#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম
পর্ব ১৭
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
এষ এক পাহাড় কৌতুহল নিয়ে আর্শির ডায়রিটা হাতে তুলে নিলো। অপরাজিতার কক্ষটা অনেক বড়। এ কক্ষে সে এর আগে বহুবার প্রবেশ করেছে, তবে একা একা কোনোদিন কাউকে এ ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি অপরাজিতা। চাকর, বাকর সহ অন্যান্য গেস্ট এমনকি আর্শিও এ কক্ষে অপরাজিতার অনুপস্থিতিতে কোনোদিন প্রবেশ করেনি। এ ঘর পুরোই সিসি টিভি ক্যামেরায় আবৃত। আর রুমের স্পেশাল চাইনিজ কোডিং লক তো আছেই। এ ঘরের এত নিরাপত্তা নিয়ে এষ আজকের আগে কোনোদিন মাথা ঘামায়নি।
অপরাজিতার কক্ষটা দারুন গোছালো। রুমে ঢুকেই বিশাল টার্নএবল কট। বিশাল কাবার্ড, ডেস্কটপ কম্পিউটার, তাতে স্ক্যানার ও প্রিন্টার যুক্ত করা আছে। কক্ষের এক কোনায় এক বিশাল বড় বুক সেল্ফে বিশাল এই ফাইলের সমারোহ কখনো তার নজরে পড়ে নি। আর এখানে আরো অনেক ডায়রি আছে৷ তবে আর্শির ডায়রিটাই তার হাতে প্রথমে চলে এলো! একি মিরাক্কেল নাকি অন্য কিছু? হতে পারে! আর বিধাতা হয়তো এটাই চেয়েছিলেন। যেকোনো উছিলায় ডায়রিটা যেনো এষ পেয়ে যায়!
ডায়রিটা এমন যে, সে সেটা পড়ার তাগিদে অপরাজিতার কক্ষেই একটা বিনব্যাগে ধপাস করে বসে পড়লো। ডায়রি পেয়ে বেমালুম ভুলে গেলো যে, অপরাজিতার মহা গুরুত্বপূর্ণ হলুদ ফাইলের সন্ধ্যানে সে উক্ত কক্ষে প্রবেশ করেছে।
এষ ডায়রির পাতা উল্টাতে লাগলো।
প্রথম পৃষ্ঠাতেই আর্শির ছোটোবেলার একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবিতে সে একাই বসে। এষের দৃষ্টিতে কি মোহনীয় সুন্দর সে ছবি! এষের দৃষ্টিতে আর্শি মানেই সৌন্দর্য, আর্শি মানে চক্ষুর শীতলতা। এষ ছবিটাতে একবার নিজের আঙ্গুলগুলো বুলিয়ে নিলো।
আর্শির বয়স যখন দশ/এগারো তখনকার এ ডায়রিটা। ছবিতে দশ/এগারো বছরের আর্শিই বসে আছে হাস্যোজ্জ্বল মুখে। সুস্পষ্ট টাইম ও ডেইট উল্লেখ করে লিখেছিলো সে। লেখা দেখেই বুঝা যাচ্ছে এটা তার অল্প বয়সের অধিক লিখা। অর্থাৎ এত অল্প বয়স থেকেই আর্শির হাতের লেখা অসামান্য সুন্দর ও নিঁখুত।
ডায়রি খুলেই এষের মনে হাজার প্রশ্ন উদয় হলো। পৃষ্ঠা উল্টালো সে।
আরো কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে কোনো লেখা নেই শুধু কিছু অচেনা মানুষের ছবি আঠা দিয়ে আটকানো রয়েছে। এষ যাদের কাউকেই চেনে না। তবে একজনের ছবি দেখে সে টাস্কি খেলো। আর্শির চেহারারই পুরুষ ভার্সনের এক ছবি। অবিকল আর্শির মতো দেখতে সে। আর্শির নাক, চোখ, ঠোঁট, মুখের কাট সবই যেনো এক। এষের বুঝতে মোটেও বেগ পোহাতে হলো না যে, ইনিই আর্শির বাবা। যার সম্পর্কে সবকিছুই অজ্ঞাত ছিলো তাদের পরিবারে৷ অপরাজিতা একদিন হুট করেই বাড়িতে জানিয়েছিলো যে, সে বিয়ে করে ফেলেছে। আবার কয়েক বছর পর আরেক দিন এক মেয়ে নিয়ে হাজির হলো সে এষের দাদাবাড়িতে তথা অপরাজিতার বাবার বাড়িতে। অপরাজিতার একরোখা স্বভাবের জন্য সে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর তার কেউ কোনো খবর রাখতো না বলে, অপরাজিতার চাকরি তে ঢুকার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে সবাই অজ্ঞাত ছিলো। আর অন্য ছবিগুলো এষ ছবিগুলোকে স্কিপ করে গেলো। সে আশ্চর্য হলো, আর্শির শরীরের ঘ্রাণ ও পাওয়া যাচ্ছে এ ডায়রির পৃষ্ঠা গুলোতে।
যেই এষ আর্শির সকল ছোটোখাটো বিষয়ে খেয়াল রাখে, সেই এষ এই ডায়রির ব্যাপারে এতটা অজ্ঞাত?
দশ বছরের ছোটো আনাড়ি লেখক যেভাবে লিখে ঠিক সেভাবে লিখেছে তার ডায়রি ভর্তি করে। এষ পড়তে লাগলো,
প্রথমেই জানাই, লাভ ইউ পাপা! কারন আমার পাপা আমাকে আজ এই ডায়রিটা কিনে দিলো। কিভাবে ডায়রি লিখতে হয়, তা আমার জানা নেই। তবে ডায়রিটা নাকি আমার নিউ মাম্মী পাঠিয়েছে আমার জন্য। সে প্রায়ই অনেক সুন্দর সুন্দর গিফট পাঠায় আমার জন্য। আমার মাম্মামের সাথে পাপার ঝগড়া চলছে বলে নতুন মাম্মী আনবে আমার পাপা। নতুন মাম্মী আমাকে খুবই ভালোবাসে। মানুষ এটাকে বলে স্টেপ মম। তবে আমার স্টেপ মম অনেক আদুরে। আমাকে ভীষণই ভালোবাসে। এত বেশি কেয়ার আমার নেয় যে বলে বুঝানো সম্ভব না।
পাপা বললো আজ থেকে সারাদিন যা যা ঘটবে তা রাতের বেলা এই ডায়রিতে লিখে রাখতে, কেননা ডায়রি লেখা অনেক ভালো একটা অভ্যাস। পাপার নিজেরও অনেক ডায়রি ছিলো সে বলেছিলো।
আজ দাদা, দাদী আমার নতুন মাম্মামকে আমাদের বাড়িতে ডেকেছে। প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা থেকে মাম্মী বাড়িতে চলে আসে। সেজন্য আমার অনেক খুশি লাগছে। তবে আমার স্টেপ মমের বিষয়টা পাপা আমাকে স্কুলের কারো সাথে শেয়ার করতে মানা করেছে। কারন মানুষ স্টেপ মম আছে এমন জানলে নাকি আমার সাথে মেশবে না! আমি অবশ্য কারো সাথে এটা শেয়ার করবোও না, একচুয়ালি আমার স্কুলের কোনো বন্ধুই নেই। সবাই আমাকে ইন্ট্রোভার্ট বলে থাকে। মানে আমি কারো সাথে মিশতে পারি না। তবে আমি সবার সাথেই মিশতে চাইলেও পারি না। কেন জানি? এটা কি আমার দোষ? এটা উল্লেখ্য যে আমরা এখন সবাই বাংলাদেশে শিফট হয়েছি বছর দুই আগে। দাদা দাদীর কাছে কোরিয়া এখন ভালো লাগে না। দাদা যদিও একজন কোরিয়ান। তাও তার কাছে বাংলাদেশ পছন্দ। কোরিয়ায় বাংলাদেশের মতো গ্রাম নেই, আর দাদা তার শেষ জীবনটা গ্রামেই কাটাতে চান বলে এদেশে চলে এসেছেন। দাদা দাদীকে পাপা নারায়নগঞ্জের একটা গ্রামে চমৎকার একটা কাঠের বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। বাড়ির সামনে বিশাল বাগান। পেছনে বিরাট পুকুর। পাপা তো থাকেন ঢাকায়। সে এখন আই সি ডি ডি আর বি, যেটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রিসার্চ সেন্টার সেটার সাইন্টিস্ট! আমার ভাবতেই গর্ব লাগে যে, আমার বাবা এত বড় একজন সাইনটিস্ট!
আমি যেহেতু গ্রামের একটা স্কুলে পড়ি সেই হিসেবে পাপা আমাকে আমার স্টেপ মমের বিষয়টা হাইড করতে বলেছেন, কারন স্টেপ মম জিনিস টা নাকি এই ভিলেজ রুল অনুসারে ব্যাড কালচারের মধ্যে পড়ে।
আর আজ সারাদিনের বিষয় লিখতে হলে আমি এটা লিখবো যে, আজ সারাটা দিন আমার অনেক ভালো কেটেছে। স্কুল থেকে এসেই পুকুর পাড়ে বসেছি। আর পুকুর পাড়ে বসলেই চমৎকার এক হাওয়া গায়ে লাগে, যে হাওয়ায় রয়েছে মাটির গন্ধের মাদকতা, যে হাওয়ায় রয়েছে শস্য ক্ষেতের কাচা সবুজের উল্লাসের নেশা। একচুয়ালি এই বাড়ির পুকুর পাড়ের চারপাশে ঘেরা বিভিন্ন গাছ পালার সমারোহ ও কৃষি ক্ষেত। সত্যিই পাপার সাথে থেকে বহু দেশেই আমার ঘুরা হলো। তবে বাংলাদেশ আমাকে মুগ্ধ করে বরাবরই। এখন বাংলাদেশে স্থায়ী হতে পারলেই আমি খুশি। ”
এষ শুধু এটুকুই পড়তে পারলো। সে এই ডায়রি পড়ায় এতটাই মত্ত ছিলো যে অপরাজিতা যে তাকে কত্তগুলা কল দিয়ে দিয়েছে সে খেয়াল তার নেই।
ফোনের অপর পাশে অপরাজিতার কন্ঠে তাড়া,
” আব্বু, পেয়েছো ফাইলটা? কি আপডেট? ”
এষ কিছুটা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো,
” হাজারটা ফাইল এখানে! তোমার নীল না লাল ফাইল তো আমি দেখি না!”
অপরাজিতা কাতর কন্ঠে বললো,
” সোনা আমার! নীল, লাল নয়, হলুদ ফাইল খুঁজতে পাঠিয়েছি আমি তোমাকে! আর্শির সাথে থাকতে থাকতে দেখি তুমিও আর্শির মতো ক্ষণে ক্ষণে সব ভুলে যাওয়ার রোগে পড়েছো! ”
এষ টেনে টেনে তার ফুপিকে ” স্যরি” বললো।
তারপর গটগট করে বলা শুরু করলো,
” ওয়েট ফুপি, আমি এক ঝটিকায় তোমার ফাইলটা খুঁজে দিচ্ছি! যাস্ট ওয়েট আ বিট। ”
বলেই ফোন রেখে দিলো।
“হলুদ ফাইল, হলুদ ফাইল..হোয়ার আর ইউ? হোয়ার আর ইউ, হাউ ডু ইউ ডু?”
টেনে টেনে গেয়ে গেয়ে আংগুল নেড়ে নেড়ে খুঁজতে লাগলো সে ফাইলটা।
মিনিট পাঁচেক খুঁজার পর সে পেয়েও গেলো মোটা হলুদ ফাইলটা। একদম হাতের নাগালের মধ্যেই ছিলো সেটা।
পেয়েই সেটা বের করে নিয়ে ফুপিকে মেসেজ পাঠালো,
” গট ইট, আই যাস্ট স্ক্যান ইট টু ইউ, প্লিজ স্টে কোয়াইট!”
ফাইলটার সাথে সাথে সে আর্শির ডায়রিটা নিতেও ভুললো না।
ডায়রিটাকে তার শুধুমাত্র একটা ডায়রিই নয়, মহামূল্যবান এক সম্পদ মনে হচ্ছিলো এষের কাছে। কারন এতে আর্শির অতীতের এত এত তথ্য দেওয়া আছে, যেগুলোকে তার এক ধরনের তথ্য ভান্ডার বলে মনে হচ্ছিলো। আর্শির সম্পর্কে এতকিছু অজানা ছিলো এতদিন এষের কাছে? এটা ভেবেই বুকের মধ্যে যেনো কাঁটা ঘায়েল করে গেলো এষের।
এষ ঘড়ি দেখলো, মাত্র দু ঘন্টা পরেই নাকি ফুপির মিটিং আছে!
ডায়রি পড়ে ফাইল খুঁজতেই তার চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গিয়েছে। আর এখন আছে আর মাত্র এক ঘন্টা বিশ মিনিট। এই এক ঘন্টা বিশ মিনিটে কি সে আগে ডায়রিটা পড়বে নাকি, আগে ফাইলের দুইশো পৃষ্ঠা স্ক্যান করে পাঠাবে তা ভেবে পাচ্ছিলো না।
ঠিক সেই সময়ই আবার অপরাজিতার কল এলো,
তার কন্ঠে তাড়া,
” এষ, তুই কি আবার ফাইলের কথা ভুলে গেছিস নাকি? হারি আপ প্লিজ, আমার পার্সোনাল মেইলে দিস, আবার প্রফেশনাল টায় দিস না বাবু”
” ফুপি, তুমি আমাকে আর বাবু ডাকবা না তো!”
” আচ্ছা, আচ্ছা, বাবু ডাকবো না, বুড়ো ডাকবো, তাড়াতাড়ি স্ক্যান করে পাঠা না ডিয়ার, আমাকে বুড়ো বয়সে এত প্যারা দিস কেনো? আমাকে ওটা আবার এনালাইজ করতে হবে না? না পাঠালে কিভাবে কি?”
এষ রুষ্ট স্বরে বললো,
” ওকে ডোন্ট ওরি! উইদেন ফিফটিন মিনিটস তুমি পেয়ে যাবে”
তারপর ঝটপট সেগুলো স্ক্যান করা শুরু করলো।
আর এই পুরোটা সময় আর্শির ডায়রিটা সে বগলদাবা করেই আছে।
মনে মনে শুধু একই তাড়া আর্শি ঘুম থেকে উঠার আগেই যেনো সে ডায়রিটা পড়ে শেষ করে ফেলতে পারে।
(চলবে)
#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম
পর্ব ১৮
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
এষ তার ফুপি অপরাজিতাকে গোটা দুশো পৃষ্ঠার সেই ফাইল স্ক্যান করে পাঠিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলো। আর ঘর্মাক্ত বদনে বিছানায় ধপ করে বসে গেলো। এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দুটো ফ্যানই ছেড়ে দিলো। মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে মনে মনে ভাবলো,
” সুযোগ পেয়ে ফুপি আজ আমাকে কেরানীগিরির কাজটাও করিয়ে নিলে! বেশ! তোমার মেয়ের বডিগার্ডের দায়িত্ব পালন করি, আর তোমার কেরানী! তোমরা দুজনের কেউ কম যাও না!”
স্মার্টফোন বের করে চট করে মেসেস করে অপরাজিতাকে জানালো,
” চেইক ইউর ইনবক্স, আই সেন্ড দ্যা হোল ফাইল রাইট নাউ”
আস্ত চল্লিশ মিনিট লেগেছিলো গোটা ফাইলটা স্ক্যান করে সেন্ড করতে। এষ ভেবেছিলো কিনা দশ পনেরো মিনিটেই শেষ হবে।
অপরাজিতাকে মেসেজ পাঠিয়ে এশ দেখতে পায় ফোনে আরো একটা মেসেজ এসেই ছিলো, যা সে পূর্বে লক্ষ করেনি।
আরাধ্যা মেসেজ পাঠিয়েছে! বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো এষের , কোনো খারাপ বার্তা নয় তো! মেসেজ খুলতেই লেখা গুলো চক্ষু ভেদ করে এপাড় ওপাড় চলে গেলো,
” এষ ভাইয়া, নেহাল ইজ নো মোর..! ”
এষের মাথায় বিনা মেঘেই ব্জ্রাঘাত হলো।
“নেহাল আর নেই? হোয়াট? এ কেমন বিচার? একজন আরেকজনকে ভালোবেসে এভাবে জীবন দিয়ে দিতে পারে?”
এষের কলিজাটায় বিশাল এক ফলা যেনো খোঁচা দিয়ে গেলো। অশ্রুধারা বেয়ে এলো গন্ডদেশ বরাবর।
অশ্রু টলোমলো চক্ষু নিয়েই সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” নেহালের মৃত্যু তো মৃত্যু নয় এ এক খু’ন। ঠান্ডা মাথায় নেহালকে খুন করেছে নিহু। হেইট ইউ নিহু! কেউ তোমাকে না ধরতে পারলেও, এই প্রকৃতিই তোমাকে বিচার করবে অবশ্যই! অবশ্যই ”
একজন স্বল্প পরিচিত যুবকের জন্য এষ ঠাঁই বসেই প্রায় হাউমাউ করে কেঁদে দেবে।
ছেলেটার আবেগ শুধু এষকেই নয়, ঘায়েল করেছে দেশের আরো লক্ষ্য মানুষকে।
এষ টিভি ছাড়লো। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছিলো নেহালের বিষয়টা।
” বনানীর ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে ভালোবেসে যুবকের আ’ত্মাহুতি! ”
এষের আর দেখার সাহস হলো না।
নেহালের শেষকৃত্তে অংশ নেবে বলে এষ মনস্থির করলো।
আর্শিকে জানাবে নাকি জানাবে না সে বিষয়েও একটা দ্বীধায় পড়ে গেলো সে, কারন আর্শি ইদানীং নেগেটিভ কোনো কিছুই আর সহ্য করতে পারে না।
সব কিছুতেই ওভার রি এক্ট করে। নেহালের মৃত্যুর খবর শোনালেও সে কষ্ট পাবে আবার না শোনালেও কষ্ট পাবে। আর আর্শির উপর কোনো প্রকার প্রেশার দেওয়াও নিষেধ। তাই এষ শোনানোরই সিদ্ধান্ত নিলো।
কিন্তু কান্না লুকাতে ভীষণই কষ্ট হলো।
আর্শিকে ঘুম থেকে ডেকে হালকা নাস্তা করিয়ে নিজের ফোনের স্ক্রিনটা আর্শির সামনে তুলে ধরলো। মুখে উচ্চারণ করার সাহসে কুলোচ্ছিলো না।
কিন্তু এষকে অবাক করে দিয়ে আর্শি বলে উঠলো,
” নেহাল? কে নেহাল ?”
এষের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, আর্শি আবার অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছে।
স্তব্দ মুখে ক্ষাণিকক্ষণ বসে থেকে এষ সুধালো,
” বল তো আমি কে? আমাকে চিনতে পারছিস?”
আর্শি তার মাথায় এলোমেলো হওয়া চুলগুলোকে চুলগুলোকে চুলকে বললো,
“তোকে চিনবোনা কিভাবে, ইউ মাই ফুট! আমার চামচা তুই, না চেনার কি আছে?”
আর্শি হেসে গড়াগড়ি দিলো বিছানা জুড়ে।
এষ বিষাদগ্রস্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। ভালোবেসে সে নি:স্ব আজ, এমন নি:স্ব যে, আর্শি তাকে অপমান করলেও তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, আর্শিকে ছাড়া। আর্শিকে দেখা ছাড়া তার হৃদপিণ্ড যেনো স্পন্দন দেয় না। মুহূর্তে মুহূর্তে রক্ত পাম্প করে শিরা উপশিরায় পৌঁছে দেয় না। আর্শিকে ছাড়া সে যেনো প্রাণহীন অসার এক দেহ।
তাই এষ আর্শির কথা স্বীকার করে নিলো।
” হুউম, আমি তোর চামচা, তো এখন কি লাগবে ম্যাডাম!”
” লম্বা ঘুম ঘুমিয়েছি আজ, মাথাটা একদম ফ্রেশ, আচ্ছা আজ কি বার?
” শুক্রবার!”
আর্শি হাত মাথার উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে বললো,
” ভাবছি আজ লং ড্রাইভে বের হবো”
নেহালের মৃত্যু সংবাদের রেশে এষের তখনো হাত পা কাঁপছে।
সে আর্শিকে ছলোছলো চোখে বললো,
” আমার অনেক ক্লোজ ফ্রেন্ডের শেষকৃত্য আজ দুপুর দুটোয়, আমাকে যে ক্ষাণিকক্ষণের জন্য যেতে হবে!”
আর্শি উৎফুল্ল হয়ে বললো,
” যা, নো প্রব, তবে যাস্ট তিনটায় ব্যাক করবি, আমি লং ড্রাইভে বের হবো”
বলেই অপরাজিতার নাম্বারে কল লাগাতে লাগাতে বললো,
” মাম্মীকে বলি আমার ভেরি ফার্স্ট বি এম ডাব্লিউ একটা বাইক লাগবে!”
এষ আশ্চর্য ভঙ্গিতে সুধালো,
” যেই মেয়ে বাই সাইকেলই চালাতে জানে না, পড়ে গিয়ে চশমা ভেঙ্গে যাবে বলে, সেই মেয়ে চালাবে বাইক? হোয়াট আ জোক্স!”
আর্শি এষের কথা শুনে তার মুখ বাঁকালো, তারপর বললো,
” বললেই হলো, অগ্রের কাছে আমি যে বহু আগেই বাইক চালানো শিখেছি, তা তুই জানিস? তুই তো ছিলি আমেরিকায়, আমার সম্পর্কে তুই জানিস কি?”
এষের নিজেকে খুবই ছোটো মনে হলো নিজের কাছে। আর্শি সম্পর্কে তার এত তথ্য অজানা। অবশ্য এর এক যুক্তিযুক্ত কারণও আছে। আর্শি তো আগে তাকে পাত্তাই দিতো না। ছোটো থেকে প্রেম থাকলেও আর্শিকে প্রেমিকা হিসেবে তো পেয়েছে সবে কয়েক দিন হলো।
এষ রুকাইয়া খালাকে ডেকে আর্শির নাস্তা দিতে বললো।
আর্শির লেখা ডায়রিটায় একবার হাত বুলিয়ে নিজের লাগেজে ঢুকিয়ে রাখলো। ডায়রিটা দ্রুত পড়ার জন্য মনটাও আকুপাকু করছে। আর অন্যদিকে নেহালের জন্য মনের মধ্যে দহন পোড়ন চলছে। কিন্তু কি ই বা আর করার আছে নেহালের জন্য, তা ভেবে পাচ্ছে না! আগে শেষকৃত্য হয়ে যাক! দূরের মানুষ হওয়া স্বত্ত্বেও এষের বুকে নেহালের হ’ত্যাকান্ডের জন্য বুকে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।
এষ নিজে গিয়ে গোসল সেরে একটা কালো রং এর পাঞ্জাবি পড়ে নিলো। আর্শি ওকে তিনটায় ব্যাক করতে বলেছে, সে কথাটা মাথায় গেড়ে, একবার রুকাইয়া খালার সাথে কথা বলতে গেলো। রুকাইয়া খালা ছাড়াও এ বাড়িতে আরো তিন জন কাজের লোক আছে। তবে রুকাইয়া খালা আর্শিকে ছোটোবেলা থেকেই দেখেছে। অপরাজিতার চির বিশ্বস্ত এ রুকাইয়া। আর্শির ভালো মন্দ সব বিষয়েই সে খেয়াল রাখে। শুরুতে রুকাইয়া আর্শির একজন ন্যানীর দায়িত্বে ছিলো। আর্শির আচরণগত পরিবর্তন সে ভালোভাবেই জানে। এষ পূর্বে কোনোদিন আর্শির ব্যাপারে রোকাইয়া কে কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে পোষণ করেনি। তবে আজ আর্শির এরকম পরিবর্তন দেখে রুকাইয়ার সাথে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞেস করতে গেলো।
এষ কিচেনে রুকাইয়া খালার পাশে গিয়ে বসলো।
এষকে বসতে দেখে রুকাইয়া খালা ইতস্তত করে উঠে গিয়ে এষকে বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দিলো। হেসে এষকে বললো,
” আরে জামাই বাবা, আপনি কিচেনে আইছেন কেনো?”
(চলবে)