#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম
পর্ব ১২
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
আর্শিকে কোলে তোলা অবস্থায়ই এষ আর্শিকে বলে চললো,
“চল! বাসর রাতের একটা ট্রায়াল দেই!”
এষের দৃষ্টি আর্শিতে গাঢ়ভাবে নিবদ্ধ আর সে তার চোখ স্থির রেখেই আর্শিকে এক অদৃশ্য ঈশারা দিয়ে গেলো আর একথা বলেই এষের মুখে এক দুষ্ট হাসি খেলে গেলো।
আর্শি সামান্য ভড়কে গেলো। ওর মাথায় খেলে গেলো,
” একি? এষ কি এসব সিরিয়াসলি বলছে নাকি নিছকই দুষ্টামি?”
যে যাই হোক! এষের নিজের প্রতি কন্ট্রোল খুবই কম! তার আর্শি তার হাত পা ছুঁড়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলো,
” আর ইউ ক্রেজি অর সিরিয়াস? ছাড় আমাকে এক্ষুনি! মাম্মী চলে আসবে? আর দেখে ফেললে ভাববে টা কি?”
আর্শির প্রতিরোধ বাক্য শুনেও এষ তার শক্ত দুটো হাত দিয়ে আর্শিকে তার বুকের সাথে আরো শক্ত করে মিশিয়ে ধরলো। তারপর সেই অবস্থাতেই আর্শিকে ব্যালকনি থেকে বেডরুমে নিয়ে এলো।
আর্শি আবার বলেই চললো,
” কি বলছি না, নামিয়ে দে এখন, আরেহ..!”
এষ ভাবলেশহীন ভাবে আর্শিকে কোলে নিয়ে বিছানার কাছে এলো, বিছানায় আর্শিকে ধপাস করে ফেলে শুইয়ে দিয়ে ওর সাথে নিজের শরীর জড়িয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো। আর্শির কানের কাছে মুখ নিয়ে স্বর নিচু করে বলতে লাগলো,
” সারাদিন, সারারাত তোকেই শুধু ফিল করি, তোর স্পর্শ, তোর নি:স্বাস, তোর শরীরের ঘ্রাণ, তোর চুলের ঘ্রাণ! এভাবে আর কতদিন? আমি ভদ্র প্রেমিক বলেই এত কষ্ট পাচ্ছি, আর অসভ্য হলে…!”
আর্শি এষের দিকে চাইলো। লাল চোখ দুটো তে রাজ্যের কামনা সাথে শুকনো ঠোঁটগুলোতে বিরহের ব্যাপকতা। আর্শিকে নিজে বুকে শুইয়ে এষ বলে চললো,
“আর্শি ইটস এনাফ, তোকে আপন করে পেতে আমার আর তর সইছে না, ফরগিভ মি, ফর বিইং রুঢ়, তবে বিশ্বাস কর বিয়ের আগে তোর সাথে ওসব করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, তবে তুই আমার হয়ে গেছিস এটার একটা সিলমোহর আমার চাই ই চাই! ”
আর্শি বুঝতে পারলো, এষের মনের হালচাল।
ছেলেটা ওকে এত চায় কেনো? তা আর্শির বোঝে আসে না। আর ওর এত ব্যাকুল হওয়াটাও আর্শির কাছে অস্বাভাবিক লাগছে না। আর্শি এষের কথা শুনবে বলে কান পাতলো।
এষ বলে চললো,
” আমার বয়সী ছেলেদের সবার ড্রিম থাকে একটা ভালো জব, ভালো ক্যারিয়ার, গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হবার পর থেকে এ পর্যন্ত কতগুলো জবের অফার পেলাম, সবগুলোই রিজেক্ট করলাম। সবগুলো জবই ছিলো মাল্টিন্যাশনাল। এত বড় বড় কোম্পানির জব সব বাদ দিলাম, এসব আমার কাছে কোনো ব্যাপার ই না, তোর জন্য আমি দুনিয়াও বাদ দিতে পারি, তুই শুধু আমার হয়ে যা।”
আর্শি হেসে বললো,
” তোর এত ভয় কিসের রে? আমি বললাম তো, আমি আছি তো, এত হারাবার ভয় কিসের? মামা মামী আসুক, এ কয়টা দিন শুধু ওয়েট কর”
এষ আর্শির দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের স্বরে বললো,
” তাহলে আজ থেকে প্রতি ঘন্টায় আমাকে একটা করে হাগ দিবি বল? অনেকক্ষণ তোর কোনো স্পর্শ না পেলে আমি কেমন যেনো পাগলাটে হয়ে যাই! ভালো লাগে না কিছু আমার! সবকিছু এলোমেলো লাগে। মনে হয় আমি পেইসেন্ট আর তুই আমার ড্রাগ, যে ড্রাগে আমি এডিক্টেড, আসলে আমি তোর নেশায় পড়ে গেছি, তুই আমার সাধনা, তুই আমার কামনা, তুই আমার বাসনা…
আর্শি এতগুলা বিশেষণ শুনে লজ্জায় কাচুমাচু করতে করতে বললো,
” প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় হাগ! এ কেমন ডিমান্ড রে! এমন ডিমান্ড জীবনেও শুনিনি আমি!”
এষ আর্শিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার পায়ে ধরে বসে পড়লো,
” কথা দে তুই, বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায় আমাকে এক বার অন্তত জড়িয়ে ধরবি?”
আর্শি হাসবে নাকি রাগবে তা ভেবে পেলো না।
মুখ টিপে হেসে বললো,
” এ কেমন ডিমান্ড রে বাবা! ”
এখন আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই এষ ওকে নিজের হৃদপিন্ডের সাথে মিশিয়ে নিলো। প্রগাঢ় নি:শ্বাস টেনে আর্শিকে যেনো নিজের মধ্যে শুষে নিতে থাকলো এষ! আর্শির শরীর উত্তপ্ত হয়ে এলো। সে মিইয়ে গেলো এষের বাহুডোরে।
.
.
ভার্সিটির কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সেমিস্টার এর ক্লাশ জুড়ে হৈচৈ।
নেহাল ক্লাশের সবাইকে ধানমন্ডি সাতাশ এর ‘স্টার কাবাব’ রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিয়েছে। ক্লাশের সবার মুখে এখন নেহালের জয়ধবনি। ক্লাশের অনেকেই নিহুকেও সাধুবাদ দিচ্ছে। কারন নিহুর জামাই পরিচয়েই নেহাল আজ ক্লাশের সবাইকে শালা শালী সম্বোধন করে। আর সে আজ তার সকল শালা শালিকে এত বড় ট্রিট দিলো।
নিনা নামের এক মেয়ে নিহুকে বলে উঠলো।
” কনগ্রেট নিহু, একখান জামাই পাইছিস রে নিহু! ইউ আর সো লাকি, এত কেয়ারিং রে বাবা! শুধু তোর কেয়ার ই না, আজ আমাদের কেয়ারো নিলো, আমাদের সব কয়টাকে আজ স্টার কাবাবে খাইয়েছে সে”
নিহু চোখ কপালে তুলে জ্বলে উঠা স্বরে বললো,
” হোয়াট গোয়িং অন, বয়ফ্রেন্ড টা আমার! আর ফর ইউর কারেকশন ও আমার জামাই না। আর তোর প্রশংসা করার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, তোর নাই দেখে, তুই জ্বলে যাচ্ছিস”
নিনা নামের সেই মেয়েটার কাছে নিহুর জ্বলে উঠার বিষয়টা স্পষ্ট লাগলো না। তাই সে আর তর্কে না জড়িয়ে স্থান ত্যাগ করলো, কারন সে যা পাওয়ার তা পেয়ে গেছে। স্টার কাবাব রেস্টুরেন্টে সে একটা আস্ত গ্রীল আর পাঁচটা শমি কাবাব একাই ভক্ষণ করেছে বলে কথা। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সে স্থান ত্যাগ করলো।
ওদিকে আর্শি, আরাধ্যা, অগ্র আর পূর্ণকেউ দেখা যাচ্ছিলো উচ্ছ্বাস করছে। নিহুর মেজাজ পুরোপুরি বিগড়ে গেলো।
নিহু নেহাল কে ফোন লাগালো।
” হোয়াট গোয়িং অন? তুই আজ কি করেছিসটা নেহালের বাচ্চা?’
নেহাল লাফাতে লাফাতে বললো,
“আরে! আমি নেহালের বাচ্চা হতে যাবো কেন? আমি হলাম নিহুর বাচ্চার বাবা! তোরে তো একশ বার কল দিলাম, আর ভয়েস এস এম এস ও পাঠালাম, যে আমি তোর ফ্রেন্ড সার্কেল কে স্টার কাবাবে স্ট্রিট দিচ্ছি, কিন্তু তুই তো কিছুই শুনলি না সাথে তুই কল ও রিসিভ ই করলি না।
নিহু চেঁচিয়ে উঠলো,
” তুই খবরদার কৈফিয়ত নিবি না আমার কাছে! হাউ ডেয়ার ইউ, আমার বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে পার্টি করস? ”
নেহাল এক্কেবারে নির্জলা শান্ত স্বরে বললো,
” কুউল ডাউন বেইব! আর কিসের হাউ ডেয়ার হাই ডেয়ার করছিস? আগে কাহিনী তো শোন? তোর ক্লাশের সব প্রায় অর্ধেক পোলাপাইন স্টার কাবাব এর সামনে আড্ডা দিচ্ছিলো, আর ওরা আমাকে দেখে হইহই ধবনি দিয়ে বলে উঠলো, দুলাব্রো এসেছে, দুলাব্রো, আজ আমাদের স্টার কাবাবে ট্রিট দিতে হবে দুলাব্রো , তাই আর কি ট্রিট দিলাম,এতে দোষের কি?”
নিহু সর্বোচ্চ স্বরে চিৎকার করে উঠলো,
” আই ওয়ান্ট ব্রেক আপ! আমি আর এই রিলেশন মানি না, আর খবরদার কোনোদিন আমার সামনেও আসবি না, তোরে কবেই বলে দিয়েছি, আই ডোন্ট নিড ইউ এনিমোর, তাও বারবার আমাকে ডিস্টার্ব করিস, ফোন দিয়ে জ্বালাতন করিস, আর আমার ক্লাশের সবাইকে বলে বেড়িয়েছিস যে, তুই আমার হাবি! আর একদিন কল দিলে তোর নামে ইভ টিজিং এর মামলা যাবে, বলে দিলাম।”
ক্লাশের সবাই হা হয়ে নিহুর কথাগুলো শুনছিলো।
সবার চোখ ছানাবড় হয়ে গেলো।
” কি বলে মেয়েটা?”
( চলবে)
#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম
পর্ব ১৩
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
ক্লাশের সবাই ভাবুক হয়ে বসে রইলো,
সবার ভাবনা একই!
” নিহু আর নেহালের প্রেম কাহিনির অধ্যায়ের এভাবেই সঙ্গিন সমাপ্তি ঘটতে পারলো? এই ভালোবাসাই যদি না টেকে তবে, পৃথিবীতে প্রকৃত ভালোবাসা বলে কি কিছু থাকলো আর?”
আর্শি আর আরাধ্যাও শক খাওয়া বদনে দাঁড়িয়ে রইলো! মনে মনে ভাবলো,
” নেহাল যার জন্য করলো চুরি, তাকে সে ই বলে চোর?”
সব বন্ধুদের খাওয়ালো বরং নিহুর এতে খুশি হওয়ার কথা ছিলো, হলো এর উলটা!
এটাই প্রথম নয়, নিহুর জন্মদিনে নেহাল বিশাল বড় পার্টি করে সকল বন্ধু বান্ধবদের আমন্ত্রণ করে, অনেক সেলিব্রেট করতো প্রতি বছরই।
” হাই প্যাথেটিক, হাউ প্যাথেটিক ” বলে কয়েকজন ছেলেমেয়ে মনস্তাপও করলো।
নেহাল ইজ দ্যা বেস্ট প্রেমিক! এসব যারা বলতো তাদের মাথা ডাউন হয়ে গেলো।
বেস্ট প্রেমিককেই মা’মলা ঠুকে দিতে চাচ্ছে তার প্রেমিকা?
এত ডেডিকেটেড একটা প্রেমিক ছিলো নিহুর! এত কেয়ারিং! ক্লাশের অনেকেই ঈর্ষাও করতো যদিও! ক্লাশের সবাই সে সব দেখেছে, সবাই নেহালের ডেডিকেশনের স্বাক্ষ্য। নিহু বড়লোকের মেয়ে, টাকা পয়সার অভাব ছিলো না। শুধু অভাব ছিলো যত্ন আত্মির! বাবা বড় বিজনেস ম্যান আর মা ফেমাস ব্র্যান্ড প্রমোটার। দুজনেই নিজেদের জীবনে ভীষণ ই ব্যস্ত। নিহু কি করছে? কি খাচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে? কার সাথে মিশছে এসব দেখার কেউ ছিলো না। বাবা মা যেনো অর্থ আর যশ খ্যাতি উপার্জন ছাড়া আর কিছু বোঝে না। নিহুর বাবা মা দুজনেরই মধ্যে চলে অর্থ উপার্জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কে কার চেয়ে বেশি অর্থ ও সুনাম অর্জন করতে পারে, এ টক্কর তাদের মধ্যে সারাবছর ধরে ই চলতো। আর এদিকে নিহু পড়াশোনায় ডাব্বা মেরে যাচ্ছিলো। আর্শি বা আরাধ্যার সাথেও বেশি মিশতো না। মিশতো শুধু কতগুলা বিগড়ে যাওয়া ছেলে মেয়ের সাথে। আর একদলের সাথে সে রাত বিরেতে পার্টি করে বেড়াতো, যারা কিনা শিরায় ড্রা’গ নিতো, অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ করতো আর আইন বিরোধী অপরাধ তো আছেই! এ ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে তাকে রক্ষা করে নেহালের সংঙ্গ! নেহাল নিহুকে নষ্ট হয়ে যাওয়ার দ্বার প্রান্ত থেকে সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে।
আরাধ্যা কিছু বলতে এগিয়ে এলেই তাকে কিছু বলতে না দিয়েই নিহু উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
” জানি! তোরা এখন ওর হয়ে বয়ান দিবি! কিন্তু শোন, ওর সাথে আমার রিলেশন টা আর যাচ্ছে না, চলছে না। এখন ফ্রেন্ড হিসেবে তোদেরও উচিত আমাকে সাপোর্ট করা আর আমি যেখানে শান্তি পাই না সেখানে.. তোরা আমার ফ্রেন্ড হওয়া স্বত্ত্বেও সেখানেই আমাকে ঠেলে দিবি না, সেটাই আমি আশা করবো! আমার নতুন একটা রিলেশন হয়েছে, সে ই আমার ফিয়ন্সি। সময় আসলে তার সাথে আমি তোদের মিট করাবো। আর নেহাল ইজ নাউ আ অফ টপিক! ওর সাথে দেখা হলে তোরা আর কোনোদিন কথাও বলবি না, এটাই আমার শেষ কথা!”
আর্শি বলে উঠলো,
” কিন্তু নিহু…”
নিহু আর্শিকে থামিয়ে চোখ রাঙ্গানি দিয়ে শাসিয়ে বলে উঠলো
” কোনো কিন্তু নয়! যে আমার হবু বর, সে একজন ভেরি পাওয়ারফুল পার্সন। সো, স্টপ দিস টপিক নাউ, অল ইজ ওভার উইথ নেহাল! ”
আর্শি থতমত খেয়ে গেলো। বুঝতে পারলো, এ মেয়ের কন্ট্রোল আর তাদের হাতে নেই, অন্য কারো কাছে চলে গেছে এর কন্ট্রোল। কিন্তু কে সে ভেরি পাওয়ারফুল?
ক্লাশে তখনি টিচার ঢুকে গেলো। সুতরাং আলোচনা অগ্যতা থামাতেই হলো।
বিষন্ন বদনে ক্লাশে মনোযোগী হলো আর্শি আর আরাধ্যা।
নিহুর চোখ মুখে তখনো রাজ্যের ক্রোধ নেহালের প্রতি!
.
.
নেহালের সাথে সেদিন কথোপকথন এর পর নেহাল আর এষের কন্টাক্ট নাম্বার আদান প্রদান হয়েছিলো।
নিহু যখন নেহালকে বিষবাক্য গুলো শুনাচ্ছিলো তখনো নেহাল তার অফিসে ফাইল হাতে বসে।
নিহুর কথাগুলো শুনে স্টাক হয়ে বসে আছে, কিসের অফিস? আর কিসের ফাইল?
নিহুর রিজেকশনের পর নেহাল কার কাছে ফরিয়াদ চাইবে? আর কার কাছে বিচার?
এ কেমন মানুষের মন? ক্ষণেই একজনের প্রতি তো ক্ষণেই আরেকজন।
শুধু আজ ই না। গত কয়েক মাস যাবত ই নিহুর এরকম হালচাল। এভয়ডেন্স এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অতিক্রম করে গেছে নিহু। শত বার করে কল, শত শত মেসেজ করা, তার পরো শত উপেক্ষা, শত অপমান! বেশির ভাগ রাতেই সে এংঙ্গেইজ থাকে অন্য কারো সাথে! যা তার জানার বাকি ছিলো না! আর আজ যা বলেছে, তা নেহালের মাথায় আয়রন রডের মতো বারি মারছে ক্ষণে ক্ষণে।
অফিসে বসেই এষকে কল দিলো নেহাল। কারন এষ বেশির ভাগ সময়ই ক্যাম্পাসের আশেপাশেই ঘুরাফেরা করে থাকে।
সত্যি সত্যিই এষ তখন ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়াতে বসে থাকে।
নেহাল কল দিয়েই চিন্তাগ্রস্ত স্বরে ” হ্যালো ব্রাদার” বললো।
এষ বুঝতে পারলো নেহালের মনের মধ্যে কি চলছে। সে ও জানে ঘটনা কি ঘটেছে। তাই নেহালকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠলো,
” ভাই, আমি জানি, নিহু এরকমটা করছে। খুবই অন্যায় করছে। আর এটাও জানি তোমাদের প্রায় চার বছরের মতো সম্পর্কটাকে ও আপনার বিনা দোষেই ও ডিসট্রয় করে দিচ্ছে! কিন্তু আপনি শক্ত হন ব্রো! নিহু ভুল করছে যে, সে সেটা ঠিকই বুঝতে পারবে”
নেহালের বুকটা কষ্টে ফেটে যাবার উপক্রম, কিন্তু কান্না করার কোনো উপায় নেই মানুষ জনের সামনে।
তার বুক ধড়ফড় করছে, হাত পা ক্রমাগত কাঁপছে। ঘাড়ের পেছনে ভীষণ ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।
চোখে অশ্রু টলমল করছে। এক কথায় নি:শব্দে সে চিৎকার করে কাঁদছে যেনো।
এষই আবার কথা বলে উঠলো।
” ব্রো, আমি আর্শিকে দিয়ে নিহুর সাথে কথা বলানোর ট্রাই করি, ওয়েট প্লিজ, কথা বলে দেখি যে ওর সমস্যাটা কোথায়! ওকে? ডোন্ট ওরি প্লিজ”
বলতেই নেহাল কলটা কেটে দেয়।
একফোঁটা অশ্রু টপ করে টেবিলে রাখা ফাইলে পড়ে।
অফিসে আর থাকা সম্ভব না, এই মুহূর্তে! অফিস আর কি? নেহালের এই মুহূর্তে মন চাইছে দুনিয়াটাই ছেড়ে দিতে।
নেহাল বাড়ি যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে অফিসের করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগলো।
বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য বসকে কিছু বলতে হয়নি তার। বসই তার চোখ মুখ দেখে বুঝে গিয়েছিলো যে, কিছু একটা ঘটেছে নেহালের সঙ্গে। কয়েক মাস যাবতই সে এরকম মনোক্ষুন্ন থাকে, বিষন্ন থাকে। এই বয়সে বিষন্ন থাকার কারন যে প্রেমিকা ছাড়া আর কেউ নয় সেটাও সবাই বুঝে। নেহাল ভাবছে, সবাই তাকে বুঝে, একমাত্র যাকে সে জানে-প্রাণে, মহাপ্রানে চায় সেই নিহু বাদে। নেহাল গাড়িতে চড়ে একাই ড্রাইভ করতে থাকে। আর চোখে অশ্রুর সাথে সাথে নিহুর অনিন্দ সুন্দর চেহারাটাও ভেসে উঠে। বার্বি ডলের ন্যায় দেখতে মেয়েটিকে সে এত ভালোবাসে, আর মেয়েটি ওকে এত জ্বালাচ্ছে। কল দিলে মামলা ঠুকে দিবে কিনা!
নেহাল ভাবলো, আর একটিবার সামনাসামনি যাবে সে নিহুর। তারপর তার সামনেই নিজেকে শেষ করে দেবে!
.
.
আর্শি, আরাধ্যা, পূর্ণ আর অগ্র চারজনই অপেক্ষায় ছিলো সব ক্লাশ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা নিহুকে প্রশ্নবানে ফেলবে যে, কেনো সে এমন করছে বেচারা নেহাল ছেলেটার সাথে! রিলেশনশীপে একশত পার্সেন্ট লয়াল আর ডেডিকেটেড মানুষ টাকেই এভাবে হার্ট করতে হবে কেনো?
কিন্তু নিহু ওদের চার জনকেই অবাক করে দিয়ে ঘটঘট করে সামনে দিয়ে চলে গেলো।
আর্শি দ্রুত কল দিলো। কিন্তু ওর ফোন তো চব্বিশ ঘন্টাই আবার সাইলেন্ট মুডে থাকে। তাই চার জনই দৌড়ে গেলো নিহুকে ধরতে।
দৌড়ে নিহুর পেছনে ওরা ভার্সিটি গেইট পর্যন্ত এগিয়ে গেলো।
কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে৷ নিহু কার জানি একটা চকচকে কালো মার্সিডিজে চড়ে সেখান থেকে ফুটেছে!
এই চার বছরের ফ্রেন্ডশীপে নিহু এত বড় অপমান চার বন্ধুকে কোনোদিন করেনি, যা আজ সে করলো।
এষও দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলো।
কার সাথে নিহু গিয়েছে, তা কেউ দেখেনি।
তবে গাড়ির পেছনে “ভি.আই.পি.” লিখাটা স্পষ্ট দেখেছে এষ!
.
.
ঘড়িতে সময় রাত নয় টা।
ড. লিওয়ের চেম্বারে অপরাজিতা আবার এসেছে।
আর্শিকে কল দিলেই চলে আসবে। এষকে বলা আছে। সে ই নিয়ে আসবে।
আবারো সেই ইজি চেয়ারে অপরাজিতা…
লিও নিজের হাতে আর্শির ছোটো থেকে ক্রমান্বয়ে বড়বেলার অনেকগুলো ছবি বিশিষ্ট একটা এলবাম আওড়াতে আওড়াতে বললো,
” তার মানে মিসেস অপরাজিতা, আপনি বলছেন যে, আর্শির বাবা আরশ নাংজু ছিলেন, আধা কোরিয়ান, সেজন্যই আরশির চেহারাও এমন? ”
অপরাজিতা উত্তর করলো “হ্যাঁ”।
লিও হেসে বললো,
” কিন্তু ওর হাসিটা আপনার মতো কেনো? ”
অপরাজিতা হাসলো, লিও অপরাজিতাকে শুধু খুশি করার জন্যই একথা বলেছে সেটা সে বুঝলো।
লিও বলে চললো, ” তার মানে অপরাজিতা পাঁচ বছর বয়স থেকে আপনি আর্শিকে পেয়েছেন?”
অপরাজিতা মাথা নাড়লো।
” আর পাঁচ থেকে বারো পর্যন্ত ওর কিচ্ছু মনে নেই!? ”
অপরাজিতা মাথা নাড়লো।
লিও আরো যোগ করলো,
” ওর বয়স যখন নয়/দশ তখন ওর বিয়ে হয়, যা সে ভুলেনি, ভুলেনি মানে ও সেটা স্বপ্নে দেখে, আর যখন সেটা স্বপ্ন দেখে ও নিজেকে বিবাহিতাই ভাবে, এবং অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় আচরন করে! রাইট?”
অপরাজিতা বললো, ” রাইট!”
আর ডক্টর বসাকের দেওয়া মেডিসিন খেয়ে ও আগের ঘটনা ভুলে যাওয়ার পাশাপাশি বর্তমান ও ভুলে যাচ্ছে! আসলে আপনি যা চাচ্ছেন তা হয়না মিসেস অপরাজিতা! আমাদের জীবনে যা যা খারাপ হয়, তা তা আপনি ভুলে যাবেন, আর ভালোটা মনে রাখবেন, এটা কিভাবে সম্ভব! ইটস ইমপসেবল। যেমন ধরুন আমাকে, আমার বাবা মা’ রা যায় আরো দশ বছর আগে, এটা আমার কাছে একটা খুবই দুর্বিষহ স্মৃতি। কিন্তু আমি এটা যদি ভুলে যেতে চাই, তা সম্ভব নয়! তেমনি আপনি! আপনি যদি ওকে সুস্থ্য করতে চান, তাহলে যেমন খারাপ স্মৃতিগুলোও মনে থাকবে সাথে ভালো স্মৃতি গুলোও থাকবে। খারাপ আর ভালোর সংমিশ্রনই হচ্ছে আমার মানব স্বত্ত্বা। ”
অপরাজিতা মাথা নাড়লো।
লিও বলে চললো,
” আমি এটা মানি যে, আর্শির চোখের সামনে ওর নিজের মা, ওর বাবাকে খু’ন করেছে, এবং বাবা দাদা, দাদীকে বাঁচাতে গিয়ে ও মাথায় ভীষণ চোট পেয়েছে এমনকি মরনাপন্ন হয়ে গিয়েছিলো , এটা খুবই খারাপ একটা স্মৃতি। তার পরো এই স্মৃতি অবশ্যই ভুলে যাবে না সে, এটা যদি সে ভুলে থাকে, তাহলে আমি তাকে সুস্থ্য স্বাভাবিক বলবো না, বলবো স্টিল নাউ সে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত!”
অপরাজিতা বাধ্যের মতো মাথা নাড়লো।
.
.
আর্শিকে বসানো হয়েছে, লিওয়ের চেম্বারে।
আর্শি ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। এষ আর অপরাজিতা বাইরে বসা।
আর্শিকে রকিং চেয়ারে বসিয়ে লিও তার সহকর্মি জাফরিনের সাথে কথা বলছে।
আর্শি ডক্টরকে বেশ অপছন্দ করে ছোটোবেলা থেকেই।
লিও আর্শির এরকম অবস্থা দেখে আর কিছুই প্রশ্ন করলো না।
জাফরিনই ফিসফিসিয়ে লিওকে বলে উঠলো,
” ডক্টর মিসেস অপরাজিতা যে মিথ্যা বলছিলো, তা বুঝতে পেরেছেন?”
লিও এক রহস্যময় হাসি হাসলো।
(চলবে)