এখানে সুখ ছোঁয়া যায় পর্ব-০৩

0
120

‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ (পর্ব-৩)

ঠিক করা হলো বড় চাচা আর বড় মা তথা আলতাফ চৌধূরী ও সালমা কায়সারের বিয়ের ছোট খাটো অনুষ্ঠান করা হবে আগামীকাল। আলতাফ চৌধূরী ল’জ্জা আর সংকোচে পরিবারের কারো সাথে ঠিক মতো কথা বলতে পারছেন না। নিজ রুমে বসে আছেন সেই কখন থেকে বই হাতে। রিনিঝিনি এসে বার কয়েক ডাকলেও আসেনি। আসবে কীভাবে! অন্যান্য দের থেকেও তার সবচেয়ে বেশি ল’জ্জা লাগছে রিনিঝিনি, তাহমীদ, ঈশান, ঊষান, রিতি, তাইফকে ফেস করতে। আচ্ছা! এই ছোট বাচ্চা গুলোর চোখে তিনি কি খুব ছোট হয়ে গেছেন?

সালমা কায়সার নতুন শাশুড়ির পাশে বসে আছেন। তার বুকের ভেতর গুড়গুড় করছে। শাশুড়ি মাকে যে ভীষণ ভ’য় পাচ্ছেন তা তার চেহারায় স্পষ্ট। শাশুড়িও পারেন একটু নরম হতে কিন্তু তিনি তো সেটা করবেন না। তাই আর কী! একটা নিরব পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। এক পর্যায়ে আশুরা খাতুন বললেন বড় বউ মাকে রুমে নিয়ে যেতে। রিনিঝিনির মা আর তাইফের মা আদেশ পেতেই দ্রুত তা পালন করলেন।

সন্ধ্যায় দেখা গেল বিয়ের খবর পেয়ে আত্মীয় স্বজন এসে ভরে গেছে সারা বাড়ি। এত মানুষ দেখে রুমঝুম বেচারি মহা চিন্তায় পড়ে গেল। ইশ! এত গুলো মানুষ তো আর এই রাত করে ফিরবে না। তারা রাতে থাকবে কোথায়? বাড়ির সদস্যই কম নয়। তারউপর সেও একটা রুম দখল দিয়ে রেখেছে। কেমন একটা ল’জ্জা আর অস্ব’স্তিতে সে গাঁট হয়ে গেল। নিজেকে একটা আগাছা মনে হতে লাগল। মন ম’রা হয়ে সে বাইরে লনে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণ পর সেখানে ঈশান এলো। রুমঝুমকে বসে থাকতে দেখে বলল,

-‘মিস! আপনি বাহিরে যে?’

কি বলবে বুঝতে পারল না রুমঝুম। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল। ঈশান কোনো উত্তর না পেয়ে ভেতরে চলে গেল। রুমঝুম ভাবল রা’গ করল হয়তো। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে দুটো কফির মগ হাতে এগিয়ে এসে রুমঝুমের পাশেই বসল। রুমঝুম উঠে যেতে নিলেই অনুনয়ের স্বরে বলল সে,

-‘উঠবেন না প্লিজ। আপনার সাথে একটু গল্প করব বলেই নিজ হাতে কফি বানিয়ে এনেছি। প্লিজ এই ছোট্ট ট্রিট টা গ্রহণ করুন।’

রুমঝুম বসল। কফি সে খায় না। কড়া লিকারের দুধ চা তার প্রিয়। তবে ভদ্রতা করে কফিটা নিলো। এক চুমুক দিয়ে দেখল ভীষণ ভালো খেতে। নিশ্চয়ই কোনো ভালো ব্র্যান্ডের কফি পাউডার আর দুধ দিয়ে তৈরি করেছে।

-‘আপনি নতুন জয়েন করছেন তাই না?’

রুমঝুম সম্মতি জানায় মাথা নেড়ে। ঈশান বলে,

-‘আমরা তাহলে সেইম এইজ হবো। আমিও পড়াশোনা শেষে এখন মাত্র চাকরীতে ঢুকলাম। আপনারও নিশ্চয়ই তেমন! আপনি অবশ্য আমার ছোটও হতে পারেন। সেই হিসেবে আমি তুমিও বলতে পারি যদিও।’

রুমঝুম ঠোঁট টিপে অন্যদিকে তাকালো। আশ্চর্য! তাকে এতই ছোট লাগছে? নিজেকে ছোট লাগছে তা সে মানতে পারে না। তাই ফট করেই বলে দেয়,

-‘আমার ঊনত্রিশ চলছে।’

ঈশানের মুখ থেকে কফি ছিটকে পড়ল। কি বলছে! ভাইয়ের বয়সী! সে তো ভেবেছে সদ্য অনার্স শেষ করা মেয়ে। বড় জোর বয়সটা চব্বিশ হবে! তাই বলে এত!

রুমঝুম তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। সে মাথা নিচু করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর কথা বলল।

-‘আমি সাতাশে পা দিয়েছি কিছুদিন আগে মিস। তবে তো আপনিই সিনিয়র। যাই হোক! আজকাল বয়সটা ম্যাটার করে না। আর আমার কাছে তো একেবারেই না।’

রুমঝুম বুঝতে পারছে না ছেলেটা বলতে চাইছে কী আসলে! একটু পর ঈশানের কল আসায় সে সরি বলে অন্যপাশে চলে যেতেই রুমঝুম বসা থেকে উঠে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। আর তখন একটা গাড়ি গেইট দিয়ে প্রবেশ করে। গাড়ির হেড লাইটের আলো তার উপর পড়তেই চোখ মুখ কঁচকে ফেলে সে। একটু পর আলো নিভে। তাহমীদকেও গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায়। রুমঝুম তাকে দেখে তড়িগড়ি করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। মাঝ পথে তাকে বাঁধা দেয় এক ভদ্র মহিলা। মহিলাটি কিছুক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

-‘এই! তুমি তাহমীদের বউ?’

রুমঝুম তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ে। সে তাহমীদের বউ এটা মহিলার মনে হলো কেন?

-‘তাহলে কার বউ?’

-‘কারো বউ না। উনি আমাদের অতিথি।’

রিনিঝিনি এসে দাঁড়ায় রুমঝুমের পাশে। মহিলা রিনিঝিনিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

-‘আমি আরো ভাবলাম এটা তাহমীদের বউ।’

রিনিঝিনি হাসল। হাসতে হাসতেই বলল,

-‘কি যে বলেন আন্টি! ভাইয়া আবার কবে বিয়ে করল?’

-‘সেটা আমরা কীভাবে বলি বলো! তোমাদের তো বিয়ের খবর লু’কা’নোর অভ্যাস আছে। তা এত বড় বংশের মানুষ হয়ে এসব করো কেন তোমরা? ভাইসাব বিয়ে করলেন আর আমাদের একবারও জানালে না! এসব কোনো ভাবেই মানা যায় না।’

রুমঝুম বুঝল কিছু খালা চাচী থাকেন না সব কিছুতে দো’ষ খুঁজবে। এই মহিলা তেমনই একজন। সে রিনিঝিনিকে বলে তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে এসে দেখল দুইটা বাচ্চা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। তার খুব ক্লান্ত লাগছিল। সে একটু ঘুমাতে চেয়েছিল তবে তা তো এখন আর হওয়ার নয়। তাই অন্য উপায় না পেয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা নিয়ে রুম থেকে বের হয়।

করিডোর এ আসতেই সে দেখল তার বিপরীত দিক থেকে তাহমীদ আসছে। হঠাৎ দুই তিনটা লোক বড় হাড়ি নিয়ে সেখান দিয়ে যেতেই তাদের জায়গা দিতে রুমঝুম একটু সরে দাঁড়ায়। ততক্ষণে তাহমীদ আরো কাছে চলে আসে। রুমঝুম সামনে যাওয়ার জন্য পা ফেলতে নিলেই অনুভব করে পিচ্ছিল কিছুতে পা পড়েছে তার। হয়তো ওই হাড়ি থেকেই পড়েছে। যার ফলে তাৎক্ষণিক পা পিছলে সে পড়ে যেতে নেয় কিন্তু পড়ে না। কেননা তাহমীদ এগিয়ে এসে তার হাত ধরে তাকে পড়ে যাওয়া থেকে র’ক্ষা করে। তাহমীদের সামনে নিজের এমন করুন দশা হওয়ায় রুমঝুম বেশ ল’জ্জায় পড়ে যায়‌। কি একটা বি’শ্রী ঘটনা ঘটে যেত আর একটু হলেই তা ভাবতেই কেমন যেন লাগে। তাড়াতাড়ি করে তাহমীদের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিজেকে সামলে চলে আসতে নিলেই শুনতে পায় পেছন থেকে তাহমীদ বলছে,

-‘হুট হাট যেখানে সেখানে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার অভ্যাস তোমার বুঝি গেল না!’

এমন কথা শুনে রুমঝুম তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরে দেখল ঠোঁট টিপে তাহমীদ হাসছে। এমা! ছেলেটা তাকে চিনে ফেলল?

__________________________

অনিরুদ্ধ চৌধূরীর বাড়ির গেইটের সামনে এসে দাঁড়াতেই রিন্টু বলল,

-‘কে আপনে!’

অনিরুদ্ধ একটু ভাবুক হয়ে পড়ল। কি বলবে? আসলে সে ভাবছে যে তার কোন পরিচয়টা দিবে বা কোন পরিচয়টা দেওয়া ঠিক হবে? এমনিতে আসল পরিচয় না দেওয়ার মতোও তো তেমন কিছু নেই। সে হাত ঘড়িতে একবার সময়টা দেখে নিলো। আটটা বাজে। মায়ের ঔষধ নেওয়ার সময় হয়েছে। এই তো, কয়েক মুহূর্ত আগেই মায়ের রুমে গিয়ে সে দেখে ঔষধের বাক্সটা মা ফেলেই এসেছেন। অর্থাৎ দুই বেলা ঔষধ ছাড়া আছেন। দরকারের কথা তো কোনো দিন কাউকে মুখ ফুঁটে বলেন না। আজও তেমনই করবেন হয়তো। তাই নিজেই এলো ঔষধের বাক্স নিয়ে। ভালো থাকতে হলে নতুন সংসারের সাথে তার এগুলোরও তো প্রয়োজন।

-‘আমি বেগম সালমা কায়সারের সাথে দেখা করতে এসেছি।’

-‘ওই নামে কেহ থাহে না এইহানে। আপনে ভুল ঠিকানায় আইসা পড়ছেন।’

-‘না আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি। আপনি প্লিজ গেইটটা খুলুন। আমার ভেতরে যাওয়ার দরকার।’

-‘কইলেই হইল! দিমু না। যান এইখান থেইকা!’
_______________________________________

রিনিঝিনি চা তৈরি করছিল। তখন কোথা থেকে জরিনা এসে তাকে খবর দিলো,

-‘আফা! এক পোলায় গেটের কাছে আইয়া খুব গমডোগোল করতেছে।’

-‘আহহা! কতবার বলব কথাটা গমডোগোল না গণ্ডগোল।’

-‘একি তো।’

-‘না এক না।’

জরিনা মুখ বাঁকা করল। যেন সে খুব বি’র’ক্ত হয়েছে রিনিঝিনির উপর। কাপে চা ঢালতে ঢালতে রিনিঝিনি বলল,

-‘গণ্ডগোলটা কি সেটা তো বললি না।’

-‘একজনরে চাইতেছে। সালমা নামের। এই বাড়িতে এই নামে কেউ থাহে না কতবার কইলাম হে আমগো কতা হুনেই না। আপনে চলেন। আপনের কতা হুনবো।’

রিনিঝিনির মনে পড়ল। সালমা নামের মানুষটি বাড়ির নতুন সদস্য। বড় মা! হায় হায়! এরা বড় মায়ের মেহমানকে গেইটে আটকে রেখেছে! সে চায়ের কাপ ফেলে হুড়মুড় করে বাইরে বের হলো। গেইটের কাছে আসতেই দেখল টি শার্ট আর ট্রাউজার পরিহিত এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। চশমা চোখের, শক্ত চোয়ালের যুবকটাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য রিনিঝিনির কিছু একটা হয়ে গেল। ভেতরটা কি নড়ল? কে জানে!

#চলবে।