এক আকাশ রুদ্ধশ্বাস পর্ব-০১

0
253
এক আকাশ রুদ্ধশ্বাস" পর্ব- ১ (নূর নাফিসা)

“এক আকাশ রুদ্ধশ্বাস”
পর্ব- ১
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যায় বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে ফুপাতো বোনের বাড়িতে। মধ্যরাত কাটাতে হচ্ছে জঙ্গলে। এখনো লুকোছাপার অন্ত নেই। এই মনে হয়, ডান থেকে এসে টেনে নিয়ে গেলো। এ-ই আবার মনে হচ্ছে বাম থেকে টানলো। রাতের ভয় এর আগে কখনো এতোটা ভয়ংকর হয়নি। রাত কখনো এতোটা ভয়ানকভাবে কাঁদায়নি। রাতের সৌন্দর্য কখনো এতো কুৎসিত আচরণ করেনি। অথচ এই রাত আজ বিদীর্ণ যন্ত্রণায় বিষিয়ে তুলেছে দেহদ্বয়। জঙ্গল থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছে নওরিন। বাঁশঝাড়ের পিছু লুকিয়ে পথের দিকে উঁকি দিয়ে দেখছে কখন এই পথ থেকে হিংস্র, অমানুষগুলোর ছায়া দূর হবে৷ কখন সে একটু আশ্রয়স্থল সুনিশ্চিত করবে। এদিকে হাতটা তার ভিজে যাচ্ছে শাবাবের রক্তে। ফুপাতো বোনের বাড়ি থেকে পালানোর সময় কাঁধ থেকে একটু নিচে পিঠে একটা কোপ বসিয়েছে নিমোক হারামির দলের কেউ। কে বসিয়েছে, দেখার সময় হয়নি। প্রাণ নিয়ে ছুটেছে প্রাণের হাত মুঠোয় ধরে। কতটা দেবেছে, তা-ও দেখার সময় ও সুযোগ পাচ্ছে না নওরিন। তবে আন্দাজ করতে পারছে, পিঠে চেপে ধরে রাখা হাতটা তার ভিজে আঠালো হয়ে গেছে। শার্টটাও আগে থেকেই ভেজা হয়ে আছে। আড়ালে আশ্রয় নেওয়া বাঁশঝাড়ের বাঁশের খুটি সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে শাবাব৷ ব্যথার প্রভাব যখন তীব্রভাবে দেহ ঝাঁকিয়ে তোলে, পৃথিবী অসার হয়ে আসে। চোখ খিচে ঠোঁট কামড়ে এই করাঘাত নিয়ন্ত্রণে আনে। নিশ্বাসে যখন একটু কম্পনের শব্দ জাগে, তখনই নওরিনের বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠে। আঁধারের দয়াদাক্ষিণ্য আলোয় অস্পষ্ট মুখটার দিকে আৎকে তাকায়। ব্যথাহত গলায় ফিসফিসে কণ্ঠে জানতে চায়,
“খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?”

ব্যথায় শক্তভাবে জমে যাওয়া শাবাব ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে ছোট শব্দে জবাব দেয়,
“উঁহুঁম।”

এখনো তাই করলো। কিন্তু নওরিন তাকে বিশ্বাস করলো না। সে জানে, অপরিমিত কষ্ট হচ্ছে। শাবাব হাজারবার না বললেও সে বুঝতে পারে, যতটা না কঠিনভাবে এই ‘না’ বললো; তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি যন্ত্রণা সে সয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সচেষ্ট থাকতে ছটফট করতে পারছে না শুধু। নওরিন অশান্ত চোখ দুটো আবার পথে ফেলে। দুর্বৃত্তের দল এখনো পথ দখল করে রেখেছে। দা*, স্টা*ম্প, কা*টারি হাতে তাদেরকে তালাশ করে চলেছে। শাবাব ব্যথায় ছটফট না করলেও নওরিন অশান্তিতে তীব্র ছটফট করছে। এই জায়গাটা তাদের জন্য মোটেও সুবিধার নয়। এ পথ ধরে শতবার আসা যাওয়া চলতে থাকবে। যখন তখন ধরা পড়ে যাওয়ার বিপদ। নওরিন আবারও শাবাবের মুখে তাকায়। ফিসফিস গলায় বলে,
“আমরা এখন কোথায় যাবো?”

শাবাব নিশ্চুপ হয়ে আছে। নওরিনের কান্নার ঢেউ বের হওয়ার জন্য ভেতরে উথাল-পাতাল করতে শুরু করে। সে অনুধাবন করতে পারছে, শাবাব ব্যথার কারণে কথা বলতে পারছে না। হঠাৎ বেড়ে যাওয়া তীব্র ব্যথাটা ধীরে ধীরে তীব্রতা কমিয়ে মৃদুতে নেমে আসে। সেই মৃদুভাবে নেমে আসার অপেক্ষাটাই শাবাব করছে। আরও মিনিটখানেক সময় নিয়েছে ব্যথা নেমে আসতে। চেপে ধরা বাঁশের খুঁটিটা ছেড়ে একটা ধীর নিশ্বাস ফেলে। মৃদুস্বরে মিনিট খানেক আগে করা প্রশ্নের জবাব দেয় এখন।

“জানিনা, কোথায় যাবো। চলো এখানেই একটু বসি।”

নওরিনের কন্ঠে ব্যাপক আপত্তি!

“এখানে বসা যাবে না কোনোমতে। বারবার যাওয়া আসা করছে এ পথে। যখন-তখন টর্চ মেরে দেখে ফেলতে পারে।”
শাবাব ডানেবামে ঘাড় ঘুরায়। পেছনে তাকিয়েও একবার ছোট জঙ্গলটার ঘনত্ব দেখার চেষ্টা করে। পাশেই কবরস্থান। নওরিন হয়তো এজন্যই ভয়টা বেশি পাচ্ছে। বেশিক্ষণ থাকতে চাইছে না এখানে। পিঠ থেকে নওরিনের হাতটা সরিয়ে দেয় শাবাব।

“ধরতে হবে না। কিছু হয়নি আমার।”

পিঠে চাপা হাত সরিয়ে দেওয়ায় চোখ জোড়া বড়ো হয়ে উঠে নওরিনের। কণ্ঠে জাগে উৎকন্ঠা।
“রক্ত ঝরছে!”

“যা ঝরার, ঝরেছে। আর ঝরবে না।”

নওরিন নিজের হাতটা কচলে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে, আসলেই রক্ত ঝরছিল কি না। হাতের তালু তার সম্পূর্ণ ভেজা, তবুও লোকটা বলছে কিছু হয়নি তার; রক্ত ঝরবে না! শাবাব বাঁশঝাড়ের পেছন থেকে দুই কদম সামনে এগিয়ে যায়। নওরিন ধক করে পিছু থেকে শার্ট খাবলে ধরে ফেলে।

“কোথায় যাচ্ছেন!”

“যাই না। দেখছি। তারা এখন কোথায়?”

“ওদিকেই গেলো মাত্র। চলে আসতে পারে যখন তখন।”

শাবাব আরেক কদম সামনে যায়। নওরিন শার্টটা ধরেই রেখেছে তবুও। পিছু টান পড়ায় শাবাব নিশ্বাসে হাসে। যে হাসির ছোঁয়া তার নিশ্বাস ও প্রাণ ব্যতীত আর কোথাও লাগেনি। ঠোঁটের ধারেও নয়। পিছু ফিরে মুখের দিকে তাকায়। আঁধার মুখাবয়ব ঢেকে রাখতে পেরেছে, কিন্তু দৃষ্টির সৃষ্টিতে পর্দা ফেলতে পারেনি৷ আঁধারের বুকে জন্ম ছাইরঙা আলোর ঢেউ দৃষ্টির ক্যানভাসে ওই সংশয়াপন্ন মুখটার আবহ শৈলী ঠিকই সুস্পষ্ট করে তুলেছে। শাবাব জানে নওরিনের অস্থিরতা কতটা ভয়ের সঙ্গে বেড়ে চলেছে। সে নওরিনের রক্তভেজা হাতটা টেনে শার্ট থেকে ছাড়িয়ে দেয়। নিজ হাতের মুঠোয় ভেজা হাত শক্ত করে চেপে ছুটে চলে বিপরীত পথে; যে পথ ফেলে দুর্বৃত্তরা চলে গেছে তাদেরই খোঁজে।

কখনো গাড়ি চলাচলের পিচ ঢালা রাস্তা, কখনো পদচারণের ইট চড়ানো রাস্তা, কখনো মাঠের কিনারায় নেমে মাটির পথ মাড়িয়ে অবিরত দৌড়ে চলেছে দুজন। কারণ, পিচ ঢালাইয়ের রাস্তা পাড়ি দেওয়ার সময়ই দুর্বৃত্তদের কেউ দেখে ফেলেছে তাদের। গলা ছেড়ে ডাকছিলো বাকিদের। এক আকাশ রুদ্ধশ্বাস পাঁজরে আটকে রেখে আবারও নওরিন পাগলপ্রায় হয়ে ছুটেছে শাবাবের হাতটা কঠিন চাপে ধরে। ঘুটঘুটে আঁধারে তৈরি হয়েছে পদছন্দের ঝুমঝুম তান। নিবিড় ঝোপে নিরবচ্ছিন্ন স্বরে জেগেছে ঝিঁঝির গান। সুপথ নেই, আলো নেই, স্বস্তির নিশ্বাসটুকু পর্যন্ত সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে এই বিপদগ্রস্ত প্রহরে৷ হন্তদন্ত পায়ে বিপদসংকুল পথে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বেদনায় কাতর দুটি প্রাণ। আর সম্ভব হচ্ছে না ওভাবে ছুটে চলা। দুইবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। আলতা রাঙা পা দুটো শতবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। আলতার রঙ আর রক্তের রঙ হয়তো এতোক্ষণে এক রঙে মিলিয়ে গেছে। পায়ের জুতো জোড়া পর্যন্ত ফেলে আসতে হয়েছে বোনের বাড়িতে। দৌড় ঝাপের কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না। শাবাব ইটের রাস্তায় নেমেই চেয়েছিলো কোনো একটা বাড়িতে ঢুকে পড়বে আশ্রয় নিতে। কিন্তু আশ্রয় না পাওয়ার আশঙ্কায় নওরিন তা হতে দেয়নি। কেউ চাইবে না, পরের জন্য নিজের ঘরে বিপদ ডেকে আনতে। তাদের আশ্রয় দিয়ে অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নিজেদেরও বিপদ সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে৷ তাই শাবাবকে এদিকে নামিয়ে এনেছে নওরিন। অথচ এদিকে খোলা মাঠে দৌড়ালেও দেখে ফেলার ভয়। রাস্তার ঢালুতে তাই ঝোপের আড়ালে বসে পড়েছে। সে আর দৌড়াতে পারছে না। শাবাবকে আঁকড়ে ধরে মিশে আছে। ভীষণ হাঁপাচ্ছে। শরীর কাঁপছে ভয়ে। আশপাশে গলা শোনা যাচ্ছে তার ভাইদের। ইট চড়ানো রাস্তায় দৌড়াচ্ছে। একটু যদি আন্দাজ করতে পারে তারা ঢালুর দিকে আছে, এক্ষুণি জীবন নাশ হয়ে যাবে। নিজেকে নিয়ে তার কোনো ভয় নেই। কিন্তু শাবাবকে পেলে আস্তো রাখবে না। কী হতে পারে ভেবে, মনের আর্তচিৎকার বাইরে বিকট আওয়াজ তুলতে চাইছে। শাবাবের বুকে চেপে থাকা সত্ত্বেও মুখে হাত চেপে রেখেছে এক বিন্দু শব্দ হতে না দেওয়ার চেষ্টায়। শাবাব নিজেও জমে আছে। নওরিনের অবস্থা তাকে আরও জমিয়ে দিচ্ছে। শক্তভাবে মিশিয়ে রেখেছে একান্ত নিজের করে। পিঠে শিরশিরে স্রোত বয়ে চলার উপলব্ধি করতে পারছে৷ নিশ্চয়ই আবারও রক্তের স্রোত নেমেছে বাঁধ ভেঙে। দেহটা ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছে। চোখ দুটো আবেশে বন্ধ করে আল্লাহকে স্মরণ করে শাবাব। মৃত্যু থেকে বাঁচতে বাঁচতেই না আবার মৃত্যু ঘনিয়ে আসে! এইযে একটা প্রাণ, নিজের ভাইদেরও এতো ভয় করছে; নিশ্চয়ই নিজের জন্য নয়। কিন্তু এদিকে তার তো একূল ওকূল দুই কূলই ধ্বসে পড়ছে, এই মেয়েটার তখন কী হবে? যাকে নিজের করে নিলো, তাকে কীভাবে শূন্য রেখে যাবে? যে হাত ধরেছে, সে হাত ছাড়তে চাইছে না কোনোমতে। যে বাঁধন বেঁধেছে, সে বাঁধন ছিঁড়তে না দেওয়ার আকুল আবেদন স্রষ্টার কাছে।
মাকে একটা অপেক্ষা দিয়ে বেরিয়েছিলো বাড়ি থেকে, তার-ও যেন সুষ্ঠু অবসান ঘটে। জানে আজই তার অবসান ঘটবে না। হয়তো আগামী এক মাসেও বাবামায়ের কাছে ফেরা হবে না। নাকি আবার আজকের ভোরও দেখা হবে না? শাবাবের বন্ধ চোখের শক্ত পাতার নিচ দিয়েও দুই চোখ হতে দুই ফোঁটা অশ্রু এসে গাল ছুঁয়ে নিলো। তা অনুভূত হতেই অতি আশ্চর্য হলো শাবাব। এ কী ছিলো? শেষ কবে এমন কিছু হয়েছে, জানা নেই তার। হয়তো খুব ছোটকালে, লাঠিম খেলা ছাড়ারও আগে; মায়ের হাতে কড়ই ডালের মাইর খেয়ে।

নওরিনের অগোচরে চোখের ধার শুকিয়ে নিয়েছে শাবাব। নিস্তব্ধ আঁধারে তাকিয়ে থাকে নড়চড়হীন। চোখের সামনে হঠাৎ জোনাকি পোকা জ্বলতে থাকে। মনে পড়ে, প্রেমে পড়ার প্রথমদিকে কাদায় পড়েছিলো কোনো এক রাতে। নওরিন বলেছিলো, জোনাকি পোকা তার ভীষণ ভালো লাগে। মায়ের আঁচারের বোয়াম খালি করে এনে তাতে বারোটি জোনাকি পোকা ভরেছিলো আঁধারে দৌড়ে দৌড়ে। চৌকিদারের মাছের পুকুরের দিকে দৌড়াতে গিয়েই কাদায় পড়ে গিয়েছিলো অসাবধানে। সেই কাদামাক্ত গায়েই নওরিনের বাড়ি পৌঁছে চুপিচুপি বোয়াম দিয়ে এসেছিলো। নওরিন তার অবস্থা দেখে হেসেছিলো। সে ছিলো বছর চারেক আগের কথা। বয়সের ক্রমে যৌবনে পা রাখলেও কিশোরত্ব যায়নি তখনো। এখন বয়স সাতাশ অতিক্রম করে আটাশের পাতায় নাম লিখলেও মনে হয়, এইতো নব যুবক হিসেবে যাত্রা শুরু করলো সবে। কিন্তু আজ সন্ধ্যায়, কাবিননামায় সাক্ষর করার আগে নবযুবকের বয়স যেন হঠাৎ ত্রিশে গিয়ে ঠেকলো! এতোদিন যে প্রেম ছিলো স্বপ্ন দেখার খেলা, আজ সে প্রেম হয়ে উঠলো হঠাৎ দায়িত্ব গড়ার মেলা। একটা সংসার কাঁধে তুলে নেওয়ার দায়িত্ব, সংসারের নতুন রূপ তৈরির সাধ; সবমিলে জীবনের নতুন নামকরণ।
চোখের প্রান্ত মুছে মাটিতে ফেলে রাখা হাতটা নিজের বুকের উপর তুলে আনে শাবাব। যেখানে শার্টের কলার খাবলে ধরে পড়ে আছে নওরিন। নওরিনের হাতের উপর নিজ হাত রাখে শাবাব। আন্দাজ করে তার হাতে অল্প কিছু কাঁচের চুরি টিকে আছে। বাকি গুলো এযাবৎ ছুটতে ছুটতে কোথায় কোথায় পড়ে আছে, কে জানে? কিন্তু শাবাব এটি ভালো জানে যে, এগুলো লাল রঙের রেশমি চুরি। পরনে আছে মায়ের বিয়ের লাল বেনারসি। মা এটা দিয়েছিলো বাসা থেকে বের হওয়ার সময়। চুরি আর আলতা শাবাব নিজে কিনেছিলো আজই৷ পালিয়ে বিয়ে করবে, তাই বলে কী এইটুকু সাজাতে পারবে না তাকে; যাকে নিয়ে জীবন সাজানোর পরিকল্পনা বেঁধে রেখেছে সেই কবে থেকে? মা শাড়ির সাথে এক জোড়া নুপুরও দিয়েছেন। নওরিনের পায়ে এখন দুই জোড়া রূপার নুপুর আছে। একটা নিজ মায়ের গড়ে দেওয়া স্মৃতি, আরেকটা শাশুড়ি মায়ের পাঠানো উপহার। শাবাব হাতের অবশিষ্ট চুড়ি গুলো ছুঁয়ে রেখে ফিসফিস কণ্ঠে বলে,
“নওরিন, জোনাকি পোকা।”

নওরিনের কানে শব্দ পৌঁছালেও ধ্যানে পৌঁছায়নি। সে শুনতে পায়নি শাবাবকে, তাই কোনো প্রতিক্রিয়াও জানায়নি। এই মুহুর্তে সে পৃথিবীর কোনো শব্দ শুনতে চাইছে না। ভাইদের পায়ের শব্দও না। আজকের জন্য পৃথিবীটা নিবিড় হয়ে যাক না!

কিছুটা সময় একই স্থানে অতিবাহিত হয়। ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে বলে উজ্জ্বল হচ্ছে আকাশের রঙ। কিন্তু ফুটে উঠার আগেই তাদের এপ্রান্ত ছাড়তে হবে। জনশূন্য পরিবেশ নিশ্চিত হয়ে তারা আবার দৌড়ে চলে মেঠোপথে। মাঠের মাঝে গুচ্ছ গুচ্ছ ঘরবাড়ি আছে। সেগুলো অতিক্রম করে গেলেই রাস্তা থেকে দেখার মতো আর শঙ্কা নেই। পরবর্তী পথটুকু তারা তুলনামূলক ধীর গতিতেই দৌড়ে চলে। মেঠোপথ পেরিয়ে পাশের গ্রাম ছুঁয়ে নেয় নিজ গ্রাম ছেড়ে। গ্রামের শুরুর দিকেই একটা মেহগনি বন আছে। ঠিক বন নয়, বাগান। আবাসস্থলের পাশেই বিঘাদুয়েক জমিতে মেহগনি গাছ লাগিয়েছে সারি সারি। লোকমুখে বন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ছোট থেকেই এই বাগান দেখে এসেছে তারা। কালক্রমে জমির পরিধি কিছু কমেছে, গাছের আয়তন বেড়েছে। তালতলা গ্রাম ছেড়ে এই মেহগনি বাগানে আশ্রিত হয়েছে নব দম্পতি। গাছের গোঁড়ায় পিঠ এলিয়ে জিড়িয়ে নিচ্ছে একটু। জিড়োতে বসেই পায়ের ব্যথা অনুভব করতে লাগলো নওরিন। দৌড়ে, পড়ে গিয়ে, কেটে গিয়ে পা দুটোতে অবশীভাব চলে আসছে যেন। তবুও নিজ পায়ের আগে শাবাবের পিঠের ক্ষত নিয়ে ব্যস্ত হলো। ভোরের আলো পুরোপুরি ফোটার আগে ক্ষতস্থান দেখার উপায় নেই। কিন্তু রক্ত এখনো যে ঝরছে নিশ্চিত হতে পেরেছে পিঠে হাত রেখেই। শাবাবের শার্টটা খুলে নিয়ে তাই প্যাচিয়ে বেঁধে দিলো কোনোমতে। রক্ত ঝরাটা আপাতত বন্ধ হলেই হয়। ঢোক গিলতে গিয়ে উপলব্ধি করে গলা শুকিয়ে আছে। তবুও কিছু করার নেই। খাওয়ার মতো পানি নেই আশপাশে। হালকা করে গলা খাঁকারি দেয় গলা পরিষ্কারের লক্ষ্যে। কুসুম কোমল ভোরের আবহে আকাশের ঝলকানো আলোতে শাবাবের ক্লান্তশ্রান্ত মুখে আবারও তাকিয়ে জানতে চায়,
“কেমন লাগছে এখন? খুব বেশি ব্যথা করছে?”

পা মেলে দিয়ে শরীরের ভার মাটিতে ছেড়ে গাছে হেলে বসে আছে শাবাব। পাশে বসা নওরিনের আঁচল বিছিয়ে আছে মাটিতে। এক হাতে সে মাটিতে পড়া আঁচল তুলে নওরিনের মাথায় দেয়। আঁচল তুলে দেওয়া হাতটা পুনরায় গাছের শেকড়ে ফেলে ঘাড়টা কিঞ্চিৎ কাত করে মাথাটাও গাছে ঠেস দেয়। শান্ত চোখের পলক ফেলে নওরিনকে দেখে সদ্য জাগ্রত ভোরের আলোয়। ক্লান্ত মুখে মুচকি হাসি এঁটে প্রশান্ত গলায় বলে,
“সুন্দর লাগছে। মোল্লা বাড়ির বউ লাগছে। শাবাব মোল্লার বউ।”

চলবে…