একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-৩১+৩২

0
20

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩১।

‘এভাবে চলতে পারে না, দোস্ত। একেবারেই পারে না।’

বিছানায় হেলান দেয়া অবস্থায় ঝুলন্ত ফ্যানটাকে নির্নিমেষ চেয়ে দেখছিল অয়ন। আচম্বিত অমিতের এই কথায় ভ্রু কুঁচকাল সে। অমিত কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ান। তার চৌকস চাহনি। অয়ন উঠে সোজা হয়ে বসল। জিজ্ঞেস করল,

‘কী চলতে পারে না?’

‘যেটা চলছে।’

অমিতের এত ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলাটা অয়নের মোটেও পছন্দ না। সে ফের বিছানায় হেলান দিয়ে বসে স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘কী বলতে চাচ্ছিস সোজাসুজি বল।’

অমিত তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। বলল,

‘আর দু’দিন। তারপরেই অন্বিতা অন্য কারোর।’

অয়ন পরিশ্রান্ত বদনে বলল,

‘তো?’

‘তো মানে? মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এখনও কি আমাদের চুপ থাকা উচিত? আর কত?’

অয়ন সাইড টেবিল থেকে ফোনটা তুলে গেইমে চলে গেল। এমনভাবে সবটা অবজ্ঞা করল, যেন অমিত তার সাথে পৃথিবীর সবথেকে অপ্রয়োজনীয় কথাগুলো বলছে। এগুলো নিয়ে কথা বলা মানে সময় ব্যয় ছাড়া আর কিছুই না। অয়নকে এমন নিস্তেজ, নিরুত্তাপ দেখে মাত্রাদিক ক্ষিপ্ত হলো অমিত। সে সরোষে বলে উঠল,

‘তুই বলবি না তো? ঠিক আছে, আমিই বলব সব। আমি তো আর তোর মতো হৃদয়হীন, পাষাণ না। আমি ঠিক বলতে পারব। বসে থাক তুই, পারলে ঐ গেইমের ভেতর ঢুকে যা।’

অমিত ফোঁস ফোঁস করছে। নিশ্বাসের আওয়াজ গিয়ে ঠেকছে অয়নের কর্ণগুহরে। সে ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলল। ফোনটা রেখে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘কী চাস তুই?’

অমিতকে উত্তেজিত দেখাল। সে ভারিক্কি সুরে বলল,

‘শুধু অন্বিতা সবটা জানুক, এইটুকুই।’

‘জানার পর কী হবে? মেয়েটার বিয়ে তো যার তার সাথে না, বরং নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে হচ্ছে, অমিত। তোকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। অবুঝের মতো আবদার করলেই সব হয়না।’

অমিত এগিয়ে আসে। চোখ মুখ বিষন্ন। সে শুধায়,

‘তোর কষ্ট হয় না?’

কাষ্ঠ হাসে অয়ন। গাঢ় গলায় বলে,

‘একটুও না।’

‘বললেই হলো? আমি বুঝি সব।’

নিষ্পলক কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অয়ন অমিতকে জড়িয়ে ধরে। তার দগ্ধ মনের পীড়া যদি কেউ বোঝে, তা একমাত্র এই অমিত। নিজের রক্তের কেউ না হয়েও নির্দ্বিধায় সে তার সমস্ত কষ্ট, ক্লেশ বোঝে যায়। তার নিদারুণ ক্ষমতা। অমিত বন্ধুকে শক্ত করে চেপে ধরে। আর্তস্বরে বলে,

‘আমি জানি তোর কষ্ট হয়, বুক পুড়ে, রাতে ঘুমাতে পারিস না। কিন্তু বন্ধু হিসেবে আমি অপারগ। চোখের সামনে তোর এত কষ্ট দেখেও কিচ্ছু করতে পারছি না।’

অয়ন মৃদু হাসল। বন্ধুর পিঠে চাপড় মেরে বলল,

‘কে বলেছে পারছিস না? এই তো আমাকে বিনাস্বার্থে আশ্বাস দিচ্ছিস, ভরসা দিচ্ছিস। এটাই বা কয়জন পায়?’

অমিত তাকে ছাড়ে। অয়নের নিরেট শূন্য চোখ। অথচ অমিতের চোখ সিক্ত। তাকে দেখে হেসে ফেলে অয়ন। অমিত রেগে যায়। ক্ষেপে গিয়ে বলে,

‘হাসবি না, শা লা। তোর কষ্টে আমি কষ্ট পাচ্ছি, আর তুই হাসছিস। তুই শা লা বড়ো হারামী।’

‘যেভাবে শা লা বলছিস, আমার কোন বোনকে বিয়ে করেছিস তুই?’

অমিত সহসা হাসল। বলল,

‘করতেই পারি। তোর বোন যথেষ্ট সুন্দরী।’

অয়ন বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে ঠাস করে পিঠে চড় বসিয়ে বলে,

‘হারাম জাদা, তোর নজর আমার বোনের দিকে? একদম চোখ তুলে ফেলব কিন্তু।’

হো হো করে হাসল অয়ন। বলল,

‘আমার নজরের কথা আপাতত বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাব। একবার বলে দেখ, কিছু হউক বা হউক একবার বলে দেখ অন্তত।’

অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘বিয়ের আগে অযথা চাপ দেওয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই মেয়েটা এক হাতে সব সামলাচ্ছে।’

অমিত তার কাঁধ ঝাগিয়ে বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘কিচ্ছু হবে না। অন্তত মেয়েটা অন্যকারোর হওয়ার আগে তোর মনের কথাটা জেনে যাক। আমি বলছি তো, এতে ওর উপর কোনো চাপ পড়বে না। একবার বল, দোস্ত।’

বিছানায় গা এলিয়ে দিল অয়ন। ক্লান্ত স্বরে বলল,

‘তুই বাচ্চাদের মতো জেদ করছিস, অমিত।’

অমিত সন্তপ্ত সুরে বলল,

‘তার মানে বলবি না তুই?’

অয়ন প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,

‘না।’

অমিত উঠে দাঁড়াল অচিরাৎ। দুর্বার গতিতে ফোনটা পকেট থেকে বের করে কাকে একটা কল লাগাল যেন। অয়ন ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কাকে কল করছিস?’

অমিত তেতো স্বরে বলল,

‘তোকে বলতে হবে?’

অয়ন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল। কল হয়তো রিসিভ হয়েছে। চোখ মুখ নরম করল অমিত। বিনয়ের সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘কেমন আছেন, অন্বিতা?’

হকচকিয়ে উঠল অয়ন। এই ছেলে কী সাংঘাতিক। অন্বিতার নাম্বারে কল দিয়ে বসল। ওপাশ থেকে জবাব শোনা না গেলেও অয়নের কথার ধরণ দেখে উত্তর বুঝে নেওয়া যাচ্ছে। অয়ন বলল,

‘জি, আমিও ভালো আছি। আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?’

অয়ন সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে আছে। ছেলেটা কী করতে চাইছে ঠাহর করতে পারছে না ঠিক। ওপাশ থেকে জবাব আসার পর অমিত বলল,

‘আমার সাথে আজকে একটু দেখা করবেন, খুব জরুরি।’

অয়ন এবার আর বসে থাকতে পারল না। উঠে এসে অমিতের কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিতে চাইল। কিন্তু অমিত বাঁধা দিচ্ছে। ঐদিকে অন্বিতা কী বলেছে সেটা অয়ন জানে না। অমিতের উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত সে। কথা শেষ করে অমিত ফোন কাটল। অয়ন তার দিকে চেয়ে আছে তেজ পূর্ণ চোখে। অমিত হেসে বলে,

‘এভাবে তাকাস কেন? নজর লাগবে তো।’

অয়ন জবাব না দিয়ে বিছানায় বসল গিয়ে। রাগ হচ্ছে তার। ভীষণ রাগ। মেয়েটার বিয়ে দু’দিন বাদে। সব জেনে শুনে এই ধরনের অবান্তর কাজ করার কোনো মানেই হয় না। সে কুপিতস্বরে বলল,

‘তুই এবার সীমা লঙ্ঘন করছিস, অমিত। সব জেনে বুঝে কেন করছিস এসব?’

অমিত দায়সারা ভাবে বলল,

‘এমনই। আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই করছি। অন্বিতা রাজি, কাল বিকেলেই আমরা ওর সাথে দেখা করব।’

অয়ন ফোঁড়ন কেটে বলল,

‘আমি করব না।’

‘তুই করবি, তোর বাপও করবে। আংকেলেরও তাঁর ছেলের পছন্দ দেখা উচিত।’

অয়ন ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। আমর্ষ গলায় বলল,

‘বাপের সাথে জেদ করে ঐ বাড়ি ছেড়েছি। তুই আর ত্যাড়ামি করলে এখান থেকেও চলে যাব।’

‘চলে যা, আমার কী?’

_____________

ঘুম আসছে না মাহিরের। আর দু’টো রাত। তারপরেই তার প্রেয়সী পুরোপুরির জন্য তার হতে চলেছে। কথাটুক ভাবতেই সারা শরীরে শিহরণ জাগে। প্রেম জাগে নতুন করে। বুকের ভেতরটা ধরাস ধরাস করে। কত ঝড়, কত বিপত্তির পর অবশেষে এক হতে চলেছে তারা। আর কখনও অন্বিতাকে সে দূরে যেতে দিবে না। নিজের সবটুকু দিয়ে তাকে আগলে রাখবে আজীবন।

দরজায় ঠকঠক শব্দে পেছন ফিরে তাকায় মাহির। এই অসময়ে দরজার কাছে শশীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকায় সে। জিজ্ঞেস করে,

‘এই সময় এখানে?’

হাসল শশী। দুই হাতের দুটো কফির মগ দেখিয়ে বলল,

‘কফি বানিয়ে এনেছিলাম। ভেতরে আসি?’

অগত্যাই মাহির বলল,

‘আয়।’

কোমর দুলিয়ে মাহিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল শশী। এক হাতের কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘নাও, তোমার জন্য।’

কফির কাপ গ্রহণ করল মাহির। তাকাল বাইরের দিকে। শশী কফির কাপে চুমুক বসিয়ে মাহিরকে একবার আপাদমস্তকে দেখল। ট্রাউজার আর হালকা সবুঝ রঙের টি শার্টে অমায়িক লাগছে তাকে। তার পেশীবহুল বাহুতে নজর আটকায় শশীর। ঢোক গিলে। কী মারাত্মক পেটানো শরীর। বড্ড আফসোস হলো শশীর, অন্বিতার জন্য এই ছেলেটাকে সে পাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গেই রাগও মাথায় চড়ে বসল তার। মেজাজ আয়ত্তে রেখে মাহিরকে বলল,

‘অন্বিতাকে তুমি ক্ষমা করে দিয়েছ, তাই না?’

মাহির ভ্রু কুঁচকে তাকাল তার দিকে। বলল,

‘ক্ষমা করার মতো অন্বিতা কিছু করেনি।’

হাসল শশী। বলল,

‘তোমার মতো মানুষ আজকাল হয় না। নয়তো এত কাহিনীর পরে তো অন্বিতার মতো মেয়েকে কেউ বিয়ে করতেই রাজী হতো না। সেখানে তুমি, কত যত্নে, ভালোবেসে তাকে বিয়ে করে আনছো।

মেজাজ হারাল মাহির। দরাজ গলায় বলল,

‘কী করেছে, অন্বিতা?’

‘সেকি! ভুলে গেলে? তোমার বন্ধু রিয়ালের সাথে অপ্রীতিকর ছবিগুলো ভুলে গিয়েছ তুমি?’

মাহির দুই ঠোঁট চেপে ধরল। শশী ভাবল, পুরোনো কথা মনে পড়ায় হয়তো অন্বিতার প্রতি ক্ষোভ’টা আবার মাথায় চড়ে উঠেছে। মনে মনে খুশি হলো সে। কিন্তু অচিরাৎ তার ধারণা পাল্টাল। যখন দেখল বিকট আওয়াজে মাহিরের হাতের গ্লাসটা ভেঙে গিয়েছে। কফি সব মাহিরের হাতে মাখামাখি। মাহিরের ক্ষুরধার চাহনি দেখে ঢোক গিলে শশী। জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, মাহির?’

মাহির চোয়াল শক্ত করে। রোষানলে দগ্ধ কন্ঠে বলল,

‘কে কী করেছে তা সব আমি জানি, শশী। নিজের আত্মীয়, নিজের বন্ধু বলে ছাড় দিয়েছি, তবে ছেড়ে দিব ভাবিস না। সুযোগ পেয়ে সেই সুযোগের অপব্যবহার করিস না। তবে আমিও ভুলে যাব, তুই আমার কাজিন।’

শশী হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। মাহির জানে সব? কিন্তু কী করে?

‘যা এখান থেকে।’

মাহিরের ঠান্ডা গলার ধমকে খানিকটা কাঁপল শশী। ফের কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই মাহির বলল,

‘আর একটা কথা, অন্বিতাকে অপমান করে কথা বলার আগে দু’বার ভেবে বলবি। কারণ, পরের বার আমি ক্ষুণাক্ষরেও কাউকে ক্ষমা করব না। বিয়েটা হয়ে গেলেই এই বাড়ি থেকে চলে যাবি। শুধুমাত্র দাদুর কথা ভেবে আমি এই কয়দিন সহ্য করে নিয়েছি। কিন্তু আমাদের বিয়ের পর তোকে এক মুহুর্তও আর সহ্য করব না। কথাটা যেন মনে থাকে।’

শশীর গা রাগে তিরতির করে কাঁপছে। এত অপমান, হজম হচ্ছে না তার। হাত পা কাঁপছে ক্রমাগত। অন্বিতাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে যেন।

সে রাগে গজগজ করে বেরিয়ে যেতেই মাহির শব্দ করে দরজাটা আটকে দিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

চলবে…..

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩২।

রেস্টুরেন্ট এর ভেতরে খুব একটা কোলাহল নেই। নার্সিংহোমের পাশেই এটা। মাহিরকে বলে জরুরি তাগিদে এই ভর দুপুরে অন্বিতা এখানে এসেছে। অমিত তাকে কেন ডেকেছে তা পুরোপুরি ধারণা করতে না পারলেও কিছুটা যেন করতে পারছে। তবে আপাতত নিজের কৌতুহল সুকৌশলে দমিয়ে রেখে অমিতের সামনে চেয়ার টেনে বসল সে। মুখে ঝুলাল মৃদু হাস্যরেখা। বলল,

‘হঠাৎ এত জরুরি তলবে ডাকলেন যে?’

অমিত সৌজন্যতার সহিত হাসল। অন্বিতার দিকে ম্যনু কার্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘খাবার অর্ডার দিন, তারপর বলছি।’

‘এই দুপুরে কফিটুকুই খেতে পারব। আর কিছু খাব না।’

ওয়েটার ডেকে দুই কাপ কফি অর্ডার দিল অমিত। ওয়েটার চলে যেতেই অন্বিতা বলল,

‘এবার বলুন।’

অমিত কথাগুলো আগে পরপর মাথায় গুছিয়ে নিল। কিছু যেন এলোমেলো না হয় সেই ব্যাপারে সচেতন রইল সে। নিজেকে যথাসম্ভব ধাতস্ত করে বলল,

‘আমি জানি না, সবটা জেনে আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। তবে আমার মনে হচ্ছে সবটা আপনাকে জানানো উচিত, তাই জানাচ্ছি।’

অন্বিতা তাকে অভয় দিয়ে বলল,

‘আপনি নিশ্চিন্তে আমায় বলতে পারেন।’

অমিত ভাবল, এত ভণিতা দেখিয়ে লাভ নেই। সত্য কথা সহজ ভাবে বলে দেওয়াটাই উত্তম। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্ব না দেখিয়ে সে আচম্বিত বলে বসল,

‘আমার বন্ধু অয়ন আপনাকে ভালোবাসে।’

কথাটা কর্ণগুহরে পৌঁছাতেই কপাল কুঁচকাল অন্বিতা। অনেক কিছু আগ থেকে ভেবে রাখলেও এমন কিছু শুনবে সেটা সে আশা করেনি। তাই যথেষ্ট চমকেছে সে। নিগূঢ় ভঙিতে চেয়ে রইল অমিতের অস্থির বদন পানে। অন্বিতার পরিশ্রান্ত চাহনি অমিতকে চিন্তায় ফেলে। কোনো প্রতিক্রিয়া কেন নেই? সে উত্তেজিত সুরে বলে,

‘আপনার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, অন্বিতা?’

এই মুহুর্তে অন্বিতা ঈষৎ হাসল। মেঘমন্দ্র গলায় বলল,

‘ভালোবাসে বন্ধু, আর সেই কথা আপনি জানাচ্ছেন? আপনার বন্ধু কি আমাকে ভয় পায়?’

এমন প্রশ্নে খানিকটা ভড়কে যায় অমিত। মাথা চুলকে বলে,

‘না, ঠিক তা না। আসলে আপনার পরশু বিয়ে বলে ও আপনাকে কিছু জানাতে চায়ছে না। কিন্তু, ওর কষ্ট দেখে আমি আর থাকতে না পেরে আপনাকে জানিয়েছি।’

তন্মধ্যে ওয়েটার এসে কফি রেখে গেল। কফির কাপ হাতে নিয়ে সোজা হয়ে বসল অন্বিতা। চরম আগ্রহ দেখিয়ে বলল,

‘আচ্ছা, বুঝলাম। এখন তাহলে আমি কী করতে পারি?’

অমিত মূঢ় হয়ে রইল। কী করতে হবে সেটা সেও অবগত নয়। বন্ধুর কষ্টে তার বুকও পুড়ছে। তাই বলে এখন মেয়েটাকে নিশ্চয়ই নিজের বিয়ে ভাঙার কথা বলতে পারে না। অমিতকে নির্বাক দেখে কফির কাপে চুমুক বসায় অন্বিতা। রাশভারী স্বরে বলে,

‘ই-ফোর ফ্ল্যাটে আপনারাই থাকেন, তাই না? প্রতিদিন বারান্দায় যে গান গাইত, সে আপনার বন্ধু অয়ন; ঠিক বলছি না আমি?’

অমিত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। কথার খেই হারায় সে। কী জবাব দিবে ভেবে পায় না। মুচকি হাসল অন্বিতা। বলল,

‘আর লুকিয়ে কী হবে? সব জানি আমি।’

অমিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকাল। গুমোট স্বরে বলল,

‘জি, যা জানেন সবটাই সত্যি।’

অন্বিতা হাসল। তার ধারণা সত্য হওয়ায় ভীষণ খুশি হয়েছে সে। জিজ্ঞেস করল,

‘আপনার বন্ধু কোথায়? তিনি আসেননি?’

‘না। অনেক জোর করেও আনতে পারিনি।’

‘পরশু আমার বাসায় অবশ্যই আনবেন। উনাকে বলবেন, উনার গান ছাড়া আমার বিয়ে সম্পূর্ন হবে না।’

অমিত হতাশ সুরে বলল,

‘তারমানে আপনি বিয়ে করবেন?’

‘আপনি কী চান, আমি বিয়ে না করি?’

উত্তর দিতে পারল না অমিত। সে এমনটাও চায় না। আবার বন্ধু কষ্ট পাক সেটাও চায় না। অমিতকে ভাবুক দেখে অন্বিতা জিজ্ঞেস করল,

‘আপনার বন্ধু আমাকে কতদিন চেনে?’

‘এই ফ্ল্যাটে উঠার পর থেকে। এই ধরুন, দুই বছরের মতো।’

‘উনার রুমে আমার ছবি আছে, তাই না?’

হকচকিয়ে উঠে অমিত জিজ্ঞেস করে,

‘কী করে জানলেন?’

‘এমনিতে সবসময় আপনাদের বারান্দার দরজা বন্ধ থাকলেও সেদিন খোলা দেখেছিলাম। কিছু ছবি ঝুলে থাকতে দেখেছি। দূর থেকে একবার দেখে মনে হয়েছিল আমার’ই ছবি। পরে মনে হলো, আমার ছবি ঐ রুমে যাবে কী করে। তবে আজ আপনার কথা শুনে নিশ্চিত হলাম, ঐগুলো আমার ছবিই ছিল। তবে, এটা কিন্তু আপনার বন্ধু একদম ঠিক করেননি। লুকিয়ে আমার ছবি তুলে সেগুলো আবার নিজের রুমে ঝুলিয়ে রেখেছেন, ভীষণ খারাপ।’

অমিতের চোখে মুখে আঁধার নামল। বিষন্ন সুরে বলল,

‘আপনাকে ভীষণ পছন্দ করে তো, তাই আপনার ছবি নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। কিছু মনে করবেন না।’

‘ঠিক আছে, মনে করব না। আমার বিয়েতে উপহারস্বরূপ ঐগুলো আমাকে দিয়ে দিতে বলবেন।’

‘আচ্ছা, বলব।’

অন্বিতা তার হাতঘড়ির দিকে একবার চেয়ে বলল,

‘আর কিছু বলবেন, নয়তো আমাকে এবার উঠতে হবে।’

অমিত আইঢাই করছে। বন্ধুর জন্য অন্বিতাকে বোঝানোর সাধ্য তার নেই। সে জানে, মাহির আর অন্বিতা দুজন দুজনকে ভালোবেসেই বিয়েটা করছে। সেখানে এমন এক অমোঘ সত্যি জানিয়েও লাভের লাভ কিছু হবে না। সে ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে বলল,

‘না, যান আপনি।’

অন্বিতা উঠে দাঁড়াল। চলে আসার জন্য পা বাড়াতে নিয়েও কী ভেবে আবার থামল যেন। অমিতের দিকে চেয়ে বলল,

‘আপনার বন্ধুকে বলবেন, পরের বার কাউকে ভালোবাসলে যেন নিজে গিয়ে সেই কথাটা তাকে জানায়। অন্যকে দিয়ে বলালে সেই ভাষার কোনো প্রাণ থাকে না।’

এই বলে চলে আসে সে। অমিত ঠায় বসে রইল। রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ পেল চোখ জুড়ে। বিরক্ত বোধ করল ভীষণ। অয়নকে কল করে বলল,

‘শালা, তোর কপালটাই খারাপ।’

_______________

মাহিরের কেবিনে প্রবেশ করে অন্বিতা জিজ্ঞেস করল,

‘স্যার, ডাকছিলেন?’

মাহির স্মিত হেসে তার দিকে চাইল। বলল,

‘হ্যাঁ, তোমার একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। আন্টিকে নিয়ে আজকে বিকেলে বের হয়ে যা যা কেনাকাটার সব সেরে ফেলো। আমার পক্ষের তো আর কেউ নেই এসব করার, তাই তোমাকেই কষ্ট করতে হবে।’

অন্বিতা খানিকটা বিস্মিত হলো। মাহিরের ফুপি আছেন, চাইলেই তিনি সবটা সুন্দর মতো গুছিয়ে করতে পারেন। কিন্তু তাঁর যে এসবে আগ্রহ নেই, সেটা অন্বিতা জানে। মাহিরের একার পক্ষেও এত চাপ নেওয়া সম্ভব না। তাই মাথা হেলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা, সব করব আমি। আপনি কিছু কিনবেন না?’

‘কেন কিনব না? মেয়েরা যেমন একবার’ই কনে সাজে তেমনি তো ছেলেরাও একবার’ই বর সাজে, তাই না?’

পরক্ষণেই মাহির আবার ভ্রু নাচিয়ে বলে,

‘অবশ্য তুমি চাইলে আরো তিনবার সাজতে পারি।’

অন্বিতা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে,

‘একবার সাজার ফল ভোগ করলে তিন বার সাজার ভূত এমনিতেই মাথা থেকে নেমে যাবে।’

সন্দিহান সুরে মাহির বলল,

‘ভয় দেখাচ্ছো নাকি?’

অন্বিতা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

‘না, কেবল সাবধান করছি।’

মাহির হাত নাড়িয়ে বলল,

‘তোমার ঐসব হুমকিতে মাহির আশহাব ভয় পায়না। এখন বাসায় যাও। কেনাকাটা করে, বিয়ে সেরে বরকে সময় দাও। নার্সিংহোমের আশেপাশে আর এক সপ্তাহও ঘেঁষবে না।’

অন্বিতা হাসল। বলল,

‘আপনি যা বলবেন স্যার, তাই হবে।’

এই বলে হেসে চলে যায় সে।

_______________

শুক্রবারের তৃতীয় প্রহরে অন্বিতার বাড়িতে বরপক্ষ এসে হাজির হয়। আভা ছুটে এসে অন্বিতার কাছে বলল,

‘দোস্ত, ভাইয়ারা এসে পড়েছেন।’

ব্রীড়ায় আরক্ত হলো অন্বিতার কপোলযুগল। বুকের ধুকধুকানি বাড়ল অচিরাৎ। লজ্জায় রাঙা বউ, লজ্জায় আরো কুন্ঠিত হলো। আভা তার ধুতনি নাড়িয়ে বলল,

‘ইশ, কী লজ্জা।’

উত্তর দিতে পারল না অন্বিতা। মুচকি হাসল খানিক। আভা তাঁড়া দেখিয়ে বলল,

‘যাই, গেইট ধরে আসি।’

এই বলে বসার ঘরের দিকে ছুটে গেল সে। অন্বিতার বাড়িতে মেহমান তেমন কেউ নেই। মা আছেন, আছেন তার একমাত্র খালামনি। আর আছে আভা। মাহিরের পক্ষে থেকেও আহামরি কাউকে আসতে দেখা গেল না। রিসেপশন করবে বলে বিয়েতে আর এত ঝামেলা করল না মাহির। দাদু, ফুপি, আর তার এক মামাকে নিয়ে এল সাথে। আর হাসপাতাল থেকে এল কেবল তার সহকারী তাইভিদ।

চলবে….