একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব-৬৮ এবং শেষ পর্ব

0
861

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৬৮(অন্তিম পর্ব)
#WriterঃMousumi_Akter.

আজ মৃন্ময় আর তরীর বিয়ে। মৃন্ময়ের বহু প্রতিক্ষার প্রত্যাশিত দিনটি আজ। এই দিনটার জন্য মৃন্ময় দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার প্রত্যাশিত ফল যে কত বেশি মধুর তা মৃন্ময়ের হাসি মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যশোরের সব থেকে দামি কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করা হয়েছে। স্টেজে রানির মতো সাজে বসে আছে তরী। গরজিয়াস সাজে তরীকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। মেয়েটা তো এত হাসি খুশিই ডিজার্ভ; করে শুধু সঠিক মানুষের অভাবে সেটা দেরিতে পেয়েছে। তরীর পাশেই বসে আছে মৃন্ময়। এই নবদম্পতিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সকলে। রোহান, ছোঁয়ার মেয়েকে কোলে নিয়ে ওয়াওয়া করে খেলা করছে। ছোঁয়া আর তন্ময়ের মেয়ে স্পর্শী। রোহান বার বার বলছে তোকে আমি স্পর্শ করেছি স্পর্শী। রোহান তাকে খ্যাপাচ্ছে সে হয়তো বুঝছে না; তবে খিলখিল করে হাসছে। বাচ্চার হাসির শব্দের মতো সুন্দরতম মিউজিক কি আর দুনিয়ার কোথাও আছে! ফটোগ্রাফার মৃন্ময় আর তরীর ছবি তুলছে। ফটোগ্রাফার বার বার ছবির বিভিন্ন পোজ দেখিয়ে দিচ্ছে। মৃন্ময় বলল, ‘আমি একটু আমার বউকে উঁচু করে ধরে ছবি তুলতে চাই।’

তরী বলল, ‘মোটেও না। ছিঃ! মানুষের মাঝে এসব কী?’

‘আড়ালে যা করার তা তো করবই। মানুষের মাঝে খারাপ কিছু করব না।’

‘রোশান ভাইয়া কিন্তু তাকিয়ে আছেন।’

‘স্যার আমার দুলাভাই এখন। এখানে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই।’

আমি উনার চোখে হাত রেখে বললাম, ‘নে মৃন্ময় উঁচু কর।’

মৃন্ময় তরীকে উঁচু করে তুলে ধরল। তরীর গলায় মৃন্ময় থুতনি ঠেকিয়ে ছবি তুলল।দুজনের হাসি মাখা মুখশ্রীতে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! তরী বলল, ‘এবার আমাকে নামানোর অনুরোধ করছি প্রিয়।’

‘নামাব মায়াবিনী, তার আগে সবার মাঝে একটি কথার উত্তর দাও।’

‘কী কথার?’

‘আগে বলো এতদিন কেন ঘুরালে আমাকে?’

‘মানুষ সহজে কিছু পেয়ে গেলে তার মূল্য দিতে জানে না, তাই অনেক সাধনার পরে পেলে তার সঠিক মূল্যায়ন করতে জানে।’

‘মায়াবিনী, তুমি কি জানো? প্রথম ভালবাসা কখনো ভুল হয় না, মানুষ ভুলতেও পারে না; সারাজীবনই মূল্য দিতে জানে।’

‘উঁহু, প্রথম ভালোবাসা যে সব সময় সঠিক মানুষের সাথেই হয়, সত্যিকারের হয় এটা কিন্তু ভুল। কিছু কিছু সময় লাইফে আসা দ্বিতীয় ব্যক্তিটি কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হয়।’

আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি ওদের দিকে।দুটো মানুষের কাছে ভালোবাসার দুটো ব্যাখ্যাই আলাদা। কারো কাছে প্রথম প্রেম বিষাক্ত, কারো কাছে প্রথম প্রেম শুদ্ধ। তরী আর মৃন্ময় বাস্তব জীবনের উদাহরণ।

তন্ময় ছোঁয়ার কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলল কতগুলো। এসবের মাঝে সবার অলক্ষে রোশান স্যার আমার হাত আলত করে চেপে ধরলেন। আমি উনার মুখের দিকে তাকালাম, উনিও তাকালেন। এই চাহনিতেই ছিল নেশাক্ত এক অনুভূতি।

ওদের বিয়ের ১০ দিন পরেই আমাদের ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা শুরু হলো। এক মাসের মধ্যেই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল।

মৃন্ময় আর তরীর বিয়ের দু’মাস পরেই তরী আবারও অন্তঃসত্ত্বা হলো।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে আবারও একটি ছেলে সন্তানের মা হলো। রোহানের আরও একটা ভাই হলো। সবার জীবনের সব অশান্তি কেটে গিয়েছে। ধীরে ধীরে সবাই যার যার লাইফে সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এটা স্বাভাবিক হয়-ই। তরীর এখন বিশাল বড়ো বিজনেস। মৃন্ময়দের ফ্যামিলি বিজনেস তরীর হাত ধরে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে।সেই তরী আজ অনেক সুখী। এরপরই পিহুর বিয়ে হয়ে গেল। হয়তো দ্বীপের কখনো পিহুকে মনে ধরেছিল; কিন্তু বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে বলা হয়ে ওঠেনি। কিছু ভালো লাগা একান্তই নিজের মনে থেকে যায়। কাউকে বলা হয়ে ওঠে না। একটা চাপা কষ্ট দিয়ে যায়।

সবাই আজ যার যার জীবন নিয়ে বিজি। নিজেকে যেন কেমন একা লাগে। ভীষণ একা। সবার কোলে বাচ্চা আছে। শত চেষ্টা করেও কোন ভাবেই কনসিভ করতে পারছি না আমি। সবার সময় কাটানোর জন্য ছোট্ট বেবি আছে। সারাদিন উনি বাইরে থাকেন। আমি একা। এখান আর চাইলেও হুটহাট বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারি না। ওদের বাবু নিয়ে ওরাই পেরে ওঠে না। অনেক কিছুই একটা সময় বদলে যায়। এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করলাম। সব কিছুই বিষন্ন লাগে। বন্ধুদের সাথে আগের মতো আর কথা বলি না। উনি প্রায় জিনিসটা খেয়াল করছেন আর আমাকে বলছেন, ‘আমার সারাহকে কিন্তু এমন বিষন্ন মানায় না। আমি সেই ছটফটে মেয়েটাকে চাই। যে মেয়েটা অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করত; কারো কষ্ট মুছে দেওয়ার জন্য যে কোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিল, যাকে একটু আদর কম করলে রা’গ দেখাত, প্রচুর ঝ’গ’ড়া করত। আমার সেই মেয়েটাকে চাই, বুঝলে? এই চোখে বিষন্নতা মানায় না। এই চোখ অগ্নিরূপেই দারুণ লাগে। এই মুখে মলিনতা মানায় না, মানায় খিলখিল করা হাসি।’

_________________
এমবিএ’র রেজাল্টও দিয়ে দিয়েছে। সবাই ভালো রেজাল্ট নিয়েই পাশ করেছি। কথায় আছে মানুষ পাপ করলে নিজ থেকেই শাস্তি পেয়ে যায়। ভালোবাসার যন্ত্রণার থেকে বড়ো যন্ত্রণা পৃথিবীতে নেই। ওশান যে যন্ত্রণা পাচ্ছে! এর চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। শাশুড়ি আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। খুব মন খারাপ। যতই হোক মা তো; সন্তানের জন্য কষ্ট পাচ্ছেন। আমাকে অনুনয় করে বললেন,
‘তুমি চাইলেই কিন্তু পারতে অনেক কিছু ঠিক করতে। আমি দো’ষ দেব না তোমার। তবুও ওশান তো নিজের ভুল বুঝেছে। তরীর জন্য ছেলেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। একবার সুযোগ দিলে মনে হয় ভুল শোধরাতে পারত।’

আমি কিছুই বললাম না। এসব নিয়ে কিছুই বলার নেই। উনি বিগত ১৫ দিন ভীষণ ব্যস্ত আছেন। মাত্র ৪ রাত বাসায় এসেছেন।তাছাড়া দিন-রাত বাসায়ও আসেন না। সেদিন সকালে ইউরিন টেস্টের পর থেকে ওই যে উনি বললেন, ‘আমি কিছুদিন বিজি থাকব।’ সেই ব্যস্ততা আর শেষ হলো না।শরীরটা কেমন পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। সন্ধ্যায় একরাশ মন খারাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বেলকনিতে। বিগত এক বছরে প্রতিমাসে ইউরিন টেস্টের কোনো ফলাফল পজিটিভ আসেনি। এর জন্য দিন দিন কেমন একাকীত্ব অনুভব করছি আমি। কিছুই ভালো লাগে না। উনি প্রায় রাত করে করে বাসায় ফেরেন। আমার বেবি হয় না বলে কি আমায় কেয়ার করেন না! আমায় কি উনি আর ভালোবাসেন না! বেবি না হওয়ার জন্য কি উনি বিরক্ত! এসবই কি আমার ব্যর্থতা? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। উনাকে সাত দিন দেখিনি। আজ সকালে কথা হয়েছিল; আর হয়নি।ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। কেমন যেন মনে হচ্ছে এখনি প্রা*ণটা বেরিয়ে যাবে। সব ঝাপসা হয়ে আসছে। আমাদের কি আর দেখা হবে না, শ্যামসুন্দর পুরুষ? আমি কি আপনার বুকে মাথা গুঁজে মরতেও পারব না!
এলোমেলো চুল, লাল টকটকে চোখ, জ্বরের মাত্রা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। চোখে সব ঝাপসা দেখতে দেখতে বেলকনিতেই পড়ে রইলাম।

____________
কানে ভেসে আসছে ফোনের টুংটাং শব্দ।কিন্তু চোখ খোলার মতো শক্তি পাচ্ছি না। প্রায় দু-ঘন্টা ধরে ফোন বেজে চলেছে। আমি প্রায় অচেতন হয়েই পড়ে আছি। এরই মাঝে হঠাৎ দুটো পুরুষালী হাত আমাকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গালে আর কপালে হাত স্পর্শ করে আমাকে ডাকল।
‘সারাহ, এই সারাহ, ঘুমিয়ে গিয়েছ? উফফ! এত জ্বর তোমার!’

শ্যামসুন্দর পুরুষ ছাড়া এত ব্যাকুল হয়ে কে আমাকে ডাকবে! তার কন্ঠ কানে স্পষ্ট ভেসে আসছে; তবুও চোখ খোলার বিন্দুমাত্র শক্তি পেলাম না। মানুষটা বার বার আমার গলা, কপাল, গালে, হাত স্পর্শ করছে আর কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। এত অবহেলার পরে এত অস্থিরতা কেন শ্যামসুন্দর পুরুষ? আমার জন্য আপনার এখনও কষ্ট হয়? একবার তো ফিরেও তাকান না আপনি।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ উনার ঠান্ডা শীতল ওষ্ঠের স্পর্শ কপালে নেমে এলো।ক্রমাগত সেই স্পর্শ পেয়েই যাচ্ছি। উনার এই স্পর্শ আমাকে শক্তি জোগাল। ভালোবাসার পাওয়ার এত বেশি হয়! আমার সব অসুস্থতা যেন নিমিষেই কমে গেল। শরীরের দূর্বলতা থেকে গেলেও মনের দূর্বলতা যেন কেটে গেল। মনের শক্তিই বড়ো শক্তি। মন সুস্থ থাকলে সবই সুস্থ থাকে। আমার এই অসুখের কারণ তার অবহেলা। সে কি বোঝে না! তার না থাকা আমাকে ভেঙে দেয়, দুমড়ে-মুচড়ে দেয়,শক্তিহীন করে দেয়।আমার এই অসুস্থতার কারণ সে নিজেই। তার সামান্য একটু স্পর্শ পিপাসিত হৃদয়কে শীতল করে তুলল। আস্তে করে চোখ খুললাম। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখনি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। এত জ্বর কখন এলো!’
বলেই উনি ফোন হাতে নিতে গেলেন। আমি হাত টেনে ধরে ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,
‘নিতে হবে না কোথাও। একটু পাশে বসুন।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’

উনি ব্যাকুল হয়ে বললেন,
‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার?’
বলেই কপালে হাত ছোঁয়ালেন।

‘শরীরে নয়, হৃদয়ের ঠিক সেইখানে, যেখানে রোশান সিদ্দিকী নামক হার্টবিট-এর বসবাস।’

‘যেখানে আমি আছি সেখানে তো কষ্ট হবার কথা নয়।’

‘তাও তো হচ্ছে, তীব্র কষ্ট। কেন দিচ্ছেন আমাকে কষ্ট?’

‘তাহলে কি কষ্টের কারণ আমি, সারাহ?’

‘হ্যাঁ আপনি, আমার সুখ যেমন আপনি, দুঃখও আপনি।’

‘আমি কষ্ট দিয়েছি তোমাকে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ দিয়েছেন। আমাকে অবহেলা করেন আপনি, কষ্ট দেন। আমার যে বেবি হয় না এই জন্য আপনি আমাকে অবহেলা করেন।এটা কি আমার দোষ?’

‘তোমার বেবি হয় না মানে? এসব কে বলে তোমাকে, আর আমি তোমাকে অবহেলা করি?’

‘লাস্ট ১৫ দিন আপনি ঠিকভাবে বাসায় আসেননি কেন? আমার ফোন ধরেননি ঠিকভাবে। আমার কত কষ্ট হয়েছে জনেন?আমি মনে হয় ম’ রে যাব।’

উনি আমার অশ্রুসজল চোখের দিকে তাকিয়ে চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বললেন,
‘তোমার চোখের অনন্ত মায়ায় আমি ডুবেছি সারাহ, অথচ অনন্ত সুখ এনে দিতে পারিনি। কেন যেন মনে হয় আমি ব্যর্থ, ভীষণ ব্যর্থ! আমি তোমাকে বোঝাতে পারিনি তুমি আমার কী। তোমাকে আমি কত বেশি ভালোবাসি যদি বোঝাতে পারতাম! তোমার কি এত কষ্ট হতো? এই যে বেবি হয় না সেজন্য কেন তুমি তোমাকে দায়ী করছ? তুমি কি বোঝো না একটা বেবি আমাদের ভালোবাসায় বাধা হতে পারে না। আমার কাছে তুমি মানেই সব পূর্ণতা, আমার কাছে তুমি মানেই সব; অথচ তোমাকে বোঝাতে আমি ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতাকে সফলতায় পরিণত করার সময় এসেছে। কেন যেন তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত। সেই শুরু থেকে তুমি পরিশ্রম করে যাচ্ছ। কারো না কারো জন্য সব সময় ব্যস্ত থেকেছ। সেই সাথে আমিও থেকেছি। কখনো দুজন দুজনকে সেই ভাবে সময় দিতে পারিনি। আমিও খুব ক্লান্ত। কেন জানি না এখন আর মানুষের কোলাহল ভালো লাগে না। নিরিবিলি থাকতে ইচ্ছা করে। একান্তে তোমার সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছা করে কোন এক নির্জনে; যে নির্জনে আমাদের প্রহর নামবে ভালোবাসা হয়ে। প্রতিটা প্রহরে কোনো দ্বিধা ছাড়াই তোমাকে ভালোবাসতে পারব। আমার আর টাকা পয়সা লাগবে না। যতটুকু আছে এনাফ। সব ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যাব আমাদের স্বপ্নের শহরে। যাবে আমার সাথে কোন এক নির্জন প্রহরে? যেখানে থাকবে আমাদের ছোট্ট একটা ঘর, সুন্দর একটা পদ্মফোটা জলাশয়, একটা ললরঙা কৃষ্ণচূড়া গাছ, বারোমাসে শিউলিতলা ফুলে ফুলে বিছিয়ে থাকবে। তুমি খিলখিল করে হাসবে সেখানে। তোমার হাসিতে মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি মুগ্ধ হবে।’

‘সত্যি আমি বড্ড ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত। এই কোলাহলের শহর ছেড়ে আমাকে নিয়ে যাবেন? একটা দিন, একটা প্রহর অন্তত নিরিবিলি আপনার বুকে মাথা রেখে বাঁচতে চাই।’

উনি আরও একটু শক্তকরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘হ্যাপি ফোর্থ ম্যারিজ এনিভার্সারি মাই লাভ।’
আজ সেই সারপ্রাইজ দেওয়ার দিন। যে সারপ্রাইজের জন্য এতদিন বিজি ছিলাম।আর তুমি ভেবেছ আমি অবহেলা করছি।’

____________
ডাক্তার দেখিয়ে উনি আমাকে নিয়ে একটা রিকশায় উঠলেন। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।জড়োসড় হয়ে উনার বুকে মাথা গুঁজে রইলাম। চাঁদনি রাত, হিম বাতাস, নিরিবিলি রাস্তায় চলেছে রিকশা। জ্বরে অচেতন করে নিয়ে আসছে। রিকশাটা গিয়ে থামল শহর থেকে অনেকটা দূরে। যেখানে কোনো লোকালয় নেই। মাঠের মাঝে এক টুকরো জমিতে লাল-নীল আলো জ্বলছে। রিকশাটা থামতেই সেদিকে আমার চোখ গেল। আমার পরনে সাদা জরজেট একটা শাড়ি। আসার সময় উনিই পরিয়ে নিয়ে এসেছেন। উনি আমাকে ধরে হাঁটছেন। গোলাপের পাপড়িতে বিছানো একটা সরু রাস্তা। আস্তে করে পা ফেলছি আমি। রাস্তার দু’পাশ বেলুন আর ফুল দিয়ে সজ্জিত। সামনেই একটা ছন আর টালির দো’তলা ঘর। ঘরটা এত সুন্দর করে আলোকসজ্জায় সজ্জিত! কোথায় যেন হারিয়ে গেল সব অসুখ। পাশে সুন্দর একটি জলাশয়। সেখানে ঝিনুকে মোমবাতি ভাসছে হরেক রকমের। লাল পদ্ম ফুটে রয়েছে। পদ্ম পাতায় মোমবাতি। জলাশয়ে বিভিন্ন রঙের রঙিন মাছ। জলাশয়ের পাড়ে লালরঙা কৃষ্ণচূড়া গাছ, ঘরের চালে বড়ো শিউলি গাছ। আমার চোখ জোড়া যেন সার্থক হলো। আমি কতটা মুগ্ধ হয়েছি তা হয়তো এই সুন্দর এক টুকরো জমির সৌন্দর্য বর্ণনা করে প্রকাশ করতে পারব না। আমার ঠোঁটে হাসি দেখে বললেন, ‘ভালো লাগছে?’

‘অনেক বেশি। একটু জলাশয়ে পা ভেজাব?’

‘উঁহু আজ নয়, অন্য একদিন। তোমার জ্বর।’

‘আপনি আছেন না, আমার মেডিসিন।আমার কিচ্ছু হবে না।’

‘বেশিক্ষণ না কিন্তু।’

‘আচ্ছা।’

উনার সাথে জলাশয়ের পানিতে পা ভেজালাম। চাঁদটাও জলাশয়ের মাঝ বরাবর এখন। জলাশয়ে পা ভিজিয়ে উনার কাঁধে মাথা রেখে যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ট সুখ অনুভব করছি। হঠাৎ চোখ গেল ঘরের সামনে।সেখানে লেখা আছে একটি “নির্জন প্রহর চাই।”
নামটা এত সুন্দর দেখেই চোখ-মুখ আনন্দ চকচক করে উঠল। নামটা একটু বেশি সুন্দর না! আমরা তো এমন কিছুই চাচ্ছিলাম। একটা নির্জন প্রহর চাচ্ছিলাম; যেখানে দু’জনে একান্তে সময় কাটাতে পারব।
আস্তে করে ডাকলাম উনাকে,’ শ্যামসুন্দর পুরুষ…’

‘হুম।’

‘এসব কবে করলেন?’

‘তিন বছর ধরে।’

‘এতদিন লাগল সামান্য এইটুকু কাজ করতে!’

‘গাছ বড়ো হতে সময় লেগেছে। আর আমি কোনো মিস্ত্রী দিয়ে এ কাজ করাইনি।’

‘আপনি কি ঘরামি যে একটা ঘর বাঁধলেন?’

‘হাহা। এটা তো ইট পাথরের ঘর না। তবে একজন ছনের ঘর করা মিস্ত্রির সাহায্য নিয়েছিলাম। তার সাথে নিজ হাতে ঘর বেঁধেছি। খুব যত্ন করে করেছি।’

‘এজন্য ব্যস্ত ছিলেন?’

‘জি ম্যাডাম।’

‘আমাকে বলেননি কেন?’

‘বললে কি আর সারপ্রাইজ হতো?’

‘এত ভালোবাসেন কীভাবে?’

‘সেটা বলতে মানা।’

‘আমিও আপনাকে ভীষন ভালোবাসি জানেন?’

‘জানি, বাট এই শ্যামবর্ণ মানুষকে এত ভালোবাসা হয় কেন?’

‘আপনার এই শ্যামলা শ্যামলা বরণই ভালোবাসার কারণ।’

হঠাৎ তীব্র জ্বর এলো। কাঁপুনি দিচ্ছে খুব। উনাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলাম। উনি কোলে তুলে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন।বিছানায় শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিলেন।তবুও ঠান্ডা যাচ্ছে না। উনি আমার হাতের তালু ঘসে গরম করার চেষ্টা করছেন।
প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে উনার উষ্ণ ছোঁয়ায় উনাকে আলিঙ্গন করলাম। উনিও মাদকের নেশার মতো আসক্ত হয়ে আমাকে কাছে টেনে নিলেন। আদর আর ভালোবাসার ছোঁয়ার ছন্দে-আনন্দে একটি নির্জন প্রহর সাক্ষী হলো আরও একটি মধুচন্দ্রিমার রাত।

________________
দু’মাস পরে নিজের ভেতরে নতুন কিছু আবিষ্কার করলাম। নিজের শারিরীক অনেক পরিবর্তন। তবে কি মন যা বলছে তাই! খুশি মনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজতে শুরু করলাম। বাইরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। উনি বৃষ্টিতে ভিজে আধভেজা অবস্থায় গায়ের শার্ট থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে আমার দিকে তাকালেন। আমাকে দেখেই ভুবন ভোলানো হাসি দিলেন। এই হাসিতেই তো আমি সব ভুলে যাই। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে হাত দুটো কোমরে নামিয়ে আনলেন। উন্মুক্ত কোমরে উনার হাতের স্পর্শ আমাকে কাঁপিয়ে তুলল। আজও উনার স্পর্শ আমাকে লজ্জা দেয়, ভীষণ লজ্জা। উনি ঘাড়ে চুমু দিয়ে বললেন, ‘এত খুশি কেন লাগছে তোমাকে?’

একটু উঁচু হয়ে উনার কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললাম, ‘সম্ভবত আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।’

মানুষটা যেন পুরোপুরি থমকে গেল। কতক্ষণ যে আমাকে জড়িয়ে ধরে রইল তার ঠিক নেই।

_______________
দু’বছর কে’টে গিয়েছে। আমাদের টুইন বেবি আরশ-আরশির জন্মদিন। যেদিন আমাদের জীবনের সব থেকে বেশি হাসি-খুশি কোনো দিন থাকে; সেদিন নির্জন প্রহরে গিয়ে সেলিব্রেট করি। আজ ওদের জন্মদিন ওখানেই পালিত হচ্ছে। তন্ময় আজ বিসিএস ক্যাডার। কাস্টম অফিসার হয়েছে। ছোঁয়ার সাথে অনেক ভালো আছে। তরী মৃন্ময় আজ অনেক সুখে আছে। তরী আজ একজন সফল উদ্যোক্তা। সেই সাথে ভালো আছি আমরা। আমার মা-বাবা, আপু, দাদু, উনার দাদু, শাশুড়ি-শ্বশুর, তরী -মৃন্ময়, ছোঁয়া-তন্ময়, দ্বীপ সবাই উপস্থিত আছে।আজ অনেক দিন পর সবাই এক জায়গায়।অনেক দিন পর সেই পুরনো আড্ডায় জমে উঠল। রোশান স্যারের নিজ হাতে তৈরি নির্জন প্রহর। এক ফ্রেমে বন্দী হলাম আমরা। হাজারও স্মৃতি নিয়ে একটা অ্যালবাম তৈরি করলাম।

সত্যি বলতে জীবনে যদি উনি না আসতেন তাহলে এত সুখ আর শান্তি পেতাম না।জীবন কত সুন্দর উপলব্ধি করতে পারতাম না। উনার জন্যই জীবনে এত সুখ। একজন শ্যামসুন্দর পুরুষ কতটা ভালবাসতে পারে তা আমি ছাড়া কেউ জানে না। এমন একজন শ্যামসুন্দর পুরুষ সবার জীবনেই আসুক। এভাবেই একটা মেয়ের জীবন আলোকিত করুক।

সমাপ্ত।