#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
ময়মনসিংহতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। তিনটা লাগেজ অতি সাবধানে নামিয়ে এখন সিএনজি খুঁজছে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। একা মেয়ে দেখে সিএনজি ড্রাইভাররা অধিক ভাড়া দাবি করছে। প্রায় দশ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে রইল। অচেনা শহর, অচেনা রাস্তা। কোনদিকে কই যাবে কিচ্ছু বোধগম্য হচ্ছে না তিতিরের। সিএনজি ড্রাইভাররাও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে মেয়েটা এই শহরের কিছু চিনে না। সিএনজি ড্রাইভাররা যতো ভাড়া চাচ্ছে ততোটা তার বাস ভাড়ার থেকেও অনেকটা বেশি। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর এক বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এসে বলল,
“মা, কই যাইবা?”
তিতির হকচকিয়ে তাকায়। এই অচেনা শহরে এতো কোমল স্বরে তাকে ডাকার মানুষটার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। রাস্তার স্বল্প আলোতে যেটুকু দেখা সম্ভব হলো তাতে তিতির বুঝল লোকটা অধীর আগ্রহে তিতিরের দিকে চেয়ে আছে। তিতির হালকা হেসে বলল,
“মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে যাব চাচা।”
“তয় লও আমার গাড়িতে। ভাড়া লইয়া চিন্তা কইরো না। মেডিকেল কলেজের ওইহানেই আমি থাকি। ন্যায্য ভাড়াই রাখমু। অনেকক্ষণ ধইরা খাড়ায় আছো। লও আমি পৌঁছায় দেই।”
তিতিরেরও আর দামাদামি করতে ইচ্ছে হলো না। লোকটাকে বিশ্বাস করতে মন সায় দিলো। লাগেজ গুলো বৃদ্ধ ড্রাইভারের সাহায্যে গাড়িতে তুলে নিলো। তারপর তিতির গাড়িতে বসলে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল। ড্রাইভার বলতে লাগে,
“আমি মেডিকেল কলেজের ওখানেই থাকি। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা আমারে খুব ভালো পায়। কিছু হইলেই আমারে ফোন কইরা কইব, ‘চাচা জলদি আসেন। এক জায়গায় যাইতে হইব।’ আমিও আর কী! যাই। সন্তান থাকতেও নিঃসন্তান আমি। ওরা পাশে আছে বইলা শান্তি লাগে। আমার ও আমার স্ত্রীর চিকিৎসার খরচও ওরাই চালায়। এতো মানা করি শোনেই না।”
বৃদ্ধ ড্রাইভার চাচার কথা শুনে তিতিরের মুখে হাসি ফুটল। তিতির বলল,
“আজ থেকে তবে আপনি আরেকটা মেয়ে পেলেন। আমাকেও ওদের মতো রাখবেন?”
“রাখমু না ক্যান? অবশ্যই রাখমু।”
তিতির মুচকি হাসল। ক্লান্তিতে চুপ করে রইল। কিছু সময় পর গন্তব্যে পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে বলে,
“ধন্যবাদ চাচা। ভালো থাকবেন। আমার জন্যও দোয়া করবেন।”
“তুমিও ভালা থাইকো মা।”
তিতির লাগেজগুলো নিয়ে হোস্টেলের ভিতরে গেলো। তিতিরের প্রস্থানের পর বৃদ্ধ ড্রাইভার চাচার ফোনে কল আসে। তিনি ফোন রিসিভ করে সালামের জবাব দিয়ে বলে,
“হ বাবা। নামাইয়া দিয়া গেছি। মাইয়াটা একলা খাড়ায় আছিল। মাইয়াডা তোমার কিছু হয়?”
“আরে না চাচা। ফ্রেন্ডের কথায় এসব করছি।”
“ওহ। আমি ভাবলাম তোমার কিছু হয়। সমস্যা নাই।”
“আচ্ছা চাচা।”
অর্ক ফোন রেখে বলে,
“এই রাফি, মাশরিফরে মেসেজ করে জানা। আমি ওয়াশরুমে গেলাম।”
এই বলে অর্ক ওয়াশরুমে দৌঁড় দেয়। শুভ বলে,
” রাফি ফোন দে। নেটে নাই দেখলাম।”
“তুই দে। আমার ফোনে টাকা থাকলে তো চাচারে আমিই ফোন দিতাম। ব্যালেন্সের মেয়াদ শেষ। কালকে সকালে ব্যালেন্স নিতে হবে।”
রাফির কথায় শুভ মাশরিফকে ফোন লাগায়। মাশরিফ যেনো ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। ফোন রিসিভ করে সরাসরি বলে,
“তিতির এসে পৌঁছেছে?”
শুভ বিরস কণ্ঠে বলে,
“ফোনটা ধরেই আমাদের কোনো খোঁজ-খবর না নিয়েই সরাসরি প্রেমিকার খবর জিগাস। যা তোরে কমু না।”
শুভ সাথে সাথে কল ডিসকানেক্ট করে দিল। রাফি অবাক হয়ে বলল,
“ফোন যখন দিছিস তো কথাটা বলেই কা’টতি।”
শুভ দাঁত বের করে হেসে বলে,
“এখন ও ফোন দিবে। দেখ খালি।”
সত্যি সত্যি মাশরিফ ফোন দিল। খুব আয়োজন করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেসা করে,
“কেমন আছিস তোরা? বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নাই।”
“হইছে থাম। আমরা সবাই ভালো আছি। তোর তিতিরপাখিও হোস্টেলে এসে পৌঁছে গেছে। শান্তি?”
মাশরিফ স্বস্থির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“থ্যাংকিউ রে। আমি আর দুইদিন পর টাংগাইল আসব। তারপর আম্মুকে মির্জাপুর থেকে বাসায় নিয়ে আসব। তোদের সাথেও দেখা করব।”
শুভ রম্যস্বরে বলে,
“আমাদের সাথে? নাকি…!”
মাশরিফ হালকা হেসে বলে,
“তোদের সাথেই দেখা করতে আসব যতোদিন থাকব। তার মধ্যে একটুখানি সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম আরকি!”
“তুই মিয়া বহুত চালাক। তা আন্টিকে বলছিস?”
শুভর প্রশ্নের জবাবে মাশরিফ ঘন নিঃশ্বাস ফেলে। হতাশ স্বরে বলে,
“নাহ্! অনেক কিছু মাকে জানানোর আছে। আগের হৃদপ্রিয়া তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করুক।”
রাফি, শুভ, অর্ক সমস্বরে বলে ওঠে,
“কবুল হোক।”
মাশরিফের সাথে বসে অভীও বলে,
“কবুল হোক।”
মাশরিফ হেসে ফেলে। বলে,
“একদিন রাতুল, রণিতকেও বল না রাজশাহী থেকে আসতে। সাত বন্ধুর একটা ছোটোখাটো গেট-টুগেদার হয়ে যাক।”
“হ্যাঁ বলব। ওরাও বলছিল।”
রাফির জবাবে মাশরিফ বলে,
“আচ্ছা থাক তবে। নামাজ পড়ে নেই।”
“বায়।”
বন্ধুদের কথা শেষ হলে মাশরিফ ও অভী নামাজ পড়তে যায়। নামাজের পর ডাইনিংয়ে যাবে ডিনারের জন্য।
_______
হোস্টেল সুপার তিতিরকে তিতিরের রুম দেখিয়ে দিল। রুমে আরও দুইজন আছে। হোস্টেল সুপার বললেন,
“শুনো তিতির, এখানে এরা ফরেন স্টুডেন্ট। অন্য রুমে তোমাকে দেওয়া হয়নি। মেয়েরা খুব ভালো। আশা করি মিলে চলতে পারবে।”
তিতির কৃতঙ্গতা প্রকাশ করে বলে,
“ধন্যবাদ মেম। আমি চেষ্টা করব ওদের সাথে বন্ধুত্ব করার।”
হোস্টেল সুপার চলে গেলে তিতির ব্যাগগুলো নিয়ে নিজের বেডে বসে। পাশের বেড থেকে এক মেয়ে বলল,
“হ্যালো। মাইসেল্ফ লিরা।”
“হ্যালো। মাইসেল্ফ তাহিয়া নূর তিতির।”
তিতিরের প্রত্যুত্তরে লিরা বলে,
“টোমার নামটা খুব বড়ো। ক্যান অ্যাই কল ইউ টিটির?”
তিতিরের বিষম লেগে যায়। তিতির বলে,
“টিটির না। তিতির। ইংলিশে টি হলেও বাংলাতে ত উচ্চারণ হয়।”
লিরা মিষ্টি হেসে বলে,
“সরি টিটির। অ্যাই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড বাংলা বাট সাম ওয়ার্ড..!”
তিতির হেসে বলে,
“ইটস অকে। ইউ ক্যান কল মি টিটির।”
“থ্যাংকস। ইট উইল টেক সাম টাইম টু প্রনাউন্স। ফার্স্ট টাইম বাঙালি রুমমেট। হেই টিটির, মিট মাই ফ্রেন্ড জুলিয়া। আমাদের বাংলাদেশ অনেক ভালো লাগে। দ্যাটস হোয়াই উই আর হেয়ার। ইউ নো? বোথ অফ আওয়ার প্যারেন্টস আর বাংলাদেশী। বাট দে আর নো মোর।”
তিতির মলিন হাসলো। এতো সুন্দর প্রাণোচ্ছল মেয়েগুলোকে দেখে মনেই হয় না ওরা পরিবারহীন। তিতির বলল,
“সরি।”
“নো নো। ইটস অকে। টুমি রেস্ট নাও।”
তিতির হালকা হেসে হাত-মুখ ধুঁতে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে মা ও হিয়াকে ফোন করে সব জানায়।
_______
নতুন ভোর। স্নিগ্ধতায় ভরপুর। নতুন শহরে প্রথম সকালটাতেই মন ভালো হয়ে গেলো তিতিরের। আজকে এখানে প্রথম ক্লাস করতে যাবে। একটু ভয় ভয় করলেও অন্যরকম উৎসাহ কাজ করছে। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ কফির মগ এগিয়ে দিলে তিতিরের ভ্রুঁ কুঁচকে আসে। পাশ ফিরে চাইলে দেখে লিরা। লিরা চমৎকার হেসে বলে,
“গুড মর্নিং।
তিতিরও হেসে বলে,
“গুড মর্নিং।”
কফি?”
তিতির লিরার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে বলল,
“থ্যাংকিউ।”
লিরা নিজে নিজেই তিতিরকে অনেক কিছু জিজ্ঞেসা করা শুরু করে। তিতিরও ওর সাথে তাল মিলাচ্ছে। রুমমেট নিয়ে তিতির দারুণ খুশি কিন্তু বেশিদিন তো থাকতে পারবে না।
কফি শেষ করে ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। তিতির জানতে পারে লিরা ও জুলিয়া তিতিরের ব্যাচমেট। তিনজন একসাথে ক্লাসে যায়। প্রথমদিন হিসেবে দুইজন নতুন ফ্রেন্ড পেয়ে ভালোই লাগছে। ক্লাসে গিয়ে লিরা ওর অন্য ফ্রেন্ডদের সাথে তিতিরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
ক্লাস শেষে লিরা ও জুলিয়া তিতিরকে ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাতে থাকে। পথে ইন্টার্নের শেষের দিকে থাকা রাফি, অর্ক, শুভদের সাথেও দেখা হয়ে যায়। অর্ক নিজ থেকে এগিয়ে এসে একটু না জানার ভান করে তিতিরকে বলে,
“তুমি কে? নতুন দেখছি আজ। ফ্রেশারদের তো আসার এখনও সময় হয়নি।”
তিতির ভয়ে কাঁচুমাচু অবস্থা। র্যা*গিং এর শি*কার হবে কী-না ভয়ে আছে। স্বল্প শব্দে বলে,
“ভাইয়া আমি মাইগ্রেশন করে ফরিদপুর থেকে এখানে এসেছি।”
“ওহ আচ্ছা। তা লিরা, জুলিয়ার সাথে উঠেছ নাকি?”
লিরা অর্কের এমন অভিনয় দেখে মুখ কুঁচকে নেয়। পরশুদিনেই তো অর্ক ও শুভ এসে লিরা ও জুলিয়াকে তাদের নতুন রুমমেটের কথা জানিয়েছিল। অর্কের এই প্রশ্নের জবাব লিরা মুচকি হেসে দেয়,
“ইয়েস ব্রো। উই আর রুমমেট!”
অর্ক জোরপূর্বক হেসে বলে,
“আচ্ছা থাক তবে। পরে কথা হবে।”
জুলিয়া মুখে হাত দিয়ে হাসছে। অর্ক, রাফি, শুভ চলে গেলে ওরাও তিতিরকে নিয়ে ঘুরতে থাকে। পরবর্তী ক্লাস শুরু হতে এখনও সময় বাকি।
________
সুজন, পলাশরা এলাকায় এসেছে ভোরে। এসেই তিতিরদের বাড়ির কাছে গেছে। উুঁকিঝুঁকি দিয়ে নিজেদের বাড়িতে চলে গেছে। ওরা তো বুঝতেও পারল না। তিতিররা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে!
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১২
সুজনরা এলাকায় আসা মাত্রই পু*লি*শের কানে খবর চলে গেছে। সুজন ও পলাশরা দুপুরের দিকে ঘুম থেকে উঠে মোড়ের দেকানে এসে বসে চা-পানি খাচ্ছে সাথে হাসি-তামাশা করছে তখনি ওদের সুখের অন্তরায় হয়ে পুলিশ হাজির হয়। আচমকা ঘটনায় সুজন, পলাশ ও তাদের সঙ্গীদের বিষম খাওয়া অবস্থা। ওরা পালানোর জন্য দৌড় দিবে তার আগেই পু*লিশ ওদের ঘেরাও করে ফেলে। পুলিশের একজন অফিসার সুজনের কলার ধরে বলে,
“চল এবার। অনেক ঘুরাইছিস।”
সুজন এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আমারে ধইরা নিবি অফিসার? তোর বড়ো অফিসারও আমার কথায় উডে বহে।”
পলাশ বলে,
“অতো সোজা নিহি? দুইদিনও রাখতে পারবি না। এই অফিসার মনে হয় নতুন। আমরা এলাকায় আছিলাম না তাই পকেট ভরতে পারে নাই।”
পুলিশ অফিসার নাদিম মুচকি হেসে বলল,
“ঠিক বলেছিস, পকেট ফাঁকা আমার। যার পকেট ভরেছিস তাকে বান্দারবান ট্রান্সফার করা হয়েছে। তাই তোদের জে*লে ভরতে এসেছি।
সুজনের এবার মাথায় হাত। কীভাবে বাঁচবে উপায় খুঁজছে। পু*লি*শের পায়ে পা*রা দিয়ে পালাতে চাইলে অফিসার হ্যা*ন্ডগা*নের পশ্চাৎ দিয়ে সুজনের মা*থায় আঘা*ত করে। আ*ঘা*তে সুজন ব্যাথায় কাঁকিয়ে উঠে যা দেখে পলাশ চুপসে যায়। তারপর পু*লিশ হাতে হ্যা*ন্ডকাফ পড়িয়ে সুজন ও পলাশকে গাড়িতে তোলে থানায় নিয়ে যায়।
________
ময়মনসিংহ আসার দুইদিন পেরিয়ে গেছে। আজ বিকেলে ক্লাস শেষ করে তিতির বাসা খোঁজার জন্য একটু বেরিয়েছে। দুইদিনে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে লিরা ও জুলিয়া তিতিরকে পুরো ক্যাম্পাস দেখিয়েছে। সেই সাথে আরও দুয়েকজন বন্ধুও হয়েছে। তিতিরের সাথে বাসা খোঁজার জন্য লিরা ও জুলিয়াও আসতে চেয়েছিল কিন্তু জুলিয়ার হঠাৎ অসুস্থতা ও লিরার জুয়েলারির কালেকশন ও মেইকওভার প্রডাক্ট, কসমেটিকস নিয়ে লাইভে যেতে হবে বলে আসা হয়নি। বলা বাহুল্য যে, লিরা ও জুলিয়া অনলাইনে বিজনেস করে নিজেদের খরচ চালায়। তাছাড়া সরকারি মেডিকেল তাই এতেই ভালো করে চলতে পারে।
তিতির যেটুকু চিনে আবার হোস্টেলে ফিরতে পারবে অতোটুকুই খুঁজতে গিয়েছে। একটা বাসা পেয়েছে কিন্তু রুমও বেশি এমনকি ভাড়াও বেশি। রুম তিনটা সাথে ডাইনিং আলাদা। ভাড়া চেয়েছে নয় হাজার। এতো বড়ো ফ্যামিলি বাসা তো ওদের দরকার নেই। হিয়া বাচ্চা নিয়ে নাজমা বেগমের সাথেই থাকবে বলেছে। তাছাড়া এতো টাকা ভাড়াতে দিতেও কষ্ট হয়ে যাবে। তাই সেটা আর নিল না। আজকের মতো খোঁজা এখানেই ইতি টানল।
সামনে একটা কদম গাছ। গাছের নিচে ঝড়ে পরা কদম ফুলের চিহ্ন পরিলক্ষিত। বর্ষাকালের প্রমাণ এখনও প্রকৃতিতে দৃশ্যমান। অথচ শরতের আগমন ঘটে গেছে। তিতির দেখল এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি খুব একটা চলাচল করে না। সিএনজি, প্রাইভেটকার ক্ষণে ক্ষণে আসে আর রিকশা। ফুটপাতে মানুষজন হাঁটছে। তাই সেখানে বসল। একটা পরে থাকা অর্ধ কদমফুল তুলে নিলো। কদমফুল তার প্রিয়দের তালিকাভুক্ত। কোন ফুল যে তার প্রিয়র তালিকায় নেই তা সে নিজেও জানে না। আকাশপানে চেয়ে আঁখিজোড়া মুদিত করে নিলো পরক্ষণেই চোখ মেলে আকাশপানে তাকালো। গোধূলির রক্তিম আভা যেনো পশ্চিম আকাশে রঙতুলিতে ছিঁটে দেওয়ার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। মৃদু-মন্দ সুনীলে মন প্রশান্তিতে ভরপুর। বহুদিন পর এভাবে ফুটপাতে একা বসল। শেষ বার কবে বসেছিল মনে করতে পারছে না। খানিকদূরেই তিতির দেখল এক আইসক্রিম ওয়ালা যাচ্ছে। লোকটা বরফ মালাই আইসক্রিম বিক্রি করে। তিতিরের ওষ্ঠকোণে হাসির রেখা ফুটল। আইসক্রিম বিক্রেতার কাছে গিয়ে বলল,
“চাচা, দুইটা আইসক্রিম দেন তো।”
আইসক্রিম ওয়ালার ফোঁকলা মুখে হাসি ফুটল। জিজ্ঞেসা করল,
“কয় টাকা কইরা দিমু মা?”
“আপনি বলেন আগে।”
তিতিরের জবাবে আইসক্রিম বিক্রেতা প্রত্যুত্তর করল,
“পাঁচ টাকা কইরা নিলে পাত্রটাও খাইতে পারবা। আর দশ টাকা কইরা নিলে প্লাস্টিকের কৌটাতে দিমু।”
তিতির গালে হাত দিয়ে কিয়ৎ ভাবল। অতঃপর বলল,
“পাঁচ টাকা করে দেন চাচা। আমার রা*ক্ষ*সী মন পাত্র সহ খে’য়ে নিতে চাইছে।”
বলেই তিতির হেসে ফেলল। তিতিরের এই মুগ্ধ করা হাসি কারও ক্যামেরায় ফোকাস হলো। আড়াল থেকে হৃদপ্রিয়ার প্রাণোচ্ছলতা উপভোগ করার মাঝে দারুণ এক আনন্দ আছে।
আইসক্রিম ওয়ালার পাওনা মিটিয়ে দুই হাতে দুইটা আইসক্রিম নিয়ে ভাবল একটা ছবি তুলবে। হাতে থাকা কদম ফুলটার নষ্ট হওয়া সাদা পাঁপড়িগুলোকে তুলে ফেলে দিল। তারপর শুধু সূর্যের ন্যায় হলুদ অংশটা রাখল। বাম হাতে কদম ফুল ও দুইটা বরফ মালাই আইসক্রিম নিয়ে চটজলদি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে পশ্চিম কোণে ডুবন্ত রক্তিম সূর্য অভিমুখে আকাশপানে হাত উুঁচাল। অতঃপর দুই ক্লিকে দুইটা ছবি তুলে নিয়ে আবারও ফুটপাতের ওই জায়গাটাতে বসল। আইসক্রিম গলে যাওয়ার দরুণ হাত বেয়ে বরফ গলা পানি পরা শুরু করেছে। অতিসত্তর যদি না খায় তবে আর খাওয়াই হবে না। তাড়াহুড়ো করে একটা আইসক্রিম পুরোটা মুখের ভিতর পু*ড়ে দেওয়া মাত্রই ঠান্ডায় নাক, কান, দাঁত শিরশির করে ওঠল। চোখে-মুখ খিঁচে পরেরবার এই বোকামি না করার মনস্থির করে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। এবার যে ফিরতে হবে। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে এখনও সন্ধ্যা নামার ঢের সময় বাকি কিন্তু প্রভাকর যে আজকের মতো নিদ্রাতে চলে গেছে!
কিছু পথ হাঁটতেই আজান পরলো। তিতির একটু থেমে দাঁড়াল। এক মসজিদে আজান শেষ হলে আবার হাঁটা ধরল। পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে মেডিকেল কলেজ এড়িয়াতে এসে পড়েছে। এবার দেখা মিলে সেই বৃদ্ধ ড্রাইভার চাচার সাথে। তিতির ভাবল, রাতে পড়ার সময় খিদে পেলে খাওয়ার জন্য বিস্কিট, চকলেট কিনে নিয়ে চাচার সাথে একটু সালাম বিনিময় করবে। দোকান থেকে জিনিসপাতি কিনে সেখানে এসে দেখে ড্রাইভার চাচা নেই। তিতির এবার হোস্টেলে ফিরতে উদ্ধত হলে একজন ডাক দেয়,
“এই মেয়ে!”
তিতির ঘাবড়ে তাকাল। দেখল তার সিনিয়র। সেদিন যেই ছেলেটা লিরা, জুলিয়াদের সাথে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার সময় এসেছিল সেই ছেলেটা। সাথে আরও তিনজনকে দেখা যাচ্ছে। একজনের চেহারা স্পষ্ট কিন্তু বাকি দুইজনের চেহারা অস্পষ্ট। ছেলেটা বলে,
“এদিকে আসো।”
তিতির খানিক আগায়। ভাবতে থাকে কোনো ভুল করেছে কী-না!
“তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি অর্ক। ওইদিন যে কথা হলো।”
অর্কর পরিচিতি পর্বে তিতির হাসার চেষ্টা করে বলল,
“জি চিনেছি ভাইয়া।”
অর্ক আবার জিজ্ঞেসা করে,
“কোথায় গিয়েছিলে? সিনিয়রদের সালাম দিতে হয় জানো না?”
তিতির থতমত খেয়ে সালাম দেয়। পাশ থেকে এক পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
“অর্ক, ওকে যেতে দে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিছু বলার হলে বল নয়তো শুধু শুধু সময় নষ্ট করছিস।”
তিতিরের কাছে কণ্ঠস্বর কিঞ্চিত পরিচিত ঠেকল কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছে না। লোকটার মুখশ্রীও দৃশ্যমান না।
এবার শুভ নামের ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল,
“তোমাকে বিকেলে ক্যাম্পাস থেকে একা বের হতে দেখেছিলাম। তুমি তো মাইগ্রেশন করে এসেছ। এই শহর চেনো?”
“না। মানে এমনি বেরিয়েছিলাম।”
তিতিরের জবাবে শুভ বলে,
“ওহ আচ্ছা। কোনো হেল্প লাগলে বলতে পারো। আমাকে না পেলেও রাফি ও অর্ককে পাবেই।”
শুভর কথায় ওর বন্ধুরা বিরক্ত হলোম রাফি শুভর মাথায় চা*টা মে*রে তিতিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি যাও এখন। কোনো হেল্প লাগলে জানাবে।”
তিতির মাথা নাড়িয়ে আবার সালাম দিয়ে চলে আসে।
তিতির চলে গেলে মাশরিফ এবার ঘুরে তাকায়। সে আজই এসেছে। প্রথমে টাঙাইল যাওয়ার বদলে এখানে এসেছে। বিকেলে এসেই তিতিরকে বের হতে দেখে পিছু নিয়েছিল। শুভ ও রাফি মাশরিফের কাঁধে হাত রাখে। রাফি বলল,
“তুই কি খুব আয়োজন করে নিজের মুখ দর্শন করাবি? নাকি ভয় পাচ্ছিস?”
শুভ মজার ছলে বলে,
“সুদর্শন পুরুষদের একটু বেশিই ঢঙ থাকে। আমি তো বুঝি না তুই রোদের মধ্যে সারাদিন দৌঁড়-ঝাঁপ করে রাফির মতো ফর্সা কি করে আছিস? রাফি হচ্ছে জুনিয়রদের ক্রাশ। আমি আর অর্ক একটু কম আরকি।
রাফি শুভকে আবারও মাথায় একটা লাগিয়ে বলে,
“তাই জন্যই তো আমি এখনও সিংগেল আর তুই চুটিয়ে প্রেম করছিস। খুব ভালো তো।”
“তুই মেয়েদের পাত্তা দেস না তো ওরা সুযোগ পাবে কেমনে? অর্ককে দেখ। জুনিয়র একটা ওর পিছে ঘুরে আর ও সেটারেই বারবার ‘আপু আপু’ বলে!
অর্ক ভাব নিয়ে বলে,
“আমার দরকার নাই ডাক্তার গার্লফ্রেন্ড বা বউ। আমি সাধারণ মেয়ে বিয়ে করমু। এদিকে বাসায় আম্মা বলতেছে, বিয়ে ঠিক করে রাখছে। বারবার বলতাছে ঢাকা ফিরতে।”
মাশরিফ হেসে বলে,
“করে ফেল তবে। সবার আগে তুই বিয়ে করে অভিজ্ঞতা জানা। সবার শেষে মনে হয় আমার বিয়ে দিবে।”
হঠাৎ শুভ বলে,
“এই মাশরিফ, তোর পিছে যে ঘুরে ওই মেয়েটার কী খবর? কী যেনো ক দিয়া নাম।”
রাফি ব্যাঙ্গ করে বলে,
“মাশু বেবি আমাকে কাশু বলবা হ্যাঁ?”
মাশরিফ রাফির কথায় চটে গিয়ে দু-য়েক ঘা লাগিয়ে বলে,
“ভাবতেছি এবার মাকে বলব, চলো তোমার কোয়াটারেই থেকে যাই। কয়দিনের জন্য আবার বাড়িতে যাওয়ার দরকার কী?”
“এতো বিরক্ত লাগলে কা’নের নিচে দুইটা লাগাবি। দেখবি সোজা হয়ে গেছে।”
রাফির বুদ্ধিতে মাশরিফ হতাশ হলো। ওই মেয়ের ন্যাকমির জন্য সত্যি বিরক্ত সে। ফোনের রিংটোনে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে মা কল করেছে। মাশরিফ বলল,
“আচ্ছা থাক তবে। আবার কাল আসব। আজ যাই। মা এবার রেগেই যাবে।”
মাশরিফ নিজের জিপে উঠে সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়।
__________
হোস্টেলের ভিতর ফিরে তিতির দেখে লিরা ও জুলিয়া দুজনেই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। তিতির জলদি করে ওজু করে নামাজটা পড়ে নেয়। তারপর জুলিয়াকে জিজ্ঞেসা করে,
“হাউ ইউ ফিলিং নাউ?
“ইয়াহ ফাইন। থ্যাংকিউ ফর আস্কিং। রেন্ট পেলে?”
জুলিয়াকে তিতির জবাব দেয়,
“না। কাল আবার বেরোব।”
“ওখেই। ডোন্ট ওয়ারি। পড়টে বসো এখন।”
তিতিরও বই নিয়ে বসলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,