এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৫১+৫২

0
331

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫১.

মতিউর আরাফাতের তদারকিতে হসপিটালের প্রাইভেট একটা কেবিনে তার ছেলের ঠাই হলো। সম্পূর্ণ কেবিনটা বিভিন্ন মেডিসিনের গন্ধে ভরপুর হয়ে আছে। বিছানায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুয়ে থাকা যুবকটার জ্ঞান ফিরতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। ঝাঁঝালো মেডিসিনের গন্ধ তার নাকে এসে ঠেকে।

রুমে তখন কেবল একজন ভদ্রমহিলা উপস্থিত ছিলেন। ভদ্রমহিলাটি আর কেউ নয় বরং প্রত্যয়ের মা। যিনি ফুপিয়ে কান্নাকাটি করতে ব্যস্ত। ছেলের জ্ঞান ফিরতে দেখেই তিনি উঠে আসেন। ছেলের শিয়রে দাঁড়িয়ে বলে,

“ বাবা, এখন কেমন লাগছে? “

প্রত্যয় মায়ের ক্রন্দনরত মুখটা দেখে গলায় সামান্য জোর নিয়ে বলে,

“ কান্নাকাটি থামাও। “

ফিজা বেগম সঙ্গে সঙ্গে নিজের চোখ মুছে ফেলেন। কেবিন থেকে হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে যান অপেক্ষারত সবাইকে ছেলের জ্ঞান ফেরার খবরটুকু জানাতে। ডক্টরের অনুমতি নিয়ে এক সঙ্গে সকল সৈন্য হুড়মুড়িয়ে কেবিনে প্রবেশ করে। সাইফ এসেই প্রথমে বলে উঠে,

“ শালা! ভালো ভয় দেখাইসোস। “

প্রত্যয় নাকমুখ কুচকে বলে,

“ শালা ডাকবি না আমাকে। আমার কোনো বোন নেই যাকে তোর কাছে তুলে দিবো আমি। “

সাইফ নাক উঁচু করে বলে,

“ গুড ফর ইউ। এম্নেও আমি এখন কারো বইনের প্রতি ইন্টারেস্টেড না। দুনিয়ার সকল নারী এখন আমার বইনের জাত। “

সাইফের মুখে এমন একটা কথা শুনে সবাই হা করে রয়। রাফি নাক টেনে বলে,

“ লাগতা হে ডাল মে কুছ কালা হে। “

ফারদিন সুর টেনে বলে,

“ ইয়া ফির পুরা ডাল হি কালা হে! “

প্রত্যয় নিজের পায়ের দিকে একবার তাকায়। এখন পায়ে কিছুটা ব্যথা অনুভব করলেও মনে মনে সে এক প্রকার শান্তি পাচ্ছে। বিস্ফোরণের পর ধোঁয়ার কারণে যখন কিছু দেখা যাচ্ছিলো না আর প্রত্যয় নিজের পায়েও কিছু অনুভব করতে পারছিলো না তখন সে ভীত হয়ে পড়েছিলো। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো তার পা’টা আছে তো?

কারণ এসব মিশনে এরকম ঘটনা বহু সৈন্যের সঙ্গে ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে। কেউ হয়তো নিজের পা হারিয়েছে কিংবা কেউ নিজের হাত। আবার অনেকে নিজের শ্রবণ শক্তিও হারিয়েছে। আর তারপর? তারপর পুরোটা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। সেই জীবনটা মোটেও সুখকর নয়। সেই অসহায়ত্বে মোড়ানো জীবন কোনো সৈন্যেরই কাম্য নয়। এর থেকে শহীদ হওয়া শ্রেয়।

সবাই যখন খুনসুটিতে প্রত্যয়কে মাতিয়ে রাখতে মশগুল ঠিক সেই মুহুর্তে কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে আলাউদ্দিন সাহেব। উনার পিছু পিছু বিড়ালের মতো প্রবেশ করে ধূসর রঙের টপস আর জিন্স পরিহিত এক রমণী। গলায় তার এক কমলা রঙের স্কার্ফ ঝুলছে। গুটিসুটি পায়ে কেবিনে প্রবেশ করে সে এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়। সৈন্যরা আলাউদ্দিন সাহেবকে দেখতেই সালাম দিয়ে সড়ে দাঁড়ায়।

আলাউদ্দিন সাহেব এসে প্রত্যয়ের হালচাল জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়। প্রত্যয় অসুস্থ অবস্থায়ই ভদ্রতার সুরে বলে,

“ আপনি কষ্ট করে কেনো আসতে গেলেন আংকেল! “

অত:পর আলাউদ্দিন সাহেবকে পাশের চেয়ারটায় বসার জন্য অফার করে। আলাউদ্দিন সাহেব আর বসেন না। ছেলেটাকে জীবিত দেখে এবং এই অবস্থায়ও নম্র ভদ্র ব্যবহার দেখে উনার মন ভরে যায়। তিনি প্রত্যয়কে রেস্ট নেওয়ার সুযোগ করে দিতে বিদায় নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। উনার সঙ্গে আসা বিড়াল ছানাটা পিছু পিছু কেবিনে প্রবেশ করলেও একই ভঙ্গিতে আর পিছু পিছু প্রস্থান করে না। ঠায় দাঁড়িয়ে রয়।

সাইফরা একবার আড়চোখে জেসিকে দেখে আরেকবার প্রত্যয়কে। দু’জনকে দেখে ভাবে এদের কিছুক্ষণের জন্য একা ছেড়ে দেওয়া শ্রেয়। সবাই নীরবে রুম থেকে প্রস্থান করে। সাইফ বেরিয়ে যাওয়ার আগে জেসির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিচুস্বরে বলে,

“ হ্যালো ঝগড়াঝাটি ভাবী। আপনার যদি উদ্দেশ্য গালিগালাজ করে আমার আধমরা ভাইকে ফুল মরা বানিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে কষ্ট করে এখানে থাকবেন না আপনি। আর যদি আপনার উদ্দেশ্য আমার আধমরা ভাইকে সেবা টেবা করে সুস্থ করা হয়ে থাকে, তাহলে থাকুন সমস্যা নেই। ইউর লাভলি দেবর উইল মেক শিওর কেউ যেনো আপনাদের বিরক্ত না করে। “

কথাটুকু বলেই সাইফ চোখ টিপে হাসে। জেসি গরম চোখে তাকায়। বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ ম্যানারলেস ছেলে। “

সাইফ সে-সব কথা গায়ে মাখে না। সে মাঞ্জা মেরে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ প্রত্যয় এতক্ষণ নীরবে চোখ মুখ কুচকে দূর হতে জেসিকে দেখছিলো। জেসিও তার পানে তাকায়। মুমূর্ষু লোকটার মুখে বিরক্তির ছাপ বড্ড বেমানান। এই লোকটার উচিত ছিলো এখন আদুরে মুখ করে পড়ে থাকা। কিন্তু তা না করে কুচকানো সুতির কাপড়ের মতো মুখটা করে রেখেছে।

জেসি সূক্ষ্ণ চোখে একবার প্রত্যয়কে মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করে। পরপর বিড়াল রূপী রমণী রিনরিনে ভঙ্গিতে এসে বেডের পাশের চেয়ারে বসে শুধায়,

“ আমার সামনে আসতে মানা করেছিলাম। তুমি তো মিয়া দুনিয়া থেকেই বিদায় নিতে যাচ্ছিলে। “

প্রত্যয় মুখ কুচকে বলে,

“ তুমি এখানে মজা লুটতে এসেছো? “

জেসি হাই তুলতে তুলতে বলে,

“ মোটেও না। সুপাত্রী হতে এসেছি। “

প্রত্যয় অবাক সুরে জানতে চায়,

“ মানে? “

জেসি প্রত্যয়ের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,

“ এদিকে আশেপাশে শপিং করার জন্য উপযুক্ত জায়গা কোনটা জানো? “

“ কি কারণে? “

“ তাড়াহুড়ায় আসার সময় ভালো করে প্যাকিং করতে পারি নি। আর আমার কাছে হসপিটাল টাইপ দুঃখী দুঃখী জামাও নেই খুব একটা। তাই কিনতে হবে। “

জেসির অদ্ভুৎ সব কথা শুনে প্রত্যয় বিরক্ত হয়ে জানতে চায়,

“ সেগুলো দিয়ে তোমার কি কাজ? আর তাছাড়া দুঃখী দুঃখী জামা কি জিনিস? “

“ দুঃখী দুঃখী জামা মানে শাবানা টাইপ জামা। তোমাকে নাকি আর ক’টা দিন শুনলাম হসপিটালেই রাখবে। এই কয়দিন রেগুলার হসপিটালে আসা যাওয়া করতে হবে আমার। তাই হসপিটাল টাইপ জামা কাপড় কিনতে হবে। “

প্রত্যয় এবার রেগে যায়। মৃদু চেচিয়ে উঠে,

“ এই মেয়ে, এসেছো, দেখেছো, এখন চুপচাপ ফিরে যাও। তোমার নাটক আমার মোটেও সহ্য হচ্ছে না। এসব নাটক করবে না একদম। “

জেসি তার রাগকে থোড়াই কেয়ার করে বলে,

“ আমার সামান্য নাটক সহ্য করতে পারছো না, আমাকে কিভাবে সহ্য করবে তুমি? “

__________

হসপিটালের ক্যানটিনে এক চতুর্ভুজ আকৃতির টেবিলে এসে ভীড় জমিয়েছে পাঁচজন। রাফি ফোনে অন্যার সঙ্গে ফোনালাপে ব্যস্ত। ফারদিন আর জুনায়েদ টেবিলে মাথা এলিয়ে দিয়ে ক্ষনিকের জন্য বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত। সাইফও ফোনের কিবোর্ডে যুদ্ধ চালাচ্ছে। আর সাদাত নীরবে দূর পানে তাকিয়ে আছে।

অর্ডারকৃত গরম গরম ধোঁয়া উঠা পাঁচ কাপ কফি নিয়ে হাজির হয় ওয়েটার। ওয়ান টাইম কাপ গুলো টেবিলে রেখে যায় তিনি। কফির সুঘ্রাণ পেয়ে দ্রুত মাথা তুলতে নিলেই জুনায়েদের হাতের সঙ্গে লেগে একটা কাপ সাদাতের গায়ে পড়ে যায়। গরম তরলের সংস্পর্শে আসতেই সাদাত লাফিয়ে উঠে। জুনায়েদও অপ্রস্তুত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে,

“ শিট! জামা খুল। “

সাদাত আঁতকে উঠে,

“ না। “

সাইফ ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি তুলে সন্দিহান ভঙ্গিতে সাদাতের পানে তাকায়। বাকিরাও একই কাজ করে। ফারদিন তো বলেই ফেলে,

“ এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? ও তো স্লিপ অফ টাঙে বলে ফেলেছে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর ইজ্জত ধরে টান মেরেছে। “

সাদাত মাথা নেড়ে বলে,

“ ওইরকম কিছু না। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি। “

বলেই সাদাত চোরের মতো পালিয়ে যায়। সাইফ বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ পোলাডা অদ্ভুৎ আচরণ করতেসে না? “

রাফি আর ফারদিন বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আর জুনায়েদ বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে। সাদাত এতো ভয় পেলো কেনো? সে তো কেবল ইউনিফর্মের চিন্তা করে মুখ ফসকে জামা খুলতে বলেছিলো।

সিংকের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে পানি নিয়ে ইউনিফর্ম যথাসাধ্য পরিষ্কার করতে ব্যস্ত সাদাত। হঠাৎ আয়নার দিকে চোখ পড়তেই সাদাত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মনে পড়ে যায় চার মাস আগের ঘটনা।

জঙ্গলে আঁধারে তলানো সেই রাতে সাদাতের সাহায্যের পূর্ব শর্ত হিসেবে ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের এজেন্ট দৃশান নামরা তাকে সত্যটা জানিয়েছিলো। কার পিছু করছে সে এবং কেনো করছে সেই সত্যটুকু বলেছিলো।

সবটা শুনে সাদাত নীরব রয়। মনে মনে ঠিক করছিলো এই নারীকে সাহায্য করা উচিত হবে কি না! দৃশান হয়তো তার সেই সংশয় আন্দাজ করতে পেরেছিলো। তাই আশ্বস্ত করতে সে বলে,

“ আই হ্যাভ ভ্যালিড প্রুফ। আই ক্যান শো ইউ। জাস্ট কিপ ইট এ সিক্রেট এন্ড হেল্প মি। “

সাদাত শান্ত স্বরে বলে,

“ প্রুফ দেখে তারপর ডিসাইড করবো আমি। “

কথাটুকু বলে সাদাত দৃশানের দিকে তাকাতেই দেখে দৃশান সরু চোখে তার পানে তাকিয়ে আছে। সাদাত কোনো এক গাছে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। দৃশানের অদ্ভুৎ দৃষ্টি দেখতেই সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে,

“ আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? “

দৃশান স্পষ্ট গলায় বলে,

“ টেক অফ ইউর ক্লথ। “

সাদাত বিস্মিত হয়েছিলো। পরমুহূর্তে দৃশান নামরার দ্বিধাহীন দৃষ্টি দেখে আঁতকে উঠে। তার মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে,

“ ছিহ। “

দৃশান তাড়া দিয়ে বলে,

“ দ্রুত খুলো। “

সাদাত এক প্রকার দূরে ছিটকে গিয়ে বলে,

“ বিহেভ ইউরসেল্ফ। “

দৃশান ভ্রু কুচকে সাদাতের দিকে তাকিয়ে রয়। পরমুহূর্তেই সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে,

“ আল্লাহ! তোমার ফিগার দেখতে চাইছি না ডাফার। আই হেভ নো ইন্টারেস্ট ইন ইউ। একটা জোক তোমার ঘাড় বেয়ে শরীরে নেমে গিয়েছে। তাই বলছিলাম। “

অতীত থেকে ফিরে আসে সাদাত। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। এই সেকেন্ড হ্যান্ড এম্বারাসমেন্টের ঘটনাটা কি কোনোভাবে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা সম্ভব না?

__________

পাথরের মূর্তির ন্যায় পরিচিত লিভিং রুমের সোফাটায় বসে আছে বাণী। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ছোট্ট দেহটা। ঘুমোচ্ছে না। দু চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। দূর্জয় রান্নাঘরে আছে। বাসায় বাজার ছিলো না। তাই আসার পথে নেমে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাবার প্যাক করে নিয়েছিলো। সঙ্গে সুপারশপ থেকে কিনে নিয়েছে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস।

একটা খাবারের প্লেটে সুন্দর করে বিরিয়ানি সেই সঙ্গে সালাদ সাজিয়ে সে খাবার টেবিলে এনে তা রাখে। কাচের গ্লাসটায় পানি ঢেলে রাখতেও ভুলে না। প্রতিটা কাজে মার্জিতের ছাপ। সে লিভিং রুমে এসে বাণীর পানে তাকায়। পুরোটা রাস্তা এরকম পাথরের মতোই চুপচাপ বসেছিলো। একটাও কথা বলে নি।

দূর্জয় এগিয়ে এসে বলে,

“ বহ্নি আমার সঙ্গে থাকুক। তুমি খেয়ে নাও। “

বাণী ফ্যাকাশে চোখ তুলে তাকায় দূর্জয়ের পানে। দূর্জয় কিছু বলে না। এগিয়ে এসে বহ্নিকে নিজের কোলে নিয়ে বলে,

“ ডোন্ট ওয়ারি। আই ক্যান হ্যান্ডেল হার। “

বাণী আর কিছু বলে না। নীরবে উঠে খাবার টেবিলের দিকে যায়। তার বুকে বয়ে যাওয়া কষ্টটাও যেমন সত্য একইভাবে তার পেটের ক্ষিধেটাও সত্য। সেই শেষ সকাল এগারোটার দিকে খেয়েছিলো সে। তারপর আর খাওয়া হয় নি। বহ্নি… বাচ্চাটাও সারাদিন অভুক্ত। কিছু খাবে কি-না কে জানে!

বাণী ধীমি গলায় বলে,

“ বহ্নিকে খাইয়ে নেই আগে। “

দূর্জয় বলে,

“ ওর কথা আমি ভুলে যাই নি। ওকে নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি খেতে বসো। “

বাণী আর কথা বাড়ায় না। দূর্জয়ের কথার বিপরীতে সে কখনো কিছু বলতে পারে না। কেনো পারে না জানে না।

বাণী খেতে বসতেই দূর্জয় এগিয়ে এসে বলে,

“ তুমি খাও। আমরা ভিতরেই আছি। “

বাণী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে দেখে দূর্জয় তার মেয়েকে নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত রুমে প্রবেশ করছে। সেই রুমটা! যেই রুমটা নিয়ে দূর্জয়ের এতো গোপনীয়তা! বাণী দৃষ্টি ফিরিয়ে খাওয়ার দিকে মনযোগ দেয়। খিদায় তার পেট ও বুক দুটোই ব্যথা করছে।

আচমকা বাণীর মনে পড়ে যায় ছয় বছর পূর্বের অতীত। যখন বহ্নি তার পেটে ছিলো। সারাটা দিন বাণী না খেয়ে থাকতো। যত ধরনের অবহেলা আছে সব করতো নিজের প্রতি, পেটের বাচ্চাটার প্রতি। কিন্তু শেষ রাতে খিদের যন্ত্রণাটা আর সহ্য করতে পারতো না। বুক ব্যথাটা যখন অসহ্যকর ঠেকতো তখন বাধ্য হয়ে জেদের সঙ্গে সন্ধি বিচ্ছেদ করতো। সবার আড়ালে লুকিয়ে রান্নাঘরে ঢু মারতো। ফ্রিজ থেকে বের করে ঠান্ডা সাদা ভাত খেতো। সেই ভাত মুখে দিয়ে চোখের পানি ফেলতো।

তার প্রেগন্যান্সির জার্নিটা আর দশটা স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সির মতো না হলেও সেই সময়কার ক্রেভিংস গুলো সন্তান সম্ভাবা দশটা নারীর মতোই ছিলো। মনের সুপ্ত কোণে বিভিন্ন কিছু খাওয়ার ইচ্ছে জাগলেও তা কখনো প্রকাশ করতো না সে। সেটাও একপ্রকার অবহেলা ছিলো তার। নীরব অবহেলা।

পুরনো সেই বিভৎসকর দিন গুলোর কথা মনে পড়তেই বাণীর চোখ ভিজে উঠে। সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে বর্তমানে ফিরে আসে৷ তখনই তার কানে ভেসে আসে টুংটাং কোনো এক যন্ত্রপাতির শব্দ। বাণী অবাক দৃষ্টি মেলে তাকায় দূর্জয়ের ব্যক্তিগত রুমের দিকে। সেখান থেকেই শব্দটা ভেসে আসছে।

বাণী খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় সেই রহস্যময় রুমটার দিকে। যত কাছে এগোচ্ছে ততই পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে সবটা। দরজার কিঞ্চিৎ অংশ ফাঁকা ছিলো। সেই ফাঁক গলে ভেতরে তাকাতেই বাণী দেখে রুমের সঙ্গে লাগোয়া অন্ধকার বারান্দাটায় দুটো ছায়া অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাটা একটা মোড়া জাতীয় কিছুতে বসে আছে। তার সামনে মেঝেতে পা ভাজ করে বসে আছে সুঠাম দেহী পুরুষটা। কোলে তার একটা বাদ্যযন্ত্র। বাণী দূর হতে গঠন দেখেই বুঝতে পারে ওটা একটা গিটার।

ইউনিফর্ম পরিহিত পুরুষটা সুকৌশলে গিটারে নিজের আঙুলের সাহায্যে সুর তুলছে। সেই সুরকে পরিপূর্ণ করতে মেলাচ্ছে নিজের পুরুষালী স্বর,

“ এক দিন আপ ইউ
হামকো মিল জায়েঙ্গে
ফুল হি ফুল রাহো মে
খিল জায়েঙ্গে
মে নে সোচা না থা।
এক দিন জিন্দেগী
ইতনি হোগি হাসিন
ঝুমেগা আসমান
গায়েগি ইয়ে জামিন
মে নে সোচা না থা। “

বাণী অদ্ভুৎ দৃষ্টি মেলে দেখে সেই ছায়া মানবকে। বিস্মিত হয়ে শুনে সেই সুর। বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। শাহরিয়ার দূর্জয় গাইছে? গান গাইতে জানে এই ছেলে? বাণী মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়। পরমুহূর্তেই অন্ধকারাচ্ছন্ন বারান্দা হতে শুনতে পায় কারো খিলখিল হাসির শব্দ।

বাণী ফের তাকায় সামনে। বাচ্চা মেয়ের অবয়বটা এবার মোড়া ছেড়ে মেঝেতে গিয়ে সেই পুরুষের কোলে জায়গাটুকু দখল করে বসে আছে। দু’জন ফিসফিস করে কি যেনো বলছে। পরমুহূর্তেই বাচ্চাটা স্নেহপূর্ণ খিলখিল হাসিতে মাতিয়ে তুলে চারিপাশটা। খুব সন্তর্পণে বাণীর বুক থেকে একটা বিশাল পাথর সড়ে যায়। সে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। দরজার পাশের দেয়ালটায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। দু চোখের পল্লব বন্ধ করে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা স্বাভাবিক স্বর শুনে চোখ মেলে তাকায়। দরজার সামনে এসে দাঁড়ানো দূর্জয় একপলক বাণীকে দেখে নিয়ে বলে,

“ ভয় কেটে গিয়েছে। আপত্তি না থাকলে ও আমার সঙ্গে আমার রুমে ডিনার করুক? “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫২.

নীরবে মাথা নেড়ে দূর্জয়কে অনুমতিটুকু দিতেই দূর্জয় রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। বাণী পিছন থেকে বলে উঠে,

“ আ’ম সরি। “

দূর্জয় অবাক হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। জানতে চায়,

“ কেনো? “

বাণী জানে দূর্জয় নিজের প্রাইভেসি নিয়ে কতটা পজেসিভ। সেই খেয়াল মাথায় রেখেই সে শুধায়,

“ আমি গিটারের শব্দ শুনে আগ্রহবসত উঠে এসে রুমের দরজার সামনে দাঁড়াই। দরজা সামান্য ফাঁক ছিলো তাই বহ্নিকে দেখছিলাম। তোমার প্রাইভেসি নষ্ট করার ইনটেনশন ছিলো না। “

দূর্জয় অবাক হয়ে বাণীকে দেখে। সারাদিন এরকম একটা সিচুয়েশন পাড় করার পরও এই মেয়ে তার প্রাইভেসি নষ্ট হলো কি-না সেই ভয় পাচ্ছে! আচমকা দূর্জয়ের খারাপ লাগে। সে স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ দরজা আমি ইচ্ছে করেই পুরোপুরি লাগাই নি। তোমার মেয়ে আমার সঙ্গে ছিলো। ইউ ক্যান চেক অন হার এনি টাইম। তোমার অধিকার এটা। আমার বিন্দুমাত্র প্রাইভেসি নষ্ট হয় নি। “

বাণী কিছু বলে না। কেবল অস্বস্তিতে ডুবে রয়। দূর্জয় নিজেই রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ তুমি খেতে বসো। আমি আমার আর বহ্নির ডিনার রেডি করতে যাচ্ছি। “

বাণী চুপচাপ গিয়ে খেতে বসে। দূর্জয়ের রুমের ভেতর থেকে এখন অপরিপক্ক হাতের গিটারের টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই বহ্নি খেলছে ওটার সঙ্গে! আচমকা সেই শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। সেকেন্ড দশ একের মধ্যে দরজা খুলে বহ্নি রুম থেকে বেরিয়ে আসে। চোখে মুখে এখন আর সেই ভয়ের ছাপটা নেই। বরং নতুন ইন্সট্রুমেন্ট প্লে করার উচ্ছ্বাস মুখ জুড়ে। সে ডাইনিং এরিয়ায় এসে প্রফুল্ল স্বরে ডাকে,

“ ইয়ো মেজর! “

দূর্জয় তখন রান্নাঘর থেকে কাজ শেষ করে কেবল প্লেট সাজিয়ে বের হচ্ছিলো। সে-ও ডাইনিং এরিয়ায় এসে মৃদু হেসে বলে,

“ ইয়েস কিডডো। “

বলে দূর্জয় নিজের হাতের প্লেট দুটো টেবিলে রাখে। পরপর দুটো পরিষ্কার কাঁচের গ্লাস টেবিলে রেখে ফের রান্নাঘরে ফিরে যায়। সেকেন্ডের ব্যবধানেই একটা গরম সসপ্যান হাতে বেরিয়ে আসে। বহ্নি একটা চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে আগ্রহ ভরে দেখে মেজরের তৈরী করা ডিনার। কিন্তু মুহুর্তেই তার মুখের ভাব ভঙ্গি বদলে যায়। উচ্ছ্বসিত মুখটায় আঁধার নেমে আসে। সে কাদো কাদো মুখ করে বাণীর দিকে তাকায়। বাণীও তখন নিজের খাওয়া ভুলে চোখ বড়ো বড়ো করে দূর্জয়ের কর্মকাণ্ড দেখছিলো। তার চোখ মুখও অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।

দূর্জয় অতি আগ্রহের সঙ্গে কাঁচের দুটো গ্লাসে গরম গরম দুধ ঢেলে নিতে নিতে প্রশ্ন করে,

“ বাণী, তুমি খাবে? “

বাণী আর বহ্নি এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠে,

“ নো ওয়ে! “

দূর্জয় চমকায়। হকচকিয়ে সে মা আর মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। দু’জনের মুখে অমাবস্যার আঁধার দেখে সে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ হোয়াট হ্যাপেন্ড? “

বহ্নি চোখ মুখ কুচকে বলে,

“ ইয়াক! “

বাণীও একইভাবে বলে,

“ ইয়াক! সিরিয়াসলি দূর্জয়? “

দূর্জয় বিস্মিত হয়। সে বুঝছে না এখানে ইয়াক বলার মতো কি আছে! সে তো কতো সুন্দর করে মশলা এবং ঝাল কম দিয়ে বাচ্চাদের জন্য যেভাবে খিচুড়ি রান্না করে সেরকম নরম খিচুড়ি রান্না করেছে। সঙ্গে রয়েছে চারটে সিদ্ধ ডিম। দুটো বহ্নির আর দুটো দূর্জয়ের। সাইড ডিশ হিসেবে নিয়েছে মরিচহীন সালাদ, যাতে বহ্নি নির্দ্বিধায় খেতে পারে। আর ড্রিংকস হিসেবে রয়েছে গরম গরম এক গ্লাস দুধ। পারফেক্ট হেলথি ডিনার।

দূর্জয় প্রশ্ন করে,

“ আপনাদের মুখ বিকৃত করে ইয়াক বলার কারণ জানতে পারি? “

বাণী বলে,

“ ডিম সিদ্ধ? গরম দুধ? এগুলো কেউ খায়? আর সাথে তোমার ওই মশলা ছাড়া পাতলা খিচুড়ি। আমার তো দেখেই বমি পাচ্ছে। “

দূর্জয় শুধায়,

“ এটা একটা ৫ বছরের বাচ্চার জন্য পারফেক্ট হেলদি মিল। আর তাছাড়াও যেকোনো বয়সের মানুষই এটা খেতে পারবে। এতে বমি পাওয়ার কি আছে? “

বাণী বলে উঠে,

“ আমি এসব কখনো খেতে পারি না। আমার মেয়েও এসব খেতে পারে না। উই হেইট অল দিজ। “

দূর্জয় বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ এজন্যই তো শরীরের এই অবস্থা। “

বহ্নি নীরবে পালিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট মেজর। গুড নাইট মাম্মা। “

কথাটুকু বলে বহ্নি বেশিদূর যেতে পারে না। দূর্জয় একহাতে তাকে পিছন থেকে কোলে তুলে এনে টেবিলের উপর বসায়। বিজ্ঞের ন্যায় বলে,

“ লিসেন কিডডো, ফার্স্ট অফ অল মিথ্যা বলা ইজ এ ব্যাড থিং। আপনার এখন ঘুম পাচ্ছে নাকি খিদে পাচ্ছে সেটা আমি ভালো করেই জানি। সেকেন্ড অফ অল, খাবার নিয়ে নাক ছিটকানোও উচিত না। এন্ড ফাইনালি, খাবার ওয়েস্ট করা একটা ব্যাড হ্যাবিট। আর আপনি জানেন আমি মেজর কিভাবে হয়েছি? আমি যখন ট্রেনিংয়ে ছিলাম তখন প্রতিদিন দুটো করে বয়েলড এগ খেতাম এন্ড সেই সঙ্গে মিল্ক। আই নো এটার টেস্ট খুব একটা আহামরি না। কিন্তু আমাদের শক্তি জোগাতে তো হেল্প করে। সো টেস্টের দিক দিয়ে একটু কম্প্রোমাইজ করা উচিত না আমাদের? “

বহ্নি মুখটা অসহায় করে তাকিয়ে রয়। এটা সত্য এসব খাবার তার পছন্দ নয়। কিন্তু মেজরের বলা কথাগুলোকেও সম্পূর্ণ ইগনোর করা যাচ্ছে না। সে কনফিউজড হয়ে বাণীর দিকে তাকায়। যে দূর্জয়ের কথাগুলো কানে না তুলে এখনো মুখ কালো করে রেখেছে। দূর্জয় এবার বাণীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

“ তুমি না বললে ও খাবে না। আর ও যদি না খায় তাহলে ভেবো না আমি খাবার ওয়েস্ট করবো। ওর খাবারটুকু তখন তোমাকে তোমাকে খেতে হবে। আই মিন ইট। “

বাণী আঁতকে উঠে। যে খাবার তার মা-ও তাকে কখনো জোর করে খাওয়াতে পারে নি সেই খাবার সে কোনো মূল্যেই মুখে তুলবে না। কোনো মেজরের ধমকের তোপে পড়েও না। নিজে টর্চারড হওয়ার থেকে মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করানোটাই তার বেটার অপশন মনে হয়। তাই সে জোর করে মৃদু হেসে মেয়েকে বলে,

“ মা, ইট ইজ হেলথি। খেয়ে নাও। “

বহ্নি এবার বাধ্য হয়ে হা করে। দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরে আড়ালে সামান্য হাসে। অবশেষে এই মানুষ দুটোর মাইন্ড আজকের ঘটনা থেকে ডাইভার্ট হয়েছে সেটাই আসল কথা। দূর্জয় হাসিটুকুকে অদৃশ্য করে সামনে ফিরে চামচ দিয়ে খাবার তুলে বহ্নির মুখে ধরে। কোনো উপায় না পেয়ে নিজের অপছন্দের খাবারটুকু চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো শেষ করে বহ্নি।

__________

কনকনে শীতের চাদরে মুড়িয়ে আছে চারিপাশটা। আকাশে সূর্যের দেখা নেই। সকালের কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে বাহিরের দৃশ্যপট। ঘুম ঘুম চোখ দুটো মেলে তাকায় প্রত্যয়। পুরো মুখে তার বিরক্তির ছাপ। হসপিটালের বেডটা এতো আনকম্ফোর্টেবল! পুরোটা রাত ও শান্তিতে ঘুমাতে পারে নি। যতবারই চোখ লেগে এসেছে, তার কিছুক্ষণ পরেই আবার অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছে।

প্রত্যয় ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ বুজে ফেলে। পরপর আবার চোখ মেলে তাকায়। বুঝতে পারছে না সে। সামনের দৃশ্যটা কি সে সত্য দেখছে নাকি হাই ডোজ মেডিসিনের প্রভাব?

প্রত্যয় শিথিল চোখে দেখে সামনের দৃশ্যটুকু। তার কেবিনের একপাশে দু সিটের একটা ফোমের সোফা আছে। গতকাল সারারাত একটু পর পর ঘুম ভেঙেই সেই সোফাটায় নিজের মা ফিজা বেগমকে দেখেছিলো প্রত্যয়। কিন্তু এই মুহুর্তে সেই সোফাটায় তার মায়ের জায়গায় বিরক্তিকর মেয়ে জেসির অবস্থান।

পড়নে একটা ঢিলেঢালা প্লাজো আর সেই সঙ্গে মলিন রঙের শাবানা গোছের কুর্তি। অফ হোয়াইট রঙের একটা পাতলা ওড়না দিয়ে অর্ধেক মাথা ঢাকা। কানেগোজা এলোমেলো চুলগুলো ওর শাবানা রূপটাকে সম্পূর্ণ করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। পা তুলে দ আকৃতিতে বসে সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে সে। নিশ্চিন্তে ঘুমানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে হসপিটাল কম শশুর বাড়িতে গভীর ঘুমে মগ্ন সে।

প্রত্যয় পুরো রুমে একবার চোখ বুলায়। আম্মু কোথায়? এই অসহ্যকর মেয়েটা আম্মুর জায়গায় কি করছে? মনে প্রশ্ন গুলো উঁকি দিতেই প্রত্যয় আবার তাকায় জেসির পানে। সঙ্গে সঙ্গে সে আরেক দফা বিরক্ত হয়। এই মেয়ে যেই স্টাইলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে তাতে করে যেকোনো সময় সোফা থেকে পড়ে কোমরের হাড়গোড় ভাঙবে নিশ্চিত।

প্রত্যয় একবার ভাবে ডাক দিবে। পরক্ষণেই তার মনে হয় এই মেয়ে যদি ঘুম ভাঙানোর অপরাধে গালি দিয়ে বসে? প্রত্যয় ভদ্রলোক। এই মেয়ের গালির বিপরীতে সে দুটো কড়া করে গালি দিতে পারবে না। পরে সেই আফসোসে তার বিরক্তির পরিমাণ বেড়ে যাবে। সুতরাং ডাক না দেওয়াই উত্তম।

প্রত্যয় ধীরে ধীরে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠে। পায়ে আপাতত আর তেমন একটা ব্যথা নেই তার। শরীরের অন্যান্য অংশেও নেই। যতটুকু আছে ততটুকু প্রত্যয়ের মতো পুরুষের জন্য সহনীয় মাত্রায় পড়ে। কেবল মাথা ব্যথাটাই তাকে পীড়া দিচ্ছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে নিলে কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।

দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে রয় প্রত্যয়। একটু স্বাভাবিক অনুভব করতেই ধীরে ধীরে বেড ছেড়ে নামে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সোফার দিকে। এখন কি করবে সে? ঠেলেঠুলে এই মেয়েকে ভেতরের দিকে পাঠাবে? যাতে বেকায়দায় পড়ে না যায়? তাতেও এই মেয়ে তেঁতে উঠবে। এসি চালিত রুমটা বড্ড ঠান্ডা হয়ে আছে। প্রত্যয় আশেপাশে তাকায়। কোথাও কোনো এক্সট্রা ব্ল্যাংকেট না দেখে বেড থেকে নিজের ব্ল্যাংকেটটা নিয়ে এসে সাবধানে জেসির গায়ে দিয়ে দেয়। অত:পর নীরবে পাশে দাঁড়িয়ে রয়। অসহ্যকর মেয়েটা কিনারে এসে পড়লে যাতে সামলাতে পারে।

মিনিট বিশ পেরোয়। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রত্যয়ের বিরক্ত লাগছিলো। তবুও কিছু করার নেই। আচমকা জেসি ঘুমের মাঝে বেকায়দায় কিনারে ফিরতে নিলেই তার মাথাটা পড়ে যেতে নেয়। প্রত্যয় ঘটনার আকস্মিকতায় কি করবে বুঝতে না পেরে সামান্য ঝুঁকে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। ক্যানেলা পড়ানো হাতের সাহায্যে মাথাটা সামলে নেয়।

জেসির সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ছুটে যায়। সে বিস্মিত হয়ে চোখ মেলে তাকায়। প্রত্যয়কে নিজের মুখের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখেই ছিটকে দূরে সরে যায়। লাফ মেরে উঠে দাঁড়ায়। অপ্রস্তুত গলায় বলে,

“ চোখ লেগে গিয়েছিলো। “

প্রত্যয় সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মুখে গাম্ভীর্য রেখে বলে,

“ তুমি আমার কেবিনে কি করছো? “

জেসি অবাক হয়। পরপর স্পষ্ট গলায় বলে,

“ এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছি। “

প্রত্যয় বিরক্ত হয় আরেক দফা। সামান্য ধমকে বলে,

“ আই মিন এখানে তোমার কি কাজ? “

“ তোমার কিছু লাগবে নাকি সেই দায়িত্বে নিযুক্ত আছি আপাতত। “

“ এটা তোমার দায়িত্ব হলো কবে থেকে? “

“ যেদিন থেকে আমি ঘুমন্ত অবস্থায় পড়ে যাই কিনা সেটার খেয়াল রাখা তোমার ম্যাটার অফ কনসার্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। “

প্রত্যয় চুপ হয়ে যায়। সব প্রশ্নের উত্তর এই মেয়ের ঠোঁটের আগায় প্রস্তুত থাকে। বিরক্তিকর! প্রত্যয় ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে জানতে চায়,

“ কি চাচ্ছো তুমি? “

“ আব্বুর পছন্দ করা সুপাত্রকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখতে চাইছি। একই সঙ্গে নিজেও সুপাত্রী হওয়ার চেষ্টা করছি বললে ভুল হবে না। “

__________

ঘুম থেকে উঠেই নিজের নাস্তাটুকু সেড়ে ফোনে জরুরি আলাপে ব্যস্ত দূর্জয়। অভ্যাসবশত গোসল সেড়ে পুরো পরিপাটি জেন্টালম্যান বেশে আছে। বাণী আর বহ্নি তখনও পাশের রুমটায় ঘুমোচ্ছে। দূর্জয় ইচ্ছে করেই ওদের ডাকে নি।

আচমকা জুলফিকার মুজতবার কল পেতেই দূর্জয় তা রিসিভ করে। জুলফিকার মুজতবা জানায় দূর্জয়কে আজকেই ঢাকায় ফিরতে হবে। সবটা নীরবে শুনে দূর্জয়। অর্ডারের বিরোধিতা করে না মোটেও। তবে খুবই শান্ত ভঙ্গিতে জুলফিকারকে জানায় গতকাল বাণীর এপার্টমেন্টে সেই বিস্ফোরণের ঘটনা। এ-ও জানায় যে বাণী এবং বহ্নি এই মুহুর্তে তার বাসায় আছে।

জুলফিকার মুজতবা অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনার জন্য আফসোস প্রকাশ করে। পরপর বলে,

“ তুমি ওদের আমার বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসো। আমি নিশাকে কল করে বলছি। ও না-হয় আজকেই নাঈমার এখান থেকে ব্যাক করবে। “

দূর্জয় শান্ত গলায় শুধায়,

“ স্যার আগে বাণীর সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি। ওর অপিনিয়ন ছাড়া ওর ব্যাপারে ডিসিশন নেওয়াটা ঠিক হবে না। আর আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এজ সুন পসিবল ঢাকায় ব্যাক করছি। “

ঘড়ির কাটা ৮ টা পেরিয়েছে তখন। দূর্জয় বসে অপেক্ষা করছিলো বাণীর উঠার। অপেক্ষা বেশিদূর গড়ায় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বাণী। দরজা খুলতেই লিভিং রুমের সোফায় বসা দূর্জয়ের মুখোমুখি হয়। দূর্জয় স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ কথা ছিলো তোমার সাথে। “

বাণী নীরবে এগিয়ে আসে। দূর্জয়ের মুখোমুখি অপর পাশের সোফাটায় বসে। দূর্জয় কোনো ভনিতা না করে বলে,

“ আই হ্যাভ সাম আর্জেন্ট ওয়ার্ক। ঢাকায় ফিরতে হবে। হোপ সো আগামীকালের মধ্যে চলে আসবো। তোমার কি এই বাসায় থাকতে কোনো অসুবিধা হবে? একা কোনো সমস্যা হলে বলো। আমি তাহলে তোমাদের নিশার কাছে ড্রপ করে দিয়ে যাবো। “

বাণী চুপ রয়। তার কাছে এই দুটো বাসাতে থাকাটাই চরম অস্বস্তিকর। মানুষ গুলো তার জন্য যথেষ্ট করেছে। এখনো করে যাচ্ছে। কোনো আত্মীয়তার কিংবা রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই। বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু। কারণ বাণী কেবল তাদের কাছ থেকে পাচ্ছেই। বিনিময়ে কিছুই করতে পারছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাণী জবাব দেয়,

“ নয়টা বাজে আমার স্কুলে উপস্থিত থাকতে হবে। দশটা বাজে ক্লাস আছে। সাড়ে বারোটার মধ্যে ক্লাস শেষ হয়ে যাবে। বহ্নিকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো। ক্লাস শেষ হলে আশেপাশে বাসা দেখবো। ওদিকে বাসার অভাব নেই। “

দূর্জয় নীরবে কথাটুকু শুনে। বাণীর কথার অর্থ দাঁড়ায় সে দুটো বাসার একটাতেও থাকতে চাইছে না। না সে কোনো ধরনের সাহায্য নিতে চাইছে। ব্যাপারটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন যে কেউ এরকমই বলতো।

দূর্জয় চুপ থাকে কিছুক্ষণ। পরপর বলে,

“ তোমার পয়েন্ট অফ ভিউ আমি বুঝতে পারছি বাণী। তোমার ডিসিশনকেও আমি সম্মান জানাই। কিন্তু একটা দিন অপেক্ষা করা সম্ভব হবে না তোমার দ্বারা? আমি ফিরে আসার আগ পর্যন্ত? ট্রাস্ট মি আই ওন্ট লেট ইউ ডাউন। “

বাণী চোখ তুলে তাকায় আচমকা। বুঝতে পারে না দূর্জয় কি তাকে রিকুয়েষ্ট করছে? কে জানে! এই পুরুষের সঙ্গে রিকুয়েষ্ট করার টার্মটা ঠিক মেলাতে পারে না বাণী। বেখেয়ালি হয়ে বসে। আনমনে বলে উঠে,

“ আমি ভেবেছিলাম তুমি গান গাওয়া অপছন্দ করো। “

আউট অফ কনটেক্সট কথার পিঠে দূর্জয় শান্ত গলায় জবাব দেয়,

“ ভাবনার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকতে হবে, এমন কোনো লিখিত আইন নেই। “

বাণী থমকায়। শীতল বরফের ন্যায় তাকিয়ে রয়। দূর্জয় পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বলে,

“ তোমার উত্তর কি হ্যাঁ ধরে নিবো আমি? “

বাণী মাথা নিচু করে বলে,

“ জানি না। “

দূর্জয় জানি না’র সমার্থক উত্তর হিসেবে হ্যাঁ-ই ধরে নেয়। সে আগে থেকে তৈরিই ছিলো। এই মুহুর্তে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের ঘড়িটা আরেকবার ঠিক করে লাগিয়ে নিতে নিতে বলে,

“ দুটো দিন স্কুলে যেতে হবে না। কল করে জানিয়ে দাও। বহ্নি ঘুমোচ্ছে, তাই ওকে আর বিরক্ত করছি না। কিচেনে আমি নাস্তা রেডি করে রেখেছি। ফ্রুটস ও কাটা আছে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় সবকিছুই রাখা আছে। কোনো অসুবিধা হলে টি টেবিলে রাখা কাগজটায় যেই নাম্বার আছে সেটায় কল করবে। ওই নাম্বারটা আমার ব্যক্তিগত। আর টেক কেয়ার। আই উইল বি ব্যাক সুন। “

এতগুলো কথা একসাথে শুনে বাণী বিষম খায়। কেবল মুখ ফুটে বলে,

“ তোমার নাম্বার আছে তো আমার কাছে। “

দূর্জয় ফিরে তাকায় না। দরজার কাছে গিয়ে পায়ে জুতার লেস বাধতে বাধতে জবাব নেয়,

“ ওটা আমার জব সেক্টরের নাম্বার। পার্সোনাল নাম্বার আলাদা। “

বাণী ঠায় বসে রয়। অনেকটা রোবটের মতো। শাহরিয়ার দূর্জয় গতকাল বহ্নিকে নিজের ব্যক্তিগত রুমে এক্সেস দিলো। আজ বাণীকে নিজের ব্যক্তিগত নাম্বার দিলো। আদৌ বিশ্বাসযোগ্য এটা? বাণী আর কিছু বলতে পারে না।

দূর্জয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার জন্য চাবিটা ঘুরায়। তখনই তার চোখ পড়ে বাড়ির পোর্চে। সকালের স্নিগ্ধ কুয়াশায় ওই মলিন মুখটা দেখে খুব পুরোনো একটা কথা মনে পড়ে তার। একবার তার আব্বু বলেছিলো ভালোবাসার সাতটা ধাপ রয়েছে। দূর্জয় অতি আগ্রহে জানতে চেয়েছিলো ধাপগুলো কি কি? শহীদ মেজর শাহরিয়ার রিফাতি তখন উত্তর দিয়েছিলেন – আগ্রহ, বিশ্বাস, মায়া, চিন্তা, ভালোবাসা, আসক্তি, ভালোরাখা।

দূর্জয়ের মন আচমকা নিভৃতে তারই অজান্তে প্রশ্ন করে বসে,

“ আমি কি চতুর্থ ধাপে আছি? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]