এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-২১+২২+২৩

0
192

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২১.

[ সতর্কতা : এই পর্বের কিছু অংশে স্ল্যাং ওয়ার্ডস এবং তার পাশাপাশি খুনের বিবরণ রয়েছে। তাই প্রাপ্তমনস্ক না হলে সেই ব্যাপার গুলো এড়িয়ে যাবেন। ]

সকাল থেকে বাড়িটা মাথায় তুলে রেখেছে বহ্নি। না মুখে তুলেছে দানাপানি, না তোয়াক্কা করছে কারো অনুনয়ের। কেবল একটাই কথা তার। মাম্মাকে চাই। হিরণ গতরাত হতে এখনো বাড়ি ফিরে নি। কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছে কে জানে! তবে হিরণ যদি বাড়ি ফিরে শুনে তার মেয়ে সকাল থেকে অভুক্ত তাহলে যে কি অবস্থা হবে তা ভাবতেই রাধুনি লিজা ভয়ে তটস্থ হয়ে যাচ্ছে। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর। এক পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে একের পর এক বহ্নির সকল প্রিয় খাবার রান্না করে মুখের সামনে নিয়ে ধরেছে। কিন্তু বহ্নি তা মুখে তো তুলেই নি উল্টো আরো রাগ করে দুপুর থেকে নিজের রুমের দরজা ভিতর থেকে লক করে বসে আছে।

লিজা বহ্নির রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,

“ বহ্নি মামণি, দরজা খুলো। মাম্মা এসে পড়বে তো। এরকম করলে মাম্মা কষ্ট পাবে। “

বহ্নি ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠে,

“ লায়ারস। মাম্মা, পাপা আসবে না। “

“ কেনো আসবে না? তোমাকে রেখে উনারা কোথায় যাবে? “

“ তাহলে সকাল থেকে কেউ একবারও আমার সাথে ফোনে কথা বলে নি কেনো? “

বহ্নির এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না লিজা। সে কিভাবে জানবে স্যার আর ম্যাডাম নিজেদের মেয়ের সাথে কেনো কথা বলছে না? এক চাপে সারাদিন এই বাচ্চা মেয়েটার পিছনে দৌড়ে লিজা ক্লান্ত। তার ধৈর্য্য শক্তিও আর মানছে না। তিনি শেষ বারের মতো ক্লান্ত গলায় বলে,

“ বের হও মামণি। তোমার পাপা খুব রাগ হবে। “

বহ্নি এবার আর কোনো জবাব দেয় না। লিজা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে ক্লান্ত পায়ে দো তলা থেকে নিচে নেমে আসে। যা হওয়ার হবে। তার পক্ষে আর সম্ভব নয় এই বাচ্চার পিছনে দৌড়ানো।

__________

গর্জন তোলা সমুদ্রের ধারে নীরবে বসে আছে হিরণ। অনিমেষ চেয়ে আছে দূর সমুদ্রের জলরাশির পানে। কেন জানি মনে হচ্ছে এইবার বাণীকে খুঁজে পাওয়া এতটা সহজ হবে না। আগের দু’বার বাণী একা পালিয়েছিলো। এবার কারো সঙ্গে পালিয়েছে। সেই কেউটা যে সাধারণ কেউ নয় তা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না হিরণের। সাধারণ কেউ হলে নিশ্চয়ই এভাবে সব প্রমাণ মিটিয়ে পালাতে পারতো না?

গভীর ভাবনার অতলে ডুবে থাকা হিরণকে কাছ হতে দেখছে ইবাত। গত রাত থেকে এক মুহুর্তের জন্যও সে হিরণকে একা ছাড়ে নি। এই শান্তশিষ্ট স্যারকে তার মোটেও ভালো লাগছে না। হিরণের স্বভাব অনুযায়ী এতক্ষণে দশ বারোটা লাশ ফেলে দেওয়ার কথা। কিন্তু হিরণ সেরকম কিছুই করছে না। কেবল শান্ত গলায় বাণী ম্যাডাম আর তার সাহায্যকারীকে খুঁজে বের করার আদেশ দিয়ে এই সমুদ্র পাড়ে এসে বসে আছেন।

ইবাতের ভাবনার মাঝেই হিরণ আচমকা মৃদু হেসে বলে উঠে,

“ বাণীকে আমি নিজের করেছি। কিন্তু বাণী আমার হয় নি। “

হিরণের কথার ধরণ দেখে ইবাতের বড্ড মায়া হয়৷ সে মানছে তার স্যার খারাপ। কিন্তু ম্যাডাম কি একটু কনসিডার করতে পারতো না? স্যারের অনুভূতিকে সামান্য মূল্যায়ন করতে পারতো না? ইবাত নিশ্চিত বাণী ম্যাডামের এক কথায় স্যার দুনিয়া এঁফোড়-ওঁফোড় করে দেওয়ার আগেও দ্বিতীয় বার ভাববেন না।

ইবাতের ভাবনার মাঝেই তার ফোন বেজে উঠে। সে কল রিসিভ করতেই অপরপাশ হতে বলা কথা শুনে ফোন কানে ধরে চিন্তিত গলায় হিরণের উদ্দেশ্যে বলে,

“ স্যার, বহ্নি দুপুর থেকে রুমের দরজা লক করে বসে আছে। গত এক ঘন্টা ধরে ওর কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। প্লিজ চলুন। “

মেয়ের কথা শুনতেই যেনো হিরণ সম্বিত ফিরে পায়। দ্রুত পায়ে উঠে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বাণীর ভাবনায় সে এতটা বিভোর হয়ে ছিলো যে নিজের মেয়ের কথা ভুলে গিয়েছিলো সে। হিরণ ফ্রন্ট সিটে উঠে বসতে বসতে আদেশের গলায় বলে,

“ দ্রুত চালাও। আমার মেয়ে অপেক্ষা করছে। “

__________

সন্ধ্যা সবে নামলো বলে। অডিটোরিয়ামের মেঝেতে বসে থাকা ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েগুলো আর সহ্য করতে পারছে না এই জীবন মরণ ক্ষণ। তবুও তাদের ঠোঁট চেপে এই পরিস্থিতি সহ্য করতে হচ্ছে। কারণ তারা কেউই তাদের শিক্ষিকা রুনা ফারহানার মতো করুণ পরিণতি চায় না।

পুরো বিকেল জুড়ে আব্রাহাম ছাদের চিলেকোঠা ঘরের জানালা দিয়ে বাহিরে আর্মিদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো কোনো আর্মির মতিগতিই সে ঠিক ঠাওর করতে পারে নি। এদের যেনো হোস্টেজদের জীবন নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। না আছে আতঙ্কবাদীদের মারার কোনো তাড়া। সবটা পরখ করে অডিটোরিয়ামের দিকে পা বাড়ায় সে।

অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখ গেলো রুমের এককোণে। মুহুর্তেই তার ভ্রু কুচকে গেলো। উক্ত কোণের মেঝেটা খালি দেখেই সে সঙ্গে সঙ্গে রুমে উপস্থিত সকল মেয়ের মুখপানে চায়। এতো এতো মুখের ভীড়ে ভীত দূর্বল মেয়েটার মুখ না দেখে সে আগ্রহী গলায় অডিটোরিয়ামে উপস্থিত একজন আতঙ্কবাদীকে প্রশ্ন করে,

“ এই কোণায় যেই সেন্সলেস মেয়েটা ছিলো ও কোথায়? “

উক্ত আতঙ্কবাদীর মুখের কোণে বিশ্রী হাসি ফুটে উঠে। সে বেশ রসালো গলায় বলে,

“ মুবিনের খিদা লাগসিলো খুব। টসটসে মাল দেইখা আর লোভ সামলাইতে পারে নাই। খাইতে নিয়ে গেসে। “

আব্রাহাম রাগে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়। এক প্রহর! কেবল এক প্রহরের জন্য একা রেখে গিয়েছিলো, আর এই সুযোগটাই লুফে নিয়েছে মুবিন। আব্রাহাম লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করে,

“ কোথায় নিয়ে গিয়েছে? “

প্রশ্নটা করলেও আর উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়ায় না আব্রাহাম। রাইফেল হাতে দ্রুত কদমে বেরিয়ে যায়। তাদের মধ্যের কথাপোকথন শুনতে পায় অডিটোরিয়ামে উপস্থিত বাকি মেয়েরা। তাদের মধ্যে কিছু মেয়ে এরকম কথা শুনে ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠে। তারমানে লোকগুলো শুধু খুনি নয় বরং মেয়ে খেকোও। কিছু মেয়ে যখন নিজ সম্ভ্রমের চিন্তায় ব্যস্ত তখন বাকি মেয়েরা মনে মনে খুশি হয়। রুহী নামক ওই মেয়ের সাথে এমনটাই হওয়া উচিত। একজন আতঙ্কবাদীর সাহায্যকারীর সাথে এরকম ঘটনায় তারা মোটেও চিন্তিত নয়।

__________

কলেজ ভবনের ভিতরের সম্পূর্ণ দো তলাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রুহী কিংবা মুবিনকে না পেয়ে আব্রাহাম দ্রুত তৃতীয় তলায় যায়। তখনই তার কানে ভেসে আসে তৃতীয় তলার করিডোরের শেষ মাথায় অবস্থিত ক্লাসরুম হতে ক্ষীণ মেয়েলি কান্নার সুর। আব্রাহাম দ্রুত পায়ে দৌড়ে সেই ক্লাস রুমের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু ভিতরে প্রবেশের সুযোগ নেই। দরজাটা ভেতর থেকে লক করা। আব্রাহাম ক্লাসরুমের জানালার থাই গ্লাস দিয়ে ভিতরে তাকাতেই তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। সে চিৎকার করে মুবিনের নাম ধরে ডাকে। মুবিনের কানে সেই ডাক পৌঁছায় না।

আব্রাহাম একটা লম্বা নিঃশ্বাস টেনে দরজার সামনে গিয়ে জোরালো পায়ে লাত্থি বসায়। একবার, দু’বার, তিনবার। পরপর কয়েকটা লাথি দরজায় পড়তেই বিশাল কাঠের দরজার ছিটকানি ভেঙে খুলে পড়ে। খুলে যায় দরজা। মুবিন উঠে দাঁড়াবে তার পূর্বেই তার ঘাড়ের কাছে শক্তপোক্ত একটা হাতের থাবা পড়ে। এক টানে তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়েই আব্রাহাম এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে শুরু করে। অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে বলে উঠে,

“ শুয়োরের বাচ্চা! তোরে এই জায়গায় ফষ্টিনষ্টি করতে নিয়ে আসছি? মাইয়া মানুষ দেখলেই লোভ সামলাইতে পারোস না? শালা খা*কির পোলা। কই হাত দিসোস তুই? তোর এতো বড় কলিজা হয়ে গেসে? “

কথাটা বলেই মুবিনের নাক বরাবর আরো দু তিনটা ঘুষি বসায় আব্রাহাম। আচমকা আঘাতে মুবিন প্রথমে নিজেকে সামলাতে না পারলেও এই পর্যায়ে এসে সে-ও আর চুপ থাকে না। বরং আব্রাহামকে প্রতিরোধ করতে তার পেট বরাবর ঘুষি মারে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

“ তোর এতো দরদ কেন এই মাগীর জন্য? পিরিত উথলায় পড়তেসে? মায়ায় পড়সোস? “

মুবিনের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না আব্রাহাম। সে আপাতত নিজের মধ্যে নেই। অতি রাগে সবসময় তার শরীর কাপে। এখনো তাই হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা করে না আব্রাহাম। হুশ জ্ঞান খুইয়ে সে ঘাত প্রতিঘাতের খেলায় মত্ত হয়। দু’জনের সাপে নেউলে মারামারির মাঝেই ক্লাস রুমের একটা টেবিলের নিচ হতে কান্না দমানোর জন্য নাক টানার শব্দ শোনা যায়। মুহুর্তেই আব্রাহামের দৃষ্টি স্থির হয় সেই পানে। ভীত রুহী হাঁটুতে মুখ গুজে গা কাপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে। একদিনে পরপর এতগুলো ঘটনা ওকে ট্রমাটাইজড করে তুলেছে। প্রতারণা, চোখের সামনে খুন হতে দেখা এবং সব শেষে মলেস্টিং এর শিকার হওয়া। আজকের মতো আর কি বাকি আছে তার জীবনে ঘটার?

আব্রাহাম একপলক রুহীর অবয়ব দেখে। অত:পর মুবিনের ডানহাতের মুঠোয় পেচানো রুহীর ইউনিফর্মের উপরের ক্রসবেল্টটা টেনে নিজের হাতে নিয়ে তা দ্বারা মুবিনের গলা পেচিয়ে ধরে। চোখের পলকেই মুবিনের নড়াচড়া করার সব পথ বন্ধ করে দিয়ে নিজের পাশের চেয়ারের দিকে তাকায় সে। চেয়ারটার উপর একটা পিস্তল, একটা চাপাতি ও মুবিনের গায়ের শার্টটা রাখা। আব্রাহাম অতি শান্ত ভঙ্গিতে একহাতে চাপাতিটা তুলে নেয়। তা দেখে মুবিন চিৎকার করে উঠে। কিন্তু সেই চিৎকার দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তার পূর্বেই আব্রাহাম নিজের হাতের চাপাতি মুবিনের গলায় চালায়। অদ্ভুৎ গড়গড় শব্দে রুহী কান্না চাপিয়ে সামান্য মাথা তুলে তাকাতেই তার সম্পূর্ণ শরীর গুলিয়ে উঠে। আরো একটা খুনের সাক্ষী হয় সে। এইবারের খুনটা আরো বেশি ভয়াবহ।

আব্রাহামকে দেখতে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় লাগছে। তার মুখভাব দেখে রুহীর তাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। যেই মুখের সরল হাসি দেখে রুহীর কিশোরী মনে প্রেমের তুফান উঠতো আজ সেই মুখ দেখেই রুহীর ভয় হচ্ছে। আব্রাহামের হাত সম্পূর্ণ রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। রুহীর মস্তিষ্কে সূক্ষ্ণ চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। সে ফের মাথা হাঁটুতে গুজে আরেকটু ভিতরের দিকে চেপে বসে।

মুবিনকে সম্পূর্ণ শেষ করেই শান্ত হয় আব্রাহাম। তাজা রক্তে সম্পূর্ণ ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। আব্রাহাম অতি শান্ত ভঙ্গিতে হাতের চাপাতিটা রেখে চেয়ারের উপর থাকা মুবিনের শার্টে নিজের হাতের রক্ত যতটুকু সম্ভব মুছে নেয়। দু দন্ড অপেক্ষা করে বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায় দূরে টেবিলের নিচে বসে থাকা ভীত তন্ত্র রুহীর কাছে। কোনো ভনিতা না করে রুহীর ডান হাতের কব্জি ধরে একটানে তাকে টেনে টেবিলের নিচ থেকে বের করে আনে। রুহী চোখ খিচে বন্ধ করে রেখে অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ লাশ… আমি তাকাবো না। “

আব্রাহাম তাকিয়ে দেখছে রুহীকে। মেয়েটা নিজের মাঝে নেই আপাতত। আব্রাহাম অতি নীরবে নিজের গায়ের কালো টি শার্টের উপর পরিহিত কালো জ্যাকেটটা খুলে রুহীর কাধে চাপিয়ে দিয়ে তার হাত চেপে ধরে শান্ত গলায় বলে,

“ চলো। “

__________

তাজা রক্তের গন্ধ হতে দূরে আসতেই আব্রাহাম বলে উঠে,

“ চোখ খুলো। “

রুহী জোরে জোরে মাথা ঝাকিয়ে না বলে। সে চোখ মেলে তাকাবে না। কোনমতেই তাকাবে না। আব্রাহাম এবার ধমকে উঠে,

“ চোখ খুলতে বলেছি রুহী। “

আব্রাহামের ধমকে রুহী আবার কেদে ফেলে বললো,

“ সব দুঃস্বপ্ন নয় কেন? “

“ আমার দিকে তাকাও রুহী। তাকিয়ে দেখো এখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। “

রুহী এবার চোখ মেলে তাকায়। অশ্রু জর্জরিত চোখ মেলে দেখে চারিদিকটা। আসলেই এই ক্লাস রুমে এখন সে আর আব্রাহাম ব্যতীত কেউ নেই। এই বিষাক্ত পরিবেশ আর সহ্য হচ্ছে না রুহীর। এই ট্রমার ভার বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয় তার পক্ষে। সে হাঁটু ভেঙে আব্রাহামের সামনে বসে আকুতি করে,

“ মেরে ফেলবে আমাকে? মেরে ফেলো প্লিজ। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। “

রুহীর আকুতি আব্রাহামের মন ছুঁতে পেরেছে কিনা তা বুঝা গেলো না। আব্রাহাম কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই আচমকা সম্পূর্ণ ভবন অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। দো তলা থেকে ভেসে এলো একঝাঁক মেয়ের চেঁচামেচির আওয়াজ। আচমকা ঘটনা ঠাওর করতে আব্রাহামের মিনিট খানেক সময় লাগে। কিন্তু বুঝতে পেরেই সে সাথে সাথে নিজের পকেট থেকে রিভলবার বের করে ডানহাতে শক্ত করে ধরে। অপর হাতে রুহীর হাত আঁকড়ে ধরে তাড়া দিয়ে বলে,

“ উঠো তাড়াতাড়ি। “

রুহী কিছু বললো কিনা সেদিকে আর খেয়াল নেই আব্রাহামের। সে শক্ত হাতে রুহীকে টেনে অন্ধকারের মধ্যেই বেরিয়ে আসে দ্রুত পায়ে। তিন তলা হতে দো তলায় নামার পথে বার কয়েক রুহী পড়ে যেতে নিলেও আব্রাহামের শক্ত বাধনের জোরে আর পড়ে নি।

দো তলায় নামতেই মেয়েগুলোর চেঁচামেচি আরো স্পষ্ট শোনা গেলো। সেই সঙ্গে শোনা গেলো এলোমেলো গুলি বর্ষণের শব্দ। আব্রাহাম করিডোরের মাথায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠে,

“ একটাও যেনো না বাঁচে। “

কথাটুকু শেষ করেই সে দ্রুত রুহীর হাত ধরে নেমে আসে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ফ্রন্ট গেটের দিকে না গিয়ে পিছনের ব্যাক গেটের দিকে পা বাড়াতে নিলেই আব্রাহাম অনুধাবন করে সেই দরজা দিয়ে কেউ প্রবেশের চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই এই বাংলার সৈনিকেরা! আব্রাহাম রুহীর হাত ধরে দ্রুত অন্যদিকে পা বাড়ায়। একাউন্টস রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই সে কোনো কথা না বলে রুহীর হাত ছেড়ে দেয়। দ্রুত পকেট থেকে একটা টর্চ লাইট বের করে সেটার আলো দিয়ে দরজার সামনে সেট করা বোমের চাবি ফেরত জায়গা মতো রাখে। অতি সাবধানে কাজটুকু শেষ করেই সে উঠে রুহীর হাত ধরে দরজা খুলে তাকে বাহিরে ঠেলে দিয়ে বলে উঠে,

“ পিছনে ফিরে তাকাবে না। যাও। “

রুহী নিজের গায়ে জড়ানো জ্যাকেটটা শক্ত করে চেপে ধরে বাকহারা হয়ে আব্রাহামের পানে তাকিয়ে আছে। ভবনের এই পূর্ব পাশটায় সাধারণত কখনো কারো আনাগোনা দেখা যায় না। আজও ঠিক তাই। তবে যেকোনো মুহুর্তে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এদিকটায় পৌঁছে যাবে। রুহীকে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আব্রাহাম ধমকে বলে,

“ যাচ্ছো না কেনো? “

রুহী কোনো জবাব দেয় না। সে একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে আব্রাহাম সিদ্ধান্ত নেয় সে নিজেই এই মেয়ের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিবে। ভাবনা অনুযায়ী কাজ করতে গিয়েও আব্রাহামের হাত থেমে যায়। সরাসরি চোখ তুলে রুহীর দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলে,

“ আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। কখনোই না। তোমার জীবন ভিক্ষা দেওয়ার পিছনে একটাই কারণ। আমি ঋণী থাকতে চাই না তোমার কাছে। “

কঠিন কথাগুলো উচ্চারণ করে এক মুহুর্তও অপেক্ষা করে না আব্রাহাম। তড়িৎ গতিতে রুহীর মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজার বাহিরে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা রুহী দিন দুনিয়া ভুলে বসলো। তার কানের কাছে কেবল বাজতে থাকলো আব্রাহামের বলা কথাগুলো। এতটা সহজ? প্রতারণা আর ভালোবাসার দ্বন্দ্বে রুহী চিৎকার করে উঠে,

“ তুমি মিথ্যা বলছো। তাই না? কখনো ভালোবাসো নি? এক মুহুর্তের জন্যও না? “

দরজার অপরপ্রান্তে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আব্রাহামের তরফ থেকে কোনো প্রতুত্তর আসে না। সে নীরব রয়। রুহী ফের চিৎকার করে,

“ তোমার পরিণতি কি হবে? “

রুহীর এই প্রশ্নের পিঠে এবার আব্রাহাম সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এই মেয়ে এরকম পরিস্থিতিতেও তার পরিণতির কথা ভাবছে? আব্রাহাম মনে মনে শুধায়,

“ বোকা রুহী। দুনিয়া তোমাকে লানত দিবে। এই দেশ তোমাকে ধিক্কার জানাবে। আমার নাম মুখেও আনলে তুমি কলঙ্কিত হবে। অথচ তুমি সেধে কলঙ্ক কুড়াচ্ছো। “

__________

দরজার সামনে থাকা বোম গুলোকে ডিফিউজ করে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা ভিতরে প্রবেশ করতেই মেজর দূর্জয় চোখ এবং হাতের ইশারায় অর্ডার দেয় তার টিমের সাত জনকে দো তলায় যেতে এবং ব্যাক আপ টিমের সদস্যদের আদেশ দেয় ভবনের বাকি ফ্লোর গুলোয় অভিযান চালিয়ে কোনো আতঙ্কবাদী পেলে যেনো তাদের জীবিত আটক করা হয়। মেজরের আদেশ পেতেই
লেফটেন্যান্টরা অর্ডার অনুযায়ী উপরের দিকে চলে যায়। দূর্জয় নিজের হাতের রাইফেলটা সু কৌশলে ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় গ্রাউন্ড ফ্লোরের করিডোরের দিকে। তার মাথায় পরিহিত সামরিক বাহিনীর ক্যাপের উপর সেট করা টর্চের আলোয় অন্ধকার কিছুটা ঘুচেছে বৈকি। সেই আলোয় এক পা দু পা করে সতর্ক দৃষ্টি মেলে এগিয়ে যাচ্ছে দূর্জয়।

__________

হেডকোয়ার্টারের মিটিং রুমে উপস্থিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা হ্যান্ডসেট ট্রান্সিভারের মাধ্যমে নিজের সৈন্যদের সঙ্গে কানেক্টেড থেকে সকল আপডেট নিতে ব্যস্ত। ঠিক সেই মুহুর্তে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা একজন সৈনিক মৃদু চেচিয়ে ডাকে,

“ স্যার! স্যার একটা ওয়েবসাইট থেকে একজন আতঙ্কবাদীর ফেস রিভিল করা হয়েছে। “

কথাটুকু শুনতেই জুলফিকার দ্রুত পায়ে সেই কম্পিউটার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই সে দেখে জঙ্গি সংগঠনের একটা অফিশিয়াল ওয়েবসাইট হতে একজন আতঙ্কবাদীর মাস্ক বিহীন ছবি দেওয়া হয়েছে। জুলফিকার দু দন্ড বড় বড় চোখ মেলে সেই ছবির পানে তাকিয়ে রয়। তার বিশ্বাস হচ্ছে না স্ক্রিনের এই দৃশ্য। সে দ্রুত ট্রান্সিভারে দূর্জয়ের সঙ্গে কানেকটেড হয়ে শুধায়,

“ মেজর দূর্জয়! ক্যান ইউ হেয়ার মি? “

দূর্জয় সবে তখন এক এক করে সবগুলো রুম চেক করছিলো। কিন্তু জুলফিকারের চিন্তিত স্বরের বিপরীতে সে ১০৫ নম্বর রুমের দরজা খুলতে খুলতে জবাব দেয়,

“ ইয়েস স্যার। “

“ একজন আতঙ্কবাদীর ফেস রিভিল করে ওয়েবসাইটে আপলোড দেওয়া হয়েছে এইমাত্র। ছবিটা… “

জুলফিকারের আর কোনো কথা পৌঁছায় না দূর্জয়ের কানে। খোলা দরজার ভেতর নির্মোচিত রুমের আঁধারে উপস্থিত ছেলেটাকে দেখে তার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়। সে আর এক পা-ও আগানোর সাহস পায় না। অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ দীপ্ত! “

টর্চের আলোয় স্পষ্ট সেই মুখশ্রীর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে মৃদু হাসি। সে ম্লান হেসে বলে,

“ ভাইয়া। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২২.

[ আজকের পর্বে একটা সেন্সিটিভ ইস্যু উঠে আসবে। একটা নির্দিষ্ট দেশের নাম। সত্যি বলতে এই উপন্যাস লেখা শুরু করার আগে যখন আমি এই প্লট সাজাই তখন মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম যে এই ইস্যু গুলো নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না তো? এখনো আমি একই চিন্তাই করছি। তবুও আপনাদের জ্ঞানার্থে জানাচ্ছি যে এই সম্পূর্ণ উপন্যাসটা কাল্পনিক। তাই পুরো কাহিনীটাকে কাল্পনিক হিসেবেই বিবেচনা করবেন। ধৈর্য্য ধরে পড়ুন কোনো আজেবাজে মন্তব্য করার পূর্বে। ]

বাকহারা দূর্জয় জুলফিকারের ডাকে সম্বিত ফিরে পায়। কানের ব্লু টুথ ডিভাইসটা হতে ভেসে আসছে জুলফিকারের অস্থির স্বর,

“ দূর্জয়? ক্যান ইউ হেয়ার মি? দূর্জয়? “

দূর্জয় অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি মেলে রেখেই ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয়,

“ ইয়েস স্যার। “

“ দূর্জয়, একটা আননোন ওয়েবসাইট থেকে একজন টেরোরিস্টের ফেস রিভিল করা হয়েছে। এন্ড ছবিতে থাকা মানুষটা দীপ্ত… “

দূর্জয় জুলফিকারকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,

“ দীপ্ত আমার সামনে আছে এই মুহুর্তে। “

জুলফিকার মুজতবার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। সে আর কিছু বলবে তার পূর্বেই কলটা ডিসকানেকটেড হয়ে যায়। জুলফিকার চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি শুরু করে। এটা কিভাবে সম্ভব? দীপ্ত তো মৃত। সতেরো দিন ধরে নিখোঁজ থাকার পরে আঠারো দিনের মাথায় তারা খবর পায় একটা ডেড বডি পাওয়া গিয়েছে। দূর্জয় নিজে সেই ডেড বডি শনাক্ত করে নিশ্চিত করেছিলো যে লাশটা দীপ্তরই। এতো দিন মৃত হিসেবে জেনে এসেছে যেই মানুষটাকে, সে কিভাবে টেরোরিস্টদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে? জুলফিকার কিছুতেই মেলাতে পারছে না কিভাবে দীপ্তর মতো একজন ব্রাইট স্টুডেন্ট এসবে জড়িয়ে পড়লো। খুব বড় কোনো রহস্য আছে এই ঘটনার পিছনে।

জুলফিকার আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। তার এই মুহুর্তে কলেজ লোকেশনে পৌঁছাতে হবে। যাওয়ার পূর্বে সে মিটিং রুমের কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা সৈন্যকে আদেশ দিয়ে বলে,

“ ওই আননোন ওয়েবসাইটের সব ডিটেইলস চাই আমি। সবার আগে ওই ওয়েবসাইট এক্সেসের লোকেশন ট্র্যাক করো। কিছু জানলে সবার আগে আমাকে কল করে জানাবে। “

__________

দূর্জয় এক কদম সামনে এগুতে নিলেই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক পিস্তল তাক করে বলে উঠে,

“ এক পা-ও সামনে এগোবে না। আমি তোমাদের দীপ্ত না। আমি আব্রাহাম। “

দূর্জয় বিস্ময় নিয়ে দেখছে নিজের ভাইকে। চোখে বিস্ময় থাকলেও সে বেশ শান্ত গলায় জবাব দেয়,

“ নাম বদলালে কি পরিচয়ও বদলে যায়? “

দীপ্ত কটুক্তি করে বলে,

“ হ্যাঁ যায়। আমি কোনো মেজরের ছেলে কিংবা ভাই নই। আমি আতঙ্কবাদীদের একজন। “

দূর্জয় আবার পা বাড়িয়ে সামনে এগোতে নিলেই দীপ্ত শক্ত করে পিস্তল তাক করে চেচিয়ে উঠে,

“ ভাইয়া সামনে এগোবে না। “

দূর্জয়ের দুই হাত অচল হয়ে আসছে মনে হচ্ছে। কার দিকে বন্দুক তাক করবে সে? নিজের ভাইয়ের দিকে? আপন ভাইয়ের দিকে? দূর্জয় নরম গলায় বলে,

“ তুই নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে সতেরোটা দিন আমরা কোন জাহান্নামের মধ্যে দিয়ে পাড় করেছি তোর ধারণা আছে? বাবা চলে যাওয়ার পরও মামণি শক্ত ছিলো। কিন্তু তুই নিখোঁজ হওয়ার পর মামণি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। হসপিটালাইজড করতে হয়েছিলো। একদিকে মামণির এই অবস্থা অন্যদিকে তুই নিখোঁজ। আমি পাগলপ্রায় হয়ে তোকে খুঁজেছি দিন রাত। পুলিশ, সামরিক বাহিনী কিছু বাদ ছিলো না। কিন্তু তোর কোনো হদিস পাওয়া যায় নি। এসব ইনভেস্টিগেশন করতে গিয়ে দেখি যে তোর বয়সী আরো কয়েকজন ভার্সিটি স্টুডেন্টস নিখোঁজের রিপোর্ট আসছে থানায়। তখনই আমি সম্পূর্ণ ছক কষে আন্দাজ করেছিলাম তুই কোথায় ফেসেছিস। কিন্তু এই কথা কাউকে বলতে পারি নি আমি। মামণি এরকম কিছু শুনলে সহ্য করতে পারতো না। আর যারা তোর নিখোঁজ হওয়ার পিছনে দায়ী তাদের চক্রকে ধরার জন্য আমি অন্যের লাশকে তোর নামে নিশ্চিত করে সকলকে বলে দেই তুই মৃত। সবার আড়ালে তোকে খোঁজার জন্য লোক লাগিয়ে রাখি আমি। কিন্তু বিশ্বাস কর ভাই একটা কোনো ক্লু পাই নি আমি। একটা বছর ধরে আমি মামণির সামনে দাঁড়াতে পারছি না। মামণির সাথে কথা বলতে পারছি না। মিথ্যা বলার অপরাধবোধে শেষ হয়ে যাচ্ছি। “

দীপ্ত নীরবে দূর্জয়ের সমস্ত কথা শুনে। তার সল্পভাষী ভাই আজ কতো কথা একসঙ্গে বলে ফেললো! এক বছরের জমানো কথা কি এতো দ্রুত ফুরোয়? হয়তো না। তবে দূর্জয়ের কথাগুলো দীপ্তর মন নরম করতে পারে না। সে রাইফেল তাক করে রেখেই জবাব দেয়,

“ ভালো করেছো। দীপ্ত মৃতই। সবাই ওকে মৃত জানাতেই তোমাদের মঙ্গল। “

দূর্জয় শুধায়,

“ এরকম করিস না ভাই। ভাইয়াকে বল তোর সাথে কি কি হয়েছিলো। এসব কিছুর পিছনে কাদের হাত আছে ভাইয়াকে বল একবার। “

দীপ্ত দূর্জয়ের উৎকণ্ঠা দেখে হেসে বলে,

“ আমি এখন ওদের একজন ভাইয়া। তোমার নীতি আর আমার নীতি ভিন্ন। তোমার বিশ্বাস আর আমার বিশ্বাসও ভিন্ন। কিছুই বলতে পারবো না আমি। “

দূর্জয় এবার রেগে ধমকে উঠে,

“ একটা চড় মেরে তোর নাটক ছুটাবো। নিজেকে কাদের একজন বলে দাবী করছিস তুই? তুই কার ছেলে ভুলে যাচ্ছিস? নিজেকে ওদের একজন দাবী করে বাবার আত্মাকে কষ্ট দিচ্ছিস তুই। “

দূর্জয়ের কোনো কথাই দীপ্তকে নরম করতে পারে না। সে নিজের জায়গায় অনড় রয়। দূর্জয় ফের নরম স্বরে বলে,

“ ভাই ওরা কি বলে তোর ব্রেনওয়াশ করেছে? কিভাবে এতো বদলে দিলো তোকে? “

দূর্জয়ের ছলছল দৃষ্টি দেখে এবার কিছুটা মায়া হয় দীপ্তর। নিজের এতো বছরের জীবনে ভাইয়াকে কখনো কাঁদতে দেখে নি সে। বাবার জানাজার সময়ও না। আজও সে নিজের ভাইয়ের চোখে পানি দেখতে চায় না। দীপ্ত ক্ষনিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। উদাস গলায় বলে,

“ একটা জিনিস চাইবো ভাইয়া। দিবে? “

“ বলে দেখ। “

“ এই দরজার ওপারে একটা মেয়ের কান্নার ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো? মেয়েটা এই কলেজের স্টুডেন্ট। রুহী মেহরোজ। ওর সাথে আমি প্রতারণা করেছি। কিন্তু ওই মেয়েটা বোকা আর দূর্বল। আমি আতঙ্কবাদী জেনেও ওর মধ্যে ঘৃণার কোনো পাদুর্ভাব দেখিনি। নিজের প্রতারকের পরিণতি জানতে চেয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলো। আমার বিশ্বাস ও নিজের গায়ে আতঙ্কবাদীর প্রেমিকা হওয়ার কলঙ্ক মাখবে। ওকে সেই কলঙ্ক থেকে বাঁচিও। ভালোবাসা থেকে না, ওর প্রতি ঋণী হিসেবে এই আবদার করছি। “

শেষের কথাটুকু দীপ্ত মৃদু হেসে বললো। দূর্জয় দূর্বল গলায় প্রশ্ন করে,

“ এই জীবনে কেনো জড়িয়ে পড়লি? নিজের পরিণতির কথা ভেবেছিস একবারও? “

দীপ্ত একইভাবে হেসে বলে,

“ আই হ্যাড নো আদার অপশন। কিন্তু চিন্তা করো না। আমার পরিণতি তোমার হাতে হবে না। তোমার রাইফেলের বুলেট শত্রু মারার জন্য, ভাই মারার জন্য নয়। “

কথাটুকু শেষ করে চোখের পলকেই দীপ্ত নিজের হাতের বন্দুকটা নিজের মাথার একপাশে তাক করে ট্রিগার পুল করে। ফায়ারের তীক্ষ্ণ শব্দের সঙ্গে দূর্জয়ের নিঃশ্বাসটাও গলার কাছে আটকে গেলো। যেনো কেউ দানবীয় হাতে তার গলা চেপে ধরেছে। মুহুর্তেই দরজার ওই পাশ হতে জোরে জোরে কেউ দরজায় আঘাত করে চিৎকার করতে শুরু করে। পাগলের মতো কান্না মিশ্রিত স্বরে আওড়াচ্ছে একটা নাম,

“ আব্রাহাম! দরজা খুলো। কি করেছো তুমি? এই! দরজা খুলো। “

দূর্জয়ের সেদিকে হুশ নেই। সে দ্রুত হাতের বন্দুক ফেলে মাটিতে পড়ে থাকা লাশকে গিয়ে ঝাপটে ধরলো। দুর্দম্য ব্যক্তিত্বের খোলস চিড়ে চোখ দিয়ে অশ্রু না বেরোলেও তার ভেতরটা সম্পূর্ণ ভেঙেচুরে আসে৷ অস্ফুটে ডাকে,

“ দীপ্ত? ভাই? ভাই তাকা। ভাইয়া ডাকছি। “

__________

দো তলায় হোস্টেজদের উদ্ধার অভিযানে দুইজন আতঙ্কবাদী নিহত হয়েছে এবং একজনকে জীবিত আটক করতে সক্ষম হয়েছে সৈন্যরা। ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ার ফলে জিম্মি মেয়ে গুলো সেই সুযোগে পালানোর চেষ্টা করতেই এবং আব্রাহামের “ একটাও যেনো না বাঁচে “ বাক্যটা শুনতেই আতঙ্কবাদীরা এলোমেলো গুলি ছোড়া শুরু করে। সেই গুলি বর্ষণে অন স্পট নিহত হয় ৩৩ জন শিক্ষার্থী। আহত হয় ১৫ জন। সব মিলিয়ে কেবল ৫০ জনকে সম্পূর্ণ সহি সালামতে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় সৈন্যরা। এছাড়াও ব্যাক আপ টিম ফোর্সের সদস্যরা অন্য ফ্লোর হতে আরো তিন জন আতঙ্কবাদীকে জীবিত অবস্থায় আটক করে।

সকল সৈন্যরা যখন আটককৃত আতঙ্কবাদী এবং হোস্টেজদের নিয়ে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় কলেজ ভবনে প্রবেশ করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা। উদ্ধার অভিযান সহজ করতেই বোধহয় ইলেকট্রিসিটি ফেরত এসে পড়েছে এখন। কৃত্রিম আলোয় আলোকিত ভবনের ভেতরের ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে দেখতে ভেতরের দিকে এগিয়ে যায় জুলফিকার। তখনই সে মুখোমুখি হয় সাদাতের। একটা আহত মেয়েকে কোলে তুলে ত্রস্ত পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো সে। আহত মেয়েটাকে দেখতেই জুলফিকারের নিশার কথা মনে পড়ে যায়। সাদাত প্রশ্ন করে,

“ স্যার আপনি? “

“ মেজর দূর্জয় কোথায়? “

সাদাত দ্রুত গলায় জবাব দেয়,

“ স্যার গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিলো। “

এইটুকু বলতেই জুলফিকার সাদাতকে ইশারা করে যেতে। সাদাতও আর অপেক্ষা না করে মেয়েটাকে নিয়ে বাহিরে চলে যায়। জুলফিকার দ্রুত করিডোরের দুই পাশে প্রত্যেকটা রুম চেক করতে করতে একাউন্টসের রুমের সামনে এসেই তার পা জোড়া থেমে যায়।

রক্তাক্ত মেঝের উপরে একটা লাশ বুকে টেনে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে নীরব ভঙ্গিতে বসে আছে দূর্জয়। দরজার ওপাশ হতে এখন কোনো নারী স্বরও ভেসে আসছে না। হয়তো সৈন্যরা মেয়েটাকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছে। জুলফিকারের উপস্থিতিতেও দূর্জয়ের মধ্যে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। যেমন ছিলো তেমনই আছে। নির্লিপ্ত। জুলফিকার এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে দূর্জয়ের পাশে। স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিথর দেহের মুখপানে। মুহুর্তেই তার বুকও কামড়ে উঠে। ছেলেটাকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন জুলফিকার। ছেলেটার জন্মের দু’দিনের মাথায় বন্ধুর সঙ্গে হসপিটাল পৌঁছে কোলেও তুলেছিলেন সে। অথচ সেই দুই দিনের ছেলেটাই আজ জীবনের বাইশ বছর বয়সে এসে তার জীবন গতি থেমে গেলো।

দীপ্তর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জুলফিকার দূর্জয়ের কাধে হাত রাখতে নিলেই তার ফোনটা বেজে উঠে। ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই অপরপ্রান্ত হতে বলে উঠে,

“ স্যার ওয়েবসাইটের লোকেশন ট্র্যাক করতে সক্ষম হয়েছি। “

“ কোন জায়গা? কোন জায়গা হতে এই ওয়েবসাইট এক্সেস করা হচ্ছে? “

অপরপ্রান্তের মানুষটা এবার বেশ জড়তা মিশ্রিত সুরে বললো,

“ স্যার, এখানে কান্ট্রি নেম ফিলিস্তিন শো করছে। “

ছোট্ট বাক্যটুকু শুনতেই জুলফিকারের ভ্রু কুচকে কুচকে আসে। তার মুখ চিড়ে বেরিয়ে আসে,

“ হোয়াট! “

অপরপ্রান্তের মানুষটা এবার বেশ ভীত গলায় বলে,

“ স্যার আমি এক্ষুনি রিচেক করছি। আ’ম শিওর কোনো টেকনিক্যাল ইস্যুর জন্য হয়তো এমনটা শো করছে। আ’ম সরি। আমি আবার নিশ্চিত হয়ে আপনাকে একুরেট তথ্য জানাবো। “

কলটা কেটে জুলফিকারও এবার স্থির ভঙ্গিতে বসে রয়। তার মাথা ঝিম ধরে আসছে। প্রফেশনাল লাইফের বিভিন্ন ঝড় ঝাপ্টা সামলে এতো গুলো বছর পাড় করার পর এখন এই কেসটা তাকে খুব পীড়া দিচ্ছে। একের পর এক প্রশ্নের জালে কেসটা আরো ঘোলা হচ্ছে। ফিলিস্তিন? কিভাবে সম্ভব? ওই রকম ইহুদীদের বিপক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত একটা দেশের পক্ষে কিভাবে সম্ভব এতো বড় একটা মিশন পরিচালনা করা? কখনোই না। অন্তত জুলফিকার মুজতবার কাছে এই তথ্যটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জুলফিকার বলে উঠে,

“ এখান থেকে চলো দূর্জয়। নিজের আবেগ সামলাও। অন্তত এখানে আবেগটা দেখিও না। খুব বড়ো একটা ঝামেলায় ফাসবে তুমি। আমি সবটা সামলানোর ব্যবস্থা করছি। “

জুলফিকারের বলা কথাগুলো দূর্জয়ের কানে পৌঁছায়। আবেগ? আসলেই তো দূর্জয়ের আবেগ দেখানোর অনুমতি নেই। পুরুষ মানুষ! দু ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিলে লোকে দূর্বল ভাববে। শত্রুরা নিজের প্রতিপক্ষকে আঘাত করতে তেড়ে আসবে। এতো বছর যেই কাজটা করে নি দূর্জয়, আজ তা কিভাবে করবে সে? দূর্জয় আবেগ দেখায় না। তবে উঠেও যায় না। একই ভঙ্গিতে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসে রয়। জুলফিকার এবার ধমকে উঠে,

“ বোকামি করো না দূর্জয়। আতঙ্কবাদীর লাশ বুকে জড়িয়ে বসে থাকার মানে বুঝতে পারছো? কারো কানে এই খবর গেলে খুব ফাসবে। চলো এখনি। “

আতঙ্কবাদী শব্দটা দূর্জয়ের কানে বেশ তীক্ষ্ণ ঠেকে। তার ভাই আতঙ্কবাদী নয়। তার ভাইকে আতঙ্কবাদী বানানো হয়েছে। আর যারা এই কাজটা করেছে তাদের পরিণাম আরো ভয়ংকর হবে। দূর্জয় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের সেই পরিণতি দেখবে।

__________

কলেজ প্রাঙ্গণে এসে জমা হচ্ছে একের পর এক অসংখ্য এম্বুল্যান্স। সেই সকল এম্বুল্যান্সে আহত শিক্ষার্থীদের তোলা হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। সেই আহত শিক্ষার্থীদের ঠিকঠাক ভাবে এম্বুল্যান্সে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব সৈন্যরাও নিজেদের কাধে যেনো তুলে নিয়েছে। কিন্তু যাওয়ার পথে এম্বুল্যান্স গুলো চরম বিপাকে পড়েছে। সৈন্যদের নিরাপত্তা সীমার ওপারেই রয়েছে উপচে পড়া মানুষের ভীড়। হোস্টেজদের অভিভাবক এবং সাংবাদিকদের ভীড় ঠেলে গাড়ি বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে প্রায়।

এরকম পরিস্থিতি দেখে সাইফের মেজাজ বিগড়ে যায়। এই আবেগী জাতি অসময়ে আবেগ দেখায় প্রচুর। যা সাইফের কাছে চরম বিরক্তিকর মনে হয়। সে বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ বালামার, এদের কি বিবেক নাই নাকি? মাইয়া গুলারে হসপিটালে নেওয়া বেশি ইম্পোরট্যান্ট এখন। আর এরা রাস্তা ব্লক করে দাঁড়ায় আছে। “

কথাটা বলতে বলতেই সাইফ এগিয়ে যায় ভীড়ের দিকে। তার সাথে সাথে তার টিমের বাকিরাও এগিয়ে যায়। সবাই যখন ভীড় কমাতে ব্যস্ত তখন সাদাত পুলিশের কাছ থেকে মাইকটা হাতে নিয়ে বলে উঠে,

“ আপনারা প্লিজ ভীড়টা কমান। জায়গা খালি করুন। এম্বুল্যান্স গুলোকে যেতে দিন। ইঞ্জুরডদের অবস্থা আরো ক্রিটিক্যাল করে তুলবেন না প্লিজ। “

সাদাতের কথার পিঠে একজন মধ্যবয়স্ক নারী কান্না মিশ্রিত সুরে বলে,

“ আমার মেয়ে। আমার মেয়েকে দেখবো আমি। “

সাদাত নরম গলায় আশ্বাস দিয়ে বলে,

“ ম্যাম, আপনি হসপিটালে যান। সবাইকে ওখানেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখানে ওয়েট করে আপনারা নিজেদের সময় নষ্ট আর পরিস্থিতি জটিল করা ছাড়া আর কিছুই করছেন না। প্লিজ বুঝুন। “

সারাদিন কিছু সংখ্যক পুলিশের চামাড়ের ন্যায় আচরণের পর সৈন্যদের তরফ থেকে এই নরম গলার কথায় হোস্টেজদের পরিবারের সদস্যরা কিছুটা শিথিল হয়। তারা একে একে সরে গিয়ে ভীড় কিছুটা কমায়। সাইফ সাদাতের থেকে মাইকটা নিজের হাতে নিয়ে বলে,

“ আমার সাংবাদিক ভাই বোনেরা আপনারাও প্লিজ একটু কো অপারেট করুন। এম্বুল্যান্স গুলো যাওয়ার সুযোগ করে দিন আগে। তারপর নিজেদের নিউজ কাভার করুন। “

লোক ভীড়ে চোখ বুলাতে ব্যস্ত সাদাতের দৃষ্টি হঠাৎ করেই এক জায়গায় স্থির হয়। সে বিস্ময় নিয়ে সেই পানে তাকাতেই ভীড়ের মধ্য থেকে একটি অবয়ব দ্রুত লুকিয়ে পড়ে। সাদাত প্রথমে অবাক হলেও সঙ্গে সঙ্গে সে সাইফকে বলে ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে সেই অবয়বকে খুঁজতে।

ব্যস্ত পায়ে ভীড় ঠেলে বেরোনোর চেষ্টার মাঝেই আচমকা কারো সাথে ধাক্কা লেগে পাকা রাস্তায় বসে পড়ে এক রমণী। এম্বুল্যান্স বের হওয়ার রাস্তা করে দিতে সবাই তখন দ্রুত পায়ে সরে যেতে ব্যস্ত। সেই ধাক্কাধাক্কিতে কিছু সংখ্যক মানুষ রমণীর ডান হাতের পিঠের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যায়। ব্যথায় কুঁকড়ে হাতটা সরিয়ে নিতেই একটি বলিষ্ঠ হাত এসে রমণীকে টেনে দাঁড় করায়। প্রথমে রমণী থ্যাঙ্কিউ বলতে নিলেও সেই হাতের মালিককে দেখে তার মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হয় না। সাদাত শক্ত মুখে প্রশ্ন করে,

“ কি নাম যেনো তোমার? হোয়াটেভার! তুমি এখানে কি করছো? আবার আমাকে ফলো করছো? “

মুখ লটকে রমণী প্রশ্ন করে,

“ তোমার মেমোরি এতো ডাল? ডিফেন্সে চান্স পেলে কি করে বলো তো? “

প্রশ্নের বিপরীতে পাল্টা প্রশ্ন শুনে সাদাত বিরক্ত হয়। সে মেয়েটার হাত ধরে টেনে ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসে। কিছুটা দূরে নিরিবিলি এক জায়গায় এসে তার হাত ছেড়ে দিয়ে শাসায়,

“ উদ্দেশ্য কি সেটা বলো তোমার? “

“ তোমার কি মনে হয়? এই চট্টগ্রাম শহর তোমার একার? “

“ দেখো মেয়ে! তোমাকে আমি প্রথম দিন থেকে সন্দেহের খাতায় তুলে রেখেছি। এই নিয়ে তিনবার এবং এটাই শেষ বার। ফারদার যদি আমি তোমাকে এরকম স্পাইগিরি করতে দেখি খুব খারাপ হয়ে যাবে। “

কথাটা বলেই সাদাত প্রস্থান করতে নিলে মেয়েটা রাগী গলায় বলে উঠে,

“ এক্সকিউজ মি এংগরি ইয়াং ম্যান। আমার নাম স্নিগ্ধা। সো ফারদার কল মি বাই মাই নেম। “

সাদাত ফের বিরক্ত হয়। তার কেনো মনে হচ্ছে মেয়েটা চাইছে যেনো সাদাত তার নাম মনে রাখুক? ব্যস্ততা না থাকলে এখনই এই মেয়েটাকে দেখে নিতো সাদাত।

__________

ফোলা ফোলা চোখ মেলে ঘুম থেকে উঠেছে কেবল বহ্নি। চারিদিকে তাকিয়ে সে দেখে রুমে কেউ নেই। ফেইরি লাইটের টিমটিমে আলোয় রুমটা মৃদ আলোকিত হয়েছে। সেই আলোর সাহায্যে আরেকবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিজের পাপাকে খুঁজে সে। সন্ধ্যায় পাপা এসে কি আদুরে স্বরে তাকে ডেকেছিলো। বহ্নি সঙ্গে সঙ্গে সব অভিমান ভুলে দরজা খুলে দেয়। পাপা কি সুন্দর তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলো। নিজ হাতে খাইয়েও দিয়েছিলো। বহ্নি মাম্মার কথা জিজ্ঞেস করতেই পাপা বলেছিলো মাম্মা এখনো হসপিটালে। আরো কিছুদিন পর ফিরবে। বহ্নি আর কোনো প্রশ্ন করে নি। করবেই বা কেনো? সে তার পাপাকে সবথেকে বেশি বিশ্বাস করে। পাপা কখনো মিথ্যা বলবে না নিশ্চয়ই? কিন্তু এখন পাপা কোথায় গেলো? বহ্নি ঘুমানোর সময় তো তার পাশেই ছিলো!

প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই বহ্নি বিছানা ছেড়ে পা টিপে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। সবার আগে সে নিজের রুম বরাবর মাম্মা পাপার রুমে উঁকি দেয়। রুমটা খালি দেখে সে ভেবে নেয় সম্ভবত পাপা হসপিটালে মাম্মার কাছে গিয়েছে। এটা ভেবে বহ্নি নিজের রুমে যেতে নিলেই বাড়ির বাহির হতে অদ্ভুৎ শব্দ ভেসে আসে। বহ্নি বরাবরই কৌতূহলী সব ব্যাপারে। এই শব্দ শুনেও তার মনে আগ্রহ জন্মায়। সেই আগ্রহ নিয়েই সে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে। নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে যেতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

মাটির উপর উবুড় হয়ে পড়ে আছে একটা পুরুষ। নাক মুখ দিয়ে তার বেলাগাম গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তাকে লাগাতার লাথি মারছে হিরণ। হিংস্র পশুর ন্যায় ফোস ফোস করছে সে। তার ঠিক পাশেই ইবাত দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মধ্যে হিরণকে থামানোর কোনো লক্ষ্মণ নেই। হিরণ এই পর্যায়ে লাথি মারা থামিয়ে এবার একটা শক্ত রড হাতে নিয়ে তা দু’হাতে ধরে আঘাত করতে শুরু করে সেই পুরুষকে। কিন্তু পুরুষটার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হওয়ার উপায় নেই। সাদা রঙা একটা টেপ দিয়ে তার মুখ আটকে দেওয়া হয়েছে। কেবল উউউ জাতীয় শব্দ বের করতে সক্ষম হচ্ছে সে। কিন্তু সেই শব্দটুকুও হিরণের সহ্য হয় না। সে আরো জোরে আঘাত করে হিসহিসিয়ে ভয়ংকর স্বরে বলে উঠে,

“ এই জানোয়ারের বাচ্চা! মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করবি না। আমার মেয়ের ঘুম ভাঙলে তোকে জানে মেরে ফেলবো আমি। “

এতটুকু দেখতেই বহ্নি দ্রুত দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে সামান্য ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকে তার পাপার মতো দেখতে এক হিংস্র পশুর অত্যাচার। হিরণ ফের হিসহিসিয়ে বলে উঠে,

“ দায়িত্ব দিয়েছিলাম তোকে। বাণীকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। একটা মেয়ে তোর চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়ে গেলো অথচ তোরা হাতে চুড়ি পড়ে বসেছিলি? “

কথাটুকু বলেই আরো আগ্রাসী হয়ে মারতে শুরু করে হিরণ। লোকটা গলাকাটা মুরগির মতো মাটিতে কাতরাতে থাকলো। এতদূর দেখেই বহ্নি ভয়ে তটস্থ হয়ে যায়। সে মানতে চায় না এই মুহুর্তে সে যা দেখেছে সব সত্যি। বহ্নি যখন আড়ালে লুকিয়ে ভয়ে কাপছে সেই মুহুর্তে হিরণ পেটানো থামিয়ে একটা রিভলবার নিয়ে লোকটার দিকে তাক করে শুট করে। সাইলেন্সার বসানোর ফলে সেই শুটের কোনো শব্দ না হলেও, সেই দৃশ্য দেখে বহ্নি পালাতে নিলে দরজায় ঠিকই শব্দ হয়।

হিরণ, ইবাত সহ উপস্থিত আরো কয়েকজনের দৃষ্টি স্থির হয় দরজার পানে। হিরণ এক মুহুর্ত কিছু একটা ভেবে চোখ খিচে বন্ধ করে শিট বলে উঠে। পরপরই সে দ্রুত পায়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। বহ্নি ততক্ষণে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। দরজা লাগিয়ে সে সোজা বিছানার নিচে গিয়ে উবুড় হয়ে চোখ বুজে শুয়ে রয়। ভয়ে এখনো কাপছে সে। সম্পূর্ণ শরীর দিয়ে তরতর করে ঘাম ছুটেছে। দরজা ধাক্কানোর শব্দ হতেই বহ্নি ভয়ে আরো কুঁকড়ে যায়। অস্ফুটে বলে উঠে,

“ মাম্মা। “

হিরণ বাহির থেকে লাগাতার ডেকে যাচ্ছে,

“ বহ্নি! মা! পাপা ডাকছি। দরজা খুলো মা। “

__________

গোছল সেড়ে প্রচন্ড লজ্জা এবং আড়ষ্টতা নিয়েই দূর্জয়ের কথামতো আলমারির তাক হতে তার মায়ের একটা শাড়ি নিয়ে পড়ে বাণী। হালকা সবুজ রঙের শাড়িটা কি কাপড়ের তৈরী সেই সম্পর্কে ধারণা নেই বাণীর। এসব ব্যাপারে ধারণা তার বরাবরই কম। তবে শাড়ির সঙ্গে পরিধেয় সাদা রঙের ব্লাউজটা যে সুতির কাপড়ের তা সে বুঝতে পেরেছে।

গোছলে যাওয়ার আগে সে জানালা দিয়ে একবার বাহিরে উঁকি মেরে দেখেছিলো। দূর্জয়ের নিযুক্ত করা সেই নিরাপত্তা কর্মীরা এখনো অটল পায়ে বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করে বাণী। এই নিরাপত্তা কর্মীদের বেড়াজাল পেরে নিশ্চয়ই হিরণ তার কাছে পৌঁছাতে পারবে না? নাকি পারবে? কে জানে!

আপাতত বাণী উদাস ভঙ্গিতে বিছানায় বসে নিজের মেয়ের কথা ভাবছে। বহ্নির জন্মের পর থেকে একদিনও নিজের মা ছাড়া থাকে নি। এই ক্ষানিকের বিচ্ছেদ বাণীর হৃদয় পুড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায়ও নেই। সুযোগ বুঝে সে নিজের মেয়েকেও ওই জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবে। নিজের কাছে নিয়ে আসবে। এইসব ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবে। যেখানে থাকবে না কোনো খারাপ ছায়া।

ভাবনায় ডুবে থাকা বাণী বাস্তবতায় ফিরে কলিংবেলের শব্দে। সে দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। পীপহোল দিয়ে বাহিরে একবার উঁকি দিয়ে দ্রুত হাতে দরজা খুলে। দ্বারপ্রান্তে ইউনিফর্ম পরিহিত দূর্জয়কে দেখে সে কোনো প্রশ্ন করার আর সাহস পায় না। এই থমথমে দূর্জয় ভয়ংকর। তা বাণীর জানা আছে। সে নীরবে সড়ে দাঁড়ায়। দূর্জয় একপলক তাকে দেখে নিয়েই ঘরে প্রবেশ করে। বাণীও দরজা লাগিয়ে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। দূর্জয় বদ্ধ কামরার সামনে গিয়ে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে। রুমের লক খুলে অন্ধকার সেই রুমে প্রবেশের পূর্বে থমথমে গলায় শুধায়,

“ আমি বাড়িতে আসায় যদি তোমার মধ্যে কোনো ইনসিকিউরিটি কাজ করে তাহলে রুমে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে বসে থাকো। ফজরের আজান হলেই আমি বেরিয়ে যাবো। তার আগে রুম থেকে বের হবে না। “

আদেশমূলক কথাটুকু বলেই দূর্জয় সেই অন্ধকার রুমের ভেতর প্রবেশ করে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দেয়। বাণী ঠায় দাঁড়িয়ে রয় আপন জায়গায়। তার মন কু ডাক গাইছে। খুব খারাপ কিছু কি হয়েছে? কে জানে!

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৩.

চাবির সাহায্যে দরজার লকটা খুলেই নব ঘোরায় এক সু বলিষ্ঠ হাত। হাতের রগ গুলো তার ফুলে দৃশ্যমান হয়ে আছে। অতি নীরবে সাজানো রুমটায় প্রবেশ করতেই উৎকণ্ঠা মিশ্রিত দৃষ্টি মেলে চোখ বুলায় সম্পূর্ণ রুম জুড়ে। কেউ নেই। ধীর পায়ে আরো কয়েক কদম এগিয়ে আসতেই তার কানে পৌঁছায় কারো নিঃশ্বাসের শব্দ। নীরব রুমটায় সেই নিঃশ্বাসের স্বর বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের সেই স্বর অনুসরণ করে সে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়। অত:পর হাঁটু গেড়ে বসতেই দেখতে পায় বিছানার নিচে দৃশ্যমান একটা ফ্রকের অংশ।

বিছানার চাঁদর কিছুটা উঠিয়ে নিচের দিকে উঁকি দিতেই সে দেখতে পায় নিজের প্রিয় মুখখানি। কিন্তু সবসময়ের মতো সেই মুখে আজ মিষ্টি হাসি লেপ্টে নেই। সেই মুখ জুড়ে লেপ্টে আতংক। ফোলা ফোলা চোখ দিয়ে বয়ে পড়ছে অবিরত নোনাজল। হিরণকে দেখতে পেয়েই ভয়ে আরেকটু ভিতরের দিকে চলে যায় সেই ছোট্ট দেহের মালিক।

হিরণ ফ্যালফ্যাল চোখ মেলে অবলোকন করে নিজের মেয়ের এই দূরে সড়ে যাওয়ার চেষ্টা। মুখে কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারে না সে। গলার কাছটায় তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করে। যেনো কোনো কাঁটাতার দিয়ে তার গলা শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মুখে কিছু বলতে না পারলেও নিজের ডান হাতটা মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে তাকিয়ে রয় হিরণ। বহ্নি সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাতকে অগ্রাহ্য করে প্রতিবাদী গলায় বলে,

“ নো! তুমি কিলার পাপা। “

হিরণ আরেক দফা বুকে যন্ত্রণা অনুভব করে। হেরে যাওয়া গলায় বলে,

“ তুমি ভুল বুঝছো মা। “

“ নো পাপা। তুমি ওই আংকেলকে মারছিলে। তুমি আংকেলকে শুট করেছো। “

হিরণ এক্সপ্লেনেশন দেওয়ার মতো করে বলে,

“ না মা। ওইটা ব্যাড আংকেল ছিলো। তাই পাপা মেরেছি। তুমি পাপাকে ট্রাস্ট করো না? “

হিরণের প্রশ্নের পিঠে বহ্নি দ্বিধায় পড়ে যায়। সে একহাতে চোখের পানি মুছে হিরণের দিকে তাকায়। কোনটা বিশ্বাস করা উচিত তার? যা সে চোখে দেখেছে নাকি যা তার পাপা বলছে? এটা সত্য যে তার পাপা কখনো কাউকে মারে না। অন্তত বহ্নি কখনো দেখে নি। তাহলে কি সত্যিই ওই আংকেলটা ব্যাড ছিলো?

দ্বিধা সংশয় নিয়ে বহ্নি প্রশ্ন করে,

“ কি করেছে ওই আংকেল? “

হিরণ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। বহ্নির এই প্রশ্নে মৃদু আশ্বাস খুঁজে পায় সে। শান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ ধরো তুমি তোমার প্রিয় টয়েস একজনকে দিয়ে বললে সেটার খেয়াল রাখতে। কিন্তু সে সেটার খেয়াল রাখতে পারে নি। হারিয়ে ফেলেছে। তাহলে তুমি কি করবে? “

বহ্নি ক্ষোভ মিশ্রিত সুরে বলে,

“ খুব রাগ করবো। ওকে খুব হেট করবো। “

“ এক্স্যাক্টলি! পাপাও ওই আংকেলকে একটা রিসপোন্সিবেলিটি দিয়েছিলাম। পাপার খুব দামী একটা জিনিস দেখে রাখার। কিন্তু ওই আংকেল সেই জিনিসটা ভালো করে দেখে রাখে নি। যেই কারণে জিনিসটা এখন হারিয়ে গিয়েছে। কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। “

বহ্নি এবার রাগ, কান্না ভুলে অবাক গলায় প্রশ্ন করে,

“ ওই জিনিসটা তোমার অনেক প্রিয়? “

“ খুব প্রিয়। “

বহ্নি এবার আরেকটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“ আমার থেকেও বেশি প্রিয়? “

মেয়ের প্রশ্নের পিঠে হিরণ হেসে দেয় এবার। হাসতে হাসতে জবাব দেয়,

“ ঠিক তোমার সমান প্রিয়। “

বহ্নি মনে মনে কিছুটা নারাজ হয়। কি সেই জিনিসটা? যেটার গুরুত্ব তার পাপার লাইফে ঠিক তার সমান? বহ্নির লটকে রাখা মুখ দেখে হিরণ মৃদু হেসে ফের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

“ বেরিয়ে আসো মা। পাপা ওয়েট করছি। “

বহ্নি গাল ফুলিয়ে বলে,

“ একটা শর্ত আছে? “

“ কি শর্ত? “

“ ওই আংকেলকে তুমি শাস্তি দিয়েছো। এখন ট্রিট করে ঠিক করে দাও। কাউকে মারা খুব খারাপ কাজ। মাম্মা শুনলেও রাগ করবে। “

বহ্নির কথা শুনে হিরণ ক্ষনিক সময় নীরব রয়। ছেলেটা আর বেঁচে আছে বলে তো মনে হয় না। বেঁচে থাকলেও হয়তো তার দেহ এতক্ষণে জিন্দা মাটিতে সমাধি দিতে নিয়ে গিয়েছে ইবাত। আর হিরণ চায়ও না ছেলেটা বাঁচুক। কিছু দোষ ক্ষমার অযোগ্য হয়। ক্ষমা যতই মহৎ গুণ হোক না কেন, হিরণের দ্বারা ক্ষমা করা সম্ভব না। তবুও সে বহ্নির মন রক্ষার্থে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলে,

“ আচ্ছা। “

বহ্নি এবার খুশি হয়। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। ওই আংকেল ঠিক হয়ে গেলে তার পাপা আর কিলার হবে না। এই বিশ্বাস মনে পুষে বহ্নি দ্রুত ইদুর ছানার মতো বিছানার নিচ হতে বেরিয়ে আসে। হিরণ মেয়েকে কোলে তুলে বুকের সাথে মিশিয়ে নিতেই একটা স্বস্তি অনুভব করে। মেয়ের চোখে ক্ষানিকের ঘৃণা এখনো তার বুকে ছুরির মতো বিঁধে আছে।

__________

অন্ধকার কক্ষের মেঝেতে বিছানার সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছে একজন পুরুষ। শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে আঁধার পানে। ভাই হারানোর করুণ শোক নীরবে পালন করতেই যেনো বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে সে। মনের মধ্যে জমে আছে অপ্রকাশিত দুঃখ ও প্রশ্নের পাহাড়। কি এমন শক্তি আছে এই জঙ্গি চক্রের কাছে? কোন শক্তি ব্যবহার করে তারা সাধারণ মানুষকে অমানুষে রূপান্তর করে? অলৌকিক কোনো শক্তি? কিন্তু তা কি করে সম্ভব?

দূর্জয়ের চোখের সামনে ভেসে উঠে দীপ্তর ছোটবেলার দৃশ্য। সরল হাসির অধিকারী ছেলেটা দূর্জয়ের বিপরীত চরিত্রের ছিলো। সবার সঙ্গে মিশতে জানতো, মন খুলে হাসতে জানতো। সেই ছেলেটা কিভাবে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে শিখলো? ঠিক কোন মন্ত্র পড়ে কানে ফুঁ দেওয়ার পর একটা মানুষের সম্পূর্ণ সত্তা বদলে দেওয়া সম্ভব?

এতো প্রশ্নের ভীড়ে দূর্জয়ের মস্তিষ্ক যখন চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে ঠিক সেই সময় তার মাথায় আরেকটা প্রশ্ন উঁকি দেয়। আসার পথে জুলফিকার মুজতবা বলেছেন, তিনি নাকি খবর পেয়েছেন যে এই টেরোরিজম রিলেটেড আপডেট পাবলিশ করা ওয়েবসাইটের এক্সেস নাকি ফিলিস্তিন থেকে দেওয়া হচ্ছে। কথাটা শুনে দূর্জয়ের মস্তিষ্ক আরো ফাঁকা হয়ে পড়ে। একজন বোধ সম্পন্ন মানুষের পক্ষে এরকম অবান্তর কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না কখনো। দূর্জয়ও বিশ্বাস করে না। কারণ এরকম স্টেটমেন্টের পক্ষে কোনো যুক্তিই খাটে না। একটা জাতি যারা কিনা নিজেদের সার্বভৌম এবং ঈমানের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে অবিরত তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না এমন অমানবিক একটা মিশন পরিচালনা করা। আর তাছাড়াও ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক অবস্থাও এখন বেশ নড়বড়ে। ওই দেশে বসবাসরত কোনো নাগরিকের পক্ষেই সম্ভব নয় এমন ব্যয়বহুল একটা মিশন চালিয়ে যাওয়া। মোদ্দা কথা কোনো লজিকই মিলাতে পারছে না দূর্জয়।

এক সঙ্গে শোক, কষ্ট, প্রশ্নের মাঝে রাগও এসে হানা করে দূর্জয়কে। কর্ণেল জুবায়ের শিকদারের সেই ননসেন্স মার্কা অর্ডারের জন্য আজ এতো গুলো হোস্টেজের প্রাণ গেলো। দূর্জয় উনাকে বারবার ওয়ার্ন করেছিলো যে এই ইলেকট্রিসিটি কেটে অন্ধকারে ভিতরে প্রবেশ করাটা শোচনীয় হবে না। টেরোরিস্ট এবং হোস্টেজ উভয়ই এতে ভীত হয়ে যাবে। টেরোরিস্টরা হয়তো এলোমেলো ভঙ্গিতে গুলি বর্ষণও করতে পারে। কেবল দূর্জয় নয় মিটিংয়ে উপস্থিত সকলেই এই বিষয়টা তুলে ধরেছিলো। কিন্তু কর্ণেল যেনো কানে তুলো গুঁজে রেখেছিলো। এতো গুলো অফিসারের কথা অগ্রাহ্য করে তিনি নিজের অর্ডারে অটল রইলেন। ফলাফল সরূপ এতো গুলো প্রাণ ঝরে পড়লো। এর দায়ভার কার? কর্ণেল তো কখনোই এই দায়ভার নিবেন না। তিনি কেবল নিজের পদোন্নতির পথ সুগম করতে ব্যস্ত।

বুকফাটা কষ্ট এবং প্রশ্নের ভীড়ে চাপা পড়ে দূর্জয় নিজের দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে। সব অসহ্যকর ঠেকছে তার কাছে। একটাই তো জীবন। তা-ও এতো কঠিন কেনো হতে হবে?

__________

আঁধার রাতে টিমটিমে আলোয় বিছানার একপাশে উত্তর দিকে পা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে একটা জীবন্ত পুতুল। তারই ঠিক পাশে দক্ষিণ দিকে পা দিয়ে শুয়ে আছে এক ত্রিশার্ধো পুরুষ। ঘাড়টা সামান্য ডান পাশে কাথ করে নিষ্পাপ পুতুলের মুখশ্রী দেখতে ব্যস্ত সে। তার এই পাপের রাজত্বে ছোট্ট এক টুকরো স্বস্তি বয়ে বেড়ায় এই মুখটা। স্বস্তি পাবে না-ই বা কেনো? মেয়েটা দেখতে অবিকল নিজের মায়ের মতো হয়েছে। হুবহু কিশোরী বাণীর প্রতিরূপ। যদিও এখন আর বাণীর চেহারায় সেই লাবণ্য নেই। অযত্ন এবং অবহেলায় পুরো চেহারার রূপ বদলে ফেলেছে।

আচমকা নিজের বাম পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই হিরণ মাথা ঘুরিয়ে সেই পানে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় সে কিশোরী বাণীকে। গায়ে ঢিলেঢালা টিশার্ট এবং ট্রাউজার, চুলগুলো ব্যাঙ্গস কাট দেওয়া, গোলগাল মুখশ্রী। বহ্নির মতোই সে-ও উত্তর দিকে পা দিয়ে শুয়ে আছে। হিরণ তাকাতেই একগাল হেসে প্রশ্ন করে,

“ বলুন তো, আপনি কাকে বেশি ভালোবাসেন? টমবয় বাণীকে নাকি বহ্নির মা-কে? “

হিরণ সেই হাসিমাখা মুখে দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

“ সম্পূর্ণ বাণীকেই ভালোবাসি। “

বাণীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। সে ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসে। নীরবে হিরণের মাথার কাছটায় বসে সামান্য ঝুঁকে তার কপালে পরশ ছোঁয়ায়। হিরণের চোখ বুজে আসে। সে জানে এই সবটা কেবলই তার কল্পনা। কারণ কল্পনা ব্যতীত এটা কভু সম্ভব নয়। কল্পনায় ডুবে হিরণ ফিরে যায় অতীতের পাতায়।

__________

তীব্র বর্ষণ এবং গোধূলি লগ্নের বিদায়বেলা তখন। একহাত গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে রেখে অপর হাতে ফোন কানে চেপে ধরে কথা বলতে ব্যস্ত এক যুবক। গাড়ি এগিয়ে চলছে সবুজে ঘেরা সিলেট শহরের পাকা সরু পথ ধরে। আচমকা গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাস্তায় কাউকে পড়ে থাকতে দেখে সে। কিন্তু ততক্ষণে ব্রেক কষার মতো অবস্থা আর নেই। তাই বাধ্য হয়ে দ্রুত গতিতে সুকৌশলে স্টিয়ারিং চালিয়ে গাড়ি অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলে সে।

কোনো এক অপরিচিতাকে বাঁচানোর চক্করে লগ্ন শেষে গোধূলি বেলায় সেই যুবকও এক এক্সিডেন্টের শিকার হয়। সাদা গাড়িটা এক বিশাল গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ব্যাপক ধাক্কায় যুবকের মাথাও বাড়ি খায় স্টিয়ারিংয়ের সঙ্গে। যার ফলস্বরূপ তার নাক দিয়ে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসে তরল লাল পদার্থ। চেতনা হারায় সে।

__________

জ্ঞান ফিরতেই চোখ মেলে তাকায় সেই যুবক। সম্পূর্ণ শরীর অক্ষত থাকলেও আঘাতের ফলে মাথা কেবল সামান্য ভারী লাগছে তার কাছে। চারিদিকটা দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাতেই তার দৃষ্টি স্থির হয় ঠিক তার পাশের বেডে। হসপিটালের নীল চাদরে ঢাকা সিঙ্গেল বেডটায় ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রীর মালিককে বেশ খুটিয়ে খুটিয়েই দেখে এক জোড়া নিষ্পলক চোখ। কি হলো কে জানে? সেই মুখশ্রী তাকে আকর্ষিত করে। নামহীন নিকষ মায়ায় ডুবতে বাধ্য করে। জীবনের প্রতিটা পদে নিজের মর্জির জোর খাটানো যুবক নিজের মনের উপর জোর হারিয়ে বসে। মস্তিষ্ক বলে উঠে,

“ থেমে যা। আগাস না। “

যুবক মস্তিষ্কর কথাকে অগ্রাহ্য করলো। খানিকটা সময় এভাবেই পেরিয়ে গেলো। যুবক নিজের সম্বিত ফিরে পেলো যখন একজন নার্স দুটো বেডের মধ্যে শুভ্র একটা পর্দা টেনে দিলো। ঘুমন্ত মুখশ্রী চোখের আড়াল হতেই যুবক সেই নার্সের পানে তাকায় ক্ষানিকটা বিরক্ত মিশ্রিত দৃষ্টি মেলে। ত্রিশার্ধো নার্স হাতের ফাইলে কিছু একটা লিখতে লিখতে বলে,

“ এখানকার সাবেক মেয়রের মেয়ে। প্রায় সবাই চিনে ওকে। তাই ওর ফ্যামিলিকে ইনফর্ম করতে আমাদের ঝামেলা হয়নি। তারা যেকোনো সময় পৌঁছে যাবে। কিন্তু তোমার ফ্যামিলির কাউকে ইনফর্ম করা সম্ভব হয় নি। ফোনটা অক্ষত নেই। সেজন্য নাম পরিচয়ও কিছু লেখা হয়নি। নিজের নামটা বলো। “

যুবক শান্ত গলায় জবাব দেয়,

“ হিরণ। “

নার্স ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ শুধু হিরণ? “

“ হ্যাঁ। “

“ আগে পিছে কিছু নেই? “

এহেন প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হয় হিরণ। তার মুখেও ফুটে উঠে সেই বিরক্তির ভাব। কোনো উত্তর না পেয়ে নার্স বলে,

“ ফোন এনে দিবো? বাসায় জানাতে চাও? “

“ প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি। একাই যেতে পারবো। “

হিরণের উত্তর শুনে নার্স আর অপেক্ষা করে না। যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলেই হিরণ প্রশ্ন ছুড়ে,

“ মেয়েটার কি হয়েছে? “

নার্স এক পলক ভ্রু কুচকে হিরণকে আগাগোড়া পরখ করে জবাব দেয়,

“ বৃষ্টিতে ভিজেছে হয়তো। খুব জ্বর বাধিয়েছে। রাস্তায় পড়ার ফলে হাত পায়ে কিছু জায়গায় ছিলেও গিয়েছে। “

হিরণ ফের প্রশ্ন করে,

“ মেয়রের মেয়ের নাম কি? “

নার্স এবার হিরণের কৌতূহলে বেশ বিরক্ত হয়। এই ইমারজেন্সি ইউনিটে এতো গুলো রোগী রেখে কি এখন সে বসে এই মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত পাগলের প্রশ্নের জবাব দেবে নাকি? তবুও সে শেষ বারের মতো বলে উঠে,

“ আনিসুজ্জামান তালুকদারের মেয়ে বাণী তালুকদার। “

__________

ফজরের আজান সবে পড়লো বলে। নির্ঘুম রাত পাড় করা দূর্জয় নীরবে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ব্যক্তিগত রুমটা চাবি দ্বারা লক করে এক মুহুর্তের জন্য অন্য পাশের বদ্ধ দরজার পানে চায়। অত:পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেইন দরজা খুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে। মেইন দরজাটা লাগানোর শব্দ হতেই দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে বাণী। নির্ঘুম রাত সে-ও পাড় করেছে। কখনো নিজের মেয়ের চিন্তায় তো কখনো দূর্জয়ের সেই থমথমে রূপের কারণ কি হতে পারে তা ভেবে। খুব ভয়ংকর কিছু কি ঘটেছে? নীরবে একমুঠ নিঃশ্বাস টেনে বুকে পুড়ে নিয়েই সে দরজার পানে তাকিয়ে রয়। সে জানে দূর্জয় ফিরবে। বাণীর মুখে সত্যটা শোনার জন্য সে অবশ্যই ফিরবে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]