#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ১৮
৩ দিন পর আজকে অনিমা হাসপাতালে থেকে বাসায় যাবে। নিহান সবকিছু ব্যাগে প্যাক করে ফেলেছে।এইতো আর ১০ মিনিট পর ৯ টা বাজলেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাবে।৯ টা বাজার সাথে সাথেই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসলো।অনিমার কোলে অরিন।নিহান সব ব্যাগ পত্র গাড়ির পিছনে রেখে সামনে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল।কিছুক্ষন বাদে অনিমার মনে হলো ওরা বাসার দিকে যাচ্ছে না।বরং অন্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। অনিমা অবাক হয়ে বলল,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?এটা তো বাসায় যাওয়ার রাস্তা না।”
নিহান ড্রাইভ করতে করতেই বলল,
“কাজি অফিসে যাচ্ছি।”
নিহানের কথা শুনে অনিমা অবাক হয়ে বলল,
“মানে?কিসের জন্য? ”
নিহান বিরক্ত হয়ে বলল,
“কাজি অফিসে মানুষ কিসের জন্য যায়?”
“বিয়ে করতে।”
“তাহলে আমরাও বিয়ে করতেই যাচ্ছি।”
“মানে হুট করে কোন প্রস্তুতি ছাড়া….। আপনি তো আমাকে আগেও বলতে পারতেন।তাহলে অন্তত… ”
অনিমার কথা শেষ করার আগেই নিহান বলল,
“ডিশিসনটা যে আমি অনেক আগে নিয়েছি ব্যাপারটা এমন না।গতকাল নিয়েছি।”
“হঠাত এমন ডিশিসন নেওয়ার কারন?”
নিহান এবার গাড়ি রাস্তার পাশে সাইড করে অনিমার দিকে ফিরে বলল,
“আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন না?অসুবিধা আছে আপনার?”
অনিমা নিহানের এমন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“আমি তা বলিনি।”
“তাহলে এত প্রশ্ন কিসের?আপনি অরিনকে নিয়ে একা একটা ফ্ল্যাটে কিভাবে থাকবেন?বিপদ বলতেও তো কিছু একটা আছে।সেটা ফেইস করবেন কিভাবে?আর আমিও তো সবসময় আপনাকে প্রটেক্ট করতে পারব না।সেটা করতে হলে সারাদিন আপনার সাথেই থাকা লাগবে আমার।যেটা সম্ভব না।তাই বিয়ে করে আমার ঘরে তুলতে চাইছি।এটলিস্ট সারাদিন না হলেও দিনের বেশিরভাগ আপনারা আমার চোখের সামনেই থাকবেন।আর বাকি সময় আমার মার সাথে।কোন টেনশন থাকবেনা আমার। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আপনাকে হারানোর ভয়ও থাকবেনা।আমার মার প্রতি আমার নিজেরই বিশ্বাস নেই।বলা নেই কওয়া নেই হুট করে তিথির সাথে একদিন বিয়ের পিরিতে বসিয়ে দিবে।আম্মুর হাবভাব আমার একদমই ভালো লাগছেনা।তাই আগেভাগে আপনাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে ফেললে আম্মুর মাথায় অমন চিন্তা আসবে না।”
লাস্টের কথাগুলা বিড়িবিড়িয়েই বলল।অনিমা না শুনতে পেয়ে বলল,
“বিড়িবিড় করে কি বললেন?শুনতে পাইনি।”
“কিছুনা।আর কোন প্রশ্ন আছে?”
“নাহ।”
“আপত্তি আছে কোন?”
“নাহ।”
নিহান আর কিছু না বলে কাজি অফিসের দিকে রওনা দিলো।কিছুক্ষন বাদেই গাড়ি এসে থামলো কাজি অফিসের কাছে।গাড়ি থেকে বের হয়ে নিহান অনিমার কোল থেকে অরিনকে নিয়ে বলল,
“চলুন যাওয়া যাক।”
“আপনার মাকে জানাবেন না?”
“অবশ্যই না।বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর আম্মু এমনেই জানবে।”
“কিন্তু….”
“কোন কিন্তু না।চলুন।”
কাজি অফিসের ভিতর ঢুকতে হুজুর বললেন চেয়ারে বসতে।নিহান আগে অনিমাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজেও পাশে বসে পরল।হুজুর নিহানের কোলে অরিনকে দেখে ভ্রু কুচকে বললেন,
“এই বাচ্চাটা আপনাদের বাচ্চা নাকি?”
“আলতু ফালতু প্রশ্ন না করে আপনার কাজ করুন।এই বাচ্চা কে সেটা জেনে আপনার লাভ কি?”
হুজুর কেশে বললেন,
“এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।আমার জীবনে প্রথম কোন দম্পতিকে বাচ্চা নিয়ে বিয়ে করতে আসতে দেখলাম তো তাই নিজেকে আটকাতে পারলাম না।”
নিহান বিরক্ত হয়ে বলল,
“আপনি কি আমাদের বিয়ে পড়াবেন নাকি আমি অন্য কাজি অফিস খুঁজব?ঢাকা শহরে কাজি অফিসের অভাব হবে না।”
“নাহ নাহ পড়াচ্ছি তো!আপনার নাম?”
“মাহির শাহরিয়ার নিহান।”
মাহির নামটা শুনতেই অনিমা চমকে নিহানের দিকে তাকালো।ও যে নামটা শুনল সেটাকি সঠিক শুনলো নাকি ভুল শুনলো?মাহির নামটা কেমন চেনা চেনা লাগছে।এর আগে কি ও এই নামটা শুনেছে কোথাও?নাকি কেও পরিচিত ছিল?হুট করেই চোখের সামনে একটা বাচ্চা ছেলের হাসির মুখশ্রী ভেসে উঠলো অনিমার সামনে।তবে কি অনিমা যেটা ভাবছে সেটাই সঠিক?অই পিচ্চিটাই কি নিহান?পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনাকে দুরে সরালো।মাহির কি করে এখানে আসবে?ওর আসার প্রশ্নই আসে না।তাছাড়া মাহির নামে দুনিয়াতে যে একজন থাকবে এমনটাও তো নয়।কতশত মানুষ আছে এই নামে গুনেও শেষ করা যাবে না।নিজের উপর হাসি আসলো অনিমার।একজনের নামের সূত্র ধরে আরেকজনের সাথে মিলিয়ে দিচ্ছিলো।
“তিনবার কবুল বলুন।”
অনিমা নিহানের দিকে তাকালো।নিহান আগেই তাকিয়ে ছিলো।অনিমা তাকাতেই ইশারায় বলল কবুল বলতে।কিছুটা সময় নিয়ে ৩ বার কবুল বলল।হুজুর নিহানকে কবুল বলার আগেই নিহান ৩ বার কবুল বলে ফেলল।হুজুর আবার দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলো।উনি উনার লাইফে এই প্রথম এমন কাওকে দেখলেন যে কিনা কবুল বলতে বলার আগেই কবুল বলে ফেলল। হুজুর মনে মনে হাসলেন নিহানের পাগলামি দেখে।সব ফর্মালিটিস পুরন করার পর যাবার সময় নিহান হুজুরকে ৫ হাজার টাকা দিলো।হুজুর অবাক হয়ে বলল,
“এত টাকা আমার ফিস না!”
“রেখে দিন।বখশিশ দিলাম আপনাকে।”
বলেই অনিমাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পরল।মনে মনে শান্তি পেলো।অবশেষে অনিমাকে নিজের করে পেলো।দীর্ঘ ১৫ বছর পর!অনেক সাধনার পরে।
“এখন আমরা কোথায় যাব?”
“অবশ্যই আমার বাড়িতে!”
.
.
নিহানের মা মুক্তা বেগম বসে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলেন।হঠাত কলিংবেলের আওয়াজ শুনে ভ্রু কুচকে ফেললেন।সন্ধ্যায় তো কেও আসে না!এখন কে আসলো।কাজের মেয়ে রহিমাকে বললেন দরজা খুলে দেখতে কে এসেছে।সিরিয়ালের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিন চলছে।এই সিন মিস করা যাবে না।ছেলে মাকে না বলে বিয়ে করে বউ ঘরে তুলে এনেছে।তাও আবার এমন একটা মেয়েকে যাকে কিনা ছেলের মা দুই চোখে দেখতেই পারেন না।মুক্তা বেগম ছেলেটাকে বকলেন।যে ছেলে মায়ের কথা শুনে না সে ছেলে হবার কোন যোগ্যতাই রাখে না।ছেলে হলে হতে হবে তার নিজের ছেলে নিহানের মতো!ভদ্র, নম্র।মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।সবাই কি আর এমন ছেলে পায়?কত ভাগ্য করে নিহানের মতো একটা ছেলে পেয়েছে। প্রাউড ফিল হয় মাঝে মাঝে মুক্তা বেগমের।ছেলের মার কি রিয়েকশন সেটাই দেখবার পালা এখন।অধীর আগ্রহে যখন ছেলের মায়ের কথা শুনার জন্য অপেক্ষা করছিলো হঠাত সামনে কাজের মেয়ে রহিমা আসল।মুক্তা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
“কি চোখের সামনে এমন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?সর এখান থেকে।আমার গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারেস্টিং সিন মিস হয়ে যাচ্ছে।”
“খালাম্মা!নিহান ভাই আইসে।”
“এই সময়ে?আমারে বলতাছিস কেন?”
“ভাই আপনারে ডাকছে।কি নাকি ইপটেন কথা কইব!”
মুক্তা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
“অইটা ইপটেন না!ইম্পোর্টেন্ট।”
“অই একই কথা।! বুঝবার পারলেই হইছে।”
মুক্তা বেগম একটা শ্বাস ফেললে চলে গেলেন।এই মেয়েরে বুঝানো যে কথা না বুঝানোও একই কথা।বিড়বিড় করতে করতে দরজার সামনে গিয়ে ১৮০ ভোল্টের শক খেলো।নিহানের কোলে বাচ্চা আর পাশে অনিমা দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে।
“কিরে?তোর কোলে এটা কার বাচ্চা?আর এই মেয়ে এই বাড়িতে কি করে?ওরে আনছিস কেন?”
“আমি আর অনিমা বিয়ে করেছি।আর কোলের বাচ্চাটা আমাদেরই বাচ্চা।”
“মানে?কি বলছিস এসব?তুই বিয়ে করেছিস মানে?আর বাচ্চাটা তোদের মানে?”
“মানে আমরা একটু আগে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছি।আর কোলের বাচ্চাটা তোমার নাতনি।”
একটু আগে দেখা সিরিয়ালের কাহিনি যে বাস্তবে ঘটে যাবে সেটা ঘুনাক্ষরেই মুক্তা বেগম কল্পনা করেন নি।
“তুই এত বড় একটা কাজ করতে পারলি?আমাকে একবার বলার প্রয়োজনবোধ করলি না?”
“আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম বিয়ে করলে আমি অনিমাকেই করব!”
“তাই বলে তুই কাওকে কিছু না বলে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলবি?”
“আমার কিছু করার ছিলো না।তুমি আমাকে বাধ্য করেছো এমনটা করতে!তুমি যদি তিথিকে না পছন্দ করে অনিমাকে করতে তাহলে আমাকে কাওকে না জানিয়ে বিয়ে করতে হতো না।আমি দুঃখিত।এত বড় একটা অন্যায় করার জন্য। কিন্তু আমার আর কিছুই করার ছিলো না।ক্ষমা করে দিও।”
“এইটা আমার ছেলে হতে পারে না।আমার ছেলে আমাকে না বলে বিয়ে করতে পারে না।আমি স্বপ্ন দেখছি।দুঃস্বপ্ন! ”
বিড়বিড় করতে করতেই চোখের সামনে সবকিছু আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যেতে লাগলো।মাথা ঘুরাতে লাগলো।আর তারপর সব অন্ধকার!মুক্তা বেগমকে পরে যাওয়া আগে অনিমা ধরে ফেলল।নিহানের কোলে অরিন ছিল।অরিনকে অনিমার কোলে দিয়ে নিহান মাকে সোফায় শুইয়ে দিলো।তাড়াতাড়ি করে চোখে মুখে পানির ছিটা দিতে লাগলো।প্রেসার মেপে দেখলো হাই প্রেসার।রহিমা মুক্তা বেগমের মাথার কাছে পাখা দিতে বাতাস করতে করতে বলল,
“ভাইজান!খালাম্মাকি অতি শোকে হার্ট এটাক করলো?”
নিহান মার মুখে পানির ছিটা দিতে দিতে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
“যাহ গিয়ে লেবু পানি নিয়ে আয়।চিনি, লবন কিছু দিবি না।জাস্ট লেবুর রস আর পানি মিক্স করে আনবি।
রহিমা মাথা নেড়ে কিচেনে চলে গেলো।কিছুক্ষন বাদেই মুক্তা বেগমের জ্ঞান ফিরলো।চোখ মিটমিট করে সামনে তাকাতেই নিহানকে দেখতে পেলো।আর তার একটু দুরেই অনিমাকে দেখে উঠার চেষ্টা করতেই আবার মাথা ঘুরিয়ে উঠলো।নিহান মাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে বলল,
“উঠো না।তোমার প্রেসার হাই হয়ে গেছে।লেবু পানি খেলে ঠিক হয়ে যাবে।রহিমাকে বলেছি।একটু পরেই নিয়ে আসবে।”
মুক্তা বেগম ছেলের কথা পাত্তা না দিয়ে উঠে গম্ভীর গলায় বললেন,
“আমার লেবু পানি টানি লাগবে না।আমি এই মেয়েকে কোনদিন নিজের বউমা হিসেবে মেনে নিতে পারব না।আর না অই বাচ্চা আমার নাতনি।
চলবে….