এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৭১+৭২+৭৩

0
348

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭১.

প্রায় ৪০ ঘন্টার অধিক সময় হসপিটালে অতিবাহিত করার পরে বিভিন্ন টেস্টের রিপোর্ট দেখে বহ্নিকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা হয়।
সঙ্গে ঠান্ডার সমস্যার জন্য বেশ কিছু মেডিসিনও গছিয়ে দেওয়া হয়। বহ্নির কাছে মেডিসিন গুলো এক প্রকার আতংকের ন্যায়ই। একে তো সিরাপ জাতীয় ওষুধ গুলো বিদঘুটে তেতো স্বাদের। তার উপর যেই দুটো ট্যাবলেট ধরনের মেডিসিন আছে সেগুলো খেতে বহ্নির খুব অসুবিধা হয়। ওষুধ গিলে খাওয়ার জন্য মুখে পানি নিলেও দেখা যায় পানি তার পেটে চলে যায় তবে ওষুধ মুখে রয়ে যায়। যদিও সেই সমস্যার সমাধান হিসেবে দূর্জয় মেডিসিন ভেঙে অর্ধেক করে দু বারে বহ্নিকে খেতে দেয়। এই সুবাদে কিছুটা সহজে গিলতে পারে বহ্নি।

জ্ঞান ফেরার পর থেকেই বহ্নি যখন হুটহাট ছোট করে দূর্জয়কে বাবা বলে ডাকে প্রতিবারই দূর্জয়ের মুখে নির্মল হাসি ফুটে উঠে। বাণী সেই দৃশ্যটা দেখে। বুকে অদ্ভুৎ প্রশান্তি অনুভব করে। সম্পর্কটা বেশি দিনের না হলেও বহ্নির প্রতি দূর্জয়ের স্নেহটা তার চোখ এড়ায় নি কখনো। সেই থেকে বাণীর মাঝেমধ্যে নিজেকে অপরাধী মনে হতো। একটা মানুষ নিঃস্বার্থ ভাবে এতোটা এফোর্ট দিচ্ছে। অথচ বিনিময়ে বাণী সমান ভালোবাসাটা ফিরিয়ে দিতে পারছে না। কিন্তু বহ্নির এই ছোট সম্বোধনে যেনো দূর্জয়ের প্রাপ্তির খাতা অনেকটাই পূরণ হয়েছে।

__________

হসপিটাল থেকে রিলিজ পেতেই বহ্নিকে নিয়ে শান্তিকুঞ্জে ফিরে আসে দূর্জয় এবং বাণী। দুটো দিন হসপিটালের হাওয়া গায়ে মেখে দুজনের চেহারারই বিধ্বস্ত অবস্থা। তবে মেয়ের সুস্থতা সেই বিধ্বস্ত চেহারায়ও প্রশান্তি ভাব লেপ্টে দিয়েছে যেনো।

শান্তিকুঞ্জে পা রাখতেই দূর্জয় ও বাণী অবাক হয় আঙিনায় বাধা কালো ছাগলটাকে দেখে। সুহালা বেগম তাদের বিস্ময়তা দূর করতে জানায় ছাগলটা তিনি আনিয়েছেন। এতো বড়ো একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেলো বাচ্চাটা। সুহালা বেগম নিয়ত করেছিলেন বহ্নির সুস্থতা সরূপ তিনি একটা ছাগল সদকা দিবেন। দূর্জয় এবং বাণী সুহালা বেগমকে বাধা দেন না এই ব্যাপারে। বরং সন্তোষ প্রকাশ করে বহ্নিকে নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে।

কিছুটা সুস্থ হলেও বহ্নি এখনো ছোটাছুটি কিংবা খেলাধুলা করার অনুমতি পায় নি। শরীরটা এখনো বেশ দূর্বল। তাপমাত্রাটাও এখানো পুরোপুরি নামে নি। এরকম অবস্থায় দূর্জয় কিংবা বাণী তাকে এক মুহুর্তের জন্যও কোল থেকে নামাচ্ছে না। এই যেমন বাসায় প্রবেশের পরও দূর্জয় তাকে কোলে নিয়ে লিভিং রুমে বসে আছে। অবশ্য বহ্নি আপাতত এর বিরোধিতাও করছে না। বিগত ঘটনা তার মনে গভীর ভাবে দাগ কেটেছে। মনে মনে সে অটল যে আর কখনো ভুলেও সে ওই পুকুরটায় নৌকা ভাসাতে যাবে না। এমনকি ওই পুকুরের ধারেও ঘেঁষবে না সে।

দূর্জয় যখন মেয়ের সঙ্গে টুকটাক আদুরে স্বরে গল্পে মশগুল ঠিক সেই মুহুর্তে সুহালা বেগম রান্নাঘর থেকে একটা বাটিতে করে পেস্ট্রি হাতে এসে বহ্নির সামনে বসেন। বাচ্চাটা হসপিটালে থাকা অবস্থায় সুহালা বেগমকে বলেছিলো তার পেস্ট্রি খেতে ইচ্ছে করছে। নাতনির ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারে সচেতন সুহালা বেগম। তাই চার পাঁচটা রেসিপির ভিডিও দেখে নিজ হাতে বাসায় পেস্ট্রি বেক করেছেন। দূর্জয় অবশ্য সেই ব্যাপারে জানে না। তাই আঁতকে উঠে,

“ না মামণি। ওকে এই দোকানের খাবার দিও না। এসব খাবার মোটেও হাইজেনিক না। “

বহ্নি মুহুর্তেই মুখটা কালো করে ফেলে। সুহালা বেগম প্রতুত্তর করে বলেন,

“ আমার হাইজেনিক বাচ্চা, নিজের মা’কে হাইজেন নিয়ে লেকচার দিচ্ছো তুমি? এইটা আমি নিজ হাতে বানিয়েছি আমার নাতনির জন্য। তাই তোমার চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণই নেই। “

দূর্জয় নিশ্চিন্ত মনে বলে,

“ তাহলে সমস্যা নেই। “

বহ্নির চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সে দ্রুত দীদার হাতে পেস্ট্রি খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাণী উপরে গিয়েছিলো জামা বদলাতে। জামা বদলে নিচে নামতেই সে দেখে বহ্নিকে কোলে বসিয়ে দূর্জয় এবং সুহালা বেগম তার সঙ্গে আড্ডায় মশগুল। মনের কোণে একরাশ ভালো লাগা নিয়ে বাণী এগিয়ে এসে বলে,

“ মা, আজকে দুপুরের রান্নাটা আমি করি? “

সুহালা বেগম মানা করেন না। তবে বলেন তিনি আর মৌটুসীও তাহলে সাহায্য করবেন। বাণী আপত্তি করেন না।

__________

সম্পূর্ণ দুপুরটা বাণী, সুহালা বেগম এবং মৌটুসী রান্নাঘরে কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন গল্প করে কাটিয়ে দেয়। যদিও গল্প মূলত সুহালা বেগম আর মৌটুসীই করছিলো। বাণী কেবল আগ্রহ নিয়ে শুনছিলো তাদের কথা। আজকাল এই মানুষ গুলোর মাঝে সেই চাপা অস্বস্তিটা কাজ করে না তার। কেমন আপন আপন মনে হয় এদেরকে!

রান্না মিটিয়ে দূর্জয় এবং বহ্নিকে ডাকতে নিজের রুমে আসতেই বাণী একটা সুন্দর দৃশ্য দেখতে পায়। বিছানার মধ্যিখানে গায়ে কম্বল টেনে রাখা বহ্নি নিশ্চিন্তে একটা বালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। তার ঠিক পাশেই দূর্জয় ঘুমিয়ে আছে কাথ হয়ে। তবে তার গায়ে কোনো কম্বল নেই।

বাণী ভাবলো যেহেতু এখন ঘুমোচ্ছে তাহলে আরেকটু ঘুমাক ওরা। পরে ঘুম থেকে উঠলে নাহয় লাঞ্চ করে নিবে। এই ভেবে বাণী এগিয়ে যায় কম্বলটা টেনে দূর্জয়ের গায়েও দিয়ে দিতে। জম্পেশ ঠান্ডা পড়েছে। লেপ, কম্বল ছাড়া শরীর বরফ হয়ে যাওয়ার কথা।

দূর্জয়ের ঘুম অত্যন্ত পাতলা। বাণী কম্বলটা টেনে তার গায়ে দিতে নিলেই সে চোখ মেলে ঘাড় ঘুরিয়ে বাণীর দিকে তাকায়। আকস্মিক ঘটনায় বাণী হতভম্ব হয়ে পড়ে। সে কিছুটা দূর্জয়ের উপর ঝুকে ছিলো। দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত গলায় বলে,

“ রান্না শেষ। খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিলাম। ঘুমাচ্ছো দেখে কম্বল টেনে দিচ্ছিলাম। “

দূর্জয় আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে বলে,

“ চোখ লেগে গিয়েছিলো। ঘুমাই নি। “

বাণী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়। বাণীকে দেখে নিয়ে দূর্জয় প্রশ্ন করে,

“ তুমি খেয়েছো? “

বাণী মাথা নেড়ে জবাব দেয়,

“ না। তুমি যেহেতু উঠেছো, তাহলে একেবারে নিচে গিয়ে খেয়ে আসো। আমি বহ্নির পাশে বসছি। ওকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। “

দূর্জয় আর কিছু না বলে উঠে রুম থেকে চলে যায়। বাণী চুপচাপ বহ্নির মাথার কাছে বসে আলতো হাতে চুলে হাত বুলাতে থাকে। বেশ ক্ষানিকক্ষণ পর দূর্জয় একটা ট্রে হাতে রুমে ফিরে আসে। দূর্জয়কে দেখতেই বাণী নিচু গলায় বলে,

“ তুমি? “

দূর্জয় বাণীর সামনে বসে ট্রে টা রেখে বলে,

“ আজকের লাঞ্চটা দু’জন রুমেই করবো। “

বাণী বিস্মিত গলায় বলে,

“ কেনো? খারাপ দেখায় না? মা একা বসে খাবার খাবে? প্লিজ তুমি নিচে যাও। “

দূর্জয় প্লেটটা হাতে নিয়ে বলে,

“ মোটেও খারাপ দেখায় না। মামণিকে কোম্পানি দেওয়ার জন্য মৌটুসী আছে। আপাতত তুমি আমাকে কোম্পানি দাও। “

বাণীর মনে খচখচানিটা রয়ে যায়। সে তবুও প্রশ্ন করে,

“ তাহলে একটা প্লেট কেনো? “

“ এক প্লেটেই দুজনের জন্য বেড়ে নিয়েছি। তোমার সমস্যা হবে প্লেট শেয়ার করতে? আমার হাতে খেতে খুব বেশি অসুবিধা হবে? “

দূর্জয়ের প্রশ্নের পিঠে বাণী নির্বাক রয়। কিছু বলতে পারে না। কেবল মাথা নেড়ে বুঝায় তার সমস্যা নেই। দূর্জয় নিজ থেকেই এবার ভাত মেখে বাণীর মুখের সামনে এগিয়ে ধরে। বাণী ধীরে সুস্থে লোকমাটা মুখে তুলতেই দূর্জয় আবার আরেক লোকমা মেখে নিজের মুখে দেয়। বাণী একদৃষ্টিতে দূর্জয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তি দেখছে নিভৃতে।

তার সামনে বসে থাকা এই পুরুষটা একসঙ্গে প্লেটে সব তরকারি বেড়ে খাওয়া পছন্দ করে না। এই বিষয়টা বিয়ের পর বেশ ক’দিন লক্ষ্য করে বাণী নিজ থেকেই বুঝতে পেরেছে। অথচ এই মুহুর্তে ঠিকই প্লেটটাতে একসঙ্গে সব তরকারি বেড়ে নিয়ে এসেছে বাণীর জন্য। সুহালা বেগমের মুখে বাণী এ-ও শুনেছে খাবার দাবারের ব্যাপারে দূর্জয় খুব হাইজেন মেইনটেইন করে চলে। কারো এঁটো খাওয়া অথবা নিজ হাতে কাউকে খাইয়ে দেওয়া এসব ব্যাপার দেখলেই দূর্জয় আঁতকে উঠতো। অথচ সেই দূর্জয় কি-না এই মুহুর্তে নিজ হাতে বাণীকে খাইয়ে দিচ্ছে আবার সে-ই একই হাতে নিজেও খাচ্ছে।

শেষ কবে এভাবে যত্ন আর স্নেহের সহিত বাণী কারো হাতে খেয়েছিলো তার মনে পড়ছে না। মুখের খাবারটা কোনো মতে গিলে নিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় নিজের। না চাইতেও তার কান্না পাচ্ছে। সেই কান্নাটা দমিয়ে রাখাও অসম্ভব ঠেকছে। বেহায়া চোখের জল গুলো গাল গড়িয়ে টুপটুপ করে পড়তে শুরু করে। দূর্জয় তা দেখতেই উদ্বেগ মিশ্রিত গলায় বলে,

“ কি হয়েছে বাণী? “

বাণী কিছু বলতে পারে না। তবে নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টাও করে না। উল্টো সামনের দিকে ঝুকে দূর্জয়ের কাধে মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে বুকের যন্ত্রণা গুলো অশ্রু রূপে বিসর্জন দিতে থাকে। দূর্জয় এই পর্যায়ে কিছু বলে না। কেবল হাতের প্লেটটা একপাশে সরিয়ে রেখে বাণীর পিঠে আলতো করে এক হাত দিয়ে বুলিয়ে দিতে থাকে। বাণী কান্নার মাঝে মৃদু গলায় বলে,

“ আমার কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে বারবার। “

দূর্জয় ফিসফিসিয়ে বলে,

“ সবটা সত্যি জানা। “

__________

নোংরা ফ্লোরে বসে থাকা আসামীটা আজকাল কেমন যেনো ঘাড়ত্যাড়ামি স্বভাবটা জাহির করে না খুব একটা। চোখে মুখে হিংস্র রূপটার বহিঃপ্রকাশও করে না খুব একটা। বরং অত্যাধিক মাত্রায় শান্ত হয়ে নিজের ভাবনার জগতে ডুবে থাকে। আজ সৈন্যদের এই সেলটায় হিরণের শেষ দিন। আগামীকাল থেকে তার বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। সেই সঙ্গে তার অবস্থানটাও পুলিশের অধিনস্থ জেলে স্থানান্তর হবে।

হিরণ ভালো করেই জানে তার হাতে এখনো অনেক সময় আছে। এটা বাংলাদেশ। এখানকার বিচার ব্যবস্থার প্রক্রিয়াটা কচ্ছপের থেকেও ধীর গতিতে এগোয়। প্রত্যেকটা শুনানির তারিখের মাঝে থাকে কয়েক মাসের ব্যবধান। যদিও দেশের বুকের একটা আইনজীবিও হিরণের কেসটা সামলাতে এগিয়ে আসে নি। আসার কথাও নয়। হিরণ একজন প্রকাশ্যে দেশদ্রোহী। তার উপর লাগানো অভিযোগের যুতসই সাক্ষ্য প্রমাণ আছে। তাই নীতি মেনে চলা কিংবা অনৈতিকতার সমর্থক আইনজীবী কেউই তার কেসটার প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে নিজেদের চাকরি হুমকিতে ফেলবে না।

চার দেয়ালে বন্দী হিরণের দেহটা আজকাল খুব ক্লান্ত অনুভব করে। কেমন দমবন্ধ অনুভব করে সে। মনে হয় কতদিন বাহিরের জগতটা দেখে না। ছোট একটা ছিদ্রও নেই দেয়ালের ফাঁক ফোকরে। সামান্যতম প্রাকৃতিক আলো দেখে না কতদিন! কেবল তো ক’টা মাসই হলো হিরণ এই বন্দী অবস্থায় আছে। মাত্র এই ক মাসেই যদি তার কাছে এই জীবনটা এতটা তিক্ত মনে হয়, তাহলে না জানি বাণী ওই সাতটা বছর কি রকম অনুভব করতো? এই তিক্ততা, অন্যের আওতায় বশ্যতা থেকে পালানোর জন্যই বুঝি বাণী এতো মরিয়া ছিলো!

একটা প্রবাদ বাক্য শুনেছিলো হিরণ। ‘You never know what someone is going through until you walk in their shoe.’ প্রবাদটা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছে হিরণ। যদিও তার তিল পরিমাণ এই উপলব্ধিটাও বাণীর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া ওই অতল গহব্বরের সম কষ্টের সামনে কিছুই না।

হুট করেই বহ্নির কথা ভাবতে বসে হিরণ। গত বেশ ক’দিন ধরেই মেয়ের জন্য তার বুকটা নীরবে পুড়ছে। কে জানে কেমন আছে মেয়েটা! অবশ্য বাণীর কাছে বহ্নির খারাপ থাকার কথাও নয়! এই কয় মাসে কি বহ্নি আগের তুলনায় আরেকটু বড়ো হয়েছে? কৌতূহল জাগে হিরণের। মেয়েটাকে একবার সামনা-সামনি দেখার ইচ্ছা জাগে খুব। এই বন্দীদশায় মেয়েকে দেখার ইচ্ছাটা পূরণ হওয়া সম্ভব নয় বলেই হিরণ মেয়ের সঙ্গে নিজের মুহুর্তের স্মৃতিচারণ করতে বসে।

বাণী যখন প্রেগন্যান্ট ছিলো তখনকার একদিনের কথা। নতুন কারো আগমনের জন্য একা হাতে প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হিরণ৷ বাচ্চাটা ছেলে হবে নাকি মেয়ে তা-ও তার জানা ছিলো না। তাই সে ছেলে মেয়ে উভয় বাচ্চার জন্যই কেনাকাটা করেছিলো। বাচ্চাকে ঘিরে তার এতো আগ্রহ দেখে ইবাত একদিন জানতে চেয়েছিলো,

“ স্যার। আপনি বাচ্চার জন্য কোনো নাম ভেবেছেন? “

সেই মুহুর্তে হিরণের মাথায় প্রবেশ করে, আসলেই তো! যার আগমনের জন্য হিরণের এতো অপেক্ষা তার জন্য এখনো কোনো নাম ভাবা হয় নি তার। সেই রাতে হিরণ খুব ভাবে। আর ভেবে ছেলে বাচ্চার জন্য কোনো নাম পায় না বলে কেবল একটা নামই ঠিক করে। বহ্নি। মেয়ে হলে এই নামটাই রাখবে সে। অনেকটা বাণী এবং নিজের নাম মিলিয়েই নামটা ঠিক করে হিরণ। বহ্নি নামটার অর্থ আগুন। হিরণের ভেতর দাউদাউ করা আগুনের একটা ছোট অংশ হবে সে।

__________

দিনটা পবিত্র শুক্রবার। সকাল থেকে বাসায় কিছু পরিচিত মুখের ভীড়। দূর্জয়ের ফুপ্পির পরিবারকে বিশেষ ভাবে দাওয়াত করেছেন সুহালা বেগম। একমাত্র আত্মীয় বলে কথা। যদিও দূর্জয়ের দুটো মামাও আছে। তবে তারা দুজনেই পরিবার সহ ইউরোপের একটা উন্নত মানের দেশে সেটেল্ড। দেশ মুখো হয় না বললেই চলে। তবে সুহালা বেগমের মতো তার দুই ভাইও সচ্ছল মনের বলেই দূর থেকে ভাগ্নে, ভাগ্নের স্ত্রী এবং কন্যার জন্য শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে না।

দূর্জয়ের ফুপ্পির তেতো কথা এড়ানোর জন্য সুহালা বেগম সারাদিন বাণীর সঙ্গে সঙ্গে থাকছেন। উক্ত ভদ্র মহিলাকে মোটেও কোনো তিক্ত কথা বলার সুযোগটুকু দিচ্ছেন না। দূর্জয়ের ফুপ্পি তা বুঝতে পারে। আর বুঝে বিরক্ত হন। নতুন নতুন ছেলের বউ নিয়ে এমন আদিখ্যেতা! মনে মনে নিজেকে বলে, দু’দিন যেতেই দেখা যাবে ছেলের বউ আর শাশুড়ীর এই মধুর সম্পর্ক কোথায় যায়!

দূর্জয় আজ আর দশটা দিনের মতো গায়ে শার্ট কিংবা টি শার্ট জড়িয়ে রাখে নি। বরং পবিত্র জুম্মার দিনের সম্মানে গায়ে জড়িয়েছে একটা কালো পাঞ্জাবি। নিজ গরজে আকিকার প্রতিটা বিষয় তদারকি করছে সে। গায়ে আসমানী রঙের শাড়ি জড়ানো বাণী তা দেখে কেবল মুগ্ধ হয়ে।

অবশেষে আসে সেই মুহুর্ত। হুজুর দূর্জয়ের কাছে জানতে চায় মেয়ের নাম কি রাখবে বলে ঠিক করেছে। দূর্জয় আড়চোখে কেবল দূরে দাঁড়ানো বাণীকে একবার দেখে। নামের ব্যাপারে বাণীর সঙ্গে সে কথা বলেছিলো। সবটা মনযোগ দিয়ে শুনে বাণী বলেছিলো নামটা যেনো দূর্জয়ই ঠিক করে। এই অধিকারটা সে দূর্জয়কে দিলো। দূর্জয় সেই মুহুর্তে অবাক হলেও উপলব্ধি করেছিলো বাণী ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ‘মেয়েটা আমার একার নয় বরং তোমারও। ওর উপর অধিকারের ভাগটা আমি তোমাকে এবং শুধুমাত্র তোমাকেই দিলাম।’

দূর্জয় বাণীর থেকে চোখ সরিয়ে হুজুরের দিকে তাকায়। নরম গলায় বলে,

“ আফরা ইলহাম৷ “

নামটুকু শুনতেই হুজুর সন্তোষমূলক হাসে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাণীর কানেও পৌঁছে দূর্জয়ের উচ্চারিত নামটা। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে তার। হুজুর বলে উঠে,

“ আলহামদুলিল্লাহ। আফরা ইলহাম। বেশ অর্থবহ নাম। আফরা অর্থ আরবি চন্দ্র মাসের ১৩ তম রাত। আর ইলহাম অর্থ অন্তর্দৃষ্টি। “

আকিকা সম্পন্ন হতেই দূর্জয় সুযোগ করে এক ফাঁকে বাণীর কাছে একটা ম্যাসেজ পাঠায়।

“ নাম পছন্দ হয়েছে? “

আধঘণ্টার থেকেও বেশি সময় পর ব্যস্ত বাণী ছোট করে রিপ্লাই করে,

“ অনেক। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭২.

রাতের অন্ধকার নেমেছে তখন চট্টগ্রাম শহরের বুকে। শীতল আবহাওয়াটা খুব প্রকোপ রূপ ধারণ করেছে। গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠে। বাধভাঙ্গা এই শীতের মাঝেও এক জোড়া তরুণ তরুণীর প্রেম বাধ মানছে না। ফিসফিস করে কথার ঝুলি খুলে বসেছে তারা।

ফোনের এপাশের তরুণী অতি আদুরে স্বরে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজিয়ে বসেছেন। কথাগুলো অনেকটা এরকম,

“ শুনুন, বিয়ের পর আপনার কোথাও পোস্টিং হলেও আমি চট্টগ্রামেই থাকবো। আমার মনে হয় কি জানেন? এই শহর, এখানকার আবহাওয়া আর সমুদ্র ছেড়ে দূরে গেলেই আমি মারা পড়বো। চট্টগ্রামের বাহিরে টেকা আমার পক্ষে সম্ভবই না। আমি স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভেবে চট্টগ্রামে থেকে গেলে কি আপনি খুব রাগ করবেন? বউ ছাড়া দূরে থাকতে কি আপনার খুব অসুবিধা হবে? “

ফোনের অপর পাশের তরুণ সজাগ গলায় উত্তর দেয়,

“ সত্যি বলবো? আজকাল আমারও মনে হয় এই শহর ছেড়ে দূরে যেতে আমার খারাপ লাগবে। দূরে গেলেও মনটা এই সমুদ্রের তীরেই রয়ে যাবে। ইয়াসমিনের কাছে থেকে যাবে। “

নিশা খানিক লাজুক হাসে। পর মুহুর্তেই মন খারাপ করে বলে,

“ যেকোনো সময়ই আপনার ডাক পড়বে তাই না? চট্টগ্রামের মিশন’টা তো শেষ। এখন অন্য জেলায় যাওয়ার পালা তাই না? “

“ আমি শিওর না। আমার কাজ হচ্ছে শুধু অর্ডার মানা। যে-ই অর্ডারই দিক না কেন তা মানতে বাধ্য আমি। “

নিশার মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। একজন সৈন্যের মেয়ে হওয়ার দরুণ এই ব্যাপারটা সে বেশ ভালো করেই বুঝে। তাই সাইফকে এই ব্যাপারে কিছু বলে না সে। তবে তার ভয় হয়। শুনেছে দূরে গেলে নাকি সম্পর্কের সুতোয় টানা পড়ে। একটা সময় সুতোটা পুরোপুরি ছিঁড়ে যায়। যদি তার আর সাইফের বেলায়ও তাই হয়?

নিশা না-হয় সাইফের অপেক্ষা করতে পারবে। কিন্তু সাইফ? উড়নচণ্ডী স্বভাবের লোকটা নিশার ভালোবাসাতেই আটকে থাকতে পারবে তো? দূরত্বটা সাইফের ভালোবাসাকে ম্লান করে দিবে না তো? প্রশ্ন গুলো নিশাকে ভাবায়। অভার থিংকিং এ ব্যস্ত নিশার নীরবতা সাইফ বুঝতে পারে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে সে বলে উঠে,

“ আমি ভালোবাসা ভাগ করতে শিখি নি ইয়াসমিন। মনে জমানো অনুভূতি, আবেগ কিংবা ভালোবাসা যা-ই বলেন না কেনো, তা বিলানোর জন্য মানুষ পাইনি কখনো। জীবনের চব্বিশটা বছর পাড় করে এসে যখন কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পেলাম, তখন নিজের সবটুকু শুদ্ধ অনুভূতি বিলিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করি নি। উজার করে সবটা আপনার নামেই দলিল করে রেখেছি। তাই কোনো ধরনের ভয় মনে থাকলে তা মুছে ফেলুন। যা আপনার তা আপনারই থাকবে। মুছবেও না, কারো ভাগও বসবে না। “

সাইফের কথায় জাদু আছে নাকি জানা নেই নিশার। তবে প্রত্যেকবার এই লোকটার কথাগুলো তার কাছে মেডিসিনের মতো কাজ করে। নিশার ভয়, সংশয়, দ্বিধা সবই সেই মেডিসিনের ন্যায় কথার কার্যকারিতায় দূর হয়ে যায়। নিশা হঠাৎ নিষ্প্রভ গলায় বলে উঠে,

“ রিসেন্টলি একটা জিনিস পড়েছি জানেন? “

“ কি জিনিস? “

“ মৃত্যুর পর নাকি ৭ মিনিট পর্যন্ত একটা মানুষের ব্রেইন সেল সচল থাকে। “

“ সিরিয়াসলি? আমার জানা ছিলো না। মেডিক্যালের ব্যাপারে আমার ধারণা কম। “

“ আমারও জানা ছিলো না। জাস্ট নিউজফিডটা স্ক্রল করার সময় একটা আর্টিকেল সামনে আসে। ওইট পড়ে জানতে পেরেছি। “

“ ওহো। বাই দ্যা ওয়ে, ওই ৭ মিনিট ব্রেইন সেলটা ঠিক কি কাজ করে? নাকি নাম্ব হয়ে যায়? “

“ উঁহু। নাম্ব হয় না। আমি পড়েছি ওই ৭ মিনিট নাকি ব্রেইন সেল জীবনের সব সুন্দর স্মৃতিগুলোকে ফ্ল্যাশব্যাক মেমোরির মতো প্লে করে। “

“ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো! “

নিশা এবার নিবিড় স্বরে বলে,

“ এই স্টেটমেন্টের সত্যতা কতদূর আমার জানা নেই। কিন্তু স্টেটমেন্টটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আপনি আমার জীবনের সেই ৭ মিনিট হবেন বলে আমি মনে করি। “

নিশার সোজাসাপ্টা কথার পিঠে স্তব্ধ বনে যায় সাইফ। পরমুহূর্তে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে তীর্যক হাসি। প্রেমে কাবু প্রেমিকার আবেগ মিশ্রিত বোকা ও অদ্ভুৎ সব কথাবার্তা তাকেও কাবু করে ফেলে।

__________

কত দিন-ই বা হলো সাদাতের মৃত্যুর? একটা মাসও এখনো পেরোয় নি। অথচ অমানুষ গুলো ইতিমধ্যে সাদাতের পরিবারের পিছনে হাত ধুয়ে পড়েছে। বুঝে নিতে চাইছে জায়গা জমির ভাগ। সদ্য ছেলে হারানো সাদাতের মা এই পরিস্থিতিতে নেই যে এসব জমির ঝামেলা নিয়ে বোঝাপড়া করবেন। উনার কাছে এই মুহুর্তে পুরো পৃথিবীটা থেকেও যেনো নেই। আর সায়রা? সে-তো হাত পায়ে লম্বা হলেও বয়স এবং মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে এখনো যথেষ্ট ছোট। তাই পরিবারের দিকে তেড়ে আসা কঠিন এই সমস্যার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সাওদা। দায়িত্বটা তো এখন তারই। ভাইয়া তো তাকেই বলে গিয়েছে যে মা আর সায়রার খেয়াল রাখতে। সে-ই কথা ফেলার সাধ্য কি সাওদার আছে?

কিন্তু দুটো দিনেই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে যেনো সে। প্রতিদিন এরকম অনেক বিষয়ের সাক্ষী হচ্ছে সে যা সম্পর্কে এতদিন তার কোনো ধারণাই ছিলো না। ভাইয়াটা কি মানুষ ছিলো নাকি অন্য কিছু? এতো জোট ঝামেলা সে সামলাতো, অথচ বাসায় কাউকে কখনো টেরও পেতে দিতো না। কিভাবে পারতো এতো নিখুঁত ভালো থাকার অভিনয় করতে?

আজকের তিক্ত দিনটার সূচনা হয়েছে সাওদার এক চাচীর আগমনের মাধ্যমে। প্রথম বিশ মিনিট মহিলা দু চারটে শান্তনা বাক্য আওড়ালেও ধীরে ধীরে উনি নিজের কথার মোড় ঘুরান। সাওদার মায়ের কানে তুলে দেয় সাওদার জন্য এক প্রস্তাবের কথা। ভালো মানুষীর সুর টেনে বুঝাতে থাকেন সাওদার বিয়েটা দিলে ঠিক কি কি উপকারিতা পাবেন তারা। মাথার উপর বাপ ভাইয়ের ছায়াহীন একটা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অন্য ঘরে তুলে দেওয়া কতটা কঠিন সেই সম্পর্কেও ধারণা দেন তিনি।

পাশের রুম হতে চাচীর সুর টেনে বলা কথাগুলো সাওদা শুনতে পায়। মেয়ে যেহেতু হয়েছে সেহেতু ঘরে বিয়ের প্রস্তাব আসতেই পারে। কিন্তু সাওদার সমস্যাটা হলো চাচীর নিয়ত আর প্রস্তাব রাখা পাত্রকে নিয়ে। প্রথমত সে ভালো করেই জানে, এসব জমিজমার ব্যাপারে সে অমানুষ গুলোর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই বিয়ের মাধ্যমে তাকে দ্রুত দূর করতে চাইছে তার চাচী এবং চাচাতো ভাইরা। আর দ্বিতীয়ত যেই পাত্রর প্রস্তাব নিয়ে ভদ্রমহিলা হাজির হয়েছে সেই পাত্র আর কেউ-ই নয় বরং তারই এক চাচাতো ভাই। কিঞ্চিৎ পরিমাণ সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার অন্যতম মাধ্যম।

সবটা শুনে সাওদা চুপ থাকতে পারে না। শরীরে বহমান ফুটন্ত গরম রক্ত নিয়ে পাশের রুমে এসে উপস্থিত হয়ে সোজাসাপ্টা বলে উঠে,

“ আমাকে নিয়ে এতো ভাবার জন্য ধন্যবাদ চাচী আম্মা। কিন্তু আমি এখন বিয়ে করতে আগ্রহী নই। সুতরাং আমার জন্য ভাবাভাবির কাজটা আপনার আর করতে হবে না। “

ধিংড়ি মেয়ের কাটকাট জবাবে পান চিবুতে ব্যস্ত মহিলার গায়ে ফোস্কা পড়ে। তিনি জ্বলে উঠে বলেন,

“ কি দিনকাল আসলো রে বাবা! মাইনষের ভালা চাইলেও দোষ। এ লো ছেড়ি, আমার পোলার জন্য তোর প্রস্তাব আইছে এইডা তো তোর সাত কপালের ভাগ্য। শুকরিয়া আদায় না কইরা চটাং চটাং জবাব দেস। কিয়ের এতো অহংকার তোর? “

সাওদা ফুসে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে স্পষ্ট গলায় বলে,

“ আপনার ছোটলোক ছেলের প্রস্তাবে শুকরিয়া জানানোর মতো কিছুই আমি খুঁজে পাই নি চাচী আম্মা। সবটা আপনাদের সাজানো ফাঁদ। বিয়েকে পুঁজি করে আমার বাপ ভাইয়ের ভাগের জমিটুকু হাতিয়ে নিতে চাচ্ছেন। আমার ভাই বেঁচে থাকতেও যেমন পারেন নি, আমি বেঁচে থাকতেও পারবেন না। তাই বৃথা চেষ্টা বন্ধ করুন। “

সাপের মতো ফোসফাস করতে করতে এইবার সেই মহিলা গর্জে উঠে,

“ সাদাতের মা। এমন কুলাঙ্গার এক একটা পেটে ধরসো নি তুমি? বুঝতে পারসি তো কার ভাষায় কথা কইতাসে তোমার মাইয়ারা। ভাইয়ে এসব শিখায় দিয়া গেসে তাই না? উপরে উপরে সাধু সাইজ্জা, তলে তলে ভাইয়ে এসব গুটি পাকাইসে। “

সাদাতের মা কিছু বলতে নিবে তার আগেই সাওদা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। মাত্রারিক্ত রাগ সামলাতে না পেরে হাতের কাছে থাকা রিমোটটা মহিলার কপাল বরাবর ছুড়ে মারে। তেড়ে এসে বলে,

“ আমার ভাইয়ের নাম মুখে নিলে জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো। “

সাওদার মা এগিয়ে এসে দ্রুত মেয়েকে থামানোর চেষ্টা করেন। ওদিকে চাচী নিজের কপাল চেপে ধরে অস্রব্য ভাষায় গালাগাজ এবং অভিশাপ বাক্য ছুড়তে ছুড়তে বেরিয়ে যান। সাওদাকে দমানো মুশকিল হয়ে পড়ছিলো। অতিরিক্ত মানসিক চাপ তাকে উগ্র ও হিংস্র করে তুলেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো একশো জ্বিনের শক্তি তার উপর ভর করেছে।

সাদাতের মা’র ধৈর্য্য শক্তি বাঁধ মানে। রাগে তিনি মেয়ের গালে এলোপাথাড়ি দু চারটে চড় দিয়ে বলে,

“ এই শিক্ষা দিসি তোরে আমি? এই শিক্ষা দিসি? বড়দের গায়ে হাত তুলোস তুই? তুই যে-ই মহিলার গায়ে হাত তুলসোস ওই মহিলা এখন সবাইরে বইলা বেড়াইবো আমি আমার পোলাপাইনরে কোনো শিক্ষা দেই নাই। এইডাই চাইতি তুই? আর ওই মহিলারে তুই চিনোস? সরাসরি কুফরি কালামের সাথে জড়িত। অপমানের ঝাল মিটাইতে ওই মহিলা এখন কালোজাদু করাইলে? বাঁচবি তুই? বল বাঁচবি? “

দরজার আড়ালে দাঁড়ানো সায়রা তখন ভয়ে কাঁদছিলো। সাওদা আর এক দন্ড অপেক্ষা করে না। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। গায়ে জড়ানো ওড়নাটা মাথায় টেনে দিক বেদিক ভুলে দৌড়ানো শুরু করে সে। সব অসহ্যকর লাগছে তার।

সাওদার পা জোড়া গিয়ে থামে বাউন্ডারি তোলা একটা জমির বাহিরে। জমিটা তাদেরই। বাউন্ডারির ভেতর এই জমিতেই সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে তার বাবা আর ভাইয়ের লাশ শায়িত অবস্থায় আছে। এই জমিটার দখল নেওয়ার জন্যই অমানুষ গুলো ওঁৎ পেতে আছে। সাওদা নিশ্চিত কোনো মতে ওরা এই জমির ভাগ পেলে তার বাবা আর ভাইয়ার শেষ ঠিকানাটুকুরও আর অস্তিত্ব থাকবে না।

সাওদা একবার ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও শেষমেশ আর ভেতরে যায় না। তার মা বলে কবরস্থানে মেয়ে মানুষের না যাওয়াই ভালো। কতগুলো ইটের স্তুপের উপর হাঁটু ভাজ করে বসে পড়ে সাওদা। জীবনের ঠিক এই মুহুর্তে একটা বুঝদার কাধের অভাব খুব পোড়াচ্ছে তাকে। বাবা চলে যাওয়ার পর ভাইয়ার কাধে মাথা রেখে অনায়াসে কাদতে পেরেছিলো ও। কিন্তু আজ যখন খুব কান্না পাচ্ছে তখন ভরসা করার মতো কোনো কাধ নেই তার কাছে। অপ্রতিরোধ্য ভাবটা চিড়ে বুকে জমে থাকা কান্না গুলো বেরিয়ে আসে। সাওদা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠে। কান্নার দমকে তার সম্পূর্ণ শরীর কাপছে। কেবলমাত্র বন্ধুর কবর জিয়ারত সেড়ে বাউন্ডারির টিনের দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে আসা যুবকের চোখে পড়ে সে-ই দৃশ্য। সে আপন জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে। উদাস নয়নে দেখে দৃশ্যটা।

দুটো দিন বন্ধ পাওয়ায় সে বন্ধুর কবরটা একবার জিয়ারত করতে এসেছিলো। এখানে আসার পূর্বে রিদওয়ানের কবরটাও জিয়ারত করে, তার পরিবারের সাথে দেখা করে এসেছে সে। ইচ্ছা ছিলো এখান থেকে সাদাতের বাসায় গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গেও দেখা করবে। কিন্তু এই মুহুর্তে কেনো জানি আর মন সায় দিচ্ছে না তার। সে যেভাবে নীরবে এসেছিলো, ঠিক সেভাবেই নীরবে বিপরীত রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করে। সাওদা টেরও পেলো না তা।

__________

এই যাত্রায় শান্তিকুঞ্জে আজ শেষ দিন বাণীর। আগামীকাল তারা চট্টগ্রামএ ফিরে যাবে। পাঁচ দিনের প্ল্যান করে আসলেও আফরার অসুস্থতার জন্য দুটো দিন বেশি ঢাকায় থাকা হয়েছে তাদের। ওদিকে দূর্জয়ের ছুটির আর কেবল আটটা দিন বাকি।

রাতের খাবার সেড়ে সুহালা বেগমের সঙ্গে উনার রুমে এসে হাজির হয়েছে বাণী। সুহালা বেগম বলেছিলেন বাণীকে কিছু পুরনো ফোটো এলবাম দেখাবেন। সেগুলো নিয়েই বসেছে দু’জন। এলবামের শুরুতেই দূর্জয়ের দাদা দাদীর কিছু ছবি দেখিয়ে তাদের সম্পর্কে কিছুক্ষণ গল্প করেন সুহালা। বাণী আগ্রহ নিয়ে শুনে তা। ধীরে ধীরে এলবামের পাতা উল্টোতেই সুহালা এবং রিফাতির বেশ কিছু ছবি সামনে আসে। দূর্জয়ের বাবার ছবি দেখে কিছুটা অবাক হয় বাণী। দূর্জয় অনেকটাই শাহরিয়ার রিফাতির মতোই দেখতে হয়েছে। সুহালা বেগম তখন নিজের আর স্বামীর ব্যাপারে আলাপ করছিলো। হঠাৎ বাণী আগ্রহবশত প্রশ্ন করে বসে,

“ বাবা কিভাবে মারা গিয়েছিলেন মা? “

আকস্মিক প্রশ্নটা করে বাণী নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মনে হয় যেনো ভুল কিছু জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। তবে সুহালা বেগম অত্যন্ত সাবলীল ভাবে বলেন,

“ দূর্জয়ের ও লেভেল এক্সামের আগের দিকের ঘটনা। আমরা তখন সিলেটে ছিলাম। ওর বাবা তখন সীমানা অঞ্চলে মিশনে ছিলো। হঠাৎ একদিন খবর আসে ওর বাবা নাকি নিখোঁজ। দুটো ছেলে নিয়ে ওই শহরটায় একা ছিলাম আমি। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। নামাজে বসে দোয়া করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিলো না আমার কাছে। তিনটা বিভসৎকর দিন পাড় করার পর আমাদের কাছে খবর আসে হি ইজ নো মোর। উনার কারণেই মূলত আমরা সিলেটে শিফট করেছিলাম। যেহেতু উনিই আর ছিলো না তাই দূর্জয়ের পরীক্ষা শেষ হতেই আমি দুই ছেলেকে নিয়ে এই বাড়িতে শাশুড়ীর কাছে ফিরে আসি। “

বাণীর মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে যায়। সে বিষণ্ণ নয়নে দেখতে থাকে সুহালা বেগমকে। কেউ যদি বাণীকে কখনো তার প্রিয় ব্যক্তিত্বের তালিকা বলতে বলে, তবে সেই তালিকায় সুহালা বেগমের নামও থাকবে। হঠাৎ কি ভেবে যেনো বাণী ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে। জানতে চায়,

“ বাবার মৃত্যুর খবর আপনারা কত তারিখে পেয়েছিলেন মা? “

সুহালা বেগম জবাবে নির্দিষ্ট তারিখটা বলতেই বাণী কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করে। মুহুর্তেই সে বিস্মিত হয়। সুহালা বেগমের বলা তারিখের দু’দিন পূর্বেই তাদের র‍্যাগ ডে ছিলো। সেই দিনটা, যেদিন বাণী দূর্জয়ের সামনে ওই ইম্যাচিওর আচরণটা করেছিলো। ওই রকম ভয়ংকর একটা পরিস্থিতিতে বাণীর কর্মকান্ডে দূর্জয়ের ওরকম রিয়েক্ট করার কারণটাও এবার বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে বাণী। লজ্জায় মরে যেতে মন চাচ্ছে বাণীর। যেই ছেলের বাবা কি-না তিনটা দিন ধরে নিখোঁজ ছিলো, বেঁচে আছে নাকি সেই খবরটুকুও তার অজানা, সেই ছেলের কাছে বাণীর ওই আচরণটা ঠিক কতটা বিরক্তিকর লাগতে পারে তা কিছুটা হলেও বাণী আঁচ করতে পারছে। লজ্জায় সে আর একটা কথাও বলে না।

সুহালা বেগম পেজ উল্টে তখনো নিজের মতো গল্প করে যাচ্ছেন। এলবামের পাতায় একটা ছবি দেখে থামেন তিনি। ছবিটা দূর্জয়ের বিএমএতে থাকা কালীন। ছবিতে দূর্জয়ের পাশে আরো দু’জন যুবককে দেখা যাচ্ছে। সুহালা বেগম হেসে বলেন,

“ এটা দূর্জয়ের বিএমএ ট্রেনিংয়ের সময়ের ছবি। সঙ্গে যে-ই দু’জনকে দেখছো না? ওরা দূর্জয়ের একমাত্র কাছের বন্ধু। বাম পাশের ছেলেটার নাম নিভ্রান আর ডান পাশের জন সায়র। “

সুহালা বেগম আরো কিছু বলতে নেন। তবে তার আগেই মৌটুসী এসে উপস্থিত হয় রুমে। বলে,

“ খালাম্মা। ভাইজান আপনারে আর ভাবীরে ছাদে যাইতে কইসে। “

সুহালা অবাক হয়ে বলেন,

“ এই রাতের বেলা? “

“ আমি তো জানি না খালাম্মা। আমারে খালি কইসে আপনাদের ডাইককা দিতে। “

বাণী প্রশ্ন করে,

“ আফরা কোথায় মৌটুসী? “

“ বহ্নি থুক্কু আফরাও ভাইজানের লগে উপরে আছে। “

সুহালা বেগম সামান্য রাগ হয়। এই রাতের বেলায় বাচ্চাটাকে নিয়ে ছাদে যাওয়ার মানে কি? কি ঠান্ডা পড়েছে বাহিরে! তার উপর মেয়ে বাচ্চাদের একটু নিয়ম কানুন মেনে চলা উচিত। ছাদ থেকে বাড়ির পিছনের পুকুর দেখা যায়। পুরো বাড়িতে কেবল ওই জায়গাটা সুহালা বেগমের খুব একটা পছন্দ নয়। মনে মনে ঠিক করেন দূর্জয়কে আলাদা করে ডেকে দুটো কড়া করে কথা শোনাবেন। মেয়ের বাপ হলে মেয়ের ভালো মন্দ সম্পর্কে সচেতনও হওয়া প্রয়োজন।

__________

গায়ে শীতের কাপড় জড়িয়ে ছাদে এসে উপস্থিত হতেই বাণী ও সুহালা বেগম দেখে ছাদের একপাশে পাটি এবং তার উপর চাদর বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করেছে দূর্জয়। রয়েছে বেশ কিছু কুশনও। তার থেকে কিছুটা দূরেই বারবিকিউ চুলোর সেটাপ করা হয়েছে। কয়লা পুড়ে সেখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। দূর্জয় সেই চুলোয় মুরগীর লেগ পিস গুলোতে ম্যারিনেটেড মশলা ব্রাশ করতে ব্যস্ত। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আফরা বেশ আগ্রহ নিয়ে একটা ছোট হাত পাখার সাহায্যে মৃদু বাতাস করছে।

সুহালা বেগম এগিয়ে গিয়ে অবাক গলায় বলে,

“ বারবিকিউর আয়োজন কখন করলে তুমি? আমি জানি না কেনো? “

আফরা দাঁত বের করে বলে,

“ সারপ্রাইজ! “

বাণী অবাক গলায় বলে,

“ ডোন্ট টেল মি এটা তোমাদের দু’জনের প্ল্যান ছিলো, আর আমাকে আর মা’কে এই ব্যাপারে কিছুই জানাও নি। “

দূর্জয় সামান্য হেসে বলে,

“ আমাদের ইনটেনশন শুধু তোমাদের সারপ্রাইজ দেওয়াই ছিলো। “

বাণী আফরার দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে বলে,

“ কি বাচ্চা? এতো তাড়াতাড়ি তুমি সাইড বদলে ফেললে? মাম্মাকে রেখে এখন বাবার সাথে সিক্রেট প্ল্যান করো তুমি, হ্যাঁ? “

দূর্জয় বলে,

“ সাইড তো মামণি চেঞ্জ করেছে। আমাকে রেখে তোমার সাথে বেশি আড্ডা চলে আজকাল। তোমাদের বেলায় দোষ নেই, আমাদের বেলায়ই সব দোষ? “

দূর্জয়ের স্বভাব বহির্ভূত কথার ধরনে বাণী বেশ মজা পায়। হেসে বলে,

“ আর ইউ জেলাস শাহরিয়ার দূর্জয়? “

“ নো আ’ম নট বাণী তালুকদার। “

সুহালা বেগম মুগ্ধ চোখে দেখে দৃশ্যটা। বিয়ের জন্য হ্যাঁ বললেও উনার মনে একটা খচখচানি ছিলো। এরকম একটা স্বাভাবিক আর সাবলীল সম্পর্ক আদৌ দুজনের মধ্যে তৈরী হবে কি-না তা নিয়ে বেশ দ্বিধা ছিলো উনার মনে। কিন্তু এই দৃশ্যটা উনার সেই দ্বিধা দূর করে দিয়েছেন। ছেলে মেয়ে দুটো নিজেদের মধ্যে সুখী থাকলেই উনি খুশি। ভালো থাকার জন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই তার।

প্রথম ব্যাচের চিকেন পিস গুলো হয়ে যেতেই দূর্জয় তা সার্ভ করে দেয় তিনজনের প্লেটে। নিজের আর মৌটুসী ও নোমান ভাইয়ের জন্য দ্বিতীয় ব্যাচে কিছু চিকেন পিস চুলার উপর দিয়ে সে এসে বাণীদের সামনে বসে। নিজ থেকে আগ্রহী গলায় বলে,

“ ম্যাডামদের জন্য কি এখন গান গেতে পারি? “

বাণী এবং সুহালা বেগম অবাক হয় দূর্জয়ের কথা শুনে। এই চাপা স্বভাবের ছেলেটা নিজ থেকে সেধে গান গেতে চাইছে? ব্যাপারটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? তাদের বিস্ময়তাকে পাশ কাটিয়ে আফরা প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ ইয়েস বাবা। বাট ডোন্ট সিং বেবি শার্ক। আই হেইট দ্যাট সং, সো চাইল্ডিশ। “

দূর্জয় হেসে মাথা নাড়ে। তার চোখ গিয়ে পড়ে ছাদের এক কোণে চিলেকোঠার ঘরটার দরজার সামনে। হঠাৎ মনে হয় দরজার সামনে কিশোর বয়সের দীপ্ত দাঁড়ানো। আফরার মাঝে নিজের চঞ্চলতার ছাপ দেখে হাসি হাসি মুখ করে বড়ো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাইয়ের অবয়ব কল্পনা করে দূর্জয়ের ঠোঁটের কোণেও মৃদু হাসি ফুটে উঠে। সে হেসে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে বসে থাকা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটা মানুষের পানে স্থির করে। খালি গলায় সনু নিগামের গাওয়া প্রিয় একটা গানের শেষ চরণ গুলো গায়,

“ হো ডোর সে টুটি পাতাঙ্গ জেসে
থি ইয়ে জিন্দেগানি মেরি,
আজ হো কাল হো মেরা না হো
হার দিন থি কাহানি মেরি,
এক বান্ধান নায়া পিছে সে
আব মুঝকো বুলায়ে,
আনে ওয়ালে কাল কে কিউ
ফিকার মুঝকো সাতা যায়ে।
এক এসি চুভান
ইস লামহে মে হে
ইয়ে লামহা কাহা থা মেরা?
আব হে সামনে
ইসে ছু লু যারা,
মার যাউ ইয়া জি লু যারা?
খুশিয়া চুম লু
ইয়া রো লু যারা,
মার যাউ ইয়া জি লু যারা?

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭৩.

সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে বসতেই জুলফিকার মুজতবা পাশের চেয়ারে বসা মেয়েকে আড়চোখে পরখ করেন। বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছে বলে মনে হচ্ছে নিশাকে। জুলফিকার মুজতবা নাস্তা করতে করতে মেয়ের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মৃদু হাসি এবং মুখের ভঙ্গিও লক্ষ্য করেন। অত:পর বেশ সাবলীল গলায় প্রশ্ন করে বসে,

“ ছেলেটা কে? “

আকস্মিক প্রশ্নে মুখে অরেঞ্জ জ্যাম মাখা পাউরুটি মুখে পুরে রাখা নিশার গলায় খাবার আটকায়। শুকনো গলায় খাবার আটকে যাওয়ার ফলে তার কাশির ভারিক্কি উঠে। জুলফিকার মুজতবা বিচলিত হয় না। বরং পানিতে ভরপুর গ্লাসটা মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করে যেনো পানিটুকু খায়। ভীত নিশা কোনো রকম পানি পান করে নিজের আব্বুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কোন ছেলের কথা বলছো আব্বু? “

“ যার সঙ্গে প্রতি রাতে কলে কথা বলো। “

চুরি করতে গিয়ে চোর ধরা পড়লে মুখভঙ্গি যেরকম হয় নিশার মুখখানাও তখন একই রকম দেখাচ্ছিলো। আব্বু কিভাবে টের পেলো? নিশা তো অত্যন্ত আস্তে এবং ফিসফিসিয়ে কথা বলে। আব্বুর তো টের পাওয়ার কথা নয়! নিশা গলা কিছুটা ভিজিয়ে এলোমেলো উত্তর সাজিয়ে বলতে নেয়,

“ আব্বু আমি আসলে… “

“ ইউ আর এ ব্যাড লায়ার নিশা। তাই অযথা মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না। আমি চাইলেই দু’দিন তোমাকে ফলো আপে রেখে ছেলেটার পরিচয় জানতে পারতাম। কিন্তু আমি তোমার মুখে সত্যিটা জানতে চাইছি। আশা করছি আমার থেকে কিছু লুকাবে না তুমি। “

নিশা জানে আর লুকানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই। তাই সে বলে,

“ আব্বু, আমি তোমার থেকে কিছু লুকাতাম না। ট্রাস্ট মি। আমরা সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার এডমিশন এক্সামের ঝামেলাটা শেষ হলেই ভেবে রেখেছিলাম তোমাকে সব জানাবো। “

জুলফিকার মুজতবা ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ মেয়েকে দেখে প্রশ্ন করে,

“ ছেলে কি চট্টগ্রাম শহরেই থাকে? “

“ জি। “

“ সম্পর্কটা কতদিনের? “

নিশা মাথা নিচু করে ইতস্তত গলায় জবাব দেয়,

“ কিছু মাসের। “

জুলফিকার মুজতবা এবার নাস্তায় মনযোগ পেশ করে বলে,

“ নাস্তা সেরে ছেলেটাকে কল দিবে। জানাবে আমি দেখা করতে চাই। আজ, এই মুহুর্তেই। যদি বুকে সাহস নিয়ে আমার মুখোমুখি হতে পারে তাহলে বিবেচনা করে দেখবো। আর যদি বুকে সৎ সাহস নিয়ে আমাকে ফেস করতে না পারে তাহলে বলে দিবে আর কখনো যেনো মুখ তুলে আমার সামনে না আসে। দ্যা এন্ড বলে এই চ্যাপ্টার ক্লোজ করবে। “

আব্বুর কথার পিঠে নিশা কিংকর্তব্যবিমুঢ় বনে যায়। জুলফিকার মুজতবাকে বলার মতো একটাও কথা খুঁজে পেলো না সে। বাকিটুকু নাস্তা নীরবে খেতে খেতে মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করে। তার আরেকটু সাবধান হওয়া উচিত ছিলো। সাইফ কি আসতে রাজি হবে? আর সাইফকে দেখে আব্বুরই বা রিয়েকশন কেমন হবে? আব্বু যদি বাংলা সিনেমার চৌধুরী সাহেবের মতো আচরণ করে? উফফ! আর ভাবতে পারছে না নিশা। মাথা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে তার।

নাস্তা সেরেই রুমে ফিরে নিশা দ্রুত সাইফের নাম্বার ডায়াল করে। প্রথম দু’বার কল হলেও সাইফ রিসিভ করে না। নিশা অস্থির হয়ে উঠে। তৃতীয় বার কল করতেই এবার কলটা রিসিভ হয়। সাইফ বলে উঠে,

“ আমি ওয়াশরুমে ছিলাম… “

“ সাইফ আপনাকে এই মুহুর্তে বাসায় আসতে হবে। আর্জেন্ট। দ্রুত আসুন। “

নিশার অস্থির স্বর শুনে সাইফ চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে ইয়াসমিন? এভ্রিথিং অলরাইট? আপনি ঠিক আছেন? “

“ আব্বু জেনে গিয়েছে সাইফ। উনি জানেন আমার কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে। আপনার নাম যদিও এখনো জানে না। তবে বলেছে এই মুহুর্তে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনি আসলে উনি বাকিটা বিবেচনা করবেন আর নাহলে চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিতে বলেছেন। আপনি আসবেন না সাইফ? এই মুহুর্তে আসতে পারবেন? “

সবটা শুনে সাইফ শান্ত হলো। নিশ্চিন্ত গলায় বলে,

“ আরে বাহ! শশুর আব্বা একদম আমার কার্বন কপি। হেব্বি চালু। যদিও আমার মেয়ে প্রেমে পড়লে আমি প্রথম দেখাতেই বুঝে যেতাম। এই দিক দিয়ে আমি শশুর আব্বার থেকে আগায় থাকবো। “

সাইফের গা ছাড়া কথায় নিশা রাগ হয়। গরম গলায় বলে,

“ সবসময় ফাইজলামি ভালো লাগে না সাইফ। আমার এদিকে জান যায় অবস্থা। আর আপনি মজা নিচ্ছেন? “

“ প্রথম কথা হচ্ছে আপনি একটু ঠান্ডা হোন। এতো ভয় পেলে চলে? তামজিদ সাইফ যেই মেয়ের প্রেমিক সেই মেয়ে হবে নির্ভীক। এমন ছেলে হাজার বছরে একবার পৃথিবীতে আসে। সাধনা করে মেয়েরা এমন প্রেমিক চায়। গিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে চিল করুন। আমি আসছি। আর শুনুন। পারলে শশুর আব্বাকে একটু পর পর ঠান্ডা পানি খাওয়ান। ইউ নো? মাথা ঠান্ডা থাকবে তাহলে। “

__________

সাইফ এসে পৌঁছালো ঠিক এক ঘন্টা পর। জুলফিকার মুজতবা তখন লিভিং রুমে বসে ফোনে জরুরী আলাপে ব্যস্ত ছিলো। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে নিশা গুটিগুটি পায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। লিভিং রুমের সামনে এসে একবার জুলফিকার মুজতবার দিকে তাকায় অনুমতির আশায়। জুলফিকার মুজতবা ফোনে কথা বলা অবস্থায়ই চোখের ইশারায় বলে দরজা খুলতে। নিশা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যায়। দরজা খুলতেই দেখে সাইফ দাঁড়িয়ে আছে। দু হাত ভর্তি হাবিজাবি প্যাকেট। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মিষ্টির প্যাকেট।

নিশার হাতে প্যাকেট গুলো ধরিয়ে দিয়ে সাইফ ধীরে সুস্থে ঘরে প্রবেশ করে। হাতের কিছুটা বামে ঘুরে এগিয়ে যেতেই লিভিং রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। জুলফিকার মুজতবা কথা বলতে বলতে আনমনে সামনে তাকাতেই খানিকটা চমকে যায়। মুহুর্তেই নিজের বিস্ময়তা চেপে গিয়ে স্বাভাবিক সাজার চেষ্টা করে। মনে তখনো উনার অবিশ্বাস কাজ করছে। সাইফ আর নিশার যোগসূত্র কোনো ভাবেই মেলাতে পারছেন না।

জুলফিকার মুজতবা কথা শেষ করে ফোনটা রেখে সাইফের দিকে তাকায়। সাইফ সৌজন্যমূলক হেসে বলে,

“ আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি তামজিদ সাইফ। মিস ইয়াসমিনের প্রেমিক এবং আপনি চাইলে আপনার ভবিষ্যৎ জামাতা আরকি। “

সাইফের অদ্ভুৎ পরিচয় পর্বে জুলফিকার অবাক হয় না। এই ছেলেটাকে উনি যতদূর চিনে সেই হিসেবে এরকম অদ্ভুৎ কথা সাইফের সঙ্গে মানানসই। তিনি গম্ভীর স্বরে বলে,

“ হ্যাভ এ সিট। “

সাইফ ধন্যবাদ বলে জুলফিকারের মুখোমুখি একটা সোফায় এসে ভদ্র ছেলের মতো বসে। নিশা ভীত ভঙ্গিতে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। জুলফিকার মুজতবা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ মেহমান এসেছে আম্মু। রান্নাঘরে যাও। নাস্তা পানির ব্যবস্থা করো। “

নিশা যাওয়ার আগে কেবল নিচু গলায় সাইফকে প্রশ্ন করে,

“ আপনার চায়ে চিনি কয় চামচ দিবো? “

সাইফ স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ আপনার যা ভালো মনে হয় ইয়াসমিন। “

জুলফিকার মুজতবা লক্ষ্য করে সাইফের নিশাকে আপনি বলে সম্বোধন করাটা। নিশা চলে যেতেই জুলফিকার বলে,

“ আমার মেয়ের পক্ষে তো প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া সম্ভব নয়। তারমানে প্রস্তাবটা নিশ্চয়ই তোমার পক্ষ থেকে ছিলো? “

“ জি স্যার। “

“ এসব প্রেম ভালোবাসার চিন্তাও আমার মেয়ের মাথায় আসার কথা নয়। তারমানে এসব নিশ্চয়ই তুমি ওর ব্রেইনে ইনপুট করেছো? “

সাইফ হাসে সামান্য। তারপর বলে,

“ ইয়াসমিন অত্যন্ত সরল স্যার। কথাটা আমরা দু’জনই জানি। কিন্তু তাই বলে উনার ব্রেইনওয়াশ করি নি আমি। আমি শুধু নিজের মনের কথা জানিয়েছিলাম। প্রস্তাব গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ উনার উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। উনি নিজ থেকে আমাকে নিজের উত্তর জানিয়েছেন। জানিয়েছেন যে আমাদের ফিলিংস মিচুয়্যাল। “

জুলফিকার নীরব থেকে প্রশ্ন করে,

“ নিশাকে নিয়ে তোমার প্ল্যান কি? “

“ প্রমোশনের অপেক্ষায় আছি স্যার। আল্লাহর ইচ্ছা এবং আপনার সম্মতিরও অপেক্ষা করছি। তারপর ইয়াসমিনকে বউ বানিয়ে আমাদের বাসায় নিয়ে যাওয়াটাই আমার প্ল্যান। “

সাইফের সোজাসাপ্টা কথায় বারবার নিজের সাজানো প্রশ্ন ভুলে বসছেন জুলফিকার সাহেব। ছেলেটা খুব স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। জুলফিকার মুজতবা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট টের পাচ্ছেন ছেলে মোটেও মিথ্যা বলছে না। তার অকপটে কথার মাঝে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। তবুও জুলফিকার মুজতবা বলে,

“ বিয়ে করা মানে শুধু কবুল বলা না। দায়িত্ব নিতে জানাটাও গুরুত্বপূর্ণ। ওর দায়িত্ব নিতে পারবে তুমি? সেরকম প্রস্তুতি আছে? “

“ জি স্যার। আর্মিতে কাজ করার দরুণ বউকে নিয়ে কোয়াটারে থাকার সুযোগ আছে যদিও। কিন্তু আমার ইচ্ছা আমাদের নিজেদের একটা বাসা হবে। জানেনই তো আমার কখনো নিজের বাসা ছিলো না। হোস্টেল, মেস এসবে থেকেই বড়ো হয়েছি। আর তাছাড়া ঘর তো পরিবার দিয়েই হয়। আগে পরিবার ছিলো না তাই ঘরও ছিলো না। তবে আমার একাউন্টে ভালো একটা এমাউন্ট জমা পড়ে আছে। আর প্রায় এক বছর চাকরিটা কন্টিনিউ করলেই কাঙ্ক্ষিত এমাউন্টটা পূরণ হবে। তারপর একটা এপার্টমেন্টে ইউনিট কেনার ইচ্ছা আছে। চট্টগ্রাম শহরেই কিনবো ইনশাআল্লাহ। ইয়াসমিনও এই শহরটাকেই বেশি ভালোবাসে। বাকি দায়িত্বও ইনশাআল্লাহ সামলে নিবো। ইয়াসমিনকে নিয়ে কখনো অভিযোগের সুযোগ দিবো না আপনাকে। “

জুলফিকার মুজতবার প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক দেখা গেলো। মেয়ের প্রেমিক বলেই বিন্দুমাত্র ছোট করে কিংবা অদ্ভুৎ কথা বলে সাইফকে বিভ্রান্ত করলো না। বরং চুপচাপ সাইফকে দেখছেন তিনি। সাইফ নিজ থেকেই আবার বলে উঠে,

“ ফ্যামিলির মর্ম আমি আর ইয়াসমিন দু’জনেই ভালো করে বুঝি স্যার। আমাদের দুজনের ইন্টেনশন আর ইচ্ছে পানির মতো স্বচ্ছ। ব্রোকেন ফ্যামিলি থেকে বিলং করার কারণে ইয়াসমিন মারাত্মক বিষন্নতায় ভুগে। আমি নিজের সঙ্গে উনার ফ্যামিলিটাও পূরণ করতে চাইছি। প্রত্যেক ঈদে কিংবা বিশেষ দিনে উনার মনে একটা দ্বিধা কাজ করে, যে আম্মুর সঙ্গে আজকের দিনটা থাকবে নাকি আব্বুর সাথে। আমি চাইনা উনি সেরকম কোনো দ্বিধা নিয়ে বিশেষ দিনগুলো অপূর্ণতার অনুভূতি কাটাক। আমাদের বিয়ের পর প্রত্যেকটা বিশেষ দিনে উনার আব্বু কিংবা আম্মুর মাঝে একজন বেছে নিতে হবে না। বরং আপনারাই নাহয় তখন নিজেদের মেয়ের খুশিটাকে বেছে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবেন। আমার আর কিছু বলার নেই স্যার। বাকিটা আপনার এবং ম্যাডামের সিদ্ধান্ত। আপনারা মেয়ের প্যারেন্টস। আপনাদের সম্পূর্ণ রাইট আছে উনার ভালো মন্দের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। “

জুলফিকার মুজতবা আর কিছু বলার পূর্বেই নিশা ট্রে হাতে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে। ট্রে টা টি টেবিলে রাখতে রাখতে সে পরিস্থিতি আন্দাজের জন্য একবার নিজের আব্বুর দিকে তাকায়। জুলফিকার মুজতবার ফোনটা বেজে উঠায় উনি ফোনটা সবে হাতে নিয়েছেন। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক না গম্ভীর তা ঠাওর করতে হিমশিম খাচ্ছে নিশা। সে আড়চোখে এবার সাইফের পানে তাকায়। সাইফ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। নিশাকে তাকাতে দেখেই সে হেসে চোখ টিপে। নিশা ভীমড়ি খায়। ডর ভয় নেই নাকি লোকটার? যার কাছে মেয়ে চাইতে এসেছে তার সামনে বসেই তার মেয়েকে চোখ টিপ মারছে! কি দুঃসাহসিক!

__________

গত দুপুরে পরিবার সমেত চট্টগ্রামে ফিরেছে দূর্জয়। সঙ্গে এসেছেন সুহালা বেগমও। যদিও সুহালা বেগমের আসার কথা ছিলো না। তবে উনার আসার পিছনে একটা বিশেষ কারণও রয়েছে। কারণটা অবশ্য এখনো উনি কাউকে জানায় নি। তবে সময়মতো কাজটা সারবেন তিনি।

রাতে খেতে বসেই দূর্জয় কথা তুলে সে প্ল্যান করেছে মা, স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এখানকার কোনো এক সী বীচে ঘুরতে যাবে কালকে। সুহালা বেগম সুযোগে বলে উঠে,

“ আমি যাবো না। “

দূর্জয় অবাক হয়ে জানতে চায়,

“ কেনো? “

সুহালা বেগম আফরার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

“ আমার আর আফরার আলাদা প্ল্যান আছে। তাই না আফরা? “

আফরা হেসে মাথা নাড়ে। এই নতুন নাম ধরে কেউ ডাকলে খুব মজা পায় সে। নামটা শুনতেও বেশ কুল লাগে তার কাছে। আগের নামটাও তার পছন্দের ছিলো। কিন্তু মাম্মা তো বুঝিয়েছে যে ওই নামটার অর্থ ভালো ছিলো না। সেজন্যই তার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। তাই আফরাও আর তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে নি। ভদ্র বাচ্চার মতো সবটা বুঝে নিয়েছে।

বাণী সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি প্ল্যান? “

আফরা জবাব দেয়,

“ নেক্সট দু’দিন আমি আর দীদা একসঙ্গে ঘুরবো। আমাদের সাথে আর কেউ এলাউড না। মাম্মাও না, বাবাও না। “

বাণী আর দূর্জয় অবাক হয়ে সুহালা বেগমের দিকে তাকায়। সুহালা বেগম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,

“ এখন কি আমি আমার নাতনির সঙ্গে দুটো দিন নিজের মতো স্পেন্ডও করতে পারবো না? “

বাণী মাথা নেড়ে বলে,

“ তা বলি নি মা। অবশ্যই স্পেন্ড করুন। কিন্তু আফরাকে একা আপনি সামলাতে পারবেন? “

সুহালা বেগম হেসে বলে,

“ কেনো পারবো না? দুটো ছেলে বড়ো করেছি না? আর আফরা তো একদম গুড গার্ল। ও প্রমিজ করেছে দীদার সব কথা মেনে চলবে। তুমি জানো না, দীপ্ত ছোটবেলায় মারাত্মক দুষ্ট ছিলো। ওকেও আমি একা হাতে সামলাতাম। “

দূর্জয় খাবার খেতে খেতে বলে,

“ সমস্যা নেই। তোমরা ঘুরো। দু’দিন পরেই নাহয় আমরা একসাথে সী বীচে যাবো। “

সুহালা বেগম আঁতকে উঠে,

“ আমাদের কারণে প্ল্যান কেনো চেঞ্জ করবে তুমি? বরং একটা কাজ করো, তুমি আর বাণী গিয়ে দুটো দিন সুন্দর যে-কোন বীচ থেকে ঘুরে আসো। ওখানে অনেক সুন্দর রিসোর্টও আছে। একটা রিসোর্ট বুক করে নাও দু’দিনের জন্য। আমরা আমাদের মতো ঘুরলাম, তোমরা তোমাদের মতো। “

বাণী এবং দূর্জয় এতক্ষণে সুহালা বেগমের ইঙ্গিত বুঝতে পারে। দূর্জয় বাণীর সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মৃদু অস্বস্তি নিয়ে মা’য়ের দিকে তাকায়। বাণী কি ভাবছে কে জানে! হয়তো মনে করছে তাকে তার মেয়ে থেকে দূরে রেখে ধরে বেধে দূর্জয়ের সঙ্গে ঘুরতে পাঠাতে চাচ্ছে।

আফরা বলে উঠে,

“ ইয়েস। ইউ গাইস ক্যান ইঞ্জয়। আমি আর দীদা এলোন টাইম স্পেন্ড করবো। “

দূর্জয় মানা করতে নিলেই সেই মুহুর্তে বাণী বলে উঠে,

“ আচ্ছা। কিন্তু তোমাকে দীদার সব কথা শুনতে হবে। আর মেডিসিন সব টাইম মতো নিতে হবে। ওকে বাচ্চা? “

আফরা মাথা নেড়ে বুঝায় সে সব কথা শুনতে রাজি। দূর্জয় বাণীর কথা শুনে বিস্মিত হলেও কিছু বলে না। খাওয়া শেষে রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর বাণী রুমে আসতেই প্রশ্ন করে,

“ তুমি মামণির মন রাখতে রাজি হয়েছো। তাই-না? “

বাণী স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ মন থেকেই রাজি হয়েছি। কেন? আমি একা তোমার সঙ্গে গেলে বিরক্ত হবে তুমি? “

দূর্জয় বাণীকে কিছুক্ষণ সূক্ষ্ণ নজরে পরখ করে বলে,

“ আফরাকে ছাড়া দুটো দিন তুমি থাকতে পারবে? “

“ মা ওর খেয়াল রাখবে। আমার ভরসা আছে। “

“ সেটা আমিও জানি। আমি তোমার কথা জানতে চাইছি। তুমি থাকতে পারবে? “

“ আগেও তো মেয়েকে ছাড়া থেকেছি। তখন যদিও মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে মন ছটফট করেছে। এবার তো আর সেই চিন্তা নেই। শি ইজ ইন সেফ হ্যান্ডস। “

দূর্জয় বেশ কিছুক্ষণ বাণীকে দেখে বলে,

“ এজ ইউর উইশ। “

বাণী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মনে মনে সে গভীর ভাবনায় বিভোর। সে ভালো করেই জানে মা তাকে আর দূর্জয়কে কিছুটা একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিতে চাচ্ছে। যেটা সম্পূর্ণ ভুল নয়। বিয়ের পর থেকে সে আর দূর্জয় হাজব্যান্ড ওয়াইফের থেকে বেশি আফরার প্যারেন্টস হিসেবেই থাকছে। আফরা নাহয় তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু দূর্জয়ও তো এই সম্পর্কটা থেকে কিছুটা হলেও ডিজার্ভ করে। তার ও তো নিজের ওয়াইফের সঙ্গে দুটো দিন একান্তে কাটাতে ইচ্ছে হতেই পারে। যদিও দূর্জয় কখনোই তা মুখ ফুটে বলবে না। সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে তুলতে হলে স্বার্থপরের মতো বাণী কেবল নিজের দিকটা দেখলেই তো হবে না। তাকে সবটাই দেখতে হবে। নিঃস্বার্থ ভাবে যেই মানুষটা নিজের সম্পূর্ণ জীবনটাই বাণী আর আফরার জন্য মনোনীত করলো, সে অন্তত এই দুটো দিন তো বাণীর কাছ থেকে প্রাপ্যই তাই না?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]