এক মুঠো বুনোপ্রেম পর্ব-১৫+১৬

0
10

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ১৫

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

“আট ঘন্টা পার হয়ে গেলো নেহালের জ্ঞান ফেরার কোনো খবর ই নেই।
কিন্তু যার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিচ্ছিলো, সেই নিহুর মধ্যে কোনো ভাবলেশ নেই।

নিহু তার সেই কথিত প্রেমিক সহ পলাতক। নিহুর বাবা মায়ের কে কোথায় তারো কোনো খবর নেই। তারাও নিহুর খবর রাখে না কোনোকালেই।

নিহুর বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে এক ফাইল পয়জন নেহাল নিজের মুখগহবরে ঢুকিয়ে নিয়েছে। তারপর ফোনে মেসেজ দিয়ে চোখ যে বন্ধ করেছে তো করেছেই!
নিহুদের বাড়ির কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড নেহালকে ধরাধরি করে হসপিটালে এনেছিলো। তারাই নেহালের বাবা মাকে খবর দিয়েছিলো। ”

কথাগুলো এষকে বললো আরাধ্যা। সে সহ ওদের ক্লাশের আরো অনেকজন নেহালকে দেখতে এসেছে।

এষের কন্ঠ রোধ হয়ে আসছিলো। কয়দিন আগেই সুখদুখের কত কথা হয়েছিলো দু জনের মধ্যে।

এষ নিজেকে সামলে ক্রন্দনরত আরাধ্য কে নিয়ে আই সি ইউ এর সামনে দাঁড়ালো।

কাঁচের গ্লাস ভেদ করে নেহালের মৃত প্রায় শায়িত দেহ দেখা যাচ্ছিলো। মুখে অক্সিজেন মাক্স, হাতে লাইফ সাপোর্ট! আগের দিনের হাসিখুশি সে যুবক আজ মৃত্যুর সাথে লড়ছে।
এ দৃশ্য দেখার সাথে সাথেই এষের হৃদপিন্ডে যেনো একশ কুঠার আঘাত করলো।

গতকালই যে সামান্য দুলাভাই বলে ডাকার খুশিতে গোটা ক্লাশকেই স্টার কাবাবে ট্রিট দিয়েছিলো আজ তার কানে তাদের একটা কথাও পৌঁছাচ্ছে না। সবাই হসপিটালের ওয়েটিং রুমে শোকাহত মুখে বসে আছে।

একই ভার্সিটি তে না পড়া স্বত্ত্বেও যে ভার্সিটির সবার প্রিয়মুখ সে হলো সবার প্রিয় দুলাভাই নেহাল।
কিন্তু যার কারনে নেহালকে তারা দুলাভাই বলে ডাকে সেই নিহু হয়তো আজ অন্য কারো বাহুতে, তা ভেবেই সবার নিহুর প্রতি ঘৃণা চলে এলো।

এষ আর্শিকে ক্লিনিক থেকে বাসায় রেখেই অতিদ্রুত নেহালকে দেখতে চলে এসেছে এপোলো হসপিটালে।

নেহালের মতো যুবক যে কিনা নিজের কোনো অংশেই কম নয়, সে নিহুর ভালোবাসার কাঙ্গাল হয়ে দুনিয়া ছাড়তে বসেছে!

এ কেমন ভালোবাসা? প্রেয়সীকে না পেলে যে জীবন জীবন মনে হয়না, সে ভালোবাসা কেমন ভালোবাসা?

নেহাল পয়জন পান করার পূর্বে একটা পোস্ট করেছিলো তার ফেইসবুক ওয়ালে।

পোস্টটা এখন প্রায় ভাইরাল। সবার মোবাইলে এই পোস্টটা ছড়িয়ে পড়েছে। গত দু দিন আর্শিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এষ সোস্যাল মিডিয়ায় ঢুকতে পারেনি। অগ্র নিজের মোবাইল স্ক্রিনে থাকা সেই পোস্টটা এষ কে পড়তে এগিয়ে দিলো।

হসপিটালের করিডোরে বসেই সে পড়তে লাগলো পোস্টটা।

“আমার কুহু পাখিটা রে,

আমার কান্না তোর এত পছন্দ, তা জানলে আমি তো গ্যালনে গ্যালনে অশ্রু পাঠাতাম তোর জন্য। সেই অশ্রু দিয়ে তুই তোর সোনা বরণ অঙ্গ স্নান করিয়ে সূচিশুভ্র হতি। তোর অঙ্গ বেয়ে টপটপ গড়িয়ে যেতো আমার অশ্রু। আর তোর সেই সৌন্দর্য দেখে আমি বিনা যাতনায়ই মরে যেতাম!

জানিস রে কুহু পাখি, এই তিন চার টা মাস আমি অনেক কেঁদেছি রে, বাথরুমে, বেডরুমে, ডাইনিং এ, অফিস ডেস্কে, তোর ক্যাম্পাসের গেইটে, ক্যাফেটেরিয়ায়, তোর বাসার নিচে, ধানমন্ডি সাতাশে যেখানে তোরা সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিস সব জায়গায়! তবে ভুল করে ফেলেছি, ওগুলো যত্রতত্র ফেলে। ওগুলো আমার জমা করা উচিত ছিলো তোর জন্য। তারপর বোতলজাত করর র‍্যাপিং পেপারে মুডে তোকে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো।

নিহু পাখি রে, তোকে কোনদিন জি এফ মানিনি আমি, মেনেছিলাম আমার সোনা বউ, যা তুই মেনে না নিলেও তোর ক্লাশ মেট রা সবাই মেনে নিয়েছিলো। তুই কি ভাবতি নাকি, বউ হলে তোর পাংখা কাটা যাবে? কক্ষনো না, তোর ঐ পরীস্বরুপ পাং্খা দেখেই তো তোর প্রেমে পড়েছিলাম। ওগুলো আমি হারগিজ কাটতাম না।

তুই জানিস রে নিহু সোনা, পূর্ণ, অগ্র, আরাধ্যা, আর্শি সবাই আমাকে দুলাভাই বলেই ডাকতো। ওরাই বলতো, তোর পাশে নাকি আমাকে এত সুন্দর মানায় যেনো আমাদের জোড়া স্বর্গে সৃষ্টি হয়েছে!

নিহু রে, তোরে আদর করে একসময় কুহু পাখি বলে ডাকতাম, তোর মিষ্টি কন্ঠস্বর যে কোকিলকেও হার মানায়। জানিস, আমাদের এই চার বছরের রিলেশন শীপের গোটা সময়টায় আমাকে এটাই ভাবিয়ে রেখেছে যে, তুই এত সুন্দর কেনো? স্রষ্টা যেমন সৌরজাগতিক দিন একেকটার একেক সৌন্দর্য দান করেছেন, তোর সৌন্দর্য্যও তেমনি! একেক দিন তুই একেক রকম সুন্দর! প্রতিদিনই প্রাণবন্ত, প্রতিদিনই আরো বেশি কাম্য!

কুহু রে! ভালোই হবে রে! এই ক্ষণস্থায়ী ইহজগতে তুই আমার হবি না, তাতেই ভালো! কারন অবিনশ্বর পরজগতে যে চিরস্থায়ী ভাবে তুই আমার হবি! তোকে পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার লোভ এত বেশি যে ক্ষণস্থায়ী ইহজাগতিক পাওয়ায় আমার না মন পুরবে না পেট! হা হা!

ক্ষণস্থায়ী ভাবে আমার জীবনে আসলে আমার সেটা ভালোও লাগতো না, মন ভরতো না আসলে…. সেজন্যই মহাপ্রজ্ঞাময় বিধাতা মৃত্যুর পর অসীম সময়ের জন্য তোকে আমার যে করে দেবে!

আরও বহু কিছু বলবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম রে! আমার প্রাণ পাখি। তুই তো আবার আমাকে সব জায়গায় ব্লক করে রেখেছিস, তাই পোস্ট দিতে হলো। যদি কেউ পেয়ে চিঠিটা তোর কাছে পৌঁছে দেয়, আমার হয়ে!

জানিস রে! মনকে বহু বোঝালাম,
কিন্তু ইহজগতের তোকে হারানোর ব্যাপারটা আমার বেপরোয়া মন ও মগজ আর সইতে পারছে না।

তার চেয়ে বরং আমি তোর জন্য পরপারে কিছু সময় অপেক্ষা করি?

জানি, তুইও চলে আসবি, বেশি সময় নিস না প্রিয় আমার…

সায়ানাইডের একটা বোতল এখন আমার হাতে।
জানি এটা বহু তীব্র বি’ষ।

হিটলার আর তার প্রিয়তমাও এই বি’ষ পানেই মৃ’ত্যুবরণ করেছিলো।
তবে এখন সব জিনিসই যেমন নকলে ছেয়ে গেছে! কোনো কিছুতেই এখন আর ভরসা নেই।

জানিস, ম’রতে কেনো জানি ভয় পাচ্ছি না। উদ্বেগ ও হচ্ছে না। চিরশান্তির উদ্দ্যেশ্যে পরপারে পাড়ি জমাচ্ছি বলেই? … আবারো বলছি আসিস রে পাখি…

ভালোবাসায় ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবো সেখানে তোকে।

মনে রাখিস, তোর জন্য ফুলসয্যা সাজিয়ে আমি সেখানে অপেক্ষায় থাকবো তোর জন্য। তোর সঙ্গে প্রমত্তা সঙ্গমে হারাবো সেখানে চিরকালের জন্য রে..

যাই রে! অপেক্ষারা ডানা মেললো রে কুহুপাখি।

বিদায়….”

চিঠির সমাপ্তি হলো।
পড়ে এষের চোখ ভিজে এলো।
স্তব্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ। নড়া সম্ভব হচ্ছে না। পা দুটো অসাড় হয়ে আসছে, সেই সাথে মুখবিবির থেকে ফুসফুস পর্যন্ত!

মুখ দিয়ে গরম ভাঁপ বের হচ্ছিলো এষের!

অদূরেই কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। নেহালের মা বাবা ও বোন কান্না করছে খুউব।

এষ বহু কষ্টে পায়ে শক্তি সঞ্চয় করে সেদিকে এগিয়ে গেলো।

নেহালের মা পাগলের মতো প্রলাপ বকছে। বাবা ও বোন ও একে অপরকে ধরাধরি করে কাঁদছে। আশেপাশে নেহালের ও নিহুর অসংখ্য বন্ধু বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষী।
সবারই গলা ধরে আসছে৷

কি হবে নেহালের?
এভাবেই কি প্রকৃত প্রেম গুলোকে গলা টিপে মেরে ফেলা হবে পৃথিবী হতে।

পুলিশ এসেছে ইনভেস্টিগেশন করতে।
নেহালের এক আত্মীয় পুলিশের সাথে কথা বলছে।

নিহুর বিরুদ্ধে তারা কোনো কমপ্লেইন ই নিতে পারবে না জানিয়ে দিলো অফিসার।

অযথা তাদের ডেকে টাইম ওয়েস্ট করেছে বলে শাসিয়েও গেলো দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার।

সবাই সেই অফিসারের কথা শুনে যেনো মড়ার উপর খাড়ার ঘা খাওয়ার মতো আহত হলো।

.
.

বিছানায় এলোমেলো শুয়ে প্রলাপ বকছে আর্শি।
এষ রুমে ঢোকা মাত্রই আর্শি একরাশ অভিমানের চাহুনীতে অন্যপাশ মুডে শুইলো।

নেহালকে দেখে আসার পর থেকে এষের মনটা বিদ্ধস্ত, একেবারে ধবংসস্তুপে গেঁড়ে থাকা মৃ’ত মানুষের ন্যায় হয়ে আছে।

আর্শিকে অসুস্থ্য অবস্থায় ঘুম পাড়িয়ে রেখেই সে চলে গিয়েছিলো নেহালকে দেখতে।

তাই আর্শি নির্ঘাত অভিমান করেছে। কয়েকবার কলও দিয়েছিলো এষকে। তবে এষ রিসিভ ও করেনি।

আর্শিকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। অভিমানে একদিন হয়তো কথাই বলবে না এষের সাথে।

অপরাজিতাকে এখনো আর্শির শারীরিক অবস্থার কথা জানানো হয়নি। অপরাজিতা জানে যে, আর্শি সাময়িক ভাবে ভয় পেয়েছিলো, কিন্তু এখন সে ভালোই আছে।

আর এষও আর্শির অসুস্থ্যতার ব্যাপারটা পুরোপুরি চেপে গেছে তার ফুপির কাছে।

এষ তার মনের দু:খকে ক্ষাণিকক্ষণের জন্য দাবিয়ে রাখার জন্য আর্শির বালিশে শয়ন করে রাখা মাথাটাকে নিজের বুকে সজোরে চেপে ধরলো।

তারপর হু হু করে কেঁদে দিলো।

আর্শি এত সজোরে এষকে কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি।

তাই অবাক হয়ে এষের মুখের পানে চাইলো। কিন্তু এষের বুকে তার মাথাটা এত শক্ত করে চাপা রাখা হয়েছে যে, সে এষের চেহারা দেখতে পেলো না।
মনে মনে ভাবলো, অভিমান করায় হয়তো এষ কাঁদছে। তাই অভিমান ভেঙ্গে আর্শি নিজের মাথা বরাবর রাখা এষের বুকে একটা শক্ত শক্ত চুম্বন এঁকে দিলো।

এষের সমগ্র শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।

সে ক্রন্দনরত অবস্থায়ই বলে উঠলো,

” নেহাল, পয়জন খেয়েছে রে, নিহুর জন্য, তুই চিন্তা করবি বলে জানাই নি কিছু! তোর ফোনে আসা মেসেজ গুলোও ডিলিট করে রেখেছিলাম, তুই অসুস্থ ছিলি বলে, এখন মনে হচ্ছে না জানালেই অনেই বড় অন্যায় হয়ে যাবে! ভালোবাসার জন্য যে মানুষ এভাবেই মরতে পারে, তা তোরও জানা উচিত! কোন দিন আবার তুইও আমাকে এভাবে রিজেক্ট করে দিবি, সেদিন আমিও নির্ঘাত এভাবেই নির্দিধায় পয়জন পান করে নেবো জেনে রাখ!”

আর্শির চোখ দিয়েও অশ্রু গড়িয়ে গন্ডদেশ ছাপিয়ে গেলো এসব কথা শুনে।

(চলবে)

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ১৬

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

শেষ রাতে যখন ঘুম দুর্লভ হয়ে যায়, তখন মানুষ নাকি নিজের আত্মার সবচেয়ে কাছাকাছি চলে আসে। তখন সে গভীরভাবে নিজের আত্মাকে তথা নিজের সকল অনুভূতিগুলোকে প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করতে পারে। তাই তো গুণিজনেরা বলে থাকে, শেষ রাতের কান্নাই হলো প্রকৃত কান্না কারন তখন কেউ ছল কান্না কাঁদতে পারে না। আর মনোবিশারদ গণ বলে থাকে, শেষ রাতে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না, সব মিথ্যের জাল ভেদ করে সত্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এ শেষরাতের একাকিত্ব কে কেন্দ্র করেই। আর সারা রাত গভীর সাধণা করে তপস্বীরা শেষ রাতেই তাদের সিদ্ধি অর্জন করতেন।

এষের মাথাটা এখন পুরোপুরি ফাঁকা। সে নিজেও খুব করে চাইছে, একটা কিছু বিষয়ে অগাধ জ্ঞান সেও সিদ্ধি লাভ করুক।
আর্শিকে নিজের হাতে ঘুমের ঔষধ সহ অন্যান্য সকল ঔষধ যত্ন সহকারে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেও এষ নির্ঘুম বসে আছে আর্শির রুমের পাশের সেই করিডোরের রকিং চেয়ারটায়। সে আধা রাত পর্যন্ত খোলা আকাশের পানে চেয়ে চেয়ে পূর্ণিমা দেখেছে। আর্শির রুমের আলো নেভানো ছিলো বলে আর্শির চেহারা দেখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পূর্ণিমা চাঁদের মধ্যেই যে চেহারা তার কাছে ফুটে উঠে, তাকে আর আলাদা করে দেখার কিছু নেই। আর এখন রাত্রী শেষে আবেগ যেনো তাকে জেঁকে ধরেছে। চোখ দিয়ে আঝোরে পানি ঝড়ছে সেই আবেগে, সেই আবেগ আর অন্য কিছুর নয়, আর্শিকে নিজের করে নেওয়ার সে আবেগ।

সামান্য আলো ফুটে উঠায় এখন আর্শির ঘুমন্ত, নিস্পাপ মুখখানা ঝাপসা করে দেখা যাচ্ছে।

এষ পলকহীন তাকিয়ে আর্শির দিকে! এই সেই আর্শি, যার ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে তার গোটা জীবনাচরন আবর্তিত হচ্ছে।

এতখানি ভালোবাসা কারো প্রতি নিজের সৃষ্টি হলো কিভাবে তা ও তার জানা নেই।

আর্শির জন্য যে নিজেকে আগুন থেকে পানি বানিয়ে নিয়েছে সে!

ভীষণ রাগী, দাপুটে আর চঞ্চল এষ আজ এক্কেবারে একটা মাটির মানুষ বনে গেছে, কারন রাগারাগি আর্শির পছন্দ নয় বলে।
চোখে জল গড়াতে গড়াতেই এষ চলে যায় তার অতীতে, যেখানে রয়েছে আর্শির প্রতি তার নব্য সৃষ্ট অনুরাগের সেই সব মোহনীয় স্মৃতি।

হুট করেই মাথা না বোধক ঝাকুনি দিয়ে চরম বিরক্তি নিয়ে মেয়েটা বলে উঠতো,

” এই! দেখ, আমি তোর সাথে আর খেলবো না এষ!”

এ কথাটা বললেই এষ চিল্লাচিল্লি করে কান্না শুরু করতো। আর্শির বৈরী আচরন ও রিজেকশন সে মেনে নিতে পারতো না।

চিল্লাচিল্লি করে সারা বাড়ি এক করে ফেলতো। মা কে ডেকে জোরাজোরি করে বলতো,

” মা, মা, আর্শিকে বলো, যেনো ও আমার সাথে একটু হলেও খেলে মা, তাছাড়া কিন্তু ওর আমি বারোটা বাজাবো!”

আবার অপরাজিতাকে ডেকে তার হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করতো যেনো আর্শি তার সাথে খেলা করে, সামান্য হলেও তার সাথে খেলা করে!
অপরাজিতাও আর্শিকে অনুরোধ করতো।

এষের মা, চাচী, ফুপু সবাই মিলে অনুরোধ করলে পরেও আর্শি তার সাথে খেলতে রাজী ছিলো না।
কারন হিসেবে আর্শি মুখ গোমড়া করে বলতো,

” এষ আমার দিকে ক্যাবলার মতো করে চেয়ে থাকে কেনো? সেজন্যই তো আমি খেলবো না!”

এই প্রথম শুরু। এষের নামে অপরাজিতার কাছে প্রতিদিনই আর্শি বিচার দিতো, এই ছেলে কেনো তার দিকে ক্যাবলাকান্তের মতো চেয়ে চেয়ে থাকে?
“আমি এ বাড়িতেই আর থাকবো না” এভাবে বলে দিতো আর্শি বরাবরই।

কিন্তু এষ বুঝতো না, তাদের বাড়ির প্রতি আর্শির এতো বিদ্বেষ কেনো?

এষের মা মাঝে মাঝে এষকে বুঝিয়ে বলতেন,

” আর্শি এ বাড়ির মেয়ে না রে! তাই ওর এ বাড়ি পছন্দ না, ও বিদেশ থেকে এসেছে! ”

কিন্তু এষ এসব বুঝতো না। বরাবরই কেবলার মতো চেয়ে থাকতো।

এই চেয়ে চেয়ে থাকার মাধ্যমেই যে ভালোবাসার সূত্রপাত।

বহু জোরাজোরির পর আর্শি কালেভদ্রে এষের সাথে খেলতো আর সেই সুযোগেই এষ তাকে ক্ষণকালের জন্য হলেও স্পর্শ করে নিতো।

এষ সর্বপ্রথম প্রেমের প্রস্তাব দেয় সেই কৈশরেই। যখন তার বয়স ষোলো আর আর্শির পনেরো।

ছোটো থেকেই আর্শি চুপচাপ ছিলো। যেনো মনের মধ্যে কোন এক গভীর ক্ষত সে বয়ে বেড়াচ্ছে।

এষ নিজে ভীষণই চঞ্চল ছিলো। গোটা বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। আর আর্শি চুপচাপ ছিলো বলেই এষের এত পছন্দ হয়েছিলো। অনেক মানুষেরই বিপরীত ধর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণ হয়তো বেশিই থাকে। এষের ক্ষেত্রেও সেটাই৷

আর্শির চোখ ভালোকরে দেখার আশায় এষ আর্শির চশমা লুকিয়ে রাখতো প্রায়ই। কিন্তু একবার চশমা লুকিয়ে রাখায় আর্শি সিঁড়িতে পড়ে হাত ভেঙ্গে ফেলেছিলো। সে স্মৃতি আওড়াচ্ছিলো এষ।

ঠিক সেই সময়ই এষের ফোনে কল আসে। তার ছোটোবোন কায়ার।

ভাবনারত মুখটাকে হাস্যরত বানিয়ে সে কল রিসিভ করলো।

” এই..এত ভোরে কল দিয়েছিস কেনো?”

কল রিসিভ করেই এষ এভাবে হার্টলেস ভাবে প্রশ্ন করায় কায়া বিস্মিত হলো, সে ন্যাকামির চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” তোমার ওখানে ভোর আর আমার এখানে সবে সন্ধে হলো। আফটার অল এত রি এক্ট করা লাগবে না, আই কলড আর্শি, নট ইউ! তো কই তোমার মাস্টার আর্শি ? যার পা টেপার জন্য তুমি ইউ এস হতে বিডি তে দৌড়ে চলে গিয়েছো?”

এষ দাঁত খিঁচে বললো,

” মাইন্ড ইউর ল্যাংঙ্গুয়েজ! আর্শি ইজ মাই ফিয়ন্সি, আ’ম নট হার সারভেন্ট!”

এই কথা শুনে কায়া এষকে হাসতে হাসতে বললো,

” আর্শির ভার্সিটির ফ্রেন্ড রা তোমাকে নিয়ে মিমস বানাচ্ছে, যে তুমি নাকি ওদের ভার্সিটির মধ্যে আর্শির বডিগার্ড আর আর্শিদের বাসায় আর্শির পি.এ এর দায়িত্ব এজ ওয়েল এজ সারভেন্ট এর দায়িত্ব পালন করো?”

এষের মেজাজ বিগড়ে গেলো, সে চেঁচিয়ে বললো,

” ইয়েস, আ’ম আ সারভেন্ট অব আর্শি, আমি আর্শির চামচা, তোর কোনো সমস্যা? আমি আমার ভালোবাসার জন্য আর্শির সারভেন্ট হতেও রাজী, আর্শির জন্য পথে পথে ঘুরতেও রাজী, পাগ্লামীর সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করতেও আমি রাজী। পারলে নিজের জন্য এমন একটা বন্য প্রেমিক যোগাড় করে দেখা তো! জানি পারবি না, কক্ষনো না, তাইতো তোর এত জেলাসি! ক্লিয়ারলি বলতে পারিস না যে, আর্শিকে দেখে জ্বলিস তুই?”

কায়া নিজের বশ্যতা স্বীকার করলো, মজা করতে গিয়ে তার ভাই তাকে হিতে বিপরীত বুঝে ফেললো? সংগে সংগে হেসে দিয়ে বললো,

” হোয়াট ননসেন্স! ব্রো, আই রিয়েলি কিড উইথ ইউ! আমি জানি তোমার ভালোবাসার গভীরতা কতখানি, ভালোবাসার মানুষকে প্রপার মর্যাদা দেওয়ার মাঝে কোনো ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স( হীনমন্যতা) নেই! নেই, কোনো ডিজ অনার(অমর্যাদা), আমি তোর ভালোবাসাকে সম্মান করি। ছোটো থেকেই আমি তোকে সাপোর্ট দিয়ে আসছি। একজন আলঝেইমার পেইসেন্ট কে তুই ডিপ্লি লাভ করিস! যে কিনা আজ বাদে কাল তোকেও হয়তো না চিনতে পারে, না মনে রাখতে পারে তোর কোনো সেক্রিফাইস। তারপরো সেই মেয়েটির জন্যই তোর মনে এত প্রেম, একে শুধু প্রেম বলা ভুল হবে রে ব্রো, এ এক বুনোপ্রেম!”

এষ নিজের বোনের কাছ থেকে এত সাপোর্ট পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলো। পালটা হেসে কায়া বলল,

” ব্রো জানিস? আমাদের বিডিতে আসার সব ডকুমেন্টস রেডি, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই আমরা ফ্লাই করবো, তোর ওখানে! আর আমরা গিয়েই তোদের বিয়ের ডেইট ফাইনাল করবো। তাই আর্শিকে দরকার ছিলো, কিন্তু ওর ফোন তো ও কয়েকদিন থেকেই ওঠায় না? তাই বাধ্য হয়ে তোকে কল দিলাম, মম আর্শির জন্য কিছু শপিং করেছে, ওগুলো তোদের বিয়ের জন্য, আর্শিকে দেখাতে পারলে ভালো লাগতো..”

এষ বললো,

” ওকে ফাইন! বাট আর্শির শরীরটা বেশ কয়েকদিন যাবৎ ভালো যাচ্ছে না, ওকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি, জাগলেই তোকে ভিডিও কল দিয়ে দিবো, ওকে ডিয়ার?

” ওকে! বাই…”

কায়ার সাথে এসব কথা শেষ করে এষ ব্যালকনি হতে আর্শির রুমে ঢুকলো সন্তর্পণে।

জানালা খোলা থাকায় সূর্যের সোনারোদ আর্শির চুলে আর চিবুকে পড়ে চমকাচ্ছিলো।

আর্শিকে ভীষণই আকর্ষণিয় ও মোহনীয় লাগছিলো এষের নিকটে। ইচ্ছে হলো, নিমেষেই সকল দুরত্ব ঘুচিয়ে আর্শিকে নিজের সাথে এক করে নিতে। এষ ধীর কদমে অগ্রসর হয়ে আর্শির বিছানায় বসে পড়লো।

এষের নিজেকে দমন করতে কষ্ট হচ্ছে, আবার ভাবছে, আর্শির অনুমতি ছাড়াই তাকে স্পর্শ করা সমীচিন হবে নাকি?

আর্শির অগোচরে একবার সামান্য আদর করে দিলেই কী ক্ষতি কি লাভ এর হিসেব মিলাতে মিলাতেই এষের ফোনে আবার কল এলো।

অপরাজিতার কল।

” এষ! আব্বু আই হ্যাভ লস্ট মাই ফাইল, ফাইলটা খুবই এসেনশিয়াল, আমি হারিয়েই ফেলেছি নাকি রুমেই রেখে এসেছি, তা ঠিক মনে করতে পারছি না রে! ”

এষ অপরাজিতা কে অভয় দিয়ে বললো,

” ডোন্ট ওরি ফুপি, আমি দেখছি তোমার রুমে গিয়ে”

অপরাজিতা যেনো ফাইল হারিয়ে নিজের মাথা খেয়েছে, সে স্ত্রস্ত হয়ে বলতে লাগলো,

” আমার রুমের চাবি তো আবার তুমি পাবে না আব্বু! আমি যেখানে রেখেছি, ওটা খুলতেও আরেকটা চাবি লাগে!”

এষ রাগত স্বরে বললো,
” হোয়াট ননসেন্স! তোমার রুমের এত সিকিউরিটি রাখার কি দরকার? সি সি ক্যামেরা তো লাগানো আছেই, তারপর আবার ডুয়াল লক৷ সিট! তোমার কি আমাদের বিশ্বাস হয় না? আমি বা আর্শি কি তোমার রুমে ঢুকবো নাকি? ”

অপরাজিতা এষকে রাগ ভাঙ্গানোর উদ্দ্যেশ্যে কোমল স্বরে বললো,

” আব্বু আমার, রাগে না সোনাটা! তোরাই তো আমার সব? তোরা আবার চোর হবি কেনো? তোরাই তো আমার সম্পদ! আমি ঘুনাক্ষরেও ওসব ভাবিনি। জানিস ই তো গভমেন্ট জব করি। আউটসাইডাররা একবার বাসায় হামলা চালিয়েছিলো বলেই তো এত সিকিউরিটি! ফাইলটা আমার খুবই দরকারী, আর আমার রুমে তেমন কিছু নেই, তবে প্রায়ই ফরেন মিনিস্ট্রির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আমার জিম্মায় থাকে যেগুলো খুবই কনফিডেন্সিয়াল, সেজন্যই রুমে এত সিকিউরিটি রেখেছি, আমার লকের কোড তোকে মেসেজ পাঠাচ্ছি, ওটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে তুই দেখ, ফরেন মিনিস্ট্রির কোনো মোটা ফাইল যার উপরে লেখা ওইপন( অ’স্ত্র) প্যাক্ট বিটুইন বাংলাদেশ এন্ড ইন্দোনেশিয়া এরকম আছে কিনা, আর সেটা পেলে তুই আমাকে সেটা স্ক্যান করে মেইলে দিয়ে দে, ইউদেন টু হাওয়ার। দু ঘন্ট পর এখানে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় আমার একটা মিটিং আছে, চার ঘন্টা ব্যাপি। আর ঐ মিটিং এ ঐ হলুদ রংয়ের ফাইলটার ইনফরমেশন গুলো আমার খুবই দরকারী! ”

এষ তার ফুপির কথাগুলো বুঝলো। তারপর অপরাজিতার থেকে প্রাপ্ত মেসেজ অনুযায়ী রুমে ঢুকে গেলো৷

ডেস্কে একগাদা ফাইলের মধ্যে থেকে হলুদ রংয়ের ফাইল খুঁজতে তাকে ভীষণই বেগ পেতে হচ্ছিলো। কারণ সেখানে প্রায় হাজার খানেক ফাইলের বিশাল সমারোহ। খুঁজতে খুঁজতেই একটা বড় মোটা ডায়রি ঝপ করে ফ্লোরে পড়ে গেলো।

এষের চোখ আটকে গেলো সেখানে। কৌতুহলী হয়ে শপে নিলো ডায়রিয়া নিজের করতলে।

” একি! এটা তো আর্শির ডায়রি! উপরে আর্শির নাম লেখা, আর তারিখ দেখে বুঝা যাচ্ছে এটা দশ বছর আগেকার! ”

এষ কৌতুহলি চিত্তে ডায়রিটা খুলে নিলো।

(চলবে)