একঝাঁক জোনাকি পর্ব-১৩

0
125

#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ১৩

অনিমা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জুইয়ের কথা শুনে।ভাগ্যিস জুই এই কথা বলেছিলো।নয়তো সে কি বলতো কে জানে!
ভেবে নিজের চেয়ারে বসে টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখল একটা টিফিন বক্স রাখা।নিহান কি ভুলে টিফিন বক্সটা রেখে গিয়েছে?তাই হবে মনে হয়।যে তাড়াহুড়া করে গেলো লোকটা ভুলেই রেখে গেছে হয়তো।ভেবে টিফিন বক্সটা ব্যাগের ভিতর রাখতে যাবে এমন সময় হঠাত মোবাইলের মেসেজের আওয়াজ ভেসে আসল টেবিলের উপর রাখা মোবাইল থেকে।অনিমা ভ্রু কুচকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজে ক্লিক করতেই দেখলো নিহান লেখা।ও তো নিহানের নাম্বার সেইভ করেনি তবে নিহান করেছে মনে হয়।লোকটা এরমধ্যেই হাসপাতালে চলে গেল?নাকি রাস্তা থেকে মেসেজ করেছে?

“আপনি বোধহয় ভাবছেন টেবিলের উপর থাকা টিফিন বক্সটা আমি ভুল করে রেখে দিয়ে এসেছি!উহু আমি মোটেও ভুল করে রেখে দিয়ে আসিনি।বরং ইচ্ছা করেই রেখেছি।টিফিন বক্সে ফ্রুট আছে।কাজ করার ফাঁকে খেয়ে নিবেন কেমন?আর ডিস্টার্ব করছি না।মন দিয়ে কাজ করুন!”

লেখাটুকু পড়ে টিফিন বক্সটা খুলে সত্যিই দেখল নানা রকমের ফলে ভরা!অবাক হলো খুব অনিমা।এত কেয়ার পাওয়ার কি সত্যিই যোগ্য সে?যেখানে নিজের হাজবেন্ড বাচ্চার কথা জেনেও কোন খোঁজ খবর রাখেনি সেখানে উনি এত খোঁজখবর রাখছে।সত্যি কি এতকিছু ওর ভাগ্যে ছিল?আর কোনকিছু চিন্তা না করে কাজে মনযোগ দিলো।

কিছুক্ষন আগে অফিস ছুটি হয়েছে।কাধে ব্যাগ নিয়ে ফুটফাতের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছে অনিমা।মাথায় চিন্তায় ভরা।নিহানকে নিয়েই!লোকটা ওকে এত সাহায্য কেন করছে?এত কেয়ার কেন করছে এটাই ভেবে পাচ্ছে না সে।একটা মানুষ কি স্বার্থ ছাড়াই কাওকে এতটা সাহায্য করতে পারে?ভাবতে ভাবতেই কারোর সাথে ঢাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে ফুটপাত থেকে নিচে পরে গেলো।রাস্তায় বসা থেকে উঠার চেষ্টা করলো কিন্তু পায়ের ব্যাথার কারনে উঠতে পারছেনা।কয়েকবার উঠে দাঁড়ানের চেষ্টার পরেও যখন ব্যর্থ হলো তখন আশা ছেড়ে দিয়ে ফুটপাতেই বসে পরল।ক্লান্ত লাগছে খুব।সারাদিন কাজ করে এখন কিনা পা ভেংগে রাস্তায় বসে আছে!ওকে আরও হেনস্তা করার জন্যই বোধহয় প্রকৃতি বৃষ্টি নামিয়ে দিলো পৃথিবীর বুকে।কাঁধে হালকা হালকা বৃষ্টির ফোটা পরছে।কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই হালকা বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেলো।মুহুর্তের মধ্যেই একদম কাক ভেজা হয়ে গেল অনিমা।রাস্তার সবাই দৌড়াতে ব্যাস্ত।বৃষ্টির পানির হাত থেকে বাঁচার জন্যই বোধহয়!ভেবেছিল কোন রিক্সা দেখতে পেলেই উঠে পরবে বাস স্টেশনে যাওয়ার জন্য। রিক্সা থেকে কোনমতে নেমে নাহয় বাসে উঠে পরবে টেনে হিচড়ে।কিন্তু যে বৃষ্টি নামছে রিক্সা তো দুরের কথা একটা মানুষও দেখা যাচ্ছে না।কোন উপায় না পেয়ে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো।
.
.
হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই নিহান ঘড়ির দিকে তাকালো ৮:৩০ টা বেজে গেছে।অনিমা কি এখনো অফিসে আছে নাকি বাসায় চলে গেছে?মনে হয় বাসাতেই চলে গেছে।৭ টায় ছুটি হলে এখন থাকার কোন মানে হয় না!ভেবেই গাড়িতে উঠে বসল।উদ্দেশ্য বাসায় যাবে।
.
.
“শুনলাম তুমি নাকি স্কুলে ছেলেদের সাথে গলা উচু করে কথা বলেছো?”

মাহির টেবিলে বসে বসে ম্যাথ করছিলো।কালকেই ওর এক্সাম।মার কথা শুনে হাতে থাকা কলমটা রেখে বলল,

“হ্যা!বলেছি।ওরা আমাকে বাজে কথা বলেছিলো।বলেছিলো আমি নাকি সবসময় তোমার কথায় উঠি বসি!মায়ের বাধ্য ছেলে বলে ভেংগিয়েছিলো।”

“তোমাকে কতবার বলেছি কারোর সাথে উচু গলায় কথা বলবে না।সবসময় নিজের পড়া নিয়ে থাকবে!”

মাহির চেয়ার থেকে উঠে মার দিকে ফিরে বলল,

“আম্মু!তুমি কি বলছ আমি ওদের কথা বসে বসে শুনব?”

“দরকার হলে তাই করবে!”

“ওরা কয়েকদিন আগে আমাকে মেরেছিলো।কপাল দিয়ে রক্ত পরছিলো আমার!আর ওদেরকে আমি কিছু বলতে পারব না?আমার সেই অধিকার নেই!”

“নাহ নেই!তুমি দিন দিন বেয়াদপ হয়ে যাচ্ছো!কালকে অই ছেলেগুলার সাথে গলা উচু করে কথা বলেছো। আর এখন আমার সাথে।মাঝে মাঝে কিছু কাজ সহ্য করা লাগে। না চাইলেও!তোমারও উচিত ছিল ওদেরকে সহ্য করা।এখন যদি ওরা তোমাকে আবার মারে তখন তুমি কি করবে?”

“সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে।আমার কালকে এক্সাম।তুমি গেলে খুশি হবো!”

মাহিরের মা একবার মাহিরের দিকে তাকিয়ে যেতে যেতে বলল,

“কালকে এক্সামে ১০০ তে ১০০ চাই আমি।১ নাম্বার কম পেলে খবর আছে তোমার!”

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।মাহির সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।নিজেকে মাঝে মাঝে রোবট মনে হয় তার।আম্মু কিনা তাকে যারা মেরেছে তাদের কিছু না বলে ওকে এসে শাসিয়ে গেলো সামান্য গলা উচু করে কথা বলার জন্য! আচ্ছা অন্যদের মা হলে কি একই কাজ করতো?নাহ!ওরা নিজেরা গিয়ে অই ছেলেদের শাসিয়ে আসতো!চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে চেয়ারে বসে পরল।সব রাগ ম্যাথের উপর ঝাড়তে লাগলো।

পরেরদিন,
ম্যাথ পরিক্ষা শেষে স্কুলের গেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলো।বাসায় যাবে।আম্মুর কারনে একটা ফ্রেন্ডও ওর কপালে জুটেনি।মার ভাষ্যমতে ফ্রেন্ড থাকলে নাকি খারাপ হয়ে যায়।পড়াশুনায় মনযোগ দেওয়া যায় না।মাথা নিচু করেই হাঁটছিলো।হঠাত সামনে কয়েকজোড়া পা দেখে ঠমকে গেল মাহির।মাথা না উচু করেই বুঝতে পারলো কারা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

“বুঝলি তোর মা কালকে আমাদের কাছে এসেছিলো।ক্ষমা চেয়ে গেলো তোর ক্ষমা চেয়ে গেল তোর বিহেভের জন্য। ”

“ভালোই তো!পথ আটকিয়েছিস কেন?”

“আসলে তোকে ভয় না দেখালে ভালো লাগে না।এক কথায় পেটের ভাত হজম হয় না।খুব তো কালকে শাসিয়েছিস!”

মাহির নিজের রাগটাকে কনট্রোল করে বলল,

“আমার বাসায় যেতে হবে।পথ ছাড়।”

“কি করবি বাসায় গিয়ে?পড়াশুনা করবি?তুই তো সারাদিনই পড়াশুনা করিস।”

মাহির দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“হ্যা করি তো?তো কি হয়েছে? দেখা।আমার ফিউচার নিয়ে টেনশন আছে।কিন্তু তোদের তাও নাই।আর তোরা যে বলিস আমি আম্মুর বাধ্য সন্তান!মার কথায় নাচি!তার কারন হলো আমি আম্মুকে সম্মান করি!তোদের মতো না যে রাস্তায় রাস্তায় গুন্ডামি করে বেরাবো।”

কথাটা শেষ হতেই গালে সজোরে থাপ্পড় পরল মাহিরের।মাহির গালে হাত দিয়ে পাশে তাকাতেই মাকে দেখতো পেলো।রাগে কাঁপছে।

“সরি বল ওদের।”

মাহির গালে হাত রেখেই অবাক গলায় বলল,

“আম্মু!”

“শুনতে পাসনি?সরি বল ওদের।”

“দোষ আমার না!দোষ ওদের!ওরা ফাস্টে এসেই আমাকে….”

“আমি কোন কথা শুনতে চাই না। সরি বল।”

মাহির সামনে তাকাতেই দেখল ছেলেগুলা হাসছে।দেখে মনে হচ্ছে অনেক মজা পেয়েছে।

“সরি।”

বলেই দৌড়ে চলে গেল।মাহিরের মা মাহিরের যাবার দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন বাসায়।

অনিমা কোচিং থেকে আসার পথেই হঠাত ঝুম করে বৃষ্টি নামলো।ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে সামনে হাঁটতেই একটু দুরেই একটা ছেলেকে বেঞ্চে বসে থাকতে দেখলো।এই বৃষ্টির মধ্যে ছেলেটা ভিজছে।ছেলেটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে অনিমার।একটু কাছ গিয়ে খেয়াল করতেই বুঝতে পারল ছেলেটা মাহির।আরেকটু সামনে এগিয়ে মাহিরের মাথায় ছাতা ধরলো।মাহির মাথা নিচু করে বসে ছিল বেঞ্চে।হঠাত সামনে কাওকে দেখে ভালো করে তাকাতেই অনিমাকে দেখল।আর চিনতে একটুও অসুবিধা হলো।
অনিমা হাটু গেড়ে বসে বলল,

“এই বৃষ্টিতে এভাবে ভিজছো কেন?ছাতা নেই?”

মাহির কিছু বলল না।চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে।

“এই বৃষ্টিতে এভাবে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে তো!”

মাহির এইবারও কোন উত্তর দিলো না।অনিমা বিরক্ত হলো খুব।এইটুকু ছেলের এত রাগ কিসের?

“তুমি কি আমার সাথে যাবা? ”

এইবারও কোন উত্তর না পেয়ে অনিমা মাহিরের হাতে ছাতাটা দিয়ে বলল,

“থাকো তাহলে তুমি!আমি গেলাম।আর বসে থাকলে ছাতাটা ধরে বসে থাকো।”

বলেই চলে যেতে নিলেই মাহির পিছন থেকে অনিমার হাত ধরল।অনিমা যেতে নিয়েও থেমে গেলো।পিছনে ফিরতেই মাহির কান্না করে দিলো।আচমকা মাহিরের এমন কান্নাতে অনিমা ভড়কে গেলো।

“কাঁদছো কেন?কি হয়েছে?”

মাহির কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আপনি বলেছিলেন অই ছেলেগুলাকে উচিত জবাব দিতে।সহ্য না করতে!”

“হ্যা!তো?”

“আমি ওদের উচিত জবাব দিয়েছি।”

অনিমা খুশি হয়ে বলল,

“বাহ!বেশ ভালো তো?এতে কান্না করার কি আছে?”

কিছুক্ষন থেমে অনিমা আবার বললো,

“ওরা কি তোমাকে আবার মেরেছে?”

“নাহ!”

“তাহলে কান্না করছো কেন?”

মাহির কান্নারত চোখে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার আম্মু আপনার মতো নয় কেন অনিমা?”

অনিমা থমকে গেলো মাহিরের এমন কথা শুনে।
.
.
অনিমা হঠাত খেয়াল করলো ওর মাথায় আর বৃষ্টি পরছে না।বৃষ্টি কি থেমে গেল?অবাক হয়ে সামনে তাকাতেই দেখল নিহান অনিমার মাথায় ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাঁটু মুড়ে অনিমার সামনে নিচু হয়ে বলল,

“আপনি এখানে এভাবে বসে আছেন কেন?আর বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন?”

অনিমা সব কথা খুলে বলতেই নিহানে এক হাতে ছাতাটা ধরে আরেক হাতে অনিমার পা টা ধরে বলল,

“মনে হয় মচকে গেছে।এত অসাবধান হলে হয়?ইশ কি লাল হয়ে গেছে!দেখেই মনে হচ্ছে অনেক ব্যাথা হচ্ছে নিশ্চয়ই! আমাকে ফোন দিয়ে জানাবেন না?তাহলেই তো আমি এসে নিয়ে যাই!এত বোকা কেন আপনি?সবসময় নিজের সমস্যা নিজেই সলভ করতে চান!”

নিহানের বলা কথা শুনে অনিমা মাথা নিচু করে বসে রইল।আসলেই তো?নিহানকে ফোন দিলেই তো পারতো।ইশ!কেন মাথায় আসলো না?
অনিমা বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু এবারও ব্যর্থ। ভেবেছিল ব্যথা হয়তোবা একটু কমেছে।নিহান বিরক্ত হয়ে অনিমাকে বলল ছাতাটা ধরতে।অনিমা ছাতাটা হাতে নিতেই….
চলবে….