এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৫৩+৫৪+৫৫

0
370

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫৩.

অস্থির ভঙ্গিতে রাস্তাজুড়ে পায়চারি করছে সাইফ। রাস্তার দু ধারে সারি সারি সুপারি আর খেজুর গাছ। লোক সমাগম কম। শেষ বিকেলের মিঠে আলোতে চারিপাশটা মোহনীয় লাগছে। আচমকা রাস্তার অপর পাশে একটা রিকশা এসে থামতেই সাইফ পায়চারি থামিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায়৷ রিকশা হতে নেমে আসে শীতের স্নিগ্ধতার মতো স্নিগ্ধ একটা মুখ। গায়ে লাল রঙের থ্রি পিস জোড়ানো। শীত হতে মুক্তি পেতে তার উপর নিয়েছে শাল। মায়াবী চোখগুলোতে ঘন কাজল।

সাইফ ঢোক গিললো দূর হতে নিশাকে দেখে। মনে প্রশ্ন জাগে এতো সাজ আয়োজন কার জন্য? সাইফের মতো অধমের জন্য? ছোট্ট নিছক ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই সাইফের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। মুখটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠে।

রাস্তার অপর পাশে নিশা তখন রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সাইফের দিকে ঘুরে তাকায়। মেয়েদের ভূষণ হিসেবে মুখে শোভা পাচ্ছে লাজের আভা। হুশ ভুলে রাস্তা পাড় হওয়ার জন্য এক পা বাড়াতেই নেয় ঠিক তখনই শাঁ শাঁ শব্দ তুলে একটা গাড়ি ঠিক তার সামনে দিয়ে যায়।

নিশা ভীত হয়ে দ্রুত দুই কদম পিছনে চলে যায়। সম্পূর্ণ ঘটনাটা রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফ দেখেছে। দ্বিতীয় দফায় তার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়। এক মুহুর্তের জন্য বুক কামড়ে উঠে। নিশা নিজেকে সামলে নিয়ে রাস্তা পাড় হওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলেই সাইফ দ্রুত এপাশ থেকে মাথা নেড়ে মানা করে। হাতের ইশারায় বুঝায় সে আসছে।

নিশা থেমে যায়। নিজের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে রয়। লং ড্রাইভের জন্য উপযুক্ত রাস্তা হওয়ায় একটু পর পরই শাঁই শাঁই করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। সাইফ অতি সাবধানে রাস্তা পাড় করে নিশার সামনে এসে দাঁড়ায়। অধিকারবোধের সঙ্গে কোনো অনুমতি ব্যতীতই নিশার ডান হাতটা নিজের বাম হাতের দখলে নিয়ে অন্যরকম স্বরে বলে,

“ নিঃশ্বাস আটকে দিয়েছিলেন। “

অবলীলায় কি সহজ স্বীকারোক্তি! নিশার সাধারণ মনের অনুভূতিরা গাঢ় হয়। মনের সুপ্ত কোণে বয়ে যায় ভালো লাগার হাওয়া। কিছু বলার সুযোগ পায় না আর। সাইফ সাবধানে ওর হাত ধরে রাস্তা পাড় হওয়া শুরু করে। যেনো এর থেকে বড় দায়িত্ব ওর দ্বিতীয়টা নেই!

নিরাপদে রাস্তা পাড় করে অপর পাশে পৌঁছাতেই সাইফ ঘুরে নিশার মুখের পানে তাকায়। গাঢ় স্বরে বলে,

“ আপনাকে স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ইয়াসমিন। “

সাইফের এরকম স্পষ্ট কথায় কি ছিলো নিশার জানা নেই। তবে হঠাৎই লজ্জার পারদ কয়েক মাত্রা বেড়ে গেলো তার। ঠোঁট জুড়ে ঝুলতে থাকে অপ্রতিরোধ্য লাজুক হাসি। সাইফ সেই হাসি দেখে। নিঃশব্দে দৃশ্যটুকু অবলোকন করে বলে,

“ জরুরী ভিত্তিতে আপনার আব্বু অর্থাৎ আমার স্যারের থেকে সময় চেয়ে চার ঘন্টার সময় পেয়েছি ইয়াসমিন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি সামনা-সামনি আপনার মুখ থেকে স্বীকারোক্তিটুকু শোনার জন্য। সামনা-সামনি না শুনলে শান্তি পেতাম না। “

নিশা লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলে,

“ আবার বলতে হবে? “

“ জি। “

নিশার কিশোরী মন আচমকা লজ্জায় বাজে ভাবে আড়ষ্ট হয়। গতকাল ওই তীব্র উৎকণ্ঠার মুহুর্তে ফোনে নিজের মনের কথা বলার সময় এক বিন্দু লজ্জা লাগে নি তার। কিন্তু আজ এই মুহুর্তে ঠিক একই কথাটা বলতে এক আকাশ সমান লজ্জা এসে ভর করেছে তার উপর।

সাইফ গাঢ় স্বরে ডাকে,

“ ইয়াসমিন? “

নিশা চোখ তুলে তাকায়। পরপর বলে উঠে,

“ আমি আপনার শেকড় হবো। “

সাইফের ঠোঁট, মুখ, চোখ জুড়ে তখন প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস। তার শক্ত দু হাত অতি সন্তর্পণে ছুঁয়ে দেয় নিশার অবাধ্য চুলগুলোকে। যত্নের সহিত সেগুলোকে কানের পিছনে গুজে দিয়ে ফের নিশার গালে হাত রাখে।

নিশার শরীরে অদৃশ্য কাঁপুনি দিয়ে উঠে। সাইফকে এগুতে দেখে ভীত হয় সে। তার ক্লাসমেটদের টিফিন টাইমের আলাপন প্রায়ই শুনে সে। কিভাবে তাদের প্রেমিকরা হুটহাট তাদের অধরে কর্তৃত্ব চালায়। সেসব আলাপন শুনতেই সবসময় নিশার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতো। এই মুহুর্তে সাইফও যদি একই কাজ করার চেষ্টা করে নিশা ভীষণভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে।

কিন্তু নিশাকে ভুল প্রমাণ করে সাইফ তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। সঙ্গে সঙ্গে নিশা চোখ জোড়া বুজে নেয়। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে হাসি। ভুল মানুষকে সে হ্যাঁ বলে নি। মানুষটা ভুল নয়।

সাইফ ফিসফিসিয়ে বলে,

“ এই শেকড় কখনো ছাড়ছি না। “

সাইফের এরকম ফিসফিসিয়ে বলা কথায় নিশার অদ্ভুৎ মৃত্যু হয়। আজনমের অনুভূতিময় মৃত্যু।

__________

চার সিঁড়ি সমান পোর্চের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বাণী। দিঘির মতো শীতল দৃষ্টি মেলে দেখছে উঠোন জুড়ে দৌড়ে বেরানো বহ্নিকে। ছোট শুভ্র দেহে শোভা পাচ্ছে কালো ফ্রকটা। তার উপর রয়েছে সাদা কার্ডিগান। ঘাড় সমান চুলগুলোকে পরিপাটি করে আঁচড়ে একটা কালো রাউন্ড ব্যান্ড পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মাথায়।

পরিহিত জামা কাপড় গুলো কিছু নতুন শপিং ব্যাগে করে বাণীর নিকট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আজ দুপুরে। বাণী দ্বিধাগ্রস্ত ছিলো। ব্যাগের ভেতর কি আছে তা চেক করবে কি-না তা নিয়ে বেশ সংশয়ে ছিলো। তাকে সেই সংশয় থেকে উদ্ধার করতেই হয়তো মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় তখন ছোট করে ম্যাসেজ পাঠায়,

“ এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। পারসেলটা তোমার উদ্দেশ্যেই পাঠিয়েছি। ভেতরে যা আছে তা তোমাদেরই। “

আচমকা বহ্নির ডাকে বাণীর ধ্যান ভাঙ্গে,

“ মাম্মা, লুক! “

বাণী পোর্চ ছেড়ে উঠোনে নেমে আসে। বহ্নির কাছে এগিয়ে যায়। বহ্নি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিলো উঠোনে অযত্নে বেড়ে উঠা একটা ফুল গাছকে। যেই গাছে কিনা হালকা বেগুনি রঙের তিনটে ফুল এসেছে। বাণী কাছে আসতেই বহ্নি প্রশ্ন করে,

“ এই ফুলের নাম কি মাম্মা? “

বাণী ফুলটাকে দেখে। কিন্তু বহু ভেবেও এর নাম মনে করতে পারে না। অবশ্য তার কখনো ফুলের প্রতি আগ্রহ ছিলও না তেমন একটা। গোলাপ, শাপলা, কৃষ্ণচূড়া এমন চার পাঁচটে ফুল ছাড়া আর কোনো ফুলের নাম জানে না সে। বাণী হতাশ গলায় বলে,

“ আমার জানা নেই মা। “

বহ্নি কিছুক্ষণ ভেবে বলে,

“ আমরা মেজরকে কল করে জিজ্ঞেস করি? “

বাণী মাথা নেড়ে বলে,

“ মেজর ব্যস্ত মা। “

বহ্নি আবার ফুল নিয়ে খেলতে থাকে। আচমকা বাণীর চোখ পড়ে উঠোনের লোহার গেটটের অপর পাশে। রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুরুষ। কেমন এক দৃষ্টি মেলে বাণী আর বহ্নির দিকে তাকিয়ে ছিলো। বাণী তাকাতেই সঙ্গে সঙ্গে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দ্রুত আড়াল হয়ে যায় ঝোপঝাড়ের ভীড়ে।

দৃশ্যটুকু দেখতেই বাণী ভীত হয়। দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। বহ্নির হাত ধরে টেনে তাড়া দিয়ে বলে,

“ সন্ধ্যা নেমে আসছে। ভিতরে চলো। “

বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেই দ্রুত দরজা জানালা আটকে দেয় বাণী। নিজের ফোন হাতে নিয়ে দ্রুত কন্ট্যাক্ট লিস্টে যায়। ইংরেজিতে Durjoy লিখে সেভ করা নাম্বারটায় ডায়াল করে। এটা দূর্জয়ের ব্যক্তিগত নাম্বার। আরো একটা নাম্বার আছে বাণীর কাছে। সেটা Major Durjoy লিখে সেভ করা।

ফোন রিং হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কল রিসিভ হয়। বাণী ভীত গলায় বলে,

“ বাড়ির বাহিরে কেউ আছে। নজর রাখছে আমাদের উপর। “

কথাটুকু শুনে দূর্জয় বলে,

“ শান্ত হও। কি হয়েছে বলো। “

বাণী দ্রুত পুরো ঘটনাটুকু বলে। কিভাবে লোকটা দূর থেকে তার আর বহ্নির উপর নজর রাখছিলো, বাণীকে তাকাতে দেখেই কিভাবে আড়াল হয়ে পড়েছে। পুরোটা বলে। সব শুনে দূর্জয় শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ লোকটা দেখতে কেমন? “

“ গায়ের রঙ কালো। হাইট হয়তো ৫’৯ হবে। মুখে গোফ আছে। সঙ্গে কপালের একপাশে… “

“ কাটা দাগ আছে তাই-তো? “

বাণী ত্রস্ত গলায় বলে,

“ হ্যাঁ, হ্যাঁ। “

হঠাৎই বাণীর সম্বিত ফিরে। সে প্রশ্ন করে,

“ তুমি কিভাবে জানো? “

“ ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওইটা আমার লোক। মাসুদ। “

বাণী যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে। সে দাঁড়ানো থেকে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। বহ্নি তার কাছেই ছিলো। সে বাণীকে এভাবে বসতে দেখে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে মাম্মা? “

ফোনের অপর পাশ হতে দূর্জয় বহ্নির কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। নরম স্বরে প্রশ্ন করে,

“ বহ্নি পাশে আছে? “

“ হু। “

“ কথা বলা যাবে? “

বাণী সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা এগিয়ে বহ্নির কাছে দিয়ে বলে,

“ মেজর, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। “

বহ্নি উৎফুল্ল হয়ে ফোনটা নিয়ে কানে চেপে ধরে,

“ ইয়ো মেজর! “

আদুরে স্বরের ব্যতিক্রমী সম্বোধন শুনে ফোনের অপর পাশের মানুষটা শত ব্যস্ততার মধ্যেও মৃদু হাসে।

__________

দু’জন নারীর হাসির শব্দে কেবিনটা মুখোরিত। বেডে হেলান দিয়ে বসে ভ্রু কুচকে সেই দৃশ্য দেখছে প্রত্যয়। মেজাজটা তার বেজাই খারাপ। অসহ্যকর মেয়েটা সারাদিন জুড়ে সবার এটেনশন
সিক করে যাচ্ছে। অসুস্থ প্রত্যয়, সবার উচিত প্রত্যয়ের দিকে ধ্যান দেওয়া, কিন্তু তার আব্বু আম্মু তিন বেলা খাবারের সঙ্গে এক প্লেট করে নিজেদের এটেনশন এই মেয়েটাকে বিলিয়ে যাচ্ছে।

প্রত্যয় আপন মনে বিড়বিড়িয়ে উঠে,

“ এই সুযোগ দেওয়া, সুপাত্রী হওয়া এইসব তোমার নাটক, আমি ভালো করেই জানি। “

তার বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলো অস্পষ্ট ভাবে জেসি আর ফিজার কানে পৌঁছায়। তারা নিজেদের আলাপ থামিয়ে প্রত্যয়ের দিকে ফিরে তাকায়। ফিজা বেগম প্রশ্ন করে,

“ কিছু বলেছো বাবা? “

প্রত্যয় বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয়,

“ আমি আর কি বলবো? তোমরা বলতে থাকো, আমি শুনি। তাছাড়াও এই কেবিনে বসে আর কি-ই বা করার আছে আমার? “

জেসি আর ফিজা আবার নিজেদের মতো গল্পে মেতে উঠে। আচমকা কল আসতেই ফিজা বেগম ফোন হাতে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। কেবিনে রয়ে যায় শুধুমাত্র জেসি। প্রত্যয় এবার বলে,

“ এসব নাটক করার জন্য আংকেলের সঙ্গে ব্যাক করো নি? “

জেসি অবাক হয়ে বলে,

“ নাটক করছি? তোমার কি আমাকে কোনো অভিনেত্রী মনে হয়? অবশ্য তোমার দোষ নেই, আমার ভিজুয়্যাল দেখতে কোনো এক্ট্রেসের থেকে কম নয়। “

প্রত্যয় রাগে চোখ পাকিয়ে তাকায়। জেসি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হেলতে দুলতে প্রত্যয়ের বেডের পাশের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। পানির বোতলটা নিয়ে পানি খেতে যাবে এমন সময় প্রত্যয় তার এক হাত শক্ত করে চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ শুনো মেয়ে, আগামীকাল সকালেই চট্টগ্রাম ফিরে যাবে তুমি। তুমি আর তোমার নাটক দুটোই অসহ্যকর লাগছে আমার। আমি তোমাকে আর এখানে দেখতে চাই না। “

জেসিরও এই পর্যায়ে রাগ উঠে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে যায় গতরাতে তার আব্বুর বলা কথা,

“ একটু দায়িত্ব নিতে শিখো। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিখো। বিশ্বাস রাখো এই দুটো জিনিস জীবনে ভালো থাকার মন্ত্র। “

জেসি নিজের রাগটুকুকে গিলে নেয়। উল্টো অন্য হাতে প্রত্যয়ের পাশে রেখে ঠেক দিয়ে সামান্য ঝুকে। অত:পর হাসি হাসি মুখ করে বলে,

“ শুনো ছেলে, তোমার প্রমোশন হয়েছে। কুত্তা থেকে সুপাত্র। ভাগ্য ভালো থাকলে ভবিষ্যতে আরো প্রমোশনের সুযোগ আছে তোমার। তুমি যদি কুত্তা থেকে সুপাত্রে প্রমোশন পেতে পারো তবে আমিও একদিন নাটকবাজ থেকে সুপাত্রীতে প্রমোশন পেতে পারি। ইউ নেভার নো। “

প্রত্যয় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে আচমকা। ধীর স্বরে প্রশ্ন করে,

“ হুট করে আমার পিছনে পড়লে কেনো? “

জেসি হেসে বলে,

“ অনেক ভেবে দেখলাম, যেই ছেলে বিপদ দেখেও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালায় না সে ভবিষ্যতে আমাকেও ছেড়ে পালাবে না। এন্ড দ্যাটস হোয়াট আই ওয়ান্ট৷ প্রোপার কমিটমেন্ট। “

প্রত্যয় বলে,

“ দেশকে আমি ভালোবাসি, সে কারণে পালাই নি। কিন্তু তোমরা প্রতি আমার সেরকম কোনো অনুভূতি নেই। “

জেসি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গুণগুনিয়ে উঠে,

“ তু সাবার তো কার মেরি ইয়ার
যারা সাস তো লে দিলদার
চাল ফিকার নু গোলি মার
ইয়ার হে দিন জিন্দাই দে চার
হোলে হোলে হো যায়েগা পেয়ার। “

প্রত্যয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই মেয়ে আর মাসুদ হলো একই জাতের। কখনোই ভালো হবে না।

__________

সৈন্যদের আওতায় কারাবন্দী হওয়াটা ভারী দূর্ভাগ্যকর এক বিষয়। কারণ সৈন্যরা কোনো আসামীকে বাগে পেলে কখনো তাকে নিজেদের খাস আপ্যায়ন হতে বঞ্চিত করে না। কারাগারে সেই আসামীকে বিভিন্ন পদ দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়। একেক পদের একেক স্বাদ। যেই আসামীর অপরাধের পরিমাণ যত বেশি তার আপ্যায়নের জন্য পদের পরিমাণও তত বেশি।

শরীরে তাজা ক্ষত নিয়ে মেঝেতে বসে আছে রক্তাক্ত দেহটা। শরীরের তাজা ক্ষতগুলো আজ সকালের আপ্যায়নেরই প্রমাণ। এতো আপ্যায়নের পরও দেহের মালিক ঝুকতে রাজি নয়। শরীরের যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিচ্ছে তবুও সামান্য আরামের আশায় মেঝেতে শরীর এলাবে না।

আজকাল ঘুম হতে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করে সে। দু চোখ বুজলেই স্বপ্নের রাজ্যে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় সে। গলা ফাটানো চিৎকারে চারিদকটা গুমোট করে তুলে সেই নবজাতক। কান্নার উৎস খুঁজতে গেলেই সে একটা খুড়ে রাখা কবরের ভেতর একটা লাশ দেখতে পায়। এক সুদর্শন যুবকের লাশ। কিছুটা ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখে সেই সুদর্শন যুবকের মুখখানা। সায়াহ্ন তালুকদার। বাণী তালুকদারের ভাই। আবারও চারিদিক থেকে ভেসে আসে সেই নবজাতকের কান্নার স্বর। কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়ার পূর্বেই চারিদিকটা আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। স্বপ্নের ইতি টানতে ঘুম ভেঙে যায়।

সেলের বাহিরের করিডর ধরে কারো আগমনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পদধ্বনি তো তাই বলছে। হিরণ ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায়। সেলের দরজাটা খুলে যায়। ভেতরে প্রবেশ করে মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। আজ আর ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় নেই। বরং ইউনিফর্মের জায়গায় গায়ে শোভা পাচ্ছে ফর্মাল শার্ট, প্যান্ট। হাত দুটো পকেটে গুজে হিরণকে ভালো করে দেখে সে। অত:পর বিদ্রুপ করে বলে,

“ ভেবেছিলি খুব বড়ো তীর মেরে ফেলেছিস, তাই-না? কিন্তু আফসোস তোর চক্রান্ত ধূলিসাৎ হয়েছে। আল্লাহর রহমতে একজন সিভিলিয়ানেরও রক্ত ঝরে নি। “

হিরণ হাসে। অদ্ভুৎ সেই হাসি। গাল জুড়ে দাঁড়ি গুলো অনেকটাই ঘন আর বড়ো হয়েছে তার। বহ্নি এই অবস্থায় তাকে দেখলে নিশ্চয়ই চোখ মুখ কুচকে বলতো,

“ ইয়াক পাপা। তোমাকে মনস্টারের মতো দেখাচ্ছে। “

দূর্জয় হিরণের হাসি দেখে। বুঝতে পারে না এই হাসির কারণ। হিরণ এমনই। কঠিন অবস্থায়ও বেহায়ার মতো হাসিটা তারা স্বভাবের বৈশিষ্ট্য। দূর্জয় আর ঘাটায় না। অসভ্যটার শাস্তি এখন আদালত ঠিক করবে। কিছুদিনের মধ্যেই একে আদালতে চালান করে দেওয়া হবে।

দূর্জয় বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলেই পিছন থেকে হিরণ আস্তে করে বলে,

“ গতকালের এট্যাকটা কি আসলেই ডুমস ডের এট্যাক ছিলো মেজর দূর্জয়? “

দূর্জয় থামে। অদ্ভুৎভাবে পিছনে ফিরে তাকায়। হিরণ এক হাতের সাহায্যে নিজের ঘাড়ের পাশটা মালিশ করতে করতে বলে উঠে,

“ প্রত্যেকটা সিনেমাই রিলিজ পাওয়ার আগে একটা ট্রেলার রিলিজ হয়। তা জানেন তো মেজর দূর্জয়? “

সূক্ষ্ণ ইঙ্গিতটা ধরতে পেরে দূর্জয় যান্ত্রিক বস্তুর মতো অনড় হয়ে তাকিয়ে রয়। হিরণ আপনমনে নিজের মতো শিস বাজাতে থাকে। এই সুরটা তার খুব প্রিয়। ছোটবেলা থেকে এই শিসের সুর দ্বারা সবাই হিরণকে চিনে। বাণীও চিনতো। সুরটা শুনতেই কেমন ভয়ে সিটিয়ে যেতো।

দূর্জয়ের মস্তিষ্কের ভেতরটা আচমকা দপদপ করে উঠে। মনে পড়ে যায় বহ্নির বলা কথাগুলো।

“ পাপা মাম্মাকে অনেক জোরে মারছিলো। দেয়ালে মাম্মার মাথা ধরে হিট করছিলো। মাম্মার নাক দিয়ে রক্তও পড়ছিলো। “

দূর্জয় রাগটুকু আর সংবরণ করে না। হিংস্র বাঘের ন্যায় এগিয়ে যায়। হিরণের মাথার চুলগুলোকে এক থাবায় মুঠি করে ধরে দেয়ালে সোজোরে আঘাত করা শুরু করে। হিংস্র স্বরে বলে উঠে,

“ একজন সৈন্য শহীদ হয়েছে কাল। নিজের দেশের সাথে বেইমানি করছিস জানোয়ারের বাচ্চা। দেশটা আর দেশের মানুষ গুলো কি ক্ষতি করেছে তোর? টেল মি! “

হিরণ জবাব দিতে পারে না। প্রতিটা আঘাতে মাথাটা ভনভন করছে তার। দূর্জয় আবার বজ্রস্বরে বলে উঠে,

“ কারমা বলতে কিছুতে বিশ্বাস করিস? কাল তা-ই হয়েছে। তুই যখন শপিং মলে বিস্ফোরণ ঘটানোর আনন্দ উদযাপন করছিলি, ঠিক ওই সময় বাণীর এপার্টমেন্টেও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে। আগুনে দাউদাউ করে সব পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছে। “

তীব্র মাথার যন্ত্রণার মধ্যেও দূর্জয়ের বলা কথা গুলো হিরণের কানে এসে পৌঁছায়। মুহুর্তেই তার বুক জ্বলে উঠে। সে হতবিহ্বল হয়ে চোখ মেলে তাকায়। যন্ত্রণা ভরা গলায় জানতে চায়,

“ আমার বাণী? আমার মেয়ে? ওরা ঠিক আছে? “

দূর্জয় হিরণের প্রশ্নের জবাব দেয় না। আরো জোরে দেয়ালের সঙ্গে মাথায় দুটো আঘাত করে। এই পর্যায়ে হিরণের মাথা ফেটে পিছন দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। দেয়ালে সেই রক্তের ছাপ দেখা যায়। হিরণের সেসব দিকে খেয়াল নেই। সে ত্রস্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ এন্সার মি। ওরা কেমন আছে? “

দূর্জয় নিজেকে ধাতস্থ করে হিরণকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। হিরণ তখন উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বাণী আর বহ্নির অবস্থা জানতে চাইছে। দূর্জয় শীতল হয়ে কিছুক্ষণ হিরণের পানে তাকিয়ে থেকে বড়ো বড়ো কদম ফেলে সেল থেকে বেরিয়ে যায়। কিছু মানুষের শাস্তি ও যন্ত্রণা এমনই হওয়া উচিত।

সেলের ভেতর থাকা হিরণ তখন পাগল প্রায়। আগুনে বাণী এবং বহ্নির পুড়ে যাওয়ার দৃশ্যটুকু চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চিৎকার করে জানতে চায়,

“ পায়ে পড়ি দূর্জয়। প্লিজ টেল মি। টেল মি ওরা ঠিক আছে। “

__________

রাতের খাবার সেড়ে রান্নাঘরে নিজের আর বহ্নির প্লেট ধুয়ে রেখে বের হয় বাণী। রুমে ফিরে আসতেই দেখে বহ্নি নেই। সে অবাক হয়। মেয়েটা আবার কোথায় গেলো? চারিদিকে চোখ বুলিয়ে খুঁজে। কোথাও নেই। বাণী রুম থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে যেতে নিলেই লক্ষ্য করে দূর্জয়ের রুমের দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। মুহুর্তেই বাণীর বুক ধক করে উঠে। বহ্নি ওই রুমে যায় নি তো আবার? দূর্জয় রুমের দরজা কেবল নব দ্বারা আটকে গিয়েছিলো। লক করে নি। হয়তো এই ভরসায়ই যে বাণী আর বহ্নি তার ব্যক্তিগত রুমে উঁকিঝুঁকি দিবে না। এখন? এখন বাণী কি জবাব দিবে?

বাণী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। সম্পূর্ণ পরিপাটি ছিমছাম করে গুছানো একটা রুম। কিন্তু বাণীর চোখ আটকায় আলমারির সামনে মেঝেতে বসে থাকা বহ্নির পানে। মুহুর্তেই বাণী স্থবির বনে যায়। বহ্নির কোলের গিটারটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়। অস্ফুটে বলে,

“ অসম্ভব। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫৪.

হিরণ উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আচরণ করছে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে ভয়ংকর এক দৃশ্য। আগুন। উত্তপ্ত আগুনে ঝলসে যাচ্ছে চারিপাশ। সেই আগুনের ভেতর থেকে চিৎকার করছে বাণী আর বহ্নি। ইতিমধ্যে তাদের চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। শুভ্র দেহী মেয়ে দুটোর শরীর পুড়ে ধীরে ধীরে কালচে হয়ে যাচ্ছে। বাকিটা… বাকিটা আর ভাবতে পারে না হিরণ। দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে।

মাথায় আঘাতের যন্ত্রণা তাকে একটুও পীড়া দিতে পারছে না। যতটা পীড়া তাকে অন্তরের দহন দিচ্ছে। হিরণ হাসফাস করে। অক্সিজেনের অভাববোধ করছে সে। চারিদিকে এলোমেলো দৃষ্টি মেলে তাকায়। কাউকে পায় না। জীবনে প্রথম বারের মতো উপলব্ধি করে, সে বড্ড অসহায়। কাকে ডাকবে সে সাহায্যের জন্য? কে তাকে সাহায্য করবে? কেউ না। ইহজগতের কাছে সে ঘৃণিত এক চরিত্র। উপরওয়ালা? সেসবে তো হিরণ কখনো বিশ্বাসই করে না।

তীব্র যন্ত্রণা সইতে না পেরে হিরণ দু হাতে মাথার চুল চেপে ধরে মেঝেতে গা এলিয়ে দেয়। পুরো শরীরটা কুজো করে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। অদ্ভুৎ করুণ আর্তনাদ করে উঠে সে। সেই আর্তনাদের স্বর পৌঁছে যায় চার দেয়াল ভেদ করে সেলের বাহিরে। দু জন নিরাপত্তা কর্মী বাহির থেকে বিস্ময়কর দৃষ্টি মেলে দেখে সেই দৃশ্য। মনে মনে প্রশ্ন জাগে কি হয়েছে এই লোকটার? প্রতিদিন তো এই লোকটাকে কতই না শারীরিক আঘাত দেওয়া হয়। তখন তো এভাবে দুনিয়া কাঁপানো আর্তনাদ করে না। আজ কি হলো?

হিরণের চিৎকার প্রতিটা দেয়ালে ঝংকার তুলে। যে-কেউ শুনলে মনে করবে যেনো কোনো নিকৃষ্ট পাপীকে জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে। সেই দমফাটা চিৎকারে বিরক্ত হয় নিরাপত্তা কর্মীরা। তিন জন ভেতরে প্রবেশ করে। রাগী স্বরে ধমকে হিরণকে চুপ হতে বলে। হিরণের মস্তিষ্কে সেসব কথা পৌঁছায় না। নিরাপত্তা কর্মীরা বিরক্ত হয় এবার পড়ে থাকা দেহটাকে শক্ত বুট শুয়ের আঘাতে দমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একটা লাত্থিও হিরণকে স্পর্শ করছিলো না। সে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এই মুহুর্তে। মনে হচ্ছে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মানুষ দুটো আর নেই এই ভাবনাটুকুই যথেষ্ট হিরণের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। হিরণের চিৎকার ধীরে ধীরে থামে। চোখ জোড়া বুজে পড়ে রয় সে। চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীত।

কোনো এক বৃষ্টিস্নাত মধ্য রাতের ঘটনা। হিরণ নিজের রুমে সোফায় বসে ছিলো। পাশের রুম হতে ভেসে আসছে বাণীর চিৎকার। দু’হাত পা বাধা অবস্থায় তড়পাচ্ছে, চিৎকার করছে। সেই চিৎকার হিরণ নীরবে শুনে। তবে তার কাছে করার মতো কিছুই ছিলো না। ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট তখন বাণী। সামান্য সুযোগ পেলেই আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সারাটা দিন তাকে প্রতিহত করাটা অসম্ভব ছিলো হিরণের কাছে। বাধ্য হয়ে এই পন্থা।

ধীরে ধীরে চিৎকারের মাত্রা কমে আসে। হিরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘুমিয়ে পড়েছে কি-না দেখার জন্য পাশের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রুমে যেতেই দেখতে পায় বাণী বিছানার সঙ্গে লেপ্টে আছে। এখন আর হাত পা ছোড়াছুঁড়ি করছে না। ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে হিরণ এগিয়ে যায়, গায়ে কম্বল টেনে দিতে। কিন্তু কাছে যেতেই টের পায় বাণী ঘুমায় নি, বরং নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে এলোমেলো নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

হিরণ ত্রস্ত হয়ে এগিয়ে যায়। দ্রুত ভঙ্গিতে বাণীর হাত ও পায়ের বাধন খুলে দেয়। হাত ছাড়া পেতেই বাণী দু’হাতে সামান্য উঁচু পেটটা খামচে ধরে ছটফট করতে থাকে। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে অস্ফুটে মা বলে কাঁদতে থাকে। হিরণ অস্থির হয়ে উঠে। বাণীকে আঁকড়ে বুকে নিয়ে নেয়। চিন্তিত স্বরে জানতে চায়,

“ ব্যথা করছে? ডাক্তার ডাকবো? “

নিস্তেজ বাণী তীব্র যন্ত্রণার মাঝেও জেদ দেখিয়ে নিজেকে হিরণের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বসে কুজো হয়ে ছটফট করতে থাকে। হিরণ বাণীর মুখোমুখি হয়ে বসে। তার চোখ ছলছল করছে। বাণীকে ধরারও সাহস পাচ্ছে না। অতিরিক্ত চেঁচামেচির ফলে সাময়িক পেট ব্যথা উঠেছিলো। ধীরে ধীরে ব্যথাটা কমে আসতেই বাণী পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। হুশ ভুলে অসাড় দেহটা সামনের দিকে সামান্য ঝুকে। মাথাটা গিয়ে ঠেকে হিরণের বুকে। হিরণ আগলে ধরে। হুশ থাকলে বাণী কখনোই এই কাজটা করতো না। তবুও হিরণ প্রশান্তি অনুভব করে। সেই সঙ্গে সূক্ষ্ণ ব্যথা। ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে সে বাণীর হাত পায়ের দিকে তাকায়। বেধে রাখার ফলে লাল, কালসিটে মিলিয়ে দাগ পড়ে গিয়েছে। হিরণ পাথরের ন্যায় বসে রয়। বাণীর গায়ের আঘাতের দাগ গুলো তার ভালোবাসার গালে সজোরে চড়ের ন্যায় ছিলো। চোখে আঙুল দিয়ে হিরণকে বলছিলো,

“ তোর ভালোবাসা এই মেয়েটার জন্য কতটা সঙ্গিন তা দেখে নে। “

অতীত থেকে বেরিয়ে আসে হিরণ। অবচেতন মন আওড়ায় তার ভালোবাসা কেবল বাণীর জন্য সঙ্গিন ছিলো না, বরং তার জন্যেও সঙ্গিন। এতটাই সঙ্গিন যে, হিরণের জীবন মরণ এখন ওই দুটো মানুষের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে।

__________

মেজর দূর্জয়ের জরুরী তলবে পাঁচজন লেফটেন্যান্ট এসে উপস্থিত হয়েছেন মিটিং রুমে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলো জুলফিকার মুজতবা সহ আরো বেশ ক’জন সিনিয়র কর্ণেল। প্রত্যেকের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। সকলে এসে উপস্থিত হতেই জুলফিকার বলেন,

“ বলো দূর্জয়। কি বলবে বলে সবাইকে ডেকেছো তুমি? “

দূর্জয় কোনো ভনিতা না করে স্পষ্ট গলায় বলে,

“ বসুমতী শপিং কমপ্লেক্সের এট্যাকটা ট্রেলার ছিলো, মূল এট্যাক এখনো পেন্ডিং অবস্থায় আছে। “

সবাই বিস্মিত হয়। একজন কর্ণেল বলে উঠে,

“ কি বলছো তুমি এসব? “

দূর্জয় কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে ডেস্কের ওপর থাকা একটা ল্যাপটপ ওপেন করে একটা ভিডিও প্লে করে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে সিসিটিভি ফুটেজের নির্দিষ্ট সময়ের ক্লিপ। ফুটেজটা হিরণকে যেই সেলে রাখা হয়েছে সেখানকার চিত্রপটের। সম্পূর্ণ ক্লিপটুকু দেখতেই সৈন্যরা থমথমে মুখে একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে।

সিনিয়র একজন কর্নেল চিন্তার ভারটুকু বইতে না পেরে বসে পড়েন। শান্ত স্বরে বলে,

“ এর শেষ কোথায়? দেশটা এদের কি ক্ষতি করেছে? জনগণ বিশ্বাস হারাতে বসেছে আমাদের প্রতি। ওরা এটা দেখবে না যে আমাদের বাহিনী কতো গুলো রাত নির্ঘুম পাড় করছে তাদের জীবন রক্ষার জন্য। ওরা শুধু জানবে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতেও গাদ্দাররা দেশের মাটিতে একের পর এক হামলা চালাচ্ছে। “

দূর্জয় শীতল গলায় বলে,

“ ইনশাআল্লাহ আমরা সবটা সামলে নিবো স্যার। “

সাদাতও পেছন থেকে বলে উঠে,

“ জি স্যার। শপিং কমপ্লেক্সের হামলাটার মতো এই হামলাও আমরা সফল হতে দিবো না। “

সাঈফ ভ্রু কুচকে বলে,

“ একটাও ক্লু রাখে নি ওরা। খুব পাকা খেলোয়াড়। যতবার আমরা এদের আস্তানা খুঁজে বের করার জন্য কোনো ক্লু ধরে এগিয়েছি ততবারই বিফল হয়েছি। “

জুলফিকার মুজতবা গম্ভীর স্বরে বলে,

“ কারণ সেই ক্লু গুলো হিরণের মর্জিতেই সাজানো। যেনো আমরা সেই ক্লু ফলো করে নিজেদের সময় অপচয় করি। যাদের দিয়ে ও আসল হামলাটা করানোর ফন্দি এঁটেছে তাদের আস্তানার কোনো হদিস খুঁজে পাওয়ার উপায় রাখে নি সে। “

সাইফ বিজ্ঞের ন্যায় জুলফিকার মুজতবার কথা শুনে। এরকম একটা সিরিয়াস সিচুয়েশনেও ভবিষ্যৎ শশুরের কথায় মুগ্ধ না হয়ে পারে না সে। জুলফিকার স্যার একদম তার মতোই চতুর, সহজে মোদ্দা ধরতে পারে। ইয়াসমিনকে প্রশ্ন করতে হবে, তিনি কি সবসময় নিজের আব্বুর মতো কাউকেই জীবন সঙ্গী হিসেবে চাইতো কি-না? নাহলে শশুর জামাই ইকুয়্যাল লেভেলের বুদ্ধিমান কিভাবে হবে?

দূর্জয় বলে,

“ প্রতিটা বিভাগে অবস্থানরত সৈন্যদের এলার্ট করতে হবে আমাদের। আসন্ন বিপদ ঠেকাতে সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বন্ধ বাড়ানোর জন্যও আপিল করতে হবে। রাজধানীর প্রতিটা পয়েন্টে নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরী। আমার মনে হয়, হিরণের টার্গেট হবে অতিরিক্ত জনবহুল জায়গা গুলো। যত বেশি মানুষের জীবন ঝুঁকিতে থাকবে, ততই তৃপ্তি পাবে ও৷ “

সকলে দূর্জয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে। সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে আরো গুরুত্বপূর্ণ আলাপে মনযোগী হয়। তাদের ফুরসত নেই। মস্তিষ্কে আর পিঠে খুব ভার বয়ে বেড়াচ্ছে তারা। এতগুলো মানুষের ভরসার ভার, এতগুলো মানুষের জীবনের ভার। সবটা তাদের দায়িত্ব এখন। যেকোনো মূলেই একটা বড় অঘটন তাদের রুখতে হবে।

__________

মিটিং সেড়ে কেবল বের হলো সাদাত। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ঘরে মা’কে কল করবে বলে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেখে একটা আননোন নাম্বার হতে ন বার মিসড কলের নোটিফিকেশনটা জ্বলজ্বল করছে। সাদাত ভ্রু কুচকে তা দেখে। সর্বশেষ কলটা এসেছে ঠিক সাতাশ মিনিট আগে। সাদাতের ফোনটা সাইলেন্ট মুডে ছিলো বলে সে টের পায় নি।

গুরুত্বপূর্ণ কোনো কল হতে পারে ভেবে সে কল ব্যাক করে। মিনিট গড়ানোর পূর্বেই কলটা রিসিভ হয়। অপরপ্রান্ত হতে একটা ক্যাটক্যাটে নারী স্বর বলে উঠে,

“ এই ছেলে, কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি তোমাকে! রিংটোনের আওয়াজ কি কানে পৌঁছায় নি তোমার? “

সাদাত বিস্মিত হয়ে ফোনটা কানের থেকে একহাত দূরে সরিয়ে ধরে। কণ্ঠটা এবং কথার ধরণটা চিনতে ভুল করে না সে। এই ধমকাধমকিটা না দেশ ছেড়ে বিদায় হয়েছিলো? আবার এই দেশের মাটিতে ফিরে এসেছে কি সেকেন্ড হ্যান্ড এম্বারাসমেন্ট এবং প্যানিক এট্যাক দিয়ে সাদাতের জীবনটা আঙ্গার করতে? সাদাত বিস্ময়তা কাটিয়ে ফোনটা কানে চেপে ধরে শান্ত স্বরে শুধায়,

“ ফোন সাইলেন্ট ছিলো। বলো, কেনো কল দিয়েছো? “

বিরক্ত এবং রাগ মিশ্রিত স্বরটা অপর পাশ হতে আবার ধমকে উঠে,

“ এয়ারপোর্টে আছি আমি। তোমার দেশের এয়ারপোর্ট কতৃপক্ষ আমার লাগেজটা হারিয়ে ফেলেছে। ভাবা যায় কতটা ইরেস্পন্সিবল? আই উইল স্যু দেম। “

সাদাত দ্বিতীয় দফা অবাক হয়। এই মহিলার লাগেজ হারানো গিয়েছে এতে সাদাতের কি করার থাকতে পারে? সাদাত তো আর এয়ারপোর্টের সর্বোচ্চ পদের অথরিটি নয়। তবে তার কাছে এরকম অভিযোগের মানে কি? সাদাত ভদ্র সুরে বলে,

“ ভুল নাম্বারে কল করেছো তুমি। তোমার উচিত এই ব্যাপারে বিমানবন্দর কতৃপক্ষের কাছে কমপ্লেইন করা। তাতেও কাজ না হলে থানায় গিয়ে জিডি করা। আ’ম শিওর কোথাও না কোথাও থেকে অবশ্যই তুমি হেল্প পাবে। “

“ এক্সকিউজ মি! ইউ থিংক আমি এখন এয়ারপোর্ট থেকে থানায় চক্কর কাটবো? এতটুকু ম্যানারস নেই তোমার মধ্যে! ওহ গড! এই ছেলে তুমি ভুলে গিয়েছো, চার মাস আগে জঙ্গলে আই সেভড ইউ? আমি না থাকলে ওই জোকটা তোমার শরীরের সকল রক্ত পান করে নিতো। তারপর… “

সাদাত ফোঁড়ন কাটে,

“ এনাফ! যথেষ্ট হয়েছে। আসছি আমি। কত নাম্বার টার্মিনালে? “

কথাটুকু শেষ করেই দ্রুত রওনা হয় সাদাত। আর কিছুক্ষণ দেরি করলে দেখা যাবে এই মহিলা পুরো এয়ারপোর্ট মাথায় তুলে ফেলেছে!

__________

রাতের শেষ ভাগ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সুহালা বেগমের পাতলা ঘুমটা আচমকা ভেঙে যায়। অনুভব করে ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে তার। খুলে রাখা চুলগুলো খোপায় বেধে তিনি রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিচে নেমে রান্নাঘরের দিকে এগুতেই টের পায় রান্নাঘরের লাইটটা জ্বলছে। সুহালা বেগমের ভ্রু কুচকে আসে। তিনি ধীরপায়ে হেঁটে রান্না ঘরে পা রাখতেই দেখেন একজন যুবক ক্যাবিনেটের সামনে একটা কফির জার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। জার হতে চামচে কফি তুলে মগে মেশাচ্ছে। গায়ে তার কালো রঙা টি শার্ট আর ট্রাউজার কেবল। নিজের স্বাভাবিক বেশভূষা ছেড়ে হোম বয় লুকে আছে।

সুহালা বেগম বলেন,

“ আমাকে ডাকো নি কেন? “

দূর্জয় চমকায় না। কাজে মনযোগী থেকেই শান্ত গলায় জবাব দেয়,

“ কারণ বাবা ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছেন, মামণি ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় কখনো বিরক্ত না করতে। “

সুহালা বেগম অভিমানী সুরে বলে,

“ বাবার শিখানো বুলি মনে আছে, শুধু আমার কথাই মনে নেই তাই না? “

দূর্জয় এবার হাতের জারটা রেখে ফিরে চায়। চোখে মুখে ক্লান্তির বদলে স্নিগ্ধতা। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। এগিয়ে এসে একহাতে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ আই মিসড ইউ এন্ড আই মিসড মাই হোম। “

সুহালা বেগম হেসে বলে,

“ তুমি গিয়ে বসো। আমি কফি বানিয়ে আনছি। “

দূর্জয় বাঁধ সেধে বলে,

“ আই ক্যান ডু দ্যাট মাইসেল্ফ। তুমি গিয়ে ঘুমাও এখন। কাল সকালে তোমাকে ব্যস্ত রাখবো আমি। সকালে যাওয়ার আগে তোমার হাতের নাস্তাটা মিস করতে চাই না। “

সুহালা বেগম অবাক হয়ে বলে,

“ কালই ফিরে যাবে তুমি? “

“ দশ-টা বাজে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। “

সুহালা বেগমের মন খারাপ হলেও তিনি এই ব্যাপারে আর কথা বাড়ায় না। এসবে অভ্যস্ত আছেন তিনি। তাই কেবল পানি খেয়ে নিজের রুমে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। যাওয়ার আগে ফিরে বলে উঠে,

“ তোমার ফুপ্পিকে আমি মানা করে দিয়েছি। হেনা আপার মেয়ের সঙ্গে আর ওই ব্যাপারটা আগাবে না সাফ জানিয়েছি। উনি ভালোই ক্ষেপেছেন আমার প্রতি। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, যে তিনি দেখতে চান আমার খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছেলে কোন রাজকুমারীকে বউ করে আনবে। “

দূর্জয় এই কথার পিঠে কোনো প্রতুত্তর করে না। সুহালা বেগম নিজের মতো রুমে ফিরে যান। কফির কাপটা হাতে নিয়ে দূর্জয় নিজের রুমটায় ফিরে আসে। বারান্দায় গিয়ে রেলিঙের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। মনে মনে চলছে অদ্ভুৎ সব ভাবনা। সেল্ফ রিয়েলাইজেশন ব্যাপারটা তার রাতের ঘুম অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে বলা চলে। হাতে দুটো অপশন আছে তার। মনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দু’পা পিছিয়ে যাওয়া। আর নাহয় নিজের মনকে স্রোতের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া। দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কফির কাপে চুমুক বসিয়ে নিশুতি আকাশের পানে চায়। আকাশ যেনো সঙ্গে সঙ্গে দূর্জয়কে দেখে ঠাট্টার সুরে বললো,

“ প্রকৃতি বড়ো অদ্ভুৎ দূর্জয়। তেরোটা বছর আগে যেই মেয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না তোমার, আজ সেই মেয়েটাই তোমার আগ্রহ, চিন্তা ও মায়ার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়রনি। “

দূর্জয় নীরব রয়। আকাশের দিকে নির্লিপ্ত তাকিয়ে রয়। তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারটা চিন্তা। অবাধ্য মন তাকে শাসায়,

“ শি ওয়াজ রেপড। “

দূর্জয় ক্ষীণ স্বরে বলে,

“ ওর দোষ নেই তাতে। “

মন দমে না। তাকে রিয়েলিটি চেক দিতে শুধায়,

“ তেরো বছর আগের বাণী এবং বর্তমানের বাণীর মাঝে আকাশ পাতাল ফারাক আছে দূর্জয়। শি ইজ সেন্সিটিভ। ইউ ক্যান্ট হ্যান্ডেল হার। “

দূর্জয় অস্ফুটে বলে উঠে,

“ আই উইল হ্যান্ডেল হার কেয়ারফুললি। “

অসভ্য মনটা ফের তাকে ছুড়ে দেয় আরেকটা ভাবনা,

“ ও একা নয়। একটা বাচ্চাও আছে ওর। “

এবার দূর্জয় আপনমনে পরিষ্কার গলায় বলে উঠে,

“ আই ক্যান হ্যান্ডেল বোথ অফ দেম ড্যালিকেটলি। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫৫.

সকালের স্নিগ্ধ শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে চারিদিকে। ঘড়ি ধরে কেবল পঁচিশ মিনিট সময় বরাদ্দ করে পাগলা বাবুর্চি রেস্টুরেন্টে হাজির হয়েছে সাদাত। দূর হতে দৃশানকে দেখতেই নির্দিষ্ট টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। গত রাতে এয়ারপোর্টে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারে নি সে। গুরুত্বপূর্ণ কল আসায় ফিরে যেতে হয়েছিলো। দৃশানের ওই ল্যাগেজ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যাপারে আর কথা বলার সুযোগই হয় নি।

টেবিলের কাছাকাছি যেতেই সাদাত চোখ ছানাবড়া করে একবার দৃশানের দিকে তাকায় আরেকবার টেবিল ভর্তি খাবারের দিকে। কোন আইটেমটা নেই টেবিলে? নিহারি, পরোটা, মুরগির লাল ভুনা, আচারি খিচুড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। লং টাইম ফ্লাইটে জার্নি করার ফলস্বরূপ হয়তো খিদেটা একটু বেশিই লেগেছে। খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত দৃশান সাদাতকে লক্ষ্য করতেই বলে,

“ হাই ছেলে, কি অবস্থা তোমার? “

সাদাতের বিস্মিত মুখটা মুহুর্তেই চুপসে যায়। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,

“ আমাকে ছেলে বলে ডাকতে মানা করেছিলাম। পছন্দ না আমার। “

দৃশান হাতের ছেড়া পরোটার অংশটুকু নিহারির ঝোলে ডুবিয়ে মুখে পুরে অবাক স্বরে বলে,

“ একজন ছেলে মানুষকে ছেলে ডাকবো না তো কি ডাকবো? তুমি কি ছেলে না? গে ডাকবো নাকি মেয়ে? “

সাদাতের মুখটা এম্বারেসমেন্টে আরো চুপসে যায়। সে চাপা ক্ষোভ নিয়ে বলে,

“ তুমি কি শুধু আমাকেই এরকম লজ্জায় ফেলো, নাকি সবাইকেই? “

দৃশান ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলে,

“ যারা সেধে লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়তে চায় শুধুই তাদের। “

সাদাত চুপ হয়ে যায়। দেখা গেলো সে কিছু বললো, সেটার জের ধরে দৃশান নামরা আবার তাকে লজ্জা দিলো। দৃশান নিজেই বলে,

“ হ্যাভ ব্রেকফাস্ট। “

সাদাত গলা ঝেড়ে বলে,

“ আমি নাস্তা করে এসেছি। তোমাকে এতটুকু জানাতে এলাম যে আমার বিমানবন্দর কতৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে ট্রানজিটের সময় তোমার ল্যাগেজটা পূর্ববর্তী এয়ারপোর্টেই রয়ে গিয়েছে। ওরা তিন দিনের মধ্যেই তা পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। “

যদিও রাতে এই ব্যাপারটা নিয়ে দৃশান খুব রেগে ছিলো কিন্তু আপাতত সকালের ফুরফুরে আবহাওয়ার সঙ্গে তার মেজাজটাও ঠান্ডা আছে। ভাগ্যিস তার হ্যান্ড লাগেজটা সঙ্গেই ছিলো। আপাতত ওটা দিয়েই চালিয়ে নিবে সে। দৃশান অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গরম ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপটা সাদাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ এট লিস্ট চা-টা খাও। মাত্রই দিয়ে গিয়েছে। আমি ছুঁয়েও দেখি নি। “

সাদাত বলে,

“ ইট’স ওকে। আমি বরং আরেক কাপ অর্ডার করছি। “

“ আরেক কাপ সার্ভ করতে টাইম লাগবে। ইউ হ্যাভ টু গো ব্যাক, রাইট? “

সাদাত আর কথা বাড়ায় না। নীরবে কাপটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ বাই দ্যা ওয়ে, জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ বাংলাদেশে ব্যাক করলে? আবার কোনো কাজে? “

“ উঁহু। আমার দাদীর নামে কিছু জমি রয়েছে এই দেশে। উনি ওগুলো বিক্রি করতে চাচ্ছেন। তাই কাগজপত্রের কাজ দেখতে এলাম। সেই সঙ্গে আমি ভ্যাকেশনেও আছি। তাই ছোট খাটো ট্রিপও বলা চলে। “

“ তোমার জব? ছুটি ম্যানেজ করলে কি করে? “

“ সরকারি জব যেহেতু আর সেই সঙ্গে লাস্ট এক বছরে আমি কোনো ভ্যাকেশনও নেই নি, তাই বেশি একটা ঝামেলা হয় নি। “

ছোট করে ওহ বলে সাদাত চুপ হয়ে যায়। আচমকা তার মনে পড়ে ওই যুবকটার কথা, যাকে ধরার জন্য দৃশানের এতো তোরজোর ছিলো। দৃশানের ভাষ্য এবং প্রমাণ মতে ছেলেটা ইয়েমেন থাকা অবস্থাতেই ওই দেশে হওয়া হামলা গুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলো। পুলিশ এবং সেনাবাহিনী যখন চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে সকল আতঙ্কবাদীদের পিছনে পড়ে তখন অবৈধ ভাবে ওই দেশ ত্যাগ করে ছেলেটা। পৌঁছায় বাংলাদেশে। এই দেশে এসেও নিজের স্বভাবটা বদলায় না। অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত রয়। ইয়েমেন সরকারের কাছে এই খবর ছিলো যে তাদের দেশের একজন নাগরিক দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে এসেও টেরোরিজমে যুক্ত রয়েছে। এই খবরটা বাংলাদেশ সরকার জানার পূর্বেই নিজেদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করতে ছেলেটাকে আটকের জন্য নিজেদের দক্ষ সিক্রেট এজেন্টকে নিযুক্ত করেন। তাকে অর্ডার দেওয়া হয়েছিলো হয় ছেলেটাকে আটক করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আর তা সম্ভব না হলে শুট করে এই ঝামেলা শেষ করতে। দৃশান নিজের দায়িত্বটুকু সাদাতের সাহায্যে নিখুঁত ভাবেই পরিপূর্ণ করতে পেরেছিলো।

পুরনো কথা মনে পড়তেই সাদাত জানতে চায়,

“ কালপ্রিট কি সাজা পেয়েছে? “

“ জেলে আছে। চূড়ান্ত শাস্তির সিদ্ধান্তও শীঘ্রই হবে আশা করি। “

সাদাত আর কথা বাড়ায় না। হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকায়। তার আর ৫ মিনিটের মধ্যে উঠতে হবে। গরম চা-টুকু এক চুমুকে শেষ করতেই দৃশান নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠে,

“ বাই দ্যা ওয়ে, এসেছু যেহেতু যাওয়ার আগে আমার সুন্দর কয়েকটা ছবি তুলে দিয়ে যাও। এই দেশে আসার পর থেকে সুন্দর ছবি তোলার জন্য মানুষ পাচ্ছি না। “

সাদাত বুঝে না তার কি বলা উচিত। এসব ছবি তোলার কাজ তার দ্বারা হয় না। তাদের গ্রুপে সাইফ, রাফি আর ফারদিন ভালো ছবি তুলতে পারে। কিন্তু সে এসব বিষয়ে অপটু। তবুও সে নীরবে ফোনটা হাতে নিয়ে ক্যামেরা অন করে দৃশানের মুখপানে স্থির করে।

দৃশান হাসে না। বরং একহাতের কনুই টেবিলের উপর ঠেকিয়ে, হাতের উল্টো পিঠে থুতনি রেখে কাঁচ ভেদ করে কুয়াশাচ্ছন্ন বাহির পানে তাকায়। মুখের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে নির্লিপ্ততা। রেড ওয়াইন রঙের এলোমেলো খোলা চুলগুলো ক্লাচার দিয়ে মাথার উপর তুলে খোপা করা। দু চারটে চুল সেই খোপা গলে বেরিয়ে এদিকে সেদিকে ঝুলে আছে।

ক্যামেরায় ফোকাস করতেই আচমকা সাদাতের মনে হয় সামনে বসে থাকা এই দুই বছরের সিনিয়র মেয়েটা দেখতে আকর্ষণীয়। তার নির্লিপ্ত ভাব, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, মুখশ্রী জুড়ে লেপ্টে থাকা দৃঢ় ভাব তাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে যেনো।

সাদাত অনুভব করে সে ঘামছে। এই কড়া শীতেও কপালের কিনারায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। গরম চা খাওয়ার ফলস্বরূপ নাকি সামনে বসা নারীর উপস্থিতির কারণে তা ঠিক ঠাওর করতে পারে না। অপ্রস্তুত হয়ে সাদাত দ্রুত পরপর চার পাঁচটা ক্লিক করে ফোনটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ায়। ‘আমার যেতে হবে’ বলে এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। কিন্তু বেরিয়ে আসতেই
তার মনে পড়ে সে চা-টার জন্য পে করে আসতে ভুলে গিয়েছে। কি অভদ্রতা! নিজের প্রতিই বিরক্ত হয় সাদাত। নিজের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার ফলে আরো একদফা সে এম্বারেসমেন্টের স্বীকার হলো।

__________

চট্টগ্রামে পৌঁছেও সোজা বাড়িতে ফিরতে পারে নি দূর্জয়। কিছু কাজে হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলো। সেখানে কাজের চাপে কিভাবে সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো তা টের পাওয়া গেলো না। বাড়ির কলিংবেলটা যখন বেজে উঠে তখন কেবল সন্ধ্যা নামলো। বাণী লুকিং গ্লাসে দরজার অপর পাশের মানুষের মুখটা দেখেই দরজাটা খুলে দেয়। দূর্জয় একবার বাণীর মুখটা দেখে নিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। নীরবে ঘরে প্রবেশ করে।

বহ্নি তখন রুমের ভেতর হতে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে দূর্জয়কে দেখছিলো। দূর্জয় দূর হতে তাকে দেখেই মৃদু হেসে বলে উঠে,

“ হ্যালো কিডডো। “

বহ্নি দাঁত বের করে হাসে। পরপর রুমের ভেতর থেকে বেরিয়ে দূর্জয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে। দূর্জয় হেসে নিজের হাতের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে বহ্নির দিকে এগিয়ে দেয়। বহ্নি উৎফুল্ল হয়ে প্যাকেট নিয়ে সোফায় বসে তা খুলতে শুরু করে। প্যাকেট খুলতেই দেখে ভেতরে পাঁচটা বিশাল চকলেট বারের প্যাকেট। বাণী দূর হতে তা দেখে নীরবে। বহ্নি দ্রুত একটা চকলেট ছিড়ে কামড় বসাতেই চোখ মুখ কুচকে ফেলে। বিদঘুটে স্বাদটা কোনমতে গিলে নিয়ে বলে,

“ ইয়াক মেজর। হোয়াট ইজ দিজ? “

দূর্জয় তখন পাশের সোফায় বসে নিজের পায়ের বুট জুতা জোড়া খুলতে ব্যস্ত ছিলো। বহ্নির প্রশ্ন শুনতেই অবাক হয়ে বলে,

“ চকলেট। আপনি-ই না বলেছিলেন আপনি চকলেট খাবেন? “

বহ্নি মুখ কালো করে বলে,

“ এটার টেস্ট অনেক বাজে। তিতা। একটুও মিষ্টি না। “

দূর্জয় এবার বিজ্ঞের ন্যায় বলা শুরু করে,

“ দিজ ইজ ডার্ক চকলেট। ১০০% সুগার ফ্রি। আপনি চাইলে প্রতিদিন ২০ গ্রাম খেতে পারবেন। হেলথে কোনো ব্যাড ইফেক্ট ফেলবে না। নরমাল চকলেটগুলোতে সুগার লেভেল অনেক হাই থাকে। এন্ড সুগার ইজ নট গুড ফর হেলথ ইউ নো। “

বহ্নি মুখ কুচকে রয়। চকলেটের মাঝেও ভালো খারাপ আছে? সে জানতো না কেনো? পাপা তো কখনো তাকে চকলেট খেতে বাধা দেয় নি। বহ্নি মন খারাপ করে হাতের চকলেট বারটা সোফায় রেখে বসে রয়। মেজরকে তার ভালো লাগে, কিন্তু মেজরের খাবারের টেস্ট অনেক বাজে। সে আর কখনো মেজরের দেওয়া কিছু খাবে না। বহ্নি সামান্য রাগ দেখিয়ে উঠে যেতে নিলেই বাণী শীতল গলায় বলে,

“ রাগ দেখিয়ে যাবে না বহ্নি। সে থ্যাঙ্কিউ ফার্স্ট। তারপর চকলেটটা নিয়ে চুপচাপ রুমে যাও। “

বাণীর কণ্ঠস্বর শুনে দূর্জয় সামান্য অবাক হয়। সে বলে উঠে,

“ থ্যাঙ্কিউ বলতে হবে না। আই ওয়াজ কিডিং উইথ হার। আই নো যে বাচ্চারা ডার্ক চকলেট খেতে পারে না। ওটা আমার জন্য ছিলো। বহ্নি, আপনার জন্য ব্যাগে আলাদা চকলেট আছে। টেক ইট। “

বহ্নি প্রফুল্ল হেসে দৌড়ে গিয়ে ব্যাগ থেকে আরেকটা প্যাকেট বের করে নেয়। দাঁত বের করে হেসে ‘থ্যাঙ্কিউ’ বলেই রুমে চলে যায়। দূর্জয় এবার চোখ তুলে বাণীর দিকে তাকায়। থমথমে মুখটা দেখে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে? “

বাণী স্পষ্ট গলায় বলে,

“ আই এম নট কম্ফোর্টেবল ইন দিজ সিচুয়েশন। আই নো তুমি মন থেকেই সাহায্য করছো আমাকে। কিন্তু আমার পক্ষে তোমার সাহায্য নেওয়া আর পসিবল না। “

দূর্জয় ভ্রু সংকুচিত করে বাণীকে বলে,

“ বসো বাণী। “

বাণী চুপচাপ দূর্জয়ের মুখোমুখি সোফাটায় বসে। দূর্জয় এবার বলে,

“ আই নো কি ফিল করছো। কিন্তু আমি তো বলেছি অপেক্ষা করো। লেট মি হ্যান্ডেল এভ্রিথিং। “

বাণী এবার গলায় জোর মিশিয়ে বলে,

“ নো আই ওন্ট। যেটা তোমার দায়িত্ব না, সেটা তোমাকে হ্যান্ডেল করার অনুমতি আমি দিতে পারি না। আমি বা আমার মেয়ে কোনটাই তোমার দায়িত্বের মাঝে পড়ে না। “

বাণীর কথা বলার ধরণ দেখে অবাক হয় দূর্জয়। নরম স্বরে জানতে চায়,

“ কি হয়েছে বাণী? “

“ কিছু না। “

“ তুমি ডিস্টার্বড। “

“ কারণ তুমি বুঝতে পারছো না যে তুমি বহ্নির অভ্যাস খারাপ করছো। ও কিছু বললেই সেটা তোমার কেনো করতে হবে? তুমি ওর কেউ নও। ওর বুঝতে হবে ওর জন্য শুধুমাত্র আমি আছি। বাকি কারো প্রতি কোনো ধরনের আশা রাখা উচিত না ওর। কারো হেল্প ছাড়া চলা শিখতে হবে ওর। শি হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড যে লাইফ ইজ নট দ্যাট ইজি যে ও যখন যা চাইবে তাই পাবে। “

“ কুল ডাউন বাণী। ও এখনো বাচ্চা। লাইফের এতো ইকুয়েশন বুঝার মতো বয়স ওর হয় নি। তোমার প্রতিটা পয়েন্টের সাথে আমি এগ্রি করছি। আই নো আমি ওর কেউ না। ওকে সেল্ফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট বানানোর ইচ্ছাও ভুল নয়। কিন্তু লেট হার গ্রো আপ এ লিটল এট লিস্ট। “

বাণী বলে,

“ সেটা না-হয় আমি ডিসাইড করবো। আপাতত আমি যেতে চাচ্ছি। আমার পরিচিত এক কলিগ সিথী আপু, উনার সাথে কথা হয়েছে। উনি বলেছেন উনার বিল্ডিংয়ে একটা এপার্টমেন্ট খালি আছে। বাজেট সহ সব মিলিয়ে আমার আর বহ্নির জন্য পারফেক্ট। বাসা পুরোটা ক্লিনই আছে। সিথী আপুর হাজবেন্ড যেহেতু নিজেই বাড়ির মালিক তাই এক তারিখে বাসায় উঠার বাধ্যবাধকতা নেই কোনো। “

দূর্জয় নীরবে দেখে বাণীকে। এতো তাড়া? একবারও এটাও ভাবছে না একটা বাসায় মুভ করতে হলে ম্যাক্সিমাম যেই ফার্নিচার গুলোর প্রয়োজন পড়ে সেগুলোও তার কাছে নেই। বাচ্চাটাকে নিয়ে গিয়ে কি এই শীতে মেঝেতে ঘুমাতে চাচ্ছে? বাণীর জেদ আর আত্মসম্মান কি দূর্জয়ের বিবেক বোধের থেকেও বড়ো হয়ে গেলো? উঁহু। কখনো না। দূর্জয় শীতল স্বরে বলে,

“ কোথাও যাচ্ছো না তোমরা। সেই অনুমতি দিতে পারছি না আমি। দুঃখিত। “

বাণী অবাক হয়। পরমুহূর্তে রেগে বলে,

“ তুমি আমাকে বাঁধা দিতে পারো না। সেই অধিকার আমি তোমাকে দেই নি। “

দূর্জয় থমথমে স্বরে বলে,

“ বহ্নি আমার কাছ থেকে কিছু নিতে পারবে না কারণ আমি ওর কেউ না। তুমি আমার সাহায্য নিতে রাজি না কারণ আমার তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তো? “

বাণীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দূর্জয় নিজেই একটা লম্বা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বলে,

“ নো প্রবলেম। আমার কাছে এই সমস্যারও সলিউশন আছে। লেট’স গেট ম্যারিড। “

বাণীর গাম্ভীর্য পূর্ণ মুখটায় বিস্ময়ে ছেয়ে যায়। সে বিস্ময় মিশ্রিত স্বরে বলে,

“ ইউ আর আউট অফ ইউর মাইন্ড। “

দূর্জয় তীব্র আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে,

“ আমি সম্পূর্ণ হুশ আর চেতনার সঙ্গেই বলছি, আমাকে বিয়ে করা যায় বাণী? সাহায্যের ইনটেনশনে নয় জেনুইনলি বিয়ে করতে চাচ্ছি। বহ্নি আর তোমার উপর আমার অধিকার নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ যেনো কেউ না পায়। নট ইভেন ইউ। “

বাণী ঠাই নিজের জায়গায় বসে রয়। বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে সে। এককালে সামনে বসে থাকা এই পুরুষটাকে বড়ো হয়ে বিয়ে করার জন্য দিন রাত মেনিফেস্ট করতো সে। সেসব খুব পুরনো ঘটনা। কিন্তু আজ যখন সেই পুরুষটাই তাকে এই প্রস্তাবটা দিলো তখন তার অনুভূতি শূন্য। উত্তর দেওয়ার মতো কিছু পেলো না। বাণী নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। পরপর উঠে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। রুমে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দেয়।

সোফায় বসে রয় ইউনিফর্ম পরিহিত পুরুষটা। এইমাত্র যেই প্রশ্নটা করেছে তার জন্য বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় সে। সে নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বাসী। হুট করে দূর্জয়ের মনে পড়ে যায় ফিলিস্তিনি কবি গাচ্চান কানাফানির এক উক্তি,

“ খোদা পুরুষের কাঁধ তৈয়ার করলেন রাইফেল বইতে, আর সাথে সইতে প্রিয়তমার দুঃখের ওজন। “

উক্তিটা মনে পড়তেই দূর্জয় চমকায়। এইমাত্র তার অবচেতন মন উক্তির পুরুষের জায়গায় নিজেকে এবং প্রিয়তমার জায়গায় বাণীকে বসিয়ে ভাবলো। সে কি তবে পাঁচ নম্বর ধাপে পৌঁছেই গেলো?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]