#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৭।
মাহিরের রুমে এসে চমকাল অন্বিতা। বাড়িটাতে বিয়ে বাড়ির আমেজ না থাকলেও এই ঘর জুড়ে বাসর ঘরের আমেজ পরিপূর্ণ। অতিশয় সুন্দর ভাবে সাজানো চারদিক। বিছানার উপর ফুলের সমারোহ। বাতাবরনে গোলাপের তীক্ষ্ণ ঘ্রাণ। অন্বিতার বক্ষস্থলের কম্পন তরান্বিত হলো। ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল সে। মাহির অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘তোমার ব্যাগটা ওখানে রাখা। ব্যাগ থেকে কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।’
অন্বিতা মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাগ খুলতে গেল। মাহির বিছানায় বসল গিয়ে। আশপাশটা ভালোভাবে পরখ করতে করতে বলল,
‘বাড়িতে কেউ ছিল না বলে ইভেন্টের লোকেরা নিজের মর্জি মতোই সাজিয়েছে।’
অন্বিতা একটা সুতি শাড়ি বের করে উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘বেশ ভালো সাজিয়েছে।’
মাহির খুশি হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘পছন্দ হয়েছে তোমার?’
অন্বিতা স্মিত হেসে বলল,
‘হ্যাঁ।’
এরপর ফ্রেশ হতে গেল সে। মাহির প্রসন্ন চিত্তে বসা। ফুলের ঘ্রাণ বক্ষস্থলের আন্দোলন বাড়াচ্ছে তার। অন্বিতাকে সে সত্যিই পেয়ে গিয়েছে, তার ভালোবাসা সফল, ভাবতেই নতুন উন্মাদনায় মন মত্ত হচ্ছে যেন।
________
‘এসব কী বলছিস? এতকিছুর পরেও মাহির হাসি মুখে মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে এল?’
শশী বিছানায় শুয়ে মাথার নিচে হাত ভাঁজ করে বলল,
‘সাধে কি আর বলি ঐ মেয়ে তোমার ভাতিজাকে জাদু করেছে। প্রমাণ পেয়েছ তো এবার?’
‘তা তুই ছিলি কী করতে? কিছু বলতে পারলি না।’
চট করে উঠে বসল শশী। কুপিত সুরে বলল,
‘এতগুলো মানুষের সামনে আমার অপমানিত হওয়ার কোনো শখ ছিল না।’
তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন জিনিয়া বেগম। মনের ভেতরটা রাগে, ক্ষোভে নিশপিশ করছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গিয়ে ঐ মেয়েটাকে ঘর থেকে বের করে দিতে। শশী সন্দিগ্ধ সুরে বলল,
‘তোমার কী মনে হয়, মা? ঐ ছেলের সাথে কি অন্বিতার সম্পর্ক থাকতে পারে?’
‘আলবাত পারে, নয়তো বিয়ের দিন কোন মেয়ে অন্য ছেলেকে এভাবে ডেকে নিয়ে কথা বলে?’
শশী ঠোঁট কামড়ে একটুক্ষণ ভেবে বলল,
‘এবার কী করবে?’
জিনিয়া বেগম চোখ বুজে কী যেন ভাবলেন। চোখ খুলে বললেন,
‘চল, তোর নানাভাইয়ের রুমে যাই।’
_____________
ওয়াশরুমে শাড়ি পরার মতো কঠিন কাজ দ্বিতীয় আর কিছু নেই বোধ হয়। হাঁপিয়ে উঠেছে অন্বিতা। কোনোভাবেই শাড়িটাকে আয়ত্তে নিতে পারছে না। এদিকে টান দিলে ঐদিক মেঝেতে পড়ে, ঐদিকে টান দিলে এদিক। ভেজা মেঝেতে পড়ে শাড়িও ভিজে যাচ্ছে তাই। সে উপায়ান্তর না পেয়ে দরজা মেলে একবার উঁকি দিল বাইরে। দেখল মাহির নেই। ভালোভাবে পরখ করে নিল- না নেই। কোনোরকমে শাড়িটা শরীরে জড়িয়ে বেরিয়ে এল সে। তারপর প্রথমেই গিয়ে মাহিরের রুমের দরজাটা আটকে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়াল অতঃপর। ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে শাড়িটা ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। আয়নার তার অর্ধন গ্ন প্রতিবিম্ব। শাড়ি পরায় ব্যস্ত সে। বারান্দা থেকে বের হওয়ার অভিমুখে এমন দৃশ্যে থতমত খায় মাহির। চট করে পেছন ফিরে যায়। বুকের বা পাশে হাত রেখে জোরে নিশ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই আবার ভাবে, সে এত ঘাবড়ে গেল কেন? অন্বিতা এখন তার বউ, তাকে এখন সে যেকোনো অবস্থাতেই দেখতে পারে। এই ভেবে আবার ঘুরে দাঁড়ায় মাহির। অন্বিতা তখন শাড়ির কুঁচি তুলছে। মাড় ভাঙা নয় বিধায় সুতি শাড়িতে কুঁচি উঠছে না ঠিকঠাক। তার কুঁচকানো ভ্রু, বিরক্ত মুখ দেখে মাহির হাসল। এগিয়ে এসে ঠিক দাঁড়াল অন্বিতার সম্মুখে। আচম্বিত কারোর আগমনে ধরফরিয়ে উঠে অন্বিতা। মাহিরকে দেখে লজ্জায়, আতঙ্কে মুখ লাল হয়ে যায়। শাড়িটা কোনোরকমে শরীরে পেঁচিয়ে অপ্রস্তুত সুরে বলে,
‘তুমি রুমে ছিলে? আমি দেখিনি কেন?’
মাহির মৃদূ হাসল অন্বিতার আরক্তিম মুখশ্রী দেখে। বলল,
‘বারান্দায় ছিলাম।’
অন্বিতা ইতস্তত সুরে বলল,
‘ওয়াশরুমে শাড়ি ভিজে যাচ্ছিল বলে রুমে এসেছি। ভেবেছিলাম তুমি নেই।’
‘কেন, আমি থাকলে অসুবিধা কীসের?’
ভ্রু নাচিয়ে শুধাল মাহির। কন্ঠে স্পষ্ট দুষ্টুমি। অন্বিতা বলল,
‘অবশ্যই অসুবিধা আছে। তুমি রুম থেকে বের হও।’
‘আমার রুম, আমি থাকব না যাব সেটা আমার ইচ্ছে। আমি অবশ্যই তোমার কথা শুনব না।’
অন্বিতা কপাল কুঁচকে তাকাল। মাহিরের চোখ মুখের চঞ্চলতা দেখে আবার দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল সে। মাহির এগিয়ে এসে হাঁটু ভাঁজ করে বসল। শাড়ির কুঁচিতে হাত রেখে বলল,
‘আমি সাহায্য করছি।’
অন্বিতা বাধা দিল না। মাহির সযত্নে একটি একটি করে কুঁচি ধরে ঠিক করে দিল। সবগুলো কুঁচি একসাথে ধরে পেটের কাছে হাত নিতেই নড়ে উঠে অন্বিতা। মাহিরের হাত থেকে কুঁচিগুলো নিয়ে বলে,
‘আমি গুঁজে নিচ্ছি।’
মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল মাহির। অন্বিতা কুঁচি গুঁজে নিয়ে আঁচল টেনে ঠিক করল। মাহির ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে একটা পিন নিয়ে পেছনে গিয়ে দাঁড়াল তার। ব্লাউজের সাথে আঁচলটা ভালোভাবে পিন দিয়ে এঁটে দিল। অন্বিতার মুখের রং এখনও স্বাভাবিক হয়নি। আয়না দিয়ে তা দেখে মাহিরের চিত্তচঞ্চল হলো। গ্রীবাদেশের চুল হটিয়ে তাতে গাঢ় চুম্বন এঁকে সরে দাঁড়াল সে। শিরশিরিয়ে উঠল অন্বিতার পুরো শরীর। লজ্জায় আর তাকাতে পারছে না। মাহির এসে বলল,
‘ভূমিকাতেই এত লজ্জা পেলে সমাপ্তিতে গিয়ে তো তোমাকে আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না।’
অন্বিতা নির্বাক, নিরুত্তাপ। মাহির নিজ থেকেই বলল,
‘বাকি লজ্জাটুকু রাতের জন্য রেখে এবার নিচে চলো। দাদু তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলেন, তাঁর সাথে আমাদের আজ বসতে হবে।’
এতক্ষণে মৃদু আওয়াজে জবাব দিল অন্বিতা। বলল,
‘তুমি যাও, আমি আসছি।’
আলতো হেসে মাহির বেরিয়ে এল সেখান থেকে। সে বেরিয়ে যেতেই হাফ ছাড়ল অন্বিতা। এতক্ষণ দম যেন ধরে রেখেছিল সে। আয়নায় দেখল নিজেকে। গালগুলো দেখে বিরক্ত হয়ে দুই হাত ঘঁষে বলল,
‘আশ্চর্য! এত লাল হওয়ার কী আছে?’
তারপর হালকা পাতলা গয়না পরে নিল সে। মাথায় টানল বড়ো করে ঘোমটা।
মাহিরের মামা খেয়ে দেয়ে আরো আগেই বেরিয়ে গেছেন। এখন ডাইনিং-এ বসেছেন দাদু, জিনিয়া বেগম, শশী, মাহির আর অন্বিতা। বাড়ির কাজের লোকেরা তাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছে। নতুন বউ বিধায় অন্বিতা খাওয়া চলছে না ঠিক মতো। শশী মা’কে কী যেন ইশারা করল। জিনিয়া বেগম চোখের পাতা ঝাপটে আশ্বস্ত করলেন তাকে। এরপর তাঁর বাবার দিকে চেয়ে বললেন,
‘বাবা, তুমি কি কিছু বলবে না?’
মাহির অন্বিতা দুজনেই তাঁর দিকে তাকায়। মাহির মুখের খাবারটা গিলে জিজ্ঞেস করল,
‘কী ব্যাপারে, ফুপি?’
জিনিয়া বেগম কপাল কুঁচকে মাহিরের দিকে চাইলেন। ক্ষুব্ধ সুরে বললেন,
‘তোমার বউয়ের ব্যাপারে।’
এই পর্যায়ে হাত থেমে যায় অন্বিতার। সে ভ্রু কুঁচকে জিনিয়া বেগমের দিকে তাকায়। মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘আমি কী করেছি, ফুপি?’
আগুনে ঘি ঢালার ন্যায় চেতে উঠলেন জিনিয়া বেগম। রোষপূর্ণ স্বরে বললেন,
‘কী করোনি তুমি, সেটা বলো। সদ্য বিয়ে করা বরকে পাশে রেখে বাইরের ছেলের সাথে আলাদা কথা বলতে যেয়ে আবার জিজ্ঞেস করো, কী করেছ?’
অন্বিতার চৌকস চাহনি তখন শশীর উপর বর্তাল। এই মেয়েটা এত কুৎসিত মনের কেন কে জানে। ঠিক মা’কে এসে উল্টা পাল্টা লাগিয়ে দিয়েছে।চোয়াল দৃঢ় করল মাহির। রাশভারী স্বরে বলল,
‘অন্বিতা আমাকে বলেই তার সাথে কথা বলেছে। যেখানে আমার বউকে নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই, সেখানে তোমাদেরও কোনো সমস্যা হবে না, আশা করছি।’
জিনিয়া বেগম তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
‘তোমার কেমন করে আপত্তি থাকবে, মেয়েটা তোমাকে অন্ধ করে ফেলেছে কি-না। এখন তো তার সাত খুনও মাফ।’
‘সেই সাত খুন সাত অপরাধীকে করলে আমি সেটা অবশ্যই মাফ করব। এই ব্যাপারে নিশ্চিন্তে থাকো।’
শশী মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলল,
‘কাকে কীসব বলছো, মা? অন্বিতা তো মাহিরকে বশ করে ফেলেছে, এখন দুনিয়ার সবাই একদিকে আর তার বউ একদিকে।’
মাহির হাসল। বলল,
‘ঠিক বলেছিস। যা বলেছিস শুধু সেইটুকু মনে রাখবি, তাহলেই হবে। আর একটা কথা, অন্বিতাকে ভাবি বলে সম্বোধন করবি। নাম ধরে ডাকবি না।’
অপমানে মুখ থমথমে হলো শশীর। দাঁত দাঁত চেপে চেয়ে রইল সে। জিনিয়া বেগম ক্ষিপ্ত সুরে বাবাকে বললেন,
‘বাবা, তুমি কি কিছুই বলবে না? তোমার নাতি আমার মেয়েটাকে কীভাবে অপমান করছে দেখতে পাচ্ছো না তুমি?’
দাদুর খাওয়া শেষ। তিনি পাশ থেকে তোয়ালেটা তুলে মুখ হাত মুছলেন। তারপর তীক্ষ্ণ চাহনিতে একবার দেখলেন সবাইকে। অতঃপর প্ররিশ্রান্ত বদনে বললেন,
‘ওরা দুজন এখন স্বামী স্ত্রী। ওদের মধ্যকার ব্যাপার ওরা বুঝে নিবে, সেটা নিয়ে তোমরা এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন?’
দাদুর পাল্টা প্রশ্ন পেয়ে অন্বিতা প্রসন্ন হাসল। এতক্ষণের সব রাগ, দুঃখ ফিঁকে হয়ে পড়ল মাহিরের জবাবে আর দাদুর সমর্থনে। জিনিয়া বেগম আর শশী ক্ষুব্ধ হয়ে বসে রইলেন। এতক্ষণ ধরে লোকটার কান ভেঙে কোনো লাভ’ই হলো না। শশী ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলে গেল সেখান থেকে। দাদুও লাঠি ভর করে উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। মাহির ফুপির দিকে চাইল। বলল,
‘ফুপি, নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে অযথা লাগবে না। আমার স্ত্রীর সম্মানে আঘাত করলে আমি কিন্তু ভুলে যাব তুমি আমার বাবার বোন।’
চলবে…..
#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৮।
মসীবর্ণ অম্বর। সুধাংশু অনস্তিত্ব ছায়ালোকে কিরণ ছড়াচ্ছে মিটিমিটি তারকা। বাতাবরণের হালচাল স্বাভাবিক। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের বেখাপ্পা আর্তনাদ। সোডিয়ামের ঔজ্জ্বল্যে পিচ ঢালা রাস্তাটা চকচক করছে। অন্বিতার পাশে এসে দাঁড়ায় মাহির। অন্বিতা নিরুদ্বেগ। মাহির তাকে এক পলক দেখে নিয়ে জানতে চাইল,
‘মন খারাপ?’
অন্বিতা মাথা নাড়িয়ে “না” বলল। মাহির শুধাল ফের,
‘ফুপি আর শশীর কথায় কষ্ট পেয়েছ?’
অন্বিতা চাইল। মাহিরের চোখে চোখ পড়তেই নির্মল হাসল সে। বলল,
‘না। তোমার আর দাদুর উত্তরে আমি আশ্বস্ত হয়েছি।’
মাহির অন্বিতার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরাল। দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় ভরে বলল,
‘ভরসা রেখো। আমি তোমার বিশ্বাস ভাঙব না।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ, সত্যি।’
অন্বিতা প্রসন্ন হাসল। ঠোঁট উপচে পড়ল অনুপম হাসি।
‘রুমে চলো।’
মাথা হেলিয়ে মাহিরের পেছন পেছন পা বাড়াল অন্বিতা। বিছানায় বসল গিয়ে। মাহির তার ঠিক সম্মুখে বসল। অন্বিতা আলতো হেসে বিছানার দিকে চেয়ে বলল,
‘বিছানাটা ঝেড়ে দিব?’
মাহির চাইল বিছানার দিকে। ফুলের পাপড়িতে ভরে আছে তা। বলল,
‘একটু পর।’
এইটুকু বলে সে অন্বিতার মুখটা নিজের হাতের আঁজলায় নিয়ে মেঘমন্দ্র স্বরে বলল,
‘আমায় একটা ওয়াদা করবে, অন্বি।’
মাহিরের পিঙ্গলবর্ণ চোখে চেয়ে যেন অন্বিতা খেই হারাচ্ছে। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে তার। গলায় কাঁপুনি ধরেছে। তাও রয়েসয়ে বলল,
‘কী?’
‘ওয়াদা করো, আজীবন আমায় আগলে রাখবে। আমাকে কখনও ছেড়ে যাবে না। ওয়াদা করো।’
মাহিরের কন্ঠে আকুতি। মনে হচ্ছে সে যেন ভয় পাচ্ছে। কীসের ভয়? অন্বিতাকে হারিয়ে ফেলার ভয়? অন্বিতা তার ঘাড় কাত করে শান্ত স্বরে বলল,
‘আমি কি ছেড়ে যাওয়ার জন্য তোমার হাত ধরেছি? ভয় পাচ্ছো কেন?’
মাহির ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে। হাত যুগল অন্বিতার গাল থেকে সরিয়ে নিজের কোলের উপর রাখে। বিমর্ষ সুরে বলে,
‘মা বাবাকে অনেক ছোট বেলায় হারিয়েছি। তাঁদের আদর ভালোবাসা বুঝিনি আমি। দাদুর একচ্ছত্র ভালোবাসায় বেড়ে উঠা, মামা আর ফুপিও ছিলেন পাশে। তবে দাদু ব্যতিত আর কারোর ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারিনি। দাদুও ছিলেন ব্যস্ত মানুষ। গ্রামের চেয়ারম্যান। নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সেরে বাকি যেটুকু সময় পেতেন আমাকে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তাও, তাও, আমার মনে কিছু একটার শূন্যতা ছিল। কেন যেন নিজের জীবনে পুরোপুরি ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারছিলাম না। একা লাগত, মাঝে মাঝে লাগত অসহায়। পাশে থেকে ভরসা দেওয়ার মতো এক দাদু ব্যতিত আর কাউকে পাইনি কখনও। তবে দাদুর কাঁধে বিশাল দায়িত্বের বোঝা দেখে দাদুকে কখনও নিজের দুঃখ, কষ্ট, একাকীত্বের কথা বলিনি, পাছে দাদুর দুশ্চিন্তা যদি আরো বাড়ে, সেই ভয়ে। নিজের মতো থেকেছি, পড়াশোনা করেছি। দাদুর স্বপ্ন ডাক্তারীকে নিজের স্বপ্ন ভেবে পূরণ করেছি। তার মাঝে একদিন তুমি এলে। হঠাৎ তোমার আচমকা আগমনে আমার রুক্ষ হৃদয় ঝলমলিয়ে উঠল বসন্তের প্রকৃতির ন্যায়। নিদারুণ সুখ বইল চিত্ত জুড়ে। ভেবে নিলাম, এই মানুষটাকে নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিব। তবে মাঝে করে বসলাম মস্ত বড়ো এক ভুল। তারপর দুটো বছরের শ্বাসরুদ্ধকর জীবন কাটালাম। তখন বুঝলাম, এই মানুষটাকে ছাড়া আমি ঠিক কতটা অসহায়। বুঝলাম, বেঁচে থাকতে হলে তাকেই আমার লাগবে। আর আজ, এই যে এই মানুষটা একান্তই আমার, আমার স্ত্রী, আমার ভালোবাসা। আমি আমার বাকি জীবনটা তোমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই, অন্বি। আমায় তুমি ফিরিয়ে দিও না।’
কন্ঠে ব্যাকুলতা ঠাসা। চোখ মুখ তার উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। অন্বিতা হতবাক হয়ে ঢোক গিলল। মানুষটা এভাবে কেন বলছে? এত আকুলতা কেন? সে আদৌ তার ভালোবাসা দিয়ে এই আকুলতা মেটাতে পারবে তো? বড্ড চিন্তায় পড়ে সে। মাহির চঞ্চল হয়ে উঠে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
‘কিছু বলছো না কেন, অন্বি?’
অন্বিতা চোখ বুজে নিজেকে ধাতস্ত করে। এই শক্ত পোক্ত কঠিন ধাচের মানুষটা ভালোবাসার এত কাঙাল সেটা তার ভাবনায় ছিল না। আজ যেন মানুষটাকে নতুন করে চিনেছে। তার পূর্ণমেদুর চাহনি। মাহিরকে আশ্বস্ত করে বলল,
‘শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি তোমাকেই ভালোবাসব, মাহির। বিশ্বাস রাখো, তোমার স্ত্রী তার ভালোবাসায় কখনও অভিযোগ তুলতে দিবে না।’
মাহিরের ঠোঁট কোণে কিঞ্চিৎ হাসি। অন্বিতাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিল। অন্বিতা টের পেল, মাহিরের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক। সে সেখানে হাত রেখে বলল,
‘এ কী ডাক্তার সাহেব, আপনার হৃদপিন্ডের গতি তো স্বাভাবিক না।’
অন্বিতার মাথায় চিবুক ঠেকাল মাহির। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,
‘হৃদপিন্ডের মালিকের আলিঙ্গন পেয়ে তার এহেন অবস্থা। কী করব বলো তো?’
মাথা তুলে অন্বিতা তাকাল। রগড় সুরে বলল,
‘সাবধান করুন। না হয় অ্যাটাক ফ্যাটাক করে বসবে।’
‘সেটা তো আরো আগেই করেছে, তোমাকে বধূরূপে দেখে।’
লাজুক হেসে মাহিরের বুকে মুখ লুকাল অন্বিতা। মাহির ফিসফিসিয়ে বলল,
‘তা কি শুধু জড়িয়ে ধরেই বসে থাকবে? আর কিছু করবে না?’
লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া সুরে অন্বিতা বলল,
‘আর কী করব?’
মাহির আগের মতোই হিসহিসিয়ে বলল,
‘পুরো বাসর বাকি আমাদের, আর তুমি করার মতো কিছুই পাচ্ছো না?’
লজ্জায় মুখের রং বদলাল অন্বিতার। মাহিরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইল। ছাড়ল না মাহির। উল্টো শাসিয়ে বলল,
‘প্রেম করা অবস্থায় একটা চুমু অবধি খেতে দাওনি বিয়ের অজুহাত দেখিয়ে। অবশেষে সেই কাঙ্খিত রাত আমি পেয়েছি। আজকে একদম মোচড়ামুচড়ি করবে না।’
মাহিরের ঠান্ডা, শীতল ধমকে অন্বিতার শরীর জমে গেল। বুকের কম্পন বেড়ে জানান দিল, সে ভয় পাচ্ছে। এই রাতের আশায় সেও ছিল। প্রেমিক হিসেবে মাহিরকে সে কখনো সীমা লঙ্ঘন করতে দেয়নি। মাহিরও কোনোদিন জোর করেনি তাকে। তার ভালোবাসায় সম্মান রেখেছে অটুট। আজ মাহিরকে ফিরিয়ে দেওয়ার অধিকার বা ইচ্ছে কোনোটাই তার নেই। যদিও জানে, সে চাইলেও এই কাঙ্খিত পুরুষের আগ্রহকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না। তাই মৌন থেকে সম্মতি’ই জানাল বোধ হয়।
মাহিরের হাতন বাঁধন আলগা হলো। অন্বিতা সোজা হয়ে বসল তখন। চোখ তুলে তাকানো দায়। মাহির এগিয়ে এসে তার ললাটে চুম্বন এঁটে দিয়ে বলল,
‘তোমাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খায় যদি একটু বেশিই উন্মাদ হয়ে উঠি, তবে ক্ষমা করে দিও।’
অন্বিতা শ্বাস আটকে বসে রইল। জবাব দিল না কোনো। মাহির তার আরক্ত গালে তার পুরু ঠোঁট বসাল। খানিকটা কেঁপে উঠল অন্বিতা। মাহির কিঞ্চিৎ হাসল তা দেখে। ক্ষীণ সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ভয় পাচ্ছো?’
অন্বিতা মাথা নাড়িয়ে “না” জানাল। মাহির জিজ্ঞেস করল,
‘তাহলে কাঁপছো কেন?’
‘শীত লাগছে।’
হেসে ফেলল মাহির। এই বিদঘুটে গরমে কারোর শীত লাগে না-কি। সে বালিশের পাশ থেকে এসির রিমোট নিয়ে এসিটা আরো কমিয়ে দেয়। বলে,
‘চিন্তা করো না, একটু পর গরম লাগবে।’
________________
এই নিস্তব্ধ, নিস্তেজ রাতে এক পুরুষ যখন নিজের প্রেয়সীতে মত্ত অন্যদিকে আরেক পুরুষ সেই প্রেয়সীর দুঃখে নিদ্রা ছিন্ন। দুই চোখের পাতা এত ভার কেন? কেন তা এক হচ্ছে না? কেন একটু ঘুমিয়ে মনকে শান্ত করতে পারছে না? পাশেই ভুসভুস শব্দ তুলে অমিত ঘুমাচ্ছে। অন্যদিন হলে অয়ন এতক্ষণে বিরক্ত হয়ে উঠলেও আজ তার মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। যেন এই শব্দ কানেই যাচ্ছে না তার। বধির সে, কান হৃদয় সবকিছুতেই যেন তালা মেরেছে। তাও যদি একটু খানি শান্তি পায়। দুই বছর যাবত যেই নারীকে নিয়ে হৃদয়ের আঙিনা সাজিয়েছে সেই নারী আজ অন্যকারোর ভালোবাসায় সুখোবতী। তাকে ভুলে রিক্ত আঙিনা নিয়ে বাকি জীবন কাটাবে কী করে? অয়ন পাশ ফিরল। কার্ণিশ বেয়ে জল পড়ল কি-না বোঝা গেল না। তার হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে আসা রুদ্ধশ্বাসে আওড়াল,
‘মৃতু মানুষকে ভোলার চেয়েও জীবিত মানুষকে ভুলে যাওয়া কঠিন।’
চলবে …..