#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৯
সময়ের পরিক্রমায় আরও তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। তিতিরের ট্রান্সফার হয়ে গেছে শুধু এই মাসের আর সপ্তাহ খানেক বাকি বলে মাসটার শেষের দিকে ফরিদপুর ছাড়বে। টিউশনগুলোতেও বলে নিয়েছে। বেশি করে পড়িয়ে নিচ্ছে। মাস শেষ হওয়ার তিন চারদিন আগে তিতির একা ময়মনসিংহ যাবে। আজকে মা ও হিয়াকে ঢাকায় চাচার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করেছে। ময়মনসিংহ গিয়ে তো আর কেউ ওদের জন্য বাসা ঠিক করে রাখবে না! যা করার নিজেদের করতে হবে। নিজেদের বাড়িটাও বিক্রি করতে কিছু প্রসেস বাকি। আজ নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হোস্টেলে উঠবে। খুব অনুরোধ করে হোস্টেলে এক সপ্তাহ থাকার অনুমতি নিয়েছে। হোস্টেল সুপার দয়ালু বলা চলে। ময়মনসিংহ বাসা ঠিক করে এই বাড়ির ফার্নিচারগুলো নেওয়া ব্যাবস্থা করবে যার জন্য বন্ধুদের সহোযোগিতা প্রয়োজন।
সবকিছু মনে মনে ঠিক করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে তিতির। ভাগ্যিস পলাশ, সুজনরা এখনও পলাতক! খুবই আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই তিন সপ্তাহে পুলিশ চারবার এলাকায় এসে পলাশ, সুজনদের খুঁজে গেছে। অথচ যখন তার ভাই তিয়াস মা*রা যাওয়ার পর পুলিশ একবার কি দুইবার এসে খুঁজে গেছে। ব্যাপারটা বুঝে তিতির তাচ্ছল্য হাসে। উপর মহল থেকে প্রেশার আসাতেই এখন এতো তদারকি। এতে যে আগুন্তকের হাত আছ। বুঝতে বাকি থাকে না। তিতিরের সন্দেহ হয় সেদিনের লোকটার উপর। আগুন্তক ও মাশরিফ ইকবাল কি দুজন ভিন্ন মানুষ নাকি একজনই? সেদিন ঝড়-বৃষ্টির রাতে আলোক স্বল্পতার কারণে মাশরিফ ইকবাল নামে লোকটির মুখশ্রী দর্শণ হয়নি।
মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙে তিতিরের। নাজমা বেগম বলেন,
“তোর চাচা বলছে এখনি বের হবেন। তোরও তো যাওয়ার সময় হয়েছে।”
“হুম। বেরোও তোমরা। আমি কাল রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। বেরোব আমিও।”
তিতিরকে এবার নাজমা বেগম জিজ্ঞেসা করেন,
“এতোদিনের জমানো হাঁড়ি-পাতিল ওসব কি করব? কতোসব তো পুরোই নতুন।”
“জানিনা। যতটুকু প্রয়োজন ততোটুকু রাখব। বাকিসব সাইফ, হাসিব ব্যাবস্থা করবে।”
“আচ্ছ্। সাবধানে থাকিস মা।”
মায়ের চিন্তামিশ্রিত বুলিতে হালকা হাসল তিতির। অতঃপর বাড়ি তালা দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।
_______
মিশন শেষে দুইদিন আগে মেজর ও সৈনিকরা সেনানিবাসে পৌঁছেছে। জেনারেল মিরাজ এবার এক সপ্তাহের আগে কাউকে বের হতে দিবেন না। এবার তিনজন টে*রো*রি-স্ট ধরা পরেছে। কিন্তু এতোকিছু করেও লিডারকে ধরতে পারছে না। ধরাটা অবশ্য সহজও না কারণ ওদের মূল ঘাঁটিতো এই দেশে না।
সকাল সকাল মাশরিফ সেনানিবাসের পুরো মাঠটা চারবার চক্কর দিয়ে এখন কফি হাতে মাঠে বেরিয়েছে। কয়েকজন এখনও চক্কর দিচ্ছে। অন্যান্য শরীরচর্চা আজ কেউ করবে না। মেজর M.I. মানে মেজর মাশরিফ ইকবাল। মাশরিফ মাঠের ঘাসের উপর বসল। এক ধ্যানে পূর্ব দিগন্তে রক্তিম সূর্যের দিকে চেয়ে আছে। এক সপ্তাহ ধরে কোনো কালোমেঘ-বৃষ্টির দেখা নেই। পরিষ্কার নীল অন্তরিক্ষে শরতের শুভ্র মেঘের আনাগোনা। রোদের প্রাণোচ্ছলতায় পুলকিত নভোমণ্ডল। মাশরিফও মিষ্টি হাসল।
মাঠের মাঝে বসে মাশরিফকে হাসতে দেখে দৌঁড়ে এলো অভী। সে ইতোমধ্যে আটবারের মতো চক্কর দিয়ে ফেলেছে। আজ এতটুকুই। কাল ও আজ একটু করে করে শুরু করেছে। আগামীকাল আবার পুরোদ্দমে শুরু করবে। অভী মাশরিফের পাশে বসে চোখের সামনে হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,
“মেজর মাশরিফ ইকবাল, কোথায় হারালেন?”
মাশরিফ আলতো হাসল। কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
“প্রেয়সীর অনন্ত মায়ায় এই প্রকৃতি আমায় বারংবার প্রেমময় ডাক দেয়। কী করব বলেন?”
অভী মাশরিফের বাম হাতের বাহুতে চা*টা মে*রে বলে,
“তুই শেষ ভাই। পুরাই পা*গ*ল মজনু হয়ে ডুবে গেছিস।”
“আসলেই আমি শেষ। কোন জায়গায় মে*রেছিস খেয়াল আছে? আহ্!”
অভী খানিক দূরে সরে গিয়ে বলল,
“সরি দোস্ত। আমার মনে ছিল না। তোর তো বাম হাতের বাহুতে গু*লি লেগেছিল। বেশি ব্যাথা করছে?”
মাশরিফ আগের মতো বসে বলল,
“বেশি না। ঘা শুকানো ধরেছে। সাত-আটদিন তো হয়ে গেল। তবে দৌঁড়ানোর সময় একটু লাগে। তাই ট্রেইনার আমার এক্সারসাইজ কমিয়ে দিয়েছে। কাল তোরা পুরোদ্দমে শুরু করবি আর আমি আরও দুই তিন দিন পর।”
অভী বলল,
“ভাগ্যিস গু*লিটা একটু সাইড দিয়ে গিয়েছিল বলে। তাই তো রক্ষে। যদি বুকে লাগত তবে? তাও দেখ বাম বাহুতেই। একটু এদিক সেদিক হলেই..!”
মাশরিফ হেসে বলে,
“সোজা হৃৎপিন্ডে!”
“তুই হাসছিস? আমার তখন আত্মা বেরিয়ে যাচ্ছিল। কলেজ থেকে আমরা একসাথে। একসাথে আর্মি জয়েন করেছি। একসাথে মেজর হয়েছি। নিজের থেকেও তোকে নিয়ে ভয়ে থাকি। আন্টির তো তুইই আছিস। রিতিকা আপু তো স্বামীর বাড়ি।”
অভীর কথায় চিন্তার রেশ।
“আরে তুই বেশি চিন্তা করছিস। তোর যখন গু*লি লাগতে নিয়েছিল, সে সময় তো এতো বিচলিত হোসনি।”
“তুই সবসময় কথা ঘোরাতে ওস্তাদ। তা মেজর রাহানের বাড়িতে খোঁজ নিবি? উনাদের তো চিঠি দিয়ে জানানো হয়নি।”
“কেনো? মেজর রাহানের বোন নাকি ফোন করে তিতিরের কথার সত্যতা যাচাই করেছেন। একজন জানলেই তো হয়।”
“তা ঠিক।”
মাশরিফ হুট করে উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়ায় অভীর দিকে। বন্ধুত্বের ডাক গ্রাহ্য করার ক্ষমতা কী আছে? নাহ্। অভীও হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। মাশরিফ বলে,
“চল একটু ঘুরে আসি।”
“আচ্ছা চল।”
মাশরিফ ও অভী আশেপাশে একটু ঘুরতে বেরোল।
________
তিতির টিউশনে আধ ঘণ্টা করে বেশি পড়িয়ে নয়টার দিকে বাড়ি ফিরল। মোট চারটার মতো টিউশন করায় এখন। আগে দুটো ছিল কিন্তু এক মাস ধরে চারটা করায়। দিনে দুটো টিউশনি। নতুন টিউশনে ছাত্রীর মায়ের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। কীই বা করবে? তার আর তো কিছু করার নেই। প্রতিটা টিউশন মেডিকেল কলেজের এড়িয়ার কিছুটা দূরে মাত্র। হোস্টেল থেকে দেরিতে আসার পারমিশন নিয়েছে। মৃদুলা বলে,
“এসেছিস তবে। যা ফ্রেশ হয়ে ওখানে দুইটা সিঙারা রাখা আছে খেয়ে পড়তে বস।”
তিতির বিছানায় গা এলিয়ে বলে,
“টায়ার্ড হয়ে গেছিরে। এখন ঘুমিয়ে ভোর তিনটায় উঠে পড়তে বসব।”
“বস তাহলে। আচ্ছা শোন, ময়মনসিংহতে হোস্টেলের জন্য এপ্লাই করেছিস?”
মৃদুলার কথায় তিতির কিঞ্চিত ভাবল। তারপর বলল,
“না। করা হয়নি। এতোকিছুতে ভুলেই গেছি।”
আবারও বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“সব ভুলে যাচ্ছি। এটাই তো ইম্পরট্যান্ট।”
“ব*ল*দিরে, হোস্টেল ঠিক না করলে থাকবি কই?”
ইতিও বলাতে এবার তিতির উঠে গিয়ে সিঙারা দুটো নিয়ে এসে খেতে খেতে বলল,
“মাথা কাজ করছে না। কালকে দেখব। সামনের মাসে কোনো টিউশন থাকবে না ভেবেই আরও অস্থীর লাগছে। বাড়ি বিক্রির টাকা থেকে কিছু টাকা নিতে হবে। চাচা বললেন ময়মনসিংহতে কোনো ছোটো এক দেড় কাঠার প্লট আছে কীনা খোঁজ নিবেন। যাতে স্থায়ি কিছু হয়। কিন্তু আমার মনে হয় এখন বাড়ি, জায়গক কেনার প্রয়োজোন নাই। আমাদের স্থায়ী ঠিকানা কই হবে তা তো জানিনা।”
রিক্তা সুধায়,
“তিন চারদিনে কোনো বাসা ভাড়া পাবি? আন্টি ও হিয়াকে মাসটা নাহয় ঢাকাতেই রাখ। তবে তোর চাচা রাখবে কীনা তাও প্রশ্ন।”
“চাচা রাখলেও আমি রাখব না। এক রুমের বাসা হলেও উঠে পরব। বাড়ির অনেক জিনিসপত্র অনেক পুরানো হয়েছে। সবতো আর নিবো না। ওগুলোর এখানেই ব্যাবস্থা করে যাব।”
“দেখ তাহলে। এখন যা ফ্রেশ হ। কাল তো সকালের ক্লাসটাতেই কুইজ আছে।”
“হুম”
তিতির ফ্রেশ হতে চলে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১০
সুন্দরবনের ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে গাছের গুড়ির উপর বসে আছে কিছু লোক। তাদের সাথে সুজন, পলাশরাও আছে। এই স্থানে সচরাচর বন্য প্রা’ণীদের আনাগোনা থাকলেও লোকগুলো আ*গু*ন জ্বালিয়ে বসেছে তাস খেলতে। এক লোক বলে ওঠে,
“মেজর মাশরিফকেও বন্ধি করতে হবে। কিন্তু ওর দুর্বলতা কি?”
আরেকজন বলে ওঠে,
“এর মা?”
“আরে মা তো সবারই দুর্বলতা থাকে। তাছাড়া মেজর মাশরিফ তার মাকে নিজের কাছে তখনি আনেন যখন সে ছুটিতে থাকে। কিন্তু এমনিতে মেজর মাশরিফের মায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। অন্য উপার খুঁজতে হবে। যেমনটা মেজর রাহানের সাথে করা হয়েছে!”
সুজন নে*শাদ্রব্যে টান দিয়ে বলে,
“ওই মেজর রাহান আছিল একটা ব*ল*দ! ও বিশ্বাস করছে ওর বউ আমার লগে শু*ই*ছে! ওই মেজর মিশনে যাওয়ার দিনই তো তিতির বউভাতের পর বাপের বাড়ি আইছিল। তিতিরের বিয়া ঠিক হইছিল তা তো পরে জানছি। একটা মা*মলার লাইগ্যা পলায় আছিলাম। এলাকায় ফিরার পরেও জানতাম না তিতিরের বিয়ার কথা চলে। জানছি ওর বিয়ার দুইদিন আগে। ওর বিয়ার তিনদিন আগে এই মেজর রাহান এলাকায় আইয়া চায়ের দোকানে আমারে সামনেই জিগায়, ‘তিয়াস আহমেদের পরিবার কেমন? কোনো খারাপ রেকর্ড আছেনি? তার বোইনে কই পড়ে? চলাফেরা কেমুন?’ তহন ওই মেজর আর্মির পোশাকে আছিল বইল্যা মুই মুখে কুলুপ অ্যাইটা আছিলাম। আমার তো তহন অতোকিছু মাতায় আহে নাই। সবার থিকা ভালা শুইনা মেজর আমার পাশে বইসা চা খাইয়া গেছে। তহন যদি জানতাম তয় তহনি কথা লাগায় দিতাম। বিয়া করত না আমার ময়না পাখিডারে। এহন মেজর নাই, ময়না পাখিডারে খাঁচায় বন্ধি কইরাই ছাড়মু।”
টে*রো*রি*স্ট লোকগুলোর মধ্যে একজন বলল,
“তোমরা সাহায্য করাতেই মেজর রাহানকে জালে ফাঁসাতে পেরোছি। এখন মেজর মাশরিফেরটাও খুঁজে বের করো। এভাবে সদস্য কমতে থাকলে কেউ কাজে আগ্রহ পাবে না।”
পলাশ বলে,
“খুঁজতে হইব। মেজর মাশরিফ তো আমাগো এলাকার না
তয় লিংক খুঁজতে হইব। আর সপ্তাহ পর এলাকায় যামু। এহন গেলে ঝামেলায় পরমু। এলাকার এক ছোটোভাই কইল, পু*লিশ নাকি তিন-চার বার খুঁইজা গেছে। তিতির, হিয়াগো বাড়িতে নাকি নিরাপত্তার ব্যাবস্থা লাগায় রাখছে। যে খবর দেয় ওয়ও দিনের বেলা বাড়িততে বাইর হয় না। সন্ধ্যার পর চা-পানের লাইগ্যা দোকানে বইলে নাকি শুনছে।”
আরেকজন টে*রো*রি*স্ট বলল,
“ব্যাপারটা সন্দেহজনক। তিয়াসকে যখন গাড়ি চা*পা দিয়ে মা*র*লে তখনও পু*লি*শ এতোবার আসেনি।”
“এইডাই তো বুঝি না বা*। কেডা এমনে পিছে লাগছে?”
পলাশ কিছুক্ষণ অশ্রাব্য গালিগালাজ করে আবার নে*শা-দ্রব্য সেবনে মন দেয়।
___________
ময়মনসিংহতে তিতিরের থাকার জন্য হোস্টেলের ব্যাবস্থাও হয়ে গেছে। একদিনেই ব্যাবস্থা হওয়াতে তিতির দারুণ অবাকও হয়েছে। এদিকে বাড়ি বিক্রির প্রসেস প্রায় শেষ। তিতিরের একাউন্টে টাকাও ট্রান্সফার শেষ। তিতির ব্যাংকে গিয়ে মা ও হিয়ার একাউন্টে সমান করে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছে সাথে কিছু টাকা তুলেও নিয়েছে সামনের মাসে যে টিউশন থাকবে না তাই। বাড়ির যেসব জিনিসপত্র ময়মনসিংহ নিবে সেগুলোকে আর্মির ট্রাক দিয়েই সেনানিবাসের ভিতরে রাখা হয়েছে। বাসা ভাড়া পেলেই নিয়ে যাবে। কম তো না! তিনটা খাট, দুইটা আলমারি, সোকেস, ফ্রিজ, সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল, পুরোনো একটা টিভি, তিনটা ওয়ারড্রবের দুইটা নিবে আরেকটা ঘুণে খে’য়ে ফেলেছে তাই নিবে না। প্রয়োজনীয় হাঁড়ি-পাতিল ও ডিনার সেট নাজমা বেগম ও হিয়া সেদিনই নিয়ে গেছিল। বাকি যেসব নিবে সেসব তিতির নিজের লাগেজে কাপড়ে পেঁচিয়ে নিবে। তিনটা লাগের নিচ্ছে এর জন্য। অন্য শহরে পাড়ি জমাতে এতো ঝামেলা তা এই কদিনে ভালোই বুঝেছে।
আজ শুক্রবার। হাসিব, সাইফ, মৃদুলা, ইতি, রিক্তা সবাই তিতিরকে বিদায় দিতে মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের কাছে এসেছে। সবার চোখে পানি। তিতির এই শহরে আর ফিরবে না। তিতির চারদিকে চোখ বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে সবটা দেখে নিলো। বন্ধুদের সাথে কতো মন খারাপ, দুষ্টুমি, আনন্দের স্মৃতি এই স্থানটায়। কপোল বেয়ে গড়ানো নোনাজলের ধারাকে দুই হস্তের তালুর দ্বারা অবরুদ্ধ করল। নাক টেনে কণ্ঠে সংক্রিয়তা এনে বলে,
“এই তোরা কাঁদছিস কেনো? আমি এই শহরে ফিরব না বলেছি কিন্তু তোদের সাথে দেখা করতে আসব না তাতো বলিনি। তোরা কেউই তো এই শহরে স্থায়ি না। একদিন এই মেডিকেল প্রাঙ্গণ তো ছাড়তেই হবে। আমি নাহয় একটু আগেই ছাড়লাম।”
ইতি তিতিরকে এসে জাপটে ধরে। মেয়েটা গতকাল রাত থেকেই কাঁদছে। একটু বেশিই আবেগী কী-না! ইতি ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,
“অ্যাই উইল মিস ইউ।”
“মিস ইউ ঠু। তোর নাদুসনুদুস গালগুলো আবার কবে টানব এটা তো বিধাতাই জানেন।”
তিতিরের আহ্লাদী সংলাপে ইতি আরও আবেগী হয়ে পড়ে। সাইফ বলে,
“তোরাও কি সাথে বাসস্টপ পর্যন্ত যাবি?”
মৃদুলা চোখের কোণা মোছে ভাঙা কণ্ঠে বলে,
“হুম। আবার কবে দেখা হবে তা তো জানিনা। শেষ পর্যন্ত সাথে যেতে চাই।”
রিক্তা নিজের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করে তিতিরের হাতে দিয়ে ঠোঁটকোলে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে,
“পড়াশোনার ব্যাস্ততা ও সংসার চালানোর জন্য হয়তো সবসময় কথা বলার সময় পাবি না। তাই নিজেকে একা লাগলে এই ছোটো ডায়েরিরটা দেখিস। আমাদের এই দুই বছরের অনেক স্মৃতি বন্ধি আছে। আমার খুব যত্নে গড়া। সামলে রাখিস কিন্তু।”
তিতির রিক্তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কান্না সংবরণ করতে পারে না। এই পাঁচজন দুই বছরের সবসময় তার পাশে ছিল। নতুন ক্যাম্পাসে গিয়ে কি এমন কাউকে পাবে? জানা নেই তিতিরের। ওরা বাসস্ট্যান্ডের জন্য রওনা হলো।
তিতিরকে বাসে উঠিয়ে বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিল। বাস ছেড়ে দিলে তিতির বাসের সিটে গা এলিয়ে দেয়। গন্তব্য নতুন। সূচনা কেমন হবে তা নিয়ে সংশয়।
________
মাগরিবের নামাজ পড়ে সেনানিবাসের নিজেদের রুমে এসেছে মাশরিফ ও অভী। হঠাৎ মাশরিফের ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে মা মহিমা বেগমের নাম্বার দেখে মুচকি হাসে সে। রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,
“কেমন আছো মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। আমি সবসময় ভালো থাকি। তুই মিশন থেকে ফিরে দুইদিন আমার ফোন রিসিভ করিসনি তাই আমি তোকে চার দিন ফোনই করিনি। এখন দেখছি আমার ছেলে আমাকে ভুলতে বসেছে!”
মায়ের অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে মাশরিফ মুচকি হাসে। সে তো মায়ের কাছে গু*লি লাগার বিষয়টা লুকাতে কয়দিন ফোন রিসিভ করেনি। মা তার খুব চিন্তাপ্রিয় মানুষ! মাশরিফ বলে,
“আর তিনদিন পর হাজির হবো। দেখো শুধু। তুমি কি কোয়াটারে আছ তো?”
“তো আর কই থাকব? তুই না থাকলে আমাকে এই ক্যাডেট কলেজের কোয়াটারেই থাকতে হয়। তোর যে কেনো এতো ভয় বুঝি না।”
মহিমা বেগমের অভিমান এখনও কমেনি। মাশরিফ বলে,
“তোমার এতোগুলো ছেলে থাকতে আমার কথা মনে পড়ে? তোমার তো ওদের সারাদিনের এক্টিভিটি দেখতে দেখতেই দিন পেরিয়ে যাওয়ার কথা। বিকেলে বড়ো মাঠটার পাশের রাস্তা দিয়ে সবটা চক্কর দাও তো? তোমার সুগার লেভেল কেমন?”
মহিমা বেগম বলেন,
“দেই তো। কম বড়ো মাঠ ওটা? তুই যে একজনকে আমার উপর নজর রাখতে রেখে গেছিস, ওই ছেলে বিকেল হলেই নিজের খেলাধুলো রেখে আমাকে নিয়ে দুইবার করে মাঠে চক্কর দেয়। কিন্তু বাবু, আমি যে ছেলেদের খেলার মাঝে তোকে খুব করে মিস করি।”
মাশরিফের নিজেরও এবার খারাপ লাগছে। ছোটো থেকে এই ক্যাডেট কলেজের মাঠেই খেলাধুলো করে বেড়ে উঠা তার। মা ওখানকার শিক্ষিকা হওয়াতে আরও সুবিধা হয়েছে। তবে মায়ের চাকুরির আর তিন বছরের মতো আছে। নিজেও তো এই ক্যাডেট কলেজের ছাত্র! অভীর সাথে বন্ধুত্ব কলেজ থেকে। আগে খুব একটা কথা হতো না অভীর সাথে কিন্তু কলেজ থেকে ফুটবল টিমে দুজনের বন্ধুত্বের শুরু। আরও বন্ধুরা সবাই তো আর্মিতে জয়েন হয়নি।
মাশরিফ আদুরে কণ্ঠে বলল,
“অ্যাই মিস ইউ ঠু, মা। খুব শিঘ্রই দেখা হবে ইনশাআল্লাহ্।”
“ইনশাআল্লাহ্।”
ফোন কে*টে দেওয়ার পর অভীর দিকে তাকালে দেখে অভী এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মাশরিফ ইশারাতে সুধালে অভী বলে,
“গু*লি লেগেছে এটা আন্টিকে তুই জানাতে না চাইলেও তুই বাসায় গেলে আন্টি এমনিতেই জানবে। ছুটির পর বাসায় গেলে আন্টি তোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে।”
মাশরিফের ভাবলেশহীন জবাব,
“করুক। সে যা করে শান্তি পায়। আমার সামনে চিন্তা করুক আমি সামলে নিব কিন্তু আমার আড়ালে চিন্তা করে বিপি হাই করে বসে থাকবে তারপর আমার চিন্তা দ্বিগুণ করবে।”
হুট করে অভী হেসে ফেলে মাশরিফও হাসে। অতঃপর দুইজনে ড্রেস বদলে ডাইনিংয়ে যায় সন্ধ্যার নাস্তার জন্য।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।