করিস না।”

কেনীথের কথার উদ্দেশ্য পাভেল ঠিকই বুঝলো তবে আলাদা তার আরো কি বলার আছে সে জানে না।তবুও সে বললো,

“ঠিক আছে বস যেটা আপনি ভালো মনে করেন। তবে প্রয়োজন হলে একটু আগেই জানাবেন নয়তো রাশিয়া থেকে ডক্টর আনতে গিয়ে… ”

“মানে…দেশে কি ডক্টর কম পড়েছে! রাশিয়া থেকে আনতে হবে কেনো?”

“আমি তা বলিনি। রাশিয়া থেকে যাদের আনবো তারা তো আমাদের পারসোনাল। কিন্তু দেশে কাউকে আনলে কাহিনি বিগড়ে যাবে। একে তো ওনার অবস্থা বারোটা বাজিয়েছেন। এখন কোনো সাইক্রিয়াটিস্টকে দেখাতে গেলেও ওনার অবস্থা দেখার পর সবাই ওনার পরিচয় নিয়েও কথা তুলবে। তারপর এমনিতেই সব তিল থেকে তাল।”

কেনীথ পাভেলের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো।

“এতদূর ভাবার কি প্রয়োজন। আর ডাক্তার প্রয়োজন পড়লে আমার কাছে আসবে, আমি কোথাও যাবো না!”

“পাগল হলেন? আপনার এই জায়গায় সন্ধান কি কেউ জানে নাকি? আর শুধু ডাক্তার কেনো, শহরের কাক পক্ষীরা যদি এই জায়গায় সন্ধান পায় তো আপনার কাহিনি ওখানেই খতম।”

“আমি ভেবে পাই না যে, তোর মতো একটা গাধাকে কেনো এখনো নিজের সাথে রেখেছি। এইখানে কেউ এলে সে কোনোদিনও আমার ইচ্ছে ছাড়া বেড়োতে পারে না। আর এটা তুই ভালো করেই জানিস। তবে তোর কাকপক্ষী কিংবা ডাক্তার, তাদের দিয়ে যদি আমার ক্ষতির আশংকাই থাকে তবে আমি কেনো তাদের এখান থেকে জ্যান্ত ফিরতে দেবো?”

কেনীথের ধমক আর এহেন কথায় পাভেল ঢোক গিললো তবুও বলতে লাগলো,

“এসব করে যে আপনি কি মজা পান, নিজেই জানেন। যাকে দিয়ে নিজের ক্ষ*ত সারিয়ে নেবেন তারই আবার ক্ষ*তি করবেন।”

“এতোদিন কি কোনো সাধু বাবার কাছে ছিলি নাকি? হঠাৎ হঠাৎ তোর মনে এতো দয়া মায়া কোথায় থেকে আসে জানি না।”

“ভালো আর থাকতে পারলাম কই জীবনে। মাফিয়া আর আপনার সাথে কাজ করতে করতে কৈশোর, যৌবন,মহত্ত্ব সব গাঙ্গে ভাসিয়া গিয়াছে আমার।”

পাভেলের এহেন ঔদাসীন্য কথায় কেনীথ শব্দহীন ভাবে হাসলো। এই পাভেলের বেশির ভাগ কথাবার্তায় কেনীথের বিরক্ত লাগলেও কেনীথ ভালো করেই জানে ছেলেটা একদম কাজের। আলাভোলা চেহারা আর কোঁকড়ানো চুলে একদম ইনোসেন্ট মনে হলেও ওকে দিয়ে এমন কিছু মিনিটের মাঝেও করা সম্ভব যা বড় বড় মানুষদের দিয়ে মাস কিংবা বছর সময় ধরে করানো সম্ভব কিনা তাতে কেনীথের সন্দেহ রয়েছে।

“শোন, তোকে একটা কাজ দিচ্ছি। ওর জন্য ভালো দেখে কয়েকটা জামা আনতে হবে। একটু ঢিলেঢালা আর নরম যেন হয়। তোর পছন্দ মতো আনিস আমার কোনো সমস্যা নেই।”

কেনীথের অকপটে বলা কথাগুলো শেষ হতে না হতেই পাভেল ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বিস্তৃত ভাবে হাসতে লাগলো। চোখেমুখে যেন কোনোকিছুর জন্য খুশি উপচে পড়ছে। এটা দেখমাত্রই কেনীথ বিরক্তির সাথে বললো,

“কি হলো! এমন ছাগলের মতো কেলাচ্ছিস কেনো?”

পাভেল কেনীথের কথায় পাত্তা না দিয়ে উল্টো নিজেই হাসতে হাসতে এক কাধ নাচাতে নাচাতে বললো,

“হে হে… হি… হি…”

কেনীথ ওর এমন সব অদ্ভুত হাসির শব্দে চরম বিরক্ত হলো। যে কারণে কঢ়া কন্ঠে বলতে লাগলো।”

“কি আজব, এমন মৃগী রোগীর মতো কেনো করছিস?”

কেনীথের কথায় নিমিষেই পাভেলের মুখ চুপসে গেলো।

“দিলেন তো মুডের বারোটা বাজিয়ে। যাইহোক, আমি আপনার বারবার পল্টি খাওয়া নিয়ে হাসছিলাম। একবার বলেন মে*রে ফেলতে আবার এখন বলছেন ভালো দেখে,নরম আর ঢিলেঢালা জামা আনতে।হঠাৎ করে এতো ভালোবাসা…”

“তোর ইচ্ছে হলে পাটের ছালাও আনতে পারিস। আমার সমস্যা নেই।”

এবারও কেনীথ পাভেলের কথায় মাঝে ব্রেক মেরে দিয়ে চলে যেতে নিলো। তবে আচমকা পাভেলের চোখে একটা জিনিস পড়ায় সে দৌড়ে কেনীথের সামনে গিয়ে বলতে লাগলো,

“দাঁড়ান!দাঁড়ান! এটা কি?”

কেনীথ ভ্রু কুঁচকে বললো,

“কোনটা?”

অমনি পাভেল কেনীথের গলার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে হেসে বলতে লাগলো,

“এটা! আপনি বলছিলেন সব কিছু নাকি আপনিই জোড়াজুড়ি করে… হ্যে হ্যেহ, কাহিনি তো অনেক দূর দেখছি।”

কেনীথ ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,

“এমন তোরও লাগবে? চল নিয়ে যাচ্ছি,ও তোকেও দিয়ে দিবে।”

এমন একটা বিষয়ে কেনীথের এহেন উত্তর পুরো মহলটাকেই বিগড়ে দিলো। পাভেলের মতে তার কথাবার্তায় হয়তো লাগাম না থাকতে পারে কিন্তু কেনীথ মাঝেমধ্যে এমন দুই একটা কথা বলে ফেলে যে তা সোজা পৃথিবীর লাগাম ছাড়িয়ে ফেলে।

_______________

কেনীথ আর পাভেল দুজনে একসাথে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই খানিকটা অবাক হলো। বিছানার উপর বসে উল্টো ঘুরে মাথা নিচু থাকা অবস্থায় আনায়া অনবরত কিছু একটা করে যাচ্ছে। চারপাশে তুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইছে। পেছন থেকে মনে হচ্ছে ও বালিশের উপর কিছু দিয়ে বারবার আঘাত করছে।

কেনীথ আর পাভেল দুজনে আনায়ার কাছে যেতেই দেখলো, তাদের ধারনাই ঠিক। খাবারের প্লেটটা পাশে ফেলে রেখে কাঁটা চামচ দিয়ে অনবরত বালিশে আঘাত করছে। আর উপরের কভারটার নানান জায়গায় ছিঁড়ে ফেলায় নিমিষেই সেখান থেকে অনবরত তুলো বের হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। আর এদিকে এসব করে যেন প্রচন্ড আনন্দ পাচ্ছে। তার চোখেমুখে অদ্ভুত হাসি ঝুলছে।

এসব দেখে পাভেল বিস্ময়ের সুরে বললো,
“বস,এসব… ”

পাভেল নিজের কথা শেষ করলো না। তার জানা মতে আনায়া তো একদম সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ছিলো হঠাৎ এমন পরিবর্তন কি শুধু কেনীথের জন্যই। এদিকে কেনীথ আনায়ার উদ্দেশ্যে গম্ভীর কন্ঠে ডাকতে লাগলো। প্রথম কয়েকবার আনায়া কোনো সাড়াশব্দ না দিয়ে নিজের মতো কাজ করতে থাকলে কেনীথ খানিকটা রাগান্বিত স্বরে বললো,

“তারা! এসব কি হচ্ছে?”

এবার কেনীথের কথা শুনে আনায়া থামলো এবং মাথা তুলে কেনীথের দিকে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। এদিকে পাভেল খানিকটা ইতস্তত হয়ে বললো,

” বস ওনার অবস্থা তো দেখছি সত্যিই বেশি খারাপ মনে হচ্ছে। এখনই কিছু করার…”

“মানে কি? একদিনের মধ্যেই পাগল হয়ে গিয়েছে?এসব অভিনয় করছে। নিশ্চিত মাথার মধ্যে অন্যকোনো প্যাচ চলছে। কিভাবে আমাকে আরো বেশি কষ্ট দেওয়া যায়। কিভাবে আমাকে ধ্বং*স করা যায়। আগে বাপ আর এখন মেয়ে,দুটোই…”

“বস বলছিলাম যে এতো বেশি হাইপার… ”

“পাভেল তুই যা এখন। পরে ডেকে নেবো তোকে।”

কেনীথের কর্কশ কথায় পাভেল আর কিছু বললো না। সে চলে যাওয়ার জন্য উদ্বেগ হলেও দরজার কাছে গিয়ে পুনোরায় কেনীথের উদ্দেশ্যে বললো,

“বস লাস্ট বারের মতো একটা কথা বলার ছিলো।”

কেনীথ ওর কথা শুনে শুধু ওর দিকে তাকালো। তখনই পাভেল ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

“বস! একটু মনে করে গলায় মলম লাগিয়ে নিয়েন আর ওনাকেও একটু লাগিয়ে দিয়েন। তাড়াতাড়ি সেড়ে যাবে।”

—“তুই যাবি নাকি, তোদের দুজনকে আমি একসাথে চিবিয়ে খাবো!”

কেনীথের এহেন দাঁত কটমট পূর্ণ ধমকে পাভেলের আর সেখানে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ হলো না। আগেপিছে না ভেবে সে সোজা বাড়ি ছাড়তে বেড়িয়ে পড়লো। এদিকে পাভেল চলে যেতেই কেনীথ জোরে শ্বাস নিয়ে আনায়ার দিকে তাকালো। এবং গম্ভীর কন্ঠ আনায়াকে বলতে লাগলো,

“কাহিনি কি? ইচ্ছে করে এসব করছিস তাই না? আমাকে রাগাতে চাস? তারা একটা কথা ক্লিয়ার করে বলে দিচ্ছি,তোকে এতক্ষণ ধরে বাঁচিয়ে রেখেছি মানে এই না যে তোকে আমি কিছু করবো না। আমাকে রাগিয়ে কোনো চালাকির চেষ্টা করলে সোজা তাই করবো যা তোর বাপের সাথে করেছি।”

কেনীথের কথায় আনায়া তেমন প্রতিক্রিয়া না করলেও কেনীথ আনায়া এক বাহু শক্ত করে ধরে রাখায় খানিকটা ব্যাথা চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো। তবে আনায়া ঠোঁট উল্টে বলতে থাকলো,

“বাবা বলেছে আমায়, বাবা। আমার কোনো দোষ নেই।”

“কিসের বাবা বাবা লাগিয়ে রেখেছিস। একটু আগেই না মনে করিয়ে দিলাম যে তোর বাপ আর নেই। ওকে আমি শেষ করে ফেলেছি।”

এবার কেনীথের রাগান্বিত কথায় আর আনায়া ভয় পেলো না বরং অদ্ভুত ভাবে মুচকি হেসে বললো,

“মজা করছেন আপনি। বাবা একেবারে ম*রে যায় নি। বাবা আবার এসেছিলো আমার কাছে। আমাকে বলেছে যে,আমাকে সে এখান থেকে নিয়ে যাবে। তার সাথে নিয়ে যাবে। আর বলেছে…”

কেনীথ এবার খানিকটা গম্ভীর কন্ঠ নিয়ে বললো,

“কি সব পাগলের মতো কথা বলছিস। আর কি বলেছে তো বাপ।”

এবার আর আনায়া কিছু না বলে মুচকি হাসতে লাগলো। ওর হাসি দেখে কেনীথ আরো বেশি বিরক্ত হলো।

“এখন আবার হাসছিস কেনো? বল কি বলেছে তোর বাপ? ”

“বলা যাবে না। বাবা বলেছে যেন আমি কাউকে কিছু না বলি। এটা আমাদের সিক্রেট, আপনাকেও বলতে মানা করেছে। নয়তো বাবা আমাকে তার সাথে নিয়ে যাবে না।”

কেনীথ এবার দীর্ঘ শ্বাস ফেললো এবং মনে মনে নিজের প্রতিই বিরক্ত হয়ে বললো,
“আজব তো! আমি কেনো এর কাছে এসব জানতে চাইছি।”

তবে কেনীথ আনায়ার দিকে খানিকটা শাসন সরূপ মনোভাব পোষণ করে বলতে থাকলো,

“রাখ তোর বাপের কাহিনি। আগে এটা বল খাবার খাসনি কেনো। আমি কি ওসব ফেলে রাখার জন্য বানিয়েছি নাকি তোর এসব রংতামাশা দেখার জন্য।”

এবার কেনীথের কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণে আনায়া অনেকটা চুপসে গিয়ে নিচের দিকে মাথা নুইয়ে ফেললো। এদিকে কেনীথ এটা দেখে নিজেকে যতটা পারলো শান্ত করলো। অতঃপর নিজেই বাকি খাবার টুকু আনায়াকে খাইয়ে দিলো। এরপর কিছু ঔষধ খাইয়ে দেওয়ার পর এখন আনায়ার হাত, গলা, মুখ সহ বিভিন্ন ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। এতোক্ষণে রাগ অনেকটাই কমে গিয়েছে। অন্যদিকে বিছানার মাঝে আনায়া একদম ছোট বাচ্চার ন্যায় চুপচাপ বসে রইছে। তবে মাঝেমধ্যে কেনীথের হাতের ছোঁয়ায় ব্যাথা অনুভব হলে কেঁপে কেঁপে উঠছে। বর্তমানে কেনীথ ওর বিধ্বস্ত ঠোঁটে খুব সাবধানের সাথে আলতোভাবে মেডিসিন লাগতে ব্যস্থ। অন্যদিকে আনায়া নিস্তব্ধ হয়ে কিছু ভেবে চলেছে আর এখন ওর চোখে খানিকটা পানিও টলমল করছে।

“আমার সাথে কাল এমনটা কেনো করলেন? আমার অনেক কষ্ট হয়েছে।”

কেনীথ যখন আনায়ার খুব কাছ থেকে নিজের কাজে মনোযোগী ঠিক তখনই কেনীথের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে আনায়ার ঠোঁট জোড়া নড়ে উঠলো। কেনীথের মেজাজ মূহুর্তেই খারাপ হয়ে গেলেও আনায়ার কথা শুনে নিমিষেই নিজের সব মেজাজ উড়িয়ে দিয়ে আনায়া দিকে তাকালো। আনায়া ওর দিকে একই ভাবে টলমল চোখে তাকিয়ে। এদিকে কেনীথ এবার নিজের কাজের সমাপ্তি ঘটালো এবং আনায়ার মুখটা দুহাতে আলতো ভাবে ধরে বলতে লাগলো,

“কাল যা করেছি, তোর কাছে সেসবের অর্থ কি? আর আমি তোর কাছে কি?”

আনায়া আমতাআমতা করে বললো,

“পাপ! কাউকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিলে সেটা পাপ। যারা কষ্ট দেয় তারা খারাপ লোক। আপনিও আমায় কষ্ট দিয়েছেন। আর আপনি তো আমার কেউ না। আপনি আমাকে বিয়েও করেননি। বিয়ে না করে ওসব করা অন্যায়, পাপ। আপনিও পাপী, আপনিও অনেক বাজে লোক, অনেক খারাপ আপনি।”

কেনীথের শান্ত চেহেরাটার দিকে তাকিয়ে আনায়া সবগুলো কথা অকপটে বললেও তার চোখ হতে অনবরত পানি ঝড়েছে।কেনীথ আনায়ার কথা শেষ হওয়া মাত্রই ওর দুহাতে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে স্পষ্টভাবে বললো,

“ভিভান নামের কাউকে চিনিস?”

আনায়া কেনীথের কথা শুনে ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। তবে পরবর্তীতে মাথা নাড়িয়ে বললো,

“নাহ ”

কেনীথ ওর উত্তরে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,

“চিনবি কিভাবে!চিনবি তো সব রেহান নামের অপদার্থ গুলোকে।”

আনায়া কিছু বললো না বরং তার আগেই কেনীথ বলতে লাগলো,

“তুই জানতে চাস না আমি কে?”
আনায়া হালকা ভাবে মাথা উপর নিচ করে সম্মতি জানালো।

“ঠিক আছে, তবে ভালো করে বলছি। মনোযোগ দিয়ে শুনবি।”

এই বলেই কেনীথ বলতে শুরু করলো,

“কাসিয়া নামক এক রাশিয়ার পরী। রাশিয়ার ভার্সিটিতে পড়া অবস্থায় কেউ জানতো না যে তার আসল পরিচয় কি। কারণ সে যে একজন রাশিয়ার নামকরা মাফিয়া আর্তেমের মেয়ে, এটা যেন সকলের জন্য বিস্ফো*রক সরূপ আ*তংক। এমনিতেও কাসিয়া মেয়েটা নিজের এই পারিবারিক পেশা থেকে নিজেকে সবসময় দূরে রাখতে চেয়েছে। প্রচন্ড নাজুক আর কমল হৃদয়ের মানুষ ছিলো। যাদের হৃদয় মাফি*য়াদের মতো জ*ঘন্য অপরা*ধগুলোকে সহ্য করার ক্ষমতা রাখতে পারে না।

তবে এই কাসিয়া নিজের জীবনকে স্বাভাবিক রাখতে আর সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে সুস্থ জীবন যাপনের জন্য নিজের পরিচয় শুরু থেকেই সবজায়গা গোপন রাখে। এমনকি জীবনের প্রথম প্রেম হিসেবে সে যাকে ভালোবাসে তাকেও সে কখনো নিজের আসল পরিচয় জানায় নি। শুধু ভয় ছিলো একটাই, যদি তার সত্যিটা জানতে পেরে তার ভালোবাসা তাকে ছেড়ে চলে যায়!

কেননা তার ভালোবাসার মানুষটা ছিলো তার চেয়েও বেশি সহজসরল আর একদম সৎ মনের মানুষ। তার মতো মানুষের সাক্ষাৎ পৃথিবীতে হয়তো খুব কম মানুষই পেয়েছে। বাংলাদেশী বলে কথা!”

এইটুকু বলেই কেনীথ চুপচাপ মনোযোগী হয়ে থাকা আনায়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। কেনীথের চোখেমুখে এখন অন্যরকম প্রতিচ্ছবির আবির্ভাব ঘটেছে। একদিকে হাসোজ্জল চোখমুখ অন্যদিকে তাচ্ছিল্য আর কষ্ট। কেনীথ পুনোরায় বলতে লাগলো,

তৈমুর শিকদারের একমাত্র ছেলে ভাহিদ শিকদার। যাকে খুব ছোট থাকতেই তৈমুর শিকদার দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দেন নিজের এক পরিচিত আত্নীয়র কাছে। কারণ সেইসময় তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না যে কারণে ছেলেকে একপ্রকার দত্তক সরূপ তিনি বিদেশে পাঠিয়ে দেন। এরপর যখন ধীরে ধীরে তৈমুর শিকদারের ছোট্ট বিজনেসটা দাঁড়িয়ে যায় তখন তিনি এসে ঢাকায় নিজের বিজনেস সহ বাড়ি বানিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করে। আর তৈমুর শিকদার কিংবা তার স্ত্রীর আত্নীয় স্বজন রইলেও, প্রেম করে বিয়ে করায় সে এবং তার স্ত্রী দুজনেই হয়েছিলো ত্যাজ্য। যে কারণে তাদের পরিবার বলতে তখন কেউ নেই।

এরইমাঝে তার ছেলে ভাহিদকে আর দেশে ফিরিয়ে আনা হয়নি। ছেলে তাদের দেশের বাহিরেই বেড়ে উঠছে কিন্তু ঢাকায় নিজেদের পরিচিতি গড়ে ওঠার আগেই তারা তাদের ঘরে আরো একজন সন্তান সরূপ বাচ্চাকে নিয়ে আসে। নিজের ছেলের শূন্যস্থান পুরনে রেল স্টেশনে কুড়িয়ে পাওয়া সেই বাচ্চাকেই নিজের সন্তানের পরিচয়ে বড় করতে থাকেন।আর সেই ছেলেরই নাম দেয় তারেক শিকদার। যাকেই পাড়াপ্রতিবেশি কিংবা এলাকা-শহরের সবাই তৈমুর শিকদারের একমাত্র ছেলে হিসেবেই জানতে থাকে।

এদিকে বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। একটা সময় তৈমুর শিকদারের স্ত্রী দুনিয়া ছাড়েন। কিন্তু তখন তার নিজের ছেলে ভাহিদ একদম ছোট। যে কারণে মায়ের হঠাৎ মৃত্যুতে সে দেশে আসেনি। অবশ্য সে সময় সে জানতোই না যে তার আসল বাবা কোথায়। সে ছোট ছিলো বিধায় এটা তাকে জানানো হয়নি।

তবে পরবর্তীতে ভাহিদ বড় হওয়ার পর তাকে সব সত্যি জানানো হয়। এতোদিনে অবশ্য সে স্কলারশিপ পেয়ে রাশিয়ায় পড়াশোনায় ব্যস্থ। তবে সত্যি জানার পর এবং মাকে দেখতে না পারায় সে খানিকটা কষ্ট পেলেও তৈমুর শিকদারের প্রতি তার কোনো আক্ষেপ ছিলো না। কারণ এবার তৈমুর শিকদার নিজেও অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। যে কারণে এবার নিজের ছেলে ভাহিদকে দেখার ইচ্ছে জেগেছিলো।

এদিকে ভাহিদও আর দেরী না বাংলাদেশের ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে পৌঁছানোর দু’দিন পেরোনোর আগেই তৈমুর শিকদারও পৃথিবী ছাড়লেন। পরিস্থিতি এমন ছিলো যে সে সময়ও কেউ জানতো যে তৈমুরের আসল ছেলে কিংবা আরো কোনো ছেলে রয়েছে। তারেকও এতোদিন এসব জানতো না। ভাহিদ ফেরার পর তৈমুর শিকদার সব সত্য বলার পর তারেক জানতে পারে যে সে তৈমুর শিকদারের নিজের ছেলে নয়। এসব জানার পর তারেকের মাথায় কি চলতে থাকে তা জানা নেই। তবে সে অতন্ত্য কুবুদ্ধি সম্পূর্ণ ব্যক্তি ছিলো।

এরপর সবকিছু পুনোরায় স্বাভাবিক চলতে থাকে। দুদিন দেশে থাকা পর ভাহিদ পুনোরায় রাশিয়ায় চলে যায়। বছরের পর বছর যেতে থাকে। একটা সময় পর ভাহিদের সাথে পরিচয় হয় কাসিয়ার। এরপর স্বাভাবিক ভাবেই তাদের মাঝে বন্ধুত্ব তৈরি হয় অতঃপর ভালোবাসা। এরমাঝে কাসিয়া আর ভাহিদকে নিজের পরিচয় সম্পর্কে সঠিক কিছু না জানালেও ভাহিদ কাসিয়াকে সবকিছুই বলেছিলো। এরপর দুজনের মাঝে আরো কিছুদিন সম্পর্ক চলার পর তারা দুজনে বিয়ের সিন্ধান্ত নেয়। কিন্তু কাসিয়া যেহেতু ভিন্ন ধর্মের ছিলো তাই ভাহিদ এ বিষয়ে কাসিয়াকে আগেই জানিয়েছিলো। কাসিয়াও আর এতে দ্বিমত করেনি। ভালোবাসার জন্য ধর্ম পরিবর্তন করে কাসিয়া থেকে হয়ে যায় কাশফিয়া। এরপর দু’জন মিলে বিয়েও করে নেয়। আর বিয়ের পরে গিয়ে কাসিয়া অর্থাৎ কাশফিয়া নিজের স্বামী ভাহিকে নিজের আসল পরিচয় জানায় এবং ভাহিদকে নিজের পরিবারের সাথে দেখা করাতে চায়।

কাশফিয়ার সকল সত্য জানার পর ভাহিদ দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায় কিন্তু সে আর কখনোই কাশফিয়াকে ছাড়তে পারবে না। ভালোবাসার চেয়ে একটু বেশিই মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলো। এমনিতেও ভাহিদের তখন পরিবার বলতে বাংলাদেশের ভাই সরূপ তারেক আর অন্যদিকে শুধু কাশফিয়া। পরবর্তীতে ভাহিদ নিজেকে বুঝিয়ে সব কিছুতে মানিয়ে নেয়। এদিকে কাশফিয়াও নিজের পরিবারকে সব কিছু জানায়। কাশফিয়ার পরিবারও আর তখন কোনো দ্বিমত পোষণ না করে সুন্দর ভাবেই সব মেনে নেয়। কারণ তারা ভাহিদের সম্পর্কে সব খোঁজখবর আগেই নিয়ে ফেলেছিলো। একজন মাফিয়ার মেয়ে হয়ে যে ছেলের জন্য ধর্ম পর্যন্ত ছাড়লো তারা সেই ছেলের সঠিক খোঁজ খবর না নিয়েই তাদের মেয়ে দিয়ে দিবে এটা তো অসম্ভব। নিত্যন্তই ভাহিদ ভালো ছিলো বিধায় নিজের জীবন না হারিয়ে কাশফিয়াকে পেয়েছিলো। যে কারণে কাশফিয়ার পরিবারের ভাহিদকে মেনে নিতে কোনো আপত্তি ছিলো না।

এরপর রাশিয়াতেই তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন চলতে থাকে। কাশফিয়া চাইলেই ভাহিদকে নিয়ে নিজের পরিবারের সাথে গিয়ে থাকে পারতো কিন্তু তারা এমনটা করেনি। আলাদাভাবে সাধারণ মানুষের মতোই ছোটখাটো বাড়িতেই তারা নিজেদের নতুন সংসার সাজিয়ে নেয়। তবে মাঝেমধ্যে সময় সুযোগ হলেও দুজনে মিলে কাশিয়াদের বাড়িতে গিয়ে থাকতো। এরপর আর কি! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের ছোট্ট সংসারে আরো এক নতুন সদস্যের আগমন হয়। কাশফিয়া আর ভাহিদের একমাত্র ছেলে,যার নামই হলো ভিভান শিকদার।

ভিভান ছেলেটাও তার বাবা মায়ের মতো ছিলো। বরং তাদের চেয়েও খুব সহজসরল, বোকাসোকা টাইপের। আর অনেকটা ভীতু। যখন ভিভান কিছুটা বড় হলো, বেশি না ছয় কিংবা সাত বছর। ঠিক তখন প্রথমবারের মতো সে বাংলাদেশে এলো। সঙ্গে শিকদার বাড়িতেও প্রথম বারের মতো ভিভান আর তার মা কাশফিয়ার প্রথম আগমন। এতোদিনে ভিভানের বেশভূষা হয়েছে আরেকটু পরিবর্তন। বোকাদের মতো চোখে কালো রংএর মোটা ফ্রেমের বড় গোল চশমা। ঢিলেঢালা জামাকাপড় সবমিলিয়ে দেখতে একদম গাধার মতো।

দেশে যাওয়ার পর পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ জানে না শিকদার বাড়িতে কি হচ্ছে। শুধু চারপাশে সোরগোল পড়ে গেলো এই নিয়ে, যে শিকদার বাড়িতে এক নতুন বাংলাদেশীর সাথে দুজন বিদেশির অতিথি এসেছে। বাড়ি থেকে বের হইলেই সোরগোল পড়ে যেতো। ভিভান নামের ছেলেটাকে কেউ একা পেলেই কখনো ফর্সা নাক, গালটা টেনে লাল বানিয়ে দিতো কখনো আবার গোলগোল চশমাটা নিয়ে টানাটানি। ভিভানও তখন একটা গাধা ছিলো, এই নিয়ে সবার মধ্যেই ভে করে কেঁদে ফেলতো।”

এইটুকু বলেই কেনীথ আনায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। কেনীথকে দেখে মনে হচ্ছে এসব যেন তার চোখে ভাসছে। চোখমুখের এক অদ্ভুত জলুস। অন্যদিকে পুরো গল্পের মাঝে আনায়া নিজের বাবার গল্পটুকু শুনে বিস্মিত। কেনীথ ঠিক কি বলতে চাইছে সেই আগ্রহেই বসে রইছে সে।

“তারেক শিকদার তখন নিজেও বিয়ে করে নিয়েছে। একজন পরিবারহীন সহজসরল মেয়েকে। তারেক শিকদারকে বোকাসোকা ছেলে ভিভানের প্রথম থেকেই তেমন একটা ভালো লাগতো না তবে তার স্ত্রী অনুকে ভিভানের বেশ পছন্দ হয়েছিলো। সত্যিই তিনি অনেক বেশি ভালো ছিলো। ভিভানকে একদম নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতো। সঙ্গে ভিভানের বাবা মাকেও অনেক বেশি শ্রদ্ধা করতো। আর সে সময় তারেকের স্ত্রী অনু ছিলো অন্তঃসত্ত্বা। এবং ভিভানরা বাংলাদেশ থাকতেই তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। কন্যা সন্তান হয় তাদের। দেখতে অনেক সুন্দর ছিলো,একদম পুতুলের মতো। ভিভানেরও বেশ পছন্দ হয়েছিলো ওকে। প্রথমবার দেখে মনে হচ্ছিলো একদম তারার মতো জ্বলজ্বল করছে।

এরপর যখন ওর নাম ঠিক করার পালা হলো তখন সবাই ওর নাম দিলো আনায়া শিকদার কিন্তু ভিভান ওর জন্য আরো একটা নাম ঠিক করলো। আনায়া যখন হয়েছিলো তখন রাতের বেলা আর আকাশে ছিলো সেদিন অনেক তারার মেলা। ভিভানও আর বেশি না ভেবে মেয়েটার নাম রেখে দেয় তারা।

এরপর আর বেশিদিন সেখানে ভিভানরা থাকেনি। অল্প দিনের মাঝেই আবার তারা রাশিয়ায় ফিরে যায়। এরপর তারা আবারও বাংলাদেশে ফিরে আসে। তবে এবার একটু বেশিদিনের ছুটি নিয়ে। এর মাঝে কেটে গিয়েছে আরো আড়াই তিন বছর। সেই আগের মতো রয়ে গিয়েছে গাধা ভিভানটা। কিন্তু ভিভান শিকদার বাড়িতে গিয়ে দেখে ভিন্ন কাহিনি। তারা ততদিনে হেঁটে লাফিয়ে বেড়ায়। কথাও বলে পটরপটর করে। এতো বেশি চঞ্চল তারাকে ভিভানের ঠিক পছন্দ হলো না। সে হয়তো তার মতোই গাধী সরূপ কাউকে চাইছিলো। কিন্তু তার পছন্দ হওয়া কিংবা না হওয়াতে তেমন লাভ হলো না।

দুদিন যেতে না যেতেই তারার অত্যা*চারে ভিভান অতিষ্ঠ হয়ে পড়লো। সারাক্ষণ তারা চুইংগামের মতো ভিভানের পেছনে লেগে রইলো। একটা সময় গিয়ে ভিভান এসব মানিয়ে নিলো। ওরও তারার অদ্ভুত কর্মকাণ্ড ভালোই লাগতো। এতো ছোট-বড় থাকার পরও তাদের ভালোই অদ্ভুত একটা বন্ধুত্ব জমে উঠলো। তবে এরই মাঝে তারেক শিকদার করে ফেলেছিলো নতুন পরিকল্পনা। সে গিয়ে ভিভানের বাবা মায়ের কাছে এক অদ্ভুত প্রস্তাব রাখে। অতো ছোট তারা আর ভিভানের নাকি বিয়ে দিবে। আর এতে তার উদ্দেশ্যই হলো যেন তাদের মধ্যে আজীবন আত্মীয়তার সম্পর্ক থেকে যায়।

তার এই প্রস্তাবে ভিভানের বাবা মা দুজনেই যথেষ্ট অবাক হয় তবে তারেকের সহজসরল কথায় একটা সময় দুজনেই গলে যায়। তারেকের কথাই ছিলো তারা আর ভিভানের শুধু একটা ধর্মীয় ভাবে বিয়ে করিয়ে রাখবে। আর ওরা যখন বড় হবে তখন ওদের আবার নতুন করে বিয়ে দেওয়া হবে। তার এই প্রস্তাবের পেছনে যে মূল উদ্দেশ্য কি ছিলো তা হয়তো সহজসরল কাশফিয়া আর ভাহিদ কখনোই বুঝতে পারেনি। আর যখন বুঝেছে ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।

তারেকের একটামাত্রই উদ্দেশ্য ছিলো তা হলো শিকদার বাড়ি আর কিছু সম্পত্তি। যখন থেকে সে জেনেছিলো সে শিকদার বাড়ির ছেলে নয় তখন থেকেই তার মাথা প্যাচ লাগতে শুরু করে। কি করবে না করবে কিছুই হয়তো বুঝতে পারেনি। একটা সময় নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলেও যখন দেখলো ভাহিদ তার ছেলে স্ত্রী নিয়ে দেশে আসছে, অন্যদিকে তার নিজের ঘরে এখন বউ মেয়ে। তখন সে পুরো উন্মাদ। তার ধারণা ছিলো শিকদারের সব সম্পত্তি ভাহিদ পাবে আর সে কানাকড়ি না পেয়ে পথের ফকির।

গাধাটা হয়তো কল্পনাও করেনি যে শিকদারের ঐ সামান্য সম্পত্তি কাশফিয়ার পরিবারের সম্পত্তির ধারেকাছেও ঘেঁষে না। অথচ উন্মাদের মতো সে কি করলো!…শয়তান একটা! পি*শাচ একটা!

এটুকু বলেই কেনীথ রাগে ফুঁসে উঠলো। আনায়া বিস্মিত, চরম বিস্মিত সে। কেনীথ এসব কি বলছে তা যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তার কিনা আগেই কারো সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে?

“শয়*তানটা তারা আর ভিভানের বিয়েটা দিয়েছিলোই মূলত শিকদারের সম্পত্তি নিজের আয়ত্তে রাখার জন্য। যেহেতু ভাহিদের পর সব সম্পত্তি ভিভানের হবে তাই নিজের মেয়েকে কাজে লাগিয়ে তার এই পরিকল্পনা। তবে এতে তো আর সরাসরি সে সম্পত্তি পাচ্ছে না৷
মূহুর্তেই সে আবার অস্থির হয়ে উঠলো। গোপনে নিজের মেয়ে আর ভিভানকে বিয়ে দেওয়ার পর সে নতুন পরিকল্পনা কষতে লাগলো। মূলত তারেকের মাথায় সমস্যা ছিলো। ও একটা শয়তানের পাশাপাশি একটা পাগল ছিলো। যে কারণে এবার তার পরিকল্পনাও হলো চরম জ*ঘন্য।

তারেক সরাসরি ভিভানের বাবা মায়ের সাথে সম্পত্তি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুরুতেই একপ্রকার ঝামেলা করলো। সম্পত্তির জন্য উম্মাদ হয়ে সে তাদের সাথে অসভ্যের মতো বিহেভ করলো। একপ্রকার শাসিয়ে তাদের বললো যেন সব সম্পত্তি তারেকের নামে দিয়ে দেওয়া হয়। এতে ভাহিদ অবাক হলেও তারেকের বিহেভিয়ারের পর সে নিজেও মাথা গরম করে রাগারাগি করলো।

এরপর একপ্রকার রাগারাগি করেই সিন্ধান্ত নিলো যে ভিভানরা আবার রাশিয়ায় ফিরে যাবে। রাশিয়ায় ফিরে যাওয়ার খবর পেয়ে তারেক আরো উম্মাদ হলো। ভাবতে লাগলো একে তো সম্পত্তি পাবে না আর এখন এই রা*গারাগিতে যদি মেয়ের বিয়েটাও আর কাজে না লাগে তো সে সব দিক থেকে এখন সব হারাবে।

যে কারণে রাশিয়ায় ফেরার দুদিন আগে সেই ঘটলো সেই কালরাত্রির আগমন। গভীর শীতের রাত, সে তারেকের সাথে আর ভাহিদের কোনো কথাবার্তা নেই। তারেকরা নিচে আর ভাহিদরা উপরে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে নিচের তলায় আলাদা করে রুমের ভেতরে তারার মা, তারা আর ভিভান শুয়েছে। তারা ঘুমিয়ে গেলেও তারার মা ভিভানকে এখনো গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। ভিভানের ঘুম আসছে না, আবারও ফিরে যেতে হবে বিধায় মন খারাপ। তবে সে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রইছে তারার মায়ের দিকে। অন্যান্য দিনের চেয়ে তাকে অদ্ভুত লাগছিলো। চোখজোড়া লাল লাল, যেন ভেতরে অনেক কষ্ট কিন্তু কাঁদতে পারছে না। ভিভান এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো তবে সে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এবং তাকে এটা বলে সে যেনো ভুলেও ঘর থেকে বাহিরে যা বেড়োয়। সে সময় অবশ্য তিনি আবারও অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ছিলেন। যে কারণে কিছুটা অসুস্থ আর দূর্বলও মনে হলো।

গল্প শোনানোর একটা পর্যায়ে গিয়ে তারার মা-ও ঘুমিয়ে যায়। এদিকে ভিহাদের চোখে ঘুম নেই, তার আর একা একা ভালোও লাগছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিভানের ছটফটানি শুরু হয়ে যায়। হঠাৎ বাবা মায়ের সাথে একবার দেখা করে আসার ইচ্ছে জাগে। সে তার ইচ্ছে মতো চুপ করেই ধীরে ধীরে দোতলায় পৌঁছে যায়।

এরপর জীবনের সবচেয়ে কলুষিত অধ্যায়টাকে তার নিজ চোখেই দেখতে হয়েছিলো। নিজ চোখে তারেকের হাতের কাশফিয়া আর ভাহিদের ভয়ং*কর মৃ*ত্যু। মূলত ঘুমানোর আগেই তাদের খাবারে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আর তারা আধ ঘুমে থাকতেই তারেক সুন্দর করে তাদের রুমে গিয়ে প্রোপার্টির পেপারে ভাহিদকে দিয়ে সাইন করিয়ে নিতে চায়। ভাহিকে দিয়ে ঘুমের ঘোরে কি করানোছিলো তা প্রথমে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে না পারলেও তার হুস হতেই তাকেই সে রাগারাগি করতে গেলে তারেক ত্বরিত ভাহিদকে শ্বাসরুদ্ধ করে মে*রে ফেলে। এরপর সে কাশফিয়াকেও মেরে ফেলার সিন্ধান্ত নেয়। যে কারণে সে কাশফিয়াকে ঘুমের মাঝেই গলা চেপে ধরে। কাশফিয়া ছটফট বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ ছটফট করে কিন্তু তারেক ছাড়ে না। একটা সময় তারেক কাশফিয়াকেও শেষ করে ফেলে।

আর করিডরের জানালার ফাঁক দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাধা ভিভান এসব শুধু দেখেই যায়। শা/লা গাধাটা এতোই গাধা ছিলো যে ওতো বড় বদল হওয়ার পরও ও কিচ্ছু করেনি। উল্টো মৃগী রোগীর মতো কেঁপেছে।

শুধু এইটুকুই নয়, তারেক কাশফিয়ার মে*রে ফেলার পর তার প্রাণহীন দেহটাকেও ছেড়ে দেনি। রাশিয়ান পরী বলে কথা। ওমন রুপের সচারাচর দেখা কোথায় মেলে। তারেকও লোভ সামলাতে পারেনি। শয়/তানটার আগে থেকেই সমস্যা ছিলো। কু//ত্তাটা শেষ পর্যন্ত কাশ*ফিয়ার মৃত দেহকে ছিড়ে*খুঁড়ে খেয়েছে। আর এসব কিছু গাধাটা নিজ চোখে তাকিয়ে দেখেছে অথচ কিচ্ছু করেনি। ইচ্ছে তো করছে গিয়ে গাধাটারে গিয়ে দুইটা দিয়ে আসি।

যাই হোক, এরপর যখন তারেকের লা/শ গায়েবে পালা। শান্ত মাথায় নতুন পরিকল্পনা কার্যকর করতে লাগলো। বড় বড় ধারালো অ*স্ত্র নিয়ে এসে প্রথমে ভাহিদের মাথাটা ঘাড় থেকে এক কোপে বিচ্ছিন্ন করলো। এরপর সে মাথাটাকে নিজের পা দিয়ে নাড়াচাড়া করে অদ্ভুত ভাবে পৈশাচিক হাসিতে হাসতে লাগলো।

এরপর একই ভাবে কাশফিয়ার সাথেও একই কাজ করতে ধরলো। কাশফিয়ার ন/গ্ন বিধ্বস্ত বুকে পা দিয়ে চেপে নিমিষেই ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেললো। এরচেয়ে বেশি কিছু দেখার ক্ষমতা আর ভিভানের হয়নি। গাধাটা কিছু করতে না পেরে কাঁপতে কাঁপতে নিচে চলে আসে। এসবকে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধতা নাকি গাধামি বলে তা জানা নেই। কিন্তু গাধাটি কিছু একটা তো করতে পারতো। নিজের বাপ মাকে কেউ চোখের সামনে শেষ করে ফেললো আর গাধাটা কিনা কিছুই করতে পারেনি? এই আফসোস কোনোদিনও শেষ হবার নয়।”

এবার কেনীথের চোখে স্পষ্ট জল টলমল করছে। মুখে ঝুলছে তাচ্ছিল্যের হাসি। হাসির গভীরতা যেন অনেক বেশি। সঙ্গে কেনীথের মতো লোকের চোখে পানি, তাও যেন এক দুষ্প্রাপ্য বিষয়। এদিকে আনায়াও শব্দহীন কেঁদে চলেছে। কেনো কাঁদছে জানা নেই। কিন্তু কেনীথ কথা থামাতেই আনায়া ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলতে লাগলো,

“মিথ্যা বলছেন আপনি! আপনি বানিয়ে বলছেন এসব। আমার বাবা এসব করেনি। আর কে এই ভিভান। চিনি না আমি এদের। আমার কারো সাথে বিয়ে হয়নি। সব মিথ্যা এগুলো।”

কেনীথ মূহুর্তেই আনায়ার দিকে ফুঁসে উঠলো। চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। একহাতে আনায়ার গাল চেপে ধরে বলতে লাগলো,

“এখনো বাপের হয়ে সায় গানা করছিস? বলছিস ঐ কু//ত্তাটা ভালো। ওর কোনো দোষ নেই। তাহলে শোন, ও এতোটাই জা/নো/য়ার যে নিজের সন্তানকেও পর্যন্ত ও মে/রে ফেলেছে।

আর বলছিস ভিভান কে? তাকে তুই চিনিস না? আর আমি কেনো এদের গল্প শোনাচ্ছি তাই তো?

তুই একটা কথা জানার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলি? আমি কে?আমার সাথে তোর কিংবা তোর বাপের সম্পর্ক কি? ”

আমায়া কিছু বললো না বরং সে এখনো কেনীথের দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে। এদিকে কেনীথ আনায়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো এবং আনায়ার গাল ছেড়ে দিলো।
“আচ্ছা তুই এটা বলতে পারিস কি, আমাকে যে পুরো দুনিয়া ভিকে নামে চিনে এই ভিকের ভি এর অর্থ কি? K তে তো কেনীথ কিন্তু V তে? শুধুই কি রক্ত পিপাসু ভাম্পায়ার নাকি অন্যকিছু?”

এবারও আনায়ার কোনো জবাব নেই। তবে আনায়া হয়তো এবার কিছুটা হলেও হিসেব মিলাতে পারছে। তবে সে কিছু বলার আগেই কেনীথ ওর ভাবগতিকে পুনোরায় হাসলো।

“থাক আমিই বলছি। তোর ছোট্টো বেলার এবং সারাজীবনের একমাত্র বিয়ে করা বর আমিই। ভিভান মানের সেই গাধাটা আর কেউ নয় বরং আমিই। আমিই ভিভান শিকদার কেনীথ।”

#চলবে