একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব-৪৯+৫০

0
517

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৪৯+৫০
#WriterঃMousumi_Akter
রাত সাড়ে চারটা বাজে।চারদিক অন্ধকারচ্ছন্ন।মাইকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে।কিছুক্ষণ পরেই অন্ধকার কেটে চারিদিক ফর্সা হয়ে যাবে।ছোঁয়া আর আমি দু’জনে নামাজ পড়ে নিজের জিনিস গোছাতে শুরু করলাম।উনি অসুস্থ তাই ঘুমোচ্ছেন।উনাকে আর ডাকাডাকি করলাম না।ব্যাগ গোছানো শেষ হতেই উনি জেগে গেলেন।কিন্তু সমস্ত শরীর-মাথা ব্যথা হওয়ায় উনি মাথা তুলতে পারছেন না।আমার কোমরে ওড়না বাঁধা। বেশ পরিশ্রমী দেখাচ্ছে আমাকে।উনি আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে আস্তে করে ডাকলেন, ‘সারাহ!’ উনি আমাকে ডাকতেই ছোঁয়া রুম থেকে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল।
উনার ডাক শুনে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আজও এত সকালে ঘুম ভেঙে গেল আপনার?”

‘অভ্যাস যে।’

‘কী দৌড়াতে যাবেন না?’.

‘আজ পারব না বলে মজা করছ?বুঝেছি, আমি বুড়ো হয়ে গেলে তুমি এমনটিই করবে।আমাকে নিয়ে হাসি মস্করা করবে?’

‘আপনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন বুঝি?’

‘হিসাব মতো তোমার আগেই তো বুড়ো হব।তোমার থেকে বয়সে বেশ বড়ো আমি।’

‘মেয়ে মানুষ একটা বাচ্চা হওয়ার পরেই মোটা হয়ে যায়, বুড়ো হয়ে যায়।আর পুরুষ মানুষ দিন যায় আর ইয়াং হয়।আমার একটা বাচ্চা হলে দেখবেন আমি তরতর করে বুড়ি হয়ে যাচ্ছি।’

‘বাচ্চা!’

এটুকু বলেই উনি কেমন একটা দুষ্টু হাসি দিলেন।
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে উনার অনেক কিছুই ভাবা হয়ে গিয়েছে।নিজেও কেমন লজ্জা পেলাম।মাঝে মাঝে যে কী বলে ফেলি নিজেও বুঝি না!এই জন্যই বলি সারাহ কথা কম বলবি।বেশি বলতে গিয়ে বারবার ফেঁসে যাস তুই।আঙুল নাকে ঘষে বললাম,
“রাতে তো কিছু খাননি,কিছু খাবেন এখন?বানিয়ে আনি?”

‘আগে আমাকে ধরো। ধরে উঠাও।ওজু করব।’

‘নামাজ পড়তে পারবেন?’

‘চেয়ারে বসে পড়ব।’

‘আচ্ছা চলুন।’

উনি কোনোমতে আমার কাঁধে ভর দিয়ে উঠলেন।ওয়াশ রুম নিয়ে গেলাম।ওজু করে রুমে এসে চেয়ারে বসে নামাজ পড়ে নিলেন।নামাজ শেষ করে বললেন, “ওরা এসেছে?”

‘এখনও ফোন দিইনি তো।’

‘ওদের মতলব ভালো মনে হচ্ছে না।আসবে তো?’

‘না না আসবে। দাঁড়ান ফোন দিচ্ছি।’

তন্ময়কে ফোন দিয়ে বললাম, “কী রে তন্ময় ইদ মোবারক।”

তন্ময় বেশ অবাক হয়ে বলল, “আজ কী ইদ!”

‘আজ তন্ময়ের আকাশে চাঁদ দেখা গিয়েছে।তাই আজ ইদ শুধু তন্ময়ের।’

‘আচ্ছা বুঝলাম।’

‘কী বুঝলি বল?’

‘বুঝলাম সারাহ আজ চাঁদ দেখেছে তন্ময়ের আকাশে।তাই আজ ইদ।’

‘শোন তন্ময়,ফুলসজ্জা সম্পর্কে ভালো আইডিয়া আছে তোর?’

‘আইডিয়া লাগে বুঝি?’

‘আইডিয়া না থাকলে ফেঁসে যাবা আমার মতো।ফুলসজ্জা অন্য সজ্জা হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা ফুল খাট দিয়ে সাজিয়ে দিস।সেই খাটে ঘুমোব হয়ে যাবে ফুলসজ্জা।’

‘শুধু ঘুমোবি?’

‘তাহলে আর কী করতে হয়?বুঝলাম না তো।’

আমার এসব কথা শুনে রোশান স্যার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।বিড়বিড় করে বললেন, “এই কয়টা কথা বলার সুযোগ পেলে হয়। দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেলেও হুঁশ থাকে না।


আমি উনার বিড়বিড় শুনে বললাম, “কীহ ব্যাপার,আপনার মুখে বিরক্তির ছাপ কেন?আপনাকে এমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে কেন?”

‘ওরা এসছে কি না সেটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাবে তুমি।যে কাজে ফোন দিয়েছ আগে সেটা জিজ্ঞেস করো।’

উনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার কথা বলায় মনোযোগী হয়ে বললাম,
“বোঝা-বুঝি পরে হবে।আগে বল তোরা এসছিস?”

সাইড থেকে দ্বীপ জোরে বলে উঠল, “এই মৃন্ময়,তন্ময় নাকি খালি ঘুমোবে।”

‘ও ঘুমোলে ওর বউকে চুমু দিবে কিডা?’
‘দেখ সারাহও তাই বলছে।’

‘ও ঘুমোলে মনে হয় মশা চুমু দিবে ওর বউকে।’

‘ বুঝলি দ্বীপ,আমি তন্ময়ের মতো অত ভদ্র না।বাসর ঘরে ঢুকব জাস্ট দরজা লাগাতে যেটুকু দেরি। ব্যাস!’

‘ভাই আমিও।’

তন্ময় বলল,“এসছি,বাট মৃন্ময় আর দ্বীপ কী করছে দেখে যা।এরা অসভ্য কথা বলছে।’
‘আমি আসতেছি ওয়েট কর।’

আমি ফোন রেখে রাস্তায় গেলাম।রাস্তায় গিয়ে দেখি তন্ময় রাস্তার পাশে লম্বা তালগাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সকালের মৃদু বাতাসে ওর সামনের সিল্ক চুল উড়ছে।গায়ে বাদামী কালারে লং হাতা শার্ট,শার্টের হাতা গোটানো,হাতে ঘড়ি,পরনে একটা ব্লু জিন্স।তন্ময়ের পরনের সব কিছুই কম দামি।২০০ টাকার শার্ট উপরে গেলে ৪০০-৫০০ টাকার প্যান্ট পরে তন্ময়।অথচ দেখে মনে হচ্ছ কোনো রাজ্যর রাজকুমার দাঁড়িয়ে আছে;পরনে কয়েক লাখ টাকার পোশাক।তন্ময় সৃষ্টিকর্তার নিঁখুত হাতের সৃষ্টি। এত বেশি সুদর্শন পুরুষ দ্বিতীয়টা দেখা যায় না।যায় পরুক না কেন সেই পোশাক খুব মানায় ওর গায়ে। দেখে মনে হয় কোনো ব্রান্ডেড পোশাক।আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে তন্ময় বলল,

“ওদের ভেতরে যেতে বল।”

আমি দেখি দ্বীপ মৃন্ময়কে ধাক্কা দিচ্ছে বাড়িতে ঢোকার জন্য।আর মৃন্ময় দ্বীপকে ধাক্কা দিচ্ছে।ওদের ধাক্কা-ধাক্কি চলছে।মৃন্ময় বলল,
“তন্ময়,তুই আর দ্বীপ আগে যা।আমি পরে আসছি।”

দ্বীপ বলল, “কীহ?আমি!ইম্পসিবল ইয়ার।আমি রোশান সিদ্দিকীর সামনে যাব!জিন্দেগীতেও না।আমি গেলেও লাস্টে যাব।’

মৃন্ময় বলল,“আরে ভাই খে’ য়ে ফেলবে না কি?এত ইয়ে করার কী আছে?”
‘তাহলে তুই যাচ্ছিস না কেন?তুই যা তোকেও তো খে’ য়ে ফেলবে না।’

‘আমি যাব?আমি উনাকে আবাল পর্যন্ত বলেছি।বুঝতে পারছিস?ওইসব সমস্যার জন্য ডাক্তারও দেখাতে বলেছি।ক””’ পর্যন্ত পাঠিয়েছি।’

‘আর আমি?আমি কী বলেছি?তোর সাথে তো আমিও ছিলাম।কিছুতেই যাব না।তন্ময় একা যাক।’

তন্ময় বলল, “তোরা না গেলে আমিও যাচ্ছি না।”

আমি গালে হাত দিয়ে একবার তন্ময় একবার মৃন্ময় আর একবার দ্বীপের দিকে তাকাচ্ছি।ওদের অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।প্রচন্ড হাসিও পাচ্ছে।
ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “তাহলে ভাব, আমি কীভাবে এই ভয়ংকর মানুষের সাথে সংসার করছি!”

মৃন্ময় বলল, “তোর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি সারাহ।আমি এটুকু এসেছি অনেক কষ্টে।ভেতরে যাব না।”

তন্ময় বলল, “দ্বীপ ওরে ধর,বেগুন ভাজা দিতে দিতে নিয়ে যায়।”

তন্ময় আর দ্বীপ দু’জনে মৃন্ময়কে ধরল।তন্ময় দুই পা ধরল আর দ্বীপ দুই হাত ধরে দোলাচ্ছে আর বলছে বেগুন ভাজা।বলতে বলতে বাড়িতে প্রবেশ করল।ওদের ওই অবস্থা দেখে ছোঁয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুখে হাত চেপে হাসছে।সেই হাসির মাঝে তন্ময় আর ছোঁয়া দু’জনেরই চোখে চোখ পড়ে গেল।সাথে সাথে ছোঁয়া চোখ নামিয়ে নিল।রোশান স্যার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে এমন কান্ড দেখে কোনরকম ওয়াল ধরে ধরে দরজায় এসে দাঁড়ালেন।দ্বীপ আর তন্ময় উনাকে দেখেই মৃন্ময়কে ফ্লোরে ফেলে দিল।মৃন্ময় দ্রুত উঠে শার্ট টেনে ঠিক করল।প্যান্টের বেল্ট ধরে টেনে উপরে তুলল।মৃন্ময় আর দ্বীপ মাথা একদম নিচু করে দাঁড়িয়ে মিনমিন কন্ঠে ফ্লোরে চোখ রেখেই সালাম দিল।তন্ময় উনার দিকে তাকিয়েই সালাম দিল।উনি উত্তর দিয়ে মৃন্ময় আর দ্বীপের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, “কী অবস্থা তোমাদের?মাথা নিচু করে রেখেছ কেন?”

‘স স্যরি স্যার,আমরা জানতাম না।আমাদের মাফ করে দিন।’

‘কোন বিষয়ে?’

‘ইয়ে স্যার।’

‘থাক পরে শুনব।গাড়ি এসে গিয়েছে।জিনিসপত্রগুলো তুলে ফেলো।’

উনি তন্ময়ের কাঁধে হাত দিয়ে তন্ময়কে নিয়ে ফাঁকা জায়গা গিয়ে কী যেন বলছেন।নিশ্চয়ই তন্ময়কে সাহস দিচ্ছেন।ভালো পরামর্শ ছাড়া তো উনি দিবেন না।মৃন্ময় আর দ্বীপ একে একে সব গাড়িতে তুলল।
সব কিছু গাড়িতে তোলা শেষ হলেই আমরা রওনা দেব।বাবাও রেডি হয়েছেন।তবে বাবা বললেন, “আমি একটু তোমার ফুফু বাড়ি যাচ্ছি।আমার আব্বার কাছে।আব্বাকে নিয়ে কয়েকদিন পরেই ফিরব।তোমরা সাবধানে থেকো।”
উনি বাবাকে কিছু টাকা দিয়ে দিলেন।

একটা গোলাপি রং করা বাড়ির সামনে গাড়ি থামল।এটা দুই তলা নতুন বাসা।এর আগে কোনো ভাড়াটিয়া ওঠেনি।আমরাই প্রথম।আবার একে একে সব জিনিস উপরে তোলা হলো।সব জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে প্রায় একটা বেজে গেল।ছোঁয়া আর তন্ময় কেউ কারো সাথে কথা বলছে না।অথচ তারা জানে আজ তাদের বিয়ে।কেউ যে রেগে আছে তাও।লজ্জায় কথা বলছে না কেউ।রান্নার কোনো ব্যবস্থা হঠাৎ করতে পারলাম না।কারণ বাজার নেই।রান্না করতে অনেক বাজারের দরকার।শুধু মাছ তরকারী হলেই তো হয় না ঝাল,পেয়াজ,রসুন,জিরা মশলা অনেক কিছু লাগে।রোশান স্যার বাইরে থাকে খাবার এবং কাজী নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন।মৃন্ময় আর দ্বীপ খাবার আর কাজী আনতে বাইরে গেল।ছোঁয়া সকাল থেকে একটা কথাও বলেনি।কী যেন চিন্তা করেই যাচ্ছে।গুটিসুটি মেরে বসে আছে এক কোনায়।আমি ছোঁয়ার কাধে রাত রেখে বললাম, “কী হয়েছে বেবি?ইদ মোবারক।”

‘ইদ মোবারক কেন?’

‘আজ তন্ময়ের আকাশে ছোঁয়া নামক চাঁদের দেখা মিলেছে।তাই আজ তাদের ইদ।’

‘আমার খুব ভ**য় করছে সারাহ।’

‘কেন?’

‘তন্ময় কী মন থেকে বিয়ে করছে?এতসব শুনেও আমাকে বিয়ে করছে?’

‘কী অদ্ভুত! তুই তন্ময়কে চিনিস না?’

‘তাও আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।’

‘ওয়েট আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

আমি তন্ময়কে ডেকে বললাম, “ওই রুমে যা, ছোঁয়া তোর সাথে কথা বলবে।”

তন্ময় হনহন করে ছোঁয়ার রুমে প্রবেশ করল।দরজা খোলাই আছে।ছোঁয়ার চোখ পানিতে ছলছল করছে।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে।তাও কান্না আটকাতে পারল না। প্রবল বেগে কান্না ধেয়ে এলো।তন্ময়কে দেখে ছোঁয়া বলল, “আমি কিছু বলতে চাই তন্ময়।”

‘আগে চোখের পানি মুছে নে।তারপর বল।অনেক জ্বালিয়েছিস।এখন চোখের পানি দেখিয়ে আবার জ্বালাতে চাস?’

‘আই আম স্যরি তন্ময়।আমি তোকে সবটা বলতাম। ‘

‘বলতি বাট বলিসনি কিন্তু।এই অন্যায় ক্ষমা করব না।’

‘আমি বুঝতে না পেরে ছবি দিয়ে ফেলছিলাম।আর তখন ভাবতাম…..’

‘আমার ওইসব জানার কোনো আগ্রহ নেই ছোঁয়া।এই যে ওশান তোর সাথে এত কিছু করল সেটা কেন জানাস নি?’

‘বলিনি কারণ….’

‘আমি ছেড়ে যাব,ভুল বুঝব,আগের মতো ভালোবাসব না তাই,এসবই তো কারণ?’

‘তুই কি আমায় আর আগের মতো ভালোবাসতে পারবি?বিয়ের পর এসব ভেবে কষ্ট দিবি না তো?আমি জোর করব না।মনে দ্বিধা থাকলে আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস।’

বলেই ছোঁয়া জোরে কেঁদে দিল।
তন্ময় ছোঁয়ার চোখের পানি মুছে বলল, “একবার বউ হয়ে দেখ তখন বুঝবি তন্ময় ইজ দ্যা বেষ্ট হাজবেন্ড।আগের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসব।যতটা ভালবাসলে তোর কখনো জীবনে সুখ নিয়ে আফসোস হবে না।”

ছোঁয়া আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল।তন্ময় ছোঁয়ার দুই গালে হাত রেখে বলল, “ বুঝেছি,এই কান্না আমার বুকে মাথা না রাখলে যাবে না।জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এখনও কবুল বলা বাকি।আমার এই সুন্দর ভালোবাসা বিয়ের আগে জড়িয়ে ধরে নষ্ট করতে চাইছি না।সো আর কাঁদবেন না ম্যাডাম।’

‘কষ্ট পেয়েছিলি অনেক?’

‘যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম সেটার এক বিন্দু তুমি যদি পেতে তাহলে সহ্য করতে পারতে না। কিন্তু আমি পেরেছি।কারণ আমার বিশ্বাস ছিল।’

ছোঁয়া আবারও কাঁদল।তন্ময় ছোঁয়ার কানের নিচে চুল গুজে দিতে দিতে বলল, “I love you my love.”এই ঠোঁট, এই চোখ,এই মুখে কান্না বেমানান।হাসিতে সুন্দর লাগে।’ কথাটি শুনে মুহূর্তের মাঝে ছোঁয়ার চোখ-মুখ আনন্দে চকচক করে উঠল।

ওদের কথপোকথনে ভীষণ খুশি খুশি লাগছে আমার।মুচকি হাসি ঠোঁটে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম।

রুমে এসে দেখি উনি পাঞ্জাবি পরার চেষ্টা করছেন।আমাকে দেখেই থমকে গেলেন।বোধহয় হাসির কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন।উনার চোখে চোখ পড়তেই আমি হাসি চেপে উনার কাছে গিয়ে বললাম, “আমাকে ডাকলেন না কেন?”
বলেই উনাকে পাঞ্জাবি পরতে সাহায্য করলাম।উনি কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।উনাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, “তাকিয়ে আছেন কেন?”

‘দেখছি।’

‘কী?’

‘তোমাকে।’

‘আমি কি নতুন হয়েছি যে ওভাবে দেখছেন।’

‘রোজই নতুনত্ত্ব খুঁজে পাই তোমার মাঝে।’

‘সিনেমাটিক ব্যাপার স্যাপার বলছেন।’

‘তা হয়তো বলছি।একটা রিকুয়েষ্ট ছিল।’

‘কী?’

‘শাড়ি পরবে আজ, ওই ব্লু শাড়িটা?’

‘পরব।’

‘যাও পরে এসো।’

ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে নীল শাড়ি পরে বাইরে বেরিয়ে এলাম।মাথায় টাওয়াল প্যাঁচানো।আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে নিজে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।আমাকে কি শাড়িতে একটু বেশি সুন্দর লাগে?এত সুন্দর লাগছে কেন আমাকে!আয়নায় চোখ গেল খাটে বসে থাকা সুদর্শন শ্যামসুন্দর পুরুষটির দিকে।তাকে আজ ব্লু পাঞ্জাবিতে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে।এই থমথমে, একটু গম্ভীর টাইপ মানুষের গম্ভীর চাহনিতে বার বার হারিয়ে গিয়েছি আমি দূর অজানায়।যেখানে উনার প্রতি আমার ভীষণ ভালো লাগা কাজ করেছে।এই শ্যামসুন্দর পুরুষটা অন্য সব পুরুষের থেকে আলাদা।তাকালেও অন্য রকম লাগে,রেগে গেলেও অন্যরকম লাগে,কথা বলার এক্সপ্রেশনটাও অন্য রকম,ভালবাসা প্রকাশ করলেও অন্যরকম লাগে।তার এত সব অন্যরকমের ভিড়ে বার বার মন হারাচ্ছি আমি।উনি বুঝতে পারলেন আয়নায় আমি উনাকে দেখছি।উনি গলা ঝাড়া দিয়ে পরিষ্কার করে বললেন, “একটা সেফটিন নিয়ে আমার কাছে এসো তো।”

আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, “কেন?”

‘আগে এসো তো।’

একটা সেফটিন নিয়ে উনার কাছে গিয়ে উনার হাতে দিলাম।উনি সেফটিনটা নিয়ে পেটের যে সামান্য অংশটুকু উন্মুক্ত ছিল সেটুকুও সেফটিপিন লাগিয়ে ঢেকে দিলেন।সেফটিনটা লাগিয়ে বললেন,
“এইভাবে কেউ পেট-কোমর বের করে বরের সামনে ঘোরে?”

‘ঘুরলে কী হইছে?’

‘আবার আমাকে উস্কানি দিচ্ছ?’
‘কীসের উস্কানি।’

‘বুঝতে পারছ না তাই না?’

‘না তো।’
বলেই আমি মাথার টাওয়াল খুলে ভেজা চুল ঝাড়া দিলাম।সাথে সাথে চুলের বিন্দু বিন্দু পানি উনার নাকে-মুখে পড়ল।উনি মুগ্ধ হয়ে দেখছেন আমাকে।

এরই মাঝে মৃন্ময়রা চলে এলো।তন্ময়ের কেনা সেই শাড়িও নিয়ে এলো।ওরা দুজন মেস থেকে এক কালারের পাঞ্জাবী পরে এসেছে।তন্ময়ের জন্য একটা শেরোওয়ানিও কিনে নিয়ে এসেছে।সাথে খাবার এবং কাজী।
এরই মাঝে তরী,পিহু আর রোহানও হাজির হলো।এই প্রথমবার তরী এবং ছোঁয়া মুখোমুখি।তরী ছোঁয়াকে দেখেই চিনে ফেলল।ছোঁয়া তরীর দিকে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।তরী নিজে এসে বলল, “আপনি সত্যি খুব সুন্দর ছোঁয়া আপু।”

মুহূর্তেই ছোঁয়া কেমন ইমোশনাল হয়ে গেল।তরীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার সংসার ভেঙে আমি সংসার শুরু করতে যাচ্ছি।আমাকে ক্ষমা করো তরী।আমি সারাজীবন তোমার কাছে অপরাধী হয়েই থাকব।”

তরী বলল, “যা হওয়ার সেটা তো হয়েই গেছে আপু।আপনার জন্য বরং আমি বেঁচে গিয়েছি।আমাকেও ক্ষমা করে দিন।না জেনে অনেক গা*লি দিয়েছি,খারাপ ভেবেছি।নিজেকেই অপরাধী লাগছে।আগে বলুন আমায় ক্ষমা করেছেন?”

‘পা*গ*লি মেয়ে।অনেক সুখী হও জীবনে।’

‘আপনার জন্য আমি আমার নিজে হাতে বানানো হলুদের গহনা আর শাড়ি এনেছি।আপনার গালে হলুদ মাখিয়ে দুই বোনের সম্পর্ক পাকাপক্ত করতে চাই।’

আমার তো হলুদের কথা মাথায়ই ছিল না।ভাগ্যিস তরী নিয়ে এসেছে।আমি তরী আর পিহু তিনজনে মিলে ছোঁয়া আর তন্ময়কে হলুদ মাখিয়ে দিলাম।হলুদ শেষ হলে ছোঁয়াকে লাল বেনারসি পরিয়ে খুব সুন্দর ভাবে সাজালাম।তন্ময়কেও সোনালি কালারের শেরওয়ানিতে দারুণ লাগছে।আমাদের চারজনের সাক্ষীতে ওদের দুজনের বিয়ে হয়ে গেল।বিয়ে বাড়ির সব ধরণের খাবারই বাইরে থেকে এনেছে।খাওয়া আর বিয়ে শেষ হতে হতে চারটা বেজে গেল।উনি তো অসুস্থ বাইরে যেতে পারবেন না।তাই উনাকে রুমে রেখেই আমরা চলে গেলাম তন্ময়ের সেই ছোট্ট ঘরটিতে।ফুলের দোকান থেকে তাজা তাজা সব রকমের ফুল নিলাম।উনি আমাকে বলে দিয়েছেন বাসর ঘর যেন খুব সুন্দর করে সাজানো হয়।ফুল কেনা টাকাও পাঠিয়েছেন।
আমরা সকলে মিলে ওদের বাসর ঘর খুব দারুণ করে সাজালাম।

একটা জিনিস ভেবে দারুণ লাগছে আজ।ওশানের জন্য এই দুটো মেয়ের জীবনই নষ্ট হচ্ছিল।সেই দুটো মেয়ের আজ দারুণ বন্ধুত্ব।তরীর অতি আনন্দের সাথে ছোঁয়ার বাসর ঘর সাজাচ্ছে।মুখে দারুণ হাসি লেগে আছে।সেই হাসিতে মৃন্ময় মুগ্ধ হচ্ছে।বারবার তাকিয়ে দেখছে তরীকে।কী মিষ্টি লাগছে আজ তরীকে!কেউ ভেবেছিল এই মেয়েটা একদিন এত হাসবে!স্বাধীন একটা জীবন পাবে!কথায় কথায় কেউ ধমকাবে না।গা*লি খেতে হবে না।কারো অবহেলায় বাঁচতে হবে না।এই মেয়েটার হাসি একটু বেশিই সুন্দর। হাসলে দারুণ লাগে।অথচ এই মেয়েটার হাসির প্রশংসা কেউ কোনদিন করেনি।কেউ হাসাতেও চেষ্টা করেনি।তরীর সৌন্দর্য ন্যাচারাল। কোনো কৃত্তিমতার ছোঁয়া নেই।যেটুকু আছে ওইটুকু খাটি সোনা।আজ এই হাসি-খুশি মেয়েটাকে দেখেই প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।ওশানের এই কৃতকর্মের ফল কি মেয়েটাকে প্রশান্তি দিয়েছে! তরী একদিন কত অভিশাপ দিয়েছে এই ছোঁয়াকে।নিজের জীবনের সব অশান্তির মূল হিসাবে ছোঁয়াকেই দায়ী করেছে।আর আজ সেই তরী ছোঁয়ার সুখ-শান্তির জন্য প্রার্থনা করছে।আজ তরী বোঝে কেউ কারো সংসার ভাঙতে পারে না।খারাপ মানুষ নিজ থেকেই খারাপ হয়।তরীর বানানো গহনাতে ছোঁয়ার গায়ে হলুদ হবে এটাও কী কারো জানা ছিল!আমার চোখের সামনে এই সুন্দর হাসি-খুশি পূর্ণ মানুষগুলোকে দেখে দারুণ আনন্দ হচ্ছে।ইয়েস আমি পেরেছি।অনেক কিছু পেরেছি।সব প্রিয় মানুষদের হাসি ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।এই সব কিছুর জন্য একটা মানুষের সাপোর্ট পেয়েছি।সে ছাড়া হয়তো কিছুই সম্ভব হতো না।আমার শ্যামসুন্দর মানুষটি না থাকলে নিজেই তলিয়ে যেতাম কোথায় তার ঠিক নেই।এমন সাপোর্টিভ মানুষ পেয়েছি বলেই আমার পক্ষে সব সম্ভবপর হয়েছে।জীবন সত্যি সুন্দর হয় যদি এমন একজন সাপোর্টিভ মানুষ সব মেয়ের জীবনেই থাকে।তন্ময়ের মতো বলতে ইচ্ছে করছে,“ I love my handsome man. I am filled with your fullness.”

চলবে?..