একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-০৬

0
164

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬।

বাড়ি ফিরে এল অন্বিতা। তার চোখ মুখের অবস্থা বিধ্বস্ত। এমনটা নয় যে, সে আজ বেশি পরিশ্রম করেছে। বরং বলা যায়, আজ তেমন কোনো পরিশ্রম’ই হয়নি তার। কিন্তু তাও আজ সে ভীষণ ক্লান্ত। আসলে মানুষের মন বিষন্ন থাকলে কোনোকিছুতেই শান্তি মেলে না। তখন সারাদিন আরামে থাকলেও বড্ভ ক্লান্ত ঠেকে।

দরজা খুলে দিয়ে আসিয়া বেগম বেশ আগ্রহ সমেত জিজ্ঞেস করলেন,

‘মাহিরের সাথে কাজ করে কেমন লাগল? ডাক্তার হিসেবে ও নিশ্চয় খুব চমৎকার?’

অন্বিতা নিস্পৃহ কন্ঠে জবাব দিল,

‘হ্যাঁ, ডাক্তার হিসেবে উনি চমৎকার।’

আসিয়া বেগম তৃপ্ত হলেন। হেসে বললেন,

‘দেখবি, স্বামী হিসেবে এর থেকেও বেশি চমৎকার হবে।’

অন্বিতা সেদিকে না গিয়ে ব্যাগ খুলে টিফিনের বক্সটা মা’কে দিয়ে বলল,

‘খাবার’টা গরম করে রেখো, আমি ফ্রেশ হয়ে খেতে আসছি।’

‘সেকি! খাবার খাসনি?’

‘না, লাঞ্চ ব্রেকের সময় তো বাসায়’ই চলে এলাম; আর খাব কখন?’

‘আচ্ছা বেশ, তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।’

অন্বিতা গোসল সেরে ডাইনিং এ এসে বসে। খাবারের প্লেট সাজানো তার। তাই মা’কে ডেকে বলে,

‘কই, মা, এসো।’

ডালের বাটিটা ডাইনিং এ রেখে অন্বিতার পাশের চেয়ারে বসলেন আসিয়া বেগম। ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন,

‘হ্যাঁ রে, মাহির কিছু বলে না, পাকাপাকি কথা বলতে সে তার দাদুকে নিয়ে কবে আসবে?’

অন্বিতা নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখার চেষ্টা করে বলল,

‘না।’

‘তুই তো জিজ্ঞেস করতে পারিস?’

‘কেন মা, আমাকে কি আর পালতে পারছো না? কষ্ট হচ্ছে তোমার?’

আঁতকে উঠলেন আসিয়া বেগম। খাবার ফেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন মেয়ের দিকে। ব্যথিত সুরে বললেন,

‘এসব কী কথা, অন্বিতা? মেয়েকে পালতে মায়ের কষ্ট হবে কেন?’

‘তবে বারবার বিয়ের প্রসঙ্গ কেন তুলো?’

‘আমি তো তোর ভালোর কথা ভেবেই…’

‘আমি এমনিতেই যথেষ্ট ভালো আছি, মা। আমাকে এভাবেই থাকতে দাও, প্লিজ।’

আসিয়া বেগম আর কথা বাড়ালেন না। তবে মায়ের মন, ঠিকই বুঝে গেলেন মেয়ের কিছু একটা হয়েছে।

খাবার শেষ করে নিজের রুমে চলে আসে অন্বিতা। ফোনটা সাইলেন্টে রেখে চুপচাপ শুয়ে পড়ে বিছানায়। আসিয়া বেগম সব গুছিয়ে নিজের রুমে আসেন। মেয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে তাঁর। কিন্তু তিনি জানেন, মেয়েটা তাঁর যে চাপা স্বভাবের, বুক ফাটবে তো মুখ ফাটবে না। তাই তিনি উপায়ান্তর না পেয়ে মাহিরকে কল লাগালেন।

বিকেলের পেশেন্ট দেখছিল মাহির। আসিয়া বেগমের নাম্বার থেকে কল আসতে দেখে সে অবাক হয়। পেশেন্টের কাছ থেকে একটু সময় নিয়ে আঁড়াল হয়ে দাঁড়ায় সে। কল রিসিভ করে। প্রথমেই সালাম দেয়। সালামের জবাব দিয়ে আসিয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

‘কেমন আছো, বাবা?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আন্টি, আপনি কেমন আছেন?’

‘এমনিতে তো ভালোই থাকি। তবে মাঝে মাঝে মেয়েটার দুশ্চিন্তা আমাকে ভালো থাকতে দেয় না।’

‘কেন, আন্টি? কী হয়েছে?’

আসিয়া বেগম ইতস্তত সুরে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আজ কি হাসপাতালে কিছু হয়েছে, বাবা? মেয়েটা আসার পর থেকেই কেমন যেন মনমরা হয়ে আছে।’

‘আসলে আন্টি, অন্বিতা একটু লেইট করে আসাতে আমি ওকে ধমক দিয়েছিলাম, হয়তো তাই মন খারাপ করে আছে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সব ঠিক করে দিব।’

‘তোমার উপর তো আমার সবসময়ই ভরসা আছে।’

‘আমি আপনার এই ভরসা কখনো ভাঙব না। আর আন্টি, আরেকটা জরুরি কথা, আমার দাদু পরশু গ্রাম থেকে আসছেন। উনি এলেই আমি উনাকে নিয়ে বিয়ের ডেইট ফাইনাল করার জন্য আপনাদের বাড়িতে যাব।’

আসিয়া বেগম খুশি হয়ে বললেন,

‘আলহামদুলিল্লাহ, এসো বাবা, আমার কোনো আপত্তি নেই।’

‘ঠিক আছে, আন্টি, এখন রাখি তবে; আমার কেবিনে এখন পেশেন্ট আছে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, ভালো থাকো। পরে আবার কথা হবে।’

সালাম জানিয়ে ফোন কাটল মাহির। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার গিয়ে বসল তার চেয়ারে।

প্রতিদিনের ন্যায় আজও সন্ধ্যা পড়তেই ঘুম ভাঙ্গে অন্বিতার। মুখটা ধুয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। স্বভাববশত’ই উল্টো দিকের বিল্ডিং এর বারান্দায় নজর পড়ে। ঐ তো সেই ছায়ামানব। আবছা আলোয় আজ ছায়াটা একটু বেশিই প্রস্ফুটিত। অন্বিতা যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছেলেটা উদম গায়ে। এবং রোজকার দিনের মতো আজও ছেলেটা গিটারের সুরে গান তুলল। অন্বিতা ভেবে পায় না, একটা মানুষ প্রতিদিন একই কাজ করতে কী মজা পায়। এই যেমন, ছেলেটা প্রতিদিন গিটার হাতে সুর তুলে আর অন্বিতাও প্রতিদিন সেই সুরের মুগ্ধতায় হারিয়ে যায় কিয়ৎক্ষণের জন্য।

নিজের উপর খানিক বিরক্ত হয়ে অন্বিতা সিদ্ধান্ত নিল, সে আজ গান শুনবে না। এই ভেবেই চলে আসতে নেয় সে। কিন্তু হঠাৎই আবার থমকে দাঁড়ায়।

“যেও না চলে বন্ধু আমায় একা রেখে
যেও না চলে বন্ধু আমায় একা রেখে

খানিক বাদে রঙ লাগিবে আসমানের ওই বাঁকে
খানিক বাদে রঙ লাগিবে আসমানের ওই বাঁকে”

গান শুনে অবাক হয় অন্বিতা। মনে হয় যেন তাকেই উদ্দেশ্য করে গাইছে। সে অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। তারপর আর পুরো গান শেষ করার আগে যেতে পারে না সে। ছেলেটা গান শেষ করে ভেতরে চলে যায়। অন্বিতা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। সে বিস্মিত, এই ছেলের গান সে উপেক্ষা করতে পারে না কেন? কী আছে ঐ গানে?

অন্বিতা এই ভেবে আরো অনেকটা সময় ব্যয় করে অতঃপর রান্নাঘরের দিকে যায়, মা আর তার জন্য কফি বানাতে। আসিয়া বেগমও রান্নাঘরেই। নাস্তার জন্য কিছু একটা হয়তো বানাচ্ছেন তিনি। অন্বিতাকে দেখে তিনি বললেন,

‘আমার আজ মাহিরের সাথে কথা হয়েছে।’

অন্বিতা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

‘কী বলেছেন উনি?’

‘বলেছে, পরশু নাকি ওর দাদু গ্রাম থেকে ফিরছেন। আর তিনি ফিরলেই মাহির তাঁকে নিয়ে এসে বিয়ের ডেইট টা পাকা করে যাবে।’

‘বাহ, খুব ভালো খবর তো। খুশি হয়েছে তো এবার?’

আসিয়া বেগম মিইয়ে যাওয়া সুরে বললেন,

‘এভাবে বলছিস কেন? তুই কি খুশি না? অমন ভালো ছেলে…’

‘থাক মা, আমাকে এখন আর উনার গুনগান শুনাতে হবে না। আমি জানি, উনার মতো ভালো মানুষ দুনিয়াতে আর একটাও হয় না। আমার সৌভাগ্য যে আমি উনাকে পাচ্ছি, এই কথাগুলো এখন আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে; তোমাকে আর কষ্ট করে বলতে হবে না, মা।’

আসিয়া বেগম হাসলেন। বললেন,

‘তারও কিন্তু ভাগ্য কম না, আমার লক্ষী মেয়েটাকে বউ হিসেবে পাচ্ছে। এমন বউ পাওয়াও কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার।’

‘হয়েছে মা, এবার আমাকে একটু কফি পাউডার’টা দাও, কফি বানাই।’

________

দুশ্চিন্তায় পড়ল অন্বিতা। মাথার স্নায়ুগুলো হয়তো অকেজো হয়ে পড়েছে। নয়তো এত ভেবে ভেবেও কোনো সমাধান কেন পাচ্ছে না সে। এতকিছুর পরেও ঐ লোকটাকে সে কোনোভাবেই বিয়ে করতে চায় না। এত অপমান, এত সহজেই ভুলে যাবে? অন্বিতা মথা নাড়াল। না, পারবে না সে। ঘরভর্তি মানুষের সামনে অপমানিত হয়েছিল সে, এই অপমান সে কখনোই ভুলবে না। আর ভুলবে না অপমান করা মানুষগুলোকেও। অন্বিতা তার টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা ছবির ফ্রেম বের করল। হাত বুলাল সেই ছবির উপর। মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর বলল,

‘আমার এক আকাশ সমান ভালোবাসাকে তুমি অবিশ্বাস্য-এর ন্যায় জঘন্য হাতিয়ার দিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছ। আমার এত কান্না, এত হাহাকারের কোনো মূল্য দাওনি। তবে এখন কেন ফিরে এলে? সেদিন তো কত করে বলেছিলাম, আমাকে ছেড়ে যেও না। কী বলেছিলে, এমন ধোঁকাবাজের সাথে তুমি কোনোপ্রকার সম্পর্ক রাখতে চাও না। তবে আবার কী ভেবে ফিরে এলে এই ধোঁকাবাজের কাছে? তুমি জানো মাহির, আমি এখন আর তোমাকে ভালোবাসি না। কেবল ঘৃণা করি, ঘৃণা।’

কথাগুলো বলার পর মুহুর্তেই অন্বিতা খেয়াল করল ছবির ফ্রেমের উপর কয়েক ফোটা পানি। সে হাসল। বলল,

‘কী আশ্চর্য, মাহির! তোমার জন্য এখনো আমার চোখে পানি আসে।’

চলবে…