একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-৫২

0
118

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫২।

ঘরোয়াভাবে শশী আর তাইভিদের বিয়ের আয়োজন করা হলো। বরপক্ষ হিসেবে তাইভিদের বাড়ি থেকে এল তার মা, ছোট বোন আর মামা। মানুষগুলোকে শশীর মা বেশ আপ্যায়ন করছেন।

অন্বিতা ভারী শরীর টেনে আজকাল নড়াচড়াও করতে পারছে না ঠিক মতো। জিনিয়া বেগমও তাকে কোনো কাজে হাত লাগাতে দেননা। তবে আজ জোর করেই শশীকে সাজানোর দায়িত্বটা সে নিয়েছে।

শশীর চিবুক নাড়িয়ে অন্বিতা বলল,

‘কী মিষ্টি লাগছে আপনাকে।’

শশী সলজ্জে হাসল। বলল,

‘তুমি সাজিয়েছ যে তাই।’

‘মাহিরকে বলে নার্সিংহোমে একটা কেবিন বুক করে রাখতে হবে। বেচারা তাইভিদ ভাইয়া! অল্প বয়সেই হার্ট ফেল করবেন।’

শশী বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসছে অন্বিতা। চোখ গরম করল শশী। বলল,

‘ননাস এর সাথে মজা করছো? বড্ড পাজি হয়েছ কিন্তু।’

মেয়েটা খিলখিলিয়ে হাসল। জিনিয়া বেগম এলেন তখন। বললেন,

‘তোমাদের হলো? কাজী সাহেব অপেক্ষা করছেন।’

‘জি ফুপি, শেষ। শশী আপুকে কেমন লাগছে, বলুন তো?’

মেয়েকে আপাদমস্তক দেখে নির্মল হাসলেন জিনিয়া বেগম। এগিয়ে এসে মেয়ের কপালে চুমু দিলেন। বললেন,

‘মাশাল্লাহ, ভীষণ সুন্দর লাগছে।’

চোখ ভিজে উঠল বোধ হয় উনার। চট করে আঁচলে চোখ মুছে বললেন,

‘চলো তবে, উনাদের আর অপেক্ষা করিয়ে লাভ নেই।’

শশীকে নিয়ে তার মা আর অন্বিতা বসার ঘরে এল। সেখানেই উপস্থিত সবাই। শশীকে বসানো হলো তাইভিদের পাশে। তাইভিদ ভদ্র নম্র ছেলের ন্যায় মাথা নিচু করে বসে আছে। অথচ মনের ভেতর চলছে তার তুমুল আন্দোলন। পাশেই লাল রঙে মুড়ানো বউকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে তার। কিন্তু বড়ো’রা সবাই আছে বিধায় তাকাতেও পারছে না।

অন্বিতাকে ধরে তার পাশে বসাল মাহির। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। কবুল বলার সময় আসতেই মায়ের হাতটা চেপে ধরল শশী। তার কেমন যেন বুক পুড়ছে। কিছু একটা হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। জিনিয়া বেগম আশ্বস্ত করছেন তাকে। অথচ বাঁধ ভাঙা জলে গাল ভিজছে উনারও। অন্বিতা চেয়ে রইল বিষন্ন চোখে। এই মুহুর্তটা এত যন্ত্রণাদায়ক কেন? কেন তখন মনে হয়, বুকের ভেতর ছিঁড়ে কলিজা কেউ বের করে নিচ্ছে? চোখ টলমল করে তারও। নিজের মায়ের দিকে তাকায়। দেখে, আসিয়া বেগমও ছলছল চোখে শশী আর তার মা’কে দেখছেন। তা দেখে মলিন হাসে অন্বিতা। মানুষ ভিন্ন হলেও এই সময়ের কষ্টগুলো সবার জন্যই সমান।

________________

ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসল অন্বিতা। মাত্রই শশীর বিদায়ের পাঠ চুকেছে। সারাদিন কোনো কাজ না করেও সে এখন বড্ড অবসন্ন। মনটাও ভালো নেই। শশীর জন্য খারাপ লাগছে তার। যবে থেকে সে প্রেগন্যান্ট হয়েছে, তবে থেকে মেয়েটা তার খুব যত্ন করছে। মাথায় তেল দিয়ে দেওয়া, সময়ে অসময়ে এটা ওটা রান্না করে খাওয়ানো, বাইরে গেলে পছন্দের খাবার আনা, তার মন ভালো রাখতে এমন অনেক কিছুই করেছে সে। মাহির সারাদিন থাকে নার্সিংহোমে। বাড়িতে শশীর সাথেই সে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে। কিন্তু কাল থেকে সেসব আর হবে না বলে মন খারাপ হচ্ছে বড্ড।

ফ্রেশ হয়ে এল মাহির। অন্বিতার সমীপে দাঁড়িয়ে তার বেঁধে রাখা চুল খুলতে খুলতে বলল,

‘মন খারাপ কেন?’

‘শশী আপুকে মিস করছি।’

মাহির মুচকি হাসল। অন্বিতাকে খানিকটা চটানোর জন্য বলল,

‘আমি আরো ভাবলাম তুমি খুশি হবে।’

ভ্রু কুঁচকাল অন্বিতা। মাথা উঁচিয়ে মাহিরের দিকে চেয়ে বলল,

‘কেন, খুশি হব কেন?’

অন্বিতার চুল থেকে খুলে আনা ক্লিপগুলো ড্রেসিং টেবিলে রাখতে রাখতে মাহির বলল,

‘না ভাবলাম আরকি, শশী এই বাড়ি থেকে চলে গেলে হয়তো তুমি খুশি হবে। ওকে তো তুমি একসময় সহ্য করতে পারতে না।’

মেজাজ খারাপ হলো অন্বিতার। রাগ দেখিয়ে বলল,

‘কী আশ্চর্য! তখন ভুল করছিল বলে, আপুকে আমি অপছন্দ করতাম। কিন্তু এখন তো উনি বদলে গিয়েছেন, এখন কেন অপছন্দ করব?’

মাহির ফের এল তার সামনে। ভেজা টিস্যুর বক্সটা নিয়ে তার পাশে বসল। তারপর ধীরে ধীরে তার মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘মজা করছিলাম। আমি জানি, শশীকে তুমি এখন কতটা পছন্দ করো।’

অন্বিতা নাক মুখ কুঁচকে বলল,

‘এমন মজা আর করবে না।’

‘ওকে বাবা, করব না।’

মুখের হালকা পাতলা প্রসাধনী টিস্যু দিয়ে মুছে অন্বিতার হাতে একটা জামা ধরিয়ে দিয়ে মাহির বলল,

‘যাও, এবার চেঞ্জ করে এসো।’

________________________

অম্বরে আজ রৌপ্যমন্ডিত মৃগাঙ্কের খন্ডাংশ। তার ছানাপোনা- অশ্বিনী, কৃত্তিকা, রোহিণী’রা আজ দলবল নিয়ে কোনো এক জরুরী আলোচনায় বসেছে। কাদম্বিনী তাদের সাথে খেলছে এক মজার খেলা। মাঝে মাঝেই সে তাদের লুকিয়ে ফেলছে নিজের প্রকান্ড ডানার আবরণে, আবার একটু পরেই সেই ডানা মিলিয়ে দিয়ে প্রকাশ করছে তাদের। এমন চঞ্চলতায় অম্বরতল আজ বেজায় খুশি। আর তার খুশিতে অদ্যকার বাতাবরণও ফুরফুরে বেশ।

বসে বসে হাত কঁচলাচ্ছে তাইভিদ। মাথার উপর ফ্যান থাকা স্বত্ত্বেও অযথা ঘামছে সে। তাকে আড়চোখে একবার দেখল শশী। বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকাল। হাতের টিস্যুখানা তারদিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘কপালের ঘাম মুছুন।’

সহসাই হাত বাড়িয়ে টিস্যুটা নিল সে। চেপে চেপে মুছল কপালের স্বেদজল। শশী জিজ্ঞেস করল,

‘পানি পান করবেন?’

তাইভিদ মাথা নাড়িয়ে “না” করল। পরক্ষণেই আবার কী ভেবে তাকাল শশীর দিকে। শশীর কুঁচকান কপাল দেখে জোরপূর্বক হাসল সে। ইতস্তত সুরে বলল,

‘আমি আসলে, আসলে আমার আগে অভিজ্ঞতা নেই তো, তাই একটু নার্ভাস।’

ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল শশী। রগড় সুরে বলল,

‘ঠিক বলেছেন। আমার আরো চার পাঁচটা বিয়ে হয়েছিল তো, তাই আমার খুব অভিজ্ঞতা আছে।’

শশীর কথার স্বর বুঝতে পেরে মাথা চুলকাল তাইভিদ। আমতা আমতা করে বলল,

‘তোমার জন্য একটা উপহার এনেছিলাম।’

‘যেদিন আপনার এই নার্ভাসনেস কমবে সেদিন’ই দিয়েন, কেমন!’

চট করে উঠে দাঁড়াল তাইভিদ। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘না, আমি এখনই আনছি।’

এই বলে সে আলমারি খুঁজে একটা ছোট্ট বক্স নিয়ে এল। শশীর পাশে বসল এসে। বক্সটা শশীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আমার যতটুকু সামর্থ্য ততটুকুর মধ্যে এটাই কিনতে পেরেছি।

শশী বক্সটা খুলে দেখল, এক জোড়া রুপোর নূপুর। খুশি হলো সে। মুখে ফুটল চমৎকার হাসি। তাদের মধ্যে আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের মতো লুতুপুতু প্রেম ছিল না কখনও। কখনও কাউকে ঠিকমতো “ভালোবাসি” কথাটাও বলা হয়ে উঠেনে। তবে এইটুকু বিশ্বাস ছিল, দুজন দুজনকে খুব পছন্দ করে। সেই বিশ্বাসেই আজ এই দিনটা এসেছে। সে নূপুর দুটো তুলে তাইভিদের হাতে দিয়ে বলল,

‘পরিয়ে দিন।’

চিত্ত চঞ্চল হলো তাইভিদের। তারমানে শশীর নূপুর পছন্দ হয়েছে। সে হাঁটু গেড়ে নিচে বসে শশীর পা’খানা নিচের হাঁটুর উপর রেখে নূপুর পরিয়ে দিল। শশী আপ্লুত চোখে দেখল তার পা যুগল। বড্ড সুন্দর লাগল তার। উঠে বসল তাইভিদ। শশী বলল,

‘আপনাকে দেওয়ার মতো তো আমার কাছে কিছু নেই।’

তাইভিদে হেসে বলল,

‘পুরো তুমিটাকেই যেখানে পেয়েছি, সেখানে আর কিছু’ই আমার লাগবে না।’

শশী মুচকি হেসে বলল,

‘তাও, বাসর রাত, কিছু না দিলে হয় না-কি? চোখ বন্ধ করুন তো।’

‘কেন?’

‘উপহার দিব।’

‘বেশ, বন্ধ করলাম।’

তাইভিদ চোখের পাতা নিমীলিত করল। শশীর লজ্জা লাগছে বেশ। তাও এগিয়ে গেল সে। কাছাকাছি আগাতেই টের পেল হৃদপিন্ডের বেগতিক কম্পন। ঢোক গিলল। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালাল খানিক। এর আগে যে কোনো ছেলের এতটা নিকটে যায়নি, তা না। বিদেশে তার এক বয়ফ্রেন্ড ছিল। একটু আধটু চুম্বনের স্বাক্ষী আরো আগেই হয়েছিল সে। তবে এমন অস্বস্তি আগে হয়নি।

শান্ত, শীতল, নির্ঝঞ্ঝাট চিত্ত জুড়ে তুমুল ঝড় শুরু হলো অচিরাৎ। আচমকা কেঁপে উঠল পুরো শরীর। বিদ্যুৎ এর মারাত্মক ঝটকা খেল বোধ হয়। বদন জুড়ে টের পেল অসহ্যকর উষ্ণতা।

ছিটকে দূরে সরে বসল শশী। হাপড়ের মতো উঠা নামা করছে তার বুক। অস্বস্তিতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। অন্যদিকে ঠোঁটে হাত দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে শশীকে দেখছে তাইভিদ। মারাত্মক কিছু একটা হয়ে গিয়েছে ভাবতেই তব্দা খাচ্ছে বারবার। শশী এবার ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,

‘অনেক রাত হয়েছে, শোয়া উচিত।’

এই বলে সে উঠতে নিলেই তাইভিদ তার হাত টেনে ধরে। শশী থমকে তাকায়। তাইভিদের অদ্ভুত সম্মোহনী দৃষ্টি দেখে ঘাবড়ায় সে। নিজের কৃতকার্যে এখন বড্ড আফসোস হচ্ছে তার। তাইভিদ কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,

‘এই নম্র ভদ্র মনটাকে অভদ্র করে দিলে, তার শাস্তিটুকু পাবে না বুঝি?’

শশী ঢোক গিলে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘কীসের শাস্তি? আমি কিছু করিনি।’

‘কিছু করোনি, বলছো? আমার ত্রিশ বছরের সতী সাধ্বী ঠোঁটকে তুমি এক লহমায় দূষিত করে দিয়ে বলছো, কিছুই করোনি?’

শশী হকচকায়। এই লোক কী বলছে এসব? তাইভিদ ফের বলে,

‘ভেবেছিলাম, ধীরে সুস্থে হবে সব। কিন্তু তুমি তো প্রথম রাতেই ঝড় বাঁধিয়েছ, এবার ঝড়ের তান্ডব না সামলেই শুয়ে পড়বে?’

শশীর এবার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ছেলেটাকে আলাভোলা ভেবেছিল, কিন্তু এ তো মিচকা শয়তান। নিজেকে আচ্ছা মতো গালমন্দ করল সে। তারপর তাইভিদের দিকে চেয়ে বলল,

‘আমি শুধু উপহার দিতে চেয়েছিলাম, আপনি এভাবে রিয়েক্ট করবেন জানলে কখনোই এমন কিছু করতাম না।’

শব্দ করে হাসল তাইভিদ। বলল,

‘এত চমৎকার উপহারে আমি শিহরত। আর এই শিহরণ আমার আজন্ম থাকবে।’

লজ্জায় মাথা নোয়ায় শশী। তাইভিদ উঠে যায়। ঘরের ফকফকা সাদা বাতি নিভিয়ে মৃদু সবুজ ঘুমবাতি জ্বালায়। আবছা সবুজ আলোয় উদম গায়ের তাইভিদকে আবিষ্কার করে শশীর শিড়দাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়। পায়ের তলা শিরশিরিয়ে উঠে। ছেলেটা শশীকে সময় দিতে চায় না। একটু আগেই যে কিনা নার্ভাসনেসে ঘামছিল সে আচমকা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠায় ভড়কে যায় শশী। এ যেন এক উন্মাদ পুরুষ। তার বিশাল শরীরের নিচে পিষ্ট শশীর শীর্ণ, নরম শরীর’খানা। থেকে থেকে মৃদু শ্বাস ফেলছে কেবল। তাও তাইভিদকে বাঁধা দিচ্ছে না।

চলবে……