একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-০৭

0
16

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ৭
#আদওয়া_ইবশার

পার্টি অফিসে নিজের জন্য বরাদ্ধ আসনটায় ঝিম ধরে বসে আছে রক্তিম। চোখ দুটো বন্ধ, কপালদ্বয়ে চিন্তার বলিরেখা সুস্পষ্ট। মুখের আদলে গম্ভীর্যতা যেন আগের থেকেও আঁটসাঁট হয়ে গেড়ে বসেছে। দুদিন যাবৎ দলের ছেলে গুলো প্রাণপ্রিয় নেতার এই বেহাল দশা দেখে সরল মনে যতবার কারণ জানতে চেয়েছে, তববার রক্তিমের ভয়ংকর মেজাজের স্বীকার হয়েছে। অল্পক্ষণ আগেও জাবির জানতে চেয়েছিলো,

” কী হয়েছে ভাই? মুখটা এমন গম্ভীর করে রেখেছেন কেন? কোনো শা’লা’র পুত আবার ঝামেলা করছে না কী? শুধু একবার বলুন, ঐ বাই**রে কেমনে সাইজ করতে হয় তা আমি দেখে নিব। তবুও আপনি এমন মন খারাপ করে থাকবেন না ভাই। আপনার কালা মুখ দেখলে দিলে চোট লাগে।”

রক্তিমের পুরোনো সঙ্গী জাবির। একসময়ের অতি প্রিয় দুটো মানুষের থেকে তীব্র আঘাত পেয়ে খু’নে’র মতো এক দন্ডনীয় অপরাধের দায়ে সে যখন স্বপ্নের পেশা, পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছুত হয়ে বেছে নিয়েছিল একাকী, ছন্নছাড়া,বেপরোয়া জীবন। বিধ্বংসী ঝড়ের কবলে পরে মেজর রক্তিম শিকদার থেকে হয়ে গিয়েছিল খু’নি, গু’ন্ডা রক্তিম শিকদার।গোটা সাভারবাসীর কাছে রক্তিম শিকদার মানেই ছিল এক আতঙ্ক। সামনে মানুষজন ভয়ে তাকে সমিহ করে চললেও আড়ালে তাকাতো ঘৃণ্য দৃষ্টিতে। জন্মদাত্রী মায়ের চোখেও ছিল তার জন্য অসীম ঘৃণা। সেই সময়টাতে কোনো রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্বেও জাবির, শান্ত, রাকিব কী যেন এক অমোঘ টানে সঙ্গ দিয়েছিল তাকে। সবার চোখে অসীম ঘৃণার পাত্র হয়েও এই ছেলে গুলোর চোখে ছিল সে বড়ো ভাইয়ের সমতুল্য। বন্ধুত্বের প্রকৃত সংজ্ঞাটাকে যথার্থ মূল্য দিয়ে মেহেদী নামক আরও একজন ছিল রক্তিমের দুঃসময়ের সঙ্গী। যারা আজও রক্তিমের কাছ ছাড়েনি। দুঃখের সঙ্গী হবার পর পূণরায় রক্তিমের সুখের সঙ্গীও হতে পেরেছে এই চারজন মানুষ। সেই সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবার অদম্য সাহস থেকেই জাবির পার্টির অন্য ছেলে গুলোর কাঁচুমাচু মুখ দেখে একটু ভাব নিয়ে জানতে চেয়েছিল রক্তিমের এই দশার মূল কারণ। ভেবেছিল অন্যদের বকে ধমকে চুপ করিয়ে দিলেও পুরোনো সঙ্গী হিসেবে তাকে একটু সম্মান দিয়ে ঘটনার বিস্তারিত বলবে। এই সুযোগে সেও পার্টির বিচ্ছু ছেলে গুলোর চোখে নিজের সম্মানটা আরও একটু বাড়াতে পারবে। কিন্তু জাঁদরেল, পাষাণ্ড রক্তিম শিকদার এসবের কিছুই না করে উল্টো দেখিয়ে দিয়েছে তার ঘাড়ের বাঁকা রগটার কেরামতি।বজ্রাঘাতের ন্যায় হুঙ্কার ছুড়ে পুরো ভবন কাঁপিয়ে বালির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে জাবিরের অবশিষ্ট সম্মানটুকু। সেই থেকেই পিনপতন নিরবতার সাথে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকে। কেউ আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলার দুঃসাহস দেখাচ্ছেনা। এক সময় রক্তিম নিজেই ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চট করে ভারী পল্লবদ্বয় আলগা করে। জাবিরর দিকে দৃষ্টিপাত করে ধীর সুরে জানতে চায়,

“মেহেদী কোথায়?”

তৎক্ষণাৎ জাবির অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে ওঠে নব উদ্যমে সাহস সঞ্চার করে ঝটপট জবাব দেয়,

” শান্ত, মেহেদী ভাই দুজনেই অফিসে আছে। আর রাকিব শালায় আমুদে আছে। শশুর বাড়ি গেছে শালির বিয়ে খাইতে।”

আগ বাড়িয়ে জাবিরের এতো সব বলাতে যথেষ্ট বিরক্ত হয় রক্তিম। পূণরায় চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।রক্তিম, মেহেদী, রাকিব, শান্ত, জাবির পাঁচজনের প্রচেষ্টায় সাত বছর আগের গড়ে তোলা ডিলারশীপের বিজনেসটা আজ দাঁড়িয়েছে শহরের নামকরা এক গার্মেন্টস ফেক্টরিতে। ব্যবসার উদ্যোগটা প্রথমে রক্তিম নিলেও এর সাফল্যের পিছনে কৃতিত্ব মেহেদী, রাকিব,জাবির আর শান্তর। নিজেকে রাজনীতি নামক নোংরা খেলাই জড়িয়ে রক্তিম পারেনি একসাথে দুটো দিক সামলাতে। বিজনেসে দেওয়ার মাঝে শুধু দিতে পেরেছে ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট, আর টুকটাক প্ল্যান প্রোগ্রাম। বাকী যেটুকু অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে ঐ চারজনের নিরলস শ্রমের কারণেই। কিছু একটা ভেবে পূণরায় চোখ মেলে তাকায় রক্তিম। থমথমে মুখভঙ্গিতে এক এক করে সব গুলো ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে গমগমে স্বরে বলে,

“খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাজ নেই কোনো? না থাকলে বাড়ি যা। তবুও বিদায় হো আমার চোখের সামনে থেকে। অসহ্য লাগছে তোদের দেখতে।”

ছেলে গুলোর অনেক আগেই বোঝা হয়ে গেছে, কিছু একটা কারণে তাদের নেতার মেজাজ তুঙ্গে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই তুঙ্গে উঠা মেজাজটাই যেকোন সময় ঘুমিয়ে থাকা সিংহটাকে জাগিয়ে তুলতে পারে। ফলস্বরূপ বিনা নোটিশে যে কোনো সময় তাদের নাদুসনুদুস গাল গুলোতে পাঁচ আঙুলের ছাপটাও সুস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। ঘুমন্ত সিংহকে খুচিয়ে জাগিয়ে তোলার থেকে আগেভাগে তার গোহা ত্যাগ করাই অতি উত্তম ভেবে একে একে কেটে পরে প্রত্যেকে। সম্পূর্ণ রুম খালি হতেই রক্তিম প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে টেবিলের উপর অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা হাতে তোলে নেয়। কয়েক মুহুর্ত ভেবে সিদ্ধান্ত স্থির করে ডায়াল করে মেহেদীর নাম্বারে। দুবার রিং হতেই ঐপাশ থেকে মেহেদী কলটা রিসিভ করে রক্তিমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠে,

“আসছি রে ভাই আসছি,একটু সবুর কর।”

ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার মিনিট পাঁচেক পরই হন্তদন্ত হয়ে মেহেদী এসে হাজির হয় রক্তিমের সামনে। হাপাতে হাপাতে বসে পরে চেয়ার টেনে। রক্তিমের সামনে থাকা সচ্ছ পানির গ্লাসটা ত্রস্ত হাতে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শেষ করে খালি গ্লাসটা ঠিক জায়গায় রাখতে রাখতে জানতে চায়,

“ঘটনা কী বলতো?নিচে দেখে আসলাম পার্টির সব ছেলেপেলেরা গোল মিটিংয়ে বসেছে। কী নিয়ে ডিসকাশন হচ্ছে জানতে চাইলে বলল, তোর উপর না কী কোন প্রেতাত্মা ভর করেছে! কাহিনী কতটুকু সত্যি বলতো?”

“বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে হয় কিভাবে? আইডিয়া জানা থাকলে বল।”

প্রশ্নের বিপরীতে এমন উদ্ভট এক প্রশ্নের জন্য মেহেদী মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। ভূত দেখার মতো বড়ো বড়ো চোখ করে কতক্ষণ রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা খুক খুক করে কেশে ওঠে মেহেদী। কিছু পল সময় নিয়ে নিজের অযাচিত কাশিটাকে সংবরণ করে উৎসুক হয়ে জানতে চায়,

“হঠ্যাৎ এই প্রশ্ন?”

এতোক্ষনের বহু কষ্টে দমিয়ে রাখা রক্তিমের মেজাজটা তড়িৎ লাগামছাড়া পাগলা ঘোড়ার মতোই টগবগিয়ে ওঠে। বলশালী হাতে টেবিলে এক থাপ্পড় দিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে বলে ওঠে,

“দুদিন যাবৎ নাটক শুরু হয়েছে আমার ঘরে। ঠিক নাটকও বলা যায়না। যাকে বলে পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি, একদম সেটাই হচ্ছে। ছেলের সামনে উগ্র মেজাজ দেখিয়েছে বলে একটু ধমক দিয়েছিলাম। ব্যস, কাহিনী শুরু। সামনে আসেনা, হাজারবার ডাকলেও যেন কানে শুনেনা এমন একটা ভাব ধরে বসে থাকে। দুদিনেই অতিষ্ঠ হয়ে গেছি আমি। সহ্য হচ্ছেনা আর। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মাথায় তুলে আছাড় মারি।”

“মাথায় তুলে আছাড় মারার ইচ্ছে নিয়ে তুই আমার কাছে রাগ ভাঙ্গানোর ট্রিক্স চাইছিস?”

রক্তিমের তিরিক্ষি মেজাজের কথায় মেহেদীর চোয়ালদ্বয় যেন ঝুলে পরেছে, এমন একটা ভাব করে জুলজুল চোখে তাকিয়ে মুখের উপর প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়। হাঁসফাঁস চিত্তে রক্তিম দুহাতের মুঠোয় মাথার চুল আকরে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে পূণরায় এক প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে। হতাশ চিত্তে বলে,

“বাইরে সারাদিন অশান্তির মাঝে থেকে ঘরে গিয়ে এসব কাহিনী দেখতে ভালো লাগেনা। কিছু একটা সলোশন দিতে পারলে দে, না হয় তুইও বিদায় হো চোখের সামনে থেকে।”

“আচ্ছা, মেজাজ শান্ত কর। বলছি শোন।”

একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে মেহেদী জিভের ডগায় শুকনো খসখসে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নেয়। বলে ওঠে,

“বউ সামলানোর দারুণ একটা মন্ত্র আছে। সেটা যদি তুই প্রয়োগ করতে পারিস, তবে আমি হান্ড্রেট পার্সেন্ট শিওর তোর সহজ-সরল ঘরওয়ালির রাগ গলে পানি হতে বেশি সময় লাগবেনা।”

এটুকু বলেই থেমে যায় মেহেদী। রক্তিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, মেজাজি বন্ধুর মেজাজের পারদ বাড়ছে না কী কমছে। কিন্তু ধৈর্য্যহারা রক্তিমের মেহেদীর কথার মাঝে চুপ হয়ে যাওয়াটা খুব একটা পছন্দ হলোনা। বিরক্তিতে মসৃণ কপালদ্বয় কুঞ্চন করে চাপা স্বরে ধমকে ওঠে,

“পুরো কথা শেষ কর শালা। অর্ধেক বের করিস আর অর্ধেক গলার ভিতর ঢুকিয়ে রাখিস, কী ধরনের স্বভাব এটা?”

“কী সব আবোলতাবোল বকছিস? আমি তোর শালা না, বরং তুই আমার সম্মন্ধি।বউয়ের চিন্তায় তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। অবশ্য এটা ভালো লক্ষণ। বুড়ো বয়সে তোর মাঝে সুপুরুষের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।”

সম্মুখে রক্তিমের অগ্নি দৃষ্টি দেখতে পেয়ে আর কিছু বলার সাহস পায়না মেহেদী। বোকা বোকা হেসে মূল প্রসঙ্গে গিয়ে ফের বলে,

“ভালোবেসে, আদর করে শুধু একবার কাছে ডেকে নিস। প্রথমে হয়তো অভিমানে আসতে চাইবেনা। জোর করে দুই-একটা চুমুটুমু খেয়ে নিস, দেখবি একদম বরফ গলে প্রেমময় নদী হয়ে যাবে। বউরা হয় স্বামী সোহাগী। স্বামীর একটু আদুরে ছোঁয়া পেলেই এরা দিন-দুনিয়া ভুলে বসে। কতবার এই ট্রিক্স ব্যবহার করে আমি তোর বোনের রাগ ভাঙিয়েছি।”

শেষ কথাটুকু বলার পরই যেন টুং করে মেহেদীর মস্তিষ্ক সংকেত পাঠায়, ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। বিদ্রুপাত্বক হেসে স্বীয় সত্তা বলে, “কী রে ভাই! ঘিলুটা কি বউয়ের আঁচলের নিচে রেখে এসে তার বড়ো ভাইয়ের কাছে বোনের রাগ ভাঙানোর গল্প জুড়েছিস?” সচকিত হয়ে তৎক্ষণাৎ দুহাতে মুখ চেপে ধরে মেহেদী। অথচ কেলেঙ্কারি যা হবার হয়ে গেছে আগেই। মেহেদী যে হুট করে এমন একটা প্রসঙ্গে চলে যাবে রক্তিম নিজেও হয়তো ভাবেনি। কথাটা শোনা মাত্রই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কেশে কটমটিয়ে তাকায়। পূণরায় মেহেদী বোকা হেসে বলে,

“হে হে, স্লিপ অফ টাং।”

****
রোদ্রিককে খাওয়াচ্ছে দৃষ্টি। সে খাচ্ছে কম, দুষ্টুমি করছে বেশি। দাঁতে দাঁত চেপে দৃষ্টি ছেলের সমস্ত দুষ্টুমি হজম করে ঠুসে ঠুসে তার গালে খাবার দিচ্ছে। মুখের খাবার না চিবিয়ে রোদ্রিক সেটা গালের একপাশে জড়ো করে পিটপিট নজরে মায়ের ঘাপটি মারা রূপ দেখছে। বাচ্চা ছেলেটারও হয়তো ভালো লাগছেনা মায়ের এমন চুপচাপ স্বভাব। দুষ্টুমি করে মায়ের বকুনি খাওয়াটা তো তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। দৃষ্টির থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সে আরও বাড়িয়ে দেয় দুষ্টুমির মাত্রা।গালের খাবারটুকু থু থু করে ফ্লোরে ফেলে আড়চোখে তাকায় মায়ের দিকে। বোঝার চেষ্টা করে এবারও মাম্মা চুপ থাকবে না কি তাকে বকবে। ছেলেকে সম্পূর্ণ হতাশ করে দৃষ্টি রোবটের মতো পূণরায় তার মুখে খাবার গুজে দেয়। তৎক্ষণাৎ রোদ্রিকের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। ঠোঁট ফুলিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত রেখে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে ওঠে,

” এখানে ব্যথা পাচ্ছি মাম্মা। কথা বলো না কেন?”

তড়িৎ দৃষ্টি এটো হাতেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয়। অসংখ্য আদরে ভরিয়ে দেয় তার ছোট্ট আদুরে মুখটা। উপরে দাঁড়িয়ে মা-ছেলের কাহিনী পুরোটাই লক্ষ্য করে রক্তিম। ঠোঁট গোল করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে পিছন ঘুরে রুমে যেতে যেতে জোর গলায় ডেকে ওঠে দৃষ্টিকে,

“রোদ্রিকের খাওয়া হলে এক কাপ কফি দিয়ে যেও।”

চলবে….