#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩।
অন্বিতা ইতস্তত সুরে বলল,
‘ঐ কেবিনের ডাক্তার একটু উনার বাসায় গিয়েছেন।’
রেগে গেল মাহির। ক্ষুব্ধ সুরে বলল,
‘ডিউটি টাইমে উনি কার অনুমতি নিয়ে বাসায় গিয়েছেন?’
‘হয়তো কোনো ইমারজেন্সি।’
‘ইমারজেন্সি সেটা কি কাউকে জানিয়েছেন উনি? আপনাকে বলে গিয়েছেন? আপনি উনার হয়ে সাফাই গাইছেন কেন?’
মাথা নুয়াল অন্বিতা। বলল,
‘আসলে স্যার, উনি আমাকে কেবিনে রেখে গিয়েছিলেন।’
এবার আরো বেশি রাগ হয় মাহিরের। সে চওড়া গলায় বলে,
‘আপনি কি গাইনি ডিপার্টমেন্টের? উনি কোন আক্কেলে আপনাকে বসিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারেন? এই জ্ঞান নিয়ে উনি ডাক্তারি করছেন?’
মাহিরের উঁচু গলার স্বরে খানিকটা ভয় পেয়ে যায় অন্বিতা। মাহির তার সহকারীকে ডেকে আনে। বলে, ঐ কেবিনে একজন গাইনোকোলজিস্ট পাঠাতে। আর সাথে বলে, ঐ কেবিনের ডাক্তার এলে যেন তার কাছে পাঠিয়ে দেয়।
সহকারী তার কথা মতো কাজ করতে গেল। মাহির এবার ভ্রুকুটি করে তাকাল অন্বিতার দিকে। গম্ভীর সুরে বলল,
‘আর আপনি, লাঞ্চের পর আমার সাথে দেখা করবেন। এখন আসুন।’
অন্বিতা চলে এল কেবিন থেকে। মানুষের উপকার করেও আজকাল শান্তি নেই। মাহির তার কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস এটা সে জানে। কাজের ক্ষেত্রে সে কাউকে ছাড় দেয় না, অন্বিতাও যে আজ ছাড় পাবে না, সেটা সে বেশ বুঝতে পারছে।
দুপুরের আগ অবধি চিন্তায় চিন্তায় রোগী দেখল অন্বিতা। সহকারী এসেছে। অন্বিতাকে বলল,
‘স্যার ডাকছেন আপনাকে।’
ঢোক গিলল অন্বিতা। মাহিরকে সে যদিও খুব একটা ভয় পায় না, তবে সে রেগে গেলে অন্যকথা। মনে সাহস জুগিয়ে মাহিরের কেবিনের কাছে গেল। দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করল,
‘আসব, স্যার?’
‘আসুন।’
গলার স্বর সুবিধার ঠেকল না। ধীয় পায়ে ভেতরে এল সে। কেবিনে দেখল সেই জুনিয়র ডাক্তারও উপস্থিত। মাথা নুইয়ে সে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্বিতা তার পাশেই দাঁড়াল। মাহিরের চোখ মুখ দৃঢ়। সে জলদগম্ভীর সুরে বলল,
‘ড. রাইনা, আপনি কোন জ্ঞানে আপনার কেবিনে একজন ইন্টার্ন ডাক্তারকে বসিয়ে গেলেন? তার উপর সে আবার অন্য ডিপার্টমেন্টের। আজ ঠিক কতগুলো ভুল আপনি করেছেন, সেটা কি আপনি আন্দাজ করতে পারছেন?’
রাইনা নামের ডাক্তারটি ঢোক গিলল। গলাটা যেন শুকিয়ে এসেছে তার। ভয়, আর জড়তায় জিভ ভার হয়ে আছে। যুতসই কোনো জবাব পাচ্ছে না। মাহিরের গলার স্বর চওড়া হলো। সে বলল,
‘প্রথমত, আপনি ডিপার্টমেন্টে না জানিয়েই আপনার বাসায় গিয়েছেন; দ্বিতীয়ত, আপনার কেবিনে বসিয়ে গিয়েছেন অন্য ডিপার্টমেন্টের একজন ইন্টার্ন ডাক্তারকে। এবার বলুন, আপনার এই মূর্খতার জন্য আপনাকে ঠিক কী শাস্তি দেওয়া যায়?’
রাইনা ভীত সুরে বলল,
‘এবারের মতো ক্ষমা করে দিন, স্যার।’
‘আপনাকে ক্ষমা করে আমি কি আমার নার্সিংহোমের বদনাম করব?’
রাইনা অসহায় সুরে বলল,
‘আর হবে না, স্যার।’
মাহিরের মন গলল না। সে বলল,
‘আগামী দুই মাসের জন্য আপনাকে সাসপেন্ড করা হলো।’
আঁতকে উঠল রাইনা আর অন্বিতা। মাহির যে এতটা কঠোর হবে অন্বিতা ভাবেনি। রাইনা অনুরোধ করল খুব। কিন্তু মাহিরকে তার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও হটাতে পারল না। সে বিধ্বস্ত, বিষন্ন মনে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। এখন কেবিনে কেবল অন্বিতা। সে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহির এবার তার দিকে চাইল। রাশভারী স্বরে বলল,
‘আমাকে না জানিয়ে অন্য ডিপার্টমেন্টের ডক্টরের কেবিনে বসার জন্য এখন আপনাকে কী শাস্তি দিব বলুন, অন্বিতা।’
অন্বিতা ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আপনার যা খুশি।’
বসা থেকে উঠে দাঁড়াল মাহির। অন্বিতার কাছে গেল। তার বরাবর টেবিলে হেলান দিয়ে বলল,
‘যা খুশি?’
অন্বিতা চোখ তুলে তাকাল। মাহিরকে দেখে বর্তমানে তার কিঞ্চিৎ ভয় জাগছে মনে। তাও সাহস করে বলল,
‘জি।’
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল মাহির। বলল,
‘আজ থেকে আগামী এক সপ্তাহ দিন রাত উভয় সময় আপনি ডিউটি করবেন।’
অন্বিতা হতবাক। নাইট ডিউটি এমনিতে সপ্তাহে একদিন পরে তার, আর এখন এক সপ্তাহ টানা নাইট ডিউটি? সে অনুনয়ের সুরে বলল,
‘স্যার, সময়টা কি একটু কমানো যায় না?’
‘না, কেবল বাড়ানো যেতে পারে। বাড়াব?’
মাথা ঝাঁকাল অন্বিতা। বলল,
‘না না, দরকার নেই।’
অন্বিতার ঠিক সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল মাহির। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,
‘পরের বার কিছু করার আগে অবশ্যই আমাকে আগে জানাবে।’
অন্বিতা সম্মতি জানাল। মাহির বলল,
‘যাও এবার, কাজের প্রস্তুতি নাও।’
কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে অন্বিতা। এই নাইট ডিউটি টা তার মোটেও পছন্দ না। আর এখন কি-না টানা এক সপ্তাহ নাইট ডিউটি করতে হবে।
বিষন্ন মনে ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ কফি খেয়ে নিল সে। যদি কফি খেয়ে মনে একটু শান্তি পায়।
বিকেলের দিকে বাসায় এসেছিল অন্বিতা। ফ্রেশ হয়ে, খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে, এখন আবার তৈরি হচ্ছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। আসিয়া বেগম তার রুমে এলেন তখন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘আজকে কি নাইট আছে?’
অন্বিতা হাতে ঘড়ি পরতে পরতে বলল,
‘হ্যাঁ, মা।’
মন খারাপ করে বিছানায় বসলেন আসিয়া বেগম। বললেন,
‘তোর নাইট থাকলে আমার একদমই ভালো লাগে না। পুরো রাত আমার একা থাকতে হয়।’
অন্বিতারও মন খারাপ হলো। সে মায়ের পাশে বসে বলল,
‘এই পুরো সপ্তাহ আমার নাইট থাকবে, মা। আমারও ভালো লাগছে না।’
মেয়ের গালে হাত রেখে আসিয়া বেগম আদুরে গলায় বললেন,
‘ভালো লাগবে, মা। যখন দেখবি তোর পরিশ্রমের বিনিময়ে একজন মানুষ সুস্থ হয়ে উঠছে, তখন। আমি তো নিজেকে এটাই বুঝাই, আমার মেয়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত। কত মহৎ কাজ এটা, তুই জানিস।’
প্রসন্ন হাসল অন্বিতা। বলল,
‘হ্যাঁ মা, আমিও চাই পৃথিবীর সমস্ত অসুস্থ মানুষ সুস্থ হয়ে উঠুক; আবার নতুন করে বাঁচুক তাঁরা। আমার এই দুই হাতে আমি সেসব মানুষদের সেবা দিতে চাই, মা।’
‘ইনশাল্লাহ, আল্লাহ আমার মেয়ের সকল নেক ইচ্ছা পূরণ করবেন।’
‘আমিন।’
মেয়েকে আদর করে বিদায় জানালেন আসিয়া বেগম।
রাস্তার পাশ ঘেঁষে হেঁটে চলছে অন্বিতা। সকালে মাহিরের গাড়িতে করে চলে গেলেও, এখন হেঁটেই রওনা করেছে। মেইন রাস্তায় গিয়েই একটা রিক্সায় উঠে যাবে। এরই মাঝে সে তার পাশে একজনের উপস্থিতি টের পায়। অন্বিতা তাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি?’
‘জি, রুমে ভালো লাগছিল না বলে একটু হাঁটতে বের হলাম। কিন্তু আপনি এসময় এপ্রোন গায়ে কোথায় যাচ্ছেন?’
‘হাসপাতালে।’
‘আজ এই সময়?’
‘নাইট ডিউটি আছে, তাই।’
‘ওহ। হেঁটেই যাবেন না-কি?’
‘না, সামনে থেকে একটা রিক্সায় উঠে যাব।’
‘আমি গাড়ি নিয়ে আসলে আপনাকে ড্রপ করে দিতে পারতাম।’
‘না না, ধন্যবাদ। আমি রিক্সাতেই যেতে পারব।’
পাশের মানুষটি আর কিছু বলল না। তবে তার সাথেই হেঁটে চলছে। অন্বিতা বেশ কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি তো ই-ফোর নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন, তাই না?’
অমিত হেসে বলল,
‘না না, বি-ফোর এ থাকি আমি।’
অন্বিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘মানে দক্ষিণমুখী ফ্ল্যাটে?’
‘জি।’
‘তবে ই-ফোর এ কে থাকে?’
‘ঐ ফ্ল্যাটেও ব্যাচেলর থাকে শুনেছি, কেন?’
‘না আসলে, এমনিতেই জানতে চাইলাম।’
অন্বিতার মস্তিষ্কে এবার নতুন প্রশ্নের উদয় হলো, এই লোকটা যদি ই-ফোর এ না’ই থাকে তবে সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিটা আসলে কে?
চলবে…