#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৫৪
#WriterঃMousumi_Akter.
ঘর্ণায়মান সন্ধ্যা। চারদিকে সন্ধ্যার হলদেটে আলো। মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি সারিবদ্ধভাবে উড়ে যাচ্ছে। এমন ঢেউ খেলানো সেই সারি যেন, শিল্পির আঁকা আকাশের বুকে নিখুঁত কোনো নৈসার্গিক দৃশ্য। যা কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখা যায়। এখনি একটা ছবি তুলতে পারলে আজকের সন্ধ্যার বেষ্ট ছবি হতো এটা। রাস্তার দু’পাশে শিমুল ফুল ফুটে আছে।শিমুল ফুলের মাঝে আমি বিশেষ কিছু সৌন্দর্য খুঁজে পাই। এই কাঁটাযুক্ত বিশাল গাছের মাথায় শত শত লাল টকটকে ফুলে যখন ছেয়ে যায়, আমি মুগ্ধ হয়ে সেটা দেখি। কেউ যদি কখনো হাতে নিয়ে একটা শিমুল ফুল দেখে, নিশ্চিত সে এই ফুলের প্রেমে পড়ে যাবে। গাছের নিচ থেকে একটা ফুল তুলে হাতে নিলাম। ফুলটা কেবলই গাছ থেকে ঝরে পড়েছে। ফুলের পাঁপড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে উত্তর দিকে তাকালাম। উত্তরে হিম বাতাস ছেড়েছে।ধোঁয়া ওড়া কুয়াশা আরও বেড়ে চলেছে। প্রতিটা মানুষের মাথায় টুপি বা মাফলার প্যাঁচানো, পরনে সোয়েটার বা চাঁদর, পায়ে জুতা।এম এম কলেজের সাইড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরনো লাইব্রেরীর সামনে এসে দাঁড়ালাম। লাইব্রেরীর পাশেই বেশ বড়ো একটা ফুচকা আর চটপটির দোকান।দোকানদার আমাকে আগে থেকেই চেনে। আমাকে দেখেই বলল, ‘আপা আজ এ সময়ে এখানে?আপনার দলবল কই?’
আমি স্বভাবসুলভ হেসে বললাম, ‘এদিকেই বাসা নিয়েছি। একটু ঘুরতে এসেছিলাম।’
‘চটপটি দেব?’
‘নাহ,আজ খেতে ইচ্ছা করছে না।’
‘মন খারাপ আপা?’
‘নাহ!এমনিই। পরে এসে খেয়ে যাব।’
এরই মাঝে একটা রিকশা আমার সামনে থেকে অতিক্রম করে বলল,
‘দড়াটানা যাবেন?’
‘জি যাব।’
রিকশায় উঠে বেশ মন খারাপ লাগছে। সেই দুপুর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। একটা বার আমাকে ফোন করল না। মানুষ কী এত বিজি থাকে যে এক মিনিট ফোনও দিতে পারে না! ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘শুধুই তার দোষ? তুমি কেন তাকে ফোন দাওনি? সে পুরুষ মানুষ অনেক ঝামেলায় থাকে। তুমিও তো ফোন দিতে পারো।’
আমি কেন ফোন দিব? সে যদি আমাকে ভালোবাসে নিশ্চয়ই সে আমাকে ফোন দিবে। সে না দিলে আমিও দিব না। নিজেই নিজের সাথে যুদ্ধ করছি। এরই মাঝে ফোনে মেসেজের রিংটোন বেজে উঠল। এই যে সব মান-অভিমান এক মুহূর্তের মাঝে উধাও হয়ে গেল। ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে শ্যামসুন্দর পুরুষ নামটা। মেসেজটা ওপেন করেই দেখি লেখা আছে,
‘নিশ্চুই রেগে আছো? স্যরি! কান ধরেছি দ্যাখো। আই রিয়েলি মিসড ইউ। ফোন সার্ভিসিং-এ ছিল, তাই ফোন দিতে পারিনি।’
কী ছিল এই একটা মেসেজে! একটা মেসেজ পেয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল।এই যে মনে মনে তার বিরুদ্ধে শত শত অভিমান সব উড়ে গেল হাওয়ায়। রিকশায় আসতে আসতে দেখি রাস্তার পাশে হালকা গোল্ডেন কালার মতো সুন্দর একটা জ্যাকেট ঝোলানো। জ্যাকেটটা দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেল। সাথে সাথে পার্স খুললাম। পার্স-এ ৫০০০ টাকা আছে। সেদিন আম্মু পাঠিয়েছে জামাইকে শীতের কাপড় কিনে দেওয়ার জন্য। কিন্তু উনি খুব রা’গ করেছেন। বরং আব্বু-আম্মুর জন্য শীতের কাপড় কিনে আমাকে পাঠিয়ে বলেছিলেন আব্বু-আম্মুকে টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে আসবে কিন্তু। আমি গিয়েছিলাম; তবে আব্বু বা বাবা কেউই ফেরত নেয়নি। বলেছে আমি যেন তাকে না জানিয়ে কিনে দিই। রিক্সা থেকে নেমে দোকানে ঢুকে জ্যাকেটের দাম জিজ্ঞেস করতেই কর্মচারী বলল, ‘আপা সাড়ে সাত হাজার দাম।’
চোখ কপালে তুলে তাদের দিকে তাকালাম।তাদের বলা দামটা যে আমার পছন্দ হয়নি সেটা আমার মুখ দেখেই বুঝে গেলেন।অমায়িক হেসে বললেন, ‘আপা নেন, কম রাখা যাবে।’
খুব কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত কম নিবেন?’
‘নেন, ১০০ টাকা কম রাখা যাবে।’
আমি আবারও কথা না বলে চোখ কপালে তুলেই তাকালাম। যা মনে আসছে তা মুখে প্রকাশ করতে না পেরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকালাম। তারা আবারও অমায়িক হেসে বলল, ‘আপা ৫০০ কম রাখব। এই মিন্টু, জ্যাকেটটা এই আপাকে প্যাকেট করে দে তো।’
চোখ-মুখে বিরক্তি ভাব এনে বললাম, ‘৫০০ তে দিবেন ভাই?’
সাড়ে সাত হাজার টাকার পোশাকের দাম ৫০০টাকা শুনে বোধহয় দোকানের মালিকসহ সকলের চোখ কপালে। মনে হলো কোনো জোকস শুনেছে। এই টাইপ একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আপা কিনতে আইছেন না ইয়ার্কি করতে আইছেন?’
‘কী মনে হয়?’
‘তাই বলে ৫০০ টাকা দাম বলবেন?’
‘তাহলে কত বলব? গোল্ড মিক্সিড করা পোশাক না কি এটা?এতো কোনো ব্রান্ডও নয়। ইয়ার্কি কি আপনারা পাইছেন? এত দাম বলেন যে মানুষ কনফিউজড হয়ে যায় কত দাম বলা উচিত।’
‘কী করব! দাম যদি সঠিকটাও চাই তাও মানুষ দামাদামি করে।’
‘কারণ, মানুষ জানে আপনারা ১ টাকার জিনিস ১০ টাকা দাম চান। এখন বলেন কত হলে দিবেন।’
‘৩০০০, লাস্ট দাম আপা।’
‘পছন্দ হয়েছে খুব, তাই পছন্দের মানুষের জন্য নিচ্ছি। কাপড় যেন এলোমেলো না হয় বুঝেছেন? আমার জামাই কিন্তু পুলিশ। বলে দিব এ দোকান থেকে কিনেছিলাম।’
‘আপা কোনো বাজে রিপোর্ট দিয়েন না যেন।আমরা কিন্তু আপনাকে ঠকাইনি। এই আপাকে আর ২০০ টাকা ফেরত দে নাস্তা খেতে।’
আরও ২০০ টাকা ফেরত দিয়ে হাতে প্যাকেট টা ধরিয়ে দিল। দোকান থেকে বেরিয়ে একা একা হাসতে হাসতে গড়িয়ে যাচ্ছি। যেখানে সেখানে ঢপ মারা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। বাসায় ফিরে রুমের লাইট অন করে প্যাকেটটা রেখে বসলাম।
কিছুক্ষণ পরেই উনি এলেন।বাইরে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপছেন। দরজা খুলতেই উনি মিষ্টি হেসে ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি ঠেস মেরে বললাম,
‘কী ব্যাপার, আজ এত দ্রুত বাসায়?’
উনি সোফায় বসে পায়ের মোজা খুলতে খুলতে বললেন, ‘আজ এত দ্রুত মানে?আমি তো রোজই দ্রুত বাসায় ফিরি। দুই একদিন লেট হয়।’
‘দুই একদিন! বাবাহ! প্রায়ই রাত বারোটা বাজে।’
হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললেন, ‘মাঝে মাঝে একটু কাজ থাকে।বোঝো না কেন তুমি?’
আমি পায়ের উপর পা তুলে বসে পা দুলাতে দুলাতে বললাম,
‘ভাবছি এখন থেকে আমি রোজ বাহিরে থাকব। রাত বারোটা করে বাসায় ফিরব।’
উনি কপাল টানটান করে তাকিয়ে বললেন, ‘চেঞ্জ করে এসে শুনছি বাকিটা। ওয়েট।’
আলমারি খুলে ট্রাউজার আর গেঞ্জি নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর কালো ট্রাউজার আর সাদা গেঞ্জির উপরে কালো শীতের কোট পরে এলেন। আমার বিপরীত পাশের সোফায় বসলেন। উনিও পায়ের উপর পা তুলে বসলেন, কোটের দুই পকেটে দুই হাত গুঁজে রাখা। কপাল টানটান করে আমার পায়ের দিকে তাকালেন। আমি যে পায়ের উপর পা তুলে নাচাচ্ছি তাতে নূপুরের রিনঝিন শব্দ হচ্ছে। কালো জরজেট শাড়িতে পা দুটো বেশি ফরসা দেখাচ্ছে। উনি সেদিকে খেয়াল রেখে বললেন, ‘আচ্ছা তারপর বলো। বাহিরে থেকে কী করার ইচ্ছা?’
‘দোকানে বসে চা খাব, সিগারেট খাব পলিটিক্যাল গল্প করব।পুরুষ মানুষ যদি ঘরে বউ রেখে বাইরে এসব করতে পারে আমি কেন পারব না?’
উনি এমন ভাবে তাকালেন কপালের চামড়ায় তিন চারটা ভাঁজ পড়ে গেল।এমন অদ্ভুত কথা শুনে বেশ অবাক বনে গেলেন।একভাবে তাকিয়েই আছেন আমার দিকে।কোনো উত্তর দিচ্ছেন না।
ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, ‘কী দেখছেন?’
‘দেখছি না, ভাবছি।’
‘কী?’
‘এই যে কখন পা*গ*ল টা*গ*ল হয়ে যাব।’
‘কেন?’
‘বউ সারাক্ষণ মুগ্ধ করে চলেছে।শাড়ি পড়ে সেজে বসে থাকলে পা*গ*ল না হলেও অন্যায় হবে।’
‘পাম দিচ্ছেন কেন?’
উনি চট করে আমার পাশে এসে বসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কী হয়েছে, এত ঝ* গ* ড়া করছ কেন?’
‘আমি তো ঝ * গ* ড়াই করি।ভালো হচ্ছে- জিনাত আপা।’
আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কী জিনাত জিনাত করছ। তোমার এই চঞ্চলতার জন্য বেশি মুগ্ধ আমি।’
‘থাক হয়েছে,আর বলতে হবে না।’
‘একটা চা বা কফি খাওয়াবে, উইথ চুমু?’
আমি লজ্জা পেয়ে উঠে গেলাম চা বানানোর উদ্দেশ্য। পেছন ফিরে দেখি উনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চট করে ফিরে এসে উনার গালে চুমু দিয়ে আবার রান্না ঘরের দিকে গেলাম। উনি ভুবন ভোলানো একটা হাসি দিলেন। গ্যাসে পানি দিয়ে উনাকে ডেকে বললাম, ‘সোফার উপর রাখা প্যাকেটটা খুলুন তো।’
উনি এদিক-ওদিক তাকিয়ে প্যাকেটটা পেলেন। প্যাকেটটা খুলে জ্যাকেটটা পেলেন।জ্যাকেটের উপর আমি একটা লাল কাগজে লিখে রেখেছি, ”শ্যামসুন্দর পুরুষ এটা আপনার গায়ে খুব মানাবে। যখন এটা পরবেন আমার খুশবু পাবেন।”
উনি জ্যাকেটের গায়ে চুমু দিয়ে বললেন, ‘ডিয়ার বউ দিস গিফট ইজ ভেরি এক্সসেপশনাল ফর মি। থ্যাংক ইউ সো মাস প্রিন্সেস।’
চায়ের কাপে চা এনে উনার হাতে দিলাম।দুঃজনেই বসে চা খাচ্ছি। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি উনি হঠাৎ ঝুঁকে এসে আমার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। সাথে সাথে ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিশে গেল। উনি লাজুক চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমিও হেসে দিয়ে চায়ের কাপ ছেড়ে দিলাম।
এরই মাঝে উনার ফোন বেজে উঠল। আমি উঠে গিয়ে উনার ফোনটা এনে দিলাম। উনি ফোন কানে দিয়ে টিভি অন করলেন। এখনি খেলা শুরু হবে। ব্রাজিল বনাম আর্জান্টিনা।ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠল,
‘কী ভাই, কী করছেন?’
‘তোমার ভাবিকে নিয়ে খেলা দেখছি।’
‘ভাবি কোন দল ভাই? আমার বউ তো আর্জেন্টিনা। খুব প্যারা দিচ্ছে। ঘরে টিকা যাচ্ছে না।’
উনি আমার কাঁধের উপর হাত দিয়ে আমাকে উনার কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘আমার বউ ওই সব আজেবাজে দল আর্জেন্টিনার সাপোর্টার নয়।শী ইজ ভেরি কিউট গার্ল।তাই সে ব্রাজিল-এর সাপোর্টার। ‘
এটুকু বলেই উনি আমার থুতনি ধরে বললেন, ‘তাই না সারাহ?’
আমি অগ্নিচোখে তাকালাম উনার দিকে।
চলবে….
#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই।
৫৫
#WriterঃMousumi_Akter.
আমাকে অগ্নিচোখে তাকাতে দেখেই উনার মুখের হাসি নিভে গেল। দ্রুত ফোনটা কেটে আমার দিকে সরল চোখে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
‘হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
আমি সাথে সাথে উঠে কোমরে হাত বেঁধে দাঁড়ালাম। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম, ‘কী বললেন, আর্জেন্টিনা আজে বাজে দল?’
উনি বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, ‘তো তোমার এতে রেগে যাওয়ার সায়েন্স বুঝলাম না। তুমি তো ব্রাজিলের সাপোর্টার।’
‘আমি ব্রাজিল সাপোর্টার হ্যাঁ? আপনাকে কে বলেছে আমি ব্রাজিল সাপোর্টার? আর আপনি কোন সাহসে আজেবাজে দল বললেন, তার কৈফিয়ত দেন।’
‘অদ্ভুত! তোমার রুমে গিয়ে দেখেছিলাম নেইমারের একটা ছবি টাঙানো।’
‘ওটা আমি নই, আমার আপু টাঙিয়েছে।’
‘ওহ! তার মানে তুমি ব্রাজিলিয়ান নও?’
‘আপনি ভাবলেন কীভাবে, আমি ওই সেভেন- আপ খাওয়া দলের সাপোর্ট করব?’
উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কীহ? সেভেন আপ খাওয়া দল? যে দল পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তাকে তুমি সেভেন আপ খাওয়া দল বলছ? ৫ বার কাপ নিয়েছে ব্রাজিল।’
‘ওহ, আপনি তাহলে কাপ দেখে দল সাপোর্ট করেন? অবশ্য এটা আপনার একার দো’ষ নয়। বেশিরভাগ ব্রাজিল সাপোর্টাররা ওই ৫ বার কাপ নিছে দেখেই ব্রাজিল সাপোর্ট করে। না হলে করত না।’
‘তাহলে তুমি কী দেখে আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করো?’
‘আমি খেলা দেখে দল সাপোর্ট করি। আমি একজন রিয়্যাল দর্শক, যে কাপ দেখে নয় বরং খেলা ভালো দেখে দল সাপোর্ট করে।’
‘আর্জেন্টাইন ভালো খেলে তাহলে ব্রাজিল এত বার কাপ পেল কেন? ভালো না খেললে কেউ কাপ পায়?’
‘কাপ টাফ ভাগ্যের ব্যাপার, বুঝেছেন? কাপ পাইছে বলেই কি ভালো হয়ে গেল? আমরা আর্জেন্টিনা সাপোর্টাররা কাপ দেখি না। আমাদের কাছে হারলেও আর্জেন্টিনা ভালো, জিতলেও আর্জেন্টিনা ভালো।’
‘হ্যাঁ, ওইটা জাতীয় স্লোগান তোমাদের।’
‘হোক জাতীয়, আপনারে বলতে বলেছি আমি?’
‘না, আমার এ ব্যাপারে কিছুই বলার নেই।তোমাদের কিছু থাকুক বা না থাকুক মুখ তো আছে।’
‘সেভেন আপ তো আর নেই।ভালো করে সেভেন আপ খান, বুঝছেন? ছিঃ! ছিঃ! তাই বলে সেভেন আপ!’
‘গোল দিয়েছিল জার্মানি দল, তোমাদের এত আনন্দ কেন বুঝলাম না। তখন কি জার্মানির সাপোর্টার হয়ে গেছিলে? নিজেরা না পেরে অন্যর দেওয়া গোল নিয়ে মাতামাতি। লজ্জা থাকা উচিত।’
‘কী! এত বড়ো কথা! আমার লজ্জা নেই!’
উনি খিল খিল করে হেসে উঠলেন। সেই হাসিতে শরীরে রাগের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। উনাকে হাসতে দেখে বললাম, ‘এমন বিশ্রী ভাবে হাসছেন কেন? মেজাজটাই খারাপ করে দিছেন। ইচ্ছা হচ্ছে আমি টিভির ভিতর ঢুকে কয়েকটা গোল দিয়ে আসি। আমি হলে দেখতেন কী পরিমান গোল দিতাম।’
‘সেভেন আপ খেতে ইচ্ছা হচ্ছে নাকি তোমার?’
‘শুনুন, আজে বাজে কথা বলবেন না কিন্তু।আপনাদের সেভেন আপ আপনারাই খান।’
‘আমার মনে হচ্ছে, তোমারও সেভেন আপ খাওয়া উচিত, তা না হলে রাগ কমবে না তোমার।’
আমি কিছু বলার আগেই উনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে গলায় সাতটা চুমু দিয়ে বললেন, ‘নাউ, সেভেন আপ খাইয়ে দিলাম।’
উনার গাল ভরা হাসি।ভীষণ মিষ্টি হাসি।ঠোঁট কামড়ে ধরে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনার চোখও যেন হাসছে।আকস্মিক উনার এহেন কান্ডে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী বলব, বুঝতে পারছি না।উনি আমার থুতনি ধরে বললেন, ‘তাও রে’গে থাকবে? চাইলে তুমিও আমাকে সেভেন আপ খাওয়াতে পারো, যেভাবে আমি খাওয়ালাম। স্যরি, সেভেন কেন, মিলিয়ন-বিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারো আমি একটুও রা’গ করব না।’
লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললাম।কী সব বলেন উনি!
আমাকে উনার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কীভাবে রে’গে যাও তুমি? যত রা’গো তত ভালো লাগে। তুমি কি পা*গ*ল? আমি বাচ্চাদের মতো খেলা নিয়ে ঝ*গ*ড়া করে ঘরে অশান্তি করব। মানুষকে দেখি এসব করে। খেয়ে কাজ না থাকলে মানুষ অনেক কিছুই করে। একদল সাপোর্ট করে বলে অরেক দলকে অপমান করা মানুষ ফুটবলপ্রেমী হতে পারে না। সব দলই বেষ্ট। আর খেলায় হার জিত থাকবেই।’
‘আপনি তাহলে প্রকৃত ফুটবলপ্রেমী?’
‘না, আমি আমার বউপ্রেমী।’
এ কথা বলেই আমাকে আরও খানিকটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। ঝগড়ার মুড কোথায় হারিয়ে গেল, জানি না। আমাকে কন্ট্রোল করার অসীম ক্ষমতা আল্লাহ এই মানুষটাকে দিয়েছেন। দিন দিন উনার প্রতি আমার আসক্তি বেড়েই চলেছে।এত বেশি আসক্তি যে, একটা মুহূর্ত উনাকে ছাড়া কাটাতে পারি না ।মানুষ, মানুষকে এতটা ভালো কীভাবে বাসতে পারে! এই মানুষের শরীরের আশ্চর্যরকম এক ফুলের খুশবু পাই আমি।যে খুশবুতে মন মাতোয়ারা করে তোলে।হারিয়ে যায় এই মানুষের প্রেমের গহীন অতলে।
‘ছাড়ুন বাবা আর দাদুকে ফোন দিতে হবে।’
উনি আমায় ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা ফোন দাও।’
উনি সোফায় বসে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছেন।
বাবার নাম্বারে ফোন দিতেই ফোনের ওপাশ থেকে বাবা বললেন,
‘হ্যালো মা কেমন আছো?’
‘জি বাবা, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।বলছি, দাদুকে নিয়ে চলে আসুন। আর কতদিন পরের বাড়ি থাকবেন?’
‘এই তো, আসব মা।পরের বাড়ি কোথায়?তোমার ফুফু আসতেই দিচ্ছে না।’
‘কিন্তু আপনাদের ছাড়া আমাদের ভালো লাগছে না। বাবা কালই কিন্তু চলে আসবেন।’
‘আসব মা।তার আগে আমার একটা ইচ্ছা আছে, সেটা পূরণ করে নিই আগে।’
‘কী ইচ্ছা, বাবা?’
‘রোশানের কাছে ফোনটা দাও তো মা।’
আমি ফোন এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ নিন বাবা কথা বলবে আপনার সাথে।’
উনি ফোন কানে দিয়ে সালাম দিয়ে বললেন,
‘বাবা, এসব কী হচ্ছে? আজ না কাল, কাল না পরশু এসব কেন করছেন? আমি যেন কাল ভোরে আপনাদেরকে এখানে উপস্থিত থাকতে দেখি।’
‘আসব বাবা, তার আগে আমার কিছু স্বপ্ন আছে। সেসব পূরণ করতে চাই; যদি তুমি অনুমতি দাও।’
‘কী স্বপ্ন বাবা?’
‘তোমার দাদু আমাকে মানুষ করতে অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়েছেন।মানুষটা বুড়ো হয়েছেন কিন্তু জীবনের কোনো শখ তার পূরণ হয়নি। আমি ভেবেছি আমার বাবাকে নিয়ে আমি সারাদেশ ঘুরব। আমার বাবাকে আমি সমুদ্র-পাহাড়সহ বাংলাদেশে দেখার মতো যা যা আছে সব দেখাব। পাসপোর্ট করব, বাবাকে নিয়ে ইন্ডিয়াও ঘুরব; হজে নিয়ে যাব। আমার খুব ইচ্ছা হয়েছে নতুন করে দেশ-বিদেশ ঘুরিয়ে দেখানোর। প্রতিটা বুড়ো মানুষেরই শখ থাকে, কিন্তু আমরা তাদের শখ-আহ্লাদেকে গুরুত্ব দিই না। নিজেরা ঘুরি অথচ যাদের জন্য ঘোরাঘুরি করার মতো সামর্থ্য অর্জন করলাম, তাদের নিয়ে ঘোরার কথা ভাবি না।’
‘বাবা, আমি আপনার ছেলে হতে পেরে সত্যি গর্ববোধ করছি। আপনার এমন মন- মানসিকতায় আমি ধন্য।’
‘আমি কিছু জমি বিক্রি করতে চাচ্ছি।তোমার কি আপত্তি আছে?’
‘না বাবা কীসের আপত্তি? তাছাড়া টাকা আমার থেকে নেন। আপনার একাউন্টে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘তোমার এখন টাকার সমস্যা আমি জানি।তরী রোহানের খরচ, নিজের সংসার। এসব নিয়ে ভাবতে হবে না? সারাজীবন তো জমিই রাখলাম। রেখে রেখে তোমার আম্মা আর ওশানের মতো অমানুষ খাইয়েছি। জমি দিয়ে কী হবে বাবা। তোমার জন্য যা রাখা আছে তোমার সমস্যা হবে না।তোমার দাদুর নামের যে জমি আছে সেগুলো তোমার আর রোহানের নামে লিখে দিতে চাচ্ছে। আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি শহরের দিকে যে জমি আছে সেখান থেকে ৫ শতক বিক্রি করে দিব। কিছু ব্যাংকে রেখে দিব তুমি বাড়ি করার সময় নিয়ো। আর বাকি টাকা দিয়ে তোমার দাদু আর আমি ঘুরব।’
‘বাবা আপনার জমি যা ইচ্ছা করুন।আমার কাছে শুনে কেন লজ্জা দিচ্ছেন, বলুন তো?’
‘তোমার কাছে না শুনলে আমি কিছুই করতে পারি না।তুমিই আমার বল-ভরসা সব।’
‘বাবা, আম্মার বিষয়ে কি কিছু ভেবেছেন?আমার সব সময় আম্মার জন্য খারাপ লাগছে। কিন্তু আম্মার পাপের কথা ভেবে খারাপ লাগা উধাও হয়ে যাচ্ছে। মানসিকভাবে খুব অশান্তিতে আছি। কী করব বুঝতে পারছি না।’
‘শোনো, ওই মহিলার নাম উচ্চারণ করো না।ওই মহিলাকে আগেই শায়েস্তা করা উচিত ছিল, যেভাবে ওশানের বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছিল ঠিক সেই ভাবে আমার আরেকটা বিয়ে করা উচিত ছিল। তাহলে নিজের সতিনের সাথে ঝামেলা করতে করতে আর ছেলের বউদের ঘরে সতিন আনার কথা ভাবত না।ভুলটা আমিই করেছি।’
‘বাবা, আম্মা অনুতপ্ত। ‘
‘আইন যা শাস্তি দেবে তাই হবে।অনুতপ্ত হলে কি পাপ কমবে?’
‘জি বাবা, কেউ অনুতপ্ত হলে ক্ষমা করতে হয়।’
‘শোনো, তোমাদের আম্মা, যা খুশি করো।তবে আমি ওই মহিলার মুখও দর্শন করব না। আমি আর এক সেকেন্ডও ওই মহিলার মুখ দেখব না। আপাতত যেখানে আছে থাকুক। বছরখানিক থাকুক, টাইট হয়ে যাবে।’
‘বাবা আমি একটা জমি নেওয়ার কথা ভাবছি।’
‘কোথায়?’
‘বাবা শহর থেকে দূরে, নিরিবিলি জায়গা।’
‘কী করবে, চাষ?’
‘না বাবা অন্য প্লান আছে, আপনাকে জানাব।’
রাতে খাওয়া শেষ করে দুজনেই কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ফোন চাপছি।
ফোন চাপতে চাপতে বললাম, ‘এখন কীসের জন্য জমি কিনবেন?’
‘কিনব, এমনি।’
‘ফাঁকা জায়গা জমি কেন?’
‘দেখি কী করা যায়।’.
‘আরেকটা বিয়ে করে ওখানে নিয়ে তুলবেন নাকি?’
উনি ফোনটা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,’ সারাদিন কি মাথায় এসব ঘোরে, হুম?’
‘আজকাল পুরুষদের বিশ্বাস নেই।’
‘লেখাপড়ার তো কোনো নাম গন্ধ নেই তোমার। লেখাপড়ার কথা কী ভুলে গেলে?’
‘পড়তে ভাল্লাগে না।’
‘কী ভাল্লাগে তাহলে?’
‘এই যে যেমন আছি, তেমন।’
‘তুমি আমার বউ, বুঝলে? সময় থাকতে লেখাপড়ায় মন দাও।’
‘আমি কি চাকরি করব না কি, যে এত পড়ব? পাশ করলেই হলো।’
‘কেন করবে না চাকরি?’
‘আমার বর চাকরি করে, আমি কী জন্য চাকরি করব?’
‘আমি করি তো কী হয়েছে? তোমার করতে আপত্তি কীসের?’
‘বউয়ের ইনকাম খাওয়ার এত লোভ কেন?’
উনি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
‘কী! আমি বউ-এর ইনকাম খেতে চাচ্ছি?’
‘তা ছাড়া কী?’
‘আমারে মাফ কইরা দ্যান ম্যাডাম, আপনাকে আর পড়তে বলব না।’
এ কথা বলেই উনি ফোন রেখে কম্বল মুড়ি দিলেন।আমিও বেশ কিছুক্ষণ ফোন চাপাচাপির পর ঘুমিয়ে গেলাম।ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি আমি ফুটবল খেলছি। নিজেকে মেসির অবস্থানে দেখতে পারছি। মানে আমি নিজেই মেসি হয়ে গিয়েছি। ব্রাজিলের বিপক্ষে প্রচুর গোল দিচ্ছি। চারদিকে সবাই আমাকে উদ্দেশ্য করে উল্লাস করছে।দর্শকের এমন উত্তেজনা দেখে ভীষণ প্রাউড ফিল করে মনে হচ্ছে এইবার ফুটবলে এমন লা** থি দিব বল মাঠ ছেড়ে গ্যালারিতে গিয়ে পড়বে। বলটা পায়ের কাছে আসতেই জোরে লা** থি মেরে বলে উঠলাম,’ গোল!
সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে বসলাম।আর তখনই বুঝতে পারলাম আমি কী ঘটিয়েছি।খাটের নিচে থেকে রোশান স্যার অদ্ভুত ভঙ্গিতে কোমরে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মানে আমি কী গোল গোল করে চিৎকার দিয়ে উনার কোমরে লা** থি মে** রে নিচে ফেলে দিয়েছি!
চলবে?…