#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৫।
অন্বিতার মুখে “অমিত” নামটা শুনে এগিয়ে আসে মাহির। স্ট্রেচারে শায়িত বিধ্বস্ত ছেলেটাকে দেখে কপাল কুঁচকায় সে। অন্বিতাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কে উনি? সেই অমিত দে?’
অন্বিতা মাথা ঝাঁকাল। বলল,
‘জি। আমাদের পাশের বিল্ডিং এ যিনি থাকেন।’
মাহির কপালের ভাঁজ আরো দৃঢ় হলো। এই প্রথম বোধ হয় কোনো রোগীর দিকে সে এতটা বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। অন্বিতা উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘উনার কী হয়েছে? আজ সন্ধ্যায়ও তো একদম ঠিক ছিলেন।’
পাশের নার্স বলল,
‘এক্সিডেন্ট করেছেন।’
‘অনেক রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে, সিরিয়াস কিছু হয়ে যায়নি তো?’
এই ছেলের জন্য অন্বিতার এত অস্থিরতা মাহিরের মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। অন্য কোনো পেশেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও, এক্ষেত্রে সে মোটেও স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না সবকিছু। সে গম্ভীর সুরে বলল,
‘অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে। মাথায় বেশ চোট পেয়েছে, সেলাই এর প্রয়োজন।’
‘তবে দেরি করছেন কেন?’
‘ডাক্তার এসেছে, অন্বিতা। আপনাকে এত অস্থির হতে হবে না।’
মাহির সার্জনের দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনি উনাকে এখনই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। আর কোনোপ্রকার সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।’
সার্জন সম্মতি জানিয়ে তার রোগী নিয়ে ও.টি’র দিকে চলে গেল। অন্বিতার দুশ্চিন্তা হচ্ছে, কষ্ট লাগছে। মানুষটা তো কিছুক্ষণ আগেও সুস্থ ছিল। কিছু সময়ের ব্যবধানে কী হয়ে গেল এসব!
অন্বিতার উদ্বিগ্ন মুখটার দিকে চেয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল মাহির। বলল,
‘চিন্তা নেই। উনি ঠিক হয়ে যাবেন।’
অন্বিতা এবার তার দিকে চাইল। বলল,
‘এক্সিডেন্ট কীভাবে হয়েছে, জানেন কিছু?’
‘ঐ যে, উনার গাড়ির সাথে।’
অন্বিতা মাহিরের ইশারা অনুসরণ করে দেখল রিসেপশনে একজন লোক বসা। তাকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে বেশ। মাহির বলল,
‘পুলিশ কেইস হবে এটা। রোগীর জ্ঞান ফিরলে বিষয়টা আরো ক্লিয়ার হবে।’
অন্বিতা এক পল দাঁড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই মাহির বলল,
‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?’
‘ও.টি’র সামনে।’
মাহির বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘এত অস্থির হচ্ছো কেন? উনার গুরুতর কিছু হয়নি।’
অন্বিতা থামল। মাহিরকে সে এখন কী করে বুঝাবে, সে যে কেবল মানবতার খাতিরে’ই অস্থির হচ্ছে, অন্য কোনো কারণ নেই। সে বসল এক কোণে। মাহির গিয়ে বলল,
‘তোমার ডেস্কে গিয়ে বসো। অপারেশন শেষ হলে তোমাকে জানানো হবে।’
মাহিরের কথা মতো ডেস্কের দিকে চলে গেল অন্বিতা। মাহির কতক্ষণ কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে থেকে চলে এল নিজের কেবিনে।
__________
রিসেপশনে ছুটে এল লম্বা দেখতে একটি ছেলে। সেখানে কার্যরত কর্মচারীকে বলল,
‘একটু আগেই আমার নাম্বারে ফোন করে জানানো হয়েছে আমার বন্ধু নাকি এই হাসপাতালে ভর্তি। ও এখন কোথায় একটু বলতে পারবেন?’
কর্মচারী খাতা দেখে বলল,
‘পেশেন্টকে ইমারজেন্সিতে নেওয়া হয়েছিল, আপনি একটু সেখানে গিয়ে খবর নিন।’
ছেলেটি ইমারজেন্সি কক্ষে ছুটে এল। একজন ডাক্তার ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। সে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘আমার বন্ধুকে এখানে আনা হয়েছিল, সে এখন কোথায় বলতে পারবেন?’
চোখ তুলে তাকাল অন্বিতা। তার ঠিক সম্মুখে দাঁড়ান ছেলেটি। দেখে মনে হচ্ছে, ভীষণ অস্থিরতা তার মাঝে। কপালে ঘাম জমে। গায়ের শার্ট’টাও ভিজে আছে। অন্বিতা জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার বন্ধুর নাম কী?’
‘অমিত, অমিত দে। কিছুক্ষণ আগেই এই হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলেছিল, ওর না’কি এক্সিডেন্ট হয়েছে। ও এখন কোথায়?’
অন্বিতা উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘আপনার বন্ধুর অপারেশন চলছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেডে নেওয়া হবে।’
ছেলেটি আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠল। বলল,
‘কী হয়েছে ওর? খুব খারাপ কিছু হয়নি তো?’
‘মাথার চোট’টা একটু গভীর। তবে চিন্তা করবেন না, ঠিক হয়ে যাবে। আপনি ঐখানে বসে অপেক্ষা করুন।’
ছেলেটি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে করিডোরের এক কোণে বসার জায়গায় বসল। অন্বিতাও বসল তার স্থানে।
কিছুক্ষণ বাদেই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এল সবাই। স্ট্রেচারে করে অমিতকেও আনা হলো। অন্বিতা আর সেই ছেলেটি ছুটে গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। অমিতের মাথা সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যান্ডেজ করা। নার্স বলল,
‘উনাকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে, তবে তার আগে উনার বাড়ি থেকে কেউ এসে থাকলে উনাকে আগে রিসেপশনে গিয়ে ফর্ম পূরণ করতে বলুন।’
অন্বিতা সেই ছেলেটির দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনি গিয়ে ফর্মটা পূরণ করে আসুন।’
‘ঠিক আছে, এক্ষুনি যাচ্ছি।’
ছেলেটি চলে গেল রিসেপশনের দিকে। অন্বিতা নার্সকে বলল,
‘আপনি উনাকে কেবিনে নিয়ে যান।’
নার্স তাই করল। অন্বিতা ভাবল, একবার কি মাহিরকে ডাকবে? সে দুটানা নিয়ে ফিরতেই দেখেই মাহির পেছনেই দাঁড়ান। মাহির এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘অস্থিরতা কমেছে?’
‘জি।’
‘ডাক্তার হয়ে পেশেন্টের জন্য অস্থিরতা দেখানো’টা স্বাভাবিক। তবে এতটাও না।’
এই বলে মাহির সামনে এগোতেই অন্বিতা বলল,
‘উনার একজন বন্ধু এসেছেন।’
ফিরে তাকাল মাহির। জিজ্ঞেস করল,
‘কোথায়?’
‘রিসেপশনে, ফর্ম পূরণ করতে গিয়েছেন।’
মাহির পথ ঘুরিয়ে রিসেপশনের দিকে গেল। ছেলেটি ফর্ম পূরণ করে ফিরতেই মাহির তার সামনে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি অমিত দে’র বন্ধু?’
‘জি।’
‘উনার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। যার গাড়ির সাথে লেগে এক্সিডেন্ট’টা হয়েছে উনি এখানেই আছেন। এসব ব্যাপার সাধারণ পুলিশ কেইস ছাড়া আমরা হ্যান্ডেল করি না। কিন্তু তখন আপনার বন্ধুর জীবন বাঁচানোটা ফরজ ছিল বলে এত ঝামেলায় আর যাওয়া হয়নি। আপনি পারলে একটা পুলিশ কেইস করতে পারেন।’
‘আচ্ছা। আগে আমার বন্ধু সুস্থ হয়ে উঠুক, তারপর আমি সব ব্যবস্থা নিব।’
‘ঠিক আছে। আপনার বন্ধুকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে, গিয়ে এখন দেখা করতে পারেন।’
ছেলেটি মাথা হেলিয়ে চলে গেল। মাহির দুহাত পকেটে পুরে পিঠ টান টান করে দাঁড়ায়। চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্ত তার। ভ্রু জোড়া এখনও কুঁচকানো। দুনিয়াতে এত হাসপাতাল থাকতে ঐ অমিত দে কে তার হাসপাতালেই আসতে হলো।
ছেলেটি গিয়ে তার বন্ধুর পাশে বসে। বন্ধুর জখমপ্রাপ্ত বিধ্বস্ত চেহারাটা দেখে বড্ড মায়া হয় তার। অন্বিতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘জ্ঞান ফিরবে কখন?’
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে।’
মাহির তখন সেই কেবিনে এসে উপস্থিত হয়। অন্বিতার পাশে এসে দাঁড়ায়। ধীর গলায় বলে,
‘আপনি এখন বাড়ি যেতে পারেন, আপনার ডিউটির টাইম শেষ।’
অন্বিতা অবাক হলো। মাহিরের দিকে তাকাতেই সে বুঝল, মাহির কেন এমনটা বলছে।
‘কিন্তু স্যার, আমার তো সকালে ফেরার কথা।’
‘আমি বলেছি না, আপনার টাইম শেষ। আমি বাইরে আমার ড্রাইভারকে বলে রেখেছি, সে আপনাকে আপনার বাসায় নামিয়ে দিবে।’
অন্বিতা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ মাহিরের দিকে চেয়ে থেকে অমিতের দিকে চাইল আবার। মাহির শক্ত কিন্তু ধীর গলায় বলল,
‘উনাকে দেখার জন্য এখানে অনেক নার্স ডাক্তার আছেন, আপনাকে এত দুশ্চিন্তার করতে হবে না।’
মাহির ক্ষেপে আছে এটা আর বোঝার বাকি নেই। অন্বিতা মাথা নুইয়ে বলল,
‘ঠিক আছে, স্যার, আপনি যা বলবেন তাই হবে।’
অন্বিতা চলে এল সেখান থেকে। মাহিরও আর সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চলে গেল নিজের কেবিনে।
চলবে…..