#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_১২
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
হেমন্তের শেষ সময়। পোষের শুরুর লগ্ন। আবহাওয়ায় শীতল শীতল ভাব বিরাজমান। ভোর রাতে হালকা-পাতলা শীত পরে। শীতের শুরুটা বহুকাল পর গ্রামের বাড়ি কাটাতে পারবে বলে উদগ্রীব সকলেই। বিশেষ করে সাবেরী খাতুন আর হাসনাত সাহেব। দুজনের বাড়ি পাশাপাশি গ্রামেই।
এক সুযোগেই বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি দুটোরই আমোদ উপভোগ করা যায়।
যদিও হাসনাত সাহেবের বছরে দু-একবার যাওয়া পরেই ব্যাবসায়ীক কারণে, এমনিতেও যাওয়া হয়।
সুতরাং বলা বাহুল্য সবচাইতে বেশি উচ্ছ্বসিত সাবেরী খাতুন। তার উচ্ছ্বাস বাচ্চাদের মতো চোখেমুখে ফুটে উঠছে। খানিক বাদে বাদেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। শাফিনকে ডেকে বাড়ির নানান বিষয়ের আদ্যোপান্ত জানতে চাচ্ছে। শাফিন এক গাল হেসে বলে, “ফুপু তুমি এমন অধৈর্য হয়ে গেলা কবে থেইকা। একটু ধৈর্য ধরো প্রাণের ফুপুজান।” বলেই জড়িয়ে ধরে। সাবেরী খাতুনও আগলে নেন। তার এই ভাইপোকে সে সবচাইতে বেশি ভালোবাসে। মুনমুনের সাথে এত দা-কুমড়া সম্পর্ক তারপরও তিনি বরবরই শাফিনের দোষ এড়িয়ে গিয়েছেন। বরং মুনমুনকেই বকাঝকা করতো। শাফিনের প্রতি মুনমুনের বিতৃষ্ণার এও এক কারণ।
বিয়ের পর পরিবারের সকলে মিলে একত্রে কোথাও ঘুরতে যাবে ভেবে পুষ্পিও আনন্দিত। শাহরিয়ারের ব্যস্ততার কারণেই মূলত এখনো তেমন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। এবার শুধু শাহরিয়ারের সাথেই নয় বরং পরিবারের সকলের সাথেই একটা আমোদপ্রমোদ যুক্ত ভ্রমণ হবে ভেবেই আনন্দিত সে।
শাহরিয়ারের নিমরাজি মনোভাব। কলেজ থেকে এতদিনের ছুটি নিয়ে কিঞ্চিৎ অনিচ্ছুক সে। তবে একেবারে যে অনাগ্রহী তা নয়। বরং মনে মনে একটু ভালো লাগাও কাজ করছে পুষ্পির সাথে প্রথম দেশের বাড়ির সফর হবে ভেবে। মেয়েটাকে যে সে বিশেষভাবে কোথাও নিয়ে বের হয়নি, তা ভেবেও কিঞ্চিৎ অনুশোচনায় ভুগল। পুষ্পি মুখচোরা স্বভাবটা তার মনে প্রেমানুরাগ সৃষ্টি করলো।
সে যাই হোক, তবে এই দেশ-যাত্রায় অনাগ্রহের তালিকায় কেবল মুনমুন বিদ্যমান। সে কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। সন্ধ্যার পর বন্ধুদের ভিডিও কল দিয়ে এ নিয়ে একগাদা কাতরোক্তি শোনাল৷
পুষ্পির কাছে এসে দুঃখ বিলাস করে, “ও ভাবী! আমি কিছুতেই যাব না গ্রামে। নয়ত এই ফাজিল আমার মাথা খারাপ করিয়ে দিবে।”
পুষ্পি জিজ্ঞেস করে, “কোন ফাজিল? তুমি কি শাফিনের কথা বলছো?”
মুনমুন ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়াতেই খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে পুষ্পি। জানতে চায়, কেন এত অপছন্দ করে ছেলেটাকে। মুনমুন যেন এই সুযোগই খুঁজছিল। এক ঝাক অভিযোগ নামা খুলে বসলো সে শাফিনের নামে। অনেক অনেক অভিযোগ করার এক পর্যায়ে প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“জানো ভাবি, একবার কি করেছিল?”
পুষ্পি ঠোঁট উল্টাল। যার অর্থ সে জানবে কি করে!
মুনমুন আক্রোশ নিয়ে বলল, “কাঁঠাল কাছে দেখবা কষ শুকিয়ে এক ধরনের আঠার মতো তৈরি হয়। জানো? বেয়াদব ছেলে একবার সেই আঠা আমার চুলে লাগিয়ে দিয়েছিল। আমার কতগুলো চুল নষ্ট হয়েছিল সেবার। আরেকবার কি করেছে জানো? আরেকবার তো আমাকে গাছে উঠিয়ে নিজে নিচে গিয়েছে আমাকে ওখানে রেখেই। কত ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। শেষবার তো ঝগড়া করতে করতে পুকুরেই ফেলে দিয়েছিল! কেমন ডাকাত ভাবো! মামা না থাকলে সেদিন যে আমার কি হতো! তোমার এই সুন্দরী ননদিনীকে আর পেতা না ভাবী!”
মুনমুনের কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎই দরজার আড়াল হতে খিলখিল হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। পুষ্পি আর মুনমুন দরজায় তাকিয়ে দেখে শাফিন দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্পি নিজেও মৃদুমন্দ হাসে। পুষ্পি সৌজন্যতা দেখিয়ে বলে, “ভেতরে আসো শাফিন।”
মুনমুন প্রতিবাদ করে বলে, “খবরদার ভেতরে আসবা না। চুরি করে মানুষের কথা শোনে! ম্যানারলেস।”
শাফিন আগেও বাধ্য ছেলে ছিল না, এখনও নেই। কারো কোনো খোঁচাদায়ক কথা কিংবা অপমান তার গায়েই লাগে না, যতক্ষণ না সে চায়। মুনমুনের নিষেধ অমান্য করে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “যেখানে ভাবি এমন আদর করে ভেতরে ঢুকতে বলছে, সেইখানে তোর মতো ডাবল মুনের কথা শুনমু কোন দুঃখে? অতটাও দূর্দিন আসে নাই যে, তোর মতো শাকচুন্নির কথা শুনা লাগবে।”
মুনমুন রাগে জিদে আগুন হয়ে যায়। ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, “মেরে ফেলবো তোমাকে একদিন আমি।”
শাফিন হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে, “মার্ডার কেসের আসামি হওয়ার শখ জাগছে নাকিরে তোর? নাকি অতিতে খুনখারাবি করছিস দুই-একটা? এত কনফিডেন্স!”
পুষ্পি অবস্থার বেগতিক বুঝতে পেরে বলে, “তোমাদের ঝগড়াঝাটিকে এখানেই স্থগিত করা হলো। এবার থেমে যাও।”
মুনমুন মুখ বাঁকাল, শাফিন হাসল। এই হাসির মানে হাসি না, নিশ্চিত কুবুদ্ধি ম। প্রথমে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল তারপর মুনমুনের মাথায় একটা চাটি মেরে রুম থেকে গায়েব হয়ে গেল।
মুনমুন বলল, “দেখলা ভাবি? কেমন অসভ্য! এই কারণেই দেখতে পারি না। বেয়াদব একটা।”
ছেলেটা একটু এমনই, ছন্নছাড়া স্বভাবের। এই এতকাল পর দেখা হওয়া স্বত্বেও ভদ্রতা বজায় রাখার চাইতেও মুনমুনকে ক্ষেপিয়ে যেন সে বেশি আনন্দ পাচ্ছে। একটু ছন্নছাড়া-বাঁধনহারা স্বভাবের হলেও মুনমুনের অভিযোগ সমান অপ্রিয়যোগ্য নয় মোটেও।
আগে বাড়িটা যতটা না হুই-হুল্লোড়ে হৈ হৈ করে থাকত, এখন যেন তা দ্বিগুণ বাড়াল শাফিন। হাস্যজ্বল প্রানবন্ত তরুণগুলো এমনই। যেখানে যায়, মাতিয়ে রাখে। প্রফুল্লতার আস্তানা যেন পুরো মন জুড়ে থাকে তাদের।
.
তবে সন্ধ্যায় ঘটল আরেক কান্ড। পুষ্পি এমনিতে কর্মপটু, বিচক্ষণ, গুণী, সুন্দর স্বভাব চরিত্র ও সুন্দর বাচনভঙ্গির অধিকারী হলেও মোটেও ধীর-স্থির স্বভাবের নয়। সব কিছু নিয়ে যেন খানিক তাড়াহুড়ো স্বভাব। কেমন যেন একটু অস্থির অস্থির ভাব! এ বিষয়টিও শাহরিয়ারের চোখ এড়িয়ে যায়নি। একদিন তাড়াহুড়োয় রুমে ঢোকার সময় শাড়ির পাড়ে পা পেঁচিয়ে পরে যেতে লাগে মেয়েটা। শাহরিয়ার কাছে থাকায় ধরে ফেলে। সে বিচলিত হয়ে সতর্ক করে বলে,
“একটু আস্তেধীরে হাঁটলে নাহয় রুমে এক মিনিট পরেই প্রবেশ করবে। ক্ষতি তো হবে না বিশেষ, না? এত তাড়া কিসের, হুম?”
পুষ্পি ইতস্তত করে বলে, “এই স্বভাব পরিবর্তন করতে পারি না। নানুও বলত আগে, আপনিও বলছেন এখন।”
শাহরিয়ার তখন হেসে ফেলে। বলে, “চেষ্টা করো ঠিক হয়ে যাবে৷ তুমি চাইলেই সব পারবে, ইনশাআল্লাহ।”
এরপরেও আরো কয়েকবার শাহরিয়ারের চোখে পড়েছে পুষ্পির এই স্বভাবটির ফলে ঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সে প্রত্যেকবারই পুষ্পিকে সতর্ক করেছে। “পুষ্প, ধীরে ধীরে যেকোনো কাজ করো। অস্থির হইয়ো না। একটা অস্থির বউ আমার একটা!”
কিন্তু মনুষ্য স্বভাব কি এত দ্রুত পরিবর্তন করা যায়? যায় না। আর যায় না বলেই, শাস্তি স্বরূপ পুষ্পির আজকের এই পরিণতি। তাড়াহুড়োয় সিড়ি দিয়ে নামার সময় তিন-চারটা সিড়ির টপকে পরে যায় নিচে। খুব আঘাত পেয়েছে মেয়েটা। তবে আশার কথা এই যে, পা মচকানো আর মাথায় সামান্য ব্যাথা পাওয়া ছাড়া বড়ো ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে শুরুতে সকলে সাংঘাতিক দুশ্চিন্তায় পরে যায়। প্রথমে ভেবেছিল পা বোধহয় ভেঙেই গিয়েছে। দ্রুত হসপিটাল নিয়ে যায়। প্রশান্তি কথা, তেমন কিচ্ছুটি হয়নি।
শারীরিক ভাবে কোনোভাবে পার পেয়ে গেলেও পার পায়নি শাহরিয়ারের সুপ্ত মেজাজ থেকে। দ্বিতীয় বারের মতো শাহরিয়ারের রাগের কবলে পড়ল মেয়েটা। একে-তো পেয়েছে ব্যথা, তার উপর প্রিয় মানুষের এমন কড়া শাসন!
হসপিটাল থেকে ফিরেই শাহরিয়ার পুষ্পিকে নিয়ে রুমে চলে এলো। হসপিটাল থাকাকালীনও যাবতীয় কথা পরিবারের বাকি সদস্য ও ডাক্তারের সাথেই বলেছে। পুষ্পিকে শুধু গিয়ে একবার জিজ্ঞেস করেছে, “বেশি ব্যথা লাগছে? দেখি, পাটা!” ব্যাস, এতটুকুই।
এমন কি হসপিটাল থেকে ফেরার সময়ও সারা পথ কোনো বাক্যবিনিময় করেনি।
যদিও পুষ্পি বারবার ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল, কিন্তু তাকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছিল না। এখন বাসায় এসে আবার ডিরেক্ট রুমে নিয়ে এসেছে। পুষ্পি এবার কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পারল, রেগে আছে যে।
শাহরিয়ার কপাল কুঁচকে পুষ্পির দিকে চেয়ে রইল। পুষ্পি একবার তাকাচ্ছে আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ যাবত এমন চলার ফলে পুষ্পিও বিরক্ত হয়ে গেল। জানতে চাইল,
“এমন করে চেয়ে আছেন কেন? কী করেছি আমি?”
শাহরিয়ার যেন ওর এই প্রশ্নেরই অপেক্ষা করছিল। কঠিন শাসনের স্বরে বলল, “কিছু করনি? পুষ্প, তোমায় আমি একশ দিন সতর্ক করেছি, হাজারবার বলেছি, সাবধানে চলাফেরা কর। ধীরস্থির হয়ে হাঁট, অস্থির হয়ে কিছু করো না৷ একটা বিপদ বাঁধাবে। কিন্তু আমার কথাতে তো তুমি কর্ণপাত-ই কর না। কিংবা গুরুত্বই দাও না। আমার কথা কি তোমার কাছে আবর্জনা লাগে?”
পুষ্পি হতবিহ্বল, হতবাক! ও ভাবতেই পারেনি উল্টো ওকে এভাবে এত কথা শুনাবে, যেখানে ওর ইচ্ছাকৃত কোনো দোষ-ই নেই। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“এভাবে বলছেন কেন?”
“তো কিভাবে বলবো আর তোমাকে? খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলবো? সত্য কথা শুনতে ভালো লাগছে না?” কন্ঠে নিরব ধমক শাহরিয়ারের।
পুষ্পি স্বভাবসুলভ শান্তভাবেই বলে, “আপনি আমাকে বকা দিচ্ছেন কেন? আমি কি ইচ্ছে করে পরে গিয়েছি?”
শাহরিয়ার এবার আরো কড়া কন্ঠে বলে,”পুষ্প, একদম চুপ করে থাকবা, আর একটি কথাও বলবা না।”
পুষ্পি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তার যেন আর সত্যিই বলার কিছু নেই। এ কেমন মানুষ! এ কেমন প্রতিক্রিয়া তার! এমন আশাতীত প্রতিক্রিয়ায় বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় মেয়েটি! এমনটা একদমই প্রত্যাশা করেনি সে। হঠাৎ-ই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল মন। অশ্রুসিক্ত হলো চোখ। আর এক মূহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না মানুষটার সামনে।
ব্যথা পা নিয়ে দাঁড়াতে গেলে ধরে ফেলে শাহরিয়ার। শাসনের সহিত বলে, “পুষ্পি, একটা মাইর দিব এবার তোমাকে। আবার দাঁড়াচ্ছ কেন? একটা কথাও শোনো না আমার। চুপচাপ বসে থাকো।”
পুষ্পি অভিমানী কন্ঠে বলে, “ছাড়ুন আমায়। একশবার কথা বলবো, ব্যথা পা নিয়ে হাঁটবো। যা খুশি করবো। আপনি আমায় বকবেন না। কেন বকছেন আমায়! ছাড়ুন বলছি।”
শাহরিয়ার তো ছাড়েই না বরং আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকে। তার রাগ ঠান্ডা হয়ে গেছে। কি আশ্চর্য! এত দ্রুতও রাগ নেমে যেতে পারে! মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “আমি কে মানে? আমিই তো সব তোমার, বোকা মেয়ে! কাঁদছ? কাঁদছ কেন? আমি বকবো, আমি শাসন করবো, আবার আমি ভালোবাসবো। কিন্তু কাঁদবে না কখনো। কেঁদে মন গলানোর ধান্ধা? হুম? পাগলী একটা।”
সামান্য প্রশ্রয় পেয়ে পুষ্পির নিরব কান্না বাড়ে বৈ কমে না। আজকাল এত রাগ দেখায় মানুষটা! পুষ্পি নিজেকে আপ্রাণ ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, “আপনার কথা আমি শুনব না।”
শাহরিয়ারের মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। বলে, “শুনবে। শুনতে তুমি বাধ্য।”
একটু থামে। তারপর পুনরায় বলে, “বেশি দুঃখ লাগছে? লাগুক দুঃখ। আমার যে দুশ্চিন্তা হয়েছিল, সে বেলায়? আমার সতর্কতা মানো না কেন? এই বোকা মেয়ে? এই বোকা? সাড়া দাও। ভালোবাসা গ্রহণ করতে পার, শাসনটা পার না কেন?”
(চলবে)….