একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৪২ (সমাপ্তি পর্ব→(০৮ অংশ এবং শেষ অংশ) )

0
40

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

সমাপ্তি পর্ব—[ ৮ম ও সর্বশেষ অংশ]

আনায়া রান্না করতে ভীষণ ব্যস্ত। কাজ করতে করতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। এরইমাঝে কেনীথ কাইরাভকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে আসে। কাইরাভকে দেখেই আনায়া চুলোর আঁচটা কমিয়ে দেয়। ওদিকে মাকে দেখে যেন কাইরাভও ছটফট করে ওঠে। তার ছটফটানি দেখে কেনীথ মনে মনে বলে,

❝একদম মায়ের গুনধর পুত্র। এখন এমন একটা কাহিনি করছে যেন—এতোক্ষণ আমি তাকে কতই না কষ্টেই রেখেছিলাম।❞

এদিকে আনায়া ঘেমে গিয়েছে বিধায়, আর এই শরীরে কাইরাভকে কোলে নিতে চাইল না। সে কাইরাভের মুখোমুখি এলেই, কাইরাভ তার দিকে ঝুকে দুহাত বাড়িয়ে কোলে যেতে চায়।

—❝আ আ মা মাম মা মা।❞

কাইভের এহেন আধো আধো বুলিয়ে, আনায়া তার দিকে ঝুঁকে অনুনয়ের স্বরে বলে,

❝ওলে বাবাটা আমার। মাম্মাম কোলে নেবে তো তোমায়। কিন্তু আরেকটু সময় দাও। আমি এই তো কাজ শেষ করেই, টুপ করে গোসল দিয়ে তোমাকে কোলে নেব৷ নয়তো দেখো মাম্মাম কেমন ঘেমে গিয়েছে। গায়ে তো নোংরা লেগে যাবে,তাই না?❞

আনায়ার কথায় যেন কাইরাভের মন ভেঙ্গে যায়। আলতোভাবে ভারী শ্বাস ফেলে, কেনীথের কাঁধের কাছে আলতোভাবে মাথা ঠেকিয়ে দেয়৷ এবং অপলক চেয়ে থাকে আনায়ার দিকে। এদিকে আনায়ারই যেন নিমিষেই খারাপ লাগা কাজ করতে থাকে। সে ঠোঁট উল্টে বলে,

❝আমার সোনা বাবা, এভাবে মন খারাপ করো না প্লিজ।❞

আনায়া আর বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করে না। সে দ্রুত আবারও রান্নার কাজে মন লাগায়। আর বেশিক্ষণ সময় নেওয়া যাবে না। সেই সকাল থেকে ছেলের থেকে দূরে সে।

এদিকে কেনীথ এতোক্ষণ দুজনের মাঝে নিরব দর্শক হয়ে থাকলেও, এখন সে পেছন হতে আনায়ার কাছে এগিয়ে যায়। এবং স্বভাবগত কারনে, বরাবরের মতোই সে আনায়ার একপাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে চোয়াল ঠেকিয়ে দেয়।ওমনি আনায়া কপাল কুঁচকে পাশে ফিরে বলে,

❝উফ কি করছেন? দেখছেন এই হাল আমার,তবুও?❞

—❝কি হয়েছে,আমার কাছে তো সব ঠিকঠাকই লাগছে।❞

কেনীথের নির্বিকার অভিব্যক্তিতে আনায়া গম্ভীর স্বরে বলে,

❝আপনার তো সবকিছুই ঠিকঠাক লাগে। ছেলেকে নিয়ে ঘরে যান। বিরক্ত করবেন না!❞

—❝কি আশ্চর্য, বিরক্ত কখন করলাম তোকে?❞

—❝তো কি করছেন? এখানে আপনার কি কাজ?❞

—❝আমি আমার একমাত্র বউয়ের কাছে এসে ঘষাঘষি করছি। কারণ এখানে আমার সেই গুনধর একমাত্র বউটা আছে।❞

কেনীথের মশকরায় আনায়া চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

❝কে আপনি, কে আপনার বউ?❞

আনায়ার কথায় কেনীথ মৃদু হেসে বলে,

❝আমি একজন শান্তশিষ্ট, পত্নী নিষ্ঠ ভদ্রলোক।
এক যে ছিল ঠ্যাংওয়ালা চেংরী, সে যে আমার একমাত্র বউ।❞

দুজনের কথোপকথনের মাঝেই আচমকা অরিন রান্নাঘরে দৌড়ে প্রবেশ করে। তবে তার ভাবগতিক কিছুটা ভিন্ন। কেমন যেন এসেই ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে ওঠে,

❝মাম্মামমম, পাপাআআআ!❞

অরিনের এহেন অভিব্যক্তিতে কেনীথের কপাল কুঁচকে যায়। একটু আগেই তো তাকে হাসতে, খেলতে দেখল। এখনই আবার কি হলো।এদিকে আনায়া কপাল কুঁচকানোর পাশাপাশি কিছুটা বিরক্তির স্বরে বলে,

❝কতবার বলেছি, এভাবে কথা বলবে না। লোকে ন্যাকা বলবে তোমায়।❞

আনায়ার কথা শুনে নিমিষেই অরিন স্বাভাবিক হয়। ইদানীং এখানে আসার পর সে যেন, অনেকটাই আহ্লাদী হয়ে উঠেছে। এদিকে কেনীথ আনায়ার কথা শুনে, তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে মনে মনে আওড়ায়,

❝ ইঁশ! কি ঢং! সারাজীবন নিজে ন্যাকামি করে করেই আমার জীবনটা ঝালাপালা করল। আর এখন আমার মেয়েকেই শেখাতে এসেছে, কিভাবে কথা বলতে হয়।❞

এদিকে অরিন আগপাছ সকল কিছু ছেড়ে,কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে,

❝পাপাআআ।❞

কেনীথও মেয়ের আহ্লাদের সাথে তাল মিলিয়ে বলে,

❝কি হয়েছে লেডিবাগ?তোমাকে এমন কেনো দেখাচ্ছে?❞

—❝পাপা আমি বিয়ে করব।❞

অরিনের এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল, সম্পূর্ণ আবটাকে পরিবর্তনের জন্য। কেনীথ অরিনের কথায় খানিকটা কেশে উঠলেও, আনায়া যেন তার দিকে তেড়ে এলো। একহাতে কাঠের খুন্তি, আরেক হাত কোমড়ে। কপাল কুঁচকে একবার অরিনকে দেখছে, তো পেছনে ফিরে কেনীথকে। পরক্ষণেই সে অরিনের উদ্দেশ্য সন্দিহান স্বরে বলল,

❝কিহ? বিয়ে করবে মানে?❞

—❝বিয়ে করব মানে বিয়ে করব।আমি বিয়ে করব পাপাআআ।❞

আনায়া বিস্ময়ে আবারও পেছনে ফিরে কেনীথের দিকে তাকায়। কাইরাভের মতো যেন সে-ও নিরব দর্শক। এদিকে আনায়ার চাহনিতে কেনীথ আবারও কেশে ওঠে। এদিকে আনায়া এবার রাগান্বিত স্বরে বলে,

❝পাপা পাপা করিস কেনো? মায়েরে চোখে পড়ে না? আর কিসের বিয়ে? বিয়ে কি আদোও বুঝিস তুই?❞

আনায়া এমন অভিব্যক্তিতে অরিনের চোখ-মুখ আরো বেশি কষ্টে ফুলে ওঠে। সে আনায়া হতে নজর সরিয়ে কেনীথের দিকে তাকিয়ে বলে,

❝পাপা তুমি কিছু বলো।❞

—❝আবার পাপা…❞

এই বলতে না বলতেই, সে পেছনে ফিরে কেনীথকে দেখে। তার তীক্ষ্ণ নজর এখন কেনীথের দিকে। কিছুটা সন্দেহের সাথে আনায়া কেনীথের উদ্দেশ্য বলে,

❝ও হঠাৎ বিয়ে বিয়ে করছে কেনো?কি বলেছো তুমি ওকে? কি শিখিয়েছো বলো?❞

—❝আরেহ আমি কি শেখাতে যাব। আমি কিছুই…❞

—❝মিথ্যে বলবে না, তোমাকে আমার একটুও বিশ্বাস নেই। কতবার বলেছি ঐ টুকু বাচ্চা মাথায় উল্টোপাল্টা কোনো কিছু ঢোকাবে না।❞

—❝সিরিয়াসলি আনায়া? এতো বেশি রিয়েক্ট করার মতো কিছু হয়নি। আমি শুধু বলেছি, ও বড় হলে ধুমধাম করে বিয়ে দেব। দ্যান…ঐ ফিউচার প্ল্যানিং আরকি।❞

—❝তো কে করতে বলে এসব ফিউচার প্ল্যান? মেয়েটার মাথা পুরোপুরি খেয়েছো। আমার ভাবতেও তো অবাক লাগে, তোমাকে বাপ বানিয়েছিল কে?❞

কেনীথ এবার বিরক্তির স্বরে বলে,

❝হয়েছে চুপ কর এবার। বেশি হয়ে যাচ্ছে। ❞

—❝কি চুপ করব আমি? সারাদিন শুয়ে বসে থাকবে আর স্বয়ং ইবলিশের আস্তানা মাথায় পালবে। এছাড়া তোমার আর কি কাজ আছে?❞

—❝আরেহ, এতো কেনো সিনক্রিয়েট করছিস? আমি তো ভালোর জন্যই বলেছি। মেয়ে তো একদিন বড় হবে তাই না? তো এখন থেকেই যদি আদব-কাদয়া না শেখাই, তাহলে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকজন তো বলতে পারে… ❞

—❝জ্বী, স্বয়ং বাপ যখন এতো উত্তেজিত তাহলে মেয়ের উত্তেজনা কোথায়,তাই তো?❞

কথা শেষ হবার পূর্বেই আনায়া নিজের কথাটুকু বলে দেয়। এরপর আর কেনীথের যেন চেয়েও কিছু বলার থাকে না। এদিকে বিয়ের কথা বলতে এসেই, এতো কিছু দেখে অরিন ভীষণ হতাশ হয়। কেননা সে যে তার এ্যাশ ভাইকে বিয়ে করতে চায়, তাই তো বলা হলো না।

_______

বিকেল হয়েছে, লুসিয়া তার পুতি-পুতনিদের নিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। অরিন একের পর এক হাসি মজার গল্প বলে যাচ্ছে আর লুসিয়াও তাতে সমান তালে তাল মেলাচ্ছে। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে সে, তীব্র ভাবে অনুভব করে যে—জীবনের সার্থকতা মূলত এসবের মাঝেই। সারাটা জীবন এতো ধন-সম্পদ,ক্ষমতার মাঝে থাকলেও জীবনে কখনো শান্তি ছিল না। অথচ এখন তার একেকটা নতুন দিনের সূচনাই যেন, নতুন এক জীবনের সূচনা। এতো ভালোলাগা, ভালোবাসা সে কখনো অনুভব করতে পারেনি।

এদিকে এ্যাশ চুপচাপ তাদের সাথেই ড্রইং রুমে বসে রয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস না করলে, খুব বেশি কথা সে বলছে না। ওদিকে আবার লুসিয়ার কোলে বসে থাকা কাইরাভ যেন বেশ উপভোগ করছে সবকিছু। মাঝেমধ্যে নতুন গজানো ছোট দু-তিনটে দাত বের করে খিলখিল করে হেসে উঠছে। সবমিলিয়ে এক পরিপূর্ণ পরিবারে, হাসিখুশি আনন্দময় অনবদ্য এক জীবনের দৃশ্য এটি।

পাহাড়ে ঘেরা গ্রাম এটি। এমনই এক জায়গায় ছোট্ট একটি দোকানের পাশে উঁচু ঢালে বসে রয়েছে রেহান আর ইনায়া। রেহান যতটা সময় পারে দোকানেই থাকে। দোকানটা সাধারণ মুদির দোকানের মতোই। তবে এখানে সময় অতিবাহিত করতে তার বেশ লাগে। ভোর সকালে খেয়ে এখানে চলে আসে। অতঃপর একটানা দুপুর পর্যন্ত থেকে, বাড়িতে যায়। এরপর গোসল আর সবার সাথে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে, পুনোরায় দোকানে এসে পরে। এরপর রাতের খাবারের সময় দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরে। কখনো বা শখ করে দোকানেই থেকে যায়।

যত কিছুই হোক, বাড়িতে একটানা সবার মাঝে থাকতে তার দমবন্ধ লাগে। সবকিছু ছেড়ে এক বিশেষ ব্যাক্তির জন্য টান—তাকে বিষিয়ে তোলে। এতো বছর ধরে চেষ্টা করছে, অতচ কোনো লাভই হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তাকে পুরপুরি ভুলতে পারছে না কেনো, তাই বুঝে উঠতে পারে না।

এদিকে আবার আজ ইনায়ার বাহিরে বের হতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সারাদিন এটা ওটা করে কাটালেও, বিকেলের সময়টা সে চেষ্টা করে দোকানের দিকে আসার। ইনায়া যেহেতু কথা বলতে আর এখন তেমন পছন্দ করে না তাই, তার সাথে রেহানের বিশেষ কোনে কথাও হয়না। আবার কখনো কখনো তাদের কথোপকথন জমে উঠলে,তা বিকেল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা নেমে যায় তা কেউই যেন টেরই পায় না।

দুজনে চুপচাপ বসে ছিল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দুজনের বসার মাঝে ব্যবধানটাও বেশ। ঘাসের উপর চুপটি করে বসে থাকতে থাকতেই, আচমকা রেহান বলল,

❝কাইরাভ, এ্যাশ,অরিন, বাবুশকা—সবাই ভালো আছে?❞

ইনায়া কিঞ্চিৎ বাঁকা হেসে বলে,

❝দুপুরেই তো দেখে এলেন।❞

রেহান আর কিছু বলে না। আলতোভাবে শ্বাস ফেলে আওড়ায়,

❝ হুহ্।❞

আবারও দীর্ঘ সময়ের জন্য দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা জমে। দুজনের নজরই দূরের ঐ আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের দিকে। তবে ইনায়া এবার খানিকটা আগ্রহী স্বরেই জিজ্ঞেস করে,

❝আপুকে এখনো ভুলতে পারেননি তাই না?❞

আচমকা এহেন প্রশ্ন রেহান যেন কিছুটা চমকায়। আনমনে হারিয়ে গিয়েছিল সে। তবে তা ইনায়াকে বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক থাকতে চাইলেও, ইনায়া ঠিকই বুঝতে পারে। ফলাফলস্বরূপ সে পুনোরায় তাচ্ছিল্যের সহিত মুচকি হাসে। তবে রেহান শুধু এইটুকুই বলে,

❝ভুলতে পারলে হয়তো ভালো হতো।কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত এমন কিছুই হয়নি।❞

ইনায়াও এহেন জবাবে এই বিষয়ে আর বেশি কিছু বলে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে,

❝আপনার কাছে একটা জিনিস চাওয়া আছে।❞

ইনায়ার কথায় সে পাশে ফিরে তার দিকে তাকায়। ইনায়াও রেহানের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলে,

❝ আমাকে মাফ করতে পারবেন? ❞

রেহানের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। সন্দিহান স্বরে বলে ওঠে,

❝মাফ! কিসের জন্য?❞

আনায়া রেহানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই পুনরায় নিজের নজর সরিয়ে সামনের দিকে তাকায়। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেয়েও যেন পারে না। কেমন যেন দূর্বল অনুভব হচ্ছে। তবুও চোয়াল দৃঢ় করে বলতে লাগল,

❝রোহান আমার জীবনে বিশেষ কিছু ছিল না। তবে সে যা ছিল, তার চেয়েও বিশেষ কিছু—আমার জীবনে নেই।❞

এইটুকু বলেই সে ভারী শ্বাস ফেলে। আজ অজান্তেই তার বুক ভারী হয়ে উঠেছে। চোখজোড়া হয়ে উঠেছে ঝাপসা। অথচ সে নিজেকে দৃঢ় দেখানোর সর্বচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আরেকটু সময় হাতে ধরে অতিবাহিত করার পর, সে আবারও বলে,

❝ওর কাছে মাফ চাওয়ার কোনো সুযোগ থাকলে চেয়ে নিতাম। ক্ষমা করতো কিনা জানিনা,তবে চাইতাম মাফ।❞

ইনায়া এই বলে আবারও থামে। কথা থেমে থেমে আসছে তার। এমন কঠিন গম্ভীর মানুষের এমন রূপ বিস্ময়কর লাগবে যে কারো কাছে। কিন্তু সে তো ইনায়া। সেই চঞ্চল, প্রানবন্ত ইনায়া। যার চঞ্চলতায় সর্বদা বিরক্ত থাকত পুরো এলাকাবাসী। অথচ সে ইনায়া কিংবা ইরার সাথে আজকের ইনার আকাশ-পাতাল তফাত। সম্পূর্ণটাই যেন শক্ত খোলসে ঢাকা।

এদিকে রেহান কিছুই বলছে না। সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, স্তব্ধ। তৎক্ষনাৎ ইনায়া আরেকটু সময় নিয়ে বলে,

❝তাই মাফটা বরং আপনার কাছেই চেয়ে নিলাম। সম্ভব হলে মাফ করে দিবেন। আর পারলে দোয়া করবেন, তার কাছে গিয়ে যেন মাফ চাওয়ার মতো সুযোগ হয়। নয়তো এই মুক্ত বাতাসেও আমার দমবন্ধ লাগে।❞

এইটুকু বলেই ইনায়া উঠে দাঁড়ায়।দুদণ্ড না দাঁড়িয়ে পা বাড়ায় সামনের দিকে। এক নাগাড়ে হেঁটে চলে বাড়ির উদ্দেশ্যে।খানিকটা দূরে যেতেই, তার চোখ বেয়ে অকস্মাৎ এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। এতে সে নিমিষেই তাচ্ছিল্যের সহিত হাসে। চারপাশের স্বচ্ছ প্রকৃতির মুক্ত বাতাসে তার কাঁধ সমান চুল ও জামার অংশগুলো উড়তে থাকে। আর পেছন হতে রেহান অপলক চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে।

__________

রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চলেছে। অথচ কাইভার এখনো ঘুমায়নি। আনায়ার জান বেড়িয়ে যাচ্ছে তাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে। ছেলেটা বাবার চেয়ে মায়ের ভ’ক্ত বেশি। সামনে মা থাকলে আর কারো দিকে তার নজর নেই। মা ছাড়া সে কিছুই বোঝেনা। যথারীতি এখনো না ঘুমিয়ে, আনায়াকে পুরো অস্থির করে তুলেছে৷ আর পাশে থেকে কেনীথ বসে বসে শুধু এদের কার্যক্রম দেখছে। কারণ এখানে তার করার কিছুই নেই। মা-কে পেলে, ছেলে যেন তাকে শ’ত্রু মনে করে। এই দুঃখ সে কোথায় রাখবে, তা নিজেও জানেনা।

প্রায় আরো খানিকটা চেষ্টার পর অবশেষে কাইরাভ আনায়ার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। আনায়া বিছানার একপাশে বসে রয়েছে। আর তার কোলে ছোট্ট কাইরাভ। পাশেই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছে কেনীথ। নজরটা সিলিং এ ঝুলানো ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে৷ চোখ-মুখে হতাশা। গত কয়েকদিনে জীবনের সবটাই যেন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।

কেনীথ ঘাড় ঘুরিয়ে উদাসীন ভঙ্গিতে একপলক আনায়াকে দেখে। এতোক্ষণ ছেলের থেমে থেমে আসা কান্নার আওয়াজটা বন্ধ হয়েছে। সে খানিকটা ভারী শ্বাস ফেলে। বাম হাতটা এগিয়ে আনায়ার পিঠে এলোমেলোভাবে আঙুল চালিয়ে, অনুনয়ের স্বরে আওড়ায়,

❝হেই ব্লাডডড।❞

কেনীথের মৃদুস্বরেও যেন আনায়া বিরক্ত হয়। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে পাশে ফিরে, কেনীথের উদ্দেশ্যে হিসহিসিয়ে চাপা স্বরে আওড়ায়,

❝সবে মাত্র ঘুমিয়েছে। ছাগলের মতো চেঁচাচ্ছেন কেনো?❞

শেষ!কেনীথ আর একটাও কথা বলে না। নিমিষেই তার চোখমুখ,চোয়াল ও হাতের মুঠো শক্ত হয়। একইসাথে কি যেন ভেবে, নিজের প্রতি খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসে। পুনোরায় সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায়।

এরইমাঝে আনায়া আলতোভাবে কাইরাভকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। অতঃপর মাথার খোঁপাটা আবারও ঠিক করে বাঁধতে বাঁধতে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। এবং এসবের সবটাই কেনীথ আঁড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

______

ওয়াশরুম থেকে আনায়া বেড়িয়ে আসে৷ আনমনে বিছানার কাছে এসে শুতে নিলেই আশ্চর্যে সে সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে যায়। বিছানার মাঝে একটু আগেই কাইরাভকে শুইয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়েছিল। অথচ এখন আর তার ছেলে বিছানায় নেই। সে বিস্ময়ে কেনীথের দিকে তাকিয়ে দেখে—কেনীথ নির্বিকার ভঙ্গিতে বিছানায় তার দিকে কাত হয়ে শুয়ে রয়েছে। আনায়া রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই, কেনীথ ওর এক-পা ধরে সজোরে টান দেয়। এবং চাপা স্বরে আওড়ায়,

❝এদিকে আয়,মাই ঠ্যাংওয়ালা চেংরী।❞

আনায়া পুরোপুরি শোয়া ছিল না। আধশোয়া ছিল বিধায় অল্প টানেই সে কেনীথের দিকে ছিটকে পড়ে। আনায়া নিজেকে সামনে নেবার পূর্বেই কেনীথ ওর হাতদুটো শক্তভাবে বালিশের দুপাশে চেপে ধরে। তৎক্ষনাৎ আনায়ার উপরে কেনীথ চড়ে বসে। কেনীথের এহেন হাভভাবে আনায়া বিস্ময় ও রাগের সংমিশ্রণে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কেনীথের কাছ থেকে ছাড়া পেতে, হাত পা মোচড়ামুচড়ি শুরু করলে,কেনীথ আরো বল প্রয়োগ করে। ওমনি আনায়া চাপা কন্ঠে বলে ওঠে,

❝এসব কি হচ্ছে? মে’রে ফেলব কিন্তু একদম!❞

আনায়ার অভিব্যক্ততে কেনীথ স্বাভাবিক স্বরে বলে,

❝আপনাকে পেয়ে তো আমার প্রতিদিনই ম’রতে হচ্ছে। আর কত মা’রবি?❞

আনায়া কেনীথের কথায় পাত্তা না দিয়ে, সোজাসুজি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

❝বাজে কথা বাদ দাও। ছেলে কোথায় আমার?❞

—❝ছেলে এখন ঠিক জায়গাতেই আছে। রোজের কাছে দিয়ে এসেছি। এতো চিন্তার কিছু নেই।❞

কেনীথের এমন নির্লিপ্ত কন্ঠস্বরে আনায়া বিস্মিত। ভেবেও কূল পাচ্ছে না, বাপ হিসেবে এই কেনীথ কত অপ’দার্থ। সে আবারও মোচড়ামুচড়ি করতে করতে, চাপা স্বরে হিসহিসিয়ে বলে,

❝ছাড়ুন আমায়, রোজের কাছে দিয়ে এসেছেন কোন আক্কেলে? ও আর কত সামলাবে একা হাতে৷❞

—❝বললাম তো এতো চিন্তা করিস না। রোজ আজকের রাতটা সামলে নিক। ভোর হলেই আবার তোর গুনধর পুত্রকে এনে দেব।❞

—❝পাগল হয়ে গিয়েছেন? আপনি জানেন না, মাঝরাতে ও জেগে গেলে কি কান্নাটাই না করে। আজ রাতে এমন কিছু হলে, রোজ কি বিপদে পড়বে বলুন তো।❞

—❝কিচ্ছু হবে না। আমার বাচ্চাকাচ্চা আমার কষ্ট ঠিকই বোঝে। খালি তুই-ই বুঝিস না।❞

কেনীথের এহেন কথায় আনায়া কপাল কুঁচকে বলে,

❝কিসের কষ্ট আপনার? সারাদিন খান-দান,ঘুড়ে বেড়ান। নাকি ছেলেটা মাঝেমধ্যে একটু ধরতে দেই বলে ওটাই আপনার জন্য কষ্টের হয়ে গিয়েছে?❞

—❝এতো কেন বেশি বুঝিস বলতো? ছেলে কি তোর একার? আমি ছাড়া ঐ গুনধর পুত্রের ডাউনলোড হতো এই পৃথিবীতে? কখনোই না। হিসেবে তোরা মা-ছেলের উচিত এইজন্য আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আমি জোর করে কিছু না করলে তো,তুই জীবনেও আমার কাছেই আসিস না।❞

—❝আপনি কি আমার সাথে ফাজলামি শুরু করেছেন? ছেড়ে দিন বলছি। আমি আপনার মতো এতো উত্তেজিত মুডে নেই।❞

—❝ও তো আপনি কখনোই থাকেন না। তাই প্রতিবারই সব কষ্ট আমাকেই করতে হয়। আর যত যাই করেন,আমি আজ আর আপনাকে ছাড়ছি না। সাতদিন ধনে অনাহারে ভুগছি আমি। এখন আপনার জন্য তো আর আমি—আমার মুড নষ্ট হতে দেব না।❞

কে শোনে কার কথা। কেনীথ আনায়ার দূরত্বটা খুবই ক্ষীণ। আর আনায়া চেয়েও কেনীথের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। তবে আনায়ার অতিরিক্ত নড়চড়ে কেনীথ বিরক্ত। শেষমেশ অতিষ্ঠ হয়ে আনায়ার হাতদুটো আরো শক্ত করে ঝাকিয়ে চেপে ধরে। অতঃপর চোখ গরম করে, চাপা ধমকের স্বরে নিরেট কন্ঠে বলে,

❝ হুঁশ! এতো তেজ কেন তোর, হ্যাঁ? সারাদিন পর তোর কাছে আসি শান্তির জন্য, আর তুই…ধরা-ছোঁয়া তো বহু দূরের কথা, কিছু বলতে নিলেও ক্যাচ ক্যাচ করিস। বিশ্বাস কর তারা, তোর এতো ঘ্যানঘ্যান আমার অসহ্য লাগে।❞

—❝হু! আর আমার আপনাকে অসহ্য লাগে। ছাড়ুন বলছি!❞

—❝ছাড়ব না, কি করব কর।❞

—❝ছেড়ে দে জলহস্তী। নয়তো তোর মাথা ফাটিয়ে দেব।❞

আকস্মিক আনায়ার এহেন অভিব্যক্তিতে কেনীথের পাশাপাশি আনায়াও থমকে যায়। আনায়ার বলার পরপরই হুঁশ এলো—হয়তো একটু বেশিই বলে ফেলল। সে খানিকটা থম মে’রে কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইল। কেনীথের হাবভাব ঠিক লাগছে না। অদ্ভুত ভাবে নিশ্চুপ চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে। আনায়া অগোচরেই কিঞ্চিৎ ঢোক গেলে। অপ্রস্তুত হয়ে কিছু বলতে চেয়েও যেন বলতে পারে না।বরং তার পূর্বেই কেনীথ আনায়ার হাতদুটো ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে নেয়। তার এহেন পদক্ষেপে আনায়া আরো বেশি অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে কেনীথের বাহু দুটো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। কেনীথ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার দিকে ফিরে তাকালে, আনায়া কিছু একটা ভেবে আমতাআমতা করে বলে,

❝কিছু কি হয়েছে? আপনাকে আজ একটু অদ্ভুত লাগছে।❞

আনায়ার সন্দিহান কন্ঠস্বরে কেনীথ কিছুই বলে না।শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই খানিকটা মাথা নাড়িয়ে বলে,

❝না, কিছু না।❞

এই বলে সে আবারও আনায়া হতে দূরে যেতে চায়। তবে তার পূর্বেই আনায়া আবারও তাকে শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

❝বলুন না কি হয়েছে।❞

—❝বললামই তো কিছু হয়নি।❞

আবারও কেনীথ স্বাভাবিক ভাবে দূরে সরতে চাইলে, আনায়া যেন এবার বিরক্ত হয়েই কেনীথকে টেনে নিজের কাছে আনতে চায়।

—❝আহ, হচ্ছেটা কি? কিছু হয়নি ভালো কথা। হুট করেই দূরে কেনো সরে যাচ্ছেন?❞

—❝তো কাছেই থেকেই বা কি করব? আমাকে তো আপনার ছাড়পোকা মনে হয়। দশ মাইল দূরে থেকেই আপনার চুলকানি ওঠে।❞

কেনীথের ক্ষীণ তিক্ত নির্বিকার অভিব্যক্তিতে আনায়া কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। তবে কেনীথকে না সরতে দিয়েই, কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে,

❝আচ্ছা সরি।❞

কেনীথ আনায়ার কথা শুনে, কিঞ্চিৎ ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হেসে বলে,

❝সরি?কিসের জন্য?❞

আনায়া পুনোরায় আমতাআমতা করে, অপ্রস্তুত হবার ভঙ্গিতে রুমের এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে বলে,

❝আ… সারাদিন তো নাকি শুধু ক্যাচক্যাচই করি। তো যদি কোনো ভুল হয় কিংবা আমার কোনো কাজে খারাপ লাগে তো সরি। তবে সবকিছুর জন্য না, ওকে! আপনি উল্টোপাল্টা কাজ করেন বলেই আমাকে ক্যাচক্যাচ করতে হয়।❞

—“ওহ,আচ্ছা।❞

কেনীথ প্রচন্ড মনযোগী হয়ে তার কথা শোনে। তবে সেভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না করেই, এবারও আনায়া হতে নিজেকে ছাড়িয়ে দূরে সরে আসতে চায়৷ এতেই যেন আনায়া পুনোরায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এবার কেনীথের বাহু ছেড়ে দিয়ে, দুহাতে কাঁধ-ঘাড় পেঁচিয়ে বলে,

❝এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে। সরি তো বলেছিই, তাহলে কেনো বারবার দূরে সরছেন?❞

—❝ঘুম পেয়েছে, ঘুমাব৷❞

আনায়া এবার আহাম্মকের ভঙিতে কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। একইসাথে একটুও সময় নষ্ট করে কেনীথের বাম গালে আচমকা সজোড়ে কামড়ে দিয়ে, পরক্ষণেই আবার পেট ও বুক বরাবর দুটো ঘুষি মে’রে, প্রচন্ড রাগের সহিত কাঁদো কাঁদো চাপা স্বরে বলে,

❝শালাআআআ! মে’রে গেঁ’ড়ে ফেলব একদম। আমার মুডের বারোটা বাজিয়ে, এখন ঘুম পেয়েছে?❞

আনায়ার এতোকিছু করার পরও, কেনীথ বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়াই করেনা। উল্টো তার যেন হাসি পাচ্ছে। সে নিজেকে কোনোমতে স্বাভাবিক রেখে আনায়ার মুখ বরাবর মুখ এগিয়ে আওড়ায়,

❝তো কি করতে বলিস?❞

নিমিষেই যেন আবারও আনায়া শান্ত হয়ে গলিত বরফের ন্যায় গলে যায়। সমস্ত রাগ কমে, মিলিয়ে যায় ক্ষণিকেই। কেনীথের নজরের সাথে নজর মেলাতে অস্বস্তি হতে থাকায়, পলকেই নজর সরিয়ে পাশে ফিরে তাকায়। আচমকা আনায়ার এহেন অভিব্যক্তিতে কেনীথ পুনোরায় মুচকি হাসে। আনায়ার হার্টবিটের আওয়াজ স্পষ্ট টের পায় সে।

—❝হায়য়য়য়…বিয়ের এতো বছর পরও তোমার হার্টবিট এতো ফাস্ট?উফ!উফ!উফ!❞

এমন পরিস্থিতিতেও কেনীথের এহেন অভিব্যক্তি যেন আনায়াকে আরো বেশি অস্থির হয়ে ওঠে। কেনীথও আনায়ার সাথে তাল মিলিয়ে মশকরা করে বলে,

❝আরেহ্ আরেহ্, আস্তে!আস্তে! হার্টটাই তো বেড়িয়ে আসবে।❞

আনায়া এবার মুখ ফিরিয়ে কেনীথের দিকে তাকায়। চাপা তার অভিব্যক্তি। হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ। চোখজোড়ায় আশ্চর্যজনক ভাবে জল জমেছে।কেনীথের মিটমিট করে মুচকি হাসা অভিব্যক্তিতে সে আরো বেশি অস্থির হয়ে যায়।যতই উপরে উপরে কেনীথের সাথে পায়ে পারা দিয়ে ঝগড়া করুক না কেনো, দিনশেষে কেনীথের নিকটতম সংস্পর্শে সে বরাবরের মতোই নরম,দূর্বল—সেই পুরনো আনায়া।

এদিকে কেনীথ চুপচাপ ওর ভাবগতিক পর্যবেক্ষণ করছে। নাহ! বেশিক্ষণ তার এই মাথা বিগড়ানো বউকে এভাবে ফেলে রাখলে চলবে না। সে আলগোছে মুখটা আনায়ার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে নিয়ে,আনায়ার নাকের সাথে আলতোভাবে নাক ঘেঁষে বলতে লাগল,

❝ব্লাডডড।❞

আনায়া আবেশে চোখ বুঁজে,মাথা উঁচিয়ে নিতেই কেনীথ মুচকি হাসে। ওমনি তার নজর পড়ে আনায়ার গলার ভাঁজে। গলার ভাঁজের এক কোণায় একটা ছোট তিল রয়েছে। বরাবরের মতো আনায়ার সবকিছুর চেয়ে তার এই গলার ভাঁজই যেন কেনীথকে সবচেয়ে বেশি টানে। কেনীথ একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে, তৎক্ষনাৎ আনায়ার গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিয়ে,কয়েকবার নিজের খোঁচা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি-মোছ দিয়ে ঘর্ষণ দিতে দিতেই আওড়ায়,

❝আমাকে ছ্যাছড়ার মতো নিজের পেছনে ঘুরাতে শান্তি লাগে, তাই না?❞

কেনীথের স্পর্শকাতর সংস্পর্শে আনায়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও, পরক্ষণেই তার এহেন কথায় খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে যায়।এবং আচমকা হেসে উঠে বলে,

❝হুম, খুব ভালো লাগে। একদন কলিজা ঠান্ডা করার মতো শান্তি পাই।❞

আনায়ার বলতে দেরি, অতচ তার গলায় কেনীথের কামড়ে দিতে দেরি নেই। আচমকা ব্যাথায় আনায়া কেঁপে ওঠে।দাঁত চেপে, আলতোস্বরে আওয়াজ করে, তবে পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নেয়। অথচ কেনীথ নির্বিকারে গলার ভাঁজ হতেই আওড়ায়,

❝শাঁকচুন্নি।❞

কেনীথের কথা শুনে আনায়া আবারও হেসে ওঠে।

—❝আপনারই তো।❞

—❝হু, হু, যে সে শাঁকচুন্নি নয়। এটা আমার রেড কালারের শাঁকচুন্নি। পুরো দুনিয়ায় যে শুধু একপিসই। যার অনেকগুলো স্পেশাল পাওয়ারও রয়েছে। যেমন,ডাইনিদের মতো উড়াউড়ির জন্য ঝাড়ুর প্রয়োজন পড়ে না। আমার রেড কালারের শাঁকচুন্নি, যখন তখন পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে, ঝাড়ু দাঁড়াই উড়াল দিয়ে এসে আমার ঘাড়ে চড়ে বসে৷

আবার সবসময় ভাব দেখাবে যেন—তিনি সতীসাবিত্রী আনায়া বিবি৷ যে কিনা এক উত্তেজনাহীন রমণী। তার গুনধর পত্নী ভক্ত স্বামীর সংস্পর্শেও তিনি হাইভোল্টেজের এলার্জি সম্পূর্ণ রোগীর মতো আচরণ করবে। অথচ তার অবলা,নিষ্পাপ সোয়ামিটা, যখনই তাকে বহু কায়দা করে নিজের আয়ত্তে আনবে—ওমনি তিনি পুরোদমে উত্তেজিত মুডে এসে,অবলা স্বামীর চরিত্রহরণ করে নিয়ে যাবে। উফ! সে কি নির্ম’ম অত্য’চার। বছর খানেক আগের নখের আঁচর—আজও আমার পিঠে গেঁথে গেঁথে রয়েছে।❞

একমনে কেনীথের কথাগুলো শুনে আনায়া হতভম্ব। উপায়ন্তর না পেয়ে, দুম করেই আচমকা কেনীথের পিঠে কিল বসিয়ে দেয়৷❞

—❝এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে।❞

কেনীথ আনায়ার কথা শুনে, গলার ভাঁজ হতে মুখ তুলে নিয়ে বলে,

❝হু,সত্যিই বললেই বেশি বেশি?❞

আনায়া এবার আর কিছু বলব। নিমিষেই তার চোখমুখের ভাবগতিক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কেনীথ তা টের পেতেই মনে মনে আরো বেশি খুশি হয়। বউ তার সিরিয়াস মুডে চলে এসেছে। এখন আর দু-চারটা সিরিয়াস কথা না বললেই নয়৷ নিমিষেই তার কথার স্বর পরিবর্তন করে বলে,

❝বউউউউ!❞

—❝হুম।❞

—❝একটা সিরিয়াস টপিকে, কিছু বলার ছিল।❞

কেনীথের কথা শুনে আনায়াও যেন খানিকটা সিরিয়াস হয়ে ওঠে। তড়িঘড়ি করে বলে,

❝হুম, বলো।কি কথা?❞

—❝বলছিলাম, দেখতে দেখতে কাইরাভের ছয়মাস তো হয়েই গেল। তো…যদি, পরেরজনের ডাউনলোড হবার ব্যবস্তাটাও করে ফেলা যায়…?❞

—❝এই তোমার সিরিয়াস টপিক?❞

—❝তা নয়তো কি? অরিনের পর পাঁচবছর লেগেছে কাইরাভের আসতে। প্রত্যেকবার যদি এতো গ্যাপ দেই, তাহলে একেকটা ফুটবল টিম হতে কত দেরি হবে জানিস?❞

—❝জানিও না, জানতেও চাই না। ঘোড়ার ডিমের কাহিনি জুড়েছো। আমাকে কি মানুষ মনে হয় না, নাকি? ডজন ডজন এগুলোকে আনলে বাঁচব আমি?… আমি ম’রার পর তোমার ফুটবল টিম নিয়ে ফুটবল খেলো!❞

—❝আহ্, রেগে যাচ্ছিস কেনো? তবে ঠিকআছে,এই প্ল্যান কান্সেল। তোর কিছু হলে, আমার বাঁচা দায় হবে। এরচেয়ে বরং নতুন কোনো প্ল্যানিং করতে হবে।❞

—❝যেমন?❞

—❝আমার মাথায় একটা চমৎকার প্ল্যান এসেছে, শুনবি?❞

—❝কি প্ল্যান?❞

—❝জীবনে অনেক পাপই তো করলাম। তো ভাবছি,চারটা বিয়ের যেহেতু অনুমতি রয়েছে। সেক্ষেত্রে আর কয়েকটা… মানে বেশি না আরকি। প্ল্যানিং অনুযায়ী যেন সবার সুবিধা হয়, সেজন্য সবমিলিয়ে আর সাত-আটটা বিয়ে করে বউ ঘরে তুলব। এরপর সবগুলো থেকে দুই-তিনটা বাচ্চা দুনিয়াতে আনতে পারলেই আমার দুইজোড়া ফুটবল টিমের প্ল্যান কমপ্লিটলি ডান।❞

—❝ডান না ছাই, ঠ্যাং ভাঙব আপনার। সাহস কত, আমার সামনেই এমন আলতু-ফালতু মজা করছেন?❞

—❝আরেহ্ আরেহ্ মজা কেনো করব? আ’ম সিরিয়াস। দুনিয়াতে চলতে গেলে একটু-আধটু সিরিয়াস না হলে হয়?❞

কেনীথ যে মশকরা করছে,এটা স্পষ্ট। কিন্তু কেনীথের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, আনায়া রাগান্বিত স্বরে বলে,

❝আমার কিন্তু এখন রাগে কান্না পাচ্ছে।❞

—❝না, না, তুই মোটেও কান্না-রাগ কিচ্ছু করিস না। তুই না আমার সবচেয়ে ভালো বউ।❞

—❝কয়টা বিয়ে করেছেন আপনি?❞

—❝না মানে, এখনো করিনি। কিন্তু যখন করব,তখন তো বড় বউ তুই-ই হবি, তাই না?❞

—❝ঠাডা পড়ুক, আপনি আর আপনার চিন্তাভাবনার উপরে।❞

—❝প্লিজ এভাবে বলিস না। সতীনে সতীনে একটু লাগতেই পারে৷ কিন্তু বাচ্চাগুলোকে কখনো ভিন্ন নজরে দেখবি না। সবগুলোকেই নিজের ভাববি, তাহলেই হবে।❞

আনায়া এবার একটা শব্দও না করে, কেনীথের দিকে অপলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। তার অভিব্যক্তিতে রাগ,ক্ষোভ,কান্না— সবকিছু মিশ্রিত।কেনীথের সাথে অতিরিক্ত রাগে,কি করবে তা বুঝতে না পেরে,সে সর্বদা কেঁদে ফেলে। আবার পুরোপুরি কাঁদতেও নিজের কাছে বিরক্ত লাগে বিধায়,যথাসাধ্য সামলানোর চেষ্টা করে কিন্তু শেষমেশ আর সম্ভব না। কেননা কেনীথের উদ্দেশ্যই থাকে তা। আনায়াকে শেষমেশ কাঁদিয়ে ছাড়া।

যথারীতি আজও তার ব্যতীক্রম কিছু হলো না। আচমকা আনায়ার চোখে একগাদা জল ভিড়তে ও নাকের পাটা লাল হয়ে ফুলতে দেখে, কেনীথ অকস্মাৎ ঠোঁট চেপে, কিঞ্চিৎ কামড়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। কেনীথের এহেন অভিব্যক্তিতে আনায়ার রাগ আরো বেড়ে যায়। ফলস্বরূপ ভাঙ্গা স্বরে বলে,

❝সরে যান এখান থেকে।❞

আর এই বলা মাত্রই কেনীথকে দু-হাত দুরে সরাতে চাইতেই, কেনীথ আরো শক্তভাবে তাকে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে। আনায়ার হাত দুটো কেনীথের মাঝে বদ্ধ হয় নিমিষেই। কেনীথ আর একবিন্দু সময় নষ্ট করে, তৎক্ষনাৎ আনায়ার ওষ্ঠের সাথে ওষ্ঠ মিলিয়ে দেয়। ওমনি আনায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বলে,

❝ অসভ্য লোক,আমাকে কাঁদিয়ে খুব শান্তি পান আপনি তাই না?❞

—❝হু, হু, একদম কলিজা ঠান্ডা করার মতো শান্তি।❞

এই বলেই কেনীথ হেঁসে ওঠে। কেনীথের পাশাপাশি এবার আনায়াও হাসে। তবে এরইমাঝে বাহির হতে কোনো শব্দ শুনে আনায়ার কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। যা দেখে কেনীথ বলে,

❝কি হলো?❞

আনায়া খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বলল,

❝গরু ডাকছে।❞

কেনীথের চোখ-মুখ কুঁচকে যায় নিমিষেই। অস্ফুটে বলে ওঠে,

❝কিহ্?❞

—❝আরেহ্ গরু ডাকছে। গোয়ালের একটা গরু কদিন হলো অসুস্থ। চোখ তো তোমার আকাশে থাকে। সবটা তো আমাকেই দেখতে হয়।❞

আচমকা আনায়ার কড়া কথা শুনে, কেনীথের মেজাজ বিগড়ে যায়৷ তবে সেদিকে তেমন তোয়াক্কা না করে বলে,

❝হয়েছে, ওসব কাল দেখলেও চলছে। গরু ছেড়ে আমার দিকে ফোকাস কর।❞

এমন পরিস্থিতিতে কেনীথের এহেন নির্বিকার কথা শুনে, আনায়ার বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে যায়। নিমিষেই ক্ষিপ্ত স্ব’রে বলে,

❝পারব না আমি, গরু রেখে কোনো জলহস্তীর দিকে ফোকাস দিতে।❞

—❝তবে যেখানে পারিস যা। আমি বাদে দুনিয়ার সবকিছু নিয়েই তোর চিন্তা। এখন কিনা আমার চেয়ে গরুর মূল্য বেশি।❞

কেনীথকে ক্ষেপে যেতে দেখে,আনায়া কিছুটা শান্ত হয়। নমনীয় স্বরে কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে,

❝আচ্ছা শোনো না,রাগ না হয় পরে করো। যাও-না গিয়ে দেখে এসো একটু,গরুটার কি অবস্থা।❞

আনায়া এহেন আকুতি শুনে কেনীথ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,

❝ওরেহ্,কি ঠেকা আমার। পারব না আমি এসব করতে। তোর গরু, তুই যা।❞

—❝আহা,এভাবে বলছো কেনো।❞

—❝তো কি বলব? খুব না শখ ছিল আপনার—সুইজারল্যান্ড আসবেন। গোয়াল ভর্তি গরু পালবেন। কত্ত সুন্দর জীবন! এখন যান না,যান! না করেছে কে?❞

কেনীথের এহেন তিক্তস্বরে আনায়া থতমত খেয়ে ঠোক গেলে।লোকচক্ষুর আড়ালে,এমন গ্রামে এসে সাধারণ জীবন যাপন করাটা সবার প্ল্যান রইলেও—গরু পালার শখটা আনায়ারই ছিল। এখন এই শখের পাল্লায় পড়ে তার জীবনটাই আধম’রা। কেননা এই বিষয়ক কোনো কাজকর্মে, কেনীথের স্বইচ্ছায় দেখা পাওয়াটা,পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের বিষয়বস্তুর ন্যায়।

—❝প্লিজ আর জেদ করো না। আচ্ছা আমিই না হয় যাচ্ছি। তুমি শুধু কষ্ট করে আমার সাথে এসো। একা একা এই রাত করে বাহিরে যাওয়াটা কেমন, তাই না?❞

আনায়া প্রস্তাবে কেনীথ কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে,

❝যাব কিন্তু একটা শর্ত আছে।❞

—❝কি শর্ত?❞

—❝সারারাত আমি যা যা চাইব, তাই তাই দিতে হবে।❞

কেনীথের শয়তানি অভিব্যক্তিতে আনায়া চোখমুখ শক্ত হয়। চোয়াল শক্ত করে চাপা স্বরে বলে,

❝ঠিক আছে। এখন বান্দ্রামি ছেড়ে সাথে আসেন।❞

অথচ মনে মনে আওড়ায়,

❝শ্লার জলহস্তী! একবার শুধু কাজটা শেষ হোক। তারপর দেখেন আপনার কি করি। উত্তেজনার কবর দিয়ে ছাড়ব। জীবনটা ঝালাপালা করে দিয়েছে পুরো।❞

_________

রাত ধীরে ধীরে আরো কিছুটা গভীর হয়েছে। চারপাশের নির্জন, নিস্তব্ধতা। এরইমাঝে টর্চ লাইট নিয়ে আনায়া আর কেনীথ বেড়িয়েছে তাদের গরুর ফার্মের দিকে। মোটামুটি বেশ কয়েকটা গরু রয়েছে ফার্মে। তবে সবকিছুর পরিচর্যা আনায়া নিজেই করে। নয়তো এসব করার মতো কেউই নেই, কিংবা কেউই এসবে সহজে অভ্যস্ত হতে পারবে না। বাকি রইল, কেনীথ—সে তো এসবের ধারেকাছেও নেই। বউয়ের শখ হয়েছে গরু পালার,আর সে অতিউত্তম স্বামীর ন্যায় বউয়ের শখ পুরোন করেছে। অতঃপর এসকল বিষয়ের সাথে তার কোনো লেনদেন নেই।

ফার্মের কাছে এসেই আনায়া তড়িঘড়ি শুরু করে। দ্রুত গতিতে অসুস্থ গরুটার দিকে এগিয়ে যায়। কেমন যেন ঝিমিয়ে গিয়েছে। গরুটা দেখে আনায়া নিমিষেই চিন্তিত হয়ে যায়।গরুর পাশে বসে, আলতোভাবে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। একইসাথে করূন আওড়ায়,

❝আহারে বাচ্চা আমার। কি অবস্থা হয়েছে।❞

আনায়ার কার্যক্রম খানিকটা দূর হতে চেয়ে চেয়ে কেনীথ দেখে যাচ্ছিল। তবে আচমকা আনায়া মুখে এহেন কথা শুনে,কেনীথের চোখ-মুখ কুঁচকে। নিমিষেই বিরক্তিতে মনে মনে আওড়ায়,

❝ওহ,গড! বাঁচাও আমাকে এর হাত থেকে। কপাল করে এটাকেই আমার কপালে জুটাতে হয়েছিল?ছাড়তেও পারি না, আবার ছেড়ে বাঁচতেও পারি না।শা’লী ঠ্যাংওয়ালা চেংরী,শেষমেশ এই দামড়া গরুর বাপ বানিয়ে দিচ্ছে আমাকে।❞

এদিকে আনায়া আবারও বলে,

❝দেখেছেন বাচ্চাটার কি অবস্থা হয়েছে? রাতের মধ্যে যদি উল্টোপাল্টা কিছু হয়ে যায়, তাহলে কিভাবে বাঁচব বলেন তো?❞

—❝ বাঁচার কি দরকার। দুজনেই ম’রে যা। আমি ঘটা করে চল্লিশা করব—তোর বাকিসব গরু,ছাগল দিয়ে।❞

কেনীথের কথাবার্তা শুনে আনায়ার চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে,

❝ মূর্খ বজ্জাত লোক।রাত বিরাতে কি ভয়ং’কর সব কথা বলছে। আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে বলুন। খবরদার আমার বাচ্চাদের নিয়ে একটাও কথা বলবেন না।❞

—❝আনায়া যাস্ট শাট আপ। আমাকে তোর কোনদিক থেকে গরু মনে হয়? আর তুই কোন দিক দিয়ে গরুর মায়ের মতো দেখতে? কোনোটাই তো না। তাহলে কোন আক্কেলে বারবার আমার বাচ্চা-বাচ্চা করে চেঁচাচ্ছিস?
একটা কথা ভালো মতো শুনে রাখ। আমি ফুটবল টিম বানাতে চাই মানে—কোনো গরু-ছাগলের বাপ হতে চাইনি। মানুষের বাচ্চার ফুটবল টিম লাগবে আমার। বুঝেছিস?❞

আনায়া কেনীথের নির্বিকার মুখের দিকে দাঁত কিড়মিড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই ধমকে চাপা স্বরে বলে,

❝চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। একটা কথাও বলবেন না।❞

আনায়ার কথা মতো কেনীথ আর একটাও কথা বলে না। অবশ্য তার এসব নিয়ে আর কিছু বলার মতো মেজাজও নেই। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। এদিকে আনায়া নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। অসুস্থ গরুর জন্য যা যা দরকার আশপাশ হতে জোগাড় করছে৷ প্রায় খানিকটা সময় চুপ থাকার পর কেনীথের মেজাজ আবার খারাপ হলো। এভাবে চুপচাপ থাকতে ভালো লাগছে না তার।ওমনি সে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ভাবনার আড়ালে হারিয়ে যায়। একইসাথে মিটমিট করে শয়তানি ভঙ্গিতে তির্যক হাসিতে হাসতেও থাকে।

—❝এ ব্লাডডড।❞

কেনীথের ডাক শুনে, আনায়া কাজে মগ্ন থাকা অবস্থাতেই বলে,

❝হুম,বলেন।❞

—❝চল না বিয়ে করি।❞

আবারও কেনীথের এমন উল্টো পাল্টা কথা শুনে আনায়া চোখ রাঙিয়ে তার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই চাপা স্বরে বলে,

❝আবারও একই কাহিনি শুরু করেছেন?❞

—❝আরেহ্ মজা করছি না।আ’ম সিরিয়াস।❞

আনায়া কেনীথের কথাবার্তাকে বেশি একটা পাত্তা না দিয়ে পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়। এদিকে কেনীথ নির্বিকারে বলতে লাগল,

❝আমার বহু দিনের স্বপ্ন। ধুমধাম করে বিয়ে করে, কঢ়াহ্ একটা বাসর করব। চারপাশে গাঢ় লাল লাল গোলাপের পাপড়ি আর তোর প্রিয় বেলীফুলের ছড়াছড়ি। তুই আর আমি—মাঝামাঝি কাছাকাছি। এরপর আরেকটু কাছাকাছি, অতঃপর সোজা মাখামাখি। উফ! ভাবতেই তো কেমন কেমন লাগে।❞

আনায়া হাসবে না কি বলবে নিজেও বুঝতে পারে না। একটা মানুষের কতটুকু ফালতু সময় থাকলে শুধুমাত্র তার সাথে লা’গার জন্য এমন উঠেপড়ে লেগে থাকে। আনায়া বেশি কিছু না বলে, খানিকটা ভ্রু উঁচিয়ে মুখ ভেঙচিয়ে বলে,

❝ওরেহ্ আমার উত্তেজনার নাতী। এমন উত্তেজনায় ঠাডা পড়ুক।❞

কেনীথ আনায়ার অভিব্যক্তিতে হাসল। ঘরে যেতে না পারলেও এখানে টাইমপাস ভালোই হচ্ছে তার।

—❝বুঝলি না রে ঠ্যাংওয়ালা চেংরী। বুঝলি না! এই অবলা ভি ও তার নিষ্পাপ ফিলিংসকে তুই কখনোই বুঝলি না।❞

আনায়া কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,

❝নিষ্পাপ? আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আগে এটা বলো। তোমার এখন এসে যদি বিয়ে করে কঢ়াহ্ বাসরের শখ জাগে—তাহলে এতোদিন যেগুলো হয়ে এসেছে সেসব কি ছিল? আকাম ছাড়াই তোমার পোটলা-পুটলি দুটো দুনিয়ায় আসছে?❞

—❝আহা বুঝিস না কেনো, ওসব তো নরমাল ছিল। যা-তা ব্যাপার-স্যাপার আরকি। কিন্তু আমি চাইছি একটা প্রোপার বাসর।❞

—❝জ্বী, আর সেই বাসরে আপনি আমার ভবলীলাসাঙ্গ করে দেবেন।❞

এই বলেই আনায়া হেসে উঠল। আনায়ার সাথে সাথে কেনীথও হাসল। এই মাঝরাতে টাইমপাস করার মতো আর কোনো উপায় সে দেখছে না। আনায়ার উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কিন্তু তা যথাসম্ভব কনট্রোল করে নিজেকে সামলাচ্ছে। কি প্ল্যান করেছিল আর এখন কি করতে হচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই কেনীথ এটাই ভাবল, দুই বাচ্চার মা হলো আনায়া৷ এখন তো তাদের সবকিছুই ঠিকঠাক। এখনোও কি এই রমণী কখনোই তাকে পুরোপুরি বুঝবে না? অবশ্য না বুঝলেও সমস্যা নেই। এমন কথায় কথায় ছ্যাত করে ওঠা আনায়াকে তার বেশি ভালো লাগে। যেহেতু এখানে তার কাজকর্ম নেই বললেই চলে, সেক্ষেত্রে সারাক্ষণ বউয়ের পেছন পেছন ঘুরে জালাতন করাটাও, এক মহৎ কর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে কেনীথের কাছে বিবেচিত।

আনায়া হাতে ধরে গুনে গুনে আরো আধঘন্টা সময় চুপচাপ অতিবাহিত করল। তবুও আনায়ার কাজের সমাপ্তি হতে দেখল না। এতক্ষণে ঘড়ির কাঁটায় বারোটা নিশ্চিত পেরিয়েছে। শেষ! আজকের পুরো মুডটাই তার ভেস্তে যাচ্ছে। ভোর হবার আগ থেকেই তার ছেলে জেগে উঠে কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন চেয়েও আর কিছু সম্ভব নয়। কেনীথ আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

❝তোর এখনো কাজ শেষ হয়নি?❞

গরুটা খানিক ঝিমিয়ে শুয়ে রয়েছে। তার দিকে চেয়ে থেকেই আনায়া অবলা স্বরে বলে,

❝কিভাবে ঘুমাবো? বাচ্চাটার জন্য চিন্তা হচ্ছে। যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার এখান থেকে।❞

কেনীথের চোয়াল শক্ত হয়। সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

❝আমার ঘুম পেয়েছে,রুমে চল।❞

—❝কি বলছো এসব। এখন কিভাবে…আরেকটু সময় থাকো না প্লিজ। বেশি রাত হয়ে গিয়েছে। নয়তো তোমায় থাকতে বলতাম না আমি।❞

কেনীথ আর কিছু না বলেই আনায়ার পাশে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তবে সময়টা বেশি দীর্ঘ হয়না। তার সহ্য সীমা যেন পেরিয়ে গিয়েছে। যার দরূন, আচমকা সে আনায়ার কাছে গিয়ে তার হাত চেপে ধরে। এবং টেনে নিয়ে যেতে চায়৷ ওমনি আনায়া হতভম্বের ন্যায় বলে,

❝আরেহ্ আরেহ্ কি করছেন?❞

এই বলতে না বলতেই আনায়া হাত মোচড়ানো শুরু করে দেয়। একই সাথে কেনীথের কাছ থেকে ছাড়া পেতে চেঁচানো শুরু করলে, কেনীথ অকস্মাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে তার একহাতে আনায়ার হাত মুচড়ে নিজের কাছে টানে। অন্য হাতে আবার আনায়ার মুখ চেপে ধরে চাপা স্বরে বলে,

❝অনেক সহ্য করেছি। আর পারব না। রুমে চল। খবরদার চেঁচামেচি করবি না।❞

আনায়াও জেদের স্বরে বলে ওঠে,

❝যাব না আমি। কি করবেন করেন। আপনার যেতে হলে আপনি যান।আমাকে কেন টানছেন?❞

—❝ঠিক আছে। তোর আজ এমন অবস্থা করব…ওয়েট! ❞

এই বলেই আনায়াকে সোজা কাঁধে তুলে নেয় কেনীথ। ওমনি আনায়া চেঁচাতে গিয়েও যেন থেমে যায়। এতোরাতে কিসব করছে সে? এখন এভাবে চেঁচালে বাড়ির লোকজন কি বলবে? কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা কেনীথ কি করতে চাইছে?

এই চিন্তা ভাবনার মাঝেই আনায়া দেখে, কেনীথ তাকে রুমের দিকে না নিয়ে গিয়ে উল্টো গোয়ালের ভেতরে ফাঁকা জায়গার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ওমনি সে আতংকিত স্বরে বলে,

❝এ…এ…তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? এটা কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না।❞

—❝কি ঠিক হচ্ছে না?❞

—❝কি করতে চাইছো তুমি?❞

কেনীথ শুধু কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

❝তুই যা ভাবছিস তাই।❞

নিমিষেই আনায়া ঢোক গিলে, কাঁদো কাঁদো স্বরে চেঁচিয়ে বলে,

❝ছিঃ আমি যাব না। ছেড়ে দেও আমায়। আমি এক্ষুনি ঘরে যাচ্ছি, তবুও এখানে না। ম’রে যাব আমি। গোবর গোবর গন্ধ করবে।❞

—❝বিয়ে করে কঢ়াহ্ বাসর যখন করবি না, তখন গোয়াল ঘরে গোবর বাসর কর। তবুও তোর তেজ তো কমুক।❞

_________

বাড়ির ভেতরের সকলেই এখন গভীর ঘুমে। এখানে এসে প্রত্যেকরই জীবনযাত্রা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যথারীতি কেউই তেমন রাত জাগে না। তবে সবার মাঝে একজন শুধু এখনোও জেগে রয়েছে। নাহ,কেনীথ কিংবা আনায়া নয়। তারা এখনো গোয়াল ঘর হতে ফেরেনি। ওখানে কি হচ্ছে তাও বাড়ির কেউ জানেনা। কারণ প্রত্যেকের ঘর হতে তা অনেকটা দূরে। শুধু আনায়াদেরটা ব্যতীত। বাকিরা তেমন কিছু টের পায়না।

তবে এই মূহুর্তে ঘরের এককোণায় ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এ্যাশ। সে ইনায়ার সাথে শুয়েছিল। অথচ ইনায়াও এখন গভীর ঘুমে। আর এ্যাশ এই সুযোগে তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ নিজের স্কুল ব্যাগটা খোলে। অতঃপর সেখান থেকে বইয়ের এক চিপায় রাখা একটি ছোট্ট কালো রাঙা খাম বের করে আনে। এ্যাশের কাছে এমন খাম আরো কয়েকটা রয়েছে। কিছু রহস্যময় লোক তাকে এসব স্কুলে থাকা অবস্থায় কিংবা নানাভাবে সবার অগোচরে দিয়ে যায়।

যেমন আজ সকালে রোজ যখন তাদের নিয়ে বের হয় তখন, একজন বৃদ্ধা অরিন আর এ্যাশকে দুটো ক্যান্ডি। অথচ ওটা নিছকই ছিল এক বাহানা। ক্যান্ডি দেবার সুযোগে এ্যাশকে সে খামটা দিয়ে যায়। ওদিকে রোজ আনমনে ছিল বিধায় কিছুই টের পায়না।

এ্যাশ যথেষ্ট গম্ভীর স্বভাবের ছেলে। বয়সের তুলনায় তার গাম্ভীর্যের পরিধি একটু বেশিই। একইসাথে সে সহজে কারো সাথে মেশেও না, যদি তার মতোই গম্ভীর কেউ না হয়। যেমন ইনায়াকে তার সবচেয়ে বেশি পছন্দ। নিজ হতে দু একটা কথা বলার হলে সে ইনায়াকেই বলে।

এছাড়া এই স্বভাবগত কারনে সে অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছুই নেয় না। কিন্তু এই কালো রঙের খামের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। সে সবসময় এটার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা করে থাকে।

পুরো অন্ধকার রুম জুরে শুধু হালকা একটা ডিম লাইট জ্বলছে। আর সেই আলোর মাঝেই সে খামটা খুলে, আরো একটা কালো রঙের কাগজ বের করে নিয়ে আসে। এগুলোকে চিঠি বললে ভুল হবে, এগুলো চিরকুট। কিন্তু নিত্যন্তই বিশেষ।

তবে হতাশাজনক ভাবে বরাবরের মতোই কাগজে লেখা থাকা রহস্যময় দুই লাইনের মাঝের কিছুই এ্যাশের বোধগম্য হলো না। এমন খাম তার কাছে আরো বেশ কয়েকটা রয়েছে। আর সেসব নির্দেশনা মোতাবেক সে সবার কাছ থেকে লুকিয়েছে। কিন্তু এতোগুলো কাগজে লেখা থাকা কোনো কথাই তার বোধগম্য হয়নি। সে আবারও কিছুটা হতাশ হলো। তবে বোঝার মধ্যে একটি অক্ষর ছিল,তা হলো ” — V “। প্রতিবার এই নামেই শুধু এই খামগুলো তার কাছে এসেছে। এর মানে এগুলো এই V-ই পাঠিয়েছে।

এ্যাশ আর একটুও সময় নষ্ট না করে। খামের ভেতর কাগজটা ভরে, তার নির্দিষ্ট গুপ্ত স্থানে রেখে দেয়। যেখান থেকে সহজেও কারো নজরে এসব আসবে না। তবে একইসাথে সে ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আওড়ায়,

❝তুমিই যদি আমার বাবা হও। তবে কেনো আমার সামনে আসছো না?❞

_______

ভোর হয়েছে। চারপাশে সূর্যের দেখা এখনো মেলেনি। কাইরাভ কান্না জুড়েছিল বিধায়,সে এখন আনায়ার কাছে তার নিজস্ব ঘরে। এদিকে সকাল সকাল গোসল সেড়ে, বউয়ের একগাদা ঝাড়ি খেয়ে কেনীথ মনের আনন্দে বাড়ির সু-বিশাল বারান্দায় হেঁটে বেড়াচ্ছে।

বারান্দায় এপাশটা হতে দূরের আকাশ ছোঁয়া পাহাড় গুলো স্পষ্ট দেখা যায়। আর ভোর বেলায় সে অনবদ্য দৃশ্য উপভোগ করার মজাই আলাদা। তবে বারান্দায় এসে কেনীথের নজর পড়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এ্যাশের দিকে। একধ্যানে পাহারের দিকে তাকিয়ে সে। পরনে শুধু এক কালো রঙের টাউজার আর টিশার্ট।

কেনীথ কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে তার দিকে এগিয়ে যায়।এ ছেলে এতো সকালে উঠে কি করছে? কেনীথ খেয়াল করে দেখে সে যে তার কাছে গিয়েছে, এটা এ্যাশ এখনো টের পায়নি। নয়তো এ্যাশ যথেষ্ট তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক সম্পন্ন ছেলে। এসব ছোটখাটো ব্যাপার কখনোই তার নজরের অগোচর হয় না। তবে এমন ধ্যানমগ্ন থাকার মানেও হলো, সে গভীর ভাবে কিছু ভাবছে।

কেনীথ তার প্রায় কোমড় সমান ছেলেটার পাশে দাড়িয়ে, আলতোভাবে তার কাঁধে হাত রাখে। ওমনি এ্যাশ যেন চমকে ওঠে। তবে তা যেন কেনীথ বুঝতে না পারে, সেজন্য নিজেকে যথাসাধ্য চেষ্টায় দৃঢ় রাখে। ওদিকে কেনীথ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, অগোচরেই মুচকি হাসে। ছেলেটাকে তার বেশ লাগে। ভাব-ভঙ্গি, অভিব্যক্তি,গম্ভীর্য—সবটাই দারুন।

—❝কি আব্বা, এতো সকাল সকাল উঠে পড়েছেন যে?❞

এ্যাশ কিছু না বলে, মাথা উঁচিয়ে কেনীথকে একপলক দেখে। কেনীথের নজর সামনের মেঘে ঘেরা পাহাড়ের দিকে। এ্যাশও চুপচাপ সামনের দিকে ফিরে তাকায়।কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর স্বাভাবিক স্বরে বলে,

❝আপনি তো আমার মায়ের ভাই , তাই না?❞

আচমকা এহেন প্রশ্নে কেনীথ খানিকটা অবাক হলেও, পরক্ষনেই স্বাভাবিক স্বরে বলে,

❝হুম।❞

কেনীথের নির্বিকার জবাবে এ্যাশ কিছুক্ষণ থেমে, পরক্ষণেই গম্ভীর্যের সহিত বলতে শুরু করে,

❝আমি আপনাদের দেখেছি ও চিনেছি বেশি সময় হয়নি। বছর খানেক আগেই আপনাদের সাথে আমার পরিচয়। ততদিন পর্যন্ত আমি জানতাম—আমি একজন আশ্রমে থাকা অনাথ। এমনকি আমার মা যদি সত্যিই আপনার বোন রোজ হয়,তাহলে…তাহলে তাকেও আমি তখনই দেখেছি।❞

—❝যা বলতে চাইছো তা সরাসরি বলো।❞

কেনীথ সর্বদা হাসিখুশিই চলে। তার কথাবার্তার ধরনও এখন এমন। অবশ্য আগের মতো হওয়ার এখন আর তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। অবশ্য ভবিষ্যতে কখনো প্রয়োজন পড়লে তা ভিন্ন কথা। তবে সে সবসময় অন্তত বাচ্চাগুলোর সাথে হাসি-মজার ছলেই কথা বলে। কিন্তু এ্যাশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। এ্যাশ গম্ভীর স্বভাবের ছেলে হওয়ায়, ও সহজে হাসি-মজার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যেবোধ করেনা। একইসাথে নিজের ভেতরে থাকা কথা গুলোও সহজে অন্যদের বলতে পারেনা। তাই কেনীথ যখন তার সাথে প্রয়োজনীয় বিষয়ে কথা বলে, তখন সে সর্বদা সিরিয়াসই থাকে।

যথারীতি কেনীথের অভিব্যক্তিতে এ্যাশ অগোচরে ভারী শ্বাস ফেলে বলে,

❝আমার বাবা কে, মামু?❞

কেনীথ এ্যাশের এমন প্রশ্নে তার দিকে ফিরে তাকায়। কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে এ্যাশও ফিরে তার দিকে তাকায়। কেনীথ আর এবার নজর সরায় না। এ্যাশের চোখে চোখ রেখে বলে,

❝জানি না, জানলে অবশ্যই বলতাম।❞

এ্যাশ আর কিছু বলেনা। আলতোভাবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। যেন তার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে, কেনীথ সত্যিই কিছু জানেনা। কেননা সে মনে করে, ব্যক্তি যা চোখে চোখ রেখে বলে তা সত্যিই হয়। তবে তার বাবার সন্ধান না পেয়েই যেন সে হতাশ।

এদিকে কেনীথ যেন শুরুতেই আন্দাজ করেছিল, এ্যাশের মাথায় ভিন্ন কিছু চলছে। অবশ্য ছেলেটা কার তা তো মাথায় রাখতে হবে। তবে এটাও সত্যি যে, সে এ্যাশের বাবার খোঁজ সত্যিই জানে না।

পুনরায় দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা। আর এবারও নীরবতা ভেঙে এ্যাশ বলল,

❝মামু! আমাকে আরেকটা সাহায্য করতে পারবেন?❞

—❝হুম, বলো। সম্ভব হলে অবশ্যই করব।❞

—❝আপনার মেয়েটাকে বলবেন আমার থেকে দূরে থাকতে। ওকে আমার আমার পছন্দ না। সে অনেক বেশি বিরক্তিকর।❞

এ্যাশের এহেন নির্বিকার অভিব্যক্তিতে কেনীথের কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। তবে ঠোঁটের কোণায় খানিকটা হাসি ঝুলিয়ে বলে,

❝আমার মেয়েকে তোমার পছন্দ না,আর এ কথা তুমি আমাকেই বলছো?❞

এ্যাশ নির্বিকার চাহনিতে কেনীথের দিকে তাকায়। শান্ত,গম্ভীর তার অভিব্যক্তি। কথাবার্তায় কোনো সংকোচ না রেখে বলে,

❝জ্বী,আপনাকেই বলছি। ওকে প্লিজ আমার থেকে দূরে থাকতে বলুন।❞

কেনীথ তার অভিব্যক্তিতে কিঞ্চিৎ হাসে। পরক্ষনেই সামনের দিকে নজর ফিরিয়ে নির্বিকারে বলে,

❝ দুঃখীত বাপজান, এ কাজ আমি করতে পারব না।❞

এ্যাশ যেন কিঞ্চিৎ অবাক হয়। সে সরাসরি বলার পরও কেনীথ মানা করছে? এ্যাশ খানিকটা সন্দিহান স্বরে বলে,

❝ কিন্তু কেনো? ❞

—❝ আমার একটা মাত্র মেয়ে। তোমার থেকে দূরে সে থাকতে চাইবে না। আর আমিও আমার লেডিবাগের কাছে এমন কোনো আবদার করে তাকে কষ্ট দিতে চাই না।❞

এবার যেন এ্যাশ নিজেই কিছুটা বিরক্ত। তার কন্ঠস্বর নিমিষেই দৃঢ় হয়ে ওঠে।

—❝তাহলে আমাকে আশ্রমে পাঠিয়ে দিন।❞

এ্যাশের কথায় কেনীথ মুচকি হেসে বলে,

❝আচ্ছা আব্বা, আমায় একটু বলবেন—লেডিবাগ আপনাকে কি করেছে? তার প্রতি এতো ক্ষোভ কেনো আপনার?❞

—❝জ্বী না, তার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। ঐ যে বললাম,সে অনেক বির’ক্তিকর।❞

এইটুকু বলেই এ্যাশ থামে। পরক্ষণেই কেনীথ কিছু বলার পূর্বেই সে আবারও কিছুটা বিরক্তি নিয়েই, কপাল কুঁচকে বলে ওঠে,

❝সবসময় বলে সে আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু আমার এসব বিয়ে তো ভালো লাগে না। আবার বলে, বিয়ের পর নাকি ফুটবল টিম বানাবে। তার বাবা… আই মিন, আপনি নাকি একজোড়া ফুটবল টিম বানাবেন। আর তাই সে চায় দুইজোড়া ফুটবল টিম বানাতে। দ্যাটস্ মিন,ফর্টি ফোর মেম্বার। সিরিয়াসলি? হাউ ইজ দিস পসিবল? সে কি আদৌও বোঝে,একেকটা ফুটবল টিম তৈরি করতে কি কি প্রয়োজন? কত খরচ করতে হতে পারে?❞

এ্যাশের এহেন কথাবার্তা শুনে,কেনীথ আচমকা কেশে উঠল। তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে,পরক্ষণেই আবার এ্যাশের পিঠ আলতোভাবে চাপড়ে দিয়ে, স্থান ত্যাগের ভঙ্গিতে বলতে লাগল,

❝আব্বা, বেশি সকালে উঠে পড়েছো। তোমার এখন আরেকটু ঘুমের প্রয়োজন। আর এসব নিয়ে না হয়, পরে কখনো আলোচনা হবে।❞

—❝কিন্তু আমি তো জানতে চাই, ও সবসময় এই টপিকেই কেনো কথা বলে?❞

—❝অবশ্যই জানবে, আরেকটু বড় হও তারপর।❞

এই বলেই কেনীথ,উল্টো ঘুরে যেতে শুরু করে। হাতদুটো পেছনে এক করে, যেতে যেতে ভারী শ্বাস ফেলে নিমিষেই মুচকি হাসে। যার সবকিছুই এ্যাশের নজরের অগোচরে ঘটে। তবে এ্যাশ থামে না। সে পেছন হতেই কেনীথের উদ্দেশ্যে গম্ভীর্যের সহিত কিছু একটা ভেবে নিয়ে, তৎক্ষনাৎ বলে,

❝তাহলে এইটুকু তো বলে যান, এই ফুটবল টিমের মানে কি?❞

কেনীথ আর পেছনে ফিরে তাকায় না। সে একই ভঙ্গিতে যেতে যেতে বলে,

❝বড় হও বাপজান। বড় হলে নিজেই বুঝে যাবে। আর তখনও না বুঝলে, আমার গুনধর মেয়ে আছে তো! সে তোমায় নিজে থেকে সব বুঝিয়ে দেবে।❞

কেনীথের কথা শুনে, এ্যাশ অপলক পেছন হতে তাকিয়ে থাকে। সে বুঝে উঠতে পারে না, এই বাবা-মেয়ে হুবহু একইরকম কেনো? অরিন ছোট হলেও, তার মামা তো অনেক বড়। এরপরও কিভাবে…? এ্যাশের এসকল প্রশ্ন মনেই রয়ে যায়। আর ওদিকে কেনীথ যেতে যেতে মনে মনে আওড়ায়,

❝কিসের একজোড়া আগুন পাখি। কোন গাধা দিয়েছে এই নাম? এই লাইফ-স্টোরির টাইটেলে নেইম হতে হবে—একজোড়া উত্তেজিত পাখি। এবং এদের উত্তেজিত চ্যালাপ্যালা। নয়তো সবগুলো প্রোডাক্ট এই বয়সেই এতো উত্তেজিত হয় কি করে?হাহ্, সবই কোনো এক নারী-জাতির লীলাখেলা।❞

___________সমাপ্ত___________