#একদিন_দেখা_হয়েছিল
নাজনীন আক্তার
পর্ব-৬
-নিজের দাদুর নাম শুনে অবাক হচ্ছো? হ্যাঁ, তোমার দাদু রবিউল খানের মেয়ে। তোমার বাবা সবুর খান, চাচা মুকুল খান, কামাল খানের একমাত্র বোন নয়নতারা খান। মির্জা বাড়ির বউ এখন তিনি। আর আমি তার একমাত্র সন্তান কাব্য মির্জা।
আমার বাবার বোন! মানে তো আমার ফুফু হন। একমাত্র ফুফু। এই খান পরিবারের মেয়ে। অথচ আমি তার অস্তিত্ব সম্পর্কেই অবগত ছিলাম না। শুধু আমি কেন! আমার কোনো ভাই-বোনই তার সম্পর্কে জানেন না। এতটা লুকিয়ে যাওয়াও সম্ভব?
– নয়নতারা ভেবেছিলেন বাবা-ভাইয়েরা হয়তো বিয়ের পর ঠিক মেনে নিবেন। এত আদরের বোনকে কি দূরে ঠেলে দিবেন! কিন্তু তা হলো না। হঠাৎ রবিউল খান অসুস্থ হয়ে পরেন। এই লজ্জা হয়তো তিনি মেনে নিতে পারেননি। সারা গ্রামে যে ছড়িয়ে পড়েছিল তার মেয়ের কথা। তার তখন একেবারে জীবন নিয়ে টানাটানি লেগে গেল। সব শুনে নয়নতারা ছুটে আসেন। কিন্তু রবিউল খান তার মুখ দেখতেও চান না। উত্তেজনা সইতে না পেরে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পরেন। শেষে সবুর খান তাকে খুবই শক্ত কণ্ঠে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। আর কখনও নয়নতারার মুখ দেখতে চান না এটাও বলে দেন।
সবুর খানই ছোট থেকে নয়নতারাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছিলেন। এই ভাইয়ের সাথেই নয়নতারার সবচেয়ে বেশি সখ্যতা ছিল। তাই ভাইয়ের এহেন আচরণে ভীষণ কষ্ট পান তিনি। আবার বাবার অসুস্থতার জন্য নিজেকেই দায়ী করতে থাকেন। তিনি সেদিনই তাই কথা দিয়ে যান যে, সবুর খান কখনও তাকে নিজে থেকে না ডাকলে তিনি আর আসবেন না। মুখ পর্যন্ত দেখাবেন না।
শ্বশুরবাড়ি থেকে তাদের বিয়ে মেনে নিলেও নয়নতারা বাপের বাড়ি থেকে এমন বিচ্ছিন্ন হওয়াটাকে মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যেতে থাকেন। খান পরিবারও তখন থেকে গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দেন। বছর দুয়েকপর নয়নতারার বাবাও মারা যান। নয়নতারা হাসপাতাল থেকে বাবাকে দেখে আসেন। মৃত্যুর আগে বাবার সাথে সময় কাটাতে না পারার আফসোস আর যন্ত্রণা নয়নতারাকেও শেষ করে দিতে থাকে। সেসময় সুরুজ মির্জাও অনেক চেষ্টা করেছেন নয়নতারাকে স্বাভাবিক হতে। কিন্তু পারেননি। ফলস্বরূপ নয়নতারা তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ভাগ্যফেরে প্রত্যেকবারই তিনি বেঁচে যান। এভাবেই চলছিল তার জীবন। কিন্তু প্রথম সন্তানের আগমনের খবরে হয়তো নয়নতারা শান্ত হন। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত যান তিনি।
আমি সবটাই বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। আর প্রত্যেক ঘটনাপ্রবাহে চমকে চমকে উঠছিলাম। আমাদের বাড়ির সাথে এত লম্বা ইতিহাস জড়িত। একজন নয়নতারা আছেন আমাদের! খান পরিবারের রাজকন্যা ছিলেন যিনি। শুধুমাত্র ভালোবেসে বিয়ে করার কারণে যার এমন পরিণতি! আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
“নয়নতারা এখন কেমন আছেন?”
কাব্য আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীর গলায় বললেন,
“সেটা নয়নতারাই জানেন!”
আমার ভীষণ কৌতুহল হলো সবকিছু নিয়ে। নয়নতারাকে দেখতে ইচ্ছাও হলো। আমি কিছু বলতে নিলেই কাব্য আমাকে থামিয়ে দেন।
– ছোটোবেলায় মায়ের কাছে এই বাড়ির বহু গল্প শুনেছি। এই বাগানের গল্প শুনেছি। আমার মা নিজ হাতে এই বাগান প্রথম সাজিয়েছিলেন। তারপর মামাদের গল্প শুনেছি। কিন্তু ভাই-বোনদের কারও গল্প শুনতে পাইনি। কারণ মা তো তোমাদের দেখেইনি। তোমরা গ্রামে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলে। কিন্তু সবকিছুর এত গল্প শুনে আমার ভীষণ ইচ্ছা হয়েছিল এই বাড়ি দেখার। এই বাগান দেখবার। এই বাড়ির লোকজনদের দেখবার। তাই কলেজে পড়াকালীন একবার বাড়িতে কিছু না বলেই, এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। বাড়ি থেকে বড় মামা, মেজো মামা, ছোটো মামা সবাইকে বের হতে দেখেছি। মামীদেরও দেখেছি, ভাইবোনদের দেখেছি। কিন্তু যখনই চলে যেতে নিব তখনই চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো এক কিশোরী। স্কুলড্রেস পড়ুয়া, দুই বেনী করা, হাসোজ্জ্বল মুখের এক মেয়ে। আমি থমকে গিয়েছিলাম। তাকে দেখেই আমার বিস্ময়ের শুরু হয়। তার মুখে আমি আমার মায়ের আদল দেখতে পেয়েছিলাম। মায়ের চেহারার গঠন একদম। জানো তোমাকে অনেকটা আমার মায়ের মতো দেখতে।
আমি থমকে দাঁড়ালাম তার এমন কথা শুনে। আর কাব্য নিজের জায়গায় বসে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ সেই চোখ থেকে দুফোঁটা পানি পড়ল। আমি আরও অবাক হলাম। তারপর সেই চোখ দুটো ধীরে ধীরে নামিয়ে কাব্য আমার চোখের দিকে তাকালেন।
” জানো মনা, প্রথমবার তোমাকে দেখেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল আমার। প্রথমে পাত্তা দেইনি। ভেবেছিলাম, মায়ের মতো দেখতে বলেই ভালো লেগেছে। কিন্তু তারপর কিছুতেই তোমাকে মাথা থেকে বের করতে পারছিলাম না। বারবার তোমার চেহারা ভেসে উঠছিল। নিজেকে বহুবার দমন করেছি। কিন্তু সামলাতে পারিনি।আমি টের পেয়েছিলাম এক ভয়ংকর অনুভূতির সূত্রপাতের সময়টুকু। তারপর বহুবার আমি এই বাড়ির সামনে এসেছি। তোমার সামনে গেছি। তখন ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা প্রথমবার অনুভব করেছি। জানো প্রেমে পড়া মানে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। নাহলে সর্বদা শক্ত, সাহসী আমি এমন তোমাকে হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে পরি!
ভালোবাসা হয়তো এমনই, যেখানে ঠোঁট নয় চোখ কথা বলে৷ অথচ কোনো শব্দ হয়না। শুধু নিঃশব্দে হৃদয় জানান দিয়ে যায়, তাকে আমার ভীষণ করে চাই।”
পুরোটা কথা কাব্য আমার চোখে চোখ রেখে বললেন। আমি অবাক হলাম। এত প্রগাঢ় অনুভূতির প্রকাশ! আর এই ভালোবাসাকেই কীনা আমি ভুল বুঝেছিলাম! আমি বেঁধে বেঁধে যাওয়া বুলিতে বললাম,
-তবে.. তবে এতদিন কেন সামনে আসেননি? সেদিন ট্রেনে দেখা হওয়ার পরও আর কখনও আপনাকে দেখিনি। আপনাকে কত জায়গায় খুঁজেছি।
-কীভাবে আসতাম? আমি তো আমার মায়ের কথা জানতাম। ভালোবেসে সে পরিবার হারিয়েছে। কী ভিষণ যন্ত্রণায় দিনে দিনে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। আমি চাইনি সেই একই যন্ত্রণা তুমিও পাও। ভেবেছিলাম সময় হলে সবাইকে জানিয়ে আমি আমার ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাব। সেদিন ট্রেনে হঠাৎ তোমার পাশে আমার সিট পরতে দেখে আমি খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম। এজন্য প্রথমে তোমার পাশে যাইনি। পরে এক শয়তানকে তোমার পাশে বসতে দেখে সামনে গিয়েছিলাম।
কিন্তু এখন আমার কি মনে হয় জানো? আমরা যাকে প্রচন্ড ভালোবেসে থাকি। আমাদের এই ভালোবাসার তীব্রতার কারণেই হয়তো তাদের মনেও আমাদের জন্য ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। মায়ার সৃষ্টি হয়। নাহলে তুমিই কেন একজন অপরিচিত মানুষকে প্রথমবারের মতো দেখেই তাকে অনুভব করতে শুরু করবে! তার জন্য সম্পূর্ণ এক ঘরে করে ফেলবে নিজেকে!
সেদিন তোমাকে দেখেই আমি বুঝেছিলাম তোমার ভিতরের দহনটটুকু। তাই আর সামনে আসিনি। ভয় হতো, এই দহন যদি আরও বেড়ে যায়, তবে তো তুমি সইতে পারবে না। আর আমিও পারব না। ভেবেছিলাম সব গুছিয়ে তোমার পরিবারের সামনে আসব। পারিবারিকভাবেই তোমাকে নিজের করে নিব। কিন্তু তুমি হঠাৎ অভিমানেই অন্য কাউকে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে।
কাব্যের সব কথা শুনে হঠাৎ আমার কী যেন হলো, আমি কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলাম না। শুধু চিৎকার করে কাঁদতে থাকলাম। কাব্য এসে আমার হাত ধরে নিলেন। খুব শক্ত করে ধরলেন। যতটা শক্ত করে ধরলে অপরজনকে ভরসা দেওয়া যায়, সাহস দেওয়া যায়। তারপর ধীর কণ্ঠে জানান,
“জানো তো মনা, আমার বাবাও এই বাগানেই প্রথম আমার মাকে তার অনুভূতির কথা জানান। ভালোবাসার কথা জানান। আজ আমিও এই বাগানেই তোমাকে আমার অন্তরের কথা জানালাম। কিন্তু আমি আমার মায়ের মতো তোমাকে পালিয়ে যেয়ে সারাটাজীবন পরিবার হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে থাকতে দিব না। আমি সকলের মত আদায় করে সবার সামনে তোমাকে নিজের করে নিব। এই কাব্য মির্জা আজ কথা দিয়ে গেল।”
———————————–
সারারাত আমি দুচোখ এক করতে পারিনি। বারেবারে অজানা ভয়ে আর অজানা আশঙ্কায় আমার হৃদয় কেঁপে কেঁপে উঠছিল। রাতে কাব্যের অনুভূতির কথা জেনে আমার পক্ষে আর কিছুতেই অন্য কাউকে বিয়ে করতে সায় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ভোর হতেই বাড়িতে সবার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর হয়তো আত্মীয়-স্বজনও আসতে শুরু করবে। আমি কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা, আমি কি বাড়ির সবার হাতে পায়ে ধরা শুরু করব! তবে কি তারা আমার কাব্যকে মেনে নিবে না?
“কীরে ভয় পাচ্ছিস?”
হঠাৎ পেছন থেকে কথাটা ভেসে আসাতে ওদিকেই তাকালাম। ভাইয়া কথাটা বলেছেন। হয়তো বিয়েতে ভয় পাচ্ছি কীনা সেটা জানতে চেয়েছেন। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আপাতত কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না।
“তুই এখন ঠিক সেই ত্রিশ বছর আগে ফেরত গিয়েছিস। নয়নতারা খানের ঠিক সেই অবস্থায় আজ তারই বংশের মেয়ে ময়না খান। তারা কাকে বেছে নিবে? ভালোবাসা কে বেছে নিবে নাকি পরিবারকে! ইতিহাস রিপিট হলো!”
আমি চমকে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া কীভাবে জানল এসব! আমার অবস্থা দেখে ভাইয়া হালকা হাসলেন।
-কালকে রাতে বাগানে শুধু ময়না খান আর কাব্য মির্জাই ছিলেন না। সাথে আমি মৃদুল খানও উপস্থিত ছিলাম। আমার ঘুম আসছিল না, তাই বাগানে হাঁটতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেন ঘুম আসছিল না জানিস?
আমি চমক কাটাতে না পেরে ওভাবেই মাথা নেড়ে না জানালাম।
– তোকে চারবছর আগে এক গল্প শুনিয়েছিলাম। আমার নীরার গল্প। আমার একতরফা ভালোবাসার গল্প। তুই শেষে জানতে চেয়েছিলি, নীরার এখন খোঁজ জানি কীনা। আমি না বলেছিলাম। অবশ্য মিথ্যা বলিনি কারণ সত্যিই তো জানতাম না। শুধু কিছু কথা লুকিয়েছিলাম। আমার নীরা ততদিনে বেঁচে নেই। আত্মহত্যা করেছিল মেয়েটা। ছোট থেকেই সৎ মায়ের সংসারে বড় হয়েছিল। সৎ মায়ের অত্যাচারে মেয়েটা একদম চুপচাপ হয়ে গেছিল। কিন্তু শেষমেশ আর সহ্য করতে না পেরে দুনিয়া থেকেই চলে গেল।
কথাটুকু বলেই ভাইয়া চোখ বন্ধ করে ফেললেন। হয়তো তার নীরার স্মৃতিতে ফেরত গেলেন। তার চোখ থেকে কয়েকফোঁটা পানিও পড়লো। আমি জড়িয়ে ধরলাম ভাইয়াকে। ভাইয়া ধীরে ধীরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন।
– সেদিন তোকে কথাগুলো বলিনি ভয়ে, যদি তুই আরও ভেঙে যেতি। তখনতো তোর মানসিক অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। কিন্তু জানিস আমার এখনও ভীষণ আফসোস হয়। আমি যদি নীরার ওই কঠিন কথাগুলোতে না ভুলে আরও ওর মনের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতাম। যদি ওকে সাহস দিতাম। তবে আমার নীরা হারাতো না। আমার ভালোবাসাও বেঁচে থাকতো। মনা, তুই তোর ভালোবাসাকে হারাতে দিস না। কোনোভাবেই না। সারাজীবন আফসোস করার চেয়ে একবার সাহস দেখানো ভালো। আমি সর্বদা তোর পাশে আছি।
ভাইয়ার কথা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম। কী করব আমি! আজ আমার হলুদ। সবাই বিয়েবাড়িতে মেতে উঠেছে। এখন কীভাবে বিয়ে ভাঙার সংবাদ দিব! বাবা-মা কি মেনে নিবেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কান্নার গতি আরও বাড়ল। কিন্তু তখনও আমি জানতাম না যে জীবন আমার জন্য আরও বড় চমক রেখেছে। শুধু আমার জন্যই নয়, গোটা খান পরিবারের জন্য। প্রায় ত্রিশ বছর পর খান পরিবারে একজনের আগমন ঘটবে। যিনি খান পরিবারের একান্তই আপনজন!
(চলবে)