একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-১৮

0
12

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_১৮
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

প্রচন্ড আমোদের সহিত মধ্যদুপুর ঘুরে আমোদিত দুটো প্রাণ বাড়ির পথে পা বাড়াল। বিশাল সেই বিল ফেলে আসতে পেরোতে হয় অনেকগুলো বাড়ির আঙিনা। গ্রাম্য মানুষ নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত তখন। রান্নাবান্না-ঝাড়পোক করে কেউ, কেউ বা ব্যস্ত অন্যান্য কাজে। এমনই এক নির্জন বাড়ির সম্মুখে এসে শাহরিয়ারের মাথা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়। শার্টের হাতা গুটিয়ে পুষ্পিকে ফিসফিসিয়ে বলে, “ওহে আমার নিরীহ বউ? চলো তোমায় একটা এডভেঞ্চার ফিল দেই।”
শাহরিয়ারের ফিসফিসানি অনুকরণ করে পুষ্পিও ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মানে? পাহাড়-সমুদ্র ছাড়া কিসের এডভেঞ্চার?”
শাহরিয়ার মুখে কিছু না বলে হাতের ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বলে। পুষ্পি নিরুপায় হয়ে তাই করে। শুনশান পরিবেশ। দোচালা টিনের ঘর। ঘরের সাথে লাগোয়া একটা বিশাল বড়ো বরই গাছ। পরিচ্ছন্ন উঠান। খানিক দূরে দেখা যায় গরুশূন্য গোয়ালঘর। পুষ্পি যতক্ষণে আশপাশ ঘুরেঘুরে দেখছিল, শাহরিয়ার ততক্ষণে কিছু শক্ত মাটির দলা সংগ্রহ করে। পুষ্পির চোখে চোখ পড়তেই দন্ত বিকশিত হাসে। তারপর একটা দুষ্টু চোখ মেরেই পরপর বেশ কয়েকবার বরই গাছটাতে ঢিল ছুঁড়তে থাকে। পুষ্পি এই দুঃসাহসীক কাজের কথা কল্পনাতেও আনেনি৷ সে শাহরিয়ারকে দমনের চেষ্টা করে বলে, “এই! আল্লাহ! কি করছে? পিটাবে আপনাকে। প্লিজ থামুন।”
শাহরিয়ারের হাসি দেখে কে! সে অফুরন্ত ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলে, “এই পাগলি! দ্রুত বরই টোকাও। জলদি…”
পুষ্পি উপায়ান্তর না পেয়ে শাহরিয়ারের নির্দেশ মান্য করে৷ বরই টোকায় আর ভয়ে তটস্থ হয়ে আশেপাশে চায়। এমন ঘটনা মেয়েটার জন্য বড়োই আশ্চর্যের! নানু তাকে মোমের পুতুলের মতো করে পেলেছে। বাড়ি থেকে স্কুল, স্কুল থেকে বাড়ি, লাইব্রেরী আর প্রাইভেট, বড়োজোর নানুর সাথে খালার বাসায় যাওয়া আর বাজারে যাওয়া; এটুকুই ছিল সীমাবদ্ধতা। সে এই খুচরো আনন্দ উপলব্ধি করার উপলক্ষ্যই পায়নি কখনো। জীবনে এত হাসি, এত আনন্দ, মান-অভিমান আর চাওয়া-পাওয়ার গন্ডি বৃহৎ আকার ধারণ করবে, তাও যেন ছিল ধারণাতীত। বিয়ের দিন খালার বলা সেই কথাটা তার মনে পড়ে, জীবনের অপ্রাপ্তি সব প্রাপ্তিতে রূপ নিবে তোর পুষ্পি। নিজ বাড়িতে যেই সুখগুলো ছিল তোর নাগালের বাহিরে, সেই অমৃত সুখ গড়াগড়ি খাবে তোর কোলে এসে। তুই হবি অন্যতম সুখী মেয়ে!
খালার সেই কথাগুলো ক্রমশ বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে কি তার জীবনে? পরিবর্তনের এই চিত্রকর্মে রূপরেখা অঙ্কনের চিত্রকার হিসেবে সৃষ্টিকর্তা কী তার স্বামীকে পেরন করেছে?
পুষ্পি নিজেনিজেই জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই!’

শাহরিয়ার শেষে যেই ঢিলটা মারে সেটা গিয়ে পরে টিনে। এমন বিকট আওয়াজ হলো যে, পুষ্পির মনে হলো আশেপাশের সব লোক বুঝি এক্ষুনি চলে আসবে। সে বরই গুলো খিট করে হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
আর কিছু করার ফুরসত পায় না এই দস্যি কপোত-কপোতী। ভেতর থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে এক বৃদ্ধা বেড়িয়ে আসে, “কেরে? কেরে ওইহানে! কোন বেদ্দপ ছাওয়াল আমার ঘরের চালে ঢিল মারতাছিস। খাঁড়া কইলাম! ওইহানেই খাৃড়া! আইজ তোর একদিন কি, আমার একদিন।”
বলতে বলতে সে লাঠি হাতে বেড়িয়ে আসে।

বৃদ্ধার পরনে কলাপাতা রঙের মলিন কাপড়। কুচিবিহিন আটপৌড়ে কাপড়। আঁচলটা ঘুরিয়ে পুনরায় কাঁধে ফেলে রাখা। লক্ষ্য করলে হয়তো দেখা যাবে আঁচলে একটা গিট দেয়া। সেই গিটে মুড়িয়ে রাখা দুটো পঞ্চাশ কিংবা একশ টাকার নোট! রুক্ষ শুভ্র চুল। কুঁচকে যাওয়া ত্বক! অযত্নে ছোপছোপ দাগ মুখে, হাতে, পায়ে কিংবা সমস্ত শরীরেই। শুষ্ক ঠোঁট আর কথার আদলেই বুঝা যায়, সামনের দাঁতগুলো হয়তো ক্ষয়ে গিয়েছে, পড়ে গিয়েছে। কিন্তু চেহার আদলে এখনও লাবণ্য বিরাজমান। যৌবনের সৌন্দর্য অনুমান করা যায়। শত পুরুষ কাবু হয়ে অন্তরিন্দ্রিয় অঙ্কন করেছে, প্রনয়ণ কাব্য, তা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

তবে সকল ভাবনার ইস্তফা ঘটিয়ে পুষ্পি হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভাবে, “হায় আল্লাহ! এই লাঠির বারি তার স্বামীর কপালে জুটবে নাকি?”

কি করবে ভেবে না পেয়ে সে বরইগুলো নিয়ে বৃদ্ধার কাছে গিয়ে বলে, “নানী! এগুলো আমরা আপনার জন্যই পেরেছি, বিশ্বাস করুন। ওকে মারবেন না। এই নিন আপনার বরই। একটাও খাইনি কেউ দেখুন, সত্যি!”

পুষ্পির বোকা কান্ডে শাহরিয়ার উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমার নানীইইইই! কেমন আছো তুমি?”

বৃদ্ধা হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে আগলে নেয় শাহরিয়ারকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”শারিয়ার! নানাভাই! কেমন আছো মনা? কবে আইছো? এই বুড়িরে মনে আছে তোমার? সোনাচাঁন আমার! কত বছর পর আইলা! কতজনরে যে জিগাইছি, কেউ তোমার কতা কইতে পারে না। কোয়ালডা নিচে নামাও, একটা চুমা দেই তোমারে।”

শাহরিয়ার আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলে, “ওঃ! নানী! এত প্রশ্ন একবারে কর ক্যামনে?”

নানী ছলছল নয়নে চেয়ে, শাহরিয়ারের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, “মনা আমার! এই নানীর খবর কি তোমরা কেউ রাহো? নানীর যে তোমগো লাইগা কত পরান পোড়ে হেইয়াও তো জানো না।”

এসব কথা বলতে বলতে আকস্মিকই পুষ্পির কথা খেয়ালে আসে তার। ঝাপসা দৃষ্টিতে পিটপিট করে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। শাহরিয়ার তা আনন্দ নিয়ে লক্ষ্য করে। বুড়ি আকাশ সম বিস্ময় নিয়ে শাহরিয়ারকে প্রশ্ন করে, “সোনাচাঁন? এই পরীডা কি তোমার বউ নিহি? মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ! পরীর লাহান বউ তোমার! বিয়া করলা কবে? এত বড়ো হইয়া গেছে, চাঁন?”
কথাটা বলতে বলতেই সে পুষ্পির চিবুক ছোঁয়। একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকে কেউ কিভাবে এত দরদ দিয়ে কথা কইতে পারে ভেবে আশ্চর্য হয় মেয়েটা। ঠোঁট জুড়ে চিকচিক করে মায়াকাড়া হাসি।
শাহরিয়ার বলে, “তোমার মতো সুন্দরী বউ আমার নানী। দেখো, তোমার মতো দেখতে না? বুড়ি হলে নিশ্চয়ই তোমার মতো হবে, কুটকুট করে হাসবে, দন্তহীন হাসি।” বলে সে নিজেই হাসে। পুষ্পি এই প্রথম লজ্জা পায় না। বরং সেও শাহরিয়ারের সাথে হাসে।
নানী শাহরিয়ারকে উদ্দেশ্য করে পুষ্পিকে বলে, “এ হইতাছে মোর কইলজার টুকরা। হেই ছোড বেলা, হের নানা বাড়িত আইলেই আমার এইহানে চইলা আইতো। হের আপনা নানীর তোন কম ভালা আমারে পাইতো না। আমার এই বরই গাছটা কিন্তু তোমার সোয়ামির-ই লাগানো, বুজ্জ? হেয় লাগাইতের কালেই কইছিল, আমি বড় হইয়া এই গাছের বরই খামু নানী। এহন দেহ, বউ লইয়া আইছে।”
বলেই খিটখিট করে হাসে।
শাহরিয়ার মজাচ্ছলে বলে, “ইশশ! বুড়ির কথা থেইকা মধুর নির্গত হয়। আসো তোমারে আরেকটু জড়ায় ধরি বুড়ি!”
হাসতে হাসতে চোখে অশ্রু চিকচিক করে বৃদ্ধার। যদিও এটা ছিল সুখের অশ্রু। কিন্তু বিদায় কালে সে টলমল হয়ে কেঁদেই ভাসাল বুক। দু’হাতে আদর করে বলল, “আর হয়তো বেশিদিন বাঁচুম না মোর চান্দ। কিন্তু মরার আগে তোরে দেখতে পারছি, এয়াই মোর লাইগা বহুত। তুই মেলা সুখী হও, আমার সব দোয়া তোমার লগে।”
বিদায়ের পর শাহরিয়ার নিশ্চুপ ভাবেই হাঁটতে থাকে। মানুষটা এমনই। যখন তার মন খারাপ হয়, তখন সে চুপ থাকে। তবে আপ্রাণ চেষ্টা করে তার দুঃখ কাউকে স্পর্শ না করুক।

পুষ্পি এখন বুঝতে পারে তাকে। দৃষ্টি আকর্ষণ এর জন্য গলা ঝেড়ে কাশে। শাহরিয়ার ভ্রু কুঁচকে চায়। পুষ্পি সুন্দর হেসে বলে, “মাস্টার মশাই? আপনি এত আদরের কেন সবার, বলুন তো? আমার খুবই হিংসা হচ্ছে!”
মূহুর্তে শাহরিয়ারের মন ভালো হয়ে যায়। মেয়েটা এত বুদ্ধিমতী! সে হাটতে হাটতেই বলে, “ওহে আমার হিংসুটে বধূ? আমার প্রাপ্তি সব আদর আমি আপনার নামে লিখে দিয়েছি সেই কবেই! তাও এই নিরীহ পুরুষের উপর হিংসে?”

শাহরিয়ারের বলার ধরনের পুষ্পি খিলখিলিয়ে হাসে। মুখ বাঁকিয়ে বলে, “আপনি নিরীহ? অতি আশ্চর্যজনক কথা।”
শাহরিয়ার প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, “এই এলাকার প্রতিটা আনাচ-কানাচ আমার স্মৃতিবিজড়িত। কত সুন্দর শৈশব আমার!”

কিছুদূর এগিয়ে শাহরিয়ার আরেকটা বাড়ি দেখাল। বলল, “এটা কার বাড়ি জানো?”

পুষ্পি বলল, “না বললে জানবো কেমন করে?”
শাহরিয়ার খুবই রসিকতার সহিত বলে, “আমার ছোট বেলার ক্রাশ এর বাড়ি৷”
কথাটা শোনা মাত্রই পুষ্পির মুখ বিমূর্ষ হয়ে যায়। সব সইতে পারে, কিন্তু শাহরিয়ার কাউকে পছন্দ করে কিংবা করতো; তা সইতে পারে না।
শাহরিয়ার ইচ্ছে করে ক্ষেপায় মেয়েটাকে। বলে, “কি হলো? এমন কেঁদে দিচ্ছ কেন?”
পুষ্পি ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়। সে বিরক্তি নিয়ে বলে, “আমি কাঁদব কী জন্য? অদ্ভুত! আপনি একজন কেন, একশজনকে পছন্দ করুন। তাতে আমার কি!”
শাহরিয়ার বলে, “ওহ! তোমার কিছু না? তাহলে শোনো, তোমাকে তো তুরিন আপার কথা বলিই নাই। কি যে সুন্দর করে তিনি কথা বলতো! আমি বিমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তারপর যেদিন তার বিয়ে হলো, সেদিন আমার সে কি মন খারাপ! ভেবেছিলাম জিন্দেগীতে বিয়েই করবো না। তারপর মেঘলার কথা তো….”

পুরো কথা শেষ করার আগেই পুষ্পি ধমকের স্বরে বলে ওঠে, “এই? আপনি আমার থেকে দূরত্ব রেখে হাঁটুন! দুশ্চরিত্র পুরুষ মানুষ!”

শাহরিয়ার আর্তনাদ করে বলে ওঠে, “আস্তাগফিরুল্লাহ! এই জগত ঘুরে তুমি আমার মতো পুরুষ পাবা? এত বড়ো অপবাদ তুমি তোমার নিজের স্বামীকে দিতে পারলা পুষ্প? দুশ্চরিত্র! ছিঃ!”

পুষ্পি খুবই কটাক্ষের সুরে বলে, “ওরে আমার সাধুবাবারে! আসুন আপনাকে একটা সালাম করি। এমন সাধু পেয়ে জীবন আমার ধন্য!”

শাহরিয়ার হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, “আই লাভ ইউর জেলাসী। কিন্তু সব সত্যি কথাই বলেছি তোমাকে।”
পুষ্পি পুনরায় ধমকের সুরে বলে,”চুপ থাকুন আপনি। আপনার কাছে সত্য-অসত্যের ডেফিনেশন চেয়েছি আমি? আর একটা কথাও বলবেন না। আমার রাগ হচ্ছে।”

শাহরিয়ার ত্যাড়ামি করে বলে, “কথা তো আমি বলবোই। আসো আসো, কাছে এসে হাঁটো….রাগ করে না, বোকা!”
বলতে বলতে সে নিজেই কাছে গিয়ে একসঙ্গে হাঁটে।
খুব চমৎকার কিছু স্মৃতি আর শেষকালিন কিছু খুনসুটি নিয়ে দুটো স্বচ্ছ প্রাণ বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে। বাড়ির ভেতর থেকে বিকট চিৎকার-চেচামেচি ভেসে আসে। তারমানে পুনরায় গন্ডগোল লেগেছে। শাহরিয়ার শংকা গ্রস্ত হয়ে বলে, “হায় আল্লাহ! এমন চলতে থাকলে আমার আলাভোলা বউ নির্ঘাত ঝগড়াঝাটি শিখে বাড়ি ফিরবে! এখন আমার কি হবে খোদা! রক্ষা করো!”

পুষ্পি শাহরিয়ারের কথা শুনতে পায় না। তার মনোযোগ ছিল বাড়ির চেচামেচির দিকে। পুষ্পি বলে, “ভেতরে আবার এত চিল্লাচিল্লি কিসের?”

শাহরিয়ার অনুনয় করে বলে, “তুমি ওদিকে কান দিও না প্লিজ! চলো আমরা পুনরায় ঘুরতে চলে যাই। এমনিতেই প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া হয়ে গিয়েছ। ঝগড়ুটে হও, চাই না।”
পুষ্পি পাল্টা প্রশ্ন করে, “আমি ঘাড়ত্যাড়া? আপনি আমাকে ঘাড়ত্যাড়া বলেছেন?”
শাহরিয়ার পড়েছে মহা মসিবতে। বাধ্য হয়ে সে তার কথা ফিরিয়ে নিয়ে বলে, “না, মোটেও না। আমার ভুল হয়েছে। আমি ঘাড়ত্যাড়া। আমার সমস্ত শরীর ত্যাড়া-বাকা। তুমি অত্যন্ত ভালো। জগতের সবচেয়ে ভালো মেয়ে।”
পুষ্পি একগাল হেসে বলে, “হ্যাঁ, সঠিক হয়েছে। সত্য বলার জন্য ধন্যবাদ।”

(চলবে)……