#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:০৪
ওহি বাসার সামনে আসতেই ওহির মা তাকে জানালা দিয়ে দেখে দ্রুত তার কাছে এসে,
–ওহি,তোমাকে সকালে কতোবার করে বলেছি আজ তোমার বাবা আসবে, তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমার কোন কথাই তুমি শোন না।
–মা, আমি ভুল করে লাইব্রেরীতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
–তোমাকে আসলেই কিছু বলার নেই আমার। এখন চলো, বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
ওহি চুপচাপ মাথা নেড়ে মায়ের সাথে ঘরে এসে দেখে বাবা, দাদি আর ওসমান একসাথে বসে গল্প করছে। ওহি সেখানে যেতেই বাবা ওহির দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাকে বসতে বলে। ওহি বাবার পাশে বসে মায়ের দিকে একনজর তাকিয়ে,
–বাবা, কেমন আছো তুমি?
–এইতো ভালো আছি। ভার্সিটিতে ক্লাস কেমন চলছে তোমার?
–ভালই চলছে বাবা।
–ভালো হলে তো ভালোই। নিয়মিত ক্লাস করছো তো? ক্লাস কিন্তু মিস দিতে পারবে না ওহি।
–জি বাবা।
–হুম। ভেবেছিলাম ওসমানের মতো তুমিও মেডিকেলে পড়বে, ডাক্তার হবে। কিন্তু, ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পেয়ে তুমি সত্যিই আমাকে হতাশ করেছো। যাই হোক, ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো, ভালো কথা। এখন তোমার রেজাল্ট কিন্তু ভালো চাই আমার। বুঝেছো তুমি?
–জি বাবা।
ওহি মাথা নিচু করে কথাটা বলে চুপ হয়ে যায়। ফারজানা বেগম একনজর ওহির দিকে তাকিয়ে,
–আচ্ছা এসব কথা এখন থাক না। এতদিন পর এসেছেন। সেখানে গিয়ে কি কি হয়েছে সেই গল্প বলুন বাচ্চাদের।
ফারজানা বেগম কথাটা বলে ওসমানকে চোখ দিয়ে ইশারা দিতেই ওসমান মাথা নেড়ে ওহির দিকে তার হাতটা এগিয়ে দিয়ে,
–এই ওহি দেখ, বাবা আমার জন্য ঘড়িটা নিয়ে এসেছে।
–খুব সুন্দর হয়েছে ভাইয়া। এই ঘড়িটা কিনার তোমার অনেক ইচ্ছে ছিলো, ফাইনালি পেয়ে গিয়েছো।
–হুম। বাবা, ওহির জন্য কি নিয়ে এসেছো?
ওহির বাবা একনজর ওহির দিকে তাকিয়ে ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বক্স বের করে ওহির দিকে এগিয়ে দেয়। ওহি চুপচাপ চকলেট বক্সটা নিয়ে বসে থাকে।
ওহিকে মাথা নিচু করে এভাবে চুপচাপ থাকতে দেখে ওসমান আর ফারজানা বেগম একে অপরের দিকে তাকায়। দাদি তখন তাদের অবস্থা বুঝে,
–এই ওহি বুড়ি, অর্ধেক চকলেট কিন্তু আমাকেও দিবি। মনে থাকে যেনো। বুড়ো হয়ে গিয়েছি বলে কি চকলেট খেতে পারবো না নাকি?
ওহি মাথা তুলে দাদির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে,
–চকলেট খেলে কিন্তু তোমার দাঁতে পোকা হবে দাদি।
ওহির কথায় ওসমান হেসে উঠে। ওহির বাবা শক্ত মুখে ওহির দিকে তাকাতেই ওহি চুপ করে মাথা নিচু করে ফেলে।
–তুমি এখন বড় হচ্ছো ওহি। দাদির সাথে এভাবে কথা বলবে না।
–ওহি তো মজা করে কথাটা বলেছে বাবা…।
–এখন এভাবে মজা করার বয়স তার নেই ওসমান। ওহিকে এখন সিরিয়াস হয়ে পড়ায় মনোযোগ দিতে হবে। কারন এটাই তার একমাত্র দায়িত্ব।
যাই হোক, এখন সে ভার্সিটিতে পড়ে, যথেষ্ট বড় হয়েছে। তাই এই ফোনটা ওহির জন্য নিয়ে এসেছি। তবে খবরদার, এই ফোনের জন্য যেন তোমার পড়ার কোন ক্ষতি না হয়।
বাবা কথাটা বলে ওহির হাতে একটা ফোনের বক্স দিয়ে তাকে নিজের ঘরে যেতে বলে। ওহি মাথা নেড়ে বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাধ্য মেয়ের মতো ঘরে চলে আসে।
সন্ধ্যায় নিজের রুমে পড়ছিলো ওহি। তখনই ওসমান তার রুমে প্রবেশ করে পড়ার টেবিলের উপর ওহির নতুন ফোনের বক্সটা হাতে নিয়ে খাটে বসে,
–জীবনের প্রথম নিজের একটা ফোন পেয়েও কীভাবে এটা ফেলে রেখেছিস। আয় তো, দেখি তোর নতুন ফোনটা কেমন। বেশি ভাল হলে কিন্ত আমি নিয়ে নিবো। কি হলো? আয় এখানে..।
ওসমান কথাটা বলে ওহির দিকে তাকাতেই ওহি চুপচাপ পড়ার টেবিল থেকে উঠে ওসমানের পাশে বসে পড়ে।
–তোর মন খারাপ?
–বাবা সবসময় এমন কেনো করে ভাইয়া? কখনো ভালো করে জিজ্ঞেসও করে না, ওহি কেমন আছো? বাবার কাছে আমার থেকে আমার ভালো রেজাল্ট বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেনো? সবসময় আমাকে তোমার মতোই হতে হবে কেনো?
–ওহি, বাবা আমাদের দুজনকেই সমান ভাবে ভালোবাসে। বাবা সবসময় চায় তুই যেনো অনেক বড় কিছু হতে পারিস। আমি জানি, বাবা তোকে নিয়ে আমার থেকেও বেশি স্বপ্ন দেখে। সবার ভালোবাসা প্রকাশের পদ্ধতি এক হয় না বোন। বাবার প্রকাশ করার এই পদ্ধতি মানছি কঠোর, কিন্তু গভীর।
ওসমানের কথা শুনে ওহি একনজর তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। ওসমান মুচকি হেসে,
–এই ওহি। দেখ তোর ফোনের ক্যামেরা কতো সুন্দর। ভালোই হলো এখন আর কোন অনুষ্ঠানে আমার তোর ছবি তোলে দিতে হবে না। আয়, ভাই বোন মিলে একটা ছবি তুলে তোর ক্যামেরার উদ্ভোদন করি।
ওহি ওসমানের হাত থেকে ফোন নিয়ে দুজন মিলে একটা ছবি তোলে।
–ভাইয়া, আমাকে কতো সুন্দর লাগছে দেখো। আর সব সময়ের মতোই তোমাকে কেমন বোকা বোকা লাগছে ছবিটায়।
ওহি কথাটা বলে আপন মনে হাসতে শুরু করে। ওসমান মুচকি হেসে ওহির দিকে একবার তাকিয়ে দরজার আড়ালে ফারজানা বেগমের দিকে তাকায়। মা ঠিকই বলে, ওহির মন খারাপ ভালো করতে একমাত্র তার ভাইয়াই যথেষ্ট।
মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে ওসমান মুচকি হেসে ওহির সাথে খুনসুটি শুরু করে।
——————-
মুখ ফুলিয়ে ক্লাস করছে ওহি। সকালে উঠে জাইমার টেক্সট দেখে তার মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে। কি সুন্দর করে জাইমা লিখেছে,
“ওহি, আমি বাবা মায়ের সাথে দাদু বাড়ি যাচ্ছি। বাবা হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলো সেখানে যাওয়ার। তাই তোকে আগে বলতে পারিনি। ভাবিস না, দুদিন পরেই ফিরে আসবো। এর মাঝে বাহাদুরি করে একাই আবার রোহান বা আশ্বিন ভাইয়ার সাথে কোন রকম ঝামেলা করিস না। ফিরে এসে তোর নতুন ফোন দিয়ে ছবি তুলবো। মিস ইউ বান্ধুবী।”
কথাগুলো ভেবে ওহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
–ধুর, ভালো লাগছে না। এভাবে একা একা ক্লাস করা যায় নাকি?
একাই কথাটা বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরীর দিকে যাওয়ার সময় হঠাত গানের শব্দ শুনে অডিটোরিয়ামের সামনে এসে দরজার আড়াল থেকে দেখে সেখানে কয়েকজন ছেলে আর মেয়ে মিলে গ্রুপ ডান্স প্র্যাক্টিস করছে। কয়েকজন আবার কাপল ডান্স করছে তো কয়েকজন মিলে র্যাম-শো করছে। একজন মেয়ে তাদের ডান্সের স্টেপ শিখিয়ে দিচ্ছে। ওহি আড়াল থেকে এসব দেখে আনমনে বলে উঠে,
–মনে হচ্ছে নবীন বরণে খুব বড় করেই আয়োজন করা হবে।
–ঠিক ধরেছো তুমি।
হঠাত কেউ তার কথার উত্তর দেওয়ায় ওহি চমকে উঠে পিছনে ফিরে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
–এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে ডান্স দেখতে হবে না। ভেতরে প্রবেশ করার পারমিশন সবারই আছে। চলো আমার সাথে।
ওহি কিছু না বলে ছেলেটার পিছু পিছু অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। ছেলেটা তার সামনে বসে,
–এই ছোটু এই আপুর জন্য এক কাপ চা নিয়ে আয় তো।
–না না ধন্যবাদ। আমি চা খাবো না। গানের শব্দে শুনে এমনি দেখছিলাম ডান্সগুলো।
–সমস্যা নেই। তোমাকে তো আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।
–জি। আমি এবার নতুন। মানে ফাস্ট ইয়ার।
–ওহ আচ্ছা। কি নাম তোমার?
–আমি ওহি।
–ওহি! সুন্দর নাম। আমার নাম রাফিন। নবীন বরণের এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সকল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমার উপর।
–ওহ! আমি শুনেছিলাম নবীন বরণের দায়িত্ব আশ্বিন ভাইয়াকে দেওয়া হয়েছিল।
–হুম। আশ্বিনের উপর অনুষ্ঠানের ডেকুরেশন, প্রধান এবং বিশেষ অতিথির আপ্যায়ন সহ আরো কিছু দায়িত্ব দেওয়ার হয়েছে। আর আমাকে এটা।
–বুঝতে পেরেছি। আপনি কি আশ্বিন ভাইয়ার বন্ধু?
–আশ্বিন আমার ক্লাসমেট। সেই হিসেবে বন্ধুও বলতে পারো। বাই দ্য ওয়ে, তুমি চাইলে নাচ গানে নাম দিতে পারো।
–আমি? আমি তো নাচ গান তেমন পারি না।
–সমস্যা নেই। রিমা আছে তো সবাইকে শিখিয়ে দেওয়ার জন্য।
ওহি স্টেজের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে,
–আমার বান্ধবী আজ ক্লাসে আসেনি। কাল তার সাথে কথা বলবো, যদি সে রাজি হয় তো আমি এসে আপনাকে জানাবো।
–ঠিক আছে।
ওহি মাথা নেড়ে চলে আসতে নিতেই রাফিন পেছন থেকে ডেকে উঠে,
–ওহি! তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। দেখা হবে।
ওহি রাফিনের দিকে ফিরে তাকিয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে মাঠের দিকে আসতেই আশ্বিনের সামনে পড়ে।
ওহি তাকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিতেই,
–চশমা! অডিটোরিয়ামে কি করছিলে তুমি? প্লিজ বলো না, তুমি নাচে নাম দিয়েছো।
ওহি শান্ত ভাবে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে,
–দিয়েছি। কেনো কি হয়েছে? আমি নাচে নাম দিলে কি সমস্যা হবে?
আশ্বিন একটা বাঁকা হাসি দিয়ে,
–রোদ্দুর, ডেকুরেটরকে বলিস যেনো স্টেজটা মজবুত করে বানায়। আমি কোন রিস্ক নিতে চাই না।
আশ্বিনের কথায় ওহি রেগে তার দিকে তাকিয়ে,
–এই কি বললেন আপনি? কি বুঝালেন এটা বলে?
এদিকে রোদ্দুর ওহির এমন রেগে বলা কথাটা শুনে হেসে উঠে।
আশ্বিন একটা বাঁকা হাসি দিয়ে কিছু বলতে নিবে হঠাত ওহির পেছনে তাকিয়ে আচমকা ওহির হাত ধরে টেনে তার কাছে নিয়ে আসে। হুট করে এমন করায় ওহি অবাক হয়ে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে দেখে, আশ্বিন খুবই শান্ত ভাবে তার পিছনে কারো দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে আশ্বিন ধীরে ধীরে সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে ওহির দিকে তাকিয়ে দেখে সে অবাক হয়ে চোখ বড় করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
হঠাত ওহি আশ্বিনকে একটা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই রোদ্দুর আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
–এই বল কোথা থেকে আসলো? তুই না দেখলে এখনই তো একটা এক্সিডেন্ট হয়ে যেতো।
রোদ্দুরের কথায় ওহি তাকিয়ে দেখে আশ্বিনের হাতে একটা ক্রিকেট বল। মানে বলটা ওহির মাথায় এসে লাগার আগেই আশ্বিন সেটা ধরে ফেলেছে। ওহি একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে,
–এই বল কোথা থেকে এলো? এখানে তো কেউই খেলছে না। তবে?
আশ্বিন কিছু না বলে ওহির দিকে তাকিয়ে,
–তোমার ক্লাস নেই? যাও ক্লাসে যাও।
ওহি ভ্রু কুঁচকে আশ্বিনের দিকে একবার তাকিয়ে একটা ভেংচি কেটে চলে আসে। ওহি চলে যেতেই আশ্বিন হাতে থাকা বল’টায় তাকিয়ে দেখে বলের ভেতর একটা চিরকুট রাখা আছে। রোদ্দুর চিরকুট দেখে আশ্বিনের দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই আশ্বিন বলে উঠে,
–কালো শার্ট পড়া একটা ছেলে এই বলটা এদিকে ছুঁড়েছে। মাক্স পড়া ছিলো তাই চেহারা খেয়াল করিনি। তুই গিয়ে দেখ কে এই ছেলে।
রোদ্দুর মাথা নেড়ে দ্রুত সেদিকে চলে যায়। আশ্বিন রোদ্দুরের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে হাতের চিরকুট পড়ে ভার্সিটির ভেতর চলে আসে।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
((আসসালামু আলাইকুম। ভুল ত্রুটি ক্ষমা চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ))