একঝাঁক জোনাকি পর্ব-২২+২৩

0
160

#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ২২

আপনাকে আজকে এমন লাগছে কেন?”

নিহান হেসে বলল,

“কেমন?”

“এইযে মনমরা!কেমন চুপচাপ।আপনি তো এমন না!”

“সবাই যে সবসময় ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে থাকে কথাটা কে বলেছে আপনাকে?”

“কেও বলেনি।মনে হলো।আচ্ছা কিছু কি হয়েছে?মন খারাপ আপনার?”

“মন খারাপ হলেই বা কি?আপনি ভালো করে দিবেন?”

“নাহ!বাট মনের কথা শেয়ার করলে নাকি মন খারাপ একটু হলেও কমে!আপনি বলতে পারেন আমাকে।”

নিহান অনিমার দিকে ফিরলো।

“সোহান যদি কোনদিন অরিনকে ফেরত নিতে চায় তখন কি করবেন?”

“সেটা সম্ভব না!”

“কেন সম্ভব না?উনার সস্পূর্ণ অধিকার আছে অরিনের উপর!ফেরত নিতে চাইলে আমি আপনি কেওই বাধা দিতে পারব না!”

“আমি ওকে আগেই এই কথা বলে দিয়েছি যাতে ভবিষ্যতে কোন অধিকার ফলাতে না আসে আমার বাচ্চার উপর! ও মেনেও নিয়েছে।”

“কিন্ত তাও!মানুষের মন কখন পরিবর্তন হয়ে যায় বলা যায় না।হঠাত করে অরিনকে দেখে যদি উনার মায়া লাগে।তখন?”

“কোর্টে যাবো। মামলা করবো ওর নামে।”

নিহান কিছু না বলে চুপ করে গেলো।

“আপনি এটা নিয়ে চিন্তা করছিলেন?”

“নাহ!জাস্ট মনে হলো আরকি!যান ঘুমিয়ে পরুন।”

“আপনি ঘুমাবেন না?”

“একটু পরে ঘুমাবো।”

“আমিও একটু পরে ঘুমাবো।এখানে থাকতে ভাল লাগছে।”

অনিমার কথা শুনে নিহান চমকে অনিমার দিকে তাকালো।এইমুহুর্তে অনিমার কাছ থেকে সে এরকম কথা আশা করেনি।নিহান তাকাতেই অনিমা বুঝল কি বলে ফেলেছে সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,

“না মানে,বাসার ভিতরে গরম লাগছিলো।কিন্তু বারান্দায় আসার পর ঠান্ডা লাগছে তাই বললাম। ”

“তাহলে থাকুন।আমার সমস্যা নেই।”

এই কথাটা বলেই নিহান সামনে তাকিয়ে হাসলো।অনিমা মনে হয় ভুলে গেছে রুমের ভিতর এসি।সেখানে গরম লাগার কোন প্রশ্নই আসে না।বরং হুট করে এসি রুম থেকে বারান্দায় আসলে গরম লাগার কথা।এইমুহুর্তে সে চাইলেই অনিমাকে এই কথাটা বলতে পারতো!কিন্তু মেয়েটাকে লজ্জায় ফেলতে ইচ্ছা করছে না।বারান্দায় নীল রঙের ড্রিম লাইট জ্বালানো।নীল রঙের ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় নিহানের হাসি অনিমা নজর এড়ালোনা।সে ঠিক বুঝতে পেরেছে ওর কথা শুনেই নিহান হেসেছে।অনিমা এদিক ওদিক তাকাতেই আবছা আলোয় নিহানের হাতের ক্ষতের দাগের দিকে নজর গেলো যেহেতু নিহান রেলিং ধরেছিলো ক্ষতটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো।ক্ষতটা দেখতেই অনিমার ভ্রু কুচকে এলো।

“আপনার হাতে এটা কিসের দাগ?”

নিহান অনিমার কথা শুনে হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তেমন কিছুনা ছোটবেলায় গাছ থেকে পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম।সেটারই দাগটা এখনো রয়ে গেছে।”

“অহ আচ্ছা!গাছে কেন উঠেছিলেন?”

“অনেক আগের কথা।কিসের জন্য উঠেছিলাম মনে নেই।”
.
.

মাহির রাস্তা দিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলো।হঠাত রাস্তার মাঝে অনিমাকে দেখে অনিমার একটু সামনে যেতেই দেখলো অনিমা সামনে থাকা গাছের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মনে হচ্ছে যেন কিছু গবেষনা করছে।মাহির অনিমার পাশে দাঁড়িয়ে সামনে থাকা বড় গাছের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কি দেখছেন? ”

মাহিরের কথায় মাহিরের দিকে তাকাতেই মাহিরও অনিমার দিকে তাকালো।চোখে মুখে তার হাজারও প্রশ্নের ছড়াছড়ি।মাহিরকে দেখেই যেন অনিমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ঠোটে হাসি রেখেই বলল,

“এসেছো ভালো করেছো!এখম আমার ব্যাগটা ধরো।ব্যাগটার জন্য আমি গাছে উঠতে পারছিলাম না।”

মাহির চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বলল,

“গাছে উঠে কি করবেন আপনি?”

“একটু আগে একটা বিড়ালের ছানাকে দেখেছি।বেচারা আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলো।আমার এখন ওকে উদ্বার করতে হবে।”

“উদ্বার কেন করতে হবে?”

“কারন ও নামতে পারছে না!”

“আপনি বুঝলেন কি করে যে ও নামতে পারছে না!”

“কারন ও বারবার নামার চেষ্টা করছিলো।বাট নিচের ভিউ দেখে ভয়ে মেবি ওর কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছিলো তাই নামতে পারছিলোনা।পিছিয়ে যাচ্ছিলো।এখন তুমিই বলো একজন মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে বিপদে সাহায্য করাটা আমার কর্তব্য না?”

“মানুষ হবে না প্রাণী হবে।”

“রাইট!তাই ওকে আমি সাহায্য করতে যাচ্ছি।”

“আপনি উঠতে পারেন গাছে?”

“অবশ্যই! ”

“কিন্তু বলছিলাম কি এসব ঝামেলায় না জড়ালে হয় না?পরে যদি আপনি বিপদে পরেন তখন আপনি কি করবেন?”

“একজন প্রাণীকে বাঁচানো কি ঝামেলা?আর আমি বিপদে পরি তখন আমাকে এই বিড়ালটা বাঁচাবে।গল্প পড়োনি যে একটা সিংহ একটা ইঁদুরকে খায়নি দেখে পরবর্তীতে সিংহ যখন জালে আটকা পরেছিলো ইঁদুরটা সিংহকে সাহায্য করেছিলো।যাইহোক দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি উঠি…”

বলেই কাধ থেকে উড়নাটা নামিয়ে কোমড়ে শক্ত করে বেধে নিলো।উঠার আগে পিছনে ফিরে বলল,

“বিড়ালটাকে কেচ ধরতে হবে তোমাকে। পারবে না?”

মাহির উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বুঝালো পারবে সে।অনিমা মিষ্টি হেসে গাছে উঠার মিশনে নেমে গেলো।কিছুক্ষন বাদেই গাছে উঠার মিশনে সফলও হয়ে গেলো।বিড়ালটা অনিমাকে দেখতেই অনিমার কাছে এগিয়ে গেলো।অনিমা বিড়ালটাকে গাছের একটা ডালে বসে বলল,

“মাহির!রেডি তো?”

“হুম!”

“কেচ ধরবে ১,২,৩ বলার সাথে সাথে! ”

মাহির গাছের নিচে দুই হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে।অনিমাও তার কথা অনুযায়ী এক দুই তিন বলেই ছুড়ে ফেলল মাহিরের হাতের মাঝে।মাহিরও বিড়ালটাকে কেচ ধরে খুশিতে বলল,

“কেচ ধরতে পেরেছি।আপনি নেমে আসুন।”

অনিমা খুশি হয়ে নিচে নামতেই যাবে হঠাত নিচের ভিউ দেখে ওর আত্মা কেঁপে উঠলো।এখন মনে হচ্ছে বিড়াল ছানার মতো ওর নিজেরও কলিজার পানি শুকিয়ে আসছে।কই যখন উঠলো তখন তো ভয় পায়নি।তাহলে এখন কেন ভয় পাচ্ছে?এজন্যই বুঝি বিড়াল ছানাটা নামতে পারছিলো না!অনেকক্ষন ধরে অনিমার নামার কোন নাম নেই বলে মাহির গলা উচিয়ে বলল,

“কি হলো নামছেন না কেন?”

অনিমা জিহ্বা দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া ঠোটকে ভিজিয়ে বলল,

“নামতে পারছিনা।ভয় লাগছে।”

মাহির অবাক হয়ে বলল,

“বলেন কি?আপনি না বললেন গাছে আপনি উঠতে পারেন?”
অনিমা অসহায় হয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

“আরে দুর!উঠতে পারি এটা মনে ছিলো।নামতে যে পারি না এটা তো মনে ছিলো না!”

“চিন্তা করবেন না বিড়াল নামিয়ে দিয়ে যাবে।অইযে গল্প পড়েন নি যে একটা সিংহ একটা ইঁদুরকে খায়নি দেখে পরবর্তীতে সিংহ যখন জালে আটকা পরেছিলো ইঁদুরটা সিংহকে সাহায্য করেছিলো।।এভাবে বিড়ালও আপনাকে সাহায্য করবে।”

“হুম ঠিক বলেছো।”

পরমুহুর্তেই পুরো বিষয়টা মাথায় আসতেই বলল,

“বিড়াল কিভাবে আমাকে নিচে নামাবে?আমি এখন বিপদে পরেছি বলে মজা নিচ্ছো আমার উপর?”

“বলেছিলাম আপনাকে না উঠতে!”

‘এখন আমি নামব কেমনে?”

মাহির কি একটা ভেবে বলল,

“আপনি লাফ দেন।আমি আপনাকে কেচ ধরব!”

মাহিরের কথা শুনে অনিমা বলল,

“অইটুকু ছেলে কিভাবে কেচ ধরবে আমাকে?”

“আমি পারব!আপনি লাফ দিন!”

“সিউর পারবে?”

“হুম।কোন চিন্তা করবেন না।আমি রেডি।”

বলেই গাছের নিচে দুই হাত মেলে দাঁড়ালো।অনিমা চোখ মুখ খিচে নিচে লাফ দিতেই অনিমার ভারি শরীর ছোট্ত মাহির নিতে পারলো না।দুজনেই মাটিতে গিয়ে পরলো।মাহিরের উপর অনিমা। মাহির ব্যথায় চোখ মুখ খিচে ফেলেছে।অনিমা মাহিরের উপর থেকে উঠে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

“যাক!কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম।”

বলেই পিছনে তাকাতেই দেখল মাহির চোখ মুখ খিচে হাত ধরে বসে আছে।অনিমা এগিয়ে গিয়ে বলল,

“কি হয়েছে ব্যথা পেয়েছো?”

হাতটা নিজের দিকে নিতেই দেখলো রক্ত পরছে হাত থেকে।

“আয় হায় রক্ত পরছে তো!ব্যথা পেলে কিভাবে?”

বলেই আশেপাশে তাকাতেই একটা ছোট্ত ইটের টুকরা চোখে পরলো।বুঝতে বাকি রইলো এই ইটের টুকরার জন্যই মাহিরের হাত থেকে রক্ত পরছে।মাহিরকে দাঁড় করিয়ে বলল,

“রক্ত থামাতে হবে।আমার জন্যই এমনটা হয়েছে।”

“আপনি চিন্তা করবেন না!রক্ত থেমে যাবে।”

“বললেই হলো!হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে তোমাকে!”

“কিন্তু এইটুকু চোটের জন্য…. ”

“চুপ করো!বেশি কথা বলো তুমি।চলো আমার সাথে।”

অনিমার ধমকে মাহির চুপ হয়ে গেলো।ভদ্র ছেলের মতো অনিমার হাত ধরে হাসপাতালে গেলো।ড্রেসিং করানোর সময় মাহির ভয়ে অনিমার হাত চেপে ধরে ছিলো।অনিমা শান্ত করার জন্য বলল,

“কিচ্ছু হবে না!ড্রেসিংটা তোমার ভালোর জন্যই করাচ্ছে।”

মাহির একবার অনিমার দিকে তাকালো। ক্ষতস্তানে স্যাভলন লাগাতেই অনিমার হাত আরও জোরে চেপে ধরল মাহির।
.
.
সকাল সকাল তিথি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরুতেই মায়ের সামনে পরল।তিথির মা ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কিরে?এত সকালে কই যাচ্ছিস?”।

” কেন অফিসে!”

“তুই অই অফিসে জয়েন করবি?তুই না বলেলি জয়েন করবি না!”

“তখন তো ভেবেছিলাম আমার বিয়ে হয়ে যাবে নিহানের সাথে।তাই অফিস করার কোন মানে হয় না।কিন্ত বিয়েটা যখন হলো না তখন ঘরে আজাইরা বসে তো লাভ নাই।তাই ভাবলাম জয়েন করেই ফেলি।”

“ব্রেকফাস্ট খেয়ে যা!”

“ক্ষিধে নেই পেটে। আমি আসছি।”

বলেই ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।তিথির মা মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।নিহান যা করেছে একদমই ঠিক করেনি।অনেক বগ অন্যায় করে ফেলেছে তিথির প্রতি।পাত্রী দেখতে এসে তার বগ বোনকে বিয়ে করাটা তো অপরাধই।বরং অপরাধের থেকেও বড় অপরাধ।
তিথি রিকশা করে অফিসের কাছে আসলো।হাতে থাকা ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই দেখল নয়টা পাঁচ বাজে।অলরেডি ৫ মিনিট লেট করে ফেলেছে সে।ভাড়া মিটিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামতে যেতেই……

চলবে..

#একঝাঁক_জোনাকি
#পর্বঃ২৩
#ইশরাত_জাহান_অধরা

তিথি রিকশা করে অফিসের কাছে আসলো।হাতে থাকা ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই দেখল নয়টা পাঁচ বাজে।অলরেডি ৫ মিনিট লেট করে ফেলেছে সে।ভাড়া মিটিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামতে যেতেই হঠাত টান অনুভব করলো সে।পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো ওড়নাটা রিকশার হুডির সাথে আটকে আছে।এরমধ্যেই রিকশা টান দিতেই তিথির গলায় আরও জোরে টান পরলো।শ্বাস প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম।ওড়নাটা গলা থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে সে।কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছেনা।মুখ দিয়ে শব্দও বের হচ্ছে না যে রিকশাওয়ালাকে বলবে রিকশা থামাতে।কথার পরিবর্তে শুধু কাশি বের হচ্ছে আর চোখ থেকে পানি।এরমধ্যেই হঠাত গলার ওড়নার বাধন হালকা হতেই রাস্তার মাঝখানে বসে পরল।গলায় হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেবার চেষ্টা করলো।

“ঠিক আছেন আপনি?”

শ্বাস ঠিক হতেই গলায় হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই গতকাল রাতের বাসের ছেলেটাকে দেখতে পেলো।চোখে মুখে আতংকে ভরা।

“কি হলো কিছু বলছেন না কেন?”

কথাটা কানে পৌছাতেই তিথি নিজেকে কোনমতে সামলে বলল,

“জ্বি ঠিক আছি আমি।”

কথাটা শুনেই যেন সস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।

“সাবধানে চলবেন তো!ওড়না রিকশায় কি করে লাগে?”

“খেয়ালে ছিলো না।কখন রিকশার হুডিতে লেগে গিয়েছে টের পায়নি।”

“আমি না দেখলে কি হতো?এতক্ষনে তো…”

“মারা যেতাম তাই তো?”

তিথির কথা শুনে ছেলেটা স্তব্দ হয়ে গেলো।তিথি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।আমি আসছি।”

বলেই রাস্তার পরে যাওয়া ব্যাগটা কাধে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।তিথির সাথে সাথে ছেলেটাও উঠে দাঁড়ালো।তিথি কিছুদুর হেঁটে কি একটা মনে পরতেই পিছন ফিরে বলল,

“ধন্যবাদ!”

ছেলেটা তিথির কাছ থেকে এই শব্দটা আসা করেনি তা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।গতকাল রাতে তিথির সাথে কথা হবার পর ভেবেছিলো মেয়েটা বোধ হয় ঘাড়ত্যাড়া।যেভাবে কথা বলছিলো এটা দ্বারা এটাই প্রমানিত হয়েছিলো।কিন্তু ছেলেটার ভাবনাকে এক নিমিষেই পালটে দিয়েছে মেয়েটা।হঠাত পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠতেই তাড়াতাড়ি অফিসের ভিতর ঢুকে গেলো।তিথিকে সোফায় বসে আছে। সামনের টেবিলে কফি রাখা।তিথির সামনে ম্যানেজার বসে আছে।কিছুক্ষন পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন।বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখে তিথি বলল,

“কোন প্রবলেম স্যার?বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন যে?”

ম্যানেজার একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

“আর বলবেননা!ছেলেটাকে নিয়ে আর পারি না!বললাম আজকে তাড়াতাড়ি আসতে।আজকেই দেরি করে আসছে।ওকে ছাড়া আপনি কাজ বুঝাবেন কি করে?যতোই হোক আপনি উনার আন্ডারে কাজ করবেন।উনার কাজ তো আপনাকে আমি বুঝিয়ে দিতে পারি না।”

“এসে পরবে বোধহয়।মেবি জ্যামে আটকে গেছে।”

কথাটা বলার সাথে সাথে কেও এসে বলল,

“আসব?”

ম্যানেজার সাহেব ভ্রু কুচকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে বলল,

“জ্বি আসুন।লেট হবার কারন?”

“রাস্তায় একটু ঝামেলা হয়েছিলো।সেটাই সলভ করতে করতে দেরি হয়ে গেল।”

“কি ঝামেলা হয়েছিলো?”

“একটা মেয়ে বিপদে পরেছিলো।উনাকে হেল্প করতে যেয়ে দেরি হয়ে গেছে।”

তিথি এতক্ষন মাথা নিচু করে বসেছিলো।হঠাত এই কথাটা শুনে চোখ তুলে পাশে তাকাতেই চোখ জোড়া বড় হয়ে গেলো। এই ছেলের আন্ডারে সে কাজ করবে?দুনিয়াতে কি আর কোন ছেলে ছিলো না?আজব!”

“হয়েছে!অনেক হেল্প করেছেন আপনি! এখন বসুন।আপনার জন্য মেয়েটাকে কখন থেকে বসিয়ে রেখেছি।”

ছেলেটা সামনের সোফায় বসতে বসতে বলল,

“সরি আপনাকে বসিয়ে রাখার জন্য। ”

বলে সামনে তাকাতেই তিথির মুখ দৃশ্যমান হলো।ম্যানেজার সাহেব তিথিকে বললেন,

“উনি হচ্ছেন তাহসান।উনার আন্ডারেই আপনি কাজ করবেন আপনাকে সব কাজ উনিই বুঝিয়ে দিবেন।আমি তাহলে আসি।”

তাহসান হাসিমুখে বলল,

“জ্বি স্যার।”

ম্যানেজার চলে যেতেই তাহসান তিথির দিকে তাকিয়ে বলল,

“আপনার সাথে যে এভাবে আবার দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।”

“কেন ভাবলে কি হতো?”

“না মানে আপনার সাথে এই নিয়ে আমার ৩ বার দেখা হলো।কোন পরিচিত মানুষের সাথে তিনবার দেখা হওয়াটা স্বাভাবিক কোন বিষয় না!”

“স্বাভাবিক বিষয় না কেন?এখানে তো আমি অস্বাভাবিকের কিছুই দেখছি না!”

“ডেস্টিনি বুঝেন?”

“না বুঝার কি আছে?আমাকে কি অশিক্ষিত মনে হয় আপনার?”

“আরে আমি কখন এই কথা বললাম?আমার মনে হচ্ছে আমাদের এই বারবার দেখা হবার পিছনে ডেস্টিনির হাত আছে।”

তিথি বিরক্ত হয়ে বলল,

“আপনি আমাকে কাজটা বুঝালে সুবিধা হতো!”

“অবশ্যই। চলুন আমার সাথে।”

.
.

“অনিমা!টেবিলের ড্রয়ারে আমার মানিব্যাগ আছে।একটু নিয়ে আসবেন প্লিজ?”

ড্রয়িংরুম থেকে চিল্লিয়ে কথাটা বলল নিহান।নিহানের কথা শুনে টেবিলের সামনে এগিয়ে গেলো।ড্রয়ারটা খুলে মানিব্যাগটা বের করে নিলো।ড্রয়িংরুমে গিয়ে নিহানের দিকে বারিয়ে দিতেই নিহান বলল,

“অরিন কোথায়?ওকে একা ফেলে এসেছেন রুমে?”

“নাহ!মারিয়ার কাছে আছে।”

“অহ আচ্ছা।বিকালের দিকে একটু রেডি থাকবেন।”

“কেন?”

“দাদীর বাড়ি যাবো।আপনাকে তো দাদী দেখেন নি!সকালেই ফোন দিয়ে বলেছিলো আপনাকে নিয়ে যেন যাই সকাল সকাল।কিন্ত আমার আজকে একটা অপারেশন আছে দুপুরের দিকে।তাই অপারেশনটা শেষ করেই যাবো।আপনার এতে অসুবিধা আছে?”

“নাহ!কি অসুবিধা থাকবে?”

“তাহলে বিকালে দেখা হচ্ছে।আম্মুকে বলে রেখেছি।চিন্তা করবেন না।”

অনিমা উপর নিচ মাথা নাড়লো।নিহান হেসে অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো।নিহানের এই কাজে অনিমা স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।নিহান এই ফাস্ট ওকে স্পর্শ করলো।এর আগে যতবারই স্পর্শ করেছে কোন কারনে। কিন্তু আজকে কোন কারন ছাড়াই মাথায় স্পর্শ করেছে।রুমে যেতেই চোখে পরল টেবিলের নিচে ডাইরির মতো কি যেন পরে আছে।মানিব্যাগ বের করতে গিয়েই মনে হয় পরে গেছে।অনিমা এগিয়ে নিচু হয়ে তুলতেই যাবে হঠাত পিছন থেকে তিথি এসে বলল,

“ভাবি!অরিন কান্না করছে। মনে হয় ক্ষিধে পেয়েছে ওর।”

অনিমা ডাইরিটা তুললো না। তিথির কাছ থেকে অরিনকে নিয়ে নিলো।তিথি যেতে যেতে বলল,

“তুমি তাহলে ওকে দুধ খাওয়াও!আমি যাই।”

অনিমা অরিনকে দুধ খাওয়ানো শুরু করল।আচ্ছা অই ডাইরিটা কিসের ডাইরি ছিলো?কেমন চিনা চিনা লাগছিলো।মনে হচ্ছে আগেও কোথাও দেখেছিলো।একটু ভালো করে চিন্তা করতেই মনে পরল সেইম এরকম একটা ডাইরি তো সে মাহিরকে দিয়েছিলো ছোটবেলায়। এই ডাইরি নিহানের কাছে কি করে আসলো?তাহলে নিহানই কি মাহির?কিন্তু নিহান কেন ওকে বললো না যে ওই মাহির।বিষয়টা মাথায় ঢুকলো না। অরিনকে দুধ খাওয়ানো শেষ করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে টেবিলের কাছে আসলো।ডাইরিটা এখনো পরে আছে নিচে।নিচু হয়ে তুলতেই যাবে আবারও নিহানের মা নিচ থেকে অনিমাকে ডাক দিলেন।অনিমা অরিনকে কোলে নিয়ে নিচে চলে গেলো।

“ডেকেছিলেন?”

“হুম।এক কাপ চা করতে বলো রহিমাকে।কখন ডাকছি ওকে শুনছেইনা!অগত্যা না চাইতেও তোমাকে ডাকতে হলো।”

“আমি গিয়ে বলছি।”

“বাচ্চাটাকে এখানে রেখে যাও। রান্নাঘরে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।”

“এখানে কোথায় রাখব?”

মুক্তা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,

“কোথায় আবার?আমার কাছে রেখে যাও!আমার মতো জলজ্যান্ত মানুষটাকে চোখে পরছেনা তোমার?”

অনিমা অবাক হয়ে বলল,

“আপনি অরিনকে কোলে নিবেন?”

“হ্যা তো?স্বাধে তো আর কোলে নিচ্ছিনা।এখন ওকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলে ওর অসুখ হবে তখন তো আমার ছেলেরই সমস্যা হবে।

কিছুক্ষন থেমে বলল,

“অরিনকে আমি কোলে নিলে কি তোমার কোন সমস্যা আছে?”

অনিমা হকচকিয়ে বলল,

“না না!আমার কি সমস্যা থাকবে?আপনি নিন।আমি রহিমা খালাকে বলো আসছি।”

বলেই মুক্তা বেগমের কোলে অরিনকে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।অনিমার যেন এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না নিহানের মা নিজ থেকে অরিনকে কোলে নিয়েছে।রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখলো রহিমা মাছ কাটছে।অনিমা এগিয়ে গিয়ে বলল চা বানাতে।কিন্তু রহিমার এতে কোন হেলদোল নেই।সে নিজের মতে মাছ কেটেই যাচ্ছে।অনিমার ভ্রু কুচকে এলো।চোখের সামনে হাত নাড়াতেই রহিমা কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বলল,

“আপনি কখন আইলেন?আমারে ডাকলেন না কেন?”

“অনেক আগেই এসেছি।ডেকেছিও কিন্তু শুনো নি।”

“আর কইয়েন না মাছ কাটতে এতো বিরক্ত লাগে!এর লাইফা কানে ইয়ারফোন দিয়া মাছ কাটতে ছিলাম যাতে বোং না লাগে!”

অনিমা ভ্রু কৃচকে বলল,

“বোং?”

“হো বোং! বোং মানে জানেন না?”

“নাহ!”

“আরে বোং মানে হইলো বিরক্ত। ”

অনিমা কোনমতে হেসে বলল,

“অহ আচ্ছা।তোমাকে চা বানাতে বল়ছে।”

“এই হাত দিয়া কেমনে চা বানামু?মাছের আইশটার গন্ধ লাগব।আপনি বানাই নেন।”

“আমি?যদি রাগ করে?আর আমি জানিও না উনি কিভাবে চা খায়?”

“বুঝতে পারলেই না!আপনি খালি চিনি দিবেন না তাইলেই হইবো।”

অনিমা ভয়ে ভয়ে চুলায় পানি বসালো।কিছুক্ষনের মধ্যেই চা বানানো শেষে এগিয়ে গেলো।ড্রয়িংরুমে যেতেই অবাক হয়ে গেল।
.
.
তিথি কাজ শেষে ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই দেখলো সাতটা বাজে।সবকিছু গুছিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে বাস স্টেশনে দাঁড়ালো বাস আসার অপেক্ষায়।বাস আসবে ৭ঃ৩০ এ।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল দেখছিলো। হঠাত পাশে তাকাতেই দেখলো কয়েকটা ছেলে ওর ওড়নার দিকে তাকিয়ে আছে।তিথি ভ্রু কুচকে ওড়নার দিকে তাকাতেই দেখলো অর্ধেকটা ছিড়ে গেছে।মনে হয় সকালের রিকশার ঘটনার জন্যই ছিড়ে গেছে।ছিড়া ওড়নাটাকে গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো।তবুও বিশ্রী লাগছে।ওড়না ছিড়ে যাবার ফলে শরীরের বেশ খানিকটা অংশই দেখা যাচ্ছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো তিথি।আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো পুরো রাস্তা জন মানবহীন।জড়ো হয়ে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো।আর দোয়া করলো যেন বাস তাড়াতাড়ি চলে আসে হঠাৎ……

চলবে…..