#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম (সূচনা পর্ব)
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
“বলো কবুল, বলো সোনামনি, বলো কবুল, কি হলো? আর্শি সোনামনি- বলো কবুল, তোমাকে চকলেট দিবো, আইসক্রিম দিবো, ঐ যে ভ্যানিলা টা..বলো কবুল…”
সুললিত কন্ঠে কেউ একজন আর্শিকে কথাগুলো বলছিলো।
আইসক্রিমের কথা শুনে আর্শির লোভাকাতুর মুখ চট করে বলে উঠলো,
” কবুল”
তারপর এক ভোঁ দৌড়!
কাজী সাহেব আর মাত্র গোটা কয় অতিথির উপস্থিতিতে এভাবেই ছোট্ট আর্শির বিয়ে হয়ে গেলো।
একজন আর্শির হাতে আইসক্রিমের কাপ তুলে দিলো । আর একজন সুন্দর একটা ওড়না মাথায় ঘোমটা দিয়ে রেখে বসিয়ে রেখেছে ছোট্ট আর্শিকে। আর্শির বিপরীতেই বরবেশে বসে রয়েছে ছোট্ট আরেক ছেলে, নাম- প্রহ। প্রহ আর্শির দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর ভেংচি কাটছে। আর্শি একা একাই আইসক্রিম খাচ্ছে দেখে হিংসা হওয়ায় হঠাৎ ই আর্শির ঘোমটার নিচে হাত ঢুকিয়ে ছোট্ট বিনুনী ধরে মারলো এক হ্যাঁচকা টান। তারপর এক দৌড়ে বাড়ি পার!
” প্রহ! এই প্রহ থাম! আজ তোকে পেলেই হলো….” এই বলে চিৎকার করতে লাগলো আর্শি।
ঠিক সেই সময়ই ঘুম ভেঙ্গে গেলো আর্শির।
সময় ভোরবেলা। সূর্য পূর্ব আকাশে ঊঁকি দিচ্ছে। পূর্বাকাশে লালে লালারন্য! এত সকালে আর্শি কোনোদিনই জাগে না। তবে যেদিন এই স্বপ্নটা দেখে তারপর আর ঘুমাতে পারেন। এসি চলছে, তারপরো ঘেমে একেবারে নেয়ে গেছে সে। এসি বন্ধ করে সে জানালা খুলে দিলো। প্রকৃতির বিশুদ্ধ সমীরনে তনুমন ডুব দিলো তার। এই স্বপ্নটা সে মাঝে মধ্যেই দেখে। স্বপ্নের ঘটনা ঠিক কত ছোটোবেলার তা সে অনুমান করতে পারে না। তবে এখন আর্শির বয়স ২৩। এই স্বপ্নটা যে ওর ছোটোবেলায় ঘটে যাওয়া একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা তার মনের দৃঢ় বিশ্বাস। বিশ বছর বয়স থেকেই আর্শি আক্রান্ত হয়েছে মস্তিষ্কের দুরারোগ্য আইঝেইমার রোগে। যে রোগের বৈশিষ্ট্য হলো অনেক কিছুই ভুলে যাওয়া। ডাক্তার বলেছে তার মস্তিষ্কের শতকরা দশ ভাগ নিউরন কার্যক্ষমতা হীন। এক নিউরনের এক ড্রেনডাইট আরেক নিউরনের এক্সনের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না, তাই বহু আগে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই সে স্পষ্ট মনে করতে পারে না। স্পষ্টভাবে মনে না পড়লেও খুব ছোটোবেলাতেই যে ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো এটা ও মনে করতে পারে। আর ওর বরের নাম প্রহ! কি মিষ্টি নামটা “প্রহ” ! আর সে প্রহের স্ত্রী। বিষ্ময়কর হলেও সত্য দুনিয়ার কেউ না মানলেও আর্শি নিজেকে এখনো নিজেকে প্রহের স্ত্রী হিসেবেই মেনে নেয়। মাঝে মাঝে একা একাই প্রহের জন্য সে সাজে। আর একা একাই আনমনে বলে উঠে,
” মিসড ইউ প্রহ! কোথায় তুমি প্রহ? আর কতদিন তুমি আমার থেকে দূরে থাকবে? ”
মনে মনে আর্শি প্রহকে খুঁজে, আর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে একদিন না একদিন প্রহ তার কাছে ফিরে আসবেই। অবচেতন মনে সে প্রায়ই ডেকে উঠে ” প্রহ!”
প্রহকে স্মরন করতে করতেই আর্শি আয়নার সামনে দাঁড়ালো। চশমা ছাড়া সে স্পষ্ট করে কিছুই দেখতে পায় না। চশমা পড়েই আয়নার দিকে তাকাতেই নিজের অবয়ব চোখে পড়লো। চোখ মুখ মলিন হয়ে আছে। ফর্সা গালে জেগে গেছে গোটা দুই লাল টকটকে ব্রণ! পিঠে গড়িয়ে থাকা চুলগুলো উস্কোখুস্কু।
রাত জেগে এসাইনমেন্টের জন্য ক্লু কালেক্ট যে করেছে! হঠাৎ ই তার মনে হয় আরেব্বা! আজই তো ভার্সিটির এসাইনমেন্টের শেষ দিন। বিছানার পাশে রাখা টেবিল ক্যালেন্ডারেই সে নোট করে রেখেছিলো একথা। আর এই এসাইনমেন্ট একা করাও তার পক্ষে সহজ নয়, অন্যদের থেকে আশি পার্সেন্ট কপি করে বাকি বিশ পার্সেন্ট নিজের জ্ঞানে লিখবে বলে ঠিক করলো।
টি শার্ট আর ট্রাউজার পালটে দ্রুত পড়ে ফেললো টু পিস।
চুলগুলো আঁচড়ে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখতেই হাঁক শুনতে পেলো।
” আর্শি, উঠেছো?
মায়ের হাঁক শুনেই আর্শি দৌড়ে গেলো।
” মাম্মা, বলো!”
“আমি ওয়াকে বের হচ্ছি! খালাকে বলো কি খাবে, সে করে দিবে! ”
” ওকে!” বলতেই মিসেস অপরাজিতা বাইরে বের হয়ে গেলেন হাঁটতে, সাথে তার পোষা কুকুর র্যালফ!
আর্শি র্যালফকে একটু আদর দিতেই সে আহ্লাদে ফোঁস ফোঁস করে উঠলো।
অপরাজিতা আর্শিকে বিদায় জানিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে গেলো।
অপরাজিতা চলে যেতেই খালা এলো। তার নাম রুকাইয়া। বহু পুরাতন চাকর সে এ বাড়ির। সে এলো এক নাস্তা নিয়ে।
নাস্তা দেখেই আর্শি ক্ষেপে গেলো।
” কেনো খালা? জানো না আমি কফি খাই?”
” কেনো জানেন না, আপনেরে চা কফি খাইতে মানা করে দিছে ডাক্তার সাহেবে?”
আর্শি একটা ব্রেড আর বাটার হাতে নিয়ে দৌড়ে গেলো।
আর্শিকে সকাল সকালই বের হতে হবে। সে বসলো তার ল্যাপটপ নিয়ে এসাইনমেন্ট করতে।
এমন সময় রুকাইয়া এলো আর্শির রুমে।
” এই নেন আপনার নোট”
বলে এসাইনমেন্টের একটা হার্ডকপি আর্শির হাতে তুলে দিলো।
আর্শি চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” কে দিয়ে গেছে এই এসাইনমেন্ট? ”
” এক্কেবারে ফজরের ওয়াক্তে আমেরিকান ভাইয়া আইছিলো, সে দিয়া গেছে।”
আর্শির মেজাজ চড় গেলো।
সে দ্রুত ল্যাপটপ খুলে বসলো।
এমন সময়ই দেখে ল্যাপটপে চার্জ নেই। রাত্রে চার্জ দিয়েই তো সে শুয়েছিলো। তবে কি হয়েছে? হয়তো প্লাগে কোনো গন্ডগোল ছিলো তাই চার্জ হয়নি।
“ধ্যাৎ” বলতেই ফোনের রিং বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠলো, ” এষ!”
” কি রে এষ? তুই রাত্রে শোয়ার আগেও কল দিস আবার ভোরে জাগার পরো কল দিস, ব্যাপার কি?”
এষের কন্ঠ ভেসে এলো। এষ হেসে হেসে বললো,
” কুল ডাউন বেইব, তুই কথা না বলতে চাইলে না বলবি, আমার কোনো সমস্যা নাই, শুধু কলটা রিসিভ করবি ব্যস!, আমি শুধু তোর ব্রিদিং এর শব্দ শুনবো, এতেও কি তোর কোনো সমস্যা আছে, এতে তো আর তোর কোনো শক্তি খরচ হচ্ছে না, তাই না?”
” না শক্তি আমার খরচ হচ্ছে না, তবে আমার ফোনের চার্জ তো যায়!”
এষ গলার স্বর খাঁদে এনে অতি আবেগ দিয়ে বললো,
” প্লিজ আবার এটা বলিস না যে, আমার মায়ের টাকা নাই, আমাদের বাসায় কারেন্ট নাই…লক্ষীটা আমি শুধু তোর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দটুকুন শুনতে চাই, বেশি চাহিদা নেই আমার, তাও তুই রাগিস কেনো?”
আর্শি রেগে বলে উঠলো,
” এষ দেখ! তুই জানিস আমি বিবাহিতা, আমার স্বামি আছে নাম…”
” প্রহ! প্রহ তার নাম, এই গল্প আমি অনেক শুনেছি, শুধু আমি না আমরা ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই শুনেছি, তোর মা শুনেছে, তোর নানা, নানী, আমার বাবা মা সবাই শুনেছে, কিন্তু প্রহ কে? কোথায় থাকে? তার কোনো উত্তর কারো কাছেই নেই। কথা দিচ্ছি, যদি প্রহ নামে কেউ থাকে তাহলে সারা দুনিয়া তন্ন তন্ন করে আমি প্রহকে তোর কাছে এনে দিবো, তোর সুখের জন্য, শুধু আমাকে একটিবার মিছেমিছি হলেও বসিল যে, ভালোবাসি, আমি হাসিমুখে তোর জন্য জীবন টা দিয়ে দিবো, জান টা দিয়ে দিবো মাই লাভ…”
আর্শি চেঁচিয়ে বললো,
” ডিসগাস্টিং!”
বলে ধপাস করে আর্শি ওর ফোনটা রেখে দিলো।
নিজের ল্যাপটপ চার্জে লাগিয়ে সে ছুটলো ভার্সিটি পানে।
বের হতে না হতেই লিফটের সামনে মিসেস অপরাজিতা কে পেয়ে গেলো সে।
অপরাজিতা মেয়েকে বলে উঠলেন,
” আর্শি মাম্মাম, ব্রেকফাস্ট করেছো তো?”
” হ্যা মাম্মি”
” দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছো মা! যাই হোক, আজ আফটারনুন ডক্টর বসাকের ওখানে তোমার এপয়েনমেন্ট আছে, মনে রেখো! ড্রাইভার কে বলা আছে, আমার ফিরতে রাত হতে পারে, কানাড়ার রাষ্ট্রদূত আসছে, তার সাথে মিটিং আছে”
আর্শি ভক্তের মতো বলে উঠলো, ” ওকে মাম্মা”
অপরাজিতা বলে উঠলো,
” আজ দুপুরে এষ বাসায় লাঞ্চ করবে, তুমি ওর সাথে একটু সঙ্গ দিও প্লিজ”
আর্শি মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে বললো,
” ইমপসেবল মাম্মি, আমি এষের সাথে লাঞ্চ করতে পারবো না, বিরক্তিকর ও!”
অপরাজিতা মেয়েকে আর উত্তেজিত করলো না, কারন ডাক্তারের বারণ আছে। সে স্বর নিচু করে বললো,
” আচ্ছা মা, আমি তোমাকে আর কিচ্ছুটি বলবো না। আমার আপন ভাইয়ের ছেলে সূদূর আমেরিকা থেকে এসে থাকছে কোথায়? হোটেলে! তবে, তোমার তো একটু বিবেক করা উচিত? আমি আর কিছুই বলবো না তোমাকে, যা তুমি ঠিক মনে করো তাই ই হবে”
অপরাজিতা মেয়েকে বুকে টেনে একবার আদর করে উপরে উঠে গেলো। আর্শি গাড়িতে উঠে গেলো।
আর্শি ভার্সিটি পৌছতেই সেখানেও এষ হাজির।
” আর্শি ও মাই আর্শি, দেখ তো টি শার্ট টা কেমন লাগছে?”
না চাইতেও আর্শি এষের দিকে তাকালো।
চোখ লাল হয়ে আছে এষের। হয়তো রাতে ভালো ঘুমায় নি। খাড়া নাক, সুস্পষ্ট ভাসা ভাসা চোখ আর ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, সুগঠিত বলিষ্ঠ দেহের এক অপূর্ব রুপবান পুরুষ এষ! আর্শি না চাইতেও তাকিয়ে ফেললো এষের দিকে। মনে মনে ভাবলো বহু নারীর এ আকাংখিত এষের একমাত্র কাম্য নারী সে। হঠাৎ ই সে বেশ গর্বিত বোধ করলো। এমন এক পুরুষ তার পেছনে পোষা কুকুরের ন্যায় ছুটে বেড়াচ্ছে সামান্য একটু ভালোবাসি শব্দটা শোনার অপেক্ষায়! আর সে তাকে সামান্য পাত্তাও দিচ্ছে না। মুহূর্তেই আবার ভাবনাদের ধামাচাপা দিয়ে সে বলে উঠলো,
” এনাফ ইজ এনাফ এষ! উঠে যা বলছি…তুই জানিস আমি….”
” হ্যাঁ জানি, তুই বিবাহিতা, মে বি চার বাচ্চার মা ও তুই, তবে সব তোর কল্পনায়, বাস্তবে না, আমি তোর কল্পনার মিথ্যে জগতটাকে ভাঙতে চাই, আমার ভালোবাসা দিয়ে!”
আর্শি এসব কথা শুনে হঠাৎ যেনো ভুলে গেলো তার পুরাতন স্বপ্নকে ঘিরে পিছুটান। রিনরিনিয়ে হেসে উঠলো সে।
আর এষ বের করে আনলো পেছনে লুকানো হাত।
যে হাতে ছিলো একগুচ্ছ লাল টকটকে গোলাপ।
আর্শি দুহাতে গোলাপ গুচ্ছটা টেনে নিলো
সহাস্যে।
দূরে দাঁড়িয়েই এষের এসব কান্ডকলাপ দেখছিলো আর হাসছিলো আর্শির ফ্রেন্ড সার্কেল।
ওরা এষের ধৈর্য্যের তারিফ করতে করতে এগিয়ে আসলো ওদের কাছে।
.
.
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। দেশের বিদেশ বিষয়ক যাবতীয় নিয়ম নীতি যেখানে রচিত হয়, পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও ফলপ্রসূ হয়। সেখানের একজন সিনিয়র সচিব হলেন মিসেস অপরাজিতা।
অফিসে ঢুকতেই এক পুরাতন স্টাফ নতুন এক স্টাফকে ফিসিফিসিয়ে তার পরিচয় দেওয়া শুরু করলেন। পুরাতন স্টাফের নাম রুবিনা আর নতুন স্টাফের নাম মেহেররাম তাবাসসুম অন্তি। দুজনে মা মেয়ের সম্পর্ক।
অন্তিকে রুবিনা মিসেস অপরাজিতার পরিচয় বলা শুরু করলো,
” মিসেস অপরাজিতা, যার পুরো নাম রায়হানা হক অপরাজিতা। যিনি একজন স্বঘোষিত বিবাহিতা। সিনিয়র সচিব তিনি। বিরাট পদবী। সোসাইটির সবাই এটা বিশ্বাস করে যে অপরাজিতা কোনোদিন বিয়েই করেনি। তার এক কন্যা আছে, নাম আর্শি। আর্শি অপরাজিতার পালক কন্যা। তবে অপরাজিতা একথা স্বীকার করেনা কোনোকালেই। সে মানুষকে এটাই বলে এসেছে এতকাল যে তিনি বিধবা। সুইজারল্যান্ডের জুরিখে কর্মরত থাকাকালীনই এক কণ্যা রেখে তার স্বামি মা’রা যায়। তবে অপরাজিতার নিজের যে অবস্থান, সে অবস্থানের মানুষকে মানুষ তার পরিবার জীবন নিয়ে এত খোঁচায় না। অপরাজিতা নিজের যোগ্যতা বলে নিজেকে নিয়ে গেছেন সকল প্রশ্নের ঊর্ধে।
(চলবে)