#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৫২
একটি মেয়ে যখন অনুভব করতে পারে , যে তার ভেতরে আরও একটি প্রাণ বেড়ে ওঠছে, আমার মনে হয়না এর থেকে কোনো সুখকর জিনিস তার কাছে আর আছে। আমার অনুভূতিটা ঠিক সেরকম। হ্যাঁ, আমার গর্ভে আনভীরের একটা ছোট্ট অংশ বেড়ে ওঠছে , এর প্রতিক্রিয়া আমার আসলে কি দেখানো উচিত আমি নিজেও জানি না। একজন মেয়ের কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মা হওয়ার প্রাপ্তিটা , যেটা আমি পেয়েছি। আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমার জীবন হয়ে গিয়েছিলো অন্ধকার, প্রতিটা পদে পদে অপমান, হতাশা আর লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি। তবে আনভীর আমার অনধকার জীবনে এসেছিলেন দূত হয়ে, যে আমার সবচেয়ে বেশি হতাশার কারন ছিলো। আমাদের বিয়ের প্রথম দিকে যে মানুষটা আমায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে , তিনি আনভীর ছাড়া আর কেউ নন।তবে কেউ কি জানতো যে আমার হতাশার মানুষটিই আমার জীবন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে দিবে?
ঘটনাটি ছিলো কিছুদিন আগের। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই আমার শরীরের কন্ডিশন খুব একটা ভালো ছিলোনা। ঘন ঘন জ্বর আসতো, কোনো খাবারের স্মেল নিতে পারতাম না, খেলেই বমি করে দিতাম। প্রথম কয়েকদিন ব্যাপারটা আমি স্বাভাবিকভাবে নিলেও আমার হুট করে খেয়াল হলো লাস্ট মান্থে আমার পিরিয়ড স্কিপ করেছে। আমার মনে অজানা আশঙ্কা ঢুকলো এবার। আনভীরকে ভয়ে বলতেও পারছিনা কারন উনি সরাসরিই আমায় বলেছিলেন এখন কনসিভ না করতে। তবে আমার আর উনার দ্বারা অজান্তেই একটা ভুল হয়ে গিয়েছিলো, যার জন্য এ ব্যাপারে খচখচানি জেগেছে আমার মনে। পরে আনভীর আমায় হসপিটালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলেও আমি ভয়ে কিছু বললাম না। তবে এ কথা কি আর লুকিয়ে রাখা যায়? যা হলো তাই। ডক্টর আমায় প্রেগনেন্সি টেস্ট করতে দিলেই আনভীরের হাত পায়ে হিম ধরে গেলো। কেননা উনি ধারনাও করতে পারেননি যে আমার প্রেগনেন্সিজনিত কোনো কারন হবে এটি। রিপোর্ট হসপিটালে সাধারনত ১২ ঘন্টা পর দেয়। তবে আনভীর ইমার্জেন্সির কথা বলে এক্সট্রা চার্জের ভিত্তিতে অল্পসময়েই রিপোর্ট ফেরত পাওয়ার ব্যস্থার করলেন।
রিপোর্ট দেখার পর আমার সন্দেহ পুরোপুরি দূর হলো এবার। আমার চোখ নিষ্প্রভ। গলার স্বর ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে এসেছে। আমি অবাক নয়নে একবার আনভীরের দিকে তাকিয়ে আবার রিপোর্ট দেখলাম। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লিখা ‘POSITIVE’ , তারপর আনভীরও দেখে বিমূঢ় হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।ডক্টর আমাদের দুজনকেই সাধুবাদ জানালেন তবে আনভীর একটি টু’ও করলেন না এতে। ডক্টর ভেবেছেন যে উনি হয়তো এখনও শক এ আছেন এ সুসংবাদ শুনে। তবে আমি জানি উনার এমন প্রতিক্রিয়ার কারন অন্যকিছু।
পুরোটা পথে উনি একটাও কথা বললেন না আমার সাথে। এমনকি আমায় এপার্টমেন্টের সামনে নামিয়েই নিজের গাড়ি নিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। বাসায় সবাই যখন আমার প্রেগনেন্সির খবর পেলো , খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেলো সবাই। মা আমায় নিজের কাছে টেনে প্রাণভোরে দোয়া করে দিলেন আমার আর আমার অনাগত সন্তানের জন্য। শিউলি ভাবিও সাধুবাদ জানাচ্ছে এবার। বলেছে , এতদিন আমি ভাবির খেয়াল রেখেছি , এবার ভাবি আমার খেয়াল রাখবে। অয়নের তো তিনমাস অলরেডি পার হয়ে গিয়েছে তাই বেবির সাথে ঘর সংসার সামলানো খুব একটা কঠিন কাজ হবেনা ভাবির জন্য। আমি পুরোটা সময় রইলাম নির্বিকার। কেননা আনভীরের ব্যবহার বেশ ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে।উনি কি কোনোভাবে খুশি না এ ব্যাপারে? মা ভাবি বারবার জিজ্ঞেস করলো যে উনি কোথায় , তবে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। চুপ করে চলে গেলাম নিজের রুমে।
সময় ঘনিয়ে রাত নেমে এলো এবার। সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আনভীরের। সাড়ে এগারোটা প্রায় বেজে গিয়েছে , কিন্ত উনার কোনো খবর নেই। আমি অনেকবার কল দিলাম কিন্ত একবারও রিসিভ করলেন না। শেষমেষ সুইচ অফ করেদিতেই আমার চোখে অশ্রু ভর করলো। শিউলি ভাবি তন্মধ্যেই এসেছেন আমায় শুভরাত্রি জানানোর জন্য। আমার কাদো কাদো মুখ দেখে উনি বিচলিত হয়ে বসে পড়লেন আমার পাশে। বললেন,
-কি হয়েছে আহি বোন? তোমার চোখ মুখ এমন ফুলে আছে কেন?
আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। শিউলি ভাবিকে জড়িয়ে অঝোরে ধারায় কাদতে লাগলাম। ভাবি সান্তনা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন এতে। জিজ্ঞেস করছেন যে কি হয়েছে। আমি কাদো কাদো হয়ে বলে ওঠলাম,
-আনভীর,,,,,,আনভীর রাগ করেছেন ভাবি। উনি,,,,উনি এই বাচ্চা চান না। নাহলে বাবা হয়েছেন জেনেও কেনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না উনি?
পাঁচ বছরের শিশুর মতো আনভীরের নামে অভিযোগ করছি আমি ভাবির কাছে। কেননা উনার এই শীতল প্রতিক্রিয়াটা খুবই কষ্ট দিয়েছে আমায়। এটা সত্যি যে আমার প্রেগনেন্সির ব্যাপারটা আনএক্সপেকটেড ছিলো। আমাদের কাছাকাছি আসার পরই উনি আমার হাতে পিল ধরিয়ে দিয়েছেন যার দরুন আমি বুঝলাম উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল। ভাবির অবস্থা দেখে উনি এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে উনি আপাদত চাচ্ছিলেন না বাচ্চা নিতে। তবুও আমাদের একটা ভুলের কারনেই আজ আমি এই প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। ভাবি মৌনতা কাটাচ্ছিলেন আমার কান্নাসুরে। তারপর জড়ানো গলায় বললেন,
-এর জন্য কান্না করতে লাগে বোকা? আনভীর শুধু একটু শকড আছে। দেখো , রাতের মধ্যেই ও ফিরে আসবে। তারপর ওই হতচ্ছাড়া কে আমি কান মলা দিয়ে ধরবো। কতো বড় সাহস ! আমার বোনকে কাদায় ও?
ভাবি আমায় ঘুমোতে বলে প্রস্থান করলেন ঘর থেকে। আমার শরীরটা আগের তুলনায় দুর্বল লাগছে অনেক। অল্পতেই চোখে ঘুম বিরাজ করে। তাই খাটে শরীর এলিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ঘুমের তলদেশে চলে গেলাম।
রাত বাজেতিনটা কি সাড়ে তিনটা। হঠাৎ নিজের খুব কাছাকাছি কারও অস্তিত্ব পেতে চোখ খুললাম আমি। দরজা খানিকটা ভিড়ানো, আনভীর আমায় নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জরিয়ে ধরে গলায় মুখ গুঁজে বেসামালভাবে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। আমি অনঢ় হয়ে গেলাম উনার এমন কাজে। পরনে শার্ট আর প্যান্ট দেখে বুঝতে বাকি রইলো না উনি মাত্রই বাড়িতে ফিরেছেন। ডুপ্লিকেট চাবি থাকাতে ঘরে আসতেও তেমন একটা কষ্ট হয়নি। আমি জড়ানো কন্ঠে বললাম,
-আমায় ছাড়ুন আনভীর । দম আটকে আসছে আমার।
উনি ছাড়লেন না। বরং কথার পরিপ্রেক্ষিতে আরও শক্ত করে মিশিয়ে রাখলেন আমায় উনার নিজের সাথে। যার দরুন উনার ঠোঁট আমার গলায় গভীরভাবে ঠেঁকে গিয়েছি। আবেশে শরীর উষ্ণ হয়ে আসলো আমার। নিঃশ্বাস পড়তে থাকলো ঘনঘন। আনভীর শুকনো ঢোক গিললেন। গলায় মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বললেন,
-আমাদের মাঝে নতুন একটা প্রাণ আসতে চলছে আহি , (আমার পেটে হত স্পর্শ করে) এখানে, এখানে হবে তার সূচনা। আমি কিভাবে সামলাবো আমার অগোছালো অনুভূতিটাকে?
চোখে অভিমানের অশ্রু ভর করেছে আমার। উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে অভিমানী গলায় বললম,
-সরুন আমার কাছ থেকে। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনি ? এখন মনে পড়েছে যে আপনি বাবা হতে চলেছেন? জানেন কতক্ষণ আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম? আর আপনি পাষাণের মতো আমায় রেখে চলে গেলেন দূরে। ফোনও ধরলেন না। এর মানে কি এটাই যে আপনি বাবা হওয়াতে খুশি………..’
আমায় কথা বলতে না দিয়ে আমার চোখে কপালে চিবুকে থুতনিতে তৃষ্ণার্তের মতো নিজের অধর যুগলের আগ্রাসী রাজত্ব চালাচ্ছেন আনভীর। আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম। চোখ হয়ে আসছে নিষ্প্রভ। এই মানুষটা জানে না যে উনার অহেতুক আক্রমণে আমি অন্য জগতে চলে যাই? আনভীর আমার কোমড়ে জড়িয়ে কপালে একটা দীর্ঘক্ষণ চুমু দিয়ে আবেশিত দৃষ্টি এলিয়ে দিলেন আমার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়ায়। গভীর সম্মোহনী কন্ঠে বললেন,
-ডাক্তার যখন তোমায় টেস্ট করাতে বললো তখনই আমার একটু সন্দেহ হয়েছিলো। কিন্ত আমি চাইনি যে তুমি প্রেগনেন্ট হও এখন। বিশ্বাস করো আহি, ভাবিমণির কথাগুলো ভাবতেই আমার বুক কেপে ওঠে। সেদিন ভাবির কি কষ্টটাই না হয়েছিলো। আর তুমি তো এখনও ছোট , পড়ালেখা বাকি, সবচেয়ে বড় কথা কনসিভ করার ক্যাপাবিলিটি তোমার থাকলেও আমি ভয় পাচ্ছি। আমার নিজের ওপরই অবিশ্বাস জমেছে যে আজরান ভাইয়ার মতো যদি আমি কোনো ভুল করে ফেললে কি অবস্থা হবে তোমার? আজরান ভাইয়া যেখানে শক্ত ছিলো, আমি মরে যাবো আহি। এজন্যই চাইনি যে তুমি এখন কনসিভ করো। তবে ডাক্তার যখন বললো যে রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে, আমার কি হলো জানিনা। শুধু প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে ছিলাম। তাইতো তোমায় বাড়িতে দিয়ে এসে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম লোকালয় থেকে অনেক দূরে। ক্রমেই আমার বোধ ফিরে এলো। আমি অনুভব করতে পারলাম পিতৃত্ব লাভ করার এক আকুল আনন্দ। আই,,,,আই এম গোয়িং টু বি ফাদার আহি! আমার ভালোবাসার একটা ছোট্ট অংশ একটু একটু করে তোমার মধ্যে বেড়ে ওঠবে।আমি,,,,,আমি বেসামাল হয়ে পড়েছি আহি, এমন সুখে চরমভাবে বেসামাল হয়ে পড়েছি।
আমার শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেলো উনার সম্মোহনী কন্ঠে। নীরবে কাদছেন আনভীর। এই প্রথম উনায় কাদঁতে দেখলাম। অশ্রুটা সুখকর হলেও একই সাথে আমার জন্য ভয় কাজ করেছে। আমি উনার কন্ঠনালিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে ওঠলাম,
-আপনার এই বেবি আপনার মতোই কেয়ারিং হবে দেখেন? একটুও তার মা’কে কষ্ট দেবে না।
ফিক করে হেসে দিলেন আনভীর। সেই সাথে আমিও। আমাদের দুজনের মনে এক চরম ভালোলাগা কাজ করছে। সেই সাথে আরও গভীর হয়েছে আমাদের বন্ধন। কে জানতো আনভীরের মতো শীতল মানুষটাই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায় হয়ে দাঁড়াবে?
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।