একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-১৮

0
154

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮।

অন্বিতা অমিতের ডাক্তারের কাছে গেল। দরজায় নক করে বলল,

‘আসব?’

‘আসুন।’

ভেতরে প্রবেশ করল সে। ডাক্তার হেসে বললেন,

‘বসুন না।’

অন্বিতা বসল। বলল,

‘আপনার পেশেন্ট অমিত দে, উনি না-কি এখনো পুরোপুরি সুস্থতা বোধ করছেন না। আমার মনে হয়, উনাকে আর দু একটা দিন পরে ছাড়লে ভালো হয়।’

‘ম্যাডাম, এটা তো মাহির স্যারের নির্দেশ।’

অন্বিতা ভ্রু কুঁচকাল। এতক্ষণে ব্যাপারটা বোধগম্য হলো তার। তারমানে মাহির ইচ্ছে করেই অমিতকে তাড়াহুড়ো করে ছেড়ে দিচ্ছে। উঠে দাঁড়াল অন্বিতা। কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘আচ্ছা, ধন্যবাদ।’

সে চলে আসতে নিলেই ডাক্তার বলে উঠেন,

‘কনগ্রাচুলেশন, ম্যাডাম।’

অন্বিতা ফিরে চেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কীসের জন্য?’

‘শুনলাম, সামনের মাসেই আপনার আর স্যারের বিয়ে, তাই শুভকামনা রইল।’

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল অন্বিতা। হাসিটা জোরপূর্বক দিয়ে বলল,

‘ধন্যবাদ।’

বেরিয়ে এল সে। পুরো হাসপাতালের বোধ হয় আর কেউ বাকি নেই এখন আর জানার। সে মাহিরের কেবিনের কাছে গেল। মাহিরের সহকারী বাইরে বসা। অন্বিতাকে দেখে বলল,

‘ভেতরে পেশেন্ট আছে, ম্যাডাম।’

অন্বিতা একপাশে বসে বলল,

‘আচ্ছা, পেশেন্ট গেলেই যাব।’

পেশেন্ট বেরিয়ে এল কিছু সময় পর। অন্বিতা নক করে ভেতরে ঢুকল।

‘স্যার, একটা জরুরি কথা ছিল।’

মাহির তাকাল তার দিকে। বলল,

‘বলুন।’

‘স্যার, অমিত দে’র শরীর এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়। উনাকে এখনই রিলিজ না দিলে হয় না?’

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল মাহির। তার চোখ মুখ দেখে ভাবমূর্তি বোঝার জো নেই। গম্ভীর স্বরে বলল,

‘আপনি যে ইন্টার্ন ডাক্তার সেটা কি ভুলে গিয়েছেন?’

অন্বিতা মাথা নুয়াল। বলল,

‘না, স্যার।’

‘তবে একজন সিনিয়র ডাক্তারের সিদ্ধান্তে সন্দেহ প্রকাশ করছেন কোন সাহসে? নিশ্চয় আপনার চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা বেশি।’

অন্বিতা অপ্রস্তুত হলো। বলল,

‘জি স্যার, আমি জানি। আসলে পেশেন্ট নিজেই আমাকে এটা বলেছেন তো, তাই…’

‘কই, আমাকে তো কিছু বলেননি। আপনি তো উনার চিকিৎসা করছেন না, তবে আপনাকে কেন বলল?’

অন্বিতা বিরক্ত বোধ করছে খুব। যতই ইনিয়ে বিনিয়ে মাহির অন্যকিছু বোঝাক, সে তো মাহিরের অস্থিরতা বুঝতে পারছে।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘স্যার, আরেকটা কথা।’

‘জি, বলুন। আপনার কথা শোনার জন্যই আমি এখানে বসেছি।’

অন্বিতা মাহিরের নিম্নবিস্তারীনিবিড় চোখ পানে চাইল। গলার স্বর ক্ষীণ করে বলল,

‘আপনার অনুপস্থিতে এই তিন বছরে আমার জীবনে নতুন কেউ আসেনি। যেখানে আপনার অনুপস্থিতে আমি আমার মনে অন্য কাউকে ঠাঁই দিতে পারিনি, সেখানে আপনার উপস্থিতিতে সেটা আমি কী করে করব? আবার তার উপর আমার আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে আপনি আপনার অধিকার দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমতাবস্থায় এই নিরীহ মন কিছুই করতে পারবে না, স্যার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। অন্তত, এই চিন্তায় নিজের পেশেন্টদের অবহেলা করবেন না। আসছি।’

কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল অন্বিতা। এই প্রথম অন্বিতার কোনো এক কথায় মনে বড্ড শান্তি অনুভব করছে মাহির। ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি তার। মনে হচ্ছে আজ অনেক দিন পর বুকের ভেতরটা একটু হালকা হয়েছে।

অমিতের কেবিনে তার চিকিৎসারত ডাক্তার এসে বললেন, তাদের আরো একদিন থেকে যাওয়ার জন্য। এই কথা শোনার পর থেকে অমিতের আনন্দ দেখে কে। অয়ন সোফায় বসে ক্ষুব্ধ চোখে তাকে দেখছে। অমিত হাসল। বলল,

‘মেয়েটার কি ক্ষমতা দেখেছিস?’

‘ক্ষমতা তো থাকবেই। এই নার্সিংহোমের ওনারের ফিয়ন্সি যে।’

অমিত কপাল কুঁচকাল। বলল,

‘ধুর, এই কথা মুখেও আনবি না। এটা শুনলে আমার রাগ হয়।’

‘আমাকে চুপ করিয়ে কি তুই সত্যকে মিথ্যে বানিয়ে ফেলতে পারবি?’

‘সত্যকে মিথ্যে বানাতে না পারি, পাল্টাতে তো পারব।’

অয়ন সোফায় পা লম্বা করে শু’লো। ফোনটা চোখের সামনে ধরে বলল,

‘কিছুই করতে পারবি না।’

‘অবশ্যই পারব। তুই অন্বিতাকে ডাক, আমি ওকে এক্ষুনি বলব সব।’

অয়ন হাসল। বলল,

‘এক্সিডেন্টে তো কেবল মাথাটা ফেটেছে খানিক, মাহির আশহাব জানতে পারলে এখন পুরো মাথাটাকেই শরীর থেকে আলাদা করে ফেলবে।’

‘মাহির আশহাবের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমি কাউকে ভয় পাই না।’

‘আমি পাই।’

অমিত চাইল তার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল,

‘কেন পাস? কীসের ভয় তোর? আগে তো এত ভয় পেতি না।’

অয়ন কিছু বলল না জবাবে। অমিত ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘জবাব দিচ্ছিস না যে?’

‘গেইম খেলছি, ডিস্টার্ব করিস না।’

অমিত রেগে বলল,

‘সারাজীবন এই গেইম’ই খেলে যাস; তোকে দিয়ে জীবনেও কিছু হবে না।’

অয়ন এমন ভাবে কথাটা অবজ্ঞা করল, যেন সে কিছু শুনেইনি।

বাসায় যাওয়ার আগে একবার ফের অমিতের কেবিনে এল অন্বিতা। জিজ্ঞেস করল,

‘শরীর এখন কেমন?’

অমিত হেসে বলল,

‘ভালো।’

‘মাথায় কি এখনো ব্যথা আছে?’

‘না, তেমন না। মাঝে মাঝে কেবল একটু চিনচিন করে।’

‘নার্স ঔষধ দিচ্ছে তো রেগুলার?’

‘জি।’

‘আচ্ছা। তারপরেও কোনো অসুবিধা হলে ডাক্তারকে জানাবেন।’

‘ঠিক আছে।’

‘রেস্ট নিন তবে। আমি বাসায় যাচ্ছি।’

‘ওহ, একাই যাচ্ছেন?’

‘জি।’

‘তাহলে আমার বন্ধুকেও সাথে নিন। ও সারাদিন খেয়ে না খেয়ে এখানে পড়ে আছে। গোসলটাও করেনি।’

অয়ন খানিকটা চওড়া গলায় বলল,

‘আমি এখন বাসায় যাব, বলেছি তোকে?’

অমিত ধমক দিল। বলল,

‘তোর বলতে হবে না। আমি বলেছি, সেটাই যথেষ্ট। তুই এখন উনার সাথে বাসায় যাবি। গিয়ে, গোসল করবি, ফ্রেশ হবি, খাওয়া দাওয়া করে আমার জন্য রাতের খাবার রেঁধে নিয়ে একেবারে আসবি, বুঝেছিস?’

‘আচ্ছা, যাব কিছুক্ষণ পর।’

‘কিছুক্ষণ পর কেন? উনি এই ভর সন্ধ্যায় একা ফিরবেন, একই তো রাস্তা, তুইও যা।’

অয়ন চোখ পাঁকিয়ে চেয়ে অমিতকে কিছু বলার চেষ্টা করে। অমিত সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলল,

‘অন্বিতা, আপনার কোনো অসুবিধা নেই তো?’

‘না না, আমার কোনো অসুবিধা নেই।’

‘তাহলে তো হলোই। অয়ন, যা তবে।’

অন্বিতার সামনে অয়ন আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না। পরাস্ত হয়ে পানসা মুখ নিয়ে অন্বিতার পেছন পেছন হাঁটা ধরল সে।

বাইরে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। অন্বিতা তো গাড়িতে উঠছে। অয়নকে থেমে যেতে দেখে অন্বিতা বলল,

‘কী হলো, আসুন।’

বিব্রতবোধ করছে অয়ন। ইতস্তত সুরে বলল,

‘গাড়ি’টা কার?’

অন্বিতা অপ্রস্তুত হেসে বলল,

‘মাহির স্যারের।’

অয়ন জোরপূর্বক হাসল। বলল,

‘আপনি যান, আমি রিক্সা করে চলে আসব।’

‘সেকি! কেন? গাড়িতে যেতে অসুবিধা কীসের?’

‘স্যার আপনার ফিয়ন্সি। উনি আপনার সুবিধার জন্য যেই গাড়ি দিয়েছেন সেটাতে আমি কী করে উঠি বলুন?’

‘আপনি এভাবে কেন ভাবছেন? স্যার কিছুই মনে করবেন না।’

‘তাও, আপনি যান। আমি একা যেতে পারব।’

অন্বিতা নেমে এল গাড়ি থেকে। বলল,

‘আপনার বন্ধুকে বলে এসে এখন আমার একা চলে যাওয়াটা খারাপ দেখায়। চলুন, একসাথেই যাব।’

অন্বিতা হাঁটা ধরল। অয়ন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। মেয়েটা ভারী অদ্ভুত!

এই সন্ধ্যায় গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। অন্বিতা আর অয়ন হেঁটেই চলছে। অয়ন ইতস্তত সুরে বলল,

‘আমার জন্য আপনাকে কষ্ট করে হেঁটে যেতে হচ্ছে।’

অন্বিতা মুচকি হেসে বলল,

‘আপনাকে কে বলল, আমার কষ্ট হচ্ছে?’

‘হচ্ছে না?’

‘একেবারেই না।’

রাস্তার এক পাশেই একটা চায়ের টং। কাছাকাছি আসতেই চায়ের গন্ধ যেন তরতরিয়ে নাসিকা দিয়ে প্রবেশ করল অন্বিতার। সে হেসে বলল,

‘চা খাবেন?’

‘একটা শর্তে।’

‘কী?’

‘বিলটা আমি দিব।’

অন্বিতা হাসল ফের। বলল,

‘ঠিক আছে, চলুন।’

চলবে…..