#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৯(স্পেশাল পর্ব)
“স্যার আপনার সন্দেহ ঠিক। এই মাত্রই তিন জন আপনার বাড়ির গেইট থেকে বেরিয়ে গেল। ওরা এসেছে উত্তর সাইডের একটা কোনা দিয়ে। মেইন গেইট তো লাগানো।”
মাশরিফ ভ্রুঁতে হাত ঘষতে ঘষতে পেছনে তাকিয়ে মাকে একবার দেখে নিল। ভারী মাদুরের উপর চাদর বিছিয়ে বালিশ নিয়ে বসেছিল তারা। মহিমা বেগম এতোটা সময় নীরবে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়েছেন এখন তিনি ঘরে যেতে চাইছেন। মাশরিফদের বসার জায়গাটা একটু ভেতরে। বাগানের কোণার দিকে হওয়ায় ভালো করে লক্ষ্য না করলে দেখা মুশকিল।
মাশরিফ ফোনের অপরপাশের ব্যাক্তিকে বলে,
“ছবি বা ভিডিও করেছ?”
“তুলেছি কিন্তু স্যার পুরা এলাকাতে অন্ধকার। বুঝা যায় না। ফ্ল্যাশ জ্বালিয়েও তুলতে পারব না। তবে হ্যাঁ, একটা ছবিতে হালকা একটু বোঝা যায়।”
“আচ্ছা রাখ। ওরা কোনদিকে গিয়েছে?”
“দুইজনকে তো বড়ো রাস্তার দিকে যেতে দেখেছি। আরেকজন একটু আগেই চলে গেছে কিন্তু অন্যদিকে। যে অন্যদিকে গিয়েছে তার হাইট কম। বাকি দুজনের মতো না। সে আসলে হুট করে অন্ধকারের মধ্যে কোথায় ঢুকেছে বুঝতে পারিনি।”
“ক্লিপগুলো আমাকে পাঠাও। আর নজর রাখো।”
“জি স্যার।”
মাশরিফ ফোন রেখে মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
“মা, তুমি একটু বসো। আমি আসছি।”
“এখানে আর বসব না। আমি ঘরে চলে যাই।”
“না মা। বসো। পাঁচ মিনিট বসো। তারপর একসাথে যাব।”
”এতো রাতে কই যাবি তুই?”
মায়ের সন্দিহান প্রশ্নে মাশরিফ জবাব ভাবছে। কী বলবে ভেবে মাকে থামাতে বলে,
“তুমি পাঁচটা মিনিট বসোই না। বললাম তো যাব আর আসব। এখান থেকে নড়বে না। আমি কাজটা করেই চলে আসব।”
কথাগুলো বলেই দ্রুত কেটে পরে সে। তারপর বাড়ির সদর দরজার কাছে গিয়ে দেখে বাহির থেকে সিটকিনিটাও লাগানো! মাশরিফের স্পষ্ট মনে আছে সে সিটকিনি লাগায়নি। তারমানে এটা ওই লোকগুলোর কাজ। মাশরিফ খুব ধীরে নিঃশব্দে সিটকিনি খুলে ও লক খুলে ভেতরে গিয়ে দেখে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। ওরা কেন এসেছিল সেটা কীভাবে বুঝবে! জানালা গুলো ভালো করে চেক করে দেখতে গেল। একি! জানালা ভেতর থেকে খোলা যাচ্ছে না! তার, মায়ের, গেস্টরুমের ও ড্রয়িংরুমের কোনটারই না। মাশরিফ অবাক হয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ভালো করে পুরো ঘরটা দেখতে শুরু করল। অতঃপর একটা জানালার কাছে একটা বস্তু পায়। বস্তুটা কী-সের তা বোঝার জন্য নিজের ঘরে গিয়ে গ্লাভস এনে সেটা পড়ে তারপর হাতে নিয়ে ভালো করে উলট-পালট করে দেখে বোঝার চেষ্টা করল। ভালো করে বুঝতে না পেরে ওটাকে নিয়েই বাগানে মায়ের কাছে গেল। মাকে বলল,
“চলো ঘরে চলো।”
“কই গেছিলি?”
“এইতো এখানেই। চলো।”
মাশরিফ মাকে নিয়ে বাড়ির প্রবেশ করার আগে বস্তুটা বাগানেই ফেলে গেল। সবগুলো রুমের ফ্যান চালিয়ে দিল আর সদর দরজাটা খোলা রাখল। তা দেখে অবাক হয়ে শুধাল,
“এই মাঝরাতে তোর কী হয়েছে? এখন সব রুমের ফ্যান ছেড়ে সদর দরজা খোলা রাখছিস কেন?”
মাশরিফ কিছু ভাবছিল। আনমনে বলল,
“প্রায় সব জানালা বাহির থেকে সিলড! শুধু মনে হয় রান্নাঘরের কাছেই মানে দক্ষিণ দিকে যেতে পারেনি!”
“কী বলছিস!”
মহিমা বেগমের বিস্ময়সূচক প্রশ্নে মাশরিফ নির্বিকার জবাব দেয়,
“কেউ তো আমাদের খুব বড়ো ক্ষতি করতে চাইছে! এখন আমি যাকে মনে মনে সন্দেহ করছি হয়তোবা সে। কিন্তু কালকে সকাল ছাড়া সেটা বোঝা যাবে না। এখন লাইট অফ রেখেই পুরো ঘরের ফ্যান চালিয়ে দিয়েছি। যাতে ভিতরে কোন বিষাক্ত বাতাস থাকলে সেগুলো বেরিয়ে যায়।”
“তুই যে কি বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না! আমাদের আবার কে ক্ষতি করতে চাইবে? তুই তোর এই সন্দেহ এবার বন্ধ কর। এগুলো রেখে এবার ঘুমাতে যা। রাত অনেক হয়েছে। আমিও গেলাম।”
মহিমা বেগম নিজের ঘরে চলে গেলেন। মাশরিফ সেখানে দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঘরের সব ফ্যান অফ করে ঘুমাতে চলে গেল।
_______
পরের দিন খুব ভোরে নামাজ পড়ে মাশরিফ বাগানের সামনের দিকে এক্সারসাইজ করছে। তখন বাড়ির এরিয়ার সামনে কাশফাকে হতচকিত হয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাশরিফ বাঁকা হাসে। অতঃপর কাশফার সামনে গিয়ে বলে,
“কী ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আমাকে সুস্থ, স্বাভাবিক দেখে খুব অবাক হচ্ছো মনে হচ্ছে! অন্য কিছু আশা করেছিলে বুঝি?”
মাশরিফের এহেনো কথায় কাশফা থমমত খেয়ে যায়। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কিছু সেকেন্ড নিজেকে সামলে নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
“তুমি ভুল বুঝছ। আমি তোমাকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছিলাম! তুমি আর আন্টি তো আজকেই ফিরে যাবে। তাই জন্য দেখতে এসেছিলাম। আর দুই দিন পরেই তো তোমার বিয়ে। তখন তো আর তোমাকে এভাবে দেখতে পাবো না।”
“ওহ আচ্ছা! দেখা শেষ? তাহলে আসতে পারো।”
মাশরিফের এভাবে বলাতে কাশফার অপমানবোধে লাগল। তাছাড়া সে বুঝতে পারছে না, ওরা বেঁচে গেল কীভাবে? কাশফা আর সেখানে দাঁড়াল না।
কাশফা চলে যাওয়ার পর মাশরিফ মনে মনে বলে,
“এখন থেকে তোমার ওপর সর্বদা আমার নজরদারি জারি থাকবে। তুমি কোথায় যাও, কী কর, সব কিছুর খবর আমি পাব। তোমাকে তো ধরতেই হবে। তারপর তোমার মুখ থেকেই সবার সব সত্যটা বের করব। এখন একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলো।”
কাশফা নিজের বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। রাগে গজরাতে গজরাতে টে*রো*রি-স্টদের ফোন করে। তারপর ফোন রিসিভ হওয়া মাত্রই দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলে,
“কী কাজ করলেন আপনারা? মাশরিফ তো সুস্থভাবে বাগানে এক্সারসাইজ করছে। আপনাদের কিছুতেই কিছু হলো না।”
টো*রো-রি-স্ট দলের সদস্যরা হতবাক হয়ে যায়। তাদের একজন বলে,
“আমরা তো সব জানালা, দরজা সিলড করে দিয়েছি। এমনকি দুইটা ভেন্টিলেটরে কাঁদামাটি লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়েছি। তবে দক্ষিণ দিকের জানালা সিল করা হয়নি কারণ রাস্তা থেকে শব্দ পেয়ে দ্রুত চলে এসেছিলাম। তাছাড়া গ্যাস ছড়িয়ে পরলে মানুষের কি এতো খেয়াল থাকে? প্রায় সবই সিলড।”
“তাহলে ওরা বেঁচে আছে কীভাবে?”
কাশফার বিরক্তির কণ্ঠ শুনে আরেকজন টে*রো*রি*স্ট বলে,
“হায়াত! তাদের হায়াত আছে বলেই কোনোভাবে বেঁচে গেছে। এবার হয়নি তো কী হয়েছে পরেরবার হবে। চার-পাঁচ দিন পর তুমি আমাদের সাথে দেখা করবে। এখন স্বাভাবিক থাক।”
কাশফাকে কিছু বলতে না দিয়ে ওরা ফোন ডিসকানেক্ট করে দেয়। কাশফা ঘন নিঃশ্বাস ফেলে লম্বাশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইল।
_______
দেখতে দেখতে আজ মাশরিফ ও তিতিরের বিয়ের দিন। শুক্রবার পবিত্র জুম্মার দিন। মাশরিফ, তার মা, বোন-দুলাভাই, ভাতিজা ও ছয় বন্ধুকে নিয়ে তিতিরদের বাড়িতে জুম্মার আগেই হাজির। জুম্মার নামাজের পরপরই আকদটা হবে। তিতিরের এখানকার ফ্রেন্ডরাও হাজির সেইসাথে ইনায়া ও ওর ফ্রেন্ডরা। ছেলেরা সব মসজিদে চলে গেছে। নামাজ শেষে কাজি নিয়ে একসাথে আসবে। মহিমা বেগম তার মেয়েকে নিয়ে তার বোনের সাথে আছেন।
তিতির নামাজের ওয়াক্ত হতেই নামাজ পড়ে এখন তৈরি হতে বসেছে। নাদিয়া ও ইনায়া তিতিরকে সাঁজাচ্ছে। জারিন বলে,
“আমাদের তিতিরকে আজ সাঁজ ছাড়াই কতো উজ্জ্বল ও সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ।”
ফাইজা হেসে একটু মজা করে বলে,
“মাশরিফ ভাইয়ের ভালোবাসার রঙে আমাদের তিতির আজ রেঙে গেছে। সেটারই প্রতিফলন তার সৌন্দর্যে ঘটছে!”
ঘরে উপস্থিত সকলে একদফা হেসে ওঠে। তিতির লজ্জায় ওদের বারকয়েক থামতে বলে চুপ করে আছে। ওরা কি আর থামে! হাসি-ঠাট্টাতেই তিতিরকে সাঁজানো শেষ হলো। খুব অল্প সাঁজ। অল্প সাঁজে লাল জামদানী শাড়িতে কোনো অপ্সরীর থেকে কম লাগছে না! লাল জামদানীর সাথে লাল ফুল স্লিভসের ব্লাউজ ও লাল প্লেইন সিল্কের হিজাব। হিজাবের ভেতর দিয়ে পাতলা গোল্ডেন স্টোনের টিকলি ও চেইনের মতো টায়রা। গলায় একটা পাতলা লম্বা গোল্ডেন স্টোনের হার। হাত ভর্তি ডিজাইনার গোল্ডেন স্টোনের কিছু চুড়ি ও বালা। হালকা সাঁজেই তিতিরকে ওরা সবাই হা করে দেখছে। ইনায়া খুশিতে ডগমগ করে বলে,
“উফ! এতো সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। কারও খারাপ নজর না লাগুক।”
এই বলে সে নিজের চোখের কোন থেকে কাজল নিয়ে হিজাবের ভেতর দিয়ে তিতিরের থুতনির নিচে লাগিয়ে দেয়। আরভি বলে,
“পুরো বউ পুতুল লাগছে। মাশাআল্লাহ।”
লিরা এসে তিতিরকে আলতো জড়িয়ে ধরে গালে হাত রেখে বলে,
“বার্বিডল! মে গড ব্লেস ইউ ডিয়ার।”
জুলিয়াও এসে উষ্ণ আলিঙ্গন করে একটা প্যাকেট দিয়ে বলে,
“তোমার উপর সকল সুখ বর্ষণ হোক ডিয়ার! দিস গিফট ফর্ম পারসোনালি মি এন্ড লিরা। জাস্ট অ্যা অর্ডিনারি থিংস, ফর উইশিং দ্যা হ্যাপি ম্যারিড লাইফ।”
তিতির খুলে দেখে একটা উইন্ড চাইম। তিতির ভীষণ খুশি হয়ে ওদের জড়িয়ে ধরে।
নাদিয়া বলে ওঠে,
“আমাদের বান্ধবী এমনিতেই পুতুলের মতো। আজ মাশরিফ ভাইতো পা-গ*ল হয়েই যাবে!”
নাদিয়ার কথায় সবাই হেসে ওঠে। জারিন বলে,
“ব্রেকিং নিউজ! ভবিষ্যৎ ডাক্তার তানুজা নূর তিতিরের রূপের ঝলকানিতে মেজর মাশরিফের হৃৎযন্ত্র খানিক সময়ের জন্য থমকে গেছে!”
ঘরের ভেতর হাসির রোল পরলেও ওদের এসব কথায় তিতির বারংবার লাজ রাঙা হচ্ছে। হিয়া গোল্ডেন নেটের ভেতর গোল্ডেন কারুকাজ ও স্টোন বসানো ব্রাইডাল ওড়নাটা এনে তিতিরের হিজাবের উপর দিয়ে সেট করে দেয়। তারপর বলে,
“আকদ হয়ে যাওয়ার পর তোকে যখন মাশরিফ ভাইয়ের সামনে নিয়ে যাওয়া হবে তখন এই ওড়নাটা দিয়ে মুখ ঢেকে নেওয়া হবে। আর ফুলের পর্দা নাকি আনবে বলেছিল? ওটা কখন আনবে?”
জারিন বলে,
“রণকের বুদ্ধি ছিল ওটা। ও আনবে বলেছিল। দাঁড়াও আমি কল করে জিজ্ঞেসা করি। এতক্ষণে তো নামাজ শেষ। ইমাম সাহেবেরও খুতবা শোনা যাচ্ছে না।”
“হ্যাঁ ফোন করো।”
ওদের কথা বলার মাঝেই তিতির আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নাটা নতুন কেনা হয়েছে। পুরো পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায়। নিজেকে বধূবেশে দেখে কিয়ৎ নিষ্পলক চেয়ে থাকে। ওর এখন নিজের প্রথম বিয়ের দিনের কথা মনে পরে যায়। সেদিনও সবার ভাষ্যমতে তিতিরকে নাকি পুতুলের মতো লাগছিল। কিন্তু সেই পুতুলের সুখ তো দীর্ঘস্থায়ী হলো না! এবারও কি তেমনটা হবে? শুনেছে বিয়ের কিছুদিন পরেই মাশরিফকে একটা মিশনে যেতে হবে। ভাবতেই তিতিরের বুক কেঁপে ওঠল। অজানা আশঙ্কাতে মন-মস্তিষ্ক ছেঁয়ে গেল। তার কাছে সব কেমন দমবন্ধকর লাগছে। হাঁসফাস লাগছে তার। কিন্তু তার বান্ধবীরার তাকে খুব বেশি সময় এই অস্থীরতার মাঝে থাকতে দিল না। টেনে নিজেদের আনন্দের সাথে সামিল করল।
________
ছেলেরা জুম্মার নামাজ শেষে কাজি নিয়ে হাজির। এবার বিয়ে পড়ানোর পালা।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪০(স্পেশাল পর্ব ২)
দুই পক্ষে সম্মতি নিয়ে বিয়ে পড়ানোর শেষে তিতিরকে মাথার উপর ওড়না ঝুলিয়ে ড্রয়িং রুমে নেওয়া হচ্ছে দোয়া পড়ানোর জন্য। তিতির চাইছিল দোয়া পড়ানোর সময় সে তার নিজের রুমেই থাকুক, তারপর যাবে। কিন্তু রণক ও বাকিরা বলছে বর-কনের সামনে ফুলের পর্দা দিয়ে দোয়া পড়ানো হবে। দোয়া পড়ানোর পরে মাশরিফ সেই পর্দা সরিয়ে তার বধূর মুখদর্শন করবে। ব্যাপারটা তিতির এর কাছে অনেকটা সিনেমাটিক মনে হল কিন্তু বন্ধু-বান্ধবীর জোড়ে তাকে এই সিনেমাটিক কাজটাই করতে বাধ্য করল। এদিকে মহিমা বেগম ও নাজমা বেগমেরও একটা বড়োসড়ো ইন্ধন কাজ করছে! নিজেদের ছেলে-মেয়ের বিয়েটা খুব সুন্দর হোক সেটা তো প্রত্যেক বাবা-মা চায়।
দোয়া পড়ানোর শেষে মাশরিফ ফুলের পর্দা সরালো। অতঃপর তিতিরের মুখের উপর আচ্ছাদিত ঘোমটা দেওয়া ওড়নাটা সরিয়ে কিয়ৎ মূহুর্ত অপলক চেয়ে থেকে মুগ্ধ চিত্তে অস্ফুট স্বরে বলল,
“মাশাআল্লাহ!”
অস্ফুট স্বর হলেও তিতির শুনেছে। সে তো লাজুকলতার ন্যায় তন্ময় হয়ে ছিল সদ্য বিয়ে করা স্বামীর মুখনিঃসৃত প্রশংসা শুনতে! মাশরিফ তিতিরের লাজুক হাসি দেখে হালকা হেসে ঘোমটা নামিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ পর খাওয়া-দাওয়া শেষে ওদের ফ্রেন্ডরা আবার আয়নায় মুখ দেখা নিয়ে জোড়াজুড়ি শুরু করেছে। মাশরিফ বাঁধা দিয়ে বলে,
“পরেরবার যখন অনুষ্ঠান হবে তখন। এখন দরকার নাই।”
“কোনো পরেরবার না। যা হবে এখনি। কতো শখ করে আমরা আয়োজন করেছি। আজ তো আপনার কোনো বাঁধাই শুনব না।”
ইনায়ার হু*মকিস্বরূপ কথায় ঘরসুদ্ধ লোক হেসে ওঠল। তারপর শুরু হলো আয়নায় মুখ দেখার পালা।
তিতির বুঝতে পারছে না সে কী বলবে! তার তো মুখ থেকে রাও বের হচ্ছে না। মাশরিফ আয়নার ভেতর দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে প্রেয়সী প্রিয়তমার মুখচ্ছবি দেখে বলে,
“আমার প্রতিটা সায়াহ্ন যার প্রেমছন্দে রাঙানোর অভিলাষ!”
সবাই হৈ হৈ করে উঠলেও তিতিরের কান লাল হয়ে গেছে। গায়ের পশমে যেন শীতল হাওয়া বয়ে গেছে। গ্রীষ্মের এই তাপদাহে এ যেন বৈপরীত্য সংযোজন! তিতিরের পালা এলে সে বলল,
“এমন একজন আমার যেকোনো প্রয়োজনে সে প্রিয়জনের ভূমিকা রেখেছে। তারর প্রেমছন্দে আমায় রাঙিয়েছে।”
কথাতে খাঁপছাড়া ভাব থাকলেও তিতিরের এই এলোমেলো সম্বোধনে মাশরিফ মুগ্ধ হয়ে চাইল।
_________
রাতের দ্বিতীয় প্রহর। তিতির গুঁটিশুটি হয়ে আড়ষ্টভাবে বিছানার মধ্যিখানে বসে আছে। সামান্য ফুলের সমরোহে বাসারের সাঁজ আছে রুমটাতে। দরজার বাহির থেকে বখশিশ নিয়ে বাকবি*তাণ্ডা চলছে। কিছুক্ষণ পরেও দরজা লাগানোর শব্দে ধড়ফড়িয়ে ওঠল তিতির। মাশরিফ সেটা লক্ষ্য করে এগুতে এগুতে বলল,
“রিল্যাক্স। আই নো, ইউ নিড টাইম। টায়ার্ড লাগলে তুমি ঘুমিয়ে পরতে পারো নয়তো আমরা কিছু সময় গল্প করে ঘুমাতে পারি।”
তিতির গল্প করতেই রাজি হলো।
—–
দুইদিন পর। মাশরিফ মিশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। গতকালকেই সে সেনানিবাসে ফিরে এসেছে। আসার সময় মা ও স্ত্রীর হাস্যজ্জল মুখের আড়ালে শঙ্কিত প্রতিচ্ছবি তার আড়াল হয় না। কিন্তু কী করার! একজন আর্মি অফিসারের দায়িত্ব এটা। এবার দুইটা সূত্রে আগাচ্ছে সে। কাশফাকে আটক করেই সূত্র আগাবে আরেকটা সিলেট! তোর সূত্র যখন একই মালয় গাথিত হবে তখনই তো সবকিছুর পরিপূর্ণতা হবে! তবে খবর এসেছে কাশফা আজ প্রায় তিনদিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে। তাকে অনুসরণ করছে একজন সিভিল ড্রেসে জুনিয়র আর্মি অফিসার ও একজন সিভিল ড্রেসে পু*লিশ অফিসার। যেকোনো মূহুর্তেই কাশফাকে আটক করা হবে। স্বার্থপর কাশফা যে নিচে বাঁচতে কিছু লুকাবে না তা মাশরিফের জানা।
“মাশরিফ তুমি তৈরি?”
“জি স্যার।”
“তোমার দেওয়া ওই ভিডিও ক্লিপটা সা*ইবার টিমে পাঠানো হয়েছে। তারা অনেকটা ক্লিয়ার করে বোঝার চেষ্টা করেছে। অন্ধকারে খাটো ব্যাক্তিটা তোমার দুই বাড়ি পরে একটা বাড়িতে ঢুকেছে।”
মাশরিফ বাঁকা হাসে।
“আমারও সন্দেহ হচ্ছিল। আপনাকে তো সেইদিনের ঘটনাটা বলেছি। তাছাড়া ওই গ্যাসের উৎসটাও পরীক্ষা করা হয়েছে। সাধারণ কা*র্বন ম*নোক্সা-ইড গ্যাস খুব ফোর্সে বের হচ্ছিল। যা অনেকটা সময় শোষিত হলে মানুষের মৃ*ত্যুও ঘটে। সাথে কিছু ভারী ধাতুর গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে যা মানুষের ফুসফুসের অ্যালভিওলাইকে ড্যামেজ করে দিতে পারে। আজকেই মেয়েটাকে আ*টক করা হবে। আমরা এবার টে*রো*রি-স্ট চক্রটাকে ধরতে পারব।”
“হ্যাঁ। যেই চক্রটা এখন আমাদের দেশে আছে সেটার মূল উপড়ে ফেলতে পারলে নতুনভাবে ওরা আসতে ভয় পাবে। ওয়েল ডান মাই বয়।”
সেনাবাহিনীর হেড মাশরিফের কাঁধ চাঁ*পড়ে চলে যান। মাশরিফ মুচকি হেসে ফোন লাগায়।
“জানতে পারলে কোথায় গিয়েছে?”
“একটা দোকানে এসেছে। মেয়েটা বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে। দোকানের জিনিসপাতি শুধু ধরে ধরে দেখছে কিন্তু কিনছে না।”
“ভালো করে নজর রাখো। ওই দোকানেই কেউ আসবে হয়তো। এক কাজ করো, তোমরা দুইজন দুইদিকে যাও। পু*লিশ অফিসার নাদিমকে বলো সে যেনো কিছুটা দূরে যায়। তারপর তুমি দোকানে যাও। ওখানে কী সিগেরেট বিক্রি হয়?”
মাশরিফের জুনিয়র অফিসার বলল,
“হয় তো স্যার। কিন্তু আমি তো খাই না।”
মাশরিফ বিপাকে পরে গেল। বলল,
“তাহলে কোনো কোল্ড ড্রিংকস কিনে দাঁড়িয়ে খেতে থাকবে। আর বারবার ঘড়ি দেখবে আর ফোন দেখবে। এমন ভাব যেন কেউ আসবে।”
“ওকে স্যার।”
এই বলে ফোন ডিসকানেক্ট করে জুনিয়র অফিসার কবির সেটাই করল। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর সে কাশফার পাশে একজনকে প্রায় গা ঘেষে দাঁড়াতে দেখল। লোকটা মাস্ক পড়া। কবির নেটওয়ার্কের বাহানায় ছবি তুলে নিয়েছে। ওদের কথা বলার মাঝেই পুলিশ অফিসার নাদিম কবিরের কাছে এমন ভাবে এসেছে যেন এতোসময় তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারপর ওরা একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, কাশফা ও সেই লোকটা এখনও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর লোকটা চলে গেলে কাশফাও চলে যেতে উদ্ধত হয়। তখনি পু*লিশ অফিসার নাদিম কাশফাকে সেন্সলেস করতে প্রস্তুত হয়। ওদের মাইক্রোটাও কাছে। কাশফা রাস্তার কাছে রিকশার জন্য এসে দাঁড়ালেই মাইক্রোটা ওর সামনে থামে তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে ওর মুখে রুমাল চেপে গাড়িতে তুলে ফেলে। কাশফাকে মুখ খোলারও সময় দেয় না।
________
জ্ঞান ফেরার পর কাশফা নিজেকে ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করে। এখন কতো সময় সে বুঝতে পারছে না। পিপাসায় কাতর সে। পানির জন্য ডাকতে থাকে।
“কেউ আছেন? এটা কোথায়? আমার হাত-পা বাঁধা কেন? আমি পানি খাব।”
তখনি কাশফার মাথার উপর তীক্ষ্ম রশ্নিযুক্ত হলুদ লাইট জ্ব*লে ওঠে। তার উজ্জ্বলতায় চোখ-মুখ খিঁচে নেয় কাশফা। তার সামনের চেয়ারটাতে মাশরিফ এসে বসে। কাশফা সামনে কারো উপস্থিতি অনুভব করে পিটপিট করে চোখ খুলে। অতঃপর মাশরিফকে দেখে হতবাক হয়ে বলে,
“তুমি? আমি কোথায় নিয়ে এসেছ? আমার হাত-পা বাঁধা কেন? কী করেছি আমি? হাত খুলো আমার।”
কাশফাকে উত্তেজিত হতে দেখে মাশরিফ হেসে হাতের কাছে পেপারওয়েটটা ঘুরিয়ে বলে,
“তুমি কী করেছ তা তো তুমি বলবে। অবশ্য ইতোমধ্যে তোমার ফোনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক খুলে তোমার সহকর্মীদের আমি তোমার টোনেই রিপ্লাই করে ফেলেছি। তাও তুমি যদি নিজের মুখে বলো তবে তোমার নিজেরই ভালো।”
কাশফার অক্ষিদ্বয় বৃহতাকার ধারণ করল। হতচকিত কণ্ঠে তুঁতলিয়ে বলল,
“মানে? কী বলছ তুমি?”
“ওহ বুঝতে পারছ না? আচ্ছা তোমাকে কিছু দেখাই।”
এই বলে মাশরিফ সেদিনকার ক্লিয়ার করা ভিডিও ক্লিপটা দেখাল। কাশফা তা দেখে ভয় পেয়ে গেছে। মাশরিফ বলে,
“তোমাকে তো এই কারণে শাস্তি হবেই সাথে ফাঁ*সিও হতে পারে। যদি সত্যিটা বলো তবে শাস্তি অনেকটাই কমবে। সুপারিশের উপর নির্ভর করে।”
কাশফা ভীত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“বিশ্বাস করো, আমি কিছু করিনি। আমি তো তাদের চিনতাম না। আমি কিছু করিনি।”
“সত্যটা বলো। তারা কোথায় আছে। কী প্ল্যান সব। যে দেখা করতে এসেছে সে কে?”
“আমি জানিনা সত্যি।”
মাশরিফ টেবিলে সজোড়ে শব্দ করলে কাশফা উত্তেজিত ও ভীত হয়ে পরে। তার হঠাৎ মৃদু ইলে*ক্ট্রিক শ*ক লাগে। কাশফা দুর্বল গলায় হড়বড়িয়ে বলে,
” বলছি বলছি। প্লিজ শ*ক দিও না। তারা কী করছে বা করবে তা জানিনা। আমাকে বলেছে তাদের টার্গেট তুমি। আর কিছু না। আমার সাথে যেই লোকটা দেখা করতে এসেছে সে মূল দলের না। সেও আমার মতো তাদের সাথে কিছু উদ্দেশ্যে যুক্ত হয়েছে।”
“নাম কী তার?”
“পলাশ বলল।”
“পলাশ! কোন পলাশ?”
মাশরিফ সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল। কাশফা জবাবে বলল,
“সে তোমার বউয়ের সাথে সম্পর্কিত।”
মাশরিফের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো।
“সুজন, পলাশ?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। ওরাই।”
মাশরিফ ব্যাপারটাতে চিন্তায় পরে যায়। সুজন-পলাশই কী তবে তিতিরের জন্য ওর ক্ষতি করতে চায়? টে*রো*রি*স্টদের কী কোনো সংযোগ নেই? ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে মাশরিফ আত্মবিশ্বাসী ভাবে প্রশ্ন করে,
“টে*রো*রি*স্ট দলের সাথে ওরা কতো বছর? আর তুমি জানো এটা কতো বড়ো অপরাধ?”
“জানি। কিন্তু ওরা আমাকে অভয় দিয়েছে। আমি তোমাকে পাব না জেনে রাগে-দুঃখে ওদের কথায় এসে গেছিলাম। আর সুজন-পলাশরা নাকি প্রায় দুই বছরের বেশি সময় যাবত আছে।”
কথাগুলো বলতে বলতে কাশফা কাঁদছে। মাশরিফ বিরক্ত হয়ে বলে,
“মূল চক্র এখন কোথায় আছে বলো। কোনো জায়গার নাম যা শুনেছ। সত্য না বললে এবার হাই ভোল্টেজের শ*ক দেওয়া হবে।”
কাশফা দ্রুত বলে ওঠে,
“না না না। বলছি। শ্রীমঙ্গল ও জাফলংয়ের ইন্ডিয়ার বর্ডারের ওই পাশের কথা শুনেছি।”
“সত্যি বলছ? ওদের না ধরা অবধি তুমি এখানেই থাকবে। ট*র্চার বাড়ানো হবে।”
“সত্যি বলছি আমি। বিশ্বাস করো সত্যি বলছি।”
কাশফাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে মাশরিফ বেরিয়ে যায়। কাশফার ফোনের মাধ্যমে সুজন ও পলাশের সাথে কাশফার মতো অভিনয় করে টুকটাক অনেক কিছু জেনেও নিয়েছে। সুজন-পলাশ বুঝতেও পারেনি যে ফোনের অপরপাশের মেসেজ কর্তা কাশফা না!
সুযোগ বুঝে সুজন-পলাশকে কাশফার ফোন থেকে মেসেজ করে আর্জেন্ট আসতে বলে ফাঁদে ফেলে আটক করে। ওদেরও ফোন ছিনিয়ে নিয়ে এবার সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা করে। এবার ফোর্স বেশি সাথে।
অভি মাশরিফকে বলে,
“ওখানে সাধারণ মানুষের সাথে ওরা মিশে থাকলে চেনাটা মুশকিল হবে। প্রতিবারের মতো আমাদের উপস্থিতিতে পালিয়ে যাবে।”
মেজর সাদ বলে,
“একজেক্টলি। তবে যদি আমরা সরকারি চাল-ডাল দেওয়ার কথা বলে সবার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে আসতে বলি তবে হয়তো সহজ হবে।”
“ঠিক বলেছেন মেজর সাদ। আমরা সেটাই করব। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য ব্যাপারটা সহজ হবে। সেইসাথে আশেপাশের আরও কয়েকটা উপজেলাতেও একই কাজ করতে হবে। এতে পু*লিশ ফোর্সও আমাদের সাহায্য করবে। তারপর আমরা নীরবে আ*ক্রম-ণ করব। আমার ধীর বিশ্বাস ওরা ত্রাণ নিতে আসবে না।”
“তাই হোক। তবে।”
চলবে ইনশাআল্লাহ,